প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল -১
নাবিলা ইস্ক
কিছু মাস ধরে অরু খুব ডিপ্রেশনে আছে৷ তার ডিপ্রেশনের কারণ দাঁড়ালো তন্ময়ের সামনে গেলেই কিছু না কিছু উদ্ভট কান্ডকারখানা সে করে বসে৷ যা খুবই বিব্রতকর৷ বিব্রতবোধ করতে করতেই মুলত তার ডিপ্রেশন চলে এসেছে৷ যেমন প্রতিদিনের মতো গত সপ্তাহে সে তন্ময়ের বাসায় পড়তে গিয়েছিল৷ পড়ার একফাঁকে তার হাঁচি এলো৷ হাঁচি দিতে গিয়ে খেয়াল করলো, হাঁচির সাথে সর্দি বেরিয়ে গিয়েছে৷ এমতাবস্থায় সে হাত আর নাকমুখ থেকে সরাতে পারছে না৷ লুকিয়ে ওড়না বা জামায় যে মুছবে তারও উপায় নেই৷ তন্ময় সামনেই বসে কফি খাচ্ছিলো৷ বিষয়টি তন্ময়ের চোখে পৌঁছাতেই সে পেছন থেকে টিস্যু এগিয়ে দিলো৷ তারপর কফি হাতে বেরিয়ে গেল৷ বিষন্ন মন নিয়ে নাক পরিষ্কার করা অরুর জীবনে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতি ইদানীং হয়েই চলেছে৷ যেমন পরশু তার টেস্ট ছিলো৷ তন্ময় তাকে মনোযোগ সহকারে পড়াচ্ছিল৷ অরুও মনোযোগ দিয়ে পড়ছে৷ তাদের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ পড়ালেখা চলছে৷ এমন সময় অরু শব্দ করে উঠলো৷ এখন সেটা কীসের শব্দ ছিলো তা বুঝতে বাকি নেই কারো৷ শব্দ শুনেও না শোনার ভাণ করে পড়িয়ে চলেছে তন্ময়৷ কিন্তু অরু আর পড়তে পারল না৷ হন্তদন্ত ভঙ্গিতে বইপত্র গুঁছিয়ে বেরিয়ে পড়লো৷ সেই যে বেরিয়েছে লজ্জায় সে এখনো তন্ময়ের সামনে যেতে পারছে না৷ বাড়িতে সারাদিন থাকে তখন তো এটা হয়না৷ তাহলে তন্ময়ের সামনে গেলেই কেন হবে? নির্লজ্জ শব্দ একটা। লজ্জায় হতভম্ব অরু নিজের উপরেই চরম বিরক্ত৷ বিরক্ত তাকে বিরক্ত করতে চলে এসেছে দীপ্ত৷ দীপ্তর হাতে নিউজপেপার৷ নিউজপেপারের এক অংশে বড় করে শাবিহার ছবি দেওয়া হয়েছে৷ তন্ময়ের ছোট বোন শাবিহা একজন জার্নালিস্ট৷ জার্নালিস্ট তাকে পত্রিকায় দেখতে পাওয়া আসলেই প্রশংসনীয়৷ আর্টিকেলটায় ছোটছোট শব্দে প্রশংসা করা হয়েছে শাবিহার৷ দীপ্ত গলা পরিষ্কার করে উচ্চস্বরে আর্টিকেল পড়তে শুরু করলো৷ সম্পুর্নটা শুনে অরু তার বোনের উপর গর্বিত৷ ব্যাগে বইপত্র গুঁছিয়ে নিয়ে দীপ্তর সামনে এসে দাঁড়ালো৷ দীপ্তর হাত থেকে নিউজপেপার নিয়ে নিজে কয়েকবার দেখল৷
– মাথা নষ্ট করা সুন্দরীকে বুক ভেঙে ফেলার যন্ত্র লাগছে একদম৷ আপুর এই ছবিটা কিন্তু আমার ভিষণ পছন্দের!
– আমারও তো পছন্দের৷
– বড় চাচ্চুকে দেখিয়েছিস?
– সবাই দেখেছে৷ শুধু তুমি মাত্র দেখছ৷
হুট করে অরুর বিষন্নতা আবারো ফিরে এলো৷ যদি সে দীপ্তকে বলতে পারতো তার বিষন্ন মনের কারণ তাহলে হয়তো একটু মনে শান্তি পেত৷ তারপর ভাবল দীপ্ত ছোট হলেও ছেলে মানুষ৷ হেসে তাকে নিশ্চয়ই বলবে,
– ছিঃ! তুমি বায়ু দূষণ করে ফেললে তাও তন্ময় ভাইয়ের সামনে ?
তখন তো অরু লজ্জায় জিন্দা মরে যাবে৷ বিষন্ন মনকে শান্ত করে বললো,
– আকাশ ভাইয়া কোথায়? বেরিয়েছে?
– হ্যাঁ৷
– আপুও বেরিয়েছে?
– হ্যাঁ৷
– এই আপুকে ফোন করে বল আজ আমাদের ট্রিট দিতে৷
– তোমার বলতে হবেনা৷ এটা আগেই বলে রেখেছি৷ আপু বলেছে রাতে ফেরার সময় পিজ্জা কোক এবং বার্গার আনবে সবার জন্য৷
– আচ্ছা। তুই এখনো বাড়িতে কেন? স্কুল যাসনি?
– আমার ডায়রিয়া হয়েছে৷ আজ বড় চাচ্চু ছুটি নিয়ে দিয়েছে৷
অরুর মন খারাপ হয়ে এলো৷ তার ডায়রিয়া হয়না কেন? ডায়রিয়া হলে দীপ্তর মতো সেও রেস্ট নিতে পারতো এই সুন্দর ওয়েদারে৷ আফসোস পেটে জমিয়ে কাঁধে ব্যাগ চেপে বেরিয়ে পড়লো কলেজের উদ্দেশ্যে৷ সাধারণত ড্রাইভার চাচা অরুকে আর দীপ্তকে একসাথে স্কুল দিয়ে আসে৷ কারণ তাদের স্কুল, কলেজ এবং ভার্সিটি একসাথেই৷ তবে মাঝেমধ্যে অরু বাইসাইকেল করে কলেজ যেতে সাচ্ছন্দ্য অনুভব করে৷ যেমন আজ সে সাইকেল নিয়ে চললো৷ হুট করে তার আরেকটি বিব্রতকর পরিস্থিতি মনে পড়লো৷ মাস খানেক আগের ঘটনা৷ অরু তন্ময়ের জন্য নিজে হাতে কফি করেছে৷ এবং কফিটা ঠিক টি-টেবিলের উপরে রেখেছিলো৷ তন্ময় গোসল সেড়ে কফি নিয়ে অরুর সামনে বসেছে৷ অরুও পড়ার ফাঁকেফাঁকে চুলগুলো আলতো করে গুঁছিয়ে নিচ্ছে৷ আশায় আছে কফির প্রশংসা শুনবে তন্ময়ের মুখ থেকে৷ তৎক্ষণাৎ মাথা তুলে খেয়াল করলো তন্ময়ের কফির মগে একটা বড় চুল৷ যেটা দেখে বোঝা যাচ্ছে তার মাথার৷ এই চুল দেখলে তন্ময় কফি আর খাবেনা এরজন্য সে দ্রুত চুলটা সরিয়ে ফেলতে চাইছে৷ বুদ্ধি করে এগিয়ে গেল সামনে৷ তন্ময় কফি মুখে নিয়েছে আর অরু কফির মগ ধরেছে৷ ছোট মগ দুজনের ধরায় দুজনেই একই মুহুর্তে আবার ছেড়ে দিয়েছে৷ গরম কফির মগ পড়ল তন্ময়ের গুপ্ত স্থানে৷ বড়বড় চোখ করে চেঁচিয়ে উঠলো অরু৷ দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ঝাড়তে লাগলো তন্ময়ের গুপ্ত স্থানের উপর৷ হতভম্বের মতো কিছুক্ষণ বসে থেকে তন্ময় উঠে দাঁড়িয়ে চলে গেল৷ মাথাটা ঠান্ডা হতেই অরুর মস্তিষ্ক জ্বলে উঠলো৷ তারপর হাতটা ধরে সে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ৷ তারপর হাতটি বিছানায় ফেলে নিঃশব্দে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো৷ ওটা কী তার ধরার মতো যায়গা? দুঃখে কষ্টে অরু তারপর একসপ্তাহ পড়তে যায়নি৷ সেই লজ্জাজনক পরিস্থিতি মনে করে অরুর ডিপ্রেশন বেড়ে চলেছে৷ সাইকেল নিয়ে কলেজের ভেতর ঢুকে মারজিকে দেখল৷ সে সাইকেল পার্ক করছে৷ অরু ওর পাশে সাইকেল পার্ক করে বললো,
– ব্যাপার কী তোর? কাল কলেজ আসলি না যে?
– ডায়রিয়া৷
– আরে ভাই! আমাকে বাদে সবার ডায়রিয়া৷ ডায়রিয়া কী আমার সাথে শত্রুতা করেছে? দীপ্তরও ডায়রিয়া হয়েছে৷
– তুই সেধে ডায়রিয়া চাইছিস? ফালতু মেয়ে!
– চাইব না? ডায়রিয়া হলে যদি কলেজ মিস দেওয়া যায়, তাহলে আমি সেটাই চাই৷
– পাগল! জানিস সুমনা নতুন প্রেম করছে!
– কার সাথে?
– স্কুলের সহযোগী শিক্ষক মুবিন স্যারের সাথে৷
অরু নিশ্চুপ হয়ে গেল৷ সুমনা তার কাজিন৷ কাজিনকে নিয়ে কী কেউ গসিপ করে? হয়তো কেউ করেনা৷ কিন্তু সে করে৷ করার অবশ্য অনেক কারণ আছে৷ সুমনা আর তার কখনো বনে না৷ বনবে কীভাবে? সুমনার চলাফেরা আর তার চলাফেরায় আকাশপাতাল তফাৎ৷ এই মেয়ে দু’একদিন পরপর নতুন প্রেমে জড়ায়৷ ওর নামে কতো খারাপ আলাপ-আলোচনা শোনা যায়৷ এর উপর বেশ কয়েকবার তন্ময়কে স্যাডুইউসডও করতে চেয়েছে৷ তাও তার চোখের সামনে৷ তন্ময় কখনো পাত্তা দেয়নি বিদায় সুযোগ পায়নি৷ নাহলে অরুর মনে হয় তন্ময়কে নিজের সব বিলিয়ে দিতো, না চাইতেই৷ পেছন থেকে কেউ তার নাম ডাকল৷ অরুর সঙ্গে মারজিও পেছনে তাকাল৷ অয়ন সাদা শার্ট-প্যান্ট, গলায় টাই ঝুলিয়ে কাঁধে ব্যাগ চেপে এগিয়ে আসছে৷ অয়ন তাদের সিনিয়র৷ অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে এবার৷ আবার তাদের বাড়িও পাশাপাশি৷ এক ছাঁদ থেকে অন্য ছাঁদে লাফিয়ে আসা যাবে এমন সিচুয়েশন৷ তাদের পরিবারের মধ্যেও বেশ সুন্দর একটা বন্ডিং আছে৷ মজার বিষয় হচ্ছে অয়নের পিছেও সুমনা পড়েছিল৷ কিন্তু অয়নের পাত্তা পায়নি৷ অরু হেসে তাকাতেই অয়ন বললো,
– ট্রিট কই?
– আমাকে বলে লাভ নেই অয়ন ভাইয়া৷ আপুকে গিয়ে বলতে হবে৷ জার্নালিস্ট সে, ছবি পত্রিকায় তার ছেপেছে৷ পাকাপোক্ত ভাবে নিজেকে স্যাটেলও করে নিচ্ছে। আর তুমি আমার থেকে ট্রিট চাও?
– তোর আপুকে বুঝি পাওয়া যায়?
– আজ তাড়াতাড়ি ফিরবে৷ ট্রিট দিবে৷ ছাদে আমাদের আড্ডা হবে আজ৷ তোমাকে ইনভাইটেশন দিলাম৷ চলে আসিও৷
অয়নের চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠলো৷
– সত্যি?
– পাক্কা৷
– তাহলে আমি কিন্তু চলে আসবো৷ ঠিক এক্সাক্ট সময় বল৷
– নয়টা?
– আচ্ছা৷
অয়ন বন্ধুদের দিক চলে গেল৷ যেতে নিয়ে আরেকবার শিয়রিটি দিলো, সে কিন্তু চলে আসবে৷ অরু হেসে মাথা দোলাল৷ মারজি অরুর পাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বললো,
– দেখ সুমনা এদিকে তাকিয়ে৷
অরু হাসলো৷
– ওর ক্রাশ সেধে এসে কথা বলছে আমাদের সাথে তাই জ্বালা করছে ওর৷
দুজনেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো৷ হাসতে হাসতে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে৷ যেমন আজকের মতো আনন্দ তারা আর পায়নি জীবনে৷
————
শাবিহা মাত্রই অফিস থেকে বেরিয়েছে৷ এখন সন্ধ্যা ছ’টায়৷ কিছু খেয়ে আবার অফিসে ঢুকবে৷ মুলত তাদের ব্রেক টাইম এখন৷ হেঁটে বাস স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়ালো৷ রাস্তা পাড় হয়ে ওপার যাবে৷ এমন সময় তার ফোন বেজে উঠলো৷ স্ক্রিনে ‘ তন্ময় ভাই ‘ লেখাটি ভেসে উঠেছে৷ শাবিহা কল রিসিভ করলো৷
— হ্যাঁ ভাই৷
— কোথায় তুই?
— অফিস থেকে বেরোলাম মাত্র৷ ব্রেক টাইম এখন৷ বাস স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছি৷
— আশেপাশেই আছি৷ দাঁড়িয়ে থাক আসছি আমি৷
— আচ্ছা৷
শাবিহা কল কেটে পাশে তাকাল৷ তার থেকে কিছুটা দূরে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে৷ পরনে সাদা হুডি৷ আঁড়চোখে তার দিকেই তাকাচ্ছে৷ ছেলেটিকে চিনতে সময় লাগলো না শাবিহার৷ সময় লাগবে কীভাবে? দিনে দুএকবার এই ছেলে ওর সামনে চলে আসবে কোনো না কোনো অজুহাত নিয়ে৷ সবই বুঝে শাবিহা৷ একটা ছেলে বারবার সামনে কেন আসছে বা কেন তাকে ফলো করছে, বা কেন তার দিক বারবার তাকায় এগুলো বুঝতে পারে সে! বুঝলেই বা কী? ভাবতেই শাবিহার লজ্জা লাগে৷ সে এইবার মাস্টার্স প্রথম বর্ষে৷ অয়ন মাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে৷ বাচ্চা ছেলে৷ মাত্র গ্রো-আপ করছে৷ চেহারায় এখনো বাচ্চামো ভাব৷ ক্লিন শেভে তাকে বাচ্চা তো লাগবেই৷ তার উপর শাবিহার সন্দেহ জাগে, এই ছেলের মনে হয় এখনো দাড়িও গজায়নি৷ নেহাতি বাচ্চা ছেলে৷ তার উপর ছোট থেকে ওকে বড় হতে দেখেছে৷ খারাপ কোনো ব্যবহার করতেও দ্বিধাবোধ হয়৷ একপ্রকার সে জালে আটকে৷ একটা কাটা তার গলায় আটকে৷ না পারছে কাটা ফেলতে আর না পারছে গিলতে৷ প্রতিদিনের মতো অভিনয় সুরে বললো,
– অয়ন তুমি এখানে?
অয়ন ভদ্র ছেলের মতো এগিয়ে সামনে দাঁড়ালো৷ প্রত্যেকদিনের মতো মিথ্যে একটা বলে দিল৷
– বন্ধুকে ড্রপ করতে এসেছিলাম৷
– ওহ্ আচ্ছা৷
– কংগ্রাচুলেশনস৷
– থ্যাংকইউ৷
– ইউ ডিজার্ভ ইট৷
শাবিহা হাসলো৷ হেসে বললো,
– থ্যাংকস৷
তন্ময়ের পৌঁছাতে দশ মিনিট লেগেছে৷ তাকে দেখেই বাইকের পেছনে উঠে বসলো শাবিহা৷ তন্ময় হুট করে অয়নকে খেয়াল করলো৷ যে আপাতত বাইকে বসে এখানে মাত্রই পৌঁছেছে এমন ভঙ্গিমা করছে৷
— তুই এখানে যে?
— হয়েছে কী ভাই! বন্ধু সজিবের এখানে দরকার ছিলো৷ ড্রপ করতে এসেছিলাম৷
— তুই কী এখন বিজি?
— না ভাই৷ বাসায় যাচ্ছিলাম৷
— তো আয় আমাদের সাথে৷ আজ শাবিহা নামকরা জার্নালিস্টদের মধ্যে একজন হতে পেরেছে৷ নিউজপেপার দেখেছিস? আম প্রাউড অব হার৷ তাই ওকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট যাচ্ছিলাম৷ আয় সাথে৷ ট্রিট দেই৷
— আচ্ছা ভাই৷
তন্ময় বাইক স্টার্ট করে যেতেই অয়ন ও বাইক স্টার্ট করে পেছন পেছন চললো৷ বসুন্ধরার সামনে একটা রেস্টুরেন্টে বাইক থামাল৷ অয়নও এসে পাশেই থেমেছে৷ তন্ময় বাইক লক করে হেলমেট এবং চাবি নিয়ে শাবিহার দিক তাকাল৷ সারাদিন কাজ করে শাবিহার চোখমুখ ক্লান্ত৷ বোনের কাঁধ চেপে রেস্টুরেন্টের ভেতরে নিতে নিতে তন্ময় বললো,
— কী দরকার এতো কষ্ট করার? পড়াশোনা মন দিয়ে কর শুধু৷
— তোমারও তো এতো কাজ করার প্রয়োজন নেই৷ বাবার এতো টাকাপয়সা ফেলে, কেন করো?
— তুই জানিস কেন করি!
— তাহলে তুমিও জেনে নাও আমি কেন করি৷
তন্ময় তর্ক করতে জানেনা৷ অল্পতেই হাড় মেনে যায়৷ একটি সাইলেন্ট কর্নার বেছে নিল৷ সেখানেই তিনজন বসলো৷ শাবিহা বসে তন্ময়ের ঘামে ভেজা মুখ দেখে মন খারাপ করে ফেললো৷ কখনো গাড়ি ছাড়া চলাচল না করা তার ভাই এখন এতো কষ্ট করে অফিস করে ভাবতেই, শাবিহার শ্বাস আটকে আসছে৷ ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে তন্ময়ের কপালের ঘাম মুছে দিল৷
— অফিসে অনেক প্রেসার বুঝি?
— হ্যাঁ একটু আকটু৷
— মা কেমন আছে?
— ভালোই৷ তোর চিন্তা করে সারাদিন৷
— বাবার কথা জিজ্ঞেস করবে না ভাইয়া?
তন্ময় ওয়েটার ডাকল৷ শাবিহার কথাটি সম্পুর্ন অগ্রাহ্য করলো৷ শাবিহা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চোখ ফেরাতেই অয়নের উপর নজর পড়লো৷ তার দিকই তাকিয়ে ফ্যালফ্যাল করে৷ চোখ দিয়েই খেয়ে ফেলবে যেমন৷ শাবিহার ইদানীং মনে হচ্ছে এই ছেলে নিজ থেকে থামবে না৷ তাকে খোলাখুলি ওর সাথে কথা বলতে হবে৷ তন্ময় মেনু এগিয়ে দিয়ে বললো,
— কি খাবি অর্ডার দে৷
শাবিহা বললো,
— ট্রিট তো আমার দেওয়ার কথা!
— তুই ট্রিট দিবি তাও আমাকে?
— আমাকে এখনো ছোট ভেবে রেখেছ?
— আমার কাছে ছোট্টো তুই!
— হু৷
ওয়েটার অর্ডার নিয়ে যেতেই তন্ময় এবার অয়নের দিক ফিরল৷
— পড়াশোনা কেমন চলছে অয়ন?
— ভালো ভাই৷
— একমাত্র ছেলে তুই তোর বাবার৷ অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা তোর উপর৷ তাই মন দিয়ে পড়াশোনা করবি৷
— জি৷
— তা প্রেম-ট্রেম করছিস নাকি?
— ন..না ভাই৷ একদম না৷
— কেন কাউকে ভালো লাগেনা?
— ভালো তো লাগে৷
— কাকে?
— আছে একজন৷ কিন্তু এগোনোর সাহস পাচ্ছিনা৷
— আজকাল প্রপোজ করতে সাহস লাগে নাকি?
— না আমার পছন্দের মানুষ খুব রাগী স্বভাবের৷ যদি উল্টাপাল্টা রিয়েকশন করে?
শাবিহা কেশে উঠলো৷ তন্ময় কথা বন্ধ করে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো৷ পানি খেয়ে নিজেকে শান্ত করে শাবিহা টপিক ঘুরিয়ে ফেললো৷
— ভাইয়া আমি কিছু পার্সেল নিব অরুদের জন্য৷ এখন নিলে তো ঠান্ডা হয়ে যাবে তাই না? ভাবছি ছুটি হলেই নিয়ে ফিরবো৷ ওদের আজ ট্রিট দিতেই হবে৷ আমার অপেক্ষায় নিশ্চয়ই বসে একেকটা৷
তন্ময় বললো,
— এই অরু পড়তে আসছে না যে?
— কি জানি!
— গিয়ে বলিস আজ টাইম মতো চলে আসতে৷
— তুমি ওকে কেন পড়াচ্ছ? এভাবেই সারাদিন অফিস করো৷ বাসায় ফিরে রেস্ট করবা তা না! তুমি জানো অরুর দেখাদেখি এখন দীপ্তও তোমার কাছে পড়তে চায়?
তন্ময় হেসে বললো,
— ও তো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট৷ ওকে আমার পড়াতে কেন হবে? অরু হায়ার ম্যাথম্যাটিকসে বেশ দুর্বল৷ টিচার্সদের পড়ানো বোঝেনা বিদায় ওকে আমার আলাদা পড়ানো৷
———
সাতটা ত্রিশে অরু কাঁধে ব্যাগ চেপে বেরিয়েছে৷ তার উদ্দেশ্য তন্ময়ের বাসা৷ বেশিদূর না এখান থেকে৷ সাইকেল করেই চলে যাওয়া যায়৷ এতক্ষণে নিশ্চয়ই তন্ময় কাজ থেকে চলে এসেছে? অরুর একটু সংকোচ অনুভব হচ্ছে৷ কিন্তু এতো সংকোচ অনুভব করলে, হায়ার ম্যাথম্যাটিকসে আবারো চল্লিশের নিচে পাবে৷ তন্ময় ছাড়া সে কারো থেকে পড়া বুঝে না৷ তার টিচার্সরা তাকে হায়ার ম্যাথম্যাটিকস বোঝায় নাকি গরুর ঘাস খাওয়ায় অরু বুঝে পায়না৷ তার তো ইচ্ছে করে সব কয়টা সাবজেক্ট তন্ময় থেকে পড়তে৷ কিন্তু তন্ময়ের সময় কই? আগের দিন গুলো মনে পড়তে লাগল অরুর৷ যখন তারা সবাই একসাথে একই ছাঁদের নিচে থাকতো৷ তন্ময়কে ঘুম থেকে উঠেই দেখতে পেতো৷ সন্ধ্যার পর তন্ময় সবাইকে পড়াতে বসাতো৷ কই সেই দিন গুলো? তাদের পরিবার না ভাঙলে কী চলছিলো না? এই দন্ড, ঝগড়াবিবাদ না হলে কী পারতো না? অরু খুব করে চায় বড় চাচ্চু আর বড় মায়ের যেন ভুল বুঝাবুঝি শেষ হয়ে যায়৷ আর কত? দুটো বছর তো হয়ে গেল৷ আর কত অপেক্ষা?
অরু একটা আটতলা বিল্ডিংয়ের সামনে সাইকেল থামাল৷ তাকে চিনে দারোয়ান ঢুকতে দিলো৷ ঢুকে সাইকেল লক করে লিফট ধরলো৷ তন্ময়দের ফ্ল্যাট পাঁচতলায়৷ সেখানে পৌঁছে কলিং বেল চাপলো৷ দরজা খুলে দিয়েছে জবেদা বেগম৷ অরুর বড় মা৷ অরু ব্যাগ ফেলে জাপ্টে ধরলো তাকে৷
– ভেতরে আয় আগে৷
গলা জাপ্টে ধরেই ভেতরে গেল৷ চারপাশে নজর বুলিয়ে বললো,
– কই তন্ময় ভাই?
– আসছে বললো৷ তুই পড়তে বোস৷ এখনই চলে আসবে৷
অরু টেবিলে বসে সরঞ্জাম তৈরি করছে৷ প্রথমে চুল বাঁধলো৷ যেনো চুল টুল কোথাও না উড়ে যায়৷ তারপর টিস্যু এগিয়ে রাখল সামনে৷ যদি কাশি চলে আসে? টিস্যু কাজে দিবে৷ কিন্তু বায়ু দূষণ প্রতিরোধ কীভাবে করবে? সে ভেবে রাখল, বায়ু দূষণ শুরু হবার আগেই উচ্চস্বরে কথা বলে, তন্ময়কে শুনতেই দেবেনা৷
চলবে