মধুচন্দ্রিমা
পর্ব ১৭,১৮
তানিয়া রহমান
১৭
মেহবুব অপুর রুমে এসে বলল- কি করছ
পিসি থেকে মুখ সরিয়ে অপু দেখলো মেহবুব ওর কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে, মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল – এ্যাসাইনমেন্টের জন্য কিছু ইনফরমেশন লাগবে তাই গুগলে সার্চ করছি
– এসব এখন রাখ,কথা আছে, তোমার মায়ের রুমে এস
ঋতুর ঘড়ে অনেক দিন আসা হয় না মেহবুবের,রুমে ঢুকে চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল, ছিমছাম সুন্দর সাজানো গোছানো, কত শত সুন্দর মুহূর্ত কেটেছে এই ঘড়ে ঋতুর সাথে মেহবুবের।ঋতুর হাস্যোজ্জ্বল ছবির দিকে তাকিয়ে মেহবুব মনে মনে বলল “কেন তুমি চলে গেলে আমাকে এমন এলোমেলো করে দিয়ে ”
অপু দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলো মেহবুব ঋতুর ছবির দিকে তাকিয়ে আছে, অপুর ভিতরটাও কেঁপে উঠল মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে, নিজেকে সামলে অপু বলল- বাবা আসব
– এস
– কি বলবে
মেহবুব নিজের পাশের ফাঁকা জায়গা দেখিয়ে বলল- বোস
বাবার পাশে বসে মেহবুবের কাঁধে মাথা রাখলো অপু
– মাম্মাকে খুব মিস করি
– আমিও করি,মাথায় হাত বুলিয়ে বলল মেহবুব
– কি বলবে বলছিলে
– আমরা নিকেতনে শিফট করবো
– মাম্মাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না বাবা
– অপু! মা আমার, খুব মন দিয়ে আমার কথা শুনো
মেহবুবকে এক হাতে জরিয়ে বলল অপু- বল শুনছি
– এই ফ্ল্যাট আমার কাছেও ভীষণ precious, তোমার মা আর আমি একটু একটু করে জমিয়ে এটা কিনেছিলাম, আমাদের প্রথম সংসার, তোমার জন্ম কত কত মেমোরেবল মোমেন্ট জরিয়ে আছে এখানে ইচ্ছে করলে অনেক আগেই নিকেতনে শিফট করতে পারতাম কিন্তু এখান থেকে যেতে মন চাইনি কখনো, এখনো চাইছে না, কিন্তু সময়ের সাথে ইচ্ছেটাও বদলে যায়, তোমার আন্টির সঙ্গে যে বিশ্রী ঘটনা ঘটেছে আমি চাই না এরকম আরও ঘটুক, তুমি অমত করোনা,সময় যখন বদলে যেয়ে আবার আমাদের অনুকূলে ফিরবে তখন না হয় ফিরে আসব
– এই ফ্ল্যাটের কি হবে
– যেমন আছে তেমনই থাকবে, মাঝে মাঝে এসে দেখে যাব তোমার মাকে
– কবে যাব
– তুমি গুছিয়ে থাক সময় হলে বলব
– ওকে!
ঝকঝকে সাদা প্রাডো ঢুকে গেল নিকেতনের ছোট্ট ডুপ্লেক্স বাড়িতে, লন,সুইমিংপুল আর চোখ ধাধানো গার্ডেন দেখে ইরিনের মনটা ভাল লাগায় ভরে গেল,
ইরিন মেহবুবকে বলল-এটা কার বাড়ি
– ভিতরে এস বলছি
নিচতলার এল শেপে লিভিং ডাইনিং, আর কিচেন, ডান দিকের দেয়াল জুড়ে অপুর ছোট থেকে বড় বেলার কতরকম ছবি, মাঝের ছবিটায় চোখ আটকে গেল ইরিনের,অপু হাসি হাসি মুখ করে দু’হাতে আগলে আছে ইরিন আর মেহবুবকে।মেহবুব ইরিনের পিছনে দাঁড়িয়ে বলল- এখন কি বুঝতে পারছো এটা কার বাড়ি
-পারছি
মেহবুব ইরিনকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল,ইরিনের কাজলে টানা স্বচ্ছ স্রোতহীন চোখে নিজের চোখ জোরা তুলে ধরলো, গভীরে দৃষ্টি ফেলে বলল- তোমার চোখে আমার ছবি আঁকবে ইরা
– রংতুলি হারিয়ে ফেলেছি
– আমি খুঁজে দিই
– রঙগুলো সব ঝড়ে গিয়েছে অশ্রু হয়ে
– একবার বলে দেখ রঙধনুর সাতটি রঙ লুটিয়ে দিব তোমার পায়ের কাছে
– বড্ড অগোছালো মন ছবি আঁকতে ভুলে গেছে
– মেঘের কাছ থেকে জল এনে রঙধনুর রঙে মিলিয়ে দিব, গুছিয়ে দিব সবকিছু তুমি শুধু ভাবনার জালে আমাকে বুনো
– ভয় হয়
– কিসের
– যদি চোখের জলে রঙ ধুঁয়ে যায়
– একবার ভরসা করে দেখ রঙ ধোঁয়া জল সুতোয় গেঁথে তাজ বানিয়ে নিব
-আমাকে একটু সময় দিন প্লিজ!
মেহবুব ইরিনেকে জরিয়ে ধরে বলল- বেশতো দিলাম।
অফিসের গেট দিয়ে ঢোকার সময় গাড়ির জানালা দিয়ে মেহবুব খেয়াল করলো মনির ইমরানের সঙ্গে হাতাহাতি করছে।দ্রুত হেটে রুমে এসে মেহবুব ইমরানকে কল করলো
– অফিসের সামনে এসব কি ইমরান
– স্যার মিঃ মনির স্ল্যাং ল্যাংগুয়েজ ইউজ করছিল আপনাকে আর ম্যামকে নিয়ে
– ওকে পাঠিয়ে দাও
– সাথে রিভলবার আছে স্যার
– ওটা তোমার কাছে রেখে উপরে পাঠাও
মনিরের ঠোঁটের একটা পাশ কেটে রক্ত বের হচ্ছে, কপালের বা পাশ ফুলে ছোট্ট বলের মত দেখাচ্ছে।
মেহবুব টিস্যু বক্স এগিয়ে দিয়ে বলল – ব্লাড মুছে নে
মনির টিস্যু নিয়ে মুছতে শুরু করলো
– ইরাকে আর কত নিচে নামাবি মনির
চোখ তুলে তাকালো মনির তারপর বলল- ইরিকে তুই কোথায় লুকিয়েছিস
– ও কি লুকানোর জিনিস
– হেয়ালি রাখ,কোথায় শিফট করেছিস ওকে নিয়ে
– তুই খুঁজে বের কর
মনির তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল – আমার পিছনে টিকটিকি লাগিয়েছিস কেন
– তোর এরকম কেন মনে হলো
মনির তাচ্ছিল্য নিয়ে বলল – ওদের বলিস আমার কাছে ট্রেনিং নিয়ে কাজে নামতে
– রিভলবার নিয়ে কেন এসেছিস আমাকে মেরে ফেলতে
মনির চুপ করে রইল
– তোর কি মনে হয় আমাকে মেরে ফেললেই সব সমস্যার সমাধান
– বিশ্বাসঘাতকদের বেঁচে থাকতে নেই
– নিজের মত সবাইকে ভাবিস না
মনির হঠাৎ নরম কন্ঠে বলল – দোস্ত দে না ফিরিয়ে ওকে,আমি আর পারছি না, ও ছাড়া আমার যে আর কেউ নেই
– তোর জন্য ইরার রঙহীন ভালবাসা ধূসর প্রজাপতি হয়ে উড়ে গিয়েছে, মিছে কেন টানা হেঁচড়া করছিস
মনির অপলক দৃষ্টি নিয়ে মেহবুবের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল ” সত্যি কি! ”
চলবে
মধুচন্দ্রিমা
পর্ব ১৮
তানিয়া রহমান
– ইমরান!
– জ্বি স্যার
– মনিরকে কে ফলো করছে
– আজমল
– মনির যে ডিফেন্সে ছিল তুমি জানতে না
– পরে জেনেছি স্যার
– পরে কেন, ওকে ফলো করার আগেই তোমার ডিটেইল জানা উচিৎ ছিল
– ভুল হয়ে গিয়েছে
– আজমলকে সরিয়ে চৌকস কাউকে সেট কর, দরকার হলে সার্কেল তৈরী করে ফলো কর
– জ্বি স্যার, আমি দেখছি
– এখন যাও
মনির আর কর্ণেল ফারুক বসে আছে স্পাইসি শেফে,এক ঢোক জুস খেয়ে ফারুক বলল- মেহবুব চৌধুরীর ডিটেইল দিয়ে কি করবি
– শালা!আমাকে বহুত নাচাচ্ছে এবার নিজের নাচ বন্ধ করে ওর নাচ দেখবো
– যতদূর জানি মেহবুব চৌধুরীতো সাদামাটা নিপাট ভদ্রলোক ও তোকে কেমন করে নাচাচ্ছে
– মুখোশ, ঐ মুখোশের আড়ালে –যাক গে তুই ডিটেইল এনেছিস
– হুম
– শুরু কর
– বাড়ী গাড়ী থেকে শুরু করি কি বলিস
শ্বাস ছেড়ে মনির বলল- ওকে
– ভদ্রলোকের সেগুনবাগিচায় একটা ফ্ল্যাট আছে আর নিকেতনে আছে ডুপ্লেক্স বাড়ি,দু মাস আগে নিকেতনে শিফট করেছে।
মনিরের চোখ চকচক করে উঠলো, ঝুঁকে এসে বলল- তারপর
– গাজীপুরে দ্যা ডিউ নামে রিসোর্ট আর বান্দরবানে আছে ছোট একটা কটেজ। এই কটেজ ভদ্রলোক পার্সোনাল ইউজের জন্য বানিয়েছেন বাট গত দেড়বছরে একবারো যাননি।
শ্বাস নিয়ে ফারুক আবার বলল – ভদ্রলোকের দুটো গাড়ি আগে ছিল, দুমাস আগে একটা রেড কালারের বিএম ডাব্লিউ নিয়েছেন, এটা মূলত তার মেয়ে অপরাজিতা ইউজ করেন, মেয়ের সঙ্গে সম্প্রতি একজন লেডি গার্ড দেখা যায় সে আবার ব্লাকবেল্টধারী।
– গাড়ীর নাম্বারটা বল
– ঢাকা মেট্রো—
মনির নাম্বারটা টুকে নিয়ে বলল – তারপর
– ভদ্রলোকের প্রথম স্ত্রীর নাম হচ্ছে নীলিমা চৌধুরী ঋতু, তিনিও একজন আর্কিটেক্ট ছিলেন,বছর দেড়েক আগে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মারা যায়, নয়মাস আগে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন,তার নাম হচ্ছে
মনির থামিয়ে দিয়ে বলল – আমি জানি, নতুন কিছু থাকলে বল
– ভদ্রমহিলা নীলক্ষেতের ভোলানাথ লাইব্রেরী থেকে প্রতিমাসে বই কিনেন
মনির মনে মনে বলল “এত ইম্পরট্যান্ট একটা জিনিস কিভাবে মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল,আমি নিজেওতো বহুবার এখান থেকে বই কিনে দিয়েছি”
ফারুক আবার বলল – কিন্তু গত দুই মাস ধরে তিনি বই কিনতে যাচ্ছে না
– নিকেতনের বাসার এড্রেস বল
– রোড নাম্বার তিন বাড়ি নাম্বার চৌদ্দ আর বাড়ীর নাম হচ্ছে অমেরা
– কি নাম
– অমেরা
মনির মুচকি হাসি দিয়ে বলল – বাড়ির নিরাপত্তা কেমন
– ও মাই গড, এটাতো রীতিমতো দূর্গ বলতে পারিস, চারদিকে গার্ড সন্ধ্যা হলেই ঝকঝকে আলো সিসি ক্যামেরার অভাব নেই
মনির মনে মনে একটা হিসেব কষে নিল
– নিরাপত্তা দিয়ে কি করবি
– কাজ আছে
– চুরি টুরি করবি নাকি
– করতেও পারি
– কি চুরি করবি বৌ,হাসতে হাসতে ফারুক আবার বলল – ভদ্রলোকের বৌ নাকি দুর্দান্ত সুন্দরী
মনির ফারুককে থামিয়ে দিয়ে বলল – তোর প্রোমোশনের কি হলো
– আর প্রমোশন! তুই -ই ভাল করেছিস, রিটায়ার্ড নিয়ে নিয়েছিস
– না নিয়ে কি করব বল,রাজ–মারপ্যাচে প্রমোশনটা আর হলো না, জুনিয়রদেরতো স্যার ডাকা যায় না
– তোর মতো ব্রিলিয়ান্ট অফিসার ডিফেন্সে দরকার ছিল, আমরা মেধার কদর করি না
মনির শ্বাস ছেড়ে বলল -তো বন্ধু অনেক ধন্যবাদ হেল্প করার জন্য
– ইটস ওকে
– বাসায় আসিস
– আসব, আজ উঠি,ভাবীকে সালাম দিস
– ওকে
চলবে