প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল-৪২,৪৩

0
1615

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল-৪২,৪৩

৪২.
থাই গ্লাসের মধ্যে সরু লাইনে বৃষ্টির রেখা বইছে। সেখানে ছোপ ছোপ বৃষ্টির ছাপ স্পষ্ট। গভীর রাতে অস্পষ্ট বৃষ্টির মধুর শব্দ কানে ভেসে আসছে। বাতাস বইছে তুমুল। বাতাস উড়াতে ব্যস্ত পর্দা। সাদা পর্দাদের এলোমেলো খেলা চলছে যেনো। অরুর হাতের বাটি ফাঁকা। রসমালাই সে খেয়ে ফেলেছে আধঘন্টা হলো। আরও খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু নেই তো! তন্ময় হাতেগোনা কিছু বানিয়েছে। সবই একাই খেয়ে নিয়েছে। কিঞ্চিৎ লজ্জা নিয়ে পেছনে আঁড়চোখে তাকাল। তন্ময় এখনো তার পিঠ ছুইছুই হয়ে দাঁড়িয়ে। একমনে বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। কী এমন ভাবছে মানুষটা! অরু খালি বাটি নাড়িয়ে বলল,’আপনাকে সাধতে ভুলে গেলাম তো। একাই খেয়ে নিয়েছি।’

তন্ময় একইভাবে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলো,’ভালো লেগেছে?’
‘ভিষণ।’
‘পেট ভরেছে?’

অরুর চোখমুখে না ফুটে উঠল। মুখ ফুটে সে বলতেই নিচ্ছিল না। পূর্বেই শব্দ করে ঢেকুর তুলে ফেললো। ঢেকুর তুলে হাসফাস করে সরে গেল। এদিকসেদিক লোকাতে চাইল। থমথমে নিঃশব্দ পরিবেশে শব্দময় হাসি শোনা গেল। গম্ভীর, গভীর হাসির স্বর। তন্ময়ের হাসির শব্দে অরু ভীষণ লজ্জায় পড়লো। হতভম্ব হয়ে গেল। ঢেকুর আসার সময় আর পেল না। একটু পড়ে আসত। তন্ময় গেলে নাহয় আসত! তখন হাজারবার আসলেও তো কোনো ক্ষতি ছিলো না। ভোঁতা মুখ নিয়ে অরু তন্ময়ের হাসি দেখার সাহস পেলো না। অন্যদিকে
খুব ব্যস্ত পায়ে তন্ময় দরজার দিক অগ্রসর হলো। অরু ভেবে নিল, তন্ময় এবার চলে যাবে। রাত কম তো হলোনা। ঘন্টাখানেক ধরে বারান্দার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখেছে। অরুর এবার ঘুম ধরেছে। চোখজোড়া বুজে আসতে চাইছে। পা’জোড়া ও ব্যথায় ঝিম মেরে গেছে। আর এভাবেও বৃষ্টির দিনগুলো তার বড্ড প্রিয় কি-না! এদিনে ঘুমোতে আরাম লাগে। পেট ভর্তি থাকলে তো কথাই নেই। দরজা বন্ধ হবার শব্দে চমকে ঘুরে তাকাল। তন্ময় দরজা বন্ধ করেছে। অরু স্তব্ধ এবং বিমুঢ়! কপালের মধ্যস্থান কুঁচকে গেল রীতিমতো। ধীরগতি অনুসরণ করে তন্ময় ফিরে আসলো। বৃষ্টি তখনো প্রখর। তন্ময় হাতঘড়ি খুলছে। খুলে টেবিলের পাশে রাখল। ভাড় ছেড়ে দিয়ে বিছানায় বসল। অরু এতটাই তাজ্জব বনে গেল যে প্রশ্ন করতে ভুলে গিয়েছে। তন্ময়কে দেখে মনে হচ্ছে সে এখানেই শোবার প্রিপারেশন করছে। অরু অবাকের চুড়ান্তে। মোস্তফা সাহেব বারংবার বলেছে সেপারেট থাকতে। পাশাপাশি রুমের বিচ্ছেদ পর্যন্ত ঘটিয়েছে। ভয়ে অরুর গলা শুকিয়ে গেল। তন্ময় যদি এই রুমে ঘুমোয় এবং সেটা মোস্তফা সাহেবের কানে যায়, তাহলে তোলপাড় হবে! আর সেইবা কীভাবে বেরোবে। দরজা তো বন্ধ! অরু ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘আমি কিন্তু শাবিহা আপুর রুমে যেতে পারব না। বড়ো চাচ্চু খুব রেগে যাবে।’

তন্ময় চুলগুলো কপাল থেকে উঠিয়ে বলল, ‘এদিকে আয়।’
‘হু?’
‘কোথাও যাবিনা। এখানেই ঘুমোবি।’
‘তাহলে আপনি?’
‘আমিও।’

অরু আশ্চর্যের শেষ প্রান্তে। তন্ময় উঠে দাঁড়ালো। কয়েক পায়ের ধাপে এসে অরুর হাত চেপে ধরলো। টেনে বিছানায় বসিয়ে দিল। সে অন্যপাশে গিয়ে লাইটস ওফ করার সুইচ টিপে দিল। আঁধারে তলিয়ে গেল সব৷ ঘুটঘুটে অন্ধকার। তন্ময় বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়েছে। অরুকে যেভাবে বসিয়েছে সে সেভাবেই বসে। নড়চড় না দেখে পরপরই হালকা টেনে শুইয়ে দিল। অরু চাপাস্বরে চিৎকার করে উঠলো। ভয়ে সে গুটিয়ে গিয়েছে। বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়েছে। তন্ময় তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে নিয়েছে। মুখটা অরুর রেশমি চুলে গুঁজে দিয়ে দিব্বি শান্ত হয়ে গিয়েছে। কোনো নড়চড়, সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না তার থেকে৷ তবুও অরুর সর্বাঙ্গ জুড়ে শিহরণ বয়ে চলেছে। ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠছে হৃদয়। পেটে স্পষ্ট তন্ময়ের হাতের স্পর্শ অনুভব করছে। অনুভব করছে নিশ্বাসের মেলা। কম্পিত গলায় কিছু বলতে চাওয়া অরু বেশ কিছুক্ষন থমকে রইল। মস্তিষ্ক সম্পুর্ন ফাঁকা তার।ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছেনা! শুনতে পেল তন্ময়ের গলা, ‘এভাবে শক্ত হয়ে আছিস কেন! শরীর ছাড়!’
‘আ..আপনি নিজের রুমে যাচ্ছেন না কেন!’
‘ঘুরে তাকা।’
‘না একদম না। আপনি জবাব দেন। কেউ দেখলে কী ভাববে! বড়ো চাচ্চু তো খুব রাগবেন।’
‘আমি দেখে নিব।’

অরু ভেঙাতে চাইল। তবে পেটে থাকা হাতের স্পর্শ গভীর হতেই, কথা গলায় আটকে গেল। থরথর করে কেঁপে, উঠতে চাইল বিছানা থেকে। সেসময় তন্ময় তাকে পাজাকোলে তুলে, ঘুরিয়ে নিয়েছে। মুখোমুখি ভাবে। অরু চোখজোড়া জাপ্টে বন্ধ করে রেখেছে। তন্ময় তার বন্ধ চোখের পাতায় চুমু খেয়ে বসলো। অরু মুচড়ে উঠলো সাপের মতো। তন্ময় ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, ‘ঘুমাতে দে। নড়চড় করবি না।’
‘নিজের রুমে যান তাহলে। আমি নড়চড় করবোই।’
‘আমার যা করতে ইচ্ছে হচ্ছে, করে ফেলি?’

অরুর নড়ানড়ি থেমে গেল আচমকা। শান্ত হয়ে গেল তন্ময়ের বাহুতে থাকা মেয়েটা। তন্ময়ের ঠোঁটের কোণে স্মিথ হাসি। সে অরুর মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ে চোখ বুজল। ভয়ে অরু জড়সড় ভাবে তন্ময়ের বাহুতে শুয়ে থাকলো। কোনোপ্রকার শব্দ বা নড়চড় করার বা মুচড়ে উঠার সাহস পেলো না। সময় অতিবাহিত হচ্ছে অথচ অরুর ঘুম আসছে না। অপরদিকে তন্ময় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অরু একধ্যানে তাকিয়ে রয়েছে তন্ময়ের ঘুমন্ত মুখশ্রীর পানে। খুব আলগোছে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিল উঁচু নাকটা। পরপর গাল। আদুরে ভাবে তন্ময়ের চাপদাড়ি’তে আঙুল ঘোরালো। কপাল, চোখ ও ছুঁয়ে দিল। শুধু ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে পারলো না। তার বেশ লজ্জা লাগছে। নজর যেতেই লজ্জাবোধ চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে। ছুঁয়ে দেওয়া খুব দূরের বিষয়। একসময় অরু পরিবারের কথা ভুলে বসলো। আরামসে তন্ময়ের বুকে মুখ গুঁজে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল। ঘুমের ঘোরে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। অস্পষ্ট স্বরে গুঙিয়েছে কয়েকবার।
____________
লতা বেগম নিজের কথায় ঠায়। তিনি এই বিয়ে মানবেন না। অদ্ভুত! দু’একমাস বা বছর খানেকের ব্যবধান নয়, চারবছরের ব্যবধান। এতবড় মেয়ে তিনি কীভাবে নিজের ছেলের জন্য আনবেন। কেমন দেখাবে এটা! লতা বেগম চোখ মুখ বিকৃত করে বসলেন। অয়ন রাগারাগি করে রাতের আঁধারে বেরিয়ে গিয়েছে। কল করা হয়েছে তাকে কিন্তু ফোন বন্ধ বলছে। লতা বেগম ছেলের জন্য চিন্তিত তবে তিনি এই বিয়েতে একদম মত দিবেন না।
সৈকত সাহেবকেও সমানে ঝেড়েছেন। ইচ্ছেমতো বকেছেন। হন্তদন্ত গলায় লতা বেগম বললেন,
‘মানুষ কি বলবে! আমার ছেলে হাসাহাসির পাত্র হয়ে উঠবে। ছেলেটা নিজের ভালো বুঝে এখনো? কতো বা বয়স ওর! প্রাপ্তবয়স্ক হলে দেখবে, এই বিয়ের উপর চরম বিরক্ত হবে। তখন আমার ডিসিশনকেই সম্মতি জানাবে। এসব আবেগ! বছর খানেকের সংসার করেই, মন উঠিয়ে ফেলবে। না, না এটা হয়না।’
‘সংসার তুমি করবে না। ছেলে করবে। এতো ভেবো না।’
‘আশ্চর্য! ছেলে করবে দেখেই ভাবছি। আমার ছেলের ভালোমন্দ আমি দেখবো না।’
‘তুমি শান্ত হও।’

সৈকত সাহেব হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বড়বড় পা ফেলে চলে গেলেন। তার নিজের ও মন শাঁয় দিচ্ছে না। মুলত ছেলের কারণে রাজি হয়েছেন। সংসার ছেলে করবে, অবশ্যই তার পছন্দ অনুসারে। তাই তিনি অমত করেননি। অপরদিকে শাবিহা তাদের চেনাজানা। গুণবতী মেয়ে! বয়সে একটু বড় হলেই বা কী! কিন্তু এতসব তার স্ত্রী বুঝবে না। তাকে এখন বোঝানো আর না বোঝানো এক! সৈকত সাহেব ভেবে রেখেছেন তিনি এই বিষয়ে পড়ে কথা বলবেন। স্ত্রীর মাথা ঠান্ডা হোক! পকেট হাতড়ে সেলফোন বের করলেন। ছেলেকে কল করলেন আবারো। সুইচডওফ বলছে পুনরায়। চিন্তিত হয়ে পড়লেন। গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। এতো রাতে ছেলেটা গেল কই, দেখতে হবে ত।

চলবে ~
‘নাবিলা ইষ্ক’

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল

৪৩.
শাবিহার কান্নাকাটি থেমেছে রাত দুটো পঁয়তল্লিশে। এতক্ষণ ধরে সে টানা কেঁদেছে। থেমে থেমে ভাঙা গলায় কেঁদেছে। চোখ মুখ নাক সব লাল করে ফেলেছে। টিস্যু তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। গলা শুকিয়ে কাঠকাঠ হয়ে আছে। এক গ্লাস পানি অবদি গলায় দেয়নি। এবার উঠে এক গ্লাস পানি খেল। খেয়ে পুনরায় ফ্লোরে বসে পড়ল। অনেক্ক্ষণ ত কেঁদেছে। কেঁদেকেটে হয়রান হয়ে পড়েছে গলা এবং চোখজোড়া। এখন তারা বিশ্রাম নিচ্ছে যেমন। শত চেষ্টার পরও জল আসছে না চোখ দিয়ে। এরপর থেকে কি হবে? শাবিহার শ্বাস আটকে আসে ভাবতেই। সবাই ত সব জেনে গেল। শাবিহাকে নিশ্চয়ই খারাপ ভাববে? বাজে কথা বলবে। কেউই মেনে নিবেনা তাদের। কেউ না! অয়ন ও দূর হয়ে যাবে। শাবিহার চোখজোড়া ভরে উঠলো পুনরায়। চোখের পাতায় ভেসে এলো, অয়নের মায়াবী মুখমণ্ডল। তার হাসি, রাগ এমনকি মন খারাপের নানান দৃশ্য। নাক টেনে বিছানা হাতড়ে সেলফোন হাতে নিল। অয়নের কোনো কল আসেনি। এতবড় তান্ডব করে, মাফ পর্যন্ত চাইলো না! তার সম্পুর্ন পৃথিবী উজাড় করে দিয়ে, কোনো ধ্যানজ্ঞান নেই ছেলেটার! কোনো চিন্তাভাবনা নেই!

বৃষ্টি থেমেছে। আঁধারের আকাশ এখন ঝকঝকে পরিষ্কার। চাঁদের দেখা মিলেছে। মেঘেদের এড়িয়ে জ্বলজ্বল করছে। চাঁদটা ঠিক অয়নের মাথার উপরে যেন। তার আঙুলের ফাঁকে জলন্ত একটা সিগারেট। সিগারেট খানা হুটহাট ঠোঁটে ছুঁয়ে চলেছে সে। তার মুখের সামনে ধোঁয়ার মেলা। পরনের টি-শার্ট এবং প্যান্ট এখনো ভেজা। চুলগুলো লেপ্টে কপালে পড়ে আছে। প্রচন্ড বিরক্ত ভঙ্গিতে সিগারেটে ফুঁক বসাচ্ছে! উশখুশ করে কয়েকবার দেয়ালে লাথি বসিয়েছে। অস্পষ্ট স্বরে গালিগালাজ করছে। ঠিক কাকে করছে অজানা! চোয়াল শক্ত করে সেলফোন ছুঁড়ে মেরেছে ঘন্টাখানেক আগে৷ সেই ভাঙা ফোন গিয়ে উঠাল। ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। কাজ করছে না। টাচস্ক্রীন চুড়চুড় হয়ে আছে। রেগেমেগে আরেকটি আছাড় বসালো। শব্দ হলো বিকট। তপ্ত শ্বাস ফেললো। চুলগুলো কপাল থেকে উঠালো। লাফিয়ে শাবিহাদের ছাঁদে এলো। ছাঁদের দরজা বন্ধ। নাহলে আজ অয়ন সোজা শাবিহার রুমে ঢুকে যেতো। অস্থির পায়ে ফিরে যেতে নিচ্ছিলো, তখনই পায়ের শব্দ শুনতে পেল। পরপর দরজা খোলার শব্দ। অয়ন ঘুরে তাকাল। শাবিহা এসেছে। এখনো শাড়ি পরে আছে। সাজগোছ কিছুটা নষ্ট হয়েছে। তবে কপালের টিপ এখনো একই যায়গায়। চকচক করছে ফর্সা কপালে। চোখজোড়া ফোলা ফোলা এবং লালচে। কান্নাকাটি করে ভাসিয়েছে যেমন। অয়নকে দেখতেই রেগে তাকাল। হুড়মুড়িয়ে চলে যাবার জন্য পা বাড়ালো। অয়ন দ্রুততম গতিতে ছুটে গেল। চেপে ধরলো শাবিহার হাত। টেনে আনল ছাঁদে। দরজা খানা শব্দ করে লাগালো। দরজার সঙ্গে শাবিহার পিঠ ঠেকিয়ে তাকে আটকে রাখল। শাবিহা হাসফাস করছে। নাক ফুসছে তার। প্রচন্ড রাগে থরথর করে কাঁপছে সে। আজ যা হয়েছে সব অয়নের জন্য। সব দোষ অয়নের। শাবিহা মুচড়ে উঠলো। দু’হাতের সাহায্যে অয়নকে ঠেলতে চাইল। অয়ন সরল না। ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। শক্তপোক্ত গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে তাকিয়ে আছে। এখনই শাবিহাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে যেমন। শাবিহাও সমানতালে রাগী চোখে তাকিয়ে। অয়ন আচমকাই শাবিহার চোখে ঢেকে ফেললো। মাথা নিয়ে গেল শাবিহার ঘাড়ে। সেখানে তপ্ত শ্বাস ফেলছে। গরম তার একেকটি নেওয়া শ্বাসপ্রশ্বাস। খুব গভীর স্বরে বলল, ‘এভাবে তাকাবে না। বুকে লাগে। আমার রাগ উবে যায়৷’

শাবিহা অয়নের হাত সরাতে চাইল। পারলো না। বিরক্ত সুরে বলল, ‘দেখি সরো।’
‘পর পুরুষের সামনে এমন সাজগোছ করে যাবার মানে কী! কই আমার সামনে তো কখনো এভাবে আসলে না।’
‘আসিনি আর আসবোও না। আজই আমাদের শেষ দেখা। তুমি আমার সাথে আর কোনো কানেকশন রাখার চেষ্টা করবে না। ছাড়ো নাহলে আমি চেঁচাব।’

অয়ন আকাশ থেকে পড়লো। শাবিহার চোখের সামনে থেকে হাত সরালো। শাবিহার দৃঢ় নজরে নিজের ক্ষিপ্ত নজর রাখল, ‘কি বললে? আবার বলোতো।’
‘বারবার বলতে পারবো না। সরে দাঁড়াও।’
‘মগের মুল্লুক পেয়েছ নাকি! আমি আইসক্রিমের সস্তা বাটি নই, যে খেয়েদেয়ে ফেলে দিবে।’
‘ফেলে দিলাম।’
‘ভালো হচ্ছেনা কিন্তু।’
‘দেখি সরো।’
‘আরেকবার টেস্ট করে দেখ, মতামত চেঞ্জ হয়ে যেতে পারে।’
‘কি! অয়ন!’
‘এতো জোরসে চেঁচায় না। আশেপাশের মানুষ উঠে চলে আসবে।’

শাবিহা দিশেহারা হয়ে অয়নের হাতে কামড় বসালো। শক্ত কামড়। অয়ন সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে ফেলল। দাঁত খিঁচিয়ে রাখল। তবুও হাত ছোটানোর চেষ্টা করলো না। শাবিহাকে কামড়াতে দিল। অয়নের প্রতিক্রিয়া না পেয়ে শাবিহা আরও বিরক্ত হলো। একপর্যায়ে হাত থেকে মুখ সরালো। দাঁতের দাগ বসে গেছে স্পষ্ট। রক্ত বেরোবে এমন অবস্থা। অয়নের চোখের কোণ ভিজে। শাবিহার একটু খারাপ লাগলো। পরমুহূর্তেই দোষ অয়নকেই দিল। তাকে ছেড়ে দিলে ত আর কামড় দিত না। জেদ ধরে কামড়াতে দিয়েছে। হাত সরিয়ে নিতো। কে না করেছে হাত সরাতে। স্বেচ্ছায় দিয়ে রাখলে কী তার দোষ নাকি! শাবিহা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘আর কামড় খেতে না চাইলে সরে দাঁড়াও।’

অয়ন হাত এগিয়ে দিল,’দাও কামড়।’
‘সত্যি কামড় দিব কিন্তু!’
‘দাও।’

শাবিহা মুখ বাড়ালো। অয়ন চোখ বুজল। নিজেকে প্রস্তুত করে রাখল। তবে যেটার জন্য প্রস্তুত রইলো, সেটা এলো না। নরম তুলতুলে একটি স্পর্শ অনুভব করতে পেল। চমকে চোখ মেলে তাকাল। শাবিহার ঠোঁট জোড়া এখনো ক্ষত স্থান ছুঁয়ে আছে৷ আরেকবার ঠোঁট ছুঁয়ে মাথা তুলে তাকাল। চাঁদের আলোয় দেখতে পারছে অয়নের ফ্যাকাসে মুখশ্রী। বৃষ্টিতে ভিজেছে নিশ্চয়ই। হাত গরম। অয়নের কপালে হাত ছোঁয়াল। জ্বর আসবে আসবে ভাব৷ শাবিহা চিন্তায় পড়ে গেল, ‘বৃষ্টিতে ভিজেছ! কেন!’

অয়ন আরও ঘনিষ্ঠ হলো। মাথায় মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজল। গরম নিশ্বাস ফেলছে সে। তার কন্ঠের স্বর গভীর, ‘আমার তোমাকেই চাই কিন্তু। যেভাবেই হোক না কেন, তোমার আমার হতে হবে। খুব ভালোবাসি তোমায়।’
_____________
শাহজাহান বাড়ির নারীদের ঘুম ভাঙে ভোর সকালে। ভোরের আলো যখন ফুটে। তারপর সম্পুর্ন বাড়িঘরে হাঁটাচলা করবে। অভ্যাসবশত আজও তাই করেছে। বাড়িঘর ঘুরেফিরে রান্নাঘরের কোণে দাঁড়িয়ে রয়েছেন জয়া বেগম। তার বরাবর হয়ে দাঁড়িয়েছেন সুমিতা বেগম। দুজন কোণা চোখে একে অপরের দিক চাওয়া-চাওয়ি করছেন। তবে মুখে কিছু বলছেন না। এমন সময় মুফতি বেগমের প্রবেশ। তার হাতে গ্লাস! এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিতে এসেছেন। এভাবে জয়া বেগম এবং সুমিতা বেগমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শুধালেন, ‘হয়েছে কী?’

জয়া বেগম মুখটা কাচুমাচু করলেন। ঠিক কী বলবেন বা কিভাবে বলবেন বুঝতে পারলেন না! মাথাটা দু দিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন। সুমিতা বেগম ও আঁড়চোখে তাকিয়ে চলে গেলেন। বোকার মতো মুফতি বেগম ফ্রিজের দিক অগ্রসর হলেন। সাতসকালে কী এমন হলো! ওদিকে সুমিতা বেগম ছটফট করছেন। সবকিছু উলটপালট করে ফেলছেন। দুধে পানি ঢেলে ফেলেছেন। আটা গোলাতে পানি বেশি ব্যবহার করেছেন। পরোটায় আলু বেশি হয়ে গেল। এমন হাবিজাবি সব সমস্যা। অন্যদিকে জয়া বেগমও রুখেদুখে কাজ করছেন। বারংবার ফিরে তাকাচ্ছেন একটি কাংখিত রুমের দিক। আরেকবার দৌড়ে ছুটে চেক করছেন, মোস্তফা সাহেব উঠেছে নাকি! তড়িঘড়ি করতে গিয়ে হয়রান হয়ে পড়েছেন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের চিহ্ন! তপ্ত শ্বাস ফেলছেন ক্ষনে ক্ষনে। দ্বিধা জড়িত পায়ে দুবার রুমের সামনে গিয়ে ফিরে এলেন। পুনরায় রান্নায় ব্যস্ত হবার বৃথা চেষ্টা করছেন। সুমিতা বেগম ইনিয়েবিনিয়ে বললেন, ‘ডাকবো?’
‘কি জানি!’
‘ভাইজান উঠে যাবেন কিছুক্ষনের মধ্যেই।’
‘একটা টোকা মেরে আয়।’
‘আপনি যান ভাবী!’
‘তুই যা সুমিতা।’
‘আপনি বড়ো ভাবী। আপনি যান।’
‘আমাকে মানাবে না। তুই ছোট, তুই যাবি।’

মুফতি বেগম চোখমুখ কুঁচকে বললেন, ‘কোথায় যেতে হবে আমাকে বলো! আমি যাবো।’

জ্বলজ্বল করে উঠলো জয়া বেগমের চোখজোড়া। তিনিই অরুর নতুন রুমের দিক আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘টোকা মেরে আয় দু একটা!’
‘এতটুকু কাজ? তোমরা যেমন করছিলে! অদ্ভুত।’

মুফতি বেগম এগিয়ে গেলেন। ছটফট হাতে করাঘাত করলেন। উচ্চস্বরে ডাকলেন ও,’এই অরু! উঠে পড়। সকাল ত হলো!’

পর্দার পেছনে জয়া বেগম আর সুমিতা বেগম। দুজন ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলেন। তবে এখন ঠোঁটের মুচকি হাসি লোকাতে ব্যস্ত। মহা ব্যস্ত!
____________
অরুর ঘুম ভেঙেছে সূর্যের কিরণে। ঝলমলানো কিরণ। সোজা তার পাশে শুয়ে থাকা তন্ময়ের মুখের উপর পড়ছে। উজ্জ্বলতায় ঘেরা তন্ময়ের মুখশ্রী। অরু মন দিয়ে দেখতে লাগলো। একসময় কাত হয়ে উঠে বসলো। সূর্য আড়াল করল। তন্ময়ের মুখে পড়তে দিল না। হাত বাড়িয়ে চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিল। ভাবুক নজরে শুধু তন্ময়কে দেখতে থাকা অরু হঠাৎ করাঘাতের শব্দে চমকে উঠল৷ মুফতি বেগম চওড়া কন্ঠে ভয় পেয়ে গেল। তন্ময়ের ও ঘুম কেটে গিয়েছে। সে পিটপিট করে চোখ মেলেছে। কপালে সূক্ষ্ণ ভাজ তার। বসে থাকা অরুর পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, পরপর উঠে বসলো। অরু ততক্ষণে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। মারাত্মক লজ্জিত সে। এই মুখ বাইরে কিভাবে নিবে। সে ত তন্ময়ের দিকই ভালোভাবে তাকাতে পারছেনা।

তন্ময় বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।দেয়াল ঘড়িতে নজর বোলালো। ঘড়ির কাঁটা আটটা আঠারো’তে। সে ব্যস্ত পায়ে ওয়াশরুমের দিক ছুটলো। যেতে নিয়ে বলে গেল, ‘চোরের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে, উপরে গিয়ে কাপড়চোপড় আর অফিস ব্যাগটা নিয়ে আয়।’

অরুর লজ্জা কেটে গেল। রেগেমেগে অস্থির হয়ে পড়লো তৎক্ষণাৎ, ‘আপনি চোর!’
‘দ্রুত আন।’

অরু গলার স্বর নামিয়ে আরও কয়েকবার ‘চোর, চোর ‘ বলল। খুব শব্দহীন ভঙ্গিতে দরজা খুলল। তার মধ্যে জড়তা কাজ করছে একপ্রকার। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই সবাই জেনে গেছে। হলোও তাই। অরু রুম খুলতেই মুফতি বেগমকে দেখতে পেল। দূরে দাঁড়ানো সুমিতা বেগম এবং জয়া বেগমকেও দেখতে পেল। তারা অপলক দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। মুফতি বেগম ‘উঠেছিস’ বলে হেসে চলে গেলেন। জয়া বেগম ও নজর সরিয়ে সাইড কাটলেন। রয়ে গেল সুমিতা বেগম। তিনি ধীর পায়ে অরুর সামনে এলেন৷ মুখমণ্ডল গম্ভীর করে বললেন, ‘এভাবে বেড়িয়েছিস কেন!’

অরু নিজের দিক তাকাল। বলল,’কীভাবে!’
‘গোসল সেড়ে বেরোতে হয়।’
‘আমিতো দুপুরে গোসল করি মা।’

সুমিতা বেগম মহা বিরক্ত হলেন। কপালে হাত চেপে বিড়বিড় করলেন। মেয়েকে চোখ রাঙিয়ে বললেন, ‘একসাথে থাকলে ফরজ গোসল করতে হয়। তুই…’

তন্ময় বেরিয়ে এসেছে। সে তাওয়াল পেঁচানো। খুব স্বাভাবিক স্বরে বলল, ‘চাচী গতকাল খুব টায়ার্ড হয়ে পড়েছিলাম তাই আর উপরে যাইনি। এখানে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এতকিছু ভাবার মতো কিছু হয়নি।’

সুমিতা চোখ পিটপিট করলেন।’ওহ আচ্ছা’ বলে চলে যাবার জন্য পা বাড়ালেন। অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়েছেন। তিনি তো ভালো চিন্তাভাবনা নিয়ে এসেছিলেন। কে জানত যে সে ফাস্ট ফাস্ট সবকিছু ভেবে ফেলেছেন। ওদিকে অরু বোকার মতো দাঁড়িয়ে। আগামাথা না বুঝতে পেরে শুধালো, ‘কি ভাবার মতো কিছু হয়নি!’

তন্ময় ধমকের সুরে বলল, ‘তোকে কাপড়চোপড় আনতে বললাম!’
‘যাচ্ছিলামই ত। এরমধ্যে… ‘
‘পকপক পড়ে। যা দ্রুত।’

অরু তন্ময়ের আকর্ষণীয় দেহে ভালোভাবে নজর দিতে পারলো না। মুখ বেঁকিয়ে তাড়াহুড়ো পায়ে ছুটলো উপরে। অবশ্য এক ঝলক দেখেছে। তাতেই লজ্জায় তার মরে যাই যাই অবস্থা।

চলবে ~
‘নাবিলা ইষ্ক’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here