মধুচন্দ্রিমা,পর্ব ৫,০৬

0
786

মধুচন্দ্রিমা
পর্ব ৫,০৬
তানিয়া রহমান
০৫

ইরিন ঘড়ে ঢুকে দেখলো সত্যি সত্যিই বেড অলকানন্দা দিয়ে সাজানো হয়েছে। ক্যান্ডেলের আলো এলোমেলো হয়ে ঢেউ খেলছে।বহুদিন পর ইরিনের মনটা ভালো লাগায় ভরে গেল।
অপু বলল- আন্টি তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও
-তুমি সাজিয়েছো রুম
– হু
-সুন্দর!
– থ্যাংকস্,অনেক রাত হয়েছে তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও,আমি ওদিকটা দেখছি

রাত তিনটা
মেহবুবের কাজিনরা প্রায় সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে,অপু ডাইনিঙে পানি খেতে এসে দেখলো স্টাডি রুমে আলো জ্বলছে। গুটিগুটি পায়ে এসে স্টাডি রুমের পর্দা সরিয়ে দেখতে পেল মেহবুব টেবিলের উপর মাথা রেখে চেয়ারে বসে আছে।বাবাকে এমন দেখে অপুর বুকের ভিতর হু হু করে উঠলো। মেহবুবের কাছে এসে আস্তে করে বলল – বাবা
মেহবুব মাথা তুলে অপুকে দেখে বলল- এখনো ঘুমাওনি
– তুমিওতো জেগে আছ
– আমার কাজ আছে, যাও শুয়ে পরো
– রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে, চলতো ঘুমাবে
অপুর জোরাজোরিতে মেহবুব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, ইরিনের রুমের সামনে এসে বলল- তোমার আন্টি বোধহয় ঘুমিয়ে গিয়েছে ডিস্টার্ব না করাই ভালো
অপু বুঝতে পারলো বাবা লজ্জা পাচ্ছে,দরজা খুলে বলল- ভিতরে যাওতো আন্টি ওয়েট করছে

ঘড়ে ঢুকে মেহবুব রীতিমতো ভীমড়ি খেল,কি সুন্দর করে বাসর সাজিয়েছে তার মেয়ে। বেডে ইরিনকে দেখতে না পেয়ে আশেপাশে তাকালো। সোফায় এক কোন ঘেঁষে বসে আছে ইরিন।
মেহবুব বলল- এখনো জেগে আছেন কোন সমস্যা
– আপনার জন্য অপেক্ষা করছি
– কিছু বলবেন
– না
ইরিন লাগেজ থেকে মেরুন রঙের নাইটি নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে গেল। হট শাওয়ার নেয়াতে সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে গিয়েছে, টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে দেখলো মেহবুব সোফায় বালিশ নিয়ে পা কুচকিয়ে শুয়ে আছে।
মেহবুবের মুখের দিকে তাকিয়ে ইরিনের মনে হল কি সহজ সরল অথচ কঠিন একটা মানুষ।
– এখানে শুয়েছেন কেন
মেহবুবের চোখ প্রায় লেগে এসেছিল, ইরিনের কথায় ধরমর করে উঠে বসে বলল- আমার রুমে ফুফুআম্মা শুয়েছে তাছাড়া বাসায় অনেক গেস্ট আলাদা রুমে ঘুমালে ব্যাপারটা কেমন হয়ে যায় না!
– ওকে!ওখান থেকে উঠুন
– কোথায় শুবো ফ্লোরে?
– কি আজেবাজে কথা বলছেন, বেডে শোন
– আপনি
– আমিও বেডে শুবো
মেহবুব আমতা আমতা করে বলল – মনির জানতে পারলে কি ভাববে
ইরিন মেহবুবের কাছে এসে চোখেচোখ রেখে বলল- আপনার বন্ধু কি ভাবলো না ভাবলো তাতে আমার কিচ্ছু এসে যায় না, আপনার বন্ধুর সঙ্গে আমার চ্যাপ্টার অনেক আগেই ক্লোজ হয়ে গিয়েছে, আমি আপনার ওয়াইফ আমার সম্মান কিভাবে আপনি রক্ষা করবেন এটা আপনার দায়িত্ব, নুন্যতম বোধ থাকলে নিজের ওয়াইফকে বন্ধুর দিকে ঠেলে দিবেন না
ইরিনের কথা মেহবুবের মাথার উপর দিয়ে গেল,মনে মনে বলল ” এমনতো হবার কথা ছিল না। এ মেয়ে কি তার প্রেমে পরেছে?কিন্তু ওর চাইতে মনির বহুগুণ সুন্দর।
ইরিন আবার বলল – কি ভাবছেন, ঘুমাতে আসুন
মেহবুব ঘোর নিয়ে ইরিনের পাশে শুয়ে পরলো।
ইরিন চোখ বন্ধ করে মেহবুবের দিকে ফিরে মটকা মেরে পরে রইল।ছোট বেলা থেকে এই জেগে ঘুমানোর খেলাটা সে খুব ভাল পারে।
মেহবুব ঘন্টা খানিক পর ইরিনের দিকে পাশ ফিরলো।ইরিনের মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবলো সব মায়া কি শুধু তোমার মুখেই দিয়েছে সৃষ্টিকর্তা!
বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ার খুলে রিঙের বক্স থেকে রিং বের করে হাতে নিল,তারপর ধীরে ধীরে ইরিনের অনামিকায় পরিয়ে দিল।
ইরিন বুঝতে পারলো কিন্তু মেহবুবকে বুঝতে দিল না।
মেহবুবের ঘুম ভাঙলো মিলার ডাকে।পিটপিট করে চোখ মেলে দেখলো ইরিনকে জরিয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। চারশো ভোল্টেজের শক খেয়ে ছিটকে পরলো বেডের পাশে। মনে মনে ভাবলো “ভাগ্য ভাল ঘুম আমারই আগে ভেঙ্গেছে। ”
মিলার ভাইয়া ভাইয়া ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেল।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সকাল সারে এগারোটা, নিজেকে নিজে গালি দিতে দিতে বলল “বাসা ভর্তি গেস্ট আর আমি কিনা বুড়ো বয়সে বউ নিয়ে ঘুমিয়ে আছি এত বেলা অব্দি। ”
কিছুটা লজ্জা নিয়ে দরজা খুলে বলল- কি হয়েছে চিৎকার করছিস কেন
– চিৎকার করছি মানে কয়টা বাজে জান?ফুফুআম্মা ডাকছে তোমাদের
– তুই যা আসছি
– ভাবী কই
মেহবুব বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলো ইরিন এখনো ঘুমাচ্ছে, নাইটিটা উঠে হাঁটুর কাছাকাছি চলে এসেছে, ফর্সা পায়ে একজোড়া পায়েল চিকচিক করছে। মেহবুব চোখ সরিয়ে বলল- ঘুমুচ্ছে
– সর আমি ডাকছি
মেহবুব সাইড হয়ে মিলাকে প্রবেশের জায়গা করে দিয়ে বলল – ওকে শাড়ী পরতে বলিস
– কস্টিউমসের উপরও অধিকার খাটাবে?
মিলার কথা অগ্রাহ্য করে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল মেহবুব।
চলবে

মধুচন্দ্রিমা
পর্ব ৬
তানিয়া রহমান

মিলা আর ফুফুআম্মা এত যত্ন নিয়ে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করছে যা দেখে মেহবুবের এক সময় মনে হলো নিজেই নিজের ঘড়ের গেস্ট।আর চোখে ইরিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো সবুজ শাড়ীতে পরী পরী লাগছে।অস্ফুট ভাবে বলল “এ মেয়ে এত সুন্দর কেন ”

মিলা জুসের গ্লাসটা ইরিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল – খাচ্ছ না কেন ভাবী
ইরিন স্মিথ হাসলো
মেহবুবের বড় ফুফুআম্মা আমেনা বেগম তীর্যক দৃষ্টি নিয়ে ইরিনকে দেখে বলল- তোমার নাম কি
– ইরিন
– কত বছরের সংসার ছিল তোমার আগের স্বামীর সাথে
ইরিন মেহবুবের দিকে তাকালো। মেহবুব বলল- এসব কি ধরনের প্রশ্ন
আমেনা বেগম রেগে বলল- তুই চুপ কর,হুট করে বিয়ে করে নিলি যাচাই বাছাই করার সুযোগ পর্যন্ত দিলি না
ইরিন অভিমানের সুরে বলল- উনত্রিশ বছর
আমেনা বেগম তাচ্ছিল্য নিয়ে বলল – কি অপরাধ করেছিলে এত বছরের সংসার ভেঙ্গে গেল
মেহবুব আর নিতে পরলো না, চেচিয়ে অপুকে ডাকতে লাগলো – অপু!অপু!
অপু তার এত বছরের জীবনে বাবাকে এমন উঁচু স্বরে কথা বলতে দেখেনি।দৌড়ে এসে বলল- বাবা ডাকছো
মেহবুব মুখে কাঠিন্য এনে বলল- ফুফুআম্মাকে মেলবোর্নে কল ধরিয়ে দাও,বড়আপা কথা বলতে চেয়েছিলে গতকাল
– কাল কথা বলতে চেয়েছিলে আর আজ বলছিস আমেনা বেগম বলল
– তুমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলে
অপু বাবার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করে বলল – কিন্তু বাবা
– কোন কিন্তু নয় আমি যা বলছি তাই কর
অপু আমেনা বেগমকে নিয়ে নিজের রুমে চলে এল।
ইরিন হাফ ছেড়ে বাঁচল। এতক্ষণ তার মনে হয়েছিল সে ডাইনিঙে নয় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। মেহবুব ইরিনের দিকে অসহায় দৃষ্টি নিয়ে বলল – স্যরি
– ইটস ওকে

দুপুরে লাঞ্চ করে মিলা আর আমেনা বেগম চলে গেল। মেহবুব নিজের রুমে রেস্ট নিচ্ছল, ইরিন দরজায় দাঁড়িয়ে নক্ করলো। মেহবুব দরজা খুলে বলল- ওহ্ আপনি, আসুন
– আসব না
– তাহলে
– গেস্টতো চলে গিয়েছে চেঞ্জ করে কামিজ পরতে পারি
মেহবুব মাথা চুলকে বলল- শাড়ীতে কি সমস্যা
– শাড়ী পরে অভ্যেস নেই তারউপর এত ভারী শাড়ী
মেহবুবের মনে হলো “তাইতো এই গরমে প্রায় সারাটি দিন মেয়টা কাতান পরে আছে এটা তার বোঝা উচিৎ ছিল। ”
মেহবুবকে চুপ থাকতে দেখে ইরিন আবার বলল – সুতি শাড়ী আনা হয়নি কাল বাসায় যেয়ে নিয়ে আসব
– আপনি ঘন্টা খানিক ওয়েট করুন আমি আসছি
ওয়ালেট প্যান্টের পকেটে গুঁজে বেরিয়ে গেল।

আধ ঘন্টা পর
আম্বিয়া দরজা খুলে দেখলো ঋতুর বোন সেতু এসেছে। ঘড়ে ঢুকতে ঢুকতে সেতু বলল- দুলাভাই নাকি বিয়ে করেছে
– জ্বে আম্মা
– বউ দেখতে কেমন
আম্বিয়া হাসি হাসি মুখ করে বলল – এক্কেরে পুতুলের নাহাল
– তোমাদের ঐ পুতুল কই, আপার রুমে
– জ্বে না, গেস্ট রুমে
সেতুর মনে কিছুটা শান্তি এল।
অপু এসে সেতুকে জরিয়ে ধরে বলল- খালামনি! কেমন আছ
– কেমন আর থাকবো বল্ এই বুড়ো বয়সে তোর বাবা আবার বিয়ে করলো যখানে তোরই বিয়ের বয়স। আসলে পুরুষ মানুষের ছোক ছোক স্বভাব কখনো যায় না
– কি সব বলছো,তাছাড়া বাবা লোনলি হয়ে গিয়েছিল।
– তুইতো তোর বাবার সাত খুনও মাফ করবি,চল্ নতুন বউ দেখি
ইরিন বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল, কাল থেকে রেস্টলেস,মাথাটা জ্যাম হয়ে আছে। অপু দরজায় নক্ করে বলল – আন্টি আসব
ইরিন শোয়া থেকে উঠে বসে বলল- এস
ঘড়ে ঢুকে সেতু ইরিনকে দেখে চমকাল।এই মেয়েতো সাক্ষাৎ পরী।তার বোন ছিল উজ্জ্বল শ্যামলা আর এই মেয়ের গায়েতো হলুদ ছড়ানো।
সেতু তার আপার সংসারে নতুন কারো আধিপত্য মেনে নিতে পারছে না। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল – এরকম কাতান পরে সঙ সেজে আছেন কেন
ইরিন সেতুর কথায় অপ্রস্তুত হয়ে গেল। একদম অচেনা একজন মানুষ এরকম বিশ্রী করে কিভাবে কথা বলতে পারে
ইরিন আমতা আমতা করে বলল – না মানে সুতি শাড়ী আনা হয়নি
– দুলাভাইকে কিভাবে ভুলালেন ঐ রুপ দিয়ে
অপুর এবার আর সহ্য হলো না, রাগ হয়ে বলল- তোমারা পেয়েছোটাকি শুনি সকাল বেলা দাদু শোনালো এখন আবার তুমি শোনাচ্ছ, সমস্যা কি তোমাদের
– শুনিয়েছি বেশ করেছি

মেহবুব দু’হাতে শপিং ব্যাগ নিয়ে ইরিনের ঘড়ে ঢুকলো, সেতুর দিকে তাকিয়ে বলল – কি অবস্থা? কখন এসেছো
সেতু মেহবুবের কথার জবাব না দিয়ে বলল – দুলাভাই কাজটা কি ঠিক করলেন
– কোন কাজ
– এই বয়সে এসে বিয়ে করে নিলেন
মেহবুব হাসতে হাসতে বলল- বিয়েইতো করেছি লিভ টুগেদারতো করছি না
ইরিনের হাতে শপিং ব্যাগ দিয়ে আস্তে করে বলল – সুতি শাড়ী আছে চেঞ্জ করে ডাইনিঙে আসুন।
তারপর মেহবুব সেতুকে বলল- চল শালিকা চা কফি খেয়ে মাথা ঠান্ডা করো

কফিতে চুমুক দিয়ে সেতু বলল- একটা কাজ ভাল করেছেন
মেহবুব সরু চোখে তাকিয়ে পিন্চ করে বলল – আমি তাহলে ভালো কাজো করি
– আপার ঘড়টাযে ঐ মেয়েকে দেননি এটা ভাল লাগছে
– নিজেকে যখন দিয়ে দিয়েছি তখন রুমে কি এসে যায়
– এত বড় মেয়ের সামনে বাসর ঘড় সাজিয়ে বাসর করেছেন আপনার বোধ বুদ্ধি এতটা লোপ পাবে ভাবিনি
– বিয়ে করতে যখন লজ্জা পাইনি বাসর করতে সমস্যা কোথায়

বেগুনি রঙের শাড়ীর সাথে লাল রঙের স্লিভলেস ব্লাউজ পরে ডাইনিঙে এল।ভেজা চুলে স্নিগ্ধতায় ভরে গেছে ও মুখ আর লাল ব্লাউজটা তার হলুদ রাঙা শরীরে সূর্যের মতো আভা ছড়াচ্ছে।
মেহবুবের চোখে নেশা ধরে গেল , সেতু মেহবুবের দিকে একবার তাকিয়ে ইরিনকে বলল- এতটা খোলামেলা পোশাক পরে কোন পুরুষের সামনে না আসাই ভাল
ইরিন সেতুর কথা শুনে থমকে দাড়ঁলো, মেহবুবের চোখে চোখ রেখে বলল- আমি রুমে যাচ্ছি
– মেহবুব সেতুর দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল – কার সঙ্গে কেমন বিহেভ করতে হয় আজও শিখলে না
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here