প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ১০,১১
নাবিলা ইস্ক
১০
রাতের দুটো বাজছে৷তন্ময়কে শাহজাহান বাড়িতে দেখে কিংকর্তব্যবিমুঢ় উপস্থিত সকলেই৷ তাকে দেখে সবাই খুশি হবে নাকি চিন্তা করবে বুঝে উঠতে পারছে না৷ মোস্তফা সাহেব ড্রয়িংরুমের চেঁচামেচি শুনে বেরিয়ে এলেন৷ সাথে দৌড়ে এসেছে অরুও৷ দীপ্তর ‘ তন্ময় ভাইয়া ‘ চেঁচানো শুনে অরুর ঘুম ভেঙে গিয়েছে৷ সে আপাতত ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তন্ময়ের দিক৷ সুমিতা বেগম এবং মুফতি বেগম কি রেখে কি করবেন দিশে পাচ্ছেন না খুঁজে৷ রান্নাঘরে ঢুকে চায়ের পানি বসিয়ে দিয়েছেন দ্রুত৷ তন্ময় এসেই হাতের সব ডক্যুমেন্টস পেপার্স টি-টেবিলে ছুঁড়ে মারল৷ মোস্তফা সাহেব তখন টি-টেবিলের সামনেই৷ এসব ডক্যুমেন্টস দেখে তিনি কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন৷ ছেলে তার নিশ্চয়ই কোম্পানির আপ-ডাউন সম্পর্কে জেনেছে। শান্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসলেন৷ ছেলের চোখে চোখ না রেখে বললেন,
– বিজনেস নদীতে ভেসে যাক৷ তাতে তোমার কী? তোমার তো কিছু না! বাবার অল্পকিছু কথাতেই রেগে কোম্পানি ছেড়েছ৷ তোমার মা আমার কিছু কথায় ঘরবাড়ি ছেড়েছে৷ ভালো কথা! এখন কোম্পানি ভেসে যাক, ঘরবাড়ি উড়ে যাক৷
তন্ময় উলটোদিকের সোফায় বসেছে৷ ডক্যুমেন্টস গুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মোস্তফা সাহেবের দিক এগিয়ে দিয়ে বলল,
– দাদার একটা কথায় তুমি শহর ছেড়েছিলে৷ আমিতো শুধুমাত্র কোম্পানি ছেড়েছি৷
– এখন তুমিও কী শহর ছাড়তে চাচ্ছ নাকি?
– আমার বাবার মতো অতটা চাইল্ডিশ আমি নই৷
আনোয়ার সাহেব মুখ চেপে হেসে উঠলেন৷ মোস্তফা সাহেব চোখ রাঙাতেই চেহারা শক্তপোক্ত করার মিথ্যে চেষ্টা করলেন৷ তন্ময় বলল,
– যোগ্যতা প্রমাণ করতে বলেছ৷ যোগ্যতা প্রমাণ করে দিলাম৷ তোমার টাকাপয়সা, দামী গাড়ি ব্যবহার না করে চলতে পেরেছি ৷ অন্যের কোম্পানিতে চাকরিও করতে পেরেছি৷
তারপর ডক্যুমেন্টের ফ্রোন্ট পেইজ মেলে দিয়ে পুনরায় বলল,
– এসব কিছুর লিস্ট আমার চাই৷ গতকালেরর মধ্যে উল্লেখ্য সবগুলো কর্মচারীকে ডিসমিস করে দিবে৷ একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং বসাবে, বাকি কথা আমি কালই বলবো৷ শুভ রাত্রি!
তন্ময় উঠে চলে যাচ্ছে৷ সুমিতা বেগম পিছু
ডাকল,
– তন্ময়!
– মা আমার জন্য অপেক্ষা করছে এক্ষুনি ফিরতে হবে চাচী!
তন্ময় বেরিয়ে গেল৷ মোস্তফা সাহেব তখনো বসে৷ ডক্যুমেন্টসের দিক তাকিয়ে৷ ওহী সাহেব ভাইয়ের পাশে বসলেন। বড়ো ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখতেই, মোস্তফা সাহেবের কাঁধ কাঁপা উপলব্ধি করতে পারলেন৷ মোস্তফা সাহেব তখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না, ছেলের কথাগুলো। ছেলের এসব কথাবার্তা বা কাজ একটা দিকে ইশারা করছে, তার ছেলে কাল থেকে নিজেদের কোম্পানিতে ফিরে আসবে৷ ওহী সাহেব হাসিমুখে বললেন,
– আমি ফ্ল্যাটের লোকেশন দিয়ে, তন্ময়ের ম্যানেজারকে বলে দিচ্ছি গাড়ির চাবি নিয়ে সকালে পৌঁছে যেতে?
মোস্তফা সাহেব মাথা দোলালেন৷ আনোয়ার সাহেব বললেন,
– এইভাবে একদিন বাড়িতেও ফিরে আসবে ভাই৷ আপনি চিন্তা করবেন না৷
মোস্তফা সাহেব তো তাই চান৷ সেদিনের ভুলের মাসুল তো দুবছর ধরে গুনছেন৷ আর কতো? আর পারছেন না তিনি৷ ছেলে, স্ত্রী ফিরে আসুক, আপাতত শুধু এটাই তার চাওয়া৷
অরু তখনো দরজার দিক তাকিয়ে৷ ভ্যালেন্টাইন্সের সুন্দরতম তার তন্ময় বেশিদিন টিকলো না, আহারে!কয়েকদিন আগে আবেগে আপ্লূত হয়ে কল দিয়েছিল বলে খুব বড়সড় ধমক খেয়েছে তন্ময় থেকে৷ ধমকে ধমকে অরুকে শেষ করে দিয়েছিল। অভিমানে সে আজ দুদিন তন্ময়কে কল দেয়নি৷ কিন্তু তিনদিনের বেলায় ঠিকই কল দিয়ে কান্নাকাটি করে ভাসিয়ে ফেলল৷
– একটু কথা বললে কী হয়?
– অনেক কিছু হয়৷
– যখন মেয়ে ফ্রেন্ডসদের সাথে কথা বলেন, তখন কেন কিছু হয়না!
– কারণ তারা মেয়ে ফ্রেন্ডস৷
– আপনার কাছে কার গুরুত্ব বেশি?
– আপাতত কাজের গুরুত্ব বেশি৷ ফোন রাখ৷
– আমারও তো পড়াশোনা আছে৷ আমি আমার পড়াশোনা থেকে আপনাকে বেশি গুরুত্ব দেই৷
– দে না করেছে কে!
– তাহলে আপনি আমাকে কেন গুরুত্ব দেন না! আমি একাই কেন আপনার এতো গুরুত্ব দেই! আপনাকে নিয়ে এতো ভাবি কেন! আপনি আমাকে একটুও পছন্দ করেন না৷ আমাকে নিয়ে একটুও ভাবেন না৷
অরু নিজের কন্নার শব্দে তন্ময়ের মিষ্টি হাসির শব্দ মিস করে গেল৷ সে শুধু শুনল,
– ফোন রাখ৷
তন্ময় যেমন অরুর কান্নাকাটি শুনেনা৷ তেমন ভঙ্গিতে কল কেটে দিল৷ তারপর মাসখানেকের মধ্যে কলেজ পোগ্রাম শুরু হয় অরুর৷ প্রোগ্রাম শেষ করেই ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের টেস্ট শুরু হয়ে গিয়েছে তার৷ পড়াশোনার চিন্তাভাবনা মাথায় গেঁথে আছে দেখে, তন্ময়ের চিন্তাভাবনা নিতে পারছেনা৷ তাই ডিসিশন নিয়েছে কিছুদিন তন্ময়কে কল, ম্যাসেজ করে বিরক্ত করবেনা৷ এভাবেও সে খেতে নিলে বা পড়াশোনায় ডুবলে পৃথিবীর সবকিছু ভুলে যায়৷ এমনকি তন্ময়কেও৷ কাল অরুর হায়ারম্যাথমেটিকসের এক্সাম৷ সন্ধ্যায় বইখাতা নিয়ে দৌড় লাগিয়েছে তন্ময়ের বাসায়৷ কলিং বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে৷ আসায় আছে জবেদা বেগম দরজা খুলে দিবে৷ কিন্তু তার সামনে স্বয়ং তন্ময় দাঁড়িয়েছে৷ তন্ময়কে দেখে অরু অবাক হলো বটে৷ কিন্তু তার অবাক হওয়ার সময় নেই৷ সে তন্ময়কে সরিয়ে গটগট করে ঢুকে গেল ভেতরে৷ টেবিলে বইখাতা বিছিয়ে বসে পড়ল৷ যেসব ম্যাথ সে বুঝতে পারছেনা খোলাখুলি তুলে ধরলো তন্ময়ের সামনে৷ কিন্তু তন্ময়ের জবাব নেই৷ জবাব নেই কেন? অরু চিন্তিত ভাবে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল৷ তন্ময় বুকে দুহাত পেঁচিয়ে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে৷ অরু ডাকল,
– ভাইয়া?
তন্ময়ের কাঁটা গায়ে যেমন নুনের ছিঁটে লাগলো৷ ছ্যাত করে উঠে অরুকে চোখ রাঙিয়ে হনহনিয়ে চলে গেল৷ আশ্চর্য! অরু বই হাতে তার পিছু ছুটেছে৷ দ্রুত ছুটতে গিয়ে পিছলে পড়তে নিয়ে, পেছন থেকে তন্ময়ের টি-শার্ট টেনে ধরলো৷ ছিঁড়ে যাবার মতো শব্দ হলো মুহুর্তেই৷ অরু দ্রুত ছেড়ে দিলো টি-শার্ট৷ বোকার মতো চোখমুখে আতঙ্কের ছাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো৷ ছেঁড়া টি-শার্ট পরিহিত তন্ময় অরুর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে৷ মুখের সামনে ঝুকে প্রশ্ন করলো,
– আমাকে ফ্রী পেয়েছিস?
– না তো!
– যখন তখন আমার কাপড়চোপড় ছিঁড়ে ফেলিস, ভিজিয়ে দিস৷ এখানে সেখানে ধরিস৷ সেইম টু সেইম আমি করলে কেমন হবে?
– শোধবোধ হবে৷ আমি কি পানি নিয়ে আসবো?
তন্ময় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চলে গেল৷ অরু আশেপাশে নজর বুলিয়ে খেয়াল করলো জবেদা বেগম কোথাও নেই৷ অরু উচ্চস্বরে ডাকতে
লাগলো,
– বড়ো মা? ওই বড়ো মা!
জবাব না পেয়ে, অরু ভয় পেয়ে বলল,
– বড়ো মা কোথায়? দেখছি না কেন? বাইরে গেছে বুঝি?
তন্ময়ের জবাব নেই৷ অরুর একটু খটকা লাগলো৷ তন্ময়ের নিশ্চয়ই মেজাজ ভালো নেই৷ রেগে আছে লোকটা৷ রেগে থাকলেই এমন নিশ্চুপ থাকে এবং জবাব দেয়না। অরু সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ৷ অনেকগুলো ইম্পর্ট্যান্ট ম্যাথম্যাটিকস বুঝতে পারছেনা। ভেবেছে তন্ময় থেকে বুঝবে তাই বাসার শিক্ষককে আসতে বলেনি৷ এখন তো মনে হচ্ছে আসতে বলতে হবে৷ অরু আবারো দৌড় লাগালো টেবিলে৷ বইপত্র গুঁছিয়ে নিলো৷ সে এখন বাড়িতে গিয়ে চাচ্চুকে বলবে, তার হোম টিচারকে এক্ষুনি আসতে বলতে৷ ম্যাথম্যাটিকস যতটুকু পারবে বুঝিয়ে দিবে৷ অরু বেশকিছু ম্যাথম্যাটিকস কভার করে ফেলেছে৷ তাড়াহুড়ো করে বেরোতে গিয়ে, চেঁচিয়ে উঠলো৷ হুট করে ইলেকট্রিসিটি চলে গেল৷ অন্ধকারে অরু ভীষণ ভয় পায়৷ বলা যায়, তার ফোবিয়া আছে অন্ধকারে৷ বইপত্র ফেলে দৌড় লাগালো অন্ধকারের মধ্যে৷ সামনে যা পেয়েছে সেটাই জাপ্টে ধরলো৷
– তন্ময় ভাইয়া লাইট কীভাবে গেল?
– আমি কীভাবে বলবো?
– দেখেন না কেন গেল! আমি ভয় পাই৷
– পেতে থাক৷
– মানে? কথা বলেন না কেন! আমি কিন্তু..
– কিন্তু, কী করবি?
অরু ভয়ে একপ্রকার তন্ময়কে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে,
– কিছুই করবো না৷ আপনি প্লিজ দেখেন না কি হইছে! নাহলে দরজাটা খুলে দেন, আমি বাসায় যাবো৷
– যা ধরেছে কে তোকে!
– অন্ধকারে কিভাবে যাবো? আপনার মোবাইলের ফ্ল্যাসলাইট ওন করেন না৷
– করবো না৷
তন্ময়ের ত্যাড়াত্যাড়া কথা শুনে অরুর গলা শুকিয়ে কাঠকাঠ৷ আচমকা তার গাল চেপে ধরলো তন্ময়৷ ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো অরু৷ এতো শক্তি দিয়ে ধরেছে যে তার চোখজোড়া ভিজে উঠেছে৷
– আমি কিন্তু কেঁদে দিব।
– কেঁদে দে৷
– আমি কিন্তু হাঁচি দিব৷
– দে৷
নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
– দেখুন না লাইট ফাইট আছে নাকি কোথাও!
-ছাড় আমাকে৷ দেখি গিয়ে!
– না না আমি ভয় পাই৷ এভাবেই চলুন৷
দিশেহারা অরু অনুভব করলো তন্ময় ঠাঁই দাঁড়িয়ে৷ তাকে যেতে না দেখে অরু বলল,
– কি হলো? চলুন!
– তোকে কল দিয়েছিলাম, ধরিস নাই কেন?
– আমার ফোন তো বড়ো চাচ্চু নিয়ে গেছে৷ পরিক্ষা শেষ না হওয়া অবদি আর দিবেনা৷
তন্ময়ের জবাব এলো না৷ হঠাৎ তন্ময় তাকে ছেড়ে চলে গেল৷ অরু চিৎকার চেঁচামেচি করবে এর পূর্বেই ইলেকট্রিসিটি চলে এলো৷ বুকে থুঁ থুঁ ছিটিয়ে অরু আশেপাশে তাকাল৷ ভয়ে তার কলিজা শুকিয়ে গিয়েছিল৷ তন্ময় ফিরে এসে বলল,
– যা টেবিলে বোস!
অরু দ্রুত পায়ে টেবিলে গিয়ে বসলো৷ তন্ময় এসে তার পাশে বসেছে৷ অরু নিজেকে পড়াশোনায় ডুবাতে তৈরি৷ হুট করে তার চোখ গেল তন্ময়ের গলায়৷ লোকটার গলার মধ্যে উঁচু হয়ে আছে৷ এটাকে যেনো কী বলে? কলারবোন? দেখতে খুব আকর্ষণীয় লাগছে৷ ইচ্ছে করছে ধরতে৷ অরু নিজের হাত জোড়া গুটিয়ে ফেললো৷ ওটা ধরলে তন্ময় তাকে জিন্দা মাটিতে পুঁতে দিবে৷
– এভাবে হবে, বুঝেছিস?
তন্ময়ের কন্ঠে ভড়কে গেল অরু৷ বাজে চিন্তাভাবনায় বিভোর সে ম্যাথে মনোযোগ দেয়নি৷ তাহলে বুঝবে কীভাবে? নিজেকে মনেমনে বকাঝকা করে ভয়েভয়ে বলল,
– আরেকবার বুঝিয়ে দিবেন?
তন্ময় তার হাতের কলম ফেলে দিলো৷ চেয়ারে হেলান দিয়ে দুহাত বুকে গেঁথে তাকিয়ে রইলো৷ যেমন অরুকে খেয়ে ফেলবে৷ চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে এক্ষুনি৷ চোখ পিটপিট করে অরু ধীরে বলল,
– আপনি আমাকে কেন কল করেছিলেন?
– তোর কি মনে হয়? কেন করেছি?
– বকাঝকা করতে?
– থাপড়ে দাঁত ফেলে দিতে৷
– কল করে দাঁত ফালানো যায় নাকি?
– সামনে আছিস ফেলে দেখাব?
– না না৷
গম্ভীর স্বরে তন্ময় বলল
– চুপচাপ মনোযোগ দে!
অরু রোবটের মতো মাথা দোলাল৷
——-
শাবিহার ইদানীং অয়নের আপনি বলাটা পছন্দ হয়না৷ মনে হয় সে খুব বড় অয়নের৷ হ্যাঁ অবশ্যই শাবিহা অয়নের বড়, তাই বলে কী বারবার মনে করিয়ে দিয়ে, কাঁটা গায়ে নুনের ছিঁটে দিবে নাকি?
আজকাল অয়নকে দেখা যায়না। খুব ব্যস্ত হয়ে গেছে৷ শুনেছে অয়ন তার বাবার বিজনেসে হাত লাগিয়েছে৷ কিছুদিন আগে চট্রগ্রাম গিয়েছে সেখানকার বিজনেসের ফিন্যান্সিয়াল অবস্থা দেখতে৷ এখনো ফেরেনি৷ শাবিহা স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে বারবার চারপাশে নজর দিচ্ছে৷ যেমন উড়ে অয়ন তার সামনে উপস্থিত হবে৷ বাড়িতে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসেছে৷ ফোনে বেশ কয়েকবার নজর দিলো৷ অয়ন কখনো ফোনে কল করেনি৷ বলা যায় তাদের কখনো ফোনে কথা হয়নি। সবসময় সামনাসামনি কথা হয়েছে৷ কিন্তু তার মন বলছে আজ অয়ন কল করবে৷ এবং মনের কথা সত্যি হয়ে অয়নের কল চলে এলো৷ দরজা লাগিয়ে সময় নিয়ে কল ধরলো শাবিহা৷ খুবই নার্ভাস সে৷ অয়নের সাথে কথা বলতে গেলেই এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়৷ লজ্জা, সংকোচ ঝেঁকে ধরে তাকে৷ বারবার মনে করিয়ে দেয় অয়ন তার ছোট৷ সে অয়নের বড়ো৷ আর এই সম্পর্ক ভীষণ লজ্জাজনক৷ মানুষ হাসবে তার উপর, তাকে কথা শোনাবে৷ এই বিষয় গুলো মস্তিষ্কে এলে কিছুই আর ভালো লাগেনা শাবিহার। ওপাশ থেকে অয়নের গভীর স্বর,
– শাবিহা!
– হু৷
– খেয়েছেন?
শাবিহা মিথ্যে বলে দিল,
– হ্যাঁ৷
– সত্যি? মাত্র আটটা৷ আপনি তো এতো তাড়াতাড়ি ডিনার করেন না।
– আজ করেছি৷
– মেনে নিলাম তাহলে৷ আমাকে মিস করছেন?
অয়নের স্বরে দুষ্টুমির আভাস৷ শাবিহা বলল,
– না৷ মিস করছি না!
– প্রয়োজন নেই৷ আমিতো আপনাকে ভীষণ মিস করছি৷ এবং হাড়েহাড়ে উপলব্ধি করছি আগেকার রাজাদের কষ্ট৷ শুনেছি তাদের খুবই কষ্ট হতো সুন্দরী স্ত্রী ফেলে নিজের রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে ভ্রমণে যেতে৷ আমিতো ভাই এক শহর থেকে আরেক শহরে গিয়েই পাগল হয়ে গেছি৷
শাবিহার ঠোঁটে চলে এসেছিল, ‘ আমি কি তোমার স্ত্রী নাকি? ‘ কিন্তু সেটা ভাবতেই ভীষণ লজ্জা পেল৷ তাহলে বলবে কীভাবে? এই বিষয়ে কথা বলা অসম্ভব৷ পারবেনা সে৷ বরং বলল,
– তোমার কাজ নেই?
– আছে তো৷ কিন্তু কাজের থেকে আপনি বেশি ইম্পর্ট্যান্ট৷
– রাখি!
– না একদম না৷ আপনাকে কতটা মিস করছি জানেন?
শাবিহা চুপ হয়ে রইলো৷ অয়ন হেসে বলল,
– আপনার জন্য কি আনব? কী চাই আপনার শাবিহা?
– কিচ্ছু না৷
– শুনেছি আপনার নুপুর খুব পছন্দ!
– একদম না৷
– তাহলে কানের দুল?
– না৷
– নাকফুল?
– অয়ন!
অয়ন হো হো করে হাসছে৷ পরপরই শোনা গেল একজন গম্ভীর স্বর৷ যেমন কেউ ওপাশ থেকে অয়নকে ডাকল৷ অয়ন বলল,
– ডাকছে৷ রাখি এটি হ্যাঁ?
– আচ্ছা৷
কল কাটার পূর্বে অয়ন বলে গেল,
– আম মিসিং ইউ অ্যা লট!
ফোনের দিক তাকিয়ে রইলো শাবিহা৷ মনপ্রাণ, মস্তিষ্ক শরীর সবকিছু হালকা লাগছে৷ একটা চাপা কষ্ট গায়েব হয়ে গিয়েছে বুক থেকে৷ এখন শুধু ভালোলাগা বিরাজমান৷ শাবিহার ভাবতেও লজ্জা লাগে, অতটুকু ছেলের প্রেমের কথায় সে অনুভূতি পায়৷ ভালোলাগায় মন ছেয়ে যায় তার৷ অয়ন কি জানে সে কতটা দুর্বল করে ফেলেছে শাবিহাকে? শাবিহা ঠিক কতটা তাকে নিয়ে ভাবে জানে? কতটুকু অনুভূতি অনুভব করে আন্দাজ আছে ছেলেটার?
চলবে
প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ১১
__________________________
শাবিহা এজ ইউজুয়ালি বাস স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়িয়ে৷ কিছুক্ষণ আগেই অফিস থেকে বেরিয়েছে। আপাতত বাসের অপেক্ষায়৷ সেলফোন হাতে নিয়ে কয়েকবার চেইক করেছে৷ নো মিসডকলস ওর নো ম্যাসেজেস! অয়নের সাথে তার গত বৃহস্পতিবার কথা হয়েছে৷ এবং আজ বৃহস্পতিবার। সাতদিন ধরে তাদের কথা হয়না৷ শাবিহা নিজের মস্তিষ্ককে হারিয়ে মনের কথা শুনে যেচে একটা কল দিতে পারছেনা৷ অবশ্য সে শতসহস্র বার একটা কল দেবার চেষ্টা করছে৷ কিন্তু তার দ্বারা সম্ভব হচ্ছেনা৷ কিছু একটা তাকে বাঁধা দিয়ে চলেছে৷ হয়তো তার বিবেক। এখনো শাবিহার মনে হয়, অয়ন সম্ভবত কিছুদিন পর নিজের খামখেয়ালীপনা শুধরে নিয়ে দূরে চলে যাবে৷ তাই যথাসম্ভব নিজেকে আঁকড়ে রেখেছে৷ অতল সাগরের গভীরে নিজেকে ভাসতে দিচ্ছে না৷ সামনে বাস এসে থেমেছে৷ শাবিহা উঠে গেল তাতে৷ জানালার সাইডে এসে বসলো৷ সুন্দর বাতাস বইছে৷ আজকের ওয়েদার বেশ রোমান্টিক৷ কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিয়ে আনমনে তাকিয়ে রইলো৷ বাস চলছে, বাতাস বইছে৷ বাস চড়তে শাবিহার সর্বদাই ভালো লাগে৷ ভালোলাগার বিশেষ কারণ জানালার পাশের সিট, এবং দুর্দান্ত বাতাস অনুভব করা৷ হুট করে চোখ গেল নিচে৷ বাসের পাশ দিয়ে একটা বাইক যাচ্ছে৷ বাইকটা একদম তার দিকটাই ফলোআপ করছে৷ একপর্যায়ে হেলমেটের মুখের সামনের কাচটা সরিয়ে মুখ তুলে তাকাল অয়ন৷ হাতের ইশারায় শাবিহাকে নামতে বলছে বাস থেকে৷ শাবিহা কানের ইয়ারফোন খুলে বেক্কলের মতো তাকিয়েই রইলো ৷ অয়ন এবার শব্দ করে চেঁচিয়ে বললো,
– নেমে আসুন!
শাবিহা দ্রুত উঠে দাঁড়ালো৷ হেল্পারকে বললো সে এখানেই নেমে যাবে, বাস থামাতে৷ বাস থামতেই নেমে আসলো৷ অয়নও নিজের বাইক সাইড করে থামিয়েছে৷ শাবিহা এগিয়ে আসতেই অয়ন
বললো,
– এতটা তাড়াহুড়ো করে এসেও আপনাকে বাস স্ট্যান্ডের সামনে পেলাম না৷ আপনার বাসটা ধরতে কতটা পরিশ্রম করেছি জানেন?
হেলমেট খুলে অয়ন বাইক থেকে নেমে এলো৷ শাবিহা বেশ কয়েকবার তাকিয়েছে অয়নের পানে৷ এক সপ্তাহ না দেখেই তার মনে হচ্ছে অয়নকে সে বছর বছর ধরে দেখেনি৷ চোখের সামনে অয়নকে হেসে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শাবিহার মনে হলো, সে সপ্তাহ খানিক ধরে এই দৃশ্যটি দেখার জন্য অপেক্ষায় ছিল৷ ঠিক অয়নের অপেক্ষায় ছিল৷ অয়ন দুষ্টু হাসি এঁকে বলল,
– আমাকে দেখে ইমোশনাল হয়ে পড়লেন নাকি শাবিহা? কান্না পাচ্ছে? আপনি কান্না করতে চাইলে কিন্তু করতে পারেন৷ আমার কাঁধ, বুক সব আপনার জন্য ফ্রি৷ আপনি ইউস করলে মাইন্ড করবো না৷ আমার কাছে আবার রুমালও আছে৷ চোখের পানি মুছিয়ে দিতে পারব৷
শাবিহা জবাব দিলো না৷ তবে তার ঠোঁট জুড়ে হাসি বিচরণ করছে৷ অনুভূতির সাথে একটা অদ্ভুত ইচ্ছে জেগেছে মনে৷ অয়নকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে৷ সেদিনের বৃষ্টির রাতের মতো৷ শাবিহার চোখে এখনো স্পষ্ট ভেসে উঠে সেদিনের দৃশ্য। অয়নের শান্ত কথাগুলো, তাকে আগলে ধরে রাখা, মাথায় ধীরে ছুঁয়ে চলা। শাবিহা চায় অয়ন তাকে আরেকটি বার ওভাবেই জড়িয়ে ধরুক৷ হুট করে অয়ন শাবিহার গালে স্পর্শ করল। তখনকার দুষ্টু হাসি এখন আর নেই৷
– কী হয়েছে? খারাপ লাগছে?
শাবিহাকে মাথা দোলাতে দেখে চিন্তিত সুরে অয়ন বলল,
– কোথায়? মাথা ঘুরছে? দুপুরে খেয়েছিলেন?
শাবিহার মনে পড়লো সে আজ লাঞ্চ করেনি৷ সকালের পর থেকে এখনো কিছু খায়নি৷ জবাব না পেয়ে অয়ন বলল,
– বাইকে চড়তে পারবেন তো? সামনেই রেস্টুরেন্ট একটা!
শাবিহা উঠে বসলো বাইকে৷ অয়ন হেলমেট পড়ে বাইক স্টার্ট করেছে৷ শাবিহা নিজের দু’হাত অয়নের দুকাঁধে রেখেছে৷ আনমনে দেখে চলেছে অয়নের কাঁধে রাখা তার হাত দুটো৷
—–
তন্ময়ের নানী বাড়ির লোকজন যে হুট করে সিলেট থেকে চলে আসবে, কে জানে? মুফতি বেগম তাড়াহুড়ো করে তাদের ড্রয়িংরুমে বসিয়েছেন৷ বাড়িতে কেউ নেই তিনি আর সুমিতা বেগম ছাড়া৷ কী করবেন এখন? কীভাবে সামাল দেবেন সবকিছু? জবেদা বেগম আর তন্ময় যে আলাদা থাকে, তা তো তারা জানেন না। জানলে তুমুল ঝগড়া হবে৷ পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র আদরের বোন জবেদা বেগম৷ যদি শুনে সেই আদরের বোন ঘরবাড়ি ছাড়া থাকে, সবকিছু উলটপালট করে দিবে৷ দেখা যাবে সম্পুর্ন শাহাজাহান বাড়ি ভেঙে গুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে গেছে৷ মুফতি বেগম আঁড়চোখে সুমিতা বেগমকে ইশারা করলেন৷ সুমিতা বেগম আড়াল হয়ে ভেতরে এলেন৷ দ্রুত কল করলেন আনোয়ার সাহেবকে৷ খুলে বললেন সবকিছু৷ শুনে আনোয়ার সাহেবও দোটানায় পড়লেন৷ কিছু একটা করবেন বলে কেটে দিলেন৷ এদিকে আজ শাহজাহান বাড়ি এসেছে তন্ময়ের নানী জয়তুন নেছা৷ এবং তন্ময়ের বড়ো মামামামী এবং ছোট মামা মামী, সাথে তাদের ছেলেমেয়েরা তো আছেই৷ জয়তুন বেগম বারবার তার মেয়ে এবং নাতি-নাতনীর কথা জিজ্ঞেস করে চলেছেন৷ মুফতি বেগম বানিয়ে বললেন,
– তন্ময় তো অফিসে৷ শাবিহা এক্সাম দিতে গিয়েছে৷ ভাবী একটু বেরিয়েছে! সবাইকে কল করেছি, এক্ষুনি চলে আসবে৷
জয়তুন বেগম বিড়বিড় করে বললেন,
– আমার ছানাটাকে কল করে আসা উচিত
ছিলো৷
তিনি চশমা ভালোভাবে পড়ে নিজের বাটন ফোন ঝুলি থেকে বের করলেন৷ খুঁজে খুঁজে নিজের নাতির নাম্বারে ডায়াল করলেন৷ রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ হয়নি৷ নাতি তার ব্যস্ত ভেবে দ্বিতীয় বার কল করলেন না৷ এরমধ্যে সুমিতা বেগম তাদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন৷ টি-টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে তাদের সামনে বসেছে৷ গল্পসল্পের মাধ্যমে তাদের ব্যস্ত রাখার অমায়িক প্রচেষ্টা চলছে৷ আধঘন্টার মাঝে মোস্তফা সাহেব এবং আনোয়ার সাহেব চলে আসেন। বাড়িতে ঢুকেই সালাম জানালেন। জয়তুন বেগম সালামের জবাব দিলেন৷ তারপর কড়াকড়ি দৃষ্টিতে মোস্তফা সাহেবকে পা থেকে মাথা অবদি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে
বললেন,
– এমন শুঁকিয়ে গেছ কেন বাবা? তোমার বউ বাচ্চা তোমাকে ছেড়ে চলে গেলে না এমন শোঁকালে কাজে দিবে৷
মোস্তফা সাহেব কেশে উঠলেন। শ্বাশুড়ির খোঁচা মেরে কথা বলার অভ্যাস আর গেল না৷ তার ছেলেটা ঠিক তার নানির মতো হয়েছে৷ স্বভাবও ঠিক তার মতো পেয়েছে৷ দুজন একই নৌকার মাঝি৷ ঘুরেফিরে এটাসেটা নিয়ে খোঁচাবে মোস্তফা সাহেবকে৷ তিনি এগিয়ে এসে উল্টো পিঠের সোফায় বসলেন৷ প্রশ্ন করলেন,
– আসতে সমস্যা হয়নি তো মা?
– এখান থেইকা এখানে আসতে আবার কীসের সমস্যা।
– শরীর ভালো আছে?
– হু৷ শরীর ভালো দেইখাই তোমার উপর নজর দিতে আইলাম৷ তা কই আমার ছানা? দেখিনা কে?
মোস্তফা সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন৷ শ্বাশুড়িকে সত্যিইটাই বলতে হবে৷ কতক্ষনই বা লুকিয়ে রাখতে পারবেন সবকিছু৷ আজ নাহয় কাল তো জেনেই যাবে৷ নিজেকে প্রস্তুত করছেন সবকিছু সত্যি বলার জন্য। নিজের উপর সম্পুর্ন দোষ নিয়ে নিবেন৷ অবশ্য বেশিরভাগ দোষ তারই।
– আসলে মা…
এমন সময় গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল৷ পরপরই তন্ময় দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকছে৷ আশ্চর্যজনক ভাবে পেছনে জবেদা বেগম৷ তাদের দেখে চমকে সম্পুর্ন শাহাজাহান পরিবার৷ মুফতি বেগমের নয়ন জোড়া ছলছল করছে৷ দৌড়ে ভাবীকে ধরতে যাবে পূর্বেই সুমিতা বেগমের টান অনুভব করলেন৷ নিজেকে সামলে পরপরই আলগোছে রান্নাঘরের দিক ছুটলেন৷ এখানে থাকলে তিনি সবকিছু নিজের আচার-আচরণেই বুঝিয়ে দিবেন৷ এদিকে মোস্তফা সাহেব ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছেন নিজের স্ত্রীর দিক তারপর ছেলের দিক৷ তন্ময় আপাতত জয়তুন বেগমের কোলে মাথা
রেখে আছে৷ জয়তুন বেগমের চিন্তিত ভ্রু জোড়া শান্ত হয়ে গেল৷ মনের খটকা গুলো নিমিষেই মিশে গিয়েছে৷ নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
– এমন শুঁকাই গেলি কেমতে?
– তুমি আসছ না! এখন মোটাতাজা করে দিয়ে যাবা৷
– তা আর বলতে।
তন্ময়ের মামা আফরিন সাহেব পাশেই বসে৷ গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বললেন,
– মা বেড়াতে এসেছেন কিছুদিনের জন্য৷ তিনি মেয়ে-মেয়ের জামাই, নাতি-নাতনীদের মিস করছিলেন৷ নিয়ে আসলাম শত ব্যস্ততার মধ্যে৷ কিন্তু এখন আমাদের ফিরতে হবে! বাড়িতে সবকিছু ফেলে এসেছি৷
মোস্তফা সাহেব তাদের থাকার জন্য বলেছেন অনেকবার৷ কিন্তু থাকতে পারবেন না জানালেন৷ কাজকর্ম পড়ে আছে বাড়িতে, সেখানে তাদের প্রয়োজন৷ অগ্যত মোস্তফা সাহেব এবং তন্ময় বেরিয়ে এসে তাদের গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছে৷ গাড়ি চোখের সামনে থেকে যেতেই তন্ময়ের দিক ফিরলেন মোস্তফা সাহেব৷ কিছু বলতে চান কিন্তু বলে উঠতে পারছেন না৷ আসলেই তার প্রত্যাশার বাইরে সবকিছু ঘটেছে৷ কল্পনাও করতে পারেননি তন্ময় আর জবেদা বেগম এভাবে চলে আসবে৷ ভেতরে যেতে নিয়ে তন্ময় বলে গেল,
– কয়েকদিনের সুযোগ আছে মিটমাট করে নাও৷ নানী চলে গেলে মা ফিরতে চাইলে কিন্তু আমি তাকে মানাবো না৷ ফিরিয়ে নিয়ে যাবো৷
মোস্তফা সাহেব কিছুক্ষণ থমকে রইলেন৷ ছেলের কথাগুলো বুঝতে পেরে, পরপরই নিঃশব্দে হেসে উঠলেন৷ সুখময় অনুভূতিতে বুক ভরে উঠছে তার৷ সন্তান, স্ত্রী বাড়িতে আছে ভাবতেই আনন্দে তার চোখজোড়া ভিজে উঠেছে৷ নিজেকে সামলে নিয়ে, তন্ময়ের পেছনে তিনিও ভেতরে এলেন৷ জবেদা বেগম নিজের মায়ের পাশে বসে৷ জয়তুন বেগম মেয়ের চোখমুখ ছুঁয়ে বলছেন,
– মুখটা এমন শুঁকিয়ে কেন!
দীপ্ত সোফার পেছন থেকে বলল,
– তোমাকে দেখে মুখ শুঁকিয়ে গেছে বড়ো মায়ের৷
হাসির ছড়াছড়ি পড়ে গেল ড্রয়িংরুমে৷
——
অরু মাত্র নিজের রুম থেকে বেরিয়েছে৷ সে ঘুমিয়ে ছিলো কলেজ থেকে ফিরে৷ তাই ড্রয়িংরুমের হাসাহাসির কারণ জানেনা৷ উঁকিঝুঁকি মেরে তন্ময়কে দেখে স্তব্ধ খেয়ে গেল৷ তারপর তার চোখ গেল সোফায় বসে থাকা জবেদা বেগমের উপর৷ তারপর গেল জয়তুন নেছার উপর৷ আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত তারা৷ অরু নিজের দিক তাকাল। চুল এলোমেলো৷ কাপড়চোপড় কুঁকড়ে আছে৷ সে তাড়াতাড়ি ওয়াশরুম ছুটেছে৷ ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে দেখল ড্রয়িংরুমে কেউই নেই। রান্নাঘরে গিয়ে প্রথমে সুমিতা বেগমকে প্রশ্ন করলো,
– কি হয়েছে মা?
সুমিতা বেগম সবকিছু খুলে বললেন৷ বলতে বলতে তিনি রাতের রান্না বসিয়ে দিয়েছেন৷ কিছুক্ষণ আগেই ওহী সাহেব বাজারে গিয়েছেন৷ জয়তুন বেগমের পছন্দের সবকিছু রান্না হবে আজ৷ আর রান্না অবশ্যই জবেদা বেগম করবেন৷ করতে না চাইলেও তাকে দিয়ে জোরপূর্বক রান্না করাবেন৷ অরু বলল,
– তারমানে তন্ময় ভাই, বড়ো মা এখন থেকে বাড়িতেই থাকবেন?
– যতদিন তোর নানি আছে ততদিন থাকতে বাধ্য৷ তারপর নাহয় আমরা আটকে রাখার চেষ্টা করবো৷
– ঠিক বলেছ মা৷ এবার তাদের বেরোতেই দিব না।
– তন্ময়ের জন্য কফি বানিয়েছি৷ দিয়ে আয়! ছেলেটা আমার হাতের কফি খায়না বছর হয়ে
গেল৷
অরু কফি হাতে উপরে উঠে এলো৷ তন্ময়ের তালা মারা রুম আজ খোলা৷ লোকটা নিশ্চয়ই ভেতরে? অরু পা টিপে টিপে উঁকিঝুঁকি দিলো! বুক ধুকপুক করছে ভীষণ ভাবে৷ আনন্দে বাকরুদ্ধ হয়ে বসেছে হৃদয়৷ আবারো তন্ময় আর সে একই ছাঁদের নিচে বসবাস করবে, ভাবতেই অরুর শ্বাস আটকে আসছে৷ পেছন থেকে শব্দ শুনে কেঁপে উঠলো৷ হাতের কফিটাও পড়ে যেতে নিচ্ছিলো ভয়ে৷ বুকে থু থু ছিটিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো৷ তন্ময় ভ্রুক্ষেপহীন ভঙ্গিতে তার দিক তাকিয়ে,
– উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিস কেন?
– আপনার জন্য কফি!
তন্ময় কফিটা নিয়ে নিজের রুমে ঢুকে গেল৷ অরু ঢোকার অনুমতি না পেয়ে মাথাটা ঢুকিয়ে দেখতে লাগলো৷ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রুম৷ ঠিক যেমনটা তন্ময় থাকলে থাকতো৷ মোস্তফা সাহেব তো প্রতিদিন কাজের লোক দ্বারা রুমটা পরিষ্কার করিয়ে রাখেন৷ আজও সকালে পরিষ্কার করানো হয়েছিলো৷ দরজায় হেলান দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে রাখা অরু হুট করে বেসামাল ভঙ্গিতে পড়ে গেল৷ পড়বে না? তন্ময় হঠাৎ করে দরজা টেনে, মেলে দিয়েছে৷ শব্দ করে ফ্লোরে পড়ে আর্তনাদ করে উঠলো অরু৷ কোমরটা শেষ তার৷ কাঁদোকাঁদো চেহারা নিয়ে মাথা তুলে দেখল তন্ময় তার সামনে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছে৷
লোকটার একটুকরো মায়া নেই অরুর জন্য৷ নিষ্ঠুরভাবে দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছে তার নির্মম অবস্থা৷ অরু নাক ফুলিয়ে পড়ে রইলো৷ তন্ময় তাকে ধরে না ওঠালে সে উঠবে না৷ এভাবেই পড়ে থাকবে৷ একপর্যায়ে তন্ময় বলল,
– উঠছিস না কেন?
– আপনি সাহায্য কেন করছেন না!
তন্ময় পাশের চেয়ার এগিয়ে দিল সামনে। এটা ধরে উঠতে বলছে যেমন৷ অরু রেগে নিজেই উঠে দাঁড়ালো এবং হনহনিয়ে গেস্ট রুমের দিক চলল৷ গেস্ট রুমে জয়তুন বেগম থাকবেন। তার সাথে অরুর ভালো সম্পর্ক৷ দেখাসাক্ষাৎ হলেই দুজনের গোপন আলাপ-আলোচনা হয় প্রায়শই৷ মাঝেমধ্যে গল্পে মশগুল হয়ে থাকে৷ আজও তাই ঘটতে চলেছে৷
নয়টায় ডাইনিং সাজানো হয়েছে৷ ঘ্রাণে আশপাশ মৌ মৌ করছে৷ সুগন্ধে মাতোয়ারা হয়ে সবাই ডাইনিংয়ে বসে পড়েছে দ্রুত৷ অরু সর্বপ্রথম এসে বসেছে৷ পরপর দীপ্ত, শাবিহা, রুবি, আকাশ৷ জয়তুন বেগমকে ধরে এনেছে তন্ময়৷ সে তার নানির পাশেই বসলো৷ ওহী সাহেব, আনোয়ার সাহেব উল্টোপাশে বসেছেন৷ সকলের শেষে এসেছেন মোস্তফা সাহেব৷ তার চোখমুখ থমথমে তবে তাতে মুগ্ধতা বিরাজমান৷ কতটা হাসিখুশি তিনি সেটা অবশ্যই তার মুখমণ্ডলে ভেসে উঠেছে। আজকের সম্পুর্ন রান্না জবেদা বেগম একা হাতে করেছেন৷ বলা যায় দু,আড়াই বছর পর এই রান্নাঘরে পা রেখেছেন তিনি৷ সকলের জন্য রান্না করছেন দুটো বছর পর৷ খেতে নিয়ে আঁড়চোখে সকলেই জবেদা বেগমকে দেখছে৷ কিন্তু কিছুই বলতে পারছেনা জয়তুন বেগমের উপস্থিতির কারণে৷ সাবধানতা অবলম্বন করে কথাবার্তা বলতে হবে৷ তাইতো মুখ বন্ধ করে চেটেপুটে খেয়ে যাচ্ছে সবাই৷ খাওয়াদাওয়া শেষ হতেই বিশ্রাম নিতে বসেছেন ড্রয়িংরুমে৷ একপর্যায়ে জয়তুন বেগমের ঘুম ধরেছে বিদায় তিনি বললেন,
– রাত হয়েছে আমি ঘুমাই গিয়ে৷
বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়েছেন৷ জবেদা বেগমও উঠে দাঁড়ালেন মায়ের সাথে৷ তাকে সাথে নিয়ে যাবেন উদ্দেশ্য৷ কিন্তু তাকে থামিয়ে জয়তুন বেগম বললেন,
– জামাইয়ের শরীর ভালো দেখাইতেছানা! দেখ কিছু লাগবো নি৷
তারপর তিনি নিজেই একা যেতে পা বাড়িয়েছেন৷ অরু দৌড়ে জয়তুন বেগমের কাঁধ ধরে তাকে যেতে সাহায্য করছে৷ এখন জবেদা বেগমকে তো নিজেদের রুমেই যেতে হবে। কিন্তু তিনি যেতে চাচ্ছেন না৷ সোফায় বসে চুপচাপ৷ মোস্তফা সাহেবও তাকে তাড়া দিচ্ছেন না৷ বা রুমে আসতেও বলছেন না৷ এদিকে তাদের দুজনকে একা রেখে সবাই সবার মতো নিজেদের রুমে চলে এসেছে ঘুমোতে৷
তন্ময় মাত্রই নিজের রুমের দরজা লাগাতে নিচ্ছিলো৷ পূর্বেই অরু দৌড়ে ঢুকে গেল বইপত্র নিয়ে৷ আজ সে বইপত্রের ছুতোয় তন্ময়ের সাথেই থাকবে৷ একদম যাবেনা, না না না৷ তন্ময় বিরক্তির হাবভাব নিয়ে বলল,
– এসব কি হচ্ছে?
– আমাকে একটুখানি পড়াবেন?
মনের দিক দিয়ে অরুর কথার মানেটা দাঁড়ায়, আমাকে একটুখানি আপনাকে দেখতে দিবেন? তন্ময় গম্ভীরমুখে বলল,
– কাল সন্ধ্যায় পড়তে আসবি৷ এখন নিজের রুমে যা!
– একটুখানি৷
বলতে বলতে অরু তন্ময়ের নরম বিছানায় লাফিয়ে বসলো৷ পরপর অনুভব করলো সে কিছুর উপরে বসেছে৷ উঠে দাঁড়িয়ে সেটি হাতে নিলো৷ এবং এটা কি চিনতে অরুর বিন্দুমাত্র সময় লাগলো না। এটাত আন্ডারওয়্যার! কালো রঙের আন্ডারওয়্যার! অরু সেটা ভালোমতো দেখার সৌভাগ্য পেল না। কারণ তন্ময় মুহুর্তেই তার হাত থেকে কেঁড়ে নিয়েছে৷ তারপর ধমকে উঠলো,
– নিজের রুমে যা! এক্ষুনি!
অরু কষ্ট পেল৷ এসব জাঙ্গিয়া টাঙিয়া কী সে ধরতে চেয়েছে নাকি? নিজেই সেধে বিছানায় রেখে, তাকে ধমকায়৷ ধমকানোর বাহানা চাই শুধু। নিজের বইপত্র গুঁছিয়ে বেরিয়ে পড়লো৷ যাওয়ার সময় আরেকবার উঁকি দিয়ে বলল,
– দেখে ফেলেছি!
তন্ময় তাড়া দিতেই দৌড়ে নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে দিল৷
চলবে