স্ত্রী পর্বঃ ১২
এক সাথে দুই পর্ব
লেখিকা ঃতাওহীদা
মায়ের রুমে খাটের উপর মায়ের শাড়ীটা আকড়ে ধরে চুপ করে বসে আছে রায়ান।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, তার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে জিনাত।ভাবছে,,একটা ছেলে তার মাকে কতটা ভালোবাসতে পারে!আজকালকার যুগে বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরা বড়ো হলে বাবা মায়ের থেকে দূরে সরে যায়,,বাবা-মায়ের আদর,ভালোবাসা,শাসন তখন অসহ্য মনে হয় তাদের।আর সেখানে মায়ের প্রতি ওনার এমন ভালোবাসা সত্যিই সচারাচর দেখা যায় না,,যে কিনা মায়ের জন্য সব করতে পারে!
আজ দুই সপ্তাহ হলো,,রায়ানের মা মারা গিয়েছে। মায়ের মৃত্যুতে একেবারে ভেঙে পরেছে ছেলেটা।এই কদিনে তো নাওয়া,,খাওয়া,,ঘুম তো ভুলেই গিয়েছে।সারাটা দিন মায়ের কবরের পাশে বসে থাকে।আর রাতে মায়ের রুমে মায়ের শাড়ীটা বুকে নিয়ে বসে থাকে।
জিনাতের খুব মায়া লাগছে রায়ানের জন্য।মানুষটাকে এতটা ভেঙে পরতে দেখে একটুও ভালো লাগছে না তার।জিনাত নিজেও জানে না,,কেনো ওর এমন কষ্ট হচ্ছে রায়ানের জন্য। ও তো সবসময় এটাক চাইতো রায়ান কষ্ট পাক,দুঃখ পাক।তবে আজ যখন সে সীমাহীন কষ্ট পাচ্ছে,,তবে তখন কেনো তা সহ্য হচ্ছে না জিনাতের!
রায়ানের মায়ের মৃত্যুর ৩ দিন পরে জিনাতের বাবা জিনাতকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছিলো। কিন্তু জিনাত যায়নি,, কারন ওর শ্বাশুড়ির বলে যাওয়া শেষ কথাটাই তার মনে হচ্ছিলো।তাছাড়া এই বাড়ি, সংসার,আর রায়ানকেও এই দুঃসময়ে ছেড়ে যেতে মন সায় দিচ্ছিলো না।তাই জিনাত ওর বাবাকে বলেছিলো, বাবা,একটা মানুষকে এই অবস্থায় ফেলে আমি কিভাবে যাই,,,আমি এখন কিছুতেই এখান থেকে যেতে পারবো না।তুমি ফিরে যাও।সময় হলে আমিও ফিরে আসবো।
কিন্তু সেইদিন জিনাতের মা ভিন্ন কথা বলেছিল।সে রায়ানের সম্পর্কে আগেই খোজ খবর নিয়েছিল।আর রায়ানের ব্যাপারে জেনেই সে বুঝেছিলো,রায়ানকে তার স্বামী আর মেয়ে চিনতে ভুল করেছে।সে তার স্বামীকে অনেক বুঝাতে চেয়েছে,,কিন্তু জিনাতের বাবা রাস্তায় রায়ানকে মারামারি করতে দেখে আর তার মেয়েকে জোর করে বিয়ে করার জন্য, রায়ানের ব্যাপারে আর কিছু শুনতেই চায় না।আর সে কঠোরভাবে জিনাতের মাকে বলে দিয়েছে,,যাতে মেয়েকে রায়ানের ব্যাপারে কিছু না বোঝায়।আর জিনাতো এই দুমাসে আর বাসায় আসতে পারেনি।তাই ওর মা ওকে কিছু আর বুঝিয়ে বলতেও পারেনি।কিন্তু রায়ানের মায়ের মৃত্যুর পরে সেদিন সে এবাড়িতে আসে আর মেয়েকে বলে,,,,
মারে,,, তোর বাবার কথা শুনে,, নিজের স্বামী সংসার ছাড়িস না।নিজের জীবনটা অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিস না।নিজের জন্য না হোক,,তোর অনাগত সন্তানের কথা ভেবে হলেও তুই রায়ানকে ক্ষমা করে দে।ভুলে যাস না,,শত হলেও তুই রায়ানের আল্লাহর কালাম সাক্ষী করা স্ত্রী!
হঠাৎই ঢুকরে কেদে ওঠে রায়ান।মায়ের শাড়িটায় মুখ গুজে ফোপাঁতে থাকে সে।কান্নার শব্দে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা জিনাতের চিন্তার ধ্যান ভাঙে।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রায়ানের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে।
-শুনছেন,,আর কতোক্ষন এভাবে বসে থাকবেন।সেই সকাল থেকে না খেয়ে আছেন।এবার একটু উঠুন,,কিছু মুখে দেন।(নরম গলায় বললো জিনাত)
কিছু বললো না রায়ান,,উঠলোও না,,ওভাবেই বসে রইলো।কথা বলার ইচ্ছে টাই যেন হারিয়ে ফেলেছে সে।
-দেখুন এভাবে দিনের পর দিন না খেয়ে থেকে কি কোনো লাভ হবে? বরং খেয়ে দেয়ে সুস্থ থেকে বেশি বেশি আমল করে মায়ের জন্য দোয়া করুন।সেটা আল্লাহর হুকুমে আপনার মাকে কবরে শান্তি দেবে।এভাবে বসে বসে না কেদে,,, জায়নামা্যে দুই হাত তুলে মায়ের মাগফিরাত এর জন্য আল্লাহর কাছে কাদুন।এতে লাভ হবে।এবার উঠুন,,উঠুন তো,,,, (রায়ানের হাত ধরে টানলো জিনাত)
রায়ান কিছু না বলে আস্তে উঠে দাড়ালো।জিনাত রায়ানের হাত ধরে ডায়নিং টেবিলে নিয়ে আসলো।তারপর ওকে বসিয়ে ওর প্লেটে খাবার বেড়ে দিলো।কিন্তু রায়ান হাত গুটিয়েই বসে রইলো। জিনাত দুইবার ওকে খেতে বললো।কিন্তু ও খেলো না।তাই জিনাত হাত ধুয়ে এসে ভাত মাখিয়ে ওর মুখের সামনে ধরলো।জিনাতের এই ব্যবহার রায়ানের চিন্তার বাইরে ছিলো।তাই জিনাত ভাতের লোকমা মুখের সামনে ধরতেই ছলছল চোখে জিনাতের দিকে তাকালো।ওর সেই তাকানোতে অজস্র আবেগ আর কষ্ট জড়িয়ে ছিলো।যা দেখে জিনাতের বুক টা হু হু করে উঠলো। কিন্তু জিনাত নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,,কি হলো,হা করুন!!
রায়ান খেতে শুরু করলো। আর জিনাতও চুপচাপ ওকে খাইয়ে দিতে লাগলো।
★★
রায়ান ওর মায়ের রুমের বেলকনির গ্রিল ধরে ওর মায়ের কবরের দিকে তাকিয়ে আছে। রায়ানের মাকে বাড়ির পেছনের অংশে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।ওই রুম থেকে সহজেই কবরস্থান দেখা যায়।তাই ওখানে দাঁড়িয়ে আছে ও।
-ঘুমাবেন না?
রায়ান হঠাৎ কথা শুনে চমকে গেলো।তাকিয়ে দেখলো জিনাত দাঁড়িয়ে আছে পাশে।একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,,,ঘুম আসছে না।
-মায়ের মৃত্যুর দুই সপ্তাহ পার হয়ে গিয়েছে।এখন অন্তত নিজেকে একটু সামলান।এভাবে নাওয়া,খাওয়া, ঘুম ছাড়ান দিয়ে কেউ বাচতে পারে? এতে মায়ের রুহু কি শান্তি পাচ্ছে?
-আমার আর আপন বলতে দুনিয়ায় কেউ রইলো না জিনাত।কার জন্য বাচবো আমি।
–এটা কেমন কথা! এই দুনিয়ায় কারো বাবা মাই চিরকাল থাকে না,,তো তাদের জীবন কি থেমে থাকে?
–তুমি বুঝবে না,, কতটা একা আর নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি আমি।আমার আপনজনদের চোখের সামনে শেষ হতে দেখেছি আমি।সেটা যে কতটা যন্ত্রনার তুমি তা অনুভব করতে পারবে না।
–আপনজনদের? ঠিক বুঝলাম না।
এই কথা শুনে রায়ান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলা শুরু করলো,,
–৮ বছর আগে,,,,,আমি তখন মাস্টার্স এর স্টুডেন্ট ছিলাম।বাবা বেচে ছিল তখন। বাবা,মা,আমি আর আমার ছোট্ট বোনটাকে নিয়ে খুব সুন্দর ছোট্ট একটা সংসার ছিলো আমাদের।তখন সবসময় হাসিখুশিতে ভরে থাকতো আমাদের এই ঘর।আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিলো আমার ছোটো বোন রুনু।ও আমার চেয়ে ছয় বছরের ছোটো ছিলো।কিন্তু আমরা দুইভাইবোন ছিলাম একে অন্যের বেস্ট ফ্রেন্ড।
বাবা ঠিকাদার ব্যাবসায়ী ছিল।ঠিকাদার ব্যাবসায়ী হিসেবে বাবার মোটামুটি নামডাক ছিল।কেননা বাবা সৎ ব্যাবসায়ী ছিলেন।ওনার কাজগুলো বেশ ভালো হতো বিধায়,,বরিশালের এক কমিশনার বাবাকে অনেক বড়ো একটা সরকারি কাজ পাইয়ে দেয়।এতে আরেক বড় ঠিকাদার ব্যাবসায়ী মানিক মির্জা বাবার উপর ক্ষুব্ধ হয়।মানিক মির্জা শুধু ঠিকাদার ব্যাবসায়ীই ছিলো না,,তখনকার কুখ্যাত সন্ত্রাসীও ছিলো সে,,,খুন,,, ধর্ষণ,, মাদক ব্যবসা সবি চালাতো সে।উপর মহলে হাত থাকায় এসব করে পার পেতো সে।বরিশালের বড় বড় সরকারি বেসরকারি কাজগুলো ঘুষ দিয়ে,ভয় দেখিয়ে নিজে নিয়ে নিতো।বাবা ওই কাজটা পাবার পরে সে বাবাকে বিভিন্ন ভাবে চাপ দেয় কাজটা না নেয়ার জন্য। কিন্তু বাবা তা শোনেন না নিজের কাজ চালিয়ে যান।আর ওইবার বাবার অনেক লাভ হয়।
এই কাজের পরে বাবা আরো দুটো বড়ো অংকের কাজ পায়।কিন্তু সেটা পাওয়ার পর হঠাৎ একদিন মানিক মির্জা আমাদের বাসায় আসে আর বাবাকে কঠোর ভাবে হুমকি দেয়,,,কাজদুটো ছেড়ে না দিলে,,আমাদের ক্ষতি করে ফেলবে,,, এমনকি বাবাকে মেরে ফেলারও ভয় দেখায়।
বাবা বেশ প্রতিবাদী মানুষ ছিলো।সে হুমকি শুনে থেমে থাকে নি।মায়ের শত বাধা দেয়া সত্ত্বেও মানিক মির্জার নামে থানায় মামলা করে।এতে মানিক মির্জা গ্রেফতার হয়। কিন্তু দুইদিন পরই জামিনে বের হয়ে আসে সে।
মানিক মির্জা বের হবার পরদিনই বাবা হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়।অনেক খোজাখুজির পরেও বাবার কোনো হদিস পাওয়া যায় নি।
(বলতে বলতে গলাটা ভারী হয়ে আসছে রায়ানের)
৩ দিন পরে ফরেস্ট অফিসের বাগানে ঝোপের মধ্যে বাবার অর্ধগলিত দেহটা পাওয়া যায়।(চলবে)
শেষ পর্ব
এইটুকু বলে চুপ হয়ে গেলো রায়ান চোখ থেকে টপটপ করে পানি পরছে।জিনাত হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
-বাবার শরীরে ২২ টা কোপের চিহ্ন ছিলো।এমন নির্মম ভাবে বাবাকে কে হত্যা করতে পারে,, তা আমরা ভালো করেই জানতাম।তাই সন্দেহ ভাজন হিসেবে মানিক মির্জার নামে মামলা করি।বাবার হত্যাকাণ্ড নিয়ে বরিশালে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।তাই পুলিশ সতর্কভাবে কেস টা হাতে নেয়।পুলিশের তদন্তে ঘটনার সত্যতার প্রমান পাওয়া যায়।এতে মানিক মির্জা গ্রেফতার হয়,,, এবং তার ফাসি হয়।
বাবার মৃত্যুতে পর মা আর রুনু খুব ভেঙে পড়ে।বিশেষ করে মাকে সামলাতে খুব কষ্ট হয়েছিলো আমার।কিন্তু তাও আমি শক্ত ছিলাম।ঘড় সামলানোর পাশাপাশি বাবার ব্যাবসার হালও আমাকেই ধরতে হয়েছিলো।কারন বাবা তার কাজের জন্য ব্যাংকের থেকে অনেক টাকা লোন নিয়েছিলো।এখন বাবার কাজ বন্ধ থাকলে সেই লোন পরিশোধ করা যাবে না।আমি অনেক আগে থেকেই পড়াশোনার ফাকে ফাকে বাবার সাথে সাইটে যেতাম।বাবার কাজে হেল্প করতাম।তাই কাজ সম্পর্কে ভালোই ধারণা ছিলো আমার।তাই এ ব্যাপারে সমস্যা হয় নি।
কিন্তু মানিক মির্জার ফাসি হলেও,,ও ছোটো ভাই রতন মির্জা, চাদাবাজী,আর মাদক ব্যাবসা চালিয়ে রেখেছিলো ওর ভাইয়ের চ্যালাপেলাদের নিয়ে।আমার বয়স তখন কম হওয়ায় ওরা বিভিন্ন সময়েই আমার কাজের সাইটে এসে বিপুল অংকের চাদা চাইতো। না দিতে চাইলে মেরে ফেলার হুমকি দিতো।প্রথম প্রথম দিতাম,,,কারন ঝামেলায় জড়াতে চাইছিলাম না।কিন্তু পরে দেখলাম,,যত দেই ততই তাদের ডিমান্ড বেড়ে যায়।তাই দেয়া বন্ধ করে দিলাম।এরপর চাদা চাইতে আসলে আমরাই হামকি ধামকি মেরে তাড়িয়ে দিলাম সাইট থেকে।কিন্তু তখনও বুঝি নি,,এর ফল এতো ভয়াবহ হবে।
আমার বোন টা সবে কলেজে উঠেছিলো তখন। ওই শকুনের দৃষ্টি পরে আমার ফুলের মতো বোনটার দিকে।
তারপর একদিন বোনটাও আমার হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়।পাগলের মতো লাগছিলো তখন,, মনে হচ্ছিলো এমন অথর্ব ভাই আমি,,আমার বোনটাকেও সামলে রাখতে পারলাম না(বলতে বলতে কান্নায় কথা জড়িয়ে যাচ্ছে রায়ানের)
অনেক খোজ করেছি,,ওই রতন মির্জার বাড়ি,আস্তানা সব খুজেছি,,কিন্তু পাইনি কোথাও আমার বোনটাকে।
২ দিন পরে বাড়ির সামনে রুনুর মৃত দেহটা পাই আমরা।জানো জিনাত ওই দৃশ্য দেখার পরে আজ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে দোয়া করি,,কোনো ভাইকে যেনো আল্লাহ তার বোনের অমন বীভৎস অবস্থা না দেখায়।
এই বলে কাদতে কাদতে মাটিতে বসে পরলো রায়ান।জিনাত হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।ওর মুখের সমস্ত ভাষাই যেনো হারিয়ে গিয়েছে।
–বুঝলাম,,, শক্ত হতে হবে।মাকে আর বাবার ব্যাবসা সামলাতে,,ব্যাংকের দেনা মেটাতে আমাকে শক্ত হতেই হবে।এই দুনিয়া শক্তের ভক্ত নরমের যম!আমার কয়েকজন ক্লোজ বন্ধু আর কিছু পরিচিত ছোট ভাইকে নিয়ে আমার দল বানিয়ে নিলাম।এরপর ,, ঝামেলা করা প্রত্যেকটাকে প্লাটা আঘাত শুরু করলাম।এরপর আর কেউ আমার সাইটগুলোতে চাদাবাজী বা গুন্ডাগিরি করার সাহস পায়নি।আমার দলের সবাই আমার সাথে সাইটের কাজ পরিচালনার কাজ করতো।একেকজন একেকটা কাজের দায়িত্বে ছিলো।অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে করতে একসময় আমিও অনেকের কাছে গুন্ডা মাস্তানে পরিনত হলাম,,যেমনটা হয়েছি তোমার আর তোমার বাবার কাছে!(জিনাতের দিকে তাকিয়ে বললো রায়ান)
এই কথা শুনে চোখ নামিয়ে নিলো জিনাত।খুব সংকোচ হচ্ছে ওর চোখের দিকে তাকাতে।
-বাবাকে হারিয়ে,বোনকে হারিয়ে মাকে নিয়ে বাচার স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি।কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস দেখো।৭ মাস আগেই জানতে পারি আমার মা টাও বেশিদিন থাকতে পারবে না আমার সাথে।আর দেখো সেই তো মাও চলে গেলো আমাকে ছেড়ে।
জিনাত নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে।আজ রায়ানের প্রতিটা কষ্ট যেনো ও নিজেই অনুভব করছে।
–তোমাকে একটা কথা বলি জিনাত!
জিনাত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর চোখের দিকে চাইলো,,,,
–আমি জানি,,আমি তোমার কাছে মহা অপরাধী।আমি তোমাকে জোর করে বিয়ে করেছি।রাগের মাথায় তোমার সাথে জোর করেছি।আসলে,, সেদিন চরিত্রহীন শব্দটা আমি নিতে পারছিলাম না তাই!!আর তখন আমার মাথায়,,তুমি আমার স্ত্রী!, এই কথাটাই কাজ করছিলো,,তাই নিজেকে সামলাতে পারি নি।
এইটুকু বলে রায়ান আবার চুপ হয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ পরে খপ করে জিনাতের হাতদুটো ধরে বললো,,,
–আমাকে আমার সন্তানটা দেবে জিনাত?আমার আপনজন সবাই তো মরে গিয়েছে।আমার সন্তানটাকে তুমি মেরে ফেলো না!
রায়ানের এই কথা শুনে জিনাতের বুকটা ধক করে উঠলো। কি বলছে রায়ান,,ও নিজের সন্তানকে মেরে ফেলবে!
রায়ান আবারো ব্যাকুল কন্ঠে বললো,,,
আমি জানি তোমার কাছে আমার শাস্তি পাওনা আছে,,সেই শাস্তি আমাকে দাও।তবুও ওই নিষ্পাপ জান টাকে শেষ করো না।তুমি তো চলেই যাবে।মন টাও তো তোমাকে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি।কাউকে ওই জায়গায় তো আর বসাতেও পারবো না।তাই আমার সন্তানটাকে নিয়ে আমায় বাচতে দাও।
জিনাত বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো ওর কথায়।কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।ওর ভেতর টা যেনো তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।তাই ও রায়ানের থেকে হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে অন্য রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো।দরজা বন্ধ করে ও বালিশে মুখ গুজে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
রায়ান ওখানেই বসে রইলো,,হয়তো ওর ভাগ্যে এতো সুখ নেই!এই ভেবেই নিজেকে বোঝাতে লাগলো।
★★
দেখতে দেখতে ১ মাস পার হয়ে গেলো।ওই রাতের পরে রায়ান আর জিনাতকে এই ব্যাপারে আর কিছু বলে নি।জিনাত এই কয়দিন রায়ানের অনেক খেয়াল রেখেছে।ওকে জোর করে সময়মতো খাইয়েছে।ঠেলেঠুলে কাজে পাঠিয়েছে।সবসময় ফোন দিয়ে ওর খোজ খবর নিয়েছে।তবে সন্তানের কথা উঠলেই তা এড়িয়ে গিয়েছে।তাই রায়ানো আর ওকে ঘাটায় নি।ভেবেছে,,ও থাকুক নিজের মতো।জোর করে বিয়ে করা যায়,, কিন্তু জোর করে সংসার করানো যায় না।
★
আজ সকালে বাথরুম থেকে বেরিয়ে রায়ান দেখে জিনাত ব্যাগে কাপড়চোপড় ঢোকাচ্ছে।সাথে সাথে রায়ানের বুকটা ধক করে উঠলো। কাপাকাপা গলায় বললো,,,
-তু,তু,,তুমি কি আজই চলে যাচ্ছো?
-হ্যাঁ!
-বলছিলাম কি,,, আর কটাদিন থেকে গেলে হতো না,,
-সম্ভব না,,এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। আরো আগেই যাওয়া উচিত ছিলো।কিন্তু আপনাকে ওই অবস্থায় রেখে যেতে বিবেকে বাধছিলো!!
-ও,,,
রায়ান মাথা নিচু করে বললো,,,
-তুমি বাচ্চাটার ব্যাপারে তো আর কিছু বললে না!
-বাচ্চার ব্যাপারে আর কি বলবো?
-দেবে না আমায়?
-না!
রায়ানের মুখটা কাদো কাদো হয়ে গেলো।তুমি ওর কিছু করবে না তো!
জিনাতের এই শুনে মেজাজ বিগড়ে গেলো।ও উঠে দাঁড়িয়ে রায়ানের কলার ধরে বললো,,ওই! বাচ্চাটা কি আপনার একার? আমার না? যে আমি ওকে কিছু করবো,,এই,এই কি করার কথা বলছেন আপনি? আমাকে কি ভাবেন? রাক্ষসী আমি? নিজের বাচ্চা খেয়ে নেবো?
–তাহহ হলে!!(কাপাকাপা গলায় বললো রায়ান)
-ও ওর বাবা মা দুজনের সাথেই থাকবে!
-মায়ায়ানে?
-আমি আজকে বাবার বাসায় যাচ্ছি,,আপনি কাল আপনার সাঙ্গপাঙ্গ দের নিয়ে ওই বাসায় যাবেন।গিয়ে আবার আমাকে বিয়ে করে নিয়ে আসবেন।আমার আত্নীয়স্বজন -পাড়াপ্রতিবেশিরা তো আর জানে না,,যে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।তারা হঠাৎ আমার এই অবস্থার কথা জানলে মান ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যাবে!বুঝলেন কিছু?
রায়ান যেনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
-আমাকে একটা চিমটি কাটো তো!
জিনাত জোরে একটা চিমটি কাটে রায়ানকে।রায়ান আউচচ,,, বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে।হাত ডলতে ডলতে একগাল হাসি দিয়ে বলে,,,,
ক্ষমা করেছো আমায়?
-একদম না!! আপনার কথার মায়ায় পরে গিয়েছি।তাই এ সিদ্ধান্ত! শাস্তি বরাদ্দ রয়ে গিয়েছে। সময়মতো প্রয়োগ করবো।
-একটা কথা বলবো,,,সেদিনের মতো সাজবে কাল?।সেই লাল শাড়ি,,হালকা গয়নায়।আর কাল তোমাকে সেই সাজে মনভরে দেখতে দেবে প্লিজ?
জিনাত কপাল কুচকে বললো,,ইস,,আগে জোড় করে
এখন অনুমতি চাওয়া হচ্ছে,ন্যাকা! চেয়ে থাকতে আপনাকে কেউ মানা করেছে!
-ও,,ও,অধিকারের গন্ডি দেখি কবেই ভেঙে দিয়েছো,, আর আমি কিনা তা জানিই না।নাহ,,বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে। এখন আর সেই ভুল না! এখন,,,,,,
এই বলে রায়ান পরম ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরলো ওর স্ত্রীকে আর জিনাত প্রথম ভালোবাসার আলিঙ্গনের লজ্জায় মুখ লুকোলো ওর স্বামীর বুকে!
★★
এক বছর পরে,,,,,
রায়ান ওর ৫ মাস বয়সী মেয়ে মুসকানকে কোলে নিয়ে হাটছে,,কলেজের মাঠে।একটু পরেই জিনাত বের হলো পরীক্ষার হল। থেকে,,ওর সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে।জিনাত বের হলে,, ওরা ফুচকা খেতে চলে যায়।এটাই পরীক্ষার দিনের নিয়ম। পরীক্ষা শেষ হলে জিনাতের ফুচকা আর আইসক্রিম চাই।তাই রায়ান পরীক্ষা ছাড়াও সুযোগ পেলেই ওকে বাইরে নিয়ে যায় ফুচকা খাওয়াতে।
জিনাতের পড়াশোনার খুব খেয়াল রাখে রায়ান।ওর মেয়ের দেখাশোনা ও আর শিমু মিলেই করে।আর জিনাতকে সময় দেয় পড়াশোনা করার জন্য। রাত জেগে পড়ার সময়,,জিনাতকে লাল চা বানিয়ে দিতে ভুল হয় না রায়ানের।জিনাতের ছোটো ছোটো ইচ্ছে,,খুশির অনেক মূল্যায়ন করে সে।
আজ জিনাতো নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে করে রায়ানের মতো মানুষের স্ত্রী হতে পেরে।এখন ওর প্রায়ই মনে হয়,,ইস!! ভাগ্যিস,,সেদিন জোর করে ও আমায় বিয়ে করেছিলো,,নয়তো এই সুন্দর দিনগুলো হয়তো জীবনে আসতোই না!(সমাপ্ত)
আপু ভাইয়া! গল্পটা কেমন লাগলো জানাবেন কিন্তু।আজ অন্তত মন্তব্যে কার্পণ্য করবেন না।