প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল-৫৭,৫৮

0
1639

‘প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল-৫৭,৫৮

৫৭.
এক অদ্ভুত অভ্যাস গড়ে উঠেছে মারজির। সেলফোনের পানে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকা। চাতক পাখির ন্যায় স্ক্রিনে চোখ রাখা। মাহিনের কলের আশায়। মানুষটাকে খুব মনে ধরেছে তার। এতো পারফেক্ট মানুষ কিভাবে হয়? কীভাবে? মারজি দুহাত বাড়িয়ে রেখেছে। মাহিনকে একবার ধরতে পারলে ছাড়বে না। একদম বুকে আগলে রাখবে। এতো সুন্দর মানুষ হয় নাকি?

মারজির অপেক্ষার অবসান ঘটলো। মাহিনের কল আসলো। রাত বারোটায়। মারজি তখন ঘুমে ঢুলুঢুলু। একবার রিং হতে না হতেই, লাফিয়ে ওঠে বসল। খুব নিরিবিলি জায়গা দখল করলো। সেটা তার প্রিয় বারান্দা। রিং চারবার হতেই ধরলো, ‘হ্যালো?’

মাহিনের পুরুষালি স্বর শোনা গেল, ‘হু। ডিস্টার্ব করলাম?’

মারজির বুকে ধাক্কা লাগলো। মৃদু ধাক্কা। গভীর রাতে, এই গলার স্বর তার সর্বনাশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে সুপ্ত হৃদয়। বলতে ইচ্ছে করছে, তুই ডিস্টার্ব কর, যতটা ইচ্ছে কর, সারাজীবন কর।আমিতো সেটাই চাই। মুখে বললো, ‘অল্পস্বল্প।’
‘তাহলে কী রাখব..ম্যাডাম!’

মারজি বুকে হাত চেপে ধরলো। উফ.. এভাবে কেউ সম্বোধন করে! সে তো বুক ব্যথায় মরেই যাবে।
তবে রাখি মানে কি? হ্যাঁ? ঘুম ভাঙিয়ে এখন রাখবে! হতচ্ছাড়া! কোনো রাখা রাখি নেই। সারারাত এভাবেই কথা বলতে হবে মারজির সাথে। তবে মুখে কুলুপ এঁটে রাখল। জবাব দিল না। মাহিন বুঝে নিল। শব্দহীন হাসলো। দুষ্টুমি ভর্তি তার স্বরে, ‘ডু ইউ লাইক মি মারজি?….. দ্যা ওয়ে আই ডু!’

মারজির বুকের ভেতরে কি সুনামি শুরু হলো? নাহলে কীসের এতো উথালপাতাল! লাজুক ককন্ঠের স্বর আড়ালে ঢেকে রাখার আপ্রান চেষ্টা, ‘তুমি কি অফিস থেকে আসলে?’

মাহিন বিষম খেল। লম্বাটে শ্বাস গলায় আটকে গেল। হুট করে এতো আদুরে তুমি ডাকার মানে কী! মাঝবয়েসী বখাটে মাহিনকে, কাবু করার ধান্দা! না, এই মেয়ে তার সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াবে নির্ঘাত।
__
আঁধারে তলিয়ে আছে কক্ষটি। ক্ষনে ক্ষনে স্তব্ধতা রুখে অস্পষ্ট শ্বাসপ্রশ্বাসের ঘন নিশ্বাস শোনা যাচ্ছে। বারান্দার দরজা মেলে আছে। পর্দা গুলো অশান্ত ভঙ্গিতে দুলছে। ছিরি ছিরি বৃষ্টির ফোঁটা বারান্দা ভিজিয়ে রেখেছে। ভেসে আসছে বৃষ্টির মৃদু শব্দ ও।

অরুর গোলাপি ঠোঁট জোড়ায় এক চিলতে হাসি, দেখা দিচ্ছে। ঘুমন্ত সে স্বপ্নের ঘোরে মিটিমিটি হাসছে। ঘোরে মধ্যে প্রলাপ করছে। হুট করেই সুন্দর স্বপ্নটা ভেঙে গেল। আড়মোড়া চোখ মেলে তাকাল। সবকিছু অন্ধকার। আঁধার! বৃষ্টির শব্দ শুনতে পেয়ে, কান পেতে দিল। বৃষ্টি হচ্ছে!

অরু হুড়মুড়িয়ে ওঠে বসলো৷ বৃষ্টিতে ভিজলে কেমন হয়? বৃষ্টি বিলাস করে ফেলবে কী? সাথে তন্ময় হলে মন্দ হয়না! দুজন একসঙ্গে বৃষ্টি বিলাস করবে। অবশ্য তন্ময় একটু অমত করবে, ভিজতে চাইবে না! অরুকেও বাঁধা দিবে! তাতে কি? অরু জোর করবে। কঠিন জোর। কথা শুনবে না একদমই।

সেলফোন হাতে নিল৷ রাত বারোটা। তন্ময় নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরেছে? বিছানা ছেড়ে উঠবে, পরমুহূর্তেই তার বিকেলের কথা মনে পড়লো। মানুষটা তো নেই। কাজের সূত্রে বেরিয়েছে। বড়ো এক দীর্ঘনিশ্বাস বেরোলো। কিছুক্ষণের ভালো লাগা কোথায় যেনো হারিয়ে গেল। মানুষটা আশেপাশে না থাকলে অরুর ভালো লাগে না। এক অদ্ভুত যন্ত্রণা সে অনুভব করে৷ বুকের ভেতরে কিছু একটা নেই নেই মনে হয়। আজ কি ছটফট একটু বেশি লাগছে?

অশান্ত মনে অরু ফটো গ্যালারিতে ঢুকলো। কতশত ছবি। সব ছবি ডিঙিয়ে সে তন্ময়ের একটা ছবি মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো। একমনে, স্থির চোখে। তন্ময় ড্রাইভিং করছে। মুখশ্রী গম্ভীর। চোখে কালো সানগ্লাস। কানে ব্লুটুথ। মোটা ঘড়িতে আবদ্ধ বা’হাত খানা, হুইল চেপে। মন খারাপ নিয়ে অরু স্ক্রিনে বেশ কিছু চুমু খেল। সেলফোন বুকে চেপে পুনরায় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। একটা কল করে নিবে?

আনচান মনে উঠে দাঁড়ালো। বারান্দার দিকটায় এগোল৷ খুব করে ভেবে নিয়ে তন্ময়ের নাম্বার ডায়াল করলো। ফোন বন্ধ৷ শহরের বাইরে গেলে নেটওয়ার্ক প্রব্লেম দেখা দেয়। বেশিরভাগ সময় লাইনে পাওয়া যায়না মানুষটাকে। গম্ভীর সুপরিচিত সেই কন্ঠের স্বর শুনতে পেলে, খারাপ লাগাটা অনেকটাই কমে আসতো তার। অভিমান হলো খুব৷ এতো করে থাকতে বললো। কথা শুনেছে? অরুকে একদম গুরুত্ব দেয়না। একটুও না। ওর কথার কি পাঁচ টাকার দামও নেই? এবার ফিরলে কথাই বলবে না। দেখাও করবে না। এতসব যন্ত্রণা দিচ্ছে সেগুলো ফেরত তো দিতে হবে, সুদেআসলে!

বিষন্ন মনে অরু বাইরে তাকিয়ে। পৃথিবী কাঁদছে। হয়তো তারও মন খারাপ ঠিক অরুর মতো। অভিমানী সে বিরবির করে, ‘ফিরে আসুন না। আমার যে ভালো লাগে না।’
_____
থেমে থেমে, ঝুম শব্দে বর্ষা নামছে। এফোঁড়ওফোঁড় তোলা বর্ষণ। হিমশীতল বাতাস। ঘন, প্রবল স্রোতে একঝাঁক বৃষ্টি রয়েসয়ে বইছে। স্যাতলা রাস্তাঘাট ফকফকে পরিষ্কার আজ। জলসিক্ত গাছপালাদের বেসামাল উথালপাতালতা। মেঘের সঙ্গে মেঘের চুড়ান্ত সংঘর্ষনের তীব্র শব্দ! আকস্মিক চমকে আশপাশ জ্বলে জ্বলে উঠছে ক্ষনে ক্ষনে। রাস্তার দুপাশে মেলেছে ঘন জঙ্গল। সারি সারি বড়ো বড়ো গাছ।

আকাশী রঙের আকর্ষণীয় গাড়িটি, দুমড়েমুচড়ে ঝলসে গিয়েছে ঝিমনো বড়ো বট গাছটির সঙ্গে। বনাট লাফিয়ে উঠে গিয়েছে। দাউদাউ আগুন ধরেছে সেখানটায়। কালো ঘোলাটে ধোঁয়া উড়ছে গুরুতর ভাবে। সামনের দুপাশের চাকা ছুটে বেরিয়েছে। আশপাশে ছড়িয়ে পড়েছে পোড়াটে গন্ধ।

হলুদ দানবীয় ট্রাক খানা বেশ সুস্থসবল রয়েছে। কিছুটা দূরেই তা দাঁড়ানো। হন্তদন্ত ভঙ্গিতে ট্রাক থেকে বেরোলো মাঝবয়েসী এক ভদ্রলোক। রেজাউল আলম তার নাম। টাঙাইল যাচ্ছিলেন মাল নিয়ে। এমন পরিস্থিতিতে পড়বেন, স্বপ্নেও ভাবেননি। তিনি খুব ঘাবড়ে পড়েছেন৷ অন্যকেউ হলে জীবন নিয়ে পালাতো৷ ভুলেও গাড়ি রুখে এগিয়ে আসতো না। এ*ক্সিডেন্টে গুরুতর হলে তো নির্ঘাত জেল, সেটা জেনে কেনই বা কেউ আসবে এগিয়ে?

ভয় রেজাউলও পাচ্ছেন। তবে নরম মনের তিনি পালাতে পারলেন না। সৎসাহস নিয়ে চওড়া গলায় ধমকে সরালেন, সামনে জড়ো হওয়া ছাতার তলে মাথা পেতে দাঁড়ানো লোকজন। তাদের সরিয়ে ক্রমশ ভেতরে যাচ্ছেন তিনি। ইতোমধ্যে চপচপে ভিজে গিয়েছেন।

ভেঙেচুরে যাওয়া গাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ড্রাইভিং সিটের জানালার কাঁচ ফেটে গিয়েছে। ফেটে বেরিয়েছে একটি র*ক্তাক্ত হাত। যা রীতিমতো ধীরে ধীরে নড়ছে। কাঁপতে কাঁপতে পরপর সম্পূর্ণ হাত বেরিয়েছে। ভেতরের মানুষটা জীবিত বুঝতে পেরে, আর এক সেকেন্ড দেরি করেনি রেজাউল। ছুটে সামনে অগ্রসর হলেন। জানালা টেনে হিঁচড়ে খুলে ফেললেন। আঁধারে তলিয়ে থাকা র*ক্তাক্ত তন্ময়কে জাপ্টে ধরে বের করে আনলেন। মাটিতে শোয়ালেন। মাথাটা নিজের রানে নিয়ে নিলেন।

তন্ময়ের কপাল ফেটেছে। অঝোর ধারায় তরল র*ক্ত বইছে। কান গলা বেয়ে যাচ্ছে টকটকে লাল র*ক্ত। মেখে গিয়েছে পড়ন্ত শার্টও। রেজাউল নিজের কোমরে বাঁধা গামছা খুলে তন্ময়ের কপালে তৎক্ষণাৎ বেঁধে দিলেন। শক্ত করে। এক্ষুনি র*’ক্ত ক্ষরণ থামানো প্রয়োজন।

হাত বাড়িয়ে তন্ময়ের গাল চাপড়ালেন দু’বার। নড়েচড়ে ওঠে তন্ময়। অস্পষ্ট চোখ মেলে তাকায়। আল্লাহর অশেষ রহমতে সাংঘাতিক কিছু হয়নি। কপাল ফেটেছে আর হাত লম্বা আঁচে কে’টেছে। কতশত দোয়া’ই না এই ছেলের জন্য বরাদ্দ!
নাহলে এতটা গুরুতর এক্সিডেন্টেও, সুস্থসবল কিভাবে রয়?

এমন ভয়ংকর এক্সিডেন্ট ঠেলে খুব কম মানুষ জীবন নিয়ে ফিরে। কেউবা ফিরে তবে জীবন্ত লা’শ হয়ে।
___
রেজাউল চেঁচালেন, ‘পানি আছে কারো কাছে?’

ছিপছিপে গড়নের যুবক এগিয়ে আসলো। পিঠে তার কালো ব্যাগ। ব্যাগ থেকে নিজের পানির বোতল এগিয়ে ধরলো। রেজাউল বোতল নিলেন। সাবধানতাজনিত ভঙ্গিতে কিছুটা পানি মুখে দিলেন তন্ময়ের। পরপর আরও কিছুটা পানি খাইয়ে, বোতল সরালেন।

তন্ময় অজ্ঞান হয়েছে। এখন আর চোখ মেলে তাকাচ্ছে না। কোনো সাড়াশব্দ নেই। রেজাউল ভড়কে গেলেন। শব্দ করে চেঁচালেন। গালে ছোট করে চড় দেবার ভঙ্গিতা করছেন। আঙুল নাকের ডগায় ধরলেন। নিশ্বাস আছে। জীবিত বুঝতে পেরে, রেজাউল শান্ত হলেন। তড়িৎগতিতে দু’হাতে আগলে ওঠালেন। এক্ষুনি হসপিটাল যেতে হবে।
____
দেয়াল ঘড়ি ঘুরছে একটায়। ড্রয়িংরুমে এখনো আলাপ-আলোচনার উত্তমমধ্যম চলছে। ইতোমধ্যে মোস্তফা সাহেব জেনেছেন, সৈয়দ সাহেবদের আসবার কারণ! তিনি তো মেনে নিয়েছিলেন অয়ন-শাবিহার সম্পর্ক। তার মতে মেয়ের খুশির থেকে বড়ো কিছু আর নয়। নিজের অর্থ-সম্পদ এমনকি সম্মান ও নয়। মেয়ে আগে তারপর সবকিছু। এখন মেয়ে যদি নিজের থেকে বয়সে ছোট কাউকে বিয়ে করে সুখী হয়, তাহলে তাই ঠিক। তিনিই তাই মানবেন। সদরে গ্রহণ করবেন।

লতা বেগম স্পষ্ট বাদী মহিলা। গুরুগম্ভীর নন। আবার ওমন হাস্যজ্বলও নন। যতটুকু অনুভূতি থাকার তার মধ্যে আছে। তিনি মন খুলে কথা বললেন। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেন সম্পর্ক নতুনভাবে তৈরি করার। তার কথা কাজেও দিয়েছে। শাহজাহান পরিবারের সন্তুষ্টি তাদের ব্যবহারেই প্রকাশ পাচ্ছে। পরিবর্তন এসেছে থমকে যাওয়া দুই পরিবারের মধ্যে। এ’যেনো নতুন সম্পর্কের সূচনা!

বিয়েটা অবশেষে মেনে নেওয়া হয়েছে। কথাবার্তা চলছে। এখন দু’পক্ষের গুরুজন সহ আসনে বসার পালা। সুষ্ঠুভাবে একটি ডেইট ফিক্সড করার পরিকল্পনা। তাড়াহুড়ো নেই! ধীরেসুস্থে বিয়ের কার্যক্রম হবে৷ আপাতত মোস্তফা সাহেব অন্যকিছু নিয়ে ভাবছেন। তিনি একটা ডিসিশন নিয়েছেন। নিজ উদ্যোগে। যার সম্পর্কে এখনো কাউকে কিছু বলেননি। এবং আপাতত বলবেন না। বলবেন সময় বুঝে।

আকাশ তড়িঘড়ি করে এলো। অশান্ত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল, ‘অদ্ভুত!তন্ময় এখনো আসে নাই? সেই কখন আসতে বললাম। আমিতো ভাবছি ও ঘন্টার মধ্যে বাড়িতে এসে হাজির হবে। অথচ, ঘন্টার পর ঘন্টা পেরচ্ছে, ওর খবর নাই!’

মুহূর্তে মোস্তফা সাহেবের হাস্যজ্বল মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে আসলো। চিন্তিত মুখে তিনি ভুরু জোড়া কুঁচকে বললেন, ‘কল দাও তো।’
‘ফোন স্যুইচডওফ চাচ্চু!’
‘ওখানে গিয়ে পৌঁছেছে? খবর নিয়েছ?’
‘হু। যায় নাই।’

আনোয়ার সাহেব কথা তুললেন, ‘কলে কি বলছ তন্ময়কে?’
‘তাড়াতাড়ি আসার জন্য তাগাদা দিলাম মাত্র। আমি শুধু বলছিলাম তাড়াতাড়ি আয়। সর্বনাশ ঘটছে। একটু যেনো দ্রুত ফিরে আরকি!’

ওহী সাহেব তৎক্ষণাৎ ছেলেকে ধমকে ওঠেন, ‘ছেলেটা অরুকে অসুস্থ দেখে গেছে। চিন্তায় কতবার করে কল করলো, দেখস নাই? এসময় তোর সর্বনাশ হয়েছে, এ-র মানে কী দাঁড়ায়? অপদার্থ ছেলে। গাধার বাচ্চা!’

মোস্তফা সাহেব ‘আহ চুপ কর’ বলে ওঠে, ওহী সাহেবকে দমিয়ে রাখলেন। চোখমুখ শান্ত করে রেখেছেন। তবে ভেতরে তিনি বড্ড অশান্ত হয়ে পড়েছেন। ছেলেকে কলের উপর কল দিয়ে যাচ্ছেন। তন্ময় খুব কয়েকবার কল করেছিল। মোস্তফা সাহেব ধরেনি জেদ ধরে। এখন নিজের উপর রাগ হচ্ছে! ছেলেটা হয়তো বেশ চিন্তায় ছিলো।

ইতোমধ্যে হাস্যজ্বল মুখশ্রী গুলোতে চিন্তা লেপ্টে। অয়ন উঠে দাঁড়ালো। গাড়ির চাবি পকেট হতে বের করতে নিয়ে বললো, ‘আমি গিয়ে দেখে আসি। এভাবে দুহাত গুটিয়ে রেখে তো লাভ নেই।’

মোস্তফা সাহেব মাথা দোলালেন। তবে স্বস্তি পেলেন না। অদ্ভুত এবং মারাত্মক কিছু উলটপালট চিন্তাভাবনা মাথায় হানা দিতে শুরু করেছে। ছেলেটা বিপদে পড়লো কি-না! জবেদা বেগম রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। চিন্তিত সুরে বিলাপ করছেন। বড্ড অশান্ত ভঙ্গিতে পায়চারি করছেন। স্বামীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। ছেলেমেয়েরা ঘর ছেড়েছে দেখতেই তিনি চিন্তায় পড়েন। যতক্ষণ অবদি না তারা সহিসালামত বাড়ি ফিরে। আর এমন একটি খবরে তিনি সম্পুর্ন নেতিয়ে।
__
রাতের তিনটা। তন্ময়ের কোনো হদিস নেই। অয়ন আর আকাশ খালি হাতে ফিরে এলো। কোনো খোঁজ খবর দিতে পারলো না। মোস্তফা সাহেব এবার অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। পুলিশ ইনফর্ম করার জন্য উতলা হলেন। ওহী সাহেব রাজি হলেন। সেও বলছেন পুলিশ নিয়ে বেরোতে।

তাদের আলোচনার মাঝপথে অরু নেমে এলো। চোখ দুটো তার ফুলো। সকলকে একসঙ্গে দেখে চমকে উঠলো। হাবভাব সুবিধার নয় বুঝে নিল। তবে কি হয়েছে ঠিক বুঝতে পারলো না। সে অবুঝের মতো নিচে নেমে এলো। প্রশ্ন করল, ‘কি হয়েছে?’

মুফতি বেগম এগিয়ে এলেন। অরুকে ধরলেন। নরম কন্ঠে বললেন, ‘কিছু না। এতো তাড়াহুড়ো কিসের? এভাবে চলাফেরা করবি না। দেখি..খিদে পেয়েছে? আয় কি খেতে ইচ্ছে করছে, চাচী এখনই বানিয়ে খাওয়াবে তোকে।’

অরু ভীষণ অবাক হলো। তার পরিবার ছোট থেকেই আদুরে, যত্নশীল। তবে আজ একটু বেশি নয় কি? সবাই এতো আগ্রহ কেন তার উপর? সবার মুখে একটাই কথা, ‘সাবধানে।’

অরু মুফতি বেগমের সাথে রান্নাঘরে গেল। ঝাল কিছু একটা হলেই হবে জানাল। মুফতি বেগম চটজলদি পাস্তা বানানোর কার্যক্রম শুরু করলেন।

অরু আলগোছে মুফতি বেগমের কাছে গেল। গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। গলার স্বর নামিয়ে শুধালো, ‘কি হয়েছে?’
‘কিছুই না।’

জবেদা বেগম রান্নাঘরে আসতেই তাকে ধরলো অরু, ‘এই বড়ো মা। কি হয়েছে?’
‘কি হবে পাগল মেয়ে? কিচ্ছুটি না। দেখি বোস..শুধু তড়িঘড়ি। এখন থেকে এগুলো একদম বন্ধ। নাহলে কান মলে দিব আচ্ছাকরে।’

সুমিতা বেগম আদূরে হাতে মেয়ের চুলগুলো বাঁধতে ধরলেন। অরু আকাশ সমান চমকে সবাইকে দেখে নিচ্ছে। কী হয়ে গেল সবার? কিছু ঘন্টায় কি এমন হয়েছে?
__
কলিং বেল বাজছে। রাত তিনটা পঁচিশ। থানায় যাবে বলে, বেরোতেই নিচ্ছিলো শাহজাহান সাহেব।
তড়িঘড়ি করে এগোলেন মোস্তফা সাহেব। বাড়ির সবাই লিভিং রুমে চোখ পেতে। জবেদা দরজার দিক ছুটেছে। ছেলেটা এসেছে কি-না!

অরু এক প্লেট পাস্তা হাতে দাঁড়িয়ে। কলিং বেলের শব্দে সেও ডাইনিং ছেড়ে উঠে এসেছে। এসময় কে এসেছে? আর বাড়ির সকলের চোখমুখের অবস্থাও ভালো নয়। এগুলো দেখে, কৌতূহলের শেষ নেই তার৷

দরজা সটানভাবে মেলে গেল। রেজাউল দাঁড়িয়ে আছেন তন্ময়কে আগলে ধরে। তন্ময়ের মাথা হেলেদুলে আছে। ব্যান্ডেজে মুড়িয়ে আছে মাথা হাত এবং পা। রক্তে মাখামাখি শার্ট-প্যান্ট। ভেজা অবস্থা শরীরের। অরুর হাতের প্লেট সজোরে শব্দ তুলে মেঝেতে পড়ে গেল৷ চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে নানা টুকরোয়। জবেদা বেগম মেঝেতে ধপ শব্দে পড়ে গিয়েছেন। শান্ত নেই বাকিরাও।

মোস্তফা সাহেব কেমন হেলে পড়লেন। বিষ্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন কেমন। অবিশ্বাস্য চোখে সামনে চেয়ে আছেন। পা’ও আজ থমকে। ভীমড়ি খেয়ে পড়তে নিতেই হুঁশে আসলেন যেন। পরপরই হন্তদন্ত ভঙ্গিতে ছুটে সামনে অগ্রসর হলেন। বুক ফেটে আর্তনাদ বেরোলো, ‘কি হইলো আমার আব্বার!’
________
চলবে ~
‘নাবিলা ইষ্ক’

‘প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল’

৫৮.
বেহিসেবী বর্ষা অঝোর ধারায় ঝরে প্রকৃতি রুষ্ট করতে এখনো ব্যস্ত। থেমে থেমে চমকাচ্ছে মেঘেদের দল। আঁধার পৃথিবীকে ক্ষনিকের আলোর ঝলকানি দেখিয়ে দিচ্ছে। অশান্ত বাতাস তেড়ে আসতে চাইছে বাড়ির ভেতরে।

স্তব্ধতা ভেঙে, অরু সজোরে চিৎকার করে ওঠে। আর্তনাদ! কেমন ধড়ফড়িয়ে ছুটে এগোল। অগ্রাহ্য করে বসলো মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা, কাঁচের টুকরো গুলো। নরম তুলতুলে পায়ের তলা কাঁচ ঘেঁষে যেতেই, র’ক্তের ছোপ ছোপ দাগ ভেসে উঠল মেঝেতে। ভড়কে উঠলেন আনোয়ার সাহেব। বিমুঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। পরপরই দ্রুত হাতে মেয়েকে বুকে আটকে নিলেন। তন্ময় বেশ দুর্বল। দাঁড়াতে পারছে না। তাকে ধরে আছে মোস্তফা সাহেব, ওহী সাহেব। পেছনে অয়ন, আকাশ ও সাহায্য করছে। সেখানে অরু কিভাবে যাবে? তাই আটকে রেখেছেন। কিন্তু অরু ছটফটিয়ে উঠছে। এখন আর সে চিৎকার করছে না। হাউমাউ শব্দে কাঁদছে। নিজেকে ছাড়াতে চাচ্ছে। দুয়ারে দাঁড়ানো তন্ময়কে ছুঁতে চাওয়ার অসীম প্রচেষ্টায় মগ্ন সে। আনোয়ার সাহেবের বুঝ তাকে বোঝাতে সক্ষম হচ্ছে না। তার চোখের সামনে শুধু র’ক্ত! তন্ময়ের বিষণ্ণ মুখশ্রী। দুর্বল শরীর!

রেজাউল সাহেব তখনো দরজা ধরে দাঁড়িয়ে। ভেজা তন্ময়কে দু’হাতে আগলে ধরেছেন, লম্বাচওড়া সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মোস্তফা সাহেব। ওহী সাহেবের সাহায্যে ছেলেকে ভেতরে নিতে নিয়ে, ব্যাকুল গলায় বিড়বিড়িয়ে আওড়ালেন, ‘কি হয়ে গেল এসব আব্বা! এই তন্ময়!’

রেজাউল চটপট জবাব দিল,’ এক্সিডেন্ট! কবরস্থানের ওদি..’

অ্যাক্সিডেন্ট শুনেই থমকে যান জবেদা বেগম। খোদার নাম নিয়ে রীতিমতো হেলে পড়েছেন। মুফতি বেগম এবং সুমিতা বেগম না ধরলে, তিনি পরে যেতেন ফ্লোরে।
_____
ইতোমধ্যে শাবিহাও চলে এসেছে। ভাইয়ের এই করুণ হাল, সেও মেনে নিতে পারছে না। দু’চোখ ভিজে উঠেছে। কিছুক্ষণ আগের উত্তেজনা, ভালো লাগা কোথায় যেন উবে গেল। একরাশ ভয়, আতঙ্ক বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে দিল। সোফায় একান্তে বসে ফুপিয়ে কাঁদছে। তন্ময়কে কামরায় নেওয়া হয়েছে। সবাই সেখানে। শাবিহাও গিয়েছিল। দাঁড়ানোর যায়গা নেই বিদায়, বড়দের জায়গা দিয়ে সরে এসেছে। অয়ন ও তার পিছু পিছু এসেছে। চারিপাশে নজর বুলিয়ে পাশে বসেছে। খানিক কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়েছে। শাবিহার কান্নার স্বর মিইয়ে গেল মুহুর্তে। তবে চোখ তুলে তাকাল না। শব্দহীন কান্নায় নিমজ্জিত সে।

অয়ন স্বান্তনার সুরে বলল, ‘কাঁদছ কেন? কান্না থামাও। ভাইয়ার কিছু হয়নি। সকালেই দেখবে সুস্থ!’

শাবিহা ভেজা গলায় বিড়বিড় করল, ‘কি হয়ে গেল! কেন হলো! এইতো বিকেলেও সুস্থসবল ছিল!’
‘তুমি এভাবে কাঁদলে অরুকে সামলাবে কে? মেয়েটা কেমন করছে দেখেছ? প্রচন্ড ভয় পেয়েছে। এই অবস্থায় এতো হাইপার হওয়া ওর জন্য ভালো না।’

শাবিহা মাথা দোলাল। দু’হাতে চোখমুখ মুছল। উঠে দাঁড়ালো। তাদের অরু তো এখন একা নয়। অরুর ভেতরে আরেকটি অরু আছে। দুজনের খেয়াল রাখতে হবে। অয়ন হাসলো। সেও উঠে দাঁড়ালো। পুনরায় চারপাশে নজর বোলালো। কেউ নেই! মুহুর্তে শাবিহার হাত টেনে বুকে জড়িয়ে নিল। শক্ত করে, দৃঢ় বন্ধনে। শাবিহা চমকে উঠলো। ছাড়াবার জন্য ছটফট করছে, ‘আরে..কি করছ!’

অয়ন হেসে সশাবিহাকে বাহু বন্ধন হতে মুক্ত করলো। হাত বাড়িয়ে শাবিহার চোখের জল মুছিয়ে দিল, ‘আজকে একটা জিনিস উপলব্ধি করলাম। তোমার চোখে পানি আমার সহ্য হয়না। বুকে যন্ত্রণা অনুভব করি।’

শাবিহা চোখ আড়াল করলো। মুখমণ্ডল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শুধালো, ‘এখন কি আমি কাঁদতেও পারব না?’

অয়ন হাসলো, ‘যাও। অরুকে দেখ।’

শাবিহা আড়চোখে তাকাল। মাথা দুলিয়ে অগ্রসর হলো পূর্ব দিক। সেদিক থেকে অরুর গলা শোনা যাচ্ছে। মেয়েটা কীভাবে কাঁদছে! তার কান্নার তোড়ে বাকিরা চুপসে গেছে। কেউই আর নিজেদের আবেগ দেখাচ্ছে না। বুকে গেঁথে রেখেছে। তাদের শান্ত দেখে হয়তো অরুর কান্নাকাটি থামবে। তার হৃদয় শীতল হবে।
___
প্রকৃতি প্রাণবন্ত, ভেজা-ভেজা। আবহাওয়া ঠান্ডা। নির্জন চারিপাশ। মৃদু বাতাস বইছে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ ভেসে আসছে। বৃষ্টি থেমেছে। আকাশ এখনো মেঘলা। প্রকৃতি আঁধারে।
পর্দা গুলো দাপিয়ে দুলছে। এলোমেলো ভঙ্গিতে ছুঁয়ে দিচ্ছে অরুর মুখশ্রী। সে জানালা আর বিছানার মধ্যে বসেছে। পর্দাগুলো তাকেই পেয়েছে জ্বালানোর জন্য। বিছানায় মাথা পেতে রেখে, বসেছে সে ফ্লোরে। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত জেগে ছিলো। চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে ছিল তন্ময়ের পানে। সহস্র চুমু খেয়েছে মুখমন্ডল জুড়ে। কতটাই না শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছিল মানুষটাকে। ভয়ে সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপেছে। তন্ময় চোখ মেলে তাকিয়েছে। অস্পষ্ট স্বরে জানিয়েছে, সে ঠিকাছে! তখনই একটু শান্ত হয়েছে মেয়েটা! তার আগ পর্যন্ত শুধু কেঁদেছে। আর্তনাদ করেছে। পাগলের ন্যায় ছটফট, ধড়ফড় করেছে।

গলাটা শুকিয়ে কাঠকাঠ হয়ে এসেছে তন্ময়ের। কয়েক প্রচেষ্টার পর আধো-আধো চোখ মেলে তাকায়। মাথা সহ শরীর বেশ ভাড় হয়ে আছে। বড্ড যন্ত্রণা অনুভব করছে সর্বাঙ্গে। চোখ জোড়া কুঁচকে, কপালে হাত চেপে ধরে। অনুভব করে ব্যান্ডেজের। দৃষ্টি পরিষ্কার করে পাশে তাকায়। তার ব্যান্ডেজ করা বাম হাত, জাপ্টে ধরে ঘুমাচ্ছে অরু। তন্ময়ের চোখের ভাঁজের মাত্রা দ্বিগুণ হয়। এতো কষ্ট করে ঘুমানোর মানে কি? ঘাড়ে ব্যথা পাচ্ছে না? তন্ময় উঠে বসতে চাইল। পারলো না। শরীর বেশ দুর্বল।

দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে জবেদা বেগম। সারারাত তিনি জেগেই কাটালেন। ক্ষনে ক্ষনে এসে দেখছেন ছেলেটা উঠেছে কিনা! কিছু লাগবে কিনা! তন্ময়কে নড়তে দেখেই এগিয়ে আসলেন। গলার স্বর নামিয়ে শুধালেন, ‘কি লাগব আব্বা? উঠে না!’

বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন৷ আঁচলে মুখ মুছলেন। তন্ময় মায়ের হাত টেনে পাশে বসালো। ভাঙা গলায় বলল,’আমি ঠিকাছি মা।’
‘কই ঠিক আছস? ভালোভাবে কথাটুকু বলতে পারতেছস না!’

তন্ময় চোখের ইশারায় অরুকে দেখাল, ‘ও এভাবে শুয়ে আছে কেন? কিছু বলোনি!’
‘তোর বাবা, চাচ্চু আমি সবাই কত করে বললাম! কথা শুনল না। এসময় কতো গুঁছিয়ে চলতে হয়। মেয়েটা কোনো কথাই শোনে না। এখন কি ও একা? কবে…’

ছেলের প্রশ্নবোধক চাহনিতে দৃষ্টি মিলতেই, জবেদা বেগম হুট করে থেমে গেলেন। মনে পড়লো ছেলে তার কিছুই জানে না। জবেদা বেগম এবার প্রগাঢ় দৃষ্টিতে ছেলের মুখশ্রী দেখে নিলেন। বিচিত্র ভঙ্গিতে ঠোঁটের কোণ ঠেসে হাসি ছুটলো তার। তন্ময়ের সন্দেহজনক স্বর, ‘কি হয়েছে মা অরুর?’

জবেদা বেগমের হাসির রেখা বড়ো হলো, ‘অরুর দায়িত্ব কার এখন? ও না-হয় ছোটো? তুই ও কি ছোটো? দেখেশুনে রাখবি না! কতটুকুই বা বুঝে!
হেলাফেলা চলবে না। সচেতন হ। খেয়াল রাখ। দায়িত্ব নে!’

তন্ময় ঘাবড়াল। গলার স্বর বেশ সচেতন, ‘হয়েছে কী?’
‘কি হবে? অরু প্রেগন্যান্ট! বাপ হতে যাচ্ছস আর জানস ও না! পোলাপান মানুষ করবি কেম্নে?’

তন্ময় পলক ঝাপটাল। পরপর থমকাল। দৃষ্টি নিথর। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রেখেছে। অসামান্য বড়ো হয়ে আছে চোখ। বেশ খানিক সময় নিল, ‘কী! মানে..’

জবেদা বেগম হেসে ছেলের মাথায় হাত রাখলেন। বোলালেন। উঠে এক গ্লাস পানি এগিয়ে রাখলেন। যাবার পূর্বে বলে গেলেন, ‘খাবার নিয়ে আসি। খাবি! তোর বাপ কিচ্ছুটি মুখে নেয়নি। এখন যদি তোর দেখাদেখি একটু খায়।’

তন্ময় তখনো থমকে বসে। মায়ের কথা বুঝতে বেশ সময় লাগলো তার। দৃঢ় দৃষ্টি ফেললো অরুর নরম ঘুমন্ত মুখশ্রীর পানে। মাদক চাহনিতে খুব করে দেখে নিল। হাত বাড়ালো। আঙুলের সাহায্যে গাল ছুঁয়ে দিল। নিস্তব্ধ কক্ষে আওড়াল, ‘সত্যি?’ চোখ বুজল। লম্বা শ্বাস নিল। দমবন্ধ হয়ে আসছে। সুখে কী? এক অদ্ভুত উত্তেজনায় সর্বাঙ্গ শিরশির করছে। ভাগ্যের উপর চরম বিরক্ত সে। এই মুহুর্তে তাকে অ্যাক্সিডেন্ট করতে হলো? এইযে অরুকে পাজাকোলে তুলতে পারছে না। আদরে দিশাহারা করতে পারছে না! অসম্ভব ভাবে চোখজোড়া লাল হয়ে এসেছে। বাবা হবার খুশিতে?
__
উইকেন্ডস ছাড়া মাহিন খুব পরিপাটি মানুষ। ঠিকঠাক সময় মতো খেয়ে নেয়। রুটিন মাফিক ঘুমোয়। ন’টায় অফিস থাকে! আটটায় বাড়ি ফিরে। উইকেন্ডের বিষয় আলাদা। সেদিন আড্ডা দেয় বন্ধুদের সঙ্গে। ঘুমোতে দেরি আর উঠতেও। সেই সময়নুমাফিক চলা ছেলেটা আজ কোথায় হারিয়ে গেল? অফিস থেকে ফিরে কথা বলা শুরু করেছে, এখনো করছে। ভোর হতে চলেছে। মারজি ঘুমঘুম গলায় কিছু একটা বলছে। মাহিন শুনছে। হাতে কফির মগ। এই নিয়ে তিনটা কফি শেষ করলো। কত ঘন্টা ধরে কথা বলছে? চার-পাঁচ ঘন্টা তো হবেই। না এবার থামতে হবে। টিনএজেরদের মতো করলে চলবে নাকি? মেয়েটাকে তো ঘুমোতে হবে! কাল আবার নাকি তার ক্লাস আছে! মারজির বকবকানি মাঝপথে থামিয়ে মাহিন বলল, ‘ক্লাস আছে না? ঘুমোতে যাও!’
‘তুমি কি ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলছ? বিরক্ত হচ্ছ?’

মাহিন নিঃশব্দে হাসলো। জবাব দিবে পূর্বেই ইনকামিং কল আসার, নোটিফিকেশন দেখা গেল। এসময় ইব্রাহিমের কল? মাহিন তাগাদা দিল, ‘শুয়ে পড়ো। গুড নাইট।’

মারজি অভিমান করতে চাইল। হলোনা। ঘুমে চোখ বুজে গিয়েছে। মুহুর্তে ঘুমের দেশে পাড়ি জমাল। কান থেকে সেলফোন ও সরানো হলো না।

‘কি হয়েছে?’ মাহিনের সচেতন গলার স্বর।

ইব্রাহিম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। কোনো বাজে সংবাদ শুনবে, বুঝে নিয়েছে মাহিন। হলো ও তাই। ইব্রাহিম জানালো, ‘তন্ময় অ্যাক্সিডেন্টে করেছে!’
‘হোয়াট? আর ইউ কিডিং?’
‘খবর পেলাম মাত্র। আকাশ বললো। অবস্থা তেমন খারাপ না। ঠিক আছে।’
‘কেম্নে কী!’
‘জানি না। যাবি?’
‘হ। কল দে শুহানি ওদের। জানা! গেলে মিলেমিশে যাই৷’
‘কল দিতেছি দুপুরের দিক।’
‘উম!’
___
ঘরের বাতি বন্ধ। পর্দা টেনে দেওয়া হয়েছে। কামরা মৃদু আঁধারে তলিয়ে। তন্ময় ভাঙা পা আর দুর্বল শরীরে উঠে দাঁড়িয়েছে। অরুকে জাপ্টে ধরে তুলেছে। পুরো শরীর ব্যথায় নিল হয়ে গেল! কাঁ’টা ক্ষত গুলো এখনো কাঁচা। টান লেগেছে অরুকে তুলতে গিয়ে। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সে দেয়াল ধরে ঘনঘন শ্বাস নিল। তারপর ধীরে বিছানায় উঠে বসলো। অরুর পাশে শুয়ে পড়লো। শরীরে কাঁথা মেলে নিল। অনিমেষ ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকলো। কেঁদেকেটে মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। লাল হয়ে আছে মুখমণ্ডল। চোখের জলের দাগ এখনো দৃশ্যমান। তন্ময় ঘনিষ্ঠ হলো। অরুকে বুকে নিল আলগোছে। মুখের কাছে মুখ এগিয়ে নিল। দু’চোখের পাতায় চুমু বসালো। গলা নামিয়ে ডাকল, ‘অরু!’

জবাব এলো না। তন্ময় হাত নিচে নামাল। অরুর পেটে ছুঁয়ে দিল। খুব করে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছে এখানটায়! কান পেতে বসে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে! তার ছোট্ট অরু মা হবে। তার অনাগত সন্তানের মা। ভাবতেই শরীর লোমকূপ দাঁড়িয়ে উঠছে। তন্ময় মুখ ডোবাল ঘন রেশমি চুলে। গোঙাল, ‘ধন্যবাদ জান। আই লাভ ইউ।’
_________
চলবে ~
‘নাবিলা ইষ্ক’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here