প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল-৫৯-৬০ (অন্তিম পর্ব)

0
2713

‘প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল-৫৯-৬০ (অন্তিম পর্ব)

৫৯

অরু কিছুটা ছন্নছাড়া। একটু বদমেজাজি। সামান্য বোকাসোকা ও। বুঝে কম, চেঁচায় বেশি। তাই বলে এতটাই অবুঝ হ্যাঁ? সে প্রেগন্যান্ট, অথচ নিজেই জানে না! বাকি সকলেই জানে! দুঃখ পেল। কষ্ট অনুভব করল। তবে চোখে জল এলো না। সে আনার চেষ্টা করেছে সামান্য। যখন থেকে প্রেগন্যান্সির খবর শুনেছে, পেটে হাত বুলিয়ে চলেছে সমানে। ক্ষনে ক্ষনে আয়না দেখছে। বিড়বিড়িয়ে কিছু একটা আওড়াচ্ছে। অনাগত সন্তানের সঙ্গে হয়তো বোকা মেয়েটা কথা বলতে চাচ্ছে! বাড়ির সবাই চিন্তায় অরুকে নিয়ে। নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছে। অরু নাকি অনেক ছোটো। এমন অল্পবয়সে বাচ্চা নেওয়া ঝুকিপূর্ণ বিষয়। তার সম্পুর্ন জীবন উপভোগ করা বাকি। পড়াশোনাই বা কতদূর গেল? নিতান্তই ছোটো মেয়েটা এখনই বাচ্চা নিলে, ভবিষ্যতে এই বিবাহ জীবন তার আর ভালো লাগবে না। ইত্যাদি!
এসব শুনে অরুর মন খারাপ হলো। ভীষণ পরিমাণে! বাড়ির সবাই কেন ভাবছে যে তার বয়স হয়নি? হয়তো অরু অবুঝ। পরিবারের ভালোবাসার আবডালে বড়ো হওয়া একটা বড়সড়বাচ্চা। কিন্তু সে আশেপাশের মানুষ দেখে। বন্ধুবান্ধবদের অবস্থা জানে। এসএসসি দিয়েই তার বান্ধবী রূপা বিয়ে করে ফেলল আলহামদুলিল্লাহ, এখন সে দু’বছরের বাচ্চার মা। তার বয়সী অনেক মেয়ে-ই সংসার করছে। তাদের বাচ্চা আছে। তাহলে অরু কেন পারবে না? পারবে সে। পেরে দেখাবে সবাইকে। এই বাচ্চার জন্য অরু সবকিছু করতে রাজি। সবকিছু!

ভালোবাসার রঙ লাল। লাল কেন? কারণ লাল রক্তের প্রতীক। আর রক্ত আমাদের ভেতরটায় অবস্থিত। রক্ত বিহীন কী মানুষ বাঁচে? উঁহু নয়। বাঁচে না। তেমনই ভালোবাসা ছাড়া মানুষ বাঁচে না। মানুষ মাত্রই ভালোবাসার কাঙাল। ভালোবাসার দাস। এতো কষ্ট, বিচ্ছেদ, হৃদযন্ত্রণার পরও ভালোবাসাই চেয়ে যায় মানুষ। ভালোবাসার মানুষ কাছে চায়, পাশে চায়। একটা দিন চোখের মনিটার উপর প্রিয় মানুষটার মুখ ভেসে না উঠলে, বক্ষে শান্তি মিলে না। পরানে আগুন জ্বলে দাউদাউ করে। যন্ত্রণা অনুভব হয়। ছটফট করে হৃদয়। আর যদি ভালোবাসার মানুষটা কথা না বলে? তাহলে কেমন অনুভূতি হয়? ভয়ংকর নয় কী? অবশ্যই। তন্ময় একদম কথা বলছে না। অরুর পানে তাকাচ্ছে না। গম্ভীরমুখে অন্যদিকে ফিরে রয়। খেতে বসে মাথা নিচুস্তর পদে রাখে। চুপচাপ থাকে। অরু বিড়ালছানার মতো তার আশেপাশে ঘুরেফিরে বেড়ায়। একটু দৃষ্টি পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে রয়। কিন্তু পাষাণ মানুষটার কোনো হেলদোল নেই। ভুলবশত ও ফিরে দেখছে না।কেমন থমথমে করে রেখেছে চেহারা। কেন? তন্ময় কী খুশি নয় এই সুখবর শুনে? সে কী বাচ্চাটা চায় না? পরমুহূর্তেই মনে পড়ল বড়ো মায়ের কথা। তিনি স্পষ্ট গলায় বলেছিলেন, বাবা হবার খুশিতে তন্ময় ইমোশনাল হয়ে পড়েছিল! কেঁদেছে ও। তাহলে? অরুর সাথে এমন কেন করছে? আকাশকুসুম ভাবনায় বিভোর সে, বড্ড অসহায় হয়ে পড়েছে।
বক্ষে বইছে সীমাহীন, আসমান জমিন ধ্বংসের সমান যন্ত্রণা। অসহ্যকর এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি শুধু তাকে তন্ময় দিতে পারবে।
_________
হাসপাতালে এপয়েন্টমেন্ট নেওয়া হয়েছে সকাল দশটার। দশটার পূর্বেই অরুকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরোনো হবে। সুমিতা বেগম ন’টার মধ্যেই ব্যাগ গুঁছিয়ে নিয়েছেন। প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়েছেন সঙ্গে। যেমন, ফ্ল্যাক্সে গরম পানি। টিস্যু, নরম তুলতুলে খাবার। পানির বোতল, ইত্যাদি। জবেদা বেগম রান্নাঘরে। তিনি খুব ভোরে আকাশকে দিয়ে টাটকা সিং মাছ আনিয়েছেন। মেয়েটা হাসপাতাল যাবে। রক্ত পরিক্ষা করাবে। কতগুলো রক্ত নেওয়া হবে। শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। সেসময় সিং মাছ বড্ড উপকারী। শরীরে রক্ত হতে সাহায্য করে। সঙ্গে তিনি আনাড় আনিয়েছেন। এই ফলেও শরীরে রক্ত হতে সাহায্য করে। এমন অনেককিছুই আনিয়েছেন যা এখন অরুর শরীরের জন্য উপকারী।

অরুর সঙ্গে হাসপাতালে যেতে সবাই তৈরি। এইযে দীপ্ত সকালসকাল ড্রয়িংরুমে বসে। তৈরি হয়ে। বাড়ির সকলের আগে। এরপর এসেছে আকাশ তারপর শাবিহা। তারাও নাকি যাবে হাসপাতালে। পাঞ্জাবি পরে এসেছেন মোস্তফা সাহেব। আনোয়ার সাহেব ও পরপর এলেন। ড্রয়িংরুম ভর্তি মানুষ দেখে, একে অপরের মুখে তাকিয়ে হাসলেন। সজোরে, উচ্চস্বরে। জবেদা বেগম হেসে বললেন, ‘বাচ্চাদের গিয়ে কাজ নেই। বড়ো কয়েকজন গেলেই হবে।’

আনোয়ার সাহেব হাসলেন। এগোলেন বড়ো ভাইয়ের দিক। কাছাকাছি এসে বললেন, ‘ভাইয়া যান। আমি থাকি।’
‘না না। তুই যা আমি থাকি।’

তর্কতর্কি হলো কিছুক্ষণ। অবশেষে ফয়সালা হলো। আনোয়ার সাহেব এবং মোস্তফা সাহেব দুজনেই যাবেন। সঙ্গে সুমিতা বেগম। ব্যস! অরু নেমেছে। বড়ো বড়ো চোখে সবাইকে দেখছে। তারা বেরোবে এমন সময় তন্ময় বেরিয়ে আসলো। ধীরেসুস্থে। তাড়াতাড়ি হাঁটলে ব্যথা পায়। খুব সাবধানে হাঁটতে হয় তার। তাকে দেখে মোস্তফা সাহেব চিন্তিত হলেন। জিজ্ঞেস করতে চাইলেন, ‘তুমি কেন… ‘

আনোয়ার সাহেব ভাইয়ার চোখে চোখ রাখলেন। ইশারায় কিছু একটা বোঝালেন। হয়তো মোস্তফা সাহেব বুঝেছেন। তাইতো আর কিছুই বললেন না। আড়ালে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। শেষমুহুর্তে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে চারজন বেরিয়েছেন।

তন্ময় ড্রাইভিংয়ে বসেছে। এক্সিডেন্টের পর একটা ট্রমাটিক সিচুয়েশনে ছিল সে। আপাতত নেই। সুস্থসবল ভাবেই চালাচ্ছে। হাতে চিনচিন ব্যথা অনুভব করছে, তবে তা সম্পুর্ন অগ্রাহ্য করল মস্তিষ্ক! এই সামান্য ব্যথা তার একরোখা মস্তিষ্ক নাজেহাল টিস্যুর মতো ডাস্টবিনে ফেলে দিল যেন!

অরু বাপ-চাচার মধ্যখানে চুপসে বসে আছে। মোস্তফা সাহেব চিন্তিত নয়নে বারবার পাশে তাকাচ্ছেন। মেয়েটার কোনো সমস্যা হচ্ছে কি-না! থেমে নেই আনোয়ার সাহেব ও। তিনি বড়ো ভাইয়ের থেকে এগিয়ে কি-না! প্রশ্নই করে বসলেন,’খারাপ লাগছে আম্মা?’

অরু মাথা নাড়াল। চোখ বুজল। আবারো খুলল। সামনে তাকাল। তন্ময়ের পাশে সুমিতা বেগম বসে। তিনি ফিরে তাকালেন। পানির বোতল বের করে এগিয়ে ধরলেন, ‘একটু খেয়ে নে। ভালো লাগবে।’

বাড়ি থেকে বেরিয়ে আধঘন্টা হয়নি। এখনই কী পানির তৃষ্ণা পায়? অরু তবুও হাত বাড়িয়ে নিল। অল্পখানিক পানি খেয়ে বোতল হাতে রাখল। উদাসীন চাহনি নিক্ষেপ করল পাষাণ মানুষটার দিক। মানুষটা কী বুঝতে পারছে তার হৃদয়ের ব্যাকুলতা? ভেতরটা যে ক্ষনে ক্ষনে দুমড়েমুচড়ে উঠছে উপলব্ধি করতে পারছে? পারছে না। তাইতো এভাবে কষ্ট দিতে পারছে।

আনোয়ার সাহেব দক্ষ চোখের অধিকারী। আশেপাশের হালচাল চোখা চোখে দেখে বুঝে ফেলতে পারেন। আপনজনের মুখ পড়ে সবকিছু বুঝে ফেলার গুণ তার মধ্যে বিদ্যমান। তাইতো ছেলেমেয়ের মধ্যে সমস্যা চলছে বুঝতে সময় লাগেনি। দুজনের মধ্যে একটা রেষারেষি চলছে, বুঝে নিলেন আনোয়ার সাহেব। তন্ময় বুদ্ধিমান ছেলে। প্রচন্ড নির্ভরশীল। অগাধ বিশ্বাস এই ছেলের প্রতি তার আছে। ঠিক সামলে নিবে। ঠিক করে নিবে। ভেবেই আনমনে মৃদু হাসলেন আনোয়ার সাহেব। নিজেদের বোঝাপড়া নিজেরাই করে নিক। মাত্রই তো শুরু সংসার জীবন। এমন ছোটোখাটো কথা-কাটাকাটি, মান-অভিমান নিয়েই তো এগোতে হবে।

অপেক্ষাকৃত মনমানসিকতা নিয়ে দাঁড়িয়ে দুই গুরুজন। দৃষ্টি তাঁক করে রেখেছেন সামনে। অরুর বেশ কিছু টেস্ট নেওয়া হয়েছে। একেক টেস্টের জন্য একেক ফ্লোরে যেতে হচ্ছে। গার্ডিয়ান শাহজাহানেরা সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছেন। তন্ময় বেঞ্চে বসে দু’পা ছড়িয়ে। একনাগাড়ে সে দাঁড়াতে পারছিল না বিধায়, একপ্রকার জোরপূর্বক ছেলেকে বসিয়েছেন মোস্তফা সাহেব। পাক্কা দু’ঘন্টা লেগেছে সবগুলো টেস্ট করাতে। রিপোর্ট গুলো কাল নিয়ে যেতে হবে। তন্ময় প্রেসক্রিপশন নিয়ে এসেছে। সুদূরে অরু দুর্বল হয়ে, ঢলে পড়েছে সুমিতা বেগমের বাহুতে। একটু র’ক্ত নিয়েছে, আর একটুখানি এদিকসেদিক কী যেতে হয়েছে, তাতেই নাজেহাল অবস্থা মেয়েটার।
_______
‘মাহিন!’
‘হু! ক!’
‘দুঃসংবাদ শুনছস! এখন সুসংবাদ শুনবি না?’
‘আবার কী হইলো?’
‘আংকেল হতে যাচ্ছস শালারপো!’

মাহিন থমকাল সামান্য ঘাবড়াল। সোফা ছেড়ে দাঁড়াল। হতবাক, বিমুঢ় সে, ‘কী কস? গাঞ্জা খাইছস?’
‘তুই দিছস?’
‘ইব্রাহীম! কী বলতাছস?’
‘আমাদের বড়ো তন্ময় চাচা ওরফে আমাদের চ্যাম্প.. চ্যাম্পের চ্যাম্পিয়ন আসতে যাচ্ছে!’
‘খাইছেড়ে!’
‘খাইছে মানে! বাইড়া তাড়াতাড়ি। এক্ষুনি যাইতে হইব।’

মাহিন দেরি করল না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শরীরে শার্ট জড়িয়ে, টেবিল থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সোজা হাইওয়ে চলে এলো। এখানে সীমান্ত ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে রিয়াদ, শুহানি, ইব্রাহীম। তারা মাহিনের অপেক্ষাতেই ছিল। কথোপকথনে পুরোদমে ব্যস্ত। গাড়ি নজরে আসতেই প্রত্যেকে উঠে বসলো। পেছনে রিয়াদ, শুহানি। সামনে ইব্রাহীম। মুহুর্তে টেনে চলে গেল গাড়িটা। উদ্দেশ্য শপিংমল। কিছু কেনাকাটা করবে। সঙ্গে হরেকরকম মিষ্টি.. ফলমূল নিতে হবে না? এমন সুসংবাদ অনেককিছুর প্রাপ্য।
______
বাড়িতে ফিরে ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিয়েছে অরু। মায়ের হাতে স্যুপ খেয়েছে। মাথায় পানি দিয়েছে। ফলের রস খেয়েছে। নিজেকে সুস্থসবল করে রুম থেকে বেরিয়েছে। মাথাটা বের করে আশেপাশে নজর বুলিয়েছে। না কেউ নেই! তারপর ছোট ছোট পা ফেলে তন্ময়ের রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তন্ময় বিছানার সাথে হেলে বসে। মুভি দেখছে মনোযোগ দিয়ে। অরু গুটিগুটি পা ফেলে বিছানার সামনে দাঁড়াল। তন্ময় তাকে দেখেও দেখছে না। অবশেষে করুণ গলায় ডাকল, ‘শুনেন।’

তন্ময় মাথা তুলে তাকাল। অরুর মায়াবী মুখে দৃষ্টি তাঁক করল। এবং তাকিয়েই থাকল। নজর আর সরাল না। তীক্ষ্ণ ভূতগ্রস্ত দৃষ্টিতে অরু ভীতু হলো। নড়েচড়ে উঠল। দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল। বুকের ভেতরটা ধপাস করে উঠল। এভাবে তাকালে অরুর বুঝি কিছু হয়না? অপরদিকে তন্ময় শুধু তাকিয়েই আছে। কোনোপ্রকার প্রশ্ন করছে না। আর নাইবা দৃষ্টি সরাচ্ছে। অদ্ভুত! অরু তীক্ষ্ণ দৃষ্টির মাঝেই বিছানার কোণে বসলো। জড়সড় ভঙ্গিতে। জামার কোণ ধরে মোচড়ামুচড়ি করছে। মস্তিষ্ক হাতড়ে কিছু একটা বলে, ‘মুভি দেখছেন?’

তন্ময়ের জবাব এলো না। তবে সে ল্যাপটপ ঘুরিয়ে দিয়েছে অরুর দিক। যাতে সে নিজে দেখে নিতে পারে। অরু কষ্ট পেলো। কিছুক্ষণ আগের মিশ্রিত লজ্জিত অনূভুতি সুদূরে পালাল। মনের গহীনে হানা দিল একরাশ বিষন্নতা। গুমোট বাঁধ ভাঙা কান্না ঠেলে আসতে চাচ্ছে। সে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রাখল। কান্না না করার আপ্রান চেষ্টা করল। তার দ্বারা হলো না। ক্ষনিকের মাঝে চোখের কোণ ঘেঁষে গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। ফুঁপিয়ে উঠল। গলার স্বর নামিয়ে আওড়াল, ‘কথা বলেন না কেন! কী করছি আমি?’

তন্ময় নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকলো। তারপর হুট করে উঠে দাঁড়াল। ভাঙা পা ফেলে ধীর গতিতে গিয়ে দরজা লক করল। ফিরে এসে দাঁড়াল অরুর সম্মুখীন হয়ে। একদম সামনাসামনি। অরুর কান্না গলায় আটকে গেল। চোখের জল থমকে গেল। মুখ তুলে সে তাকাল। তন্ময় ঝুকল। একদম অরুর মুখ বরাবর। তার ঘন, তপ্ত নিশ্বাস অরুর মুখশ্রী ছুঁয়ে গেল। অনিমেষ তাকিয়ে থাকলো ক্ষনিক। সময় নিয়ে শুধালো, ‘তুই পিল গুলি নিয়েছিলিক?’
________
চলবে ~

৬০.
অরু হকচকিয়ে ওঠে। বড়ো বড়ো চোখে চায়, দীঘল কালো পাপড়ি ঝাপ্টে ঝাপ্টে। মুখটা বড়সড় আকারে হা হয়ে রয়। তন্ময় কীভাবে বুঝল? সত্য কখনো চাপা থাকে না। আর তার তন্ময় ভাইয়া তো বুদ্ধিমান। এমন বুদ্ধিমান মানুষের কাছ থেকে কী সত্য লুকানো যায়? অরু চোখ নামাল। অপরাধীর ন্যায় মাথা নাড়াল। দু’পাশে। যার অর্থ দাঁড়ায় সে পিলগুলো নেয়নি। তন্ময় সচল চোখে ইশারা ইঙ্গিত দেখল। বুঝল। তবে বক্ষে শান্তি পেল না। তাই ধমকের সুরে শাসাল, ‘মুখে বল।’
‘না। নেইনি।’
‘কেন?’

অরু ‘কেন’ এর জবাব কী দিবে? হৃদয়ে যেই চিন্তাভাবনা রেখেছে সেগুলো বলবে? নাকি চুপ রইবে। পরপর আরেকদফায় ধমক খেল। দৃষ্যমান রূপে কেঁপে উঠল। নাক ফুলিয়ে তাকাল। মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল, ‘আমি..আমি ভাবছি আপনি খুশি হবেন।’

তন্ময় হাত বাড়াল। অরুর গাল চেপে ধরল। মাথাটা উঠিয়ে চোখে চোখ রাখল, ‘আমার খুশি দিয়ে কী? আমার খুশির জন্য এতো বড়ো একটা স্টেপ কীভাবে নিলি? অরু তুই এতো অবুঝ কেন? একটা বাচ্চা…সাধারণ বিষয় নয়। একটা বাচ্চা ক্যারি করার মতো মনমানসিকতা তোর নেই! যেই ধকল.. যেইসব সমস্যা দিয়ে তুই যাবি তা অগুনিত। শারীরিক, মানসিক সবরকম যন্ত্রণা দিয়ে যাবি। প্রসবের যন্ত্রণা তুই সহ্য করতে পারবি? পারবি না। এই যন্ত্রণা গুলো দিয়ে তুই একা যাবি। আমি না। তাহলে কেন? তুই…’

অর টলমল চোখে চেয়ে। আচমকাই তন্ময়ের কোমর দু’হাতে জাপ্টে নিল। পেটে মাথা চেপে ধরল। কান্না মিশ্রিত স্বরে বলল, ‘আপনি পাশে থাকলে আমি সব সইতে পারব।’

তন্ময় থমকাল। স্থির চোখে তাকিয়ে থাকল। পরমুহূর্তেই মাথা নুইয়ে হামলে পড়ল, অরুর কোমল গোলাপী ঠোঁট জোড়ায়। নেশাক্ত বস্তুর স্বাদে নিজেকে হারিয়ে ফেলল। বেশকিছু সময় পেরোল। অরুকে বুকে গেঁথে রাখল। মাথায় হাত বুলিয়ে তন্ময় আওড়াল, ‘আমি খুশি। ভীষণ খুশি। আমার হৃদয়ের এই অনুভূতি শ্রেষ্ঠ অনুভূতি। যা তুই দিয়েছিস।’
__________
মোস্তফা সাহেব দক্ষ মিস্ত্রি এনেছেন। দোতলার পেছনের রুম দুটো ভাঙতে। ভেঙে একত্রিত করে বর্তমান ডিজাইন মোতাবেক, একটা সুন্দর আলিসান কামরা বানাতে। তন্ময় আর অরুর জন্য। এরমধ্যে তিনি ভাইদের নিয়ে একটা ছোটোখাটো মিটিং সেরেছেন। মুখ্য বিষয় তন্ময় আর অরুর আনুষ্ঠানিক বিয়েটা সেরে ফেলা। শাবিহা অয়নের বিয়ের পূর্বেই, তন্ময় অরুর বিয়েটা ঘরোয়া ভাবে সেরে ফেলার উদ্দেশ্যে রেখেছেন মনে৷ গার্ডেনে প্যান্ডেল সাজাবেন। রীতিনীতি অনুসারে মেহেদী, হলুদ তারপর বিয়েটা! ডেট ফেললেন একুশ তারিখ শুক্রবার। আজ থেকে চারদিন পর। পরশু থেকে মেহেদী, হলুদের প্রোগ্রাম শুরু করবেন। চেনাজানা মানুষদের নিমন্ত্রণ করবেন৷ বিকেল দিকেই সিলেট কল লাগালেন। নিমন্ত্রণ করলেন শ্বশুর বাড়ির সকলকে। তারা কালকের মধ্যেই চলে আসবে। মোস্তফা সাহেব সুমিতা বেগমের পরিবারকেও নিমন্ত্রণ করেছেন। কলের মাধ্যমে পারা প্রতিবেশী.. আপনজন যারা ছিলেন সবাইকে তিনভাই মিলে নিমন্ত্রণ করে ফেললেন।

মাহিনদের আগমন ঘটেছে সন্ধ্যায়। হাত ভর্তি তাদের সরঞ্জাম। অনেককিছুই এনেছে। এরমধ্যে হাস্যকর বিষয় দাঁড়াল, বেবি টয়েস! এতগুলো বাচ্চাদের খেলনা। সেগুলো গোছাতে নিয়ে জবেদা বেগম সহ বাড়ির সকলেই হাসলেন। হট্টগোল পড়ে গেল। চেঁচামেচি, তোড়জোড় এলাহি সব কাণ্ড। তাদের হট্টগোলে শুনে কী না এসে থাকা যায়? তন্ময় এলো। তাকে ধরে বন্ধুদের অযৌক্তিক সব আচরণ। এই ইমোশনাল তো পরপর হাসিঠাট্টার স্বরে খেপানো।

মাহিন তন্ময়ের পাশে বসে। হাতে জুসের গ্লাস। সে মনোযোগ সহ বন্ধুর এক্সিডেন্টের বিবরণ শুনল। সিরিয়াস সিচুয়েশন। সেমুহুর্তে হুট করে মাহিন শুধাল, ‘কীরে! বাচ্চাটা কেম্নে চলে আসল! ক্রেডিট কিন্তু সব আমার হ্যাঁ? রাস্তাটা ক্লিয়ার আমি করেছিলাম।’

তন্ময় হাসলো। বন্ধুদের অযৌক্তিক আচরণের সঙ্গে সে বড্ড পরিচিত। অপরদিকে মাহিনের চেঁচামেচিতে অরুকে আসতে হলো। একপ্রকার বাধ্য হয়ে। লজ্জিত মুখে সে দাঁড়াল। শুহানি বক্ষে চেপে ধরেছে অরুকে। অজস্র আদরে মেয়েটাকে ভরিয়ে দিল। রাশভারি গলায় কতশত নরম কথা বলল। অরু আদুরে মুখে শুনল সবটাই। জবাব দিতে পারল। গাল দুটো ভারী হয়ে আসছে।
_______
আকাশে বড়ো চাঁদ। ছাঁদ নির্জন। হিম শীতল বাতাস বইছে। ঠান্ডা আবহাওয়ায়। শাবিহা দাঁড়িয়ে এককোণে। দৃষ্টি দূর আসমানে। তার পেছনে লম্বাটে অয়ন। প্রশস্ত দেহ দ্বারা শাবিহাকে জাপ্টে রেখেছে বক্ষস্থলে। ঠোঁটের বিচরণ চলছে ঘাড়ে। হাত বেসামাল ভঙ্গিতে কোমরে চলে গিয়েছে, ‘মন খারাপ কেন? আমাদের মন খারাপের দিন শেষ শাবিহা!’

শাবিহা শিউরে উঠল। তার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। নিজেকে ছাড়াতে চাইল। পারল না। অবশেষে ঘুরল। অয়নের চোখে চোখ পড়ল, ‘আমার মন খারাপ না। আমি খুব খুশি।’
‘তাই বুঝি? খুশির একটা ঝলক দেখাও।’

শাবিহা অনিমেষ তাকিয়ে থাকল। হাত বাড়াল। অয়নের গাল ছুঁয়ে দিল। মুখ বাড়িয়ে ওর গালে ঠোঁট স্পর্শ করাল। লাজুক গলার স্বরে বলল, ‘দেখলে?’
‘উহু।’

শাবিহা উঁচু হলো। দ্বিতীয় গালেও চুমু বসালো। এবং নিজেই কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল, ‘এবার?’

অয়ন হাসল। সুদর্শন পুরুষের সুদর্শন সেই হাসি। অয়ন মাথা ঝুকাল। মাথাটা শাবিহার ঘাড়ে রাখল। লম্বা শ্বাস নিল। স্রেফ গলায় বলল, ‘সেদিন মেঘলা আকাশ ছিল। বৃষ্টি হবে বলে। আমি ছাঁদে ছিলাম। ব্যাট বল নিয়ে। বৃষ্টির কয়েক ফোঁটা পড়ল। তুমি তখন দৌড়ে ছাঁদে এলে। এলোমেলো চুল। অপ্রস্তুত তোমার অবস্থা! চোখমুখে চিন্তা। ধড়ফড়িয়ে শুকনো কাপড়চোপড় নিতে খুবই ব্যস্ত। আমি ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকলাম। এলেমেলো কেশের সেই অপ্রস্তুত নারী হৃদয়ে পা ফেলল। খুব যত্নে, অজান্তে। ভালোলাগার স্বাদ জাগাল। ধীরেসুস্থে প্রেমে ফেলে দিল। তারপর এক গভীর ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরল। নিজেকে আর কখনো ছাড়াতে পারিনি। আমি চাইনি ছাড়াতে। শাবিহা.. বয়সের ব্যবধান কখনোই ভালোবাসার উর্ধ্বে নয়। আমার ক্ষেত্রে তো নয়ই।’
‘হু।’
‘কী হু? বলো আমাকে ভালোবাস?’
‘তুমি জানো আমার উত্তর।’
‘আমি কিচ্ছু জানি না। তুমি বলবে।’
‘দেখি ছাড়ো নিচে যাব।’
‘জবাব দিয়ে যাও।’

শাবিহা একসময় নড়াচড়া থামাল। আশেপাশে তাকাল। মনের ভেতরে অনেককিছু আছে। যা অপ্রকাশিত। বলা হয়নি। বলা প্রয়োজন। কিন্তু পারছে না। অয়ন হাল ছাড়ল। ধরে নিল ভালোবাসি এই মেয়ের মুখ থেকে আর শোনা হবে না৷ সে সরে দাঁড়াল। হাসল। বলল, ‘যাও। শ্বশুর আব্বা নাহয় চলে আসবে! তিনি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন, বিয়ের আগে মেলামেশা করা যাবে না। তিনি আরও বলে, আর তো মাত্র একমাস। সবুর করো। সে কী আর জানে এই প্রেমিক পুরুষের জন্য, এই একমাস সহস্র বছরের সমান!’

শাবিহা সরু চোখে দেখল ছেলেটাকে। আচমকাই মনের কথাটি বলার সাহস এলো। এবং সেইমুহুর্তেই, অয়নকে চমকে সে জানায়, ‘ভালোবাসি।’
________
মেহেদী আর্টিস্ট এসেছে গতকাল। দু’হাতে মেহেদী পরিয়ে দিয়ে গিয়েছে। টকটকে গাঢ়ও হয়েছে রঙ। তালুতে ছোট করে লেখা তন্ময় নামটিও র’ক্তাক্ত লাল। কথায় কথায় তার আশেপাশের মেয়েগুলো বলছে, মেহেদীর রঙ যতটা লাল হয়, স্বামী ততটাই ভালোবাসে। সেগুলো শুনে অরুর কী যে লজ্জা লাগছে। সে তো মুখোমুখি হতে পারছে না কারো!

আজ গায়ে হলুদ। দুজনের। দু’পাশ দিয়ে। অরু হলুদরঙের শাড়ি পরেছে। দুগালে তার হলুদ। দিয়েছে মারজি। ইচ্ছেমতো হলুদ ঘষেছে মেয়েটা। নিজেও নিজের গালে লাগিয়েছে। হৈ-হুল্লোড়, গানবাজনা, নাচানাচি, চেঁচামেচি সবই হলো। সবথেকে বেশি চেঁচামেচি আসছে ওপর পাশ হতে। তন্ময়ের ওখানে এলাহি কাণ্ড ঘটছে। পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নিয়েছে।

অরুর হলুদ গোসল হলো। নতুন কাপড় পরিয়ে তাকে বিছানায় বসানো হয়েছে। দুদিন ধরে তার আশেপাশে ছায়ার মতো থাকে শাবিহা আর মারজি। আরও তো অনেকেই আছে যারা সর্বক্ষণ রুমে থাকছে৷ তারজন্য তন্ময়ের সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। লুকোচুরি চলছে। এই অনুভূতি বড্ড অদ্ভুত!

রাতে পাঞ্জাবি গায়ে তন্ময় এসেছে। অরুর রুমের সামনে। দুয়ারে দাঁড়িয়ে। কাল শুক্রবার তাদের বিয়ে। আজ রাতে একটু কথা বলবে না? মেয়েটাকে একটু ছুঁয়ে ও তো দেখা হয়নি। মারজি বুদ্ধিমান। তন্ময়কে দেখতেই আলগোছে রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। শাবিহা আগেই চলে গিয়েছে ফোনে কথা বলতে। রুম খালি হতেই তন্ময় ঢুকল। দরজা লাগাল। অরু তখন শুয়ে ছিল। হুট করে তন্ময়কে দেখে তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। দাঁড়াতে চাইল৷ তন্ময় দিল না। জোরপূর্বক পুনরায় শুইয়ে দিল তাকে। পাশে সে শুয়ে পড়ল৷ মাথাটা অরুর বুকে রাখল। হাত দুটো অরুর নরম কোমর পেঁচিয়ে নিয়েছে। নিজের সাথে লেপ্টে ধরেছে। ধীর গলায় জানাল, ‘ঘুম ধরছে।’
‘তাহলে ঘুমান গিয়ে।’
‘এইতো ঘুমোচ্ছি।’
‘না না। নিজের রুমে গিয়ে ঘুমান।’

তন্ময় হাসল। মাথা তুলে তাকাল। চোখ জোড়া ঘুমে লাল হয়ে গিয়েছে, ‘তোকে নিজের সাথে জাপ্টে ধরে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে।’

অরু হার মারল৷ আরাম করে শুইল। তন্ময়কে নিজের বুকে শোবার জায়গা করে দিল যেন। ডান হাতে চুলও টেনে দিতে শুরু করল। তন্ময় আরামে গোঙাল। অল্প সময়ের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ল। অরু তবুও সেভাবেই থাকল। দেখা গেল সেও সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছে। দুজন দুজনের আলিঙ্গনে রয়ে গেল সারাটি রাত।
_______
এই মনে হয় একমাত্র বিয়ে যেখানে কান্নাকাটি নেই। রয়েছে উল্লাস, উচ্ছ্বাস, আনন্দ। সবাই নাচগানে ব্যস্ত। নতুন বউ সোফায় বসে ফল খাচ্ছে। নতুন বর হাঁটু গেড়ে তার বউয়ের নখ কাঁটায় ব্যস্ত। এই দৃশ্য একটু কমিক্যাল, আবার আনন্দদায়ক ও।

এতো মেহমানদের মাঝে অরু কলিকে দেখতে পেয়েছিল। যেই কলি একসময় তার তন্ময় ভাইকে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। কারণ আল্লাহ তায়ালা তন্ময়কে শুধু তার জন্য পাঠিয়েছেন। তারপর সে সুমনাকেও দেখেছে।শুনেছে সুমনার ও বিয়ে ঠিক হয়েছে। বড়োলোক, খানদানি এক পুরুষের সঙ্গে৷ অরু হেসে শুভকামনা জানিয়েছে। মনেপ্রাণে সে চায় কাছের মানুষ সবাই সুখী হোক, ভালো থাকুক, আনন্দে কাটুক তাদের দিনগুলো।
______
মাস খানেক গেল৷ ঘনিয়ে এল অয়ন শাবিহার বিয়ে। প্রস্তুতি শুরু হলো। কমিউনিটি সেন্টার বুক করা হলো। বেশ কয়েকটা ফাংশনাল এক্টিভিটিস হবে৷ একেক দিন একেকটা। তোরজোর করে শপিং শুরু হলো। কেনাকাটায় ব্যস্ত সবাই। অরু নিজেও শপিংমল যেতে চেয়েছে তবে পারেনি। তাকে তন্ময় গার্ডে রাখে। অফিস ছেড়ে তার পিছু লেগে থাকে। হুকুম, আদেশ ঠোঁটে লেগেই থাকে মানুষটার। এইতো সেদিনের ব্যাপার। অরু ভার্সিটি যাবে একটা ক্লাস করতে। ওমনি তন্ময় অফিস ছেড়ে চলে এল। তাকে নিজে নিয়ে যাবে ভার্সিটি। ক্লাশ শেষে আবার নিয়ে আসবে সঙ্গে। এতে অবশ্য অরুর ভালোই লাগে। মনের ভেতরটা শান্তিতে মিইয়ে যায়৷

শাবিহার গায়ে হলুদে সবার সাথে মিলেমিশে অরু হলুদ শাড়ি পরে। জর্জেটের, পাতলা৷ তার মিশ্রণ ধবধবে পেট দৃশ্যমান। পেট তার সামান্য উঁচু। অরু আয়নায় পর্যবেক্ষণ করছে। এমন সময় রুমে তন্ময় এল। সে পাঞ্জাবি পরে। হাতে ঘড়ি। চুলগুলো স্যাট করা। কপালে ভাঁজ। বিরক্ত বটে। কদিন যাবত বেশ ছুটাছুটি। একটা বড়সড় অনুষ্ঠান মুখের বিষয় নয়। অরুকে দেখে তন্ময়ের কপালে ভাঁজের সংখ্যা বাড়ল, ‘এটা কী পরছিস?’
‘শাড়ি।’
‘খোল। কামিজ পর।’

অরু মুখ ভেঙাল। সে এভাবেও শাড়িটা খুলে ফেলত৷ এমন পেট দেখিয়ে কী সে বেরোতে পারবে? কখনোই না। তবে তন্ময়কে সেগুলো বলল না। একরোখা জেদ নিয়ে দাঁড়িয়ে। যেন এভাবেই যাবে অনুষ্ঠানে। তন্ময় এগিয়ে আসল। খুব কাছাকাছি। ঘনিষ্ঠ হলো। লম্বা শ্বাস নিল। সুগন্ধি নাকে এসে বাড়ি খেল। অরুর পেটে হাত রাখল। হালকা হাতে ছুঁড়ে দিল। ঘাড়ে কামর বসিয়ে আওড়াল, ‘আমাকে জ্বালাবি না। জ্বালালে খবর আছে তোর।’

অরুর মনপ্রাণ, শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। চোখ বুজল শক্ত করে। ঘনঘন শ্বাস ফেলল। তন্ময় ছাড়ল তাকে। বেরোতে বেরোতে বলল, ‘তাড়াতাড়ি কর।’
_______
বিয়ের দিনে অয়ন শেরওয়ানিতে হাজির বর সেজে, নিজের শাবিহাকে কবুল বলে নিজের করে নিতে। আলিসান কমিউনিটি সেন্টারের, জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে সাজানো সোফায় অয়ন বসে। বউ এখনো এসে পৌঁছায়নি। পার্লার থেকে সোজা আসবে। অয়ন ছটফট করছে। তার আচার-আচরণ সকলের নজরে এসেছে। কমবেশি সবাই তাকে নিয়ে মজার ছুতোয় হাসিতামাশা করছে৷

কনের গাড়ি এসেছে। হৈ-হুল্লোড় পড়ে গেল। অয়ন হুড়মুড়িয়ে দাঁড়াল। সদর দরজায় নজর ফেলল৷ বড়ো ভাই আর বাবার হাত ধরে এগিয়ে আসছে তার পানে। বউ রূপে, পরী সেজে। রুপকথার পরী। যে আসমান থেকে নেমেছে। অয়নের চোখ কেমন অজান্তেই জ্বলে উঠল। সে হাসল। শাবিহা কাছাকাছি আসতেই হাত বাড়াল। টেনে উঠাল স্টেজে। সবার সামনেই কপালে চুমু বসিয়ে ফেলল৷ হাসাহাসির রেশ পড়ল। শাবিহা লজ্জা পেল৷ লেহেঙ্গা ধরে অয়নের পাশে গিয়ে বসল সোফায়। ফটোসেশান হলো। এরপরই হুজুর এসেছে। কবুল বলার সময়টাতে শাবিহা চুপসে গেল। সে কিছুতেই মুখ খুলছিল না। চোখের কোণ ঘেঁষে নিজ গতিতে অশ্রু বইতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। তার কান্না দেখে বাকিরাও ঠিক নেই। মোস্তফা সাহেব আড়ালে চোখের কোণ মুছে নিলেন। ঠোঁটে চাপা হাসি বরাদ্দ রাখলেন। তন্ময়ের শান্ত চোখজোড়াও শান্ত নেই। জবেদা বেগম মুখ ঘুরিয়ে কেঁদে ফেললেন। হুজুর বেশ কয়েকবার বলেছেন, বলো মা কবুল। শেষ মুহুর্তে শাবিহা কবুল বলে দেয়। হয়ে যায় অয়নের। চিরজীবনের জন্য৷ অপরদিকে অয়ন সময় নেয়না।
ফর-জি স্পিডে তিন কবুল বলে ফেলে। এই নিয়েও একদফা হাসির রোল পড়ে৷

বিদায়ের পালা৷ হয়তো মেয়ে পাশের বাসায় যাচ্ছে। তবে যাচ্ছে তো? এতেই মনের একাংশ খালি হয়ে গিয়েছে পিতামাতার। গাড়িতে একপ্রকার জোরপূর্বক তুলে দেয় তন্ময়, ‘বোকা মেয়ে। এভাবে কাঁদার কী আছে? উঁকি দিলেই দেখবি আমরা আছি।’
_______
রাতের একটা নয় বাজে। রাস্তা শুনশান। গাড়ি দু একটা ছুটে যাচ্ছে। হেডলাইটের হলুদ আলো মাথার উপর। মারজির হাতে উঁচু জুতো। পরনে লেহেঙ্গা। মুখে সাজসজ্জা। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। শাবিহা অয়নের বিয়ে থেকেই বেরিয়েছে সে। পাশে লম্বাচওড়া দেহের মাহিন। কোট-স্যুট পরে। দুহাত দুপাশে। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে মারজির জুতো জোড়া নিজের হাতে নিয়ে নিল। মারজি হাসল। কিছু বলল না। হেলেদুলে হাঁটছে। গুনগুন করে গান গাইছে। মাহিন গলা পরিষ্কার করে শুধাল, ‘তোমার কেমন ধরনের ছেলে পছন্দ?’

মারজি হাসল। চোখ তুলে তাকাল। হাসি অটল রেখে জবাব দিল, ‘উঁহু ছেলে নয়। পুরুষ পছন্দ। স্যাম্পল হিসেবে তুমি হলে বেস্ট হয়।’

মাহিনের পদচারণ থমকে গেল। মারজি শব্দ করে হাসল। হাঁটা থামাল না। পিছু ফিরল না। পুনরায় বলল, ‘তোমার কী ধরনের মেয়ে পছন্দ? আমাকে পছন্দ না হলে বলতে পারো।’

মাহিন কেমন হন্তদন্ত ভঙ্গিতে ছুটে আসে। মারজির হাত ধরে। নরম তুলতুলে ছোটো হাত। চোখমুখে একরাশ ব্যাকুলতা নিয়ে বলে, ‘আমার তোমাকে মারাত্মক ভাবে পছন্দ মারজি।’
‘তাই বুঝি? কেন? আমিতো ঠোঁট কাঁটা স্বভাবের। প্রচন্ড চঞ্চল। একদম চালাক। একটু বেয়াদব ও। তাহলে?’
‘এভাবেই এই মারজি আমার পছন্দ।’

মারজি হাত ছাড়াল। আবারো হাঁটা ধরল, ‘হু। দেখা যাক তোমার পছন্দের দৌড় কতটুকু। আমি কিন্তু সিরিয়াস প্রেম করছি। ছ্যাকা ট্যাকা মেরে আবার বড়লোক মেয়েলোক ধরে চলে যেওনা।’

মাহিন বিরক্ত মুখে মারজির সামনে দাঁড়াল, ‘তুমি আমাকে ক্ষেপাতে চাচ্ছ?’

মারজি আড়ালে ঠোঁট বাঁকাল। মনে আওড়াল, ‘ইন্টেলিজেন্ট মাহিন সাহেব। ধরে ফেলেছে। তাতে কী! আমিতো স্বীকারোক্তি দিব না।’ মারজি থামল না। হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘শুনো তোমরা হচ্ছ বড়োলোক। আর বড়োলোক মানুষদেরর আছে সব বড়োলোক নামকাম। এদের কখন কী মন চায় বলা বড়ো কঠিন। দিনশেষে আমাকে ভালো না লাগতেই পারে। আমাকে তখন খোলাখুলি… ‘
‘তুমি আমাকে রাগাচ্ছ কেন? মারজি! আমি রাগলে ঠিক থাকি না। মাথা প্রচন্ড গরম থাকে। উল্টাপাল্টা কিছু বলে দিব।’

মারজি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। আপসেট হবার ভঙ্গিমায় সে বলে ‘এখনই এমন। আর ক’মাস পর হয়তো বাজে বিহেভিয়ার করেই বসবে। আমাকে চড়টড় ও মেরে দিতে দ্বিধাবোধ করবে… ‘

মাহিন সাংঘাতিক রাগল। কপালের রগ ফুলে উঠল, ‘মারজি! স্টপ ইট। কী বলছ! এমন কিছু কখনোই হবে না। আমি কাপুরষ নই। তু..তুমি আমাকে মারাত্মক ভাবে রাগাতে জানো।’

মারজি থামল। ঘুরে তাকাল। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলল। অসহ্যকর এক হাসি ছুটেছে তার ঠোঁট ঘেঁষে। পা জোড়া উঁচু করে। মুখটা মাহিনের কানের কাছটায় নেয়। হাসিটুকু অটল রেখে সে বলে, ‘রাগলে তোমায় মারাত্মক হ্যান্ডসাম দেখায়। আমার চোখে ধাঁধা ধরিয়ে দেয়। তোমার এই রাগী রূপ দেখার জন্য ভবিষ্যতে আমি..সাত সমুদ্র পারি দিব। অতল সাগরে ডুবে যাব। আসমান সমান তোমায় ভালোবাসব!’

মারজি হাসল। সুন্দর হাসি। থমকে যাওয়া মাহিনের হাত থেকে জুতো জোড়া নিয়ে পরে ফেলল। পুনরায় হাঁটা ধরল। কিছুদূর যেতে না যেতেই শক্ত বাহুতে আটকে পড়ল৷ পেটে পুরুষালি হাতের স্পর্শ পেল। মাহিনের গলার স্বর সামান্য কাঁপল, ‘তুমি আমাকে পাগল করে দিবে।’

অসহ্যকর হাসিটা এবারও মারজির ঠোঁটে। চোখ বুজে সে নিজমনে আওড়াল, ‘তুমিতো আমাকে পাগল করলে। হৃদয় ব্যাকুল করালে। প্রেমের ফাঁদে ফেললে। ভালোবাসতে বাধ্য করলে। এখন তুমিও হও জনাব।’
________
অয়ন শাবিহার বাসর রাত অদ্ভুত বটে। রাতের দুটো। দীপ্ত তাদের ফুলের বিছানায় টান টান হয়ে বসে। ল্যাপটপে মুভি দেখছে। তাকে অনেকেই নিতে এসেছে। কিন্তু পারছে না। এদিকে ভদ্র অয়নের পেসেন্স ভেঙে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে দীপ্তকে কাঁধে তুলে শাহজাহান বাড়ি রেখে আসতে। শাবিহার ঘুম ধরেছে। তাই সে ওয়াশরুম ফ্রেশ হতে গিয়েছে। গয়নাগাটি, লেহেঙ্গা খুলে কামিজ পরেছে। মেক-আপ, চুলের স্যাটিং সময় নিয়ে শেষ করেছে। শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে। সে জড়সড় ভঙ্গিতে দীপ্তর পাশে শুয়ে পড়ল৷ অয়ন থমথমে চেহারায় সবটা দেখে গেল।

তিনটার দিক তন্ময় আসে হন্তদন্ত ভঙ্গিতে। দীপ্তকে ঘাড়ে তুলে নিয়ে যায় শাহজাহান বাড়ি। অয়ন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। ঘরের দরজা আটকায়। শাবিহা ঘুমে বিভোর। অয়ন হেসে দুপাশে মাথা দুলাল৷ বাতি নিভিয়ে এসি ওফ করল৷ জানালা খুলে দিল। সিলিন ফ্যান ছেড়ে দিল। আকাশে চাঁদটা জ্বলছে দাউদাউ করে। অয়ন বিছানার সামনে দাঁড়াল। বুকে হাত চেপে ধরল। এই দৃশ্য ঘুমের ঘোরে কতশত বারই না দেখেছে। অথচ আজ স্বপ্নটা বাস্তবে তার সামনে ঘটছে। অয়ন হুড়মুড়িয়ে বিছানায় উঠে। ঘুমন্ত শাবিহার মুখশ্রী জুড়ে সহস্র চুমু খেয়ে নেয়। শাবিহা গোঙায়। বিরক্ত হয়। ঘুমে কাবু স্র চোখ মেলে না। অয়ন ছোট গলায় আওড়ায়, ‘আজ বেঁচে গেলে। কাল থেকে বাঁচবে না।’
________
সাত-আট মাস পরের ঘটনা। আষাঢ়ে মাস। বৃষ্টিবাদলের দিন। রাস্তাঘাট সারাদিন স্যাতলা। দিনে আট ঘন্টা ধরণীর বুকে বেহিসেবী বর্ষা নামে৷ প্রকৃতি করে তুলে উচ্ছ্বাস, প্রানবন্ত। অরুর বৃষ্টির দিনগুলো পছন্দ। বৃষ্টি দেখা তার মোস্ট ফেভারিট কাজ। আগে বৃষ্টি হলে দৌড়ে বারান্দায় যেত। ভিজত। এখন কী আগের মতো সে আছে? অরু এখন নড়তে পারে না। বিছানা থেকে উঠতেই কষ্ট হয়। ভারী বড়ো পেট ধরে উঠতে হয়৷ পানি জমানো পা ফেলে ধীরেসুস্থে হাঁটতে হয়। মুখশ্রী ফুলে টমেটো। মা হলে নাকি নারীদের আলাদা সৌন্দর্য ফুটে উঠে? আসলেই তাই। অরুকে দেখলে দেখতেই ইচ্ছে করে। মেয়েটাকে চোখ ধাঁধানো মায়াবী লাগে। সৌন্দর্যের রানী৷ তন্ময় অফিস যায় না ইদানীং। বেশিরভাগ সময় বাড়ি থাকে। অরুর পাশাপাশি, কাছাকাছি। আজ একটু বেরিয়েছে। খুব দরকারী। তাই সে একান্ত এসে বসেছে বেলকনিতে। চেয়ার পেতে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে। অরু চোখ বুজল। দু’হাত তার পেটে রেখেছে। মানুষ হিসেবে তার পেট সাংঘাতিক বড়ো। পেট এতটা বড়ো কেন এই নিয়ে সুমিতা বেগমের চিন্তার শেষ ছিল না। পড়ে যখন আটমাসে চেক-আপে গেল, তখন চিন্তা কমার বদলে বাড়ল বলে। বাড়ির সকলে ভয়ে জড়সড়। চিন্তাভাবনায় ঘুম, খাওয়াদাওয়া সপ্তাহ খানেকের জন্য উড়ে গেল।

তন্ময় ফিরেছে। অরুকে রুমে না দেখে চেঁচামেচি শুরু করল। অরু হাসল। আওয়াজ দিল, ‘এইযে।’

তন্ময় দ্রুত পায়ে বেলকনিতে আসল। ভুরু-জোড়া কুঁচকে ফেলল, ‘বৃষ্টি হচ্ছে। ঠান্ডা লাগবে।’
‘লাগবে না।’

তন্ময় তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল৷ মাথাটা ঝুঁকিয়ে কান পেতে দিল অরুর বড়সড় পেটে। দুষ্টুমি সুরে আওড়ায়, ‘কী করে আমার সোনামণিরা?’

অরু হাসে। তন্ময়ের মাথায় হাত রাখে৷ চুল টেনে দেয় নরম হাতে। শুধায়, ‘গোসল নিয়ে খেয়ে নিন।’
‘হুম। আয়।’

তন্ময় ধরে উঠাল। খুব মনোযোগী হয়ে অরুকে ভেতরে নিয়ে আসল। বিছানায় বসালো। অফিস ব্যাগ থেকে একটা বাটি বের করে সামনে রাখল। হালিম এনেছে সে। কয়েকটা মাস যাবত তন্ময় কিছু না কিছু আনেই। মুলত অরুর পছন্দের সব। অরুর চোখজোড়া বড়ো হয়ে এল, ‘কেম্নে বুঝলেন আমার হালিম খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল?’
‘এমনেই। খেয়ে নে। আমি গোসল করে আসি।’

অরু মাথা দোলায়। পুরোটা হালিম সাফা করে। কয়েকটা মাস ধরে অরু খুব জ্বালাতন করেছে। বিশেষ করে তন্ময়কে। রাতবিরেত তন্ময়কে উঠিয়ে কেঁদেছে। নাহয় এটাসেটা খেতে চেয়েছে। নাহয় ঘুমাতে পারছে না বলে, তন্ময়কেও নিজের সঙ্গে জাগিয়ে রেখেছে। অথচ মানুষটা বিন্দুমাত্র রাগ, বিরক্ত হয়নি। অরুকে শান্ত করেছে, বুঝিয়েছে। যা চেয়েছে দিয়েছে, দিচ্ছে। অরু এখন যা বলে বাড়ির সবাই তাই করে। তার আবদার কেউ ফেলতেই পারে না।
________
২৩ তারিখ বৃহস্পতিবার। বিকেল দিক। অরুর পেটে যন্ত্রণা ওঠে। মারাত্মক যন্ত্রণা। মরণ যন্ত্রণা। তার ডেট আরও দুদিন পর। তাই বাড়িতে পুরুষ মানুষ নেই। তন্ময় বেরিয়েছে মিটিংয়ের জন্য। আনোয়ার সাহেব কিংবা মোস্তফা বা ওহী সাহেব ও বাড়ি নেই। বাইরে অঝোর ধারায় বর্ষা। তুফান ছেড়েছে। বাইরের অবস্থা ভালো না। সুমিতা বেগম স্বামীকে কল করেন। ফোন বন্ধ। জবেদা বেগম ছেলেকে লাগাতার কল করতে থাকেন। কল ঢুকছে না। সাত তম কল ভাগ্যক্রমে ঢুকে। জবেদা বেগম তাড়াহুড়ো গলায় বলে, ‘অরুকে হাসপাতাল নিতে হবে।’

ওপর পাশে তন্ময় ঘাবড়ে যায়, ‘আসছি’ বলে ছুট লাগায়। আধঘন্টার মধ্যে, ঝড়ের গতিতে ফিরে সে। হন্তদন্ত ভঙ্গিতে। চিন্তিত, ঘাবড়ানো মানুষটা। বুকের ধড়ফড়ানো কমেনি। অরুকে তুলে দ্রুত এগোয় গাড়ির দিক। গাড়িতে চড়িয়ে জবেদা বেগম এবং সুমিতা বেগমকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরোয়৷ রাস্তায় গাছ ভেঙে পড়েছে। গাড়ি দমিয়ে দিচ্ছে ঝড়। তন্ময় দক্ষ হাতে গাড়ি ঘুরায়। অরু যন্ত্রণায় ডুকরে কাঁদছে। তাকে জাপ্টে ধরে আছে সুমিতা বেগম এবং জবেদা৷

অরুকে ভেতরে নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে সবাই উপস্থিত হাসতালে। তন্ময় ছটফট করছে। স্থির নেই। করিডোরে পা চালাচ্ছে। চিন্তায় হাতপা আসাড় হয়ে আসছে। বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে উঠছে। উদ্ভট চিন্তাভাবনা মাথায় আসছে। মাগরিবের আজান পড়েছে। তন্ময় থমকাল। পরপর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল। পাশেই মসজিদ। তার দোয়া আজ একটাই। আল্লাহর কাছে চাওয়াও একটাই।

অরুর সিজার হচ্ছে। নরমালে বেবি হবে না, ডাক্তার জানিয়েছেন। তন্ময় ফিরেছে সবে। তৎক্ষণাৎ খুলে গেল দরজা। স্পষ্ট শিশুর কান্নার স্বর ভেসে এলো। দুজন নার্স এগিয়ে আসছেন। দুজনের কোলে দুটো ফুটফুটে শিশু। জমজ ভাইবোন তারা। তন্ময় বাচ্চাদের পানে তাকাল। পরপর পেছনে, ‘আমার স্ত্রী..’
‘তিনি রেস্ট নিচ্ছেন।’

তন্ময় বুকে আটকে রাখা শ্বাস ফেলল। অজান্তে কখন চোখের কোণ ভিজেছে জানা নেই। নার্স শিশুটিকে কোলে দিল তন্ময়ের। তন্ময় কম্পিত হাতে ছোট্ট নিষ্পাপ প্রাণ নিয়ে, তাকিয়ে রয়েছে। পরপর বুকে আগলে নিয়েছে। দু’চোখে ভিজে উঠেছে। মাথা ঝুকাল, কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল। আওড়াল, ‘আব্বু! আমার বাবা!’
_______
মানুষের জীবন সময়ের ইশারায় চলে। বছরের পর বছর সময়ের তালে চলে যায়। জীবন পাল্টে যায়। মানুষ পরিবর্তন হয়। মানুষ মাত্রই পরিবর্তনশীল কি-না! এরমধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, সম্পর্ক ভেঙে যায়। কেউ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে তো কেউ জন্মের । এইতো জীবন? দেখতে দেখতে কেটে গেল তিনটে বছর। চোখের পলকে পেরিয়ে গেল কেমন। মনে হচ্ছে এইতো কালই অরু পুরো শাহজাহান বাড়ি নেচে-কুঁদে বেড়াল।

অরুর আজ অনার্স ফাইনালের শেষ পরিক্ষা। পরিক্ষা দিয়ে বেরিয়েছে সে মাত্র। সদর দরজায় দাঁড়িয়েছে। কারোও অপেক্ষায়। পরিক্ষার হলের সাথী ও পাশে এসে দাঁড়াল। নাম তার জুঁই। সেও কারো অপেক্ষায় । মিষ্টি হেসে বলল, ‘এই অরু। দাঁড়িয়ে আছ যে?’
‘আমার ফ্যামিলি আসবে।’

জুঁই হাসল,
‘যেভাবে বলছ যেমন পুরো ফ্যামিলি আসবে।’

অরু স্মিথ হাসল। বলল, ‘ঠিক ধরেছ পুরো ফ্যামিলি আসবে।’
‘এখানে?’
‘হ্যাঁ। আমরা এখান থেকে ভ্যাকেশনে যাব। মুলত আমার জন্য এতদিন ধরে যাওয়া হচ্ছিল না। পরিক্ষা শেষ তাই এখান থেকেই বেরোবো।’
‘মনে হচ্ছে খুব সুন্দর পরিবার আছে তোমার!’
‘অনেক সুন্দর।’

জুঁই ভেবে প্রশ্ন করল,
‘তুমিতো ম্যারিড তাই না? ভাইয়ার নাম যেন কী?’
‘তন্ময় শাহজাহান।’
‘অ্যাই ওয়েট। তোমার নামের শেষেও তো শাহজাহান?’

অরুর হাসি দীর্ঘ হলো, ‘আমার চাচাতো ভাই।’
‘মাশাআল্লাহ। কীভাবে কী!’
‘এভাবেই এভাবেই।আল্লাহর রহমতে হয়ে গেল। তিনি আমাকে দিয়ে দিলেন শ্রেষ্ঠ জীবনসঙ্গী।’

সেমুহুর্তে তিন চারটে গাড়ি রাস্তা আটকে থামল সুদূরে৷ অরু হেসে তাকাল৷ পরপর বেরিয়ে এলো দুটো বাচ্চা। তিন বছরের। একটা ছেলে আরেকটি মেয়ে। সমান উচ্চতার। ভিন্ন চেহারার। খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় ছেলেটি তার মায়ের মতো দেখতে, আর মেয়েটি তার বাবার মতো। বাচ্চা দুটো ছুটে এদিকে আসছে। ছোট ছোট পায়ে। ফুলো সুস্থসবল গাল দুটো তাদের দৌড়ানোর গতিতে নড়ছে৷। পেছন থেকে বেশকিছু গলা ভেসে এলো, ‘নানাভাই ধীরে ধীরে যেতে হয়।’
‘এভাবে দৌঁড়াতে নেই দাদুভাই…।’

জুঁই খেয়াল করল সুন্দর বাচ্চাদুটো তাদের দিক আসছে। উচ্চস্বরে অস্পষ্ট আধো স্বরে ডাকছে, ‘মাম্মা।’

জুঁই চমক পাশে চায়। অরু হাঁটু ভাজ করে বসে দু’হাত মেলে দিয়েছে। জুঁই মুগ্ধ নয়নে, অবিশ্বাস্য গলায় শুধালো, ‘তোমার বাচ্চা আছে?’

অরুর বাহুতে দুটো সুস্থ্য সবল বাচ্চা ঢুকে পড়ে। গলা জাপ্টে আজহারি করে ওঠে। ঘুরতে যাবার বায়না ধরে। অরু হেসে বলে, ‘আমি দু’বাচ্চার মা।’

তারপর সে উঠে দাঁড়ায়। গাড়ির সামনে দাঁড়ানো এক সুদর্শন পুরুষ দেখিয়ে বলে ‘ওইযে আমার তন্ময় ভাই। আমার স্বামী।’

জুঁই বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। অরু আরও বলে, ‘ওখানে আমার পুরো পরিবার। আমার জীবন।’

জুঁই দেখল সেই সুদর্শ পুরুষ এগিয়ে আসে৷ অরুও এগিয়ে যায়৷ লোকটা পকেট থেকে রুমাল বের করে, অরুর কপাল মুছে দেয়। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলে। তারপর দু’সন্তান অনায়াসে কোলে তুলে নেয়। অরুকে ইশারায় আসতে বলে এগিয়ে যায়। অরু মাথা ঘোরায়। হাত নাড়ে, ‘বিদায়।’

জুঁই অনিমেষ তাকিয়ে থাকে। ছোট্ট গলায় বলে, ‘বিদায় অরু। সারাজীবন সুখী থেকো, ভালো থেকো। দোয়া রইল।’

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here