প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল-৩৯,৪০

0
1508

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল-৩৯,৪০

৩৯.
বাড়িঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে! রান্নাবান্নার আয়োজন চলছে। প্রতিবেশীদের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। মুলত আজ শাবিহাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। বিকেল দিকে। মোস্তফা সাহেব দুপুরের আগ দিয়ে মেয়ের কক্ষে আসলেন গম্ভীরমুখে। শাবিহা তখন জড়সড় হয়ে বাবার সামনে দাঁড়ালো। মোস্তফা সাহেব চেয়ারে বসলেন। মেয়েকে ইশারা করলেন তার সামনে বসতে। শাবিহা বসলো। মোস্তফা সাহেব বললেন, ‘শুনেছ তো তোমার মায়ের থেকে?’
‘জি বাবা।’
‘তোমার কোনো আপত্তি আছে?’

শাবিহা চুপ থাকলো। বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। তীব্র যন্ত্রণায় ভেতরটা দাউদাউ করে জ্বলছে। তবুও মুখ ফুটে সত্যটা বলার সাহস পাচ্ছে না। কীভাবে বলবে, কোন মুখে বলবে! এভাবেই তন্ময়ের বিষয়টি নিয়ে তার বাবা প্রচন্ড অস্বস্তিতে। এখন আবার সে যদি এগুলে বলে! শাবিহা বাবার আদুরে মেয়ে হয়ে সত্যটা প্রকাশ করতে পারলো না। আর না পারলো ‘ না ‘ বলতে! মাথা নত করে বসে থাকলো। মোস্তফা সাহেব বললেন, ‘বিয়ে তো করতে হবে! আর কতদিন! আমাকে পিতার দায়িত্বটা পালন করতে দাও মা।’

মোস্তফা সাহেব মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। কিছুক্ষণ মাথা বুলিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বাবা যেতেই কান্না’য় ভেঙে পড়লো শাবিহা। ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে নিঃশব্দে ! নিঃশব্দ কান্না কষ্ট হাজার গুন বাড়িয়ে দেয়। যন্ত্রণায় চিৎকার করে কাঁদতে না পারলে, সেই কান্নার সমাপ্তি পাওয়া যে বড়ো মুশকিল। কান্নার একপর্যায়ে বেশ ক্লন্ত হয়ে পড়লো শাবিহা। ফ্লোরে বসে মাথাটা বিছানায় এলিয়ে দিল। অশ্রুসিক্ত নয়নে সেলফোন হাতে নিল। অয়নের অনেক গুলো মেসেজ এসে আছে। লাস্ট মেসেজটা দেখে সে আবারো ফুঁপিয়ে উঠেছে। অয়ন একটা লেহেঙ্গার ছবি পাঠিয়েছে। সঙ্গে একটি মেসেজ, ‘মামীর সাথে শপিং এসেছি শাবিহা। একটা ব্রাইডাল লেহেঙ্গা দেখলাম। আমার সেটা খুব পছন্দ হয়েছে তোমার জন্য। কিনবো বলে প্রাইস জানতে চাইলাম, শুনবে কতো বলল? পঁয়তল্লিশে হাজার। আমার কার্ডে আটাশ হাজার আছে। বাবার থেকে চাইলে ব্যাপারটা কেমন না! বিজনেসে প্রফিট করে প্রথমেই এই লেহেঙ্গা কিনবো! আমাদের বিয়েতে তুমি এটাই পরবে কেমন?’

কান্নায় শাবিহার শ্বাস আটকে যাবার যোগাড়। এই ছেলেটা কি বুঝতে পারছে কোন সিচুয়েশনে আছে তারা? তাদের সামনে সে তো কোনো রাস্তা দেখছে না! তার বাবা এই প্রেম একদম মেনে নিবেন না। কখনো না।

ঘন্টাখানেক বাদে অয়নের কল এলো। শাবিহা ঘুমিয়ে পড়েছিল। চোখবুঁজে বিছানায় হাতড়ে সেলফোন হাতে নিল। সেভাবেই কল রিসিভ করলো। অয়ন হয়তো বাইরে। যানবাহনের তীব্র শব্দ কানে আসছে। ঘুম পুরোদমে ভেঙে গেল তার। উঠে বসলো। প্রশ্ন করলো, ‘কোথায় তুমি?’

অয়ন যেমন প্রচন্ড বিরক্ত! খুব গম্ভীর স্বরে বলল,’পোলাপান জড়ো করছি।’
‘কী!কেন!’
‘কেন আবার! যে শালা আসছে তোমাকে দেখতে ওর কতবড় কলিজা বুকে, ওটার পোস্টমর্টেম করবো আজ আমি। মাঝরাস্তায় ধোলাই-ওয়াশ করে ফেরত পাঠিয়ে দিব। কার দিকে নজর দিয়েছে হাড়েহাড়ে টের পাবে!’

শাবিহা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য নির্বোধে পরিনত হলো। সময় নিয়ে ধমকে উঠলো,
‘তু..তুমি..এক্ষুনি বাড়িতে আসো বেয়াদব!’

অয়ন মুখ ভোঁতা করে ফেললো। অসহায় সুরে ডাকল,
‘শাবিহা.. ‘
‘আর কোনো কথা নেই আমাদের মধ্যে।’

কল কেটে গেল। অয়ন অন্ধকার মুখে ফোনের স্ক্রিনের দিক তাকিয়ে রইলো। সৌভিক তখন পোলাপানদের হাতের স্টিক, লাঠি গুলো হাতিয়ে দেখছে। ভয় দেখাতে এইসব অ’স্ত্রতেই হবে নাকি আরও লাগবে ভাবছিল। এমতাবস্থায় বন্ধুর নেতিয়ে থাকা মুখশ্রী দেখে নড়েচড়ে উঠলো। আন্দাজ সুরে বলল,’তুই কী ভাবীকে বলে দিলি?’
‘হু। রেগে গেল।’
‘তুই কি পাগল! কেন বলতে গেলি। সে এগুলো পছন্দ করবে না এটাই স্বাভাবিক।’

অয়ন সেলফোন পকেটে ঢুকিয়ে, হাতের ইশারায় সবাইকে যেতে বলল। ভোঁতা মুখে পোলাপানগুলো বিদায় হতেই, বাইকে চড়ে বসলো। পেছনে সৌভিক উঠে বসলো। ভেবেচিন্তে বলল,’দোস্ত এই দেখাদেখির বিষয়টা কীভাবে থামাবি? আন্টিকে জানাবি?’
‘আর জানাব! সে তো পাত্রপক্ষ আসা নিয়ে বেশ এক্সাইটেড! দেখলাম নিজের সিগনেচার আইটেম গুলো রান্না করে শাবিহাদের বাসায় যাচ্ছে।’
‘আহারে!’
‘ওদের বাসার সামনে আগুন লাগালে কেমন হয়? নাকি শাবিহাকে তুলে নিয়ে আসব? নাকি সোজাসাপটা শ্বশুর আব্বার সামনে যাবো? নাকি… ‘

অয়ন বিষন্ন অনুভব করছে। কী করবে বুঝতে পারছে না। সে কি ডিরেক্ট কাজি নিয়ে শাহজাহান বাড়ি চলে যাবে?
____________
লতা বেগম চল্লিশ বয়সের স্বাস্থ্যবতী মহিলা। লম্বাচওড়া দেহের গড়নের। অয়নের মুখশ্রীর সঙ্গে বড্ড মিল পাওয়া যায়। টানা ভুরু। উঁচু নাক। পাতলা ঠোঁট। গোলাকৃতি চেহারা। এমনকি ভুরুর উপরের ছোট্ট তিল খানা হুবহু অয়ন ও পেয়েছে। তিনি সবেমাত্র শাহজাহান বাড়ি ঢুকেছেন। দু’হাত ভর্তি খাবার। শাবিহাকে দেখতে আসবে এরথেকে আনন্দের বিষয় যেমন পৃথিবীতে দুটো নেই তার কাছে। তিনি নিজের রান্না করা আইটেমস গুলো সোজা ডাইনিংয়ে রাখলেন। সোফায় বসে প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলোচনায় মগ্ন হলেন। তাদের কানাঘুঁষা গল্পের মাধ্যমে জানতে পারলেন, তন্ময় আর অরুর বিয়ের কথা। বিয়ের বিষয়টি একান্তই গোপন। এখনো শাহজাহান পরিবার সরাসরি কাউকে বলেনি এ-বিষয়ে। প্রতিবেশী যারা জানে সবটাই কানাকানি ভাবে। সাহস করে সোজাসাপটা যে কেউ শুধাবে, তাও পারছে না। তবে লতা বেগম ভিন্ন। তার আবার শাহজাহান বাড়ির গিন্নীদের সঙ্গে বেশ ভাব। সোজা চলে গেলেন জবেদা বেগমের কাছে। সরাসরি জিজ্ঞেস করবেন। বিয়ের বিষয়টি তার একদম বিশ্বাস হচ্ছে না! এটা কী বিশ্বাস করার মতো বিষয় নাকি! ভদ্রসমাজের বড়ো বাড়ির দুটো ছেলেমেয়ে কিনা একা-একা বিয়ে করে নিল! জবেদা বেগম তখন রান্নায় ব্যস্ত। তাকে সাহায্য করছে মুফতি বেগম। ধীর স্বরে লতা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, ‘তন্ময় নাকি অরুকে বিয়ে করে নিয়েছে?’

এমন প্রশ্নে জবেদা বেগম মুচকি হাসলেন। তিনি কিছু বলবেন এর পূর্বেই মুফতি বেগম মুখ খুললেন,
‘ আর বলবেন না! এই বিষয়ে ঝড়তুফান হয়ে গেল বাড়িতে। বিয়েটা গতকাল করেছে। কাজি অফিসে গিয়ে। করবেনা কেন বলুন! চারপাশ থেকে ছেলেটার উপর যে হাড়ে নজর পড়ছে! আর এদিকে মেয়েটার ও রক্ষা নেই।’

লতা বেগম কিছুই বুঝলেন না। মুফতি বেগমের কথাবার্তা তার মাথার উপর দিয়ে গেল। জবেদা বেগম আঁচলে হাত মুছলেন। চায়ের কাপ লতা বেগমের হাতে দিলেন। দুজন অন্যদিকে হাঁটতে শুরু করলেন।এদিকটায় মানুষজন নেই। নিরিবিলি! চায়ে চুমুক দিচ্ছেন লতা বেগম। প্রত্যাশায় আছেন জবেদা বেগম কিছু বলবেন হয়তো! জবেদা বেগম বললেন ও,’আপনাকে যে জানাব তার উপায় ছিলো না। ছেলেমেয়ে দুটো না জানিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে। এমন বিষয় তো বলার মতো নয়।’
‘তা তো অবশ্যই।’
‘আমার ছেলেটা অরুর জন্য পাগল। সেই ছোট থেকে! আমরা ভেবে রেখেছিলাম অরু বড়ো হলে এই বিষয়ে কথা বলবো! কিন্তু ছেলে মানতে নারাজ। না জানিয়েই বিয়ে করে নিল হুট করে। অবশ্য তার দ্বারা এমন কান্ড আমরা কেউই প্রত্যাশা করিনি। খুব বুদ্ধিমান ছেলে আমার। সবসময় সবকিছু সামলে নিয়েছে এখনো সামলাচ্ছে! সে কীভাবে এই কাজ করে বসলো জানা নেই। এখন বিয়েটা তো আর অস্বীকার করা যাবেনা! আপনার ভাই এখনো রেগে। তিনি চাচ্ছিলেন না অরু এখনই বিয়ে করে নিক। মেয়েটা এখনো ছোটো। ইন্টার পাশ করলো সবেমাত্র। ভাই-জি’কে বড্ড ভালোবাসেন কিনা। চাচ্ছিলেন আরও সময় নিয়ে ভাববেন।’
‘বিয়েটা হয়ে ভালোই হয়েছে। আমার তো এখন দুটোকে পাশাপাশি দেখতে ইচ্ছে করছে। নিশ্চয়ই খুব মানিয়েছে।’

জবেদা বেগম হাসলেন। আসলেই দুটোকে মানিয়েছে। তিনি তো চোখ ফেরাতে পারেন না। কতটা সুন্দর দেখায় ছেলেমেয়ে দুটোকে একত্রে তা তিনি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবেন না। এইতো সকালে অরু তন্ময় একসাথে খেতে বসলো। জবেদা বেগম আঁড়চোখে কতবার যে নজর দিলেন, অগুনিত। শুধু সে নয়! মোস্তফা সাহেব, আনোয়ার সাহেব খাওয়া বাদ দিয়ে বেশ কয়েকবার তাকিয়েছেন।
______________
তাদের বিয়ের কথা সকলেই ভুলে বসেছে, এ বিষয়ে আর মন খারাপ করে বসে থাকতে পারলো না অরু। বিবেকবান সে এখন শাবিহার চিন্তায় পাগল প্রায়। এইযে সকালে তন্ময় তাকে ধমক দিয়েছিল। ধমক খেয়ে অরু তন্ময়ের উপর আরও ক্ষিপ্ত। তবুও সে নিজের অভিমানী মন এবং ক্ষিপ্ত অনুভূতি একপাশে রেখে, তন্ময়ের রুমের সামনে হাজির হলো।আজ তন্ময় বাসায়। মোস্তফা সাহেব তাকে অফিস যেতে দেয়নি। শাবিহাকে দেখতে আসবে। বড়ো ভাই হিসেবে তাকে তো থাকতেই হবে। অরু অল্প খানিক দরজা ঠেলে মাথা ঢোকাল। তন্ময় বিছানায় শুয়ে টেলিভিশন দেখছে। খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। টেলিভিশন থেকে খবরের শব্দ আসছে। অরু ঢিপঢিপ মন নিয়ে সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। ভেতরে যেতে দ্বিধাবোধ করছে মুলত। যাবে নাকি না দ্বিধাজড়িত অরুকে আঁড়চোখে তন্ময় দেখে নিয়েছে। মিনিট পাঁচেক হলো তবুও অরু ভেতরে প্রবেশ করছে না দেখে, এবার তন্ময় বলল, ‘চেয়ার এগিয়ে দিব?’

ভড়কে অরু পড়ে যেতে গিয়ে নিজেকে সামলাল। ওড়নার কোণা দরজায় লেগে আছে। খেয়াল করেনি। কিছুটা যেতেই পেছনে টান খেল। এ অগোছালো অরুকে তন্ময় এক ধ্যানে দেখছে। খবর থেকে তার নজর সরে গিয়েছে খানিকক্ষণ হয়েছে। লজ্জিত অরু টেনেটুনে ছুটিয়ে নিল ওড়না। ছিঁড়ে যাবার শব্দও শোনা গেল। লজ্জা কাটিয়ে ধীরেসুস্থে ভেতরে আসলো। মিনমিনে সুরে বলল, ‘আমিতো মাত্রই এলাম।’
‘দেখলাম তো!’

অরু ভুরু দু’য়ের মাঝে সূক্ষ্ম ভাজ নিয়ে বলল,’আপনি এমন আরামসে কীভাবে শুয়ে আছেন!’
‘কেন! আমার আরামসে শুয়ে থাকা বারন?’

অরু বিরক্ত সুরে বলল, ‘শাবিহা আপু কাঁদছে।’
‘তুইও যা মিলেমিশে কান্না কর গিয়ে।’
‘আমি কেন কান্না করবো। আশ্চর্য!’

মুহুর্তে তন্ময় শোয়া থেকে উঠে বসলো। বিছানা থেকে নেমে অরুর সামনে এলো। লম্বা সে কোমর বেঁকিয়ে অরুর সমানতালে এসে, দু’গালে ছোট্ট করে চড় মেরে বসলো। অরুর তুলতুলে গাল দুটো হালকা লাল হয়ে গেল। আকস্মিক চড়ে সে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। বড়বড় চোখে তন্ময়ের পানে তাকাল। তন্ময় শুধালো, ‘কান্না করার রিজন পেয়েছিস?’

অরু রেগেমেগে একাকার। নাক ফুলিয়ে বলল, ‘আপনি..আপনি…’

রাগান্বিত সে সম্পুর্ন কথা বলতে পারল না। শব্দ করে চলে গেল। নিস্তব্ধতা কক্ষ জুড়ে। তন্ময় দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। বুকে দু’হাত পেঁচিয়ে দরজার দিক তাকিয়ে। কিছু একটার অপেক্ষায় যেমন৷ মিনিট খানিক পর অরুর ছায়ার দেখা মিললো। ধীরেধীরে সে পুরোটাই পুনরায় তন্ময়ের রুমের সামনে এসেছে। চিৎকার করে বলল,
‘একটা পাষাণ ভাই আপনি! আপনার ভেতর বিন্দুমাত্র দয়ামায়া কিছুই নেই।’

তন্ময় গম্ভীরমুখে বলল,’সামনে এসে বল।’
‘না। এখান থেকেই বলবো। আপনি কিছু কেন করছেন না হ্যাঁ!’
‘ভেতরে আয় বলছি।’

ভেতরে যাবার সাহস অরু করলো না। বরং আরও দূরে সরে দাঁড়ালো। তন্ময় টেলিভিশন ওফ করে দিল। বইয়ের সাইডে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। শেল্ফ থেকে একটা বই হাতে নিয়েছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অরু পুনরায় দরজার সামনে এলো। তন্ময়ের মনোযোগ না পেয়ে দু’পা ভেতরে গেল। গলার স্বর নামিয়ে বলল, ‘শাবিহা আপু এই বিয়েটা করতে চায়না।’
‘তো?’
‘অয়ন ভাইয়া কতো ভালো। আপুর জন্য পারফেক্ট। চাচ্চুকে তাদের ব্যাপারে বলবেন না?’

তন্ময় বইটা রেখে অরুর সামনে দাঁড়ালো। মনোযোগ দিয়ে দেখছে। তীক্ষ্ণ নজরে নজর মেলাতে পারছে না অরু। সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকাচ্ছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে তন্ময় বারান্দার দিক চলে গেল। অরু ঠাঁই দাঁড়িয়ে। জিহ্বা কামড়ে তন্ময়ের পিছুপিছু গেল। রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তন্ময়। হিমশীতল বাতাস বইছে। ঠান্ডা আবহাওয়া। তন্ময়ের দেখাদেখি অরুও রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়ালো। এই ঠান্ডা বাতাসে তার চোখবুঁজে আসছে। হঠাৎ পেছনে থেকে শ্বাসপ্রশ্বাস অনুভব করলো। বিচলিত হয়ে চোখ মেলে তাকাল। তন্ময় পাশে নেই, তার পেছনে। ছুঁইছুঁই হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার দুপাশে রেলিং ধরেছে। তন্ময়ের বাম গালের চাপদাড়ির খোঁচা লাগছে তার ডান গালে। দুরুদুরু কাঁপছে অরুর হাত। তোলপাড় শুরু হয়েছে ভেতরে। গলা শুকিয়ে কাঠকাঠ। তন্ময়ের গলার স্বর নরম এবং নিচুস্তরে, ‘ভাই হিসেবে আমার কর্তব্য আছে। বোনকে সহিসালামত এমন কারো হাতে দেয়া, যে তাকে সুখী রাখবে, ভালো রাখবে। আমি চাই ও এমন কাউকে পাক যে ওকে রাজরানী করে রাখবে। আমার বোনকে রাজরানী করতে হলে, ঐ ব্যাক্তিকে আগে রাজা হতে হবে। শক্তিশালী, ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাক্তিত্বের অধিকারী হতে হবে। তাই অবশ্যই আমার বোনকে পেতে হলে রাজা হয়ে আসতে হবে আমার সামনে। কেঁড়ে নিয়ে যেতে হবে, আমার সাহায্য ছাড়া! আমি দেখতে চাই অয়ন কতদূর যেতে পারে। এখন তোর মাথায় ঢুকেছে আমার কথা?’

অরু মাথাটা পাশে ঘোরাতে চাইল। সঙ্গে সঙ্গে চাপদাড়ির খোঁচা খেল গালে গভীর ভাবে। ‘উহ’ শব্দ করে উঠলো। সরতে চাইল। তবে তন্ময় সরতে দিলো না। সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকলো মূর্তির মতো। একসময় অরু শাবিহা-অয়ন সব ভুলে গেল। পেছনে তন্ময় দাঁড়িয়ে শুধু তাই মগজে রয়ে গেল!

চলবে~
‘নাবিলা ইষ্ক’

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল

৪০.
ড্রয়িংরুমে তাড়াহুড়ো পায়ে দৌড়াচ্ছে অরু। একবার সুমিতা বেগমের পেছনে লোকাচ্ছে তো আরেকবার জয়া বেগমের পেছনে, নাহলে মুফতি বেগমের পেছনে। তন্ময় টিশার্ট টাউজার পরে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। খুব ধীরেসুস্থে আসছে। তার ডান হাতে নেইলকাটার। শব্দ করছে কাটার দিয়ে। অরু পুনরায় ভনভন করে উঠলো মাছিদের মতো। হট্টগোলের কারণে আনোয়ার সাহেবও উপস্থিত হলেন। আজ সকলেই বাড়িতে। তাই এই বেসামাল দৃশ্য একপ্রকার সকলের সামনে অনিচ্ছাকৃত ভাবে চলে এসেছে। জয়া বেগম বিচলিত অরুকে শক্ত করে ধরলেন। শুধালেন, ‘হয়েছে কী!’

অরু জবাব দেবার পূর্বেই তার সামনে তন্ময় চলে এসেছে। দৌড়ে আনোয়ার সাহেবের পেছনে চলে গেল অরু!গম্ভীর স্বরে তন্ময় ডাকল, ‘এদিকে আয়।’
‘না!’

আনোয়ার সাহেব হাসছেন বাড়ির বাচ্চাদের বাচ্চামিতে। হেসে কারণ জানতে চাইলেন। ঠিক হয়েছে কী! দীপ্ত শব্দ করে হেসে বলল, ‘চাচ্চু আজ অরু আপুর নখ কাটা হবে।’

অরুর বা’হাতের হাতের নখ সামান্য বড়ো। খুবই সামান্য। সাদা ফকফকে নখ। অরু প্রত্যেকদিন পরিষ্কার করে রাখে। নেইলপালিশ দিলে দেখতে সুন্দর লাগে কি-না। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সেই নখের কারণে আজ তন্ময়ের ঘাড় জ্বলছে। আসলে তখন তন্ময়ের বাহুতে অরু কৈ-মাছের মতো ছোটাছুটি করতে গিয়ে ঘাড়ে খোঁচা দিয়ে ফেলেছে। তৎক্ষণাৎ যায়গাটা লালচে হয়ে গেল। তন্ময় তখনই নেইল-কাটার হাতে নিয়েছে। অরুর নখ কাটবে। অরু দিবেনা কাটতে।

আনোয়ার সাহেব সরে যেতেই, তন্ময় এসে হাত চেপে ধরেছে অরুর। তাকে সোফায় বসিয়ে সে পাশে বসল। জয়া বেগম হেসে দুপাশে মাথা দোলালেন। পরপর রান্নাঘরে চলে গেলেন। বাকিরাও আর থাকল না। দীপ্ত সামনে বসে রইলো। টানটান উত্তেজনা নিয়ে গভীর ধ্যানমগ্ন হলো তাদের দেখায়। অরু তখনো চোখমুখ অন্ধকার করে আছে। তন্ময় টানটান করে অরুর আঙুল টেনে ধরেছে। নড়চড় লক্ষ্য করে ধমকে উঠলো, ‘নড়বি না। চুপচাপ বোস।’

অরু ভীষণ ব্যস্ত তন্ময়কে দেখল। নিচুস্তর গলায় মিনমিনে সুরে বলল, ‘ধরাধরি করেছে কেন! এখন সব দোষ আমার নখের!’

তন্ময় যেমন কিছুটা আন্দাজ করে নিয়েছে। সে চোখ তুলে তাকালো। অরু চুপসে গেল। তন্ময় খুব ছোট স্বরে বলল, ‘কামড় দিলে সমস্যা নেই। দাঁত কা’টব না।’

এরপর আর অরু নড়চড় করল না। থমকে বসে থাকলো। তন্ময় আরামসে নখ গুলো কে*টে চলে গেল।
____________
উত্তরায় একটি নতুন কোম্পানি খোলা হয়েছিল পাঁচ মাস পূর্বে। নতুন কোম্পানি! নামডাক তখনো উঠেনি। প্রচন্ডভাবে শেয়ারহোল্ডারের প্রয়োজন ছিলো। অনেককেই ডাকা হলো। অনেক নামকরা বিজনেস ম্যান হাজির হলো। তবে শেয়ারের দাম বেশি। এতো দামে শেয়ার কিনবে না জানালো! দিশেহারা কোম্পানির একেকজন মালিক বাধ্যতামূলক শেয়ারের দাম কমিয়েছেন। অয়ন সেসময় নিজের সর্বোচ্চ টাকা দিয়ে শেয়ার কিনে রেখেছে। আটচল্লিশ লাখ টাকার শেয়ার একাই কিনে, কোম্পানির সবথেকে শেয়ারহোল্ডারের খেতাব অর্জন করে নিল। অনেক বিজনেসম্যান তাকে বাচ্চা, নির্বোধ, মুর্খ বলেছিল! টাকাগুলো নির্ঘাত জলে যাবে বলে বেট লেগেছে একেকজন। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে, নতুন কোম্পানি তখন তেমন সাড়া না পেলেও, দু-মাসের মাথায় সাড়া পেতে লাগলো। জমিনে পড়ে থাকা থেকে উঠে দাঁড়ালো। পাঁচ মাসের মাথায় কোম্পানির শেয়ারের দাম হুড়মুড়িয়ে বেড়ে গেল। এখন অয়নের আটচল্লিশ লাখ টাকার শেয়ারের দাম উঠেছে, তিন কোটি প্রায়! ব্যাপারটা মাত্রই জেনেছেন অয়নের বাবা সৈকত সাহেব। সেক্রেটারি শারমিন মাত্রই নিউজপেপার দেখিয়েছেন তাকে। নিউজপেপারে বিজনেস রিলেটেড পৃষ্ঠায় ছেলের ছবিসহ হেডলাইন দেখে আহাম্মক হয়ে গেলেন। ছ’মাস পূর্বে অয়ন হিউজ পরিমাণে টাকা নিয়েছে তার থেকে। বলেছে অফিস খুলবে। নিজের! সৈকত সাহেব রেগে যান। ছেলেকে প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু ছেলে কথা শুনবে না। ওয়াদা দেয়, সে পাঁচগুণ বাড়িয়ে টাকা ফেরত দিবে। বিশ্বাস করেননি সৈকত সাহেব। তবুও বাধ্য হয়ে চল্লিশ লাখ টাকা দেন ছেলেকে। এদিকে সেক্রেটারী শারমিনের চাহনিতে বিষ্ময় ফুটে! সে অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল, ‘স্যার আপনি জানতেন না? তারমানে কী ছোট স্যারের একার চিন্তাভাবনা এগুলো? সে কীভাবে এতো টাকা ইনভেস্ট করার মতো সাহস পেলো? চল্লিশ লাখ টাকা! যা এখন দু কোটি! বিশ্বাস করতে পারছি না এখনো!’

সৈকত সাহেব শুকনো ঠোঁট জোড়া জিহ্বা দ্বারা ভিজালেন। তিনি নিজেও বিশ্বাস করতে পারছেন না। ব্যস্ত পায়ে উঠে দাঁড়ালেন। তার আজকের মিটিং গুলো, হোল্ডিং রাখতে বলে বেড়িয়ে পড়লেন। মাঝরাস্তায় ছেলেকে কয়েক কল করলেন। বন্ধ ফোন! বাড়ির সামনাসামনি পৌঁছাতেই অয়নের ফোন থেকে কল ব্যাক এলো। এবং সৈকত সাহেবকে বলতে না দিয়ে সে বলল, ‘বাবা৷ তুমি অফিসে নেই কেন!’
‘তুই কোথায়? অফিসে নেই আমি। বাড়ির সামনে।’
‘তোমার সাথে কথা আছে। আসছি আমি। থাকো।’

সৈকত সাহেব নরম সুরে বলতে চাইলেন ‘আয় বাবা।’ বলতে পারলেন না। ছেলে কল কেটে দিয়েছে। তবুও রাগলেন না। আজ তিনি ছেলেকে নিয়ে গর্ববোধ করছেন। উচ্ছ্বসিত মনে বাড়িতে ঢুকলেন। স্ত্রী নেই! খোঁজ করলেন না স্ত্রীর। সে আরাম করে সোফায় বসে থাকলেন। ছেলের সাথে বিজনেস রিলেটেড কথাবার্তা বলবেন। সেখানে স্ত্রী না থাকলেও চলবে। অয়ন হাওয়ার বেগে এসেছে। পাঁচ মিনিট লাগেনি। তারমানে কতটা সাংঘাতিক মাত্রায় বাইক চালিয়ে এসেছে এই ছেলে, তা বোঝার জন্য আলাদা আর ব্রেইন ব্যবহার করতে হবে না। আরাম ভাব ছেড়ে নড়েচড়ে বসলেন সোজা হয়ে। অয়ন বাবার সামনে বসেছে। ঘেমে-নেয়ে একাকার সে। অস্থির ভঙ্গিতে কয়েকবার হাত ঘড়িতে চোখ বোলালো। সৈকত সাহেব মুগ্ধ নয়নে ছেলেকে দেখে মিষ্টি করে হাসলেন। আজ তিনি ছেলের ক্ষমতা সম্পর্কে জেনেছেন। এই ছেলেই তার বিজনেস উঁচু করে রাখবে। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে মুখ খুললেন। কিছু একটা বলতে চাইলেন, পূর্বেই অয়ন উতলা সুরে বলে উঠল, ‘বাবা আমি একজনকে পছন্দ করি!’

সৈকত সাহেবের প্রসস্থ হাসির রেখা স্তব্ধ খেয়ে গেল। কয়েকবার পাপড়ি ঝাপটালেন। মুখ খুলবেন পূর্বেই অয়ন বলল, ‘আজ তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। আমি সেটা হতে দিব না। তুমি এক্ষুনি গিয়ে আমার জন্য তার হাত চাইবে।’

সৈকত সাহেবের থমকে যাওয়া হাসি এবার বিলুপ্ত হওয়ার পথে। তিনি অবিশ্বাস্য নয়নে আবারো মুখ খুলতে চাইলেন, পূর্বেই অয়ন বলে দিলো, ‘আমি শাবিহাকে বিয়ে করতে চাই বাবা।’
‘ত..তুমি.. কী! শাবিহা? কোন শাবিহা!’
‘পাশের বাড়ির।’

সৈকত সাহেব আঁতকে উঠলেন। আর এক সেকেন্ডও বিলম্ব না করে বুক চেপে ধরলেন। তার শ্বাস আটকে এসেছে। এতগুলো আনইনভাইটেড অপ্রত্যাশিত তথ্য হজম করতে পারলেন না।
___________
সময় যেন পানির গতিতে চলে যায়। চোখের পলকে দুপুর গড়িয়ে বিকেলে ঠেকেছে প্রকৃতি। সোনালী আলোয় আলোকিত চারপাশ। শাবিহাকে তৈরি হতে বলে গিয়েছিলেন জবেদা বেগম। সুন্দর করে শাড়ি পরতে বলেছিলেন মুলত। রান্নাঘরের কাজ শেষ করে এসে দেখছেন, মেয়ে তার এখনো ফ্লোরে বসে আছে। ঠিক যেভাবে দেখে গিয়েছেন। ভুরু জোড়া কুঁচকে বললেন, ‘কি রে! তৈরি হচ্ছিস না কেন!’

শাবিহার জবাব নেই। সে একই ভঙ্গিতে বসে। জবেদা বেগম দু’পাশে মাথা নাড়ালেন অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে। জোর গলায় ডাকলেন, ‘অরু, রুবি! কই তোরা!’

অরু আর রুবি একত্রেই রয়েছে। দুজন আড়াল হয়ে আছে৷ কেউই শাবিহাকে তৈরি করতে যেতে চাইছে না। অরু তো কেঁদে নাক লাল কাপ ফেলেছে। রুবি ব্যস্ত পায়ে রুমে হাঁটাচলা করছে। সে জানত না, শাবিহা অয়নের বিষয়টা। সবে জেনেছে। জেনে অবাক হয়েছে ভীষণ। শাবিহাকে ভালোভাবে জানে এবং চেনে। এমন মেয়ে নিজের থেকে ছোট এক ছেলেকে মন দিয়ে বসবে, কেইবা ভাবতে পেরেছিল!
দুএকবার মুখ খুলেছে কিছু বলতে! অবশেষে কিছুই বলতে পারল না। চুপচাপ দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই। শাবিহাকে অয়নের সঙ্গে ভেগে যেতে বলত! তবে সেই ডিসিশন কতটাই ভালো হত? সে-তো তেমন তাদের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা জানে না৷ নাক কুঁচকে রুবি বলল,’কান্না ওফ কর। বড়ো মা ডাকছে। চল…’
‘শাবিহা আপু কান্না করছে!’
‘করুক।’
‘আমার তার কান্না সহ্য হচ্ছেনা!’
‘সহ্য না হলে কান আর চোখ বন্ধ করে চল।’

অরু বিষন্ন অনুভব করলো। কেউ তাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছে না৷ হুয়াই! এইযে অরু কষ্টে রসমালাই খেতে পারছে না। বাড়ির আনাচকানাচ রসমালাইয়ের ঘ্রাণে ম-ম করছে। অথচ কষ্টের কারণে একটা পিস মুখে পুড়তে পারেনি এখন অবদি। সেই কষ্টে কান্নার মাত্রা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। জবেদা বেগমের তৃতীয় ডাকে দুজনকে একপ্রকার বাধ্য মেয়েদের মতো যেতে হলো। তাদের ধমকের সুরে আদেশ করলেন জবেদা বেগম, ‘সুন্দর ভাবে তৈরি করে দে মেয়েটাকে। চলে আসবে তো লোকজন। তাড়াতাড়ি কর!’

মাথা দোলাল রুবি। অরু বিক্ষিপ্ত মনে শাবিহার পাশে বসেছে। শাবিহার এঅবস্থা কী দেখছে না বড়ো মা? নাকি সে চোখেই দেখে না। জবেদা বেগমের উপর চরম বিরক্ত অরু! আচ্ছা, সে কী একটা কল দিবে অয়নকে? বলবে কি খুলে সবকিছু? এইযে শাবিহা সকাল থেকে কিচ্ছুটি খেলো না। আড়াল হয়ে কাঁদল। কার জন্য? অবশ্যই অয়নের জন্য! এখন সেই অয়নকে জানাতে হবে না বুঝি? অরু মনে মনে ঠাঁই করে নিল, আজ সে অয়নকে কল করবে। কিছুক্ষণ পরেই করবে। অয়নকে খুব করে বলবে কিছু করতে।

শাবিহা উঠে দাঁড়িয়েছে। চুলগুলো কোনোরকমে হাতে পেঁচিয়ে নিল। পা বাড়ালো ওয়াশরুমের দিক। ফ্রেশ হয়ে এসে বসেছে ড্রেসিং টেবিলের সামনে। রুবি চিরুনি নিয়ে ধীরে শাবিহার চুল আঁচড়ে দিতে সাহায্য করছে। অরু হাতে পেটিকোট আর ব্লাউজ নিয়ে দাঁড়িয়ে। ব্লাউজ কাজ করা! খুব সুন্দর কারচুপির কাজ। এটা জবেদা বেগমের নিজের শাড়ি। মেয়েকে এটাই পরতে বলেছেন। অরু ব্লাউজ খানা নিজে পরতে নিয়ে থেমে গেল। এমতাবস্থায় রুমের সামনে হাজির হয়েছেন জবেদা বেগম এবং লতা বেগম। লতা বেগম মুলত শাবিহাকে দেখতে এসেছেন। শাড়িটা তিনিই পরিয়ে দিবেন জানালেন। শাবিহা অস্বস্তি অনুভব করলো। লতা বেগমের পানে বেশ করে তাকাল। বুকের ভেতরটা দুরুদুরু কাঁপছে। কাছ থেকে দেখতে পাওয়া অয়নের চেহারার সঙ্গে ভদ্রমহিলার কী মিল! লতা বেগম এসে শাবিহার মুখ উঁচু করে ধরলেন।’দেখি.. দেখি… মাশাল্লাহ। কি মিষ্টি। পাত্রপক্ষ এক দেখায় পাগল হয়ে যাবে নির্ঘাত।’

শাবিহার ভীষণ লজ্জা লাগলো। সে চুপচাপ লতা বেগমের ইশারায় দুলল। শাড়ি পরিয়ে ভালোভাবে তাকে দেখল লতা বেগম। ভারী মিষ্টি দেখাচ্ছে। চোখ ফেরানো দায়। শাবিহার বিচলিত আচরণ দেখে অরু লতা বেগমকে টেনে বিছানায় বসালো। খুব ইনিয়েবিনিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘অয়ন ভাইয়া কই?’

লতা বেগম অশান্ত সুরে বললেন, ‘ছেলেটার যে কি হলো হুট করে! রাত থেকে কেমন করছে! খাচ্ছে না, ঘুমোচ্ছে না! সামনে অনার্সের ফাইনাল। অথচ সে কী যেন নিয়ে মহা ব্যস্ত। ওর সবকিছু আমার মাথার উপর দিয়ে যায় বাবা!’

অরু পিটপিট নয়নে শাবিহার দিক তাকাচ্ছে। দেখল শাবিহা মন দিয়ে শুনছে। দুষ্টু হেসে সে শুধালো, ‘অয়ন ভাইয়াকে বিয়ে দিবেন না আন্টি?’
‘দিব তো। আমার তো একটামাত্র সন্তান। বিয়ে দিয়ে দিলে দুটো হবে৷ ভাবছি বিয়েটা দিয়ে বাড়িতে একটা মেয়ে নিয়ে আসব যত দ্রুত সম্ভব। আমার আর একাএকা পড়ে থাকতে ভালো লাগে না।’

অরু উত্তেজিত হয়ে পড়লো। কন্ঠ তটস্থ করে বলল, ‘হ্যাঁ বিয়েটা দিয়ে দিন। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখুন ভালো মেয়ে আছে। একদম ফুলপরী।’

ভাবুক হয়ে পড়লেন লতা বেগম। ভেবে বসলেন অরু নিজেকে ইঙ্গিত করে বলছে। তিনি বললেন, ‘তোর তো বিয়ে হয়ে গেছে অরু!’

অরু স্তব্ধ, বিমুঢ়! আশ্চর্য! সে কী নিজের কথা বলেছে নাকি! লজ্জায় হতভম্ব অরু চুপসে গেল। লতা বেগম উৎসুকভাবে বললেন, ‘তন্ময় কোথায়?’
‘ভাইয়া ঘরে।’
‘এই ভাইয়া কীসের! ভাইয়া ডাকবি না। তন্ময় বলে ডাকবি। দেখি ডেকে দেখা! এখান থেকে ডেকে
উঠ। ছেলেটা আসুক, কতদিন ধরে দেখিনা।’
‘পারব না।’

রুবি হঠাৎ করে দুষ্টু বনে গিয়েছে। সে হুলস্থুল হয়ে লতা বেগমের সাথী হয়েছে। দুজন মিলে অরুকে হেনস্তা করতে শুরু করলো। বাধ্যতামূলক ডাকতে হবেই হবে, বলে চলেছে! বড়দের সামনে অরু ভীষণ বিষন্ন হয়ে পড়লো। ছোট ছোট পায়ে দরজার সামনে দাঁড়াল। নরম ছোট সুরে ডাকল, ‘তন্ময় ভাইয়া!’

সঙ্গে সঙ্গে রুবি অরুর মাথায় গাট্টি দিয়ে বসল। ভারী গম্ভীর স্বরে বলল,’তন্ময় হবে।’
‘আমি..আমি পারবো না।’
‘পারবি। পারবি.. ট্রায় কর!’

অরু মিনমিন ধীর সুরে বলল,’আমাকে ছেড়ে দাও রুবি আপু!’,
‘আগে ডাক তারপর ছেড়ে দিব।’

অরু কখনোই তন্ময়কে নাম ধরে ডাকেনি। বড়দের সে সর্বদাই সম্মান করে। তন্ময় তার বড়ো। বড়দের নিশ্চয়ই সে নাম ধরে ডাকবে না৷ আকাশ হলে ফাজলামো করে হলেও নাম ধরে ডাকা যেতো। কিন্তু তন্ময়! অরু এই লোককে কখনোই, নাম ধরে ডাকতে পারবে না। তার দ্বারা অসম্ভব। তবে অসম্ভব কে সম্ভব করাই রুবির কাজ। সে ইচ্ছেমতো অরুকে জ্বালালো। অবশেষে অরু চেঁচিয়ে উঠলো,’তন্ময়!’

আশ্চর্যজনকভাবে তন্ময় তখন সিঁড়ির মাথায়। সবেই নামতে নিচ্ছিল নিচে। মোস্তফা সাহেব ডেকেছেন। অরুর গলা ফাটানো ডাক শুধু সে নয়, পাশে উপস্থিত ওহী সাহেবও শুনলেন। তন্ময়ের পা জোড়া অপ্রস্তুত ভাবে সামনে চলে গেল। স্লিপ খেয়ে রেলিঙ ধরলো। প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো সে! অরু পরপরই তন্ময়কে লক্ষ্য করল। আতঙ্ক মনে পরপর উচ্চ গলায়, ‘ভাইয়া!’ বলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে রুবির গাট্টা ও পড়ল তার মাথায়!
___________
সময় পাঁচটা পঞ্চান্ন। পিতাপুত্র একত্রে সদরদরজার সামনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গম্ভীরমুখে। যেমন তাদের থেকে কেউ টাকা পাওনা। এক্ষুনি পরিশোধ করতে হবে যেন। নাহলে গলা কে*টে নিবে। মোস্তফা সাহেব তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, ‘আজকাল প্রতিশ্রুতি দিলেই হয়না, রাখতেও জানতে হয়। আর সবাই তা পারেনা।’

তন্ময়ের জবাব এলো না। মোস্তফা সাহেব তাতে আরও বিরক্ত হলেন। খিটখিটে মেজাজে বললেন,
‘বুকের পাঠা থাকতে হয়।’

তন্ময় মাথা ঘুরে তাকাল।খুব স্বাভাবিক স্বরে শুধালো, ‘কিছু বললে!’

মোস্তফা সাহেব ছেলেকে চোখ রাঙালেন। গম্ভীরতা বজায় রেখে পূর্বের ন্যায় দাঁড়ালেন৷ ওহী সাহেব এবং আনোয়ার সাহেব ও পাশেই আছেন। অতিথির আগমনে কোনো ত্রুটি রাখবেন না৷ একপর্যায়ে দূর থেকে একটি গাড়ি দেখা গেল। মোস্তফা সাহেব সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। গাড়ি কাছাকাছি আসতেই হুট করে ওপর পাশ থেকে আরেকটি গাড়ি চলে এলো। দুটো গাড়ি একত্রে মোস্তফা সাহেবের সামনে থামলো। একটি কালো রঙের গাড়ি আরেকটি সাদা।
___________
চলবে ~
‘নাবিলা ইষ্ক’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here