প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ২

0
1769

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ২
নাবিলা ইস্ক

তন্ময় ফিরেছে শুনে অরু কান পেতে৷ কিন্তু স্পষ্ট কোনোকিছুই শুনতে পারছেনা৷ এতো ছোট স্বরে কথা বলে এই লোক! টেবিলে বসে কান পেতে থাকলে শোনা যাবেনা৷ আর এমন আধোআধো স্বরের কন্ঠ অরুর শুনতে বিরক্ত লাগে৷ তাই সে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো৷ ছোট ছোট পায়ে দরজার পর্দা দ্বারা আড়াল হয়ে কান পেতে দিল৷ তন্ময় তখন জুতো খুলছে দুয়ারের সামনে৷ জবেদা বেগম ছেলের ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে৷ তন্ময় বললো,
– ভালো কাজের লোকের সন্ধান পেয়েছি৷ কাল আসতে বলবো?
– আবার একই প্রসঙ্গ? এতটুকু কাজ আমি একাই করে নিতে পারি৷ সারাদিন বাসায় একাই বসে থাকি৷ কাজের লোকের প্রয়োজন নেই৷
– একা থাকো বিদায় তো বলছি৷ সাথী পেয়ে যাবে কথা বলার৷
– না দরকার নেই৷
– তাহলে তুমি আমার কাপড়চোপড়ে হাত দিবেনা৷ আমি নিজেরটা নিজেই ধুয়ে নিব৷
জবেদা বেগম অসহায় হয়ে পড়লেন৷ তন্ময় আবারো বললো,
– তোমার কোমরে সমস্যা৷ ডাক্তার না করেছে বসে কাজকর্ম করতে৷ এখন তুমি যদি এসব ধোয়ামোছা করো, কীভাবে হবে মা? এমন বাচ্চাদের মতো জেদ ধরে থাকলে হয়?
ছেলের গম্ভীরমুখ দেখে জবেদা বেগম আর তর্ক করলেন না৷ বরং রান্নাঘরের দিক যেতে নিচ্ছিলেন৷ তন্ময় পেছন থেকে জবেদা বেগমের চোখের সামনে, আজকের নিউজপেপার মেলে ধরলো৷ শাবিহার ছবি দেখে তিনি ভড়কে গেলেন৷ তন্ময়ের হাত থেকে নিউজপেপার নিয়ে পড়তে শুরু করলেন৷ মেয়ের সম্পর্কে এতো সুন্দর প্রশংসা পত্রিকায় ছেপেছে দেখে, তার চোখজোড়া ভিজে উঠেছে৷ আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে আর্টিকেল বেশ কয়েকবার রিপিট করে পড়ছেন৷ তন্ময় হেসে রুমের দিক পা বাড়ালো৷ অরু সঙ্গে সঙ্গে টেবিলে গিয়ে বসেছে৷ রুমে ঢুকে অরুকে এভাবে দেখে তন্ময় চমকে গেল৷ অরুর আশেপাশে বইয়ের থেকে বেশি অপ্রোয়জনীয় জিনিসপত্র৷ রুমাল, টিস্যু, ওড়না সাউন্ড বক্স৷ এতকিছুর সামনে তন্ময় অরুর চেহারা দেখতে পারছেনা৷
– এসব কী করে রেখেছিস?
অরু মাথা তুলে তাকাল না৷ বইয়ে নজর রেখে বললো,
– প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সামনে রেখেছি৷ দরকার পড়ে আমার৷
এই পাগলকে জবাব দিলো না তন্ময়৷ সে বই নিজের কাছে নিয়ে একটা নতুন চ্যাপ্টার বের করে অরুর সামনে দিয়ে বললো,
– দেখ সলভ করতে পারিস নাকি৷ ভুল হলে সমস্যা নেই। আমি এসে বুঝিয়ে দিব৷
অরু মাথা দোলাল৷ তন্ময় বাথরুমে গিয়েছে৷ সেদিকে নজর বুলিয়ে বইয়ের দিক তাকাল৷ জবেদা বেগমের চোখজোড়া তখনো লাল৷ তিনি এসে প্রশ্ন করলেন,
– তোর জন্য কফি করবো?
– বড়ো মা শুধু এক গ্লাস পানি৷
– আচ্ছা৷
তন্ময় যখন বেরিয়েছে অরুর সামনে তখন একটি পানির গ্লাস৷ সে এতটাই ব্যস্ত পড়ালেখায় যে পানিটুকু খায়নি৷ তন্ময় জবেদা বেগমের থেকে কফি নিয়ে এসেছে৷ অরুর পাশের চেয়ারে বসেছে সবে৷ তখনই অরুর হাত লেগে পানির গ্লাস অসাবধানতা বসত তন্ময়ের উপর পড়লো৷ তার সাদা টি-শার্ট ভিজে বুকের দুপাশের কয়লা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে৷ এবারো অরু হন্তদন্ত হয়ে তন্ময়ের বুক পরিষ্কার করতে নেমেছে৷ তন্ময়কে ঠেলেঠুলে তার পরিষ্কারের কার্যক্রম চলছে৷ আর না নিতে পেরে তন্ময় চেঁচিয়ে উঠলো,
– অরু!
আচমকা ধমকে অররু কেঁদে ফেলল৷ কাঁদতে কাঁদতে বললো,
– সরি ভাইয়া। দেখি নাই আমি৷
– তুই দেখিস কী? আমার মাথা! গাধা একটা৷ তোর মতো এমন মেসি পার্সন আমি আমার লাইফে আর দুটো দেখিনি৷
অরুর কান্নাকাটির শুব্দ শুনে জবেদা বেগম চলে এসেছেন৷
– কী হয়েছে?
– হয়েছে আমার মাথা৷
বলেই তন্ময় রুম থেকে বেরিয়ে গেল৷ এদিকে অরু টিস্যু নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নাক পরিষ্কার করে জবেদা বেগমের দিক তাকাল,
– তুমি বলো বড়ো মা৷ পানি পড়েছে এটা কি আমার দোষ? পানি চেয়েছি আমি, দিয়েছ তুমি, পড়েছে তার গায়ে৷ তারমানে আমরা তিনজন সমান অপরাধী৷ অথচ সে আমাকে ধমকে রাখলো না কিছু!
জবেদা বেগম অরুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
– থাক কাঁদিস না৷ কাজ থেকে এসেছে তাই মাথা গরম৷ এবার হাতপা সামলে রাখবি কেমন?
অরু মাথা দুলিয়ে আবার চেয়ারে বসলো৷ তন্ময় টি-শার্ট পরিবর্তন করে এসেছে৷ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চেয়ার টেনে পাশে বসলো৷ অরুর সামনে থেকে বই নিয়ে কয়েকটি টপিক দাগাল করার জন্য৷ সে খাতা কলম নিজের দিক নিয়ে বোঝাতে শুরু করেছে৷ অরু নাক টেনে টেনে বোঝার চেষ্টা করছে৷ তবে পারছে না৷ নাক টানার শব্দে তন্ময়ের অর্ধেক কথাই সে শুনতে পারছেনা৷ তন্ময় শব্দ করে কলম টেবিলে রেখে বলল,
– তুই বাথরুমে যা৷ গিয়ে কান্নাকাটি, নাক পরিষ্কার আরো যত কাজ আছে সেড়ে আয়৷ যা!
অরু আরেকটু শব্দ করে কেঁদে বাথরুমের দিক হাঁটা দিল৷ বাথরুমের ভেতরে ঢুকে নিজেকে আয়নায় দেখে তার কান্না থেমে গেল৷
– ইশ কী বিশ্রী৷ এভাবে কেউ কান্না করে?
অরু মুখ ভালোমতো দেখে কয়েকটি সুন্দর পদক্ষেপ ট্রায় করছে কান্নার৷ অবশেষে নিজেকে গুঁছিয়ে নিয়ে বেরোলো৷ তন্ময় তখন নিজের অফিসের ডকুমেন্টস দেখছে৷ অরুকে দেখে
বললো,
– বোস৷
অরু বসলো নিজের যায়গায়৷ আবারো পড়ায় মনোযোগী হলো৷ তন্ময়ও তাকে মনোযোগ সহকারে ম্যাথম্যাটিকস বোঝাচ্ছে৷ এমন সময় অরুর নাক আবারো পিটপিট করছে৷ বোঝে উঠবার আগেই সে হাচি দিয়ে উঠলো৷ তন্ময় পাথরের ন্যায়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে চলে গেলো৷ যাওয়ার পূর্বে বললো,
– যা, বাসায় যা৷ গিয়ে হাচি, কান্না যা আছে শেষ কর কালকের মধ্যে৷
অরু মুখ ভেঙিয়ে ব্যাগ গোছাতে শুরু করেছে৷ কত্তো ভাব লোকটার৷ এই একটু ঝামেলা তো আজকাল হয়েই থাকে৷ সাধারণ বিষয়৷ এতো রিয়েক্ট করার কী আছে? অরু ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে পড়লো৷ যাবার সময় তার হাতে জবেদা বেগম চিংড়ির তরকারি ধরিয়ে দিলো৷ এটা তার পছন্দের৷ বাটি সাইকেলের সামনে রেখে, সাইকেল চালিয়ে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে গেল৷ যেতে নিয়ে সে কয়েকবার হাচি দিয়ে উঠেছে৷ পাঁচতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কফি খেতে নিয়ে তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকা তন্ময়কে অরু দেখতে পেল না৷ সে তখনো তার হাচি, কাশি নিয়ে বড়োই ব্যস্ত৷ মোরের সামনে যেতেই সাইকেলের চেইন পড়ে গেল৷ মাঝরাস্তায় ঠিক করতে ইচ্ছে হচ্ছে না বলে সাইকেল থেকে নেমে গেল৷ সাইকেল হাতে চালিয়ে হেঁটে হেঁটে যাবে ডিসিশন নিল৷ আসলে অরুর তন্ময় ভাই এতটা শান্ত কোনো কালেই ছিলো না৷ গম্ভীর এবং অশান্ত প্রকৃতির লোক তিনি৷ খুব কম কথা বলত সে৷ দরকার ছাড়া তাকে বাড়িতে পাওয়া যেতো না৷ সারাদিন নিজের বাবার বিজনেস দেখাশোনার দ্বায়িত্ব নিয়ে রেখেছিল যেমন৷ কিন্তু তার পরিবর্তন ঘটে দুবছর আগে৷ দু’বছর আগের ঘটনা তাকে একদম পরিবর্তন করে দেয়৷ অরু সেই পরিবর্তনের সৎ ব্যবহার করছে৷ ব্যবহার বললে ভুল হবে হয়তো। অরু ছোট থেকেই এমন৷ ভীষণ ব্যাকুল এবং চঞ্চল স্বভাবের৷ কোনোকিছু করতে গেলেই তার খিচুড়ি বানিয়ে ফেলে৷ এরজন্যই হয়তো সে সকলের আদরের৷ এই চঞ্চল তাকে সবাই একটু বেশিই ভালোবাসে৷
——–
রিক্সা এলাকার মোরে থেমেছে৷ শাবিহা নেমে টাকা পরিশোধ করলো৷ রিক্সা সামনে থেকে যেতেই সে এগিয়ে চললো৷ যাবার পথে অয়নকে দেখল৷ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে৷ ঠোঁটে সিগারেট গুঁজে ছিলো৷ শাবিহাকে দেখে সেটা পিঠের পেছনে লুকিয়ে ফেললো৷ মুখের সামনের ধোঁয়া গুলো সরাতে ব্যস্ত সে৷ শাবিহা দেখেও না দেখার ভান করে এগোচ্ছে৷ অয়ন বন্ধুদের ফেলে শাবিহার পিছু চলে এসেছে৷ একহাত দূরত্ব রেখে শাবিহার পেছনে হাঁটছে৷ হুট করে ধীর কন্ঠে গানের কয়েকটি লাইন গাইল৷
‘ এই পথ যদি না শেষ হয়,
তবে কেমন হতো তুমি বলোত৷ ‘
শাবিহার পা জোড়া থেমে গেল। অয়নও ভড়কে নিজ যায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লো৷ চোরের মতো এদিকসেদিক তাকাতে লাগলো৷ শাবিহা ঘুরে অয়নের সামানে দাঁড়ালো৷ বললো,
– তোমার সাথে কথা আছে৷ রাতে ছাঁদে থেকো৷
– জি আচ্ছা৷
শাবিহা দ্রুত পায়ে চলে যাচ্ছিল৷ অয়ন বললো,
– ব্যাগ গুলো আমি নেই?
– প্রয়োজন নেই৷
শাবিহা ব্যাগ গুলো শক্ত করে ধরে এগিয়ে চলেছে৷ পেছনে ঠাই দাঁড়িয়ে অয়ন৷ তারপর দৌড়ে আবারো শাবিহার পেছনে চলে এসেছে৷ একহাত দূরত্ব বজায় রেখে হেটে চলেছে৷ শাবিহা বাড়ির সামনে এসেও দেখল অয়ন তার পিছু৷ তবুও কিছু বললো না৷ কেচি গেইট খুলে ভেতরে গিয়ে আঁড়চোখে দেখল অয়নও তার পিছুপিছু আসছে৷ শাবিহা রেগে বললো,
– ঘরে আসতে বলিনি৷
– ওহ্৷ আমাকে অরু ইনভাইটেশন দিয়েছিল৷ বললো ন’টায় চলে আসতে৷ ট্রিট দিবে নাকি!
– এই মেয়েটা!
শাবিহা হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকছে৷ অয়ন হেসে সদরদরজা টপকে বেরিয়ে গেল৷ সে তো যাবে তবে এভাবে নয়৷ ছাঁদ দিয়ে৷ পেছন পেছন বাড়িতে ঢুকেছে নেহাতি শাবিহাকে জ্বালাতে৷ এদিকে শাবিহা ঢুকে পেছন ফিরে দেখল কেউই নেই৷ তাহলে কী মিথ্যে বললো ছেলেটা? ড্রয়িংরুমে সবাই বসে৷ অরু, রুবি, আকাশ, দীপ্ত৷ সব কয়টা ওঁৎ পেতে তার অপেক্ষায় বসে৷ শাবিহাকে দেখেই অরু লাফিয়ে উঠলো৷ একপ্রকার নিজেকে ছুড়ে মারল তার শরীরে৷ টকটকে লাল নাক শাবিহার বুকে ঘষে বললো,
– কংগ্রাচুলেশনস বাবুন৷
– থ্যাংকিউ আমার টিমটিম৷
দীপ্ত দৌড়ে শাবিহার হাত চেপে ধরেছে৷
– আমাকে থ্যাঙ্কিউ দিবেনা?
– থ্যাংকিউ নুডলস৷
– ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম৷
– বাবা ফেরেনি?
– না৷
অরু দীপ্তকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে খাবারের জিনিসপত্র গুলো ডাইনিংয়ে রাখল শাবিহা৷ সুমিতা বেগম এক গ্লাস পানি নিয়ে আসলেন৷ শাবিহার হাতে দিয়ে তার থেকে অফিস ব্যাগ নিজের হাতে নিলেন৷ প্রশ্ন করলেন,
– খাবার এগুলো গরম করে দিব?
– না চাচি৷ এগুলো গরম৷ মাত্রই অর্ডার করে বানিয়ে এনেছি৷
– আচ্ছা৷ এই তোরা সর বসতে দে মেয়েটাকে৷
অরু বললো,
– মা আমরা এগুলো নিয়ে ছাঁদে গেলাম৷ আড্ডা দিব৷
সুমিতা বেগম এই পাগলদের চক্করে পড়তে চান না৷ আলগোছে চলে যাচ্ছেন৷ শাবিহা নিজের রুমের দিক চললো৷ গোসল নিয়ে তারপর সেও জয়েন হবে ভাইবোনদের আড্ডায়৷ এদিকে পাটি থেকে ধরে যেসব জিনিসপত্র প্রয়োজন সবকিছু ছাঁদে নিচ্ছে অরু, রুবি এবং দীপ্ত৷ তাদের হাতাহাতি কাজে সবকিছু মুহুর্তেই ছাঁদে আনতে পেরেছে৷ আর অলরেডি ছাদে আকাশ বসে৷ সে মুলত খাওয়ার জন্যই বসে৷ খাওয়াদাওয়া শেষে তাকে আর পাওয়া যাবেনা৷ এসব আড্ডা তারজন্য নয়৷ কিন্তু যখন পাশের বিল্ডিং থেকে অয়ন লাফিয়ে এলো, আকাশ নিজের চিন্তাভাবনা পাল্টাল৷ তারা দুজন মিলে আলাপ-আলোচনায় বিভোর৷ কিন্তু একসময় জরুরি ফোনকল আসায় আকাশকে যেতে হবে। শাবিহা যখন ছাদে এসেছে আকাশ চলে গেছে৷ আপাতত অরু, অয়ন, দীপ্ত এবং রুবি বসে৷ শাবিহা অরুর পাশে বসলো৷ তখনই সাউন্ড বক্স ছেড়েছে দীপ্ত৷ একটি রোমান্টিক গান বাজছে৷ কোক সকলের জন্য গ্লাসে ঢেলে, পিজ্জার বক্স খোলা হলো৷ অমনি সবাই হামলে পড়েছে৷ অরু পিজ্জার স্লাইস মুখে ঢুকিয়ে কেশে উঠলো৷ দীপ্ত কোকের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললো,
– তোমার কাশাকাশি যাবেনা?
– যেভাবে বলছিস যেমন আমি সারাদিন কাশি?
– সারাদিন কাশো না তবে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কাশতে কাশতে মানুষের মাথা গরম করে দাও৷
অরু এবারও মুখ ভেঙাল৷ খাওয়াদাওয়ার মাঝে টুকটাক কথা চলছে৷ আড্ডা শেষ হতে খুব রাত হয়েছে৷ শাবিহা সবাইকে জিনিসপত্র ধরিয়ে
বললো,
– যা ঘুমিয়ে পড়৷
অরু আঁড়চোখে কয়েকবার পিছু তাকিয়ে চলে গেল৷ অয়ন ছাদের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে৷ চাঁদ ঠিক তাদের মাথার উপর৷ ঘনঘন হাওয়া বইছে৷ শাবিহা তার পাশে দাঁড়ালো৷ প্রশ্ন করলো,
– আমার বয়স জানো?
আজ অয়ন নিজেকে প্রস্তুত করে এনেছে৷ তাই এই প্রশ্নে হিমশিম খায়নি৷ বরং চাঁদের থেকে নজর সরিয়ে শাবিহার দিক রাখল৷ জবাবে বলল,
– বয়স দিয়ে কিছুই হয়না৷ মন বয়স মানে না, না মানে জাত, ধর্ম৷
– এতটুকু বয়সে কবিতা বলা খুব সহজ৷ দুনিয়া দেখেছ কতটুকু?
– যতটুকু দেখেছি ততটুকুতে না হলে, আমি পুরো দুনিয়া দেখতে প্রস্তুত৷
শাবিহা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো৷
– দেখ অয়ন। এসব বাচ্চামো ছেড়ে দাও৷ তুমি আমাদের চেনাজানা৷ ছোট ভাইয়ের মতো৷ তোমাকে এগুলোতে মানায় না৷
– আমিতো আপনাকে বোনের মতো মানিনা৷
– মানতে শেখ৷
– আপনি তো আমার আপন বোন না৷ কেন মানব?
– না মানো বোন৷ কিন্তু আমি তোমার বড় সেটার রেসপেক্ট তো করবে?
– করছি বলেই আপনার থেকে আমি এখনো একহাত দূরে দাঁড়িয়ে৷ রেসপেক্ট করি বলেই আপনি বলে সম্বোধন করছি৷ রেসপেক্ট করি বলেই এখনো আপনাকে মনের কথা বলিনি৷ আমি আপনাকে রেসপেক্ট করি৷
– বেশ ভালো৷ সেই রেসপেক্ট ধরে রেখেই এসব আজেবাজে চিন্তাভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।
– চেষ্টা করেছি৷ হয়না৷
– অয়ন!
– আপনি আমার নাম উচ্চারণ করলে শুনতে ভালো লাগে৷
– তোমার থেকে আমি চার বছরের বড়৷
– তাতে কী? বললাম তো বয়স দিয়ে মনের বিচার করা যায়না৷
– তোমাকে আমি প্রত্যেকদিন বোঝাতে আসবো না৷ শুধু বলে রাখি তোমার এসব চিন্তাভাবনা সরিয়ে ফেল, আমার ভাই জানার আগে৷
– মারবে আমাকে?
শবিহা চোখ রাঙাল৷ দ্রুত পায়ের গতিতে সেখান থেকে চলে যাচ্ছে৷ অয়ন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো৷ তারপর লাফিয়ে নিজেদের ছাদে চলে গেল৷ সেখানেই বসে রইলো৷ ছাঁদ থেকে নামলো না৷
——
অরু দেখল মোস্তফা সাহেবের রুমের দরজা খোলা৷
সে দরজা সরিয়ে মাথা ঢুকালো ভেতরে৷ মোস্তফা সাহেব চেয়ারে বসে৷ ঢুলছেন একটু একটু করে৷ মাথাটা নিচের দিক ফেলে রেখেছেন৷ সামনে মদের বোতল৷ লুকিয়ে মাঝেসাঝে খান একটু৷ অরু আলগোছে ভেতরে ঢুকলো৷ মোস্তফা সাহেব কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খুললেন৷ সোজা হয়ে বসলেন৷
– কিরে এখনো ঘুমাসনি যে?
বলতে বলতে তিনি দ্রুত মদের বোতল লোকাতে চাইলেন৷ কিন্তু অরু তাকে সেটা করতে দিলো না৷ মোস্তফা সাহেবকে চেয়ারে ঠেলে দিয়ে বললো,
– আমি উঠিয়ে রাখছি৷ বসো তুমি৷
মোস্তফা সাহেব হাসলেন৷ তার হয়তো নেশা চড়েছে৷ মাথাটা ঝিমাচ্ছে৷ কথা বলতেও বেশ কষ্ট হচ্ছে৷ একরাশ বিষন্নতা বুকে গেঁথে আছে তার৷ অরু মোস্তফা সাহেবের হাত ধরে বললো,
– তন্ময় ভাই, বড় মা’র কথা মনে পড়ছে চাচ্চু?
মোস্তফা সাহেব হাসলেন৷ চোখজোড়া খুলে বুকের বা পাশ দেখিয়ে বললেন,
– খুব ব্যথা হয় এখানটায়৷ এই ব্যথার যন্ত্রনা আজকাল সহ্য করা যাচ্ছে না রে৷
অরুর চোখজোড়া ভিজে উঠলো৷ মোস্তফা সাহেব বিরবির করতে করতে, সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছেন৷ অরু তাকে উঠিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো৷ কাঁথা দিয়ে শরীর ঢেকে ফিরতেই দেখলো শাবিহা দাঁড়িয়ে৷ মুখে হাত চেপে কাঁদছে। অরুকে ফিরতে দেখে দ্রুত বেরিয়ে গেল সেখান থেকে৷ অরু দরজা লাগিয়ে তার পিছু যেতে নিয়েও গেল না৷ নিজের রুমের দিক চললো৷ শাবিহা এখন একা থাকতে পছন্দ করবে৷ আগ বাড়িয়ে সে গিয়ে উল্টো তার কান্না বাড়িয়ে দিবে৷ তার থেকে বরং মন হালকা করুক কেঁদে৷ নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে বিছানায় উবুত হয়ে পড়লো৷ হুট করে মনে পড়লো তন্ময়ের কথা৷ আজকের খাবারের ছবি তুলেছে সে৷ সেগুলো তন্ময়কে দেখিয়ে লোভ লাগাবে৷ দ্রুত ছবি গুলো তন্ময়ের মেসেঞ্জারে পাঠাল৷ পরক্ষণেই একটি ভয়েস ম্যাসেজ পেলো৷ যেখানে গম্ভীর স্বরে তন্ময় তাকে বলল ‘ এসে থাপ্পড় মেরে দাঁত ফেলে দিব বেয়াদপ! এটা ম্যাসেজ করার সময়? ‘
অরুর ছোট মন ভালো হয়ে গেল৷ আজকাল তার মন তন্ময়ের ধমকে ভালো হয়ে যায়৷

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here