মোহঘোর #পর্বঃ১৩,১৪

0
549

#মোহঘোর
#পর্বঃ১৩,১৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
১৩

মায়ের আর্ত চিৎকারে ঘুম ভাঙে ইনজাদের। কাউচে শুইয়ে তার হ্যান্ডেলের ওপর পা উঠিয়ে রেখেছে। মুখে ওপর চেপে রাখা কুশন সরিয়ে ঘুমো ঘুমো চোখে জড়ানো গলায় বলল—

“সকাল সকাল কী শুরু করলেন আম্মা? গ্রামের মানুষ কই মোরগের ডাকে ঘুম থেকে উঠে আর আমরা ভাঙা রেডিওর।”

তমালিকা চিৎকার করে বললেন—

“দেখেছিস, দেখেছিস তোরা! একদিনে আমার ছেলেকে ঘরের বাইরে বের করে ছেড়েছে! কত বড়ো অপয়া ওই মেয়ে ভেবে দেখেছিস!”

ইনজাদ ঘুম ছাড়াল। তাজা স্বরে বলল—

“আম্মা, আপনার কী আর কোনো কাজ নাই? কেন শুধু শুধু মনগড়া কথা বলছেন?”

“আমি মনগড়া কথা বলছি? বউ ঘরে তুই বাইরে কেন? ওই মেয়ে তোকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে তাই না?”

ইনজাদ ক্লান্ত চোখে তাকাল। ত্রিমুল বোনের কাঁধে হাত দিয়ে বলল—

“শান্ত হ আপা। সকাল সকাল কী শুরু করলি?”

“আমি শুরু করেছি, আমি? তোর চোখ কী বন্ধ? দেখতে পাচ্ছিস না কিছু? ওই মেয়ে আরাম করে বিছানায় ঘুমাচ্ছে আর আমার ছেলে এই সোফায়!”

ইনজাদের মামি সুরমা মৃদু গলায় কৌতূহল নিয়ে বললেন—

“কী হয়েছে বলোতো ইনজাদ? তুমি এখানে কেন?”

ইনজাদ নীরস গলায় বলল—

“তেমন কিছু না মামি। আমার রুমে ডিম লাইট নেই। রেহাংশী অন্ধকারে ঘুমাতে পারে না। আর আলোতে আমার ঘুম আসে না। তাই আমি নিজেই এখানে এসে শুয়েছি।”

তমালিকা চোখ বড়ো বড়ো করে তাজ্জব গলায় বললেন—

“বউ অন্ধকারে ঘুমাতে পারবে না তাই তিনি বসার ঘরে এসে ঘুমাচ্ছেন! দেখেছ, কীভাবে আমার ছেলেটাকে বশ করেছে? আমি এখনো বলছি এই মেয়ে আমার সব শেষ করে ছাড়বে।”

ত্রিনা মুখ চিপে হাসছে। সুরমা তাকাতেই হাত নামিয়ে আনে মুখ থেকে। সটান দাঁড়িয়ে হাসি মিলিয়ে নেয় হাওয়ায়। নিরস্ত্র গলায় বলল ইনজাদ—

“আম্মা, কেন শুধু শুধু কথা বাড়াচ্ছেন?”

“তুই চুপ কর।”

দেয়াল ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই সপ্রতিভ হয় ইনজাদ। ব্যগ্র গলায় বলল—

“সাতটা বেজে গেছে! আমাকে বের হতে হবে।”

তমালিকা বিড়বিড় করেই যাচ্ছেন। পারভেজ মির্জা কোনো শব্দই করলেন না। আপাতত চুপ থাকাই সমীচীন মনে করছেন তিনি। ইনজাদ টলতে টলতে নিজের কক্ষের দিকে হাঁটা ধরে। অবারিত গলায় বলল—

“সাবধান আম্মা! আমাকে তো শুধু বশ করেছে, ও কিন্তু কালো জাদু জানে আই মিন ব্ল্যাক ম্যাজিক। দেখেছেন না রাতের বেলা ছাদে হাঁটাহাঁটি করে। দূরে থাকবেন ওর থেকে। কখন কী করে বসে! এইজন্য-ই তো সাথে নিয়ে যাচ্ছি।”

খিলখিল করে হেসে উঠে ত্রিণা। তার হাসিতে তাল মেলালো পারভেজ মির্জা। না চাইতেও হেসে ফেলল ত্রিমুল। জ্বলে উঠলেন তমালিকা। সুরমা থতমত খেয়ে শান্ত গলায় বললেন—

“আপা কিছু মনে করবেন না। ও তো…।”

আড় চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন সুরমা। ততক্ষণে নিজের কক্ষে প্রবেশ করেছে ইনজাদ। দরজা লক করে দিয়েছে।

দরজার পাশ ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে রেহাংশী। পরনে বেগুনি রঙের সুতি শাড়ি। ইনজাদ সহিষ্ণু গলায় বলল—

“আম্মার কথা শুনছিলে? কিছু মনে করো না। আম্মা এমনি এসব বলে। দু’দিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“হুম।”

“রাতে কী বিছানায় যুদ্ধ করেছিলে না কি? শাড়ির এ অবস্থা কেন?”

রেহাংশী নিজের দিকে তাকাল। নতুন সুতি শাড়িতে ভাঁজ পরে গেছে। ইনজাদ আদেশের সুরে বলল—

“শাড়িটা চেঞ্জ করে বাইরে যাবে।”

‘হুম।”

“কী হু, হু। হ্যাঁ বলতে পারো না। আর তাড়াতাড়ি করো। বের হতে হবে আমাদের।”

রেহাংশী মনমরা গলায় বলল—

“ও বাড়িতে জানাবেন না?”

“সময় নেই। নুহাশকে কল করেছি। যাওয়ার সময় দেখা করতে আসবে। আর ঝামেলা করতে পারব না। এমনিতেও একটু পর ঝড় শুরু হবে।”

রেহাংশী ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে বলল—

“কেন?”

“কেন আবার! তোমার হবু বর আসবে না। তার একমাত্র হবু বউকে বিয়ে করে নিয়েছি।”

“তাই বুঝি পালিয়ে যাচ্ছেন?”

চট করেই রেহাংশীকে বুকের মাঝে টেনে নেয় ইনজাদ। কোমরে চাপ দিয়ে পিষে ধরে নিজের সাথে। দম্ভ করে বলল—

“আমার জিনিসের দিকে চোখ দিলে সেই চোখ তুলে নেবো। এখন শুধু সময় নেই বলে।”

রেহাংশীর দুই হাত ইনজাদের বুকের সাথে লেপ্টে আছে। পূর্ণ নজরে তাকিয়ে বলল—

” এই জন্য বুঝি চুপ করে ছিলেন?”

“অন্যায় সয়ে নেওয়ার শিক্ষা আমার পরিবার আমাকে দেয়নি। তবে সম্মান আর অনুরক্তির মাঝে পার্থক্য আছে। সেইটা তোমাকে বুঝতে হবে বিষবাণ। আমরা যা চাই তা সবসময় ঘটে না। জগতে তাই ঘটে যা আল্লাহপাক চান।”

“যদি সত্যিই বিয়ে হয়ে যেত?”

ইনজাদের দৃষ্টি নরম হয়। কণ্ঠে নমনীয়তা আসে। আরেকটু চেপে ধরে রেহাংশীকে। তার গলায় নাক ঘষে বলল—

“ভাগ্য বলে মেনে নিতাম। আর ভাগ্যে তাই ছিল যা হয়েছে। মহান আল্লাহ পাক তাই করেন যা তার বান্দাদের জন্য সঠিক।
পবিত্র কুরআনে আছে-“আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে কোনো কাজ চাপিয়ে দেন না। সে যা ভালো কাজ করেছে তার ফল পাবে এবং যা খারাপ করেছে তা তার বিরুদ্ধে যাবে।
“ও আমাদের রব, আমরা ভুলে গেলে বা ভুল করে ফেললে আমাদের পাকড়াও করেন না।
ও আমাদের রব, আগেকার লোকদের উপর যেমন কঠিন বোঝা দিয়েছিলেন, আমাদের উপর তেমন বোঝা দিয়েন না।
ও আমাদের রব, যে বোঝার ভার বইবার সামর্থ্য আমাদের নেই , সে-ই বোঝা চাপিয়ে দিয়েন না। আমাদের অপরাধগুলো মাফ করে দিন। আমাদের পাপগুলো গোপন করে দিন। আমাদের উপর দয়া করুন। আপনিই তো আমাদের রক্ষাকর্তা। তাই অবিশ্বাসী লোকগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন।” [আল-বাক্বারাহ ২৮৬]
বুঝলে বিষবাণ। জলদি করো, দেরি হচ্ছে আমার।”

রেহাংশীকে ছেড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে ইনজাদ। কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে রেহাংশী। ভাগ্য সবসময় তাকে ধোঁকা দিয়েছে। তাই আজ সে ভাগ্যকে।”
,
,
,
ভাইয়ের পাশেই বসেছে ত্রিণা। খাচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে। ইনজাদ গাঢ় চোখে তাকিয়ে তার হাসির কারণ উদঘাটন করার চেষ্টা করছে। ধমকে উঠে বলল—

“হাসছিস কেন?”

“ফুফু আম্মু কী বলেছে তোমাকে!”

আবারও ঝুমঝুমিয়ে হাসে ত্রিনা। একটা গাঢ় নীল রঙের জামদানি পরেছে রেহাংশী। ছোটো ছোটো পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল সুরমার সামনে। প্রগাঢ় মায়ায় তাকে কাছে ডেকে চেয়ারে বসালেন তিনি। ত্রিণা বাচ্চাদের মতো হেসে হেসে বলল—

“তোমাকে তো খুব মিষ্টি লাগছে!”

চোখে হাসে রেহাংশী। সুরমা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল–

“আপার কথায় কিছু মনে করো না। সে মানুষটা কঠিন কথা বললেও মনটা নরম। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“আরে তুমি জানো না, ফুফু আম্মু এমনিতেই রাগ করে। কিন্তু মনটা খুব ভালো। দেখবে তার সব রাগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে। এই তুমি লিপস্টিক দিয়েছ?”

ঢোক গিলে রেহাংশী। অপ্রস্তুত হয় সে। ইনজাদ চাটি মারে ত্রিণার মাথায়।

“গাধি! এইটা কী ধরনের প্রশ্ন? এইটাকে বিয়ে দিচ্ছ না কেন মামি?”

“বিয়ে করব না আমি। তাতে তোমার কী?”

“এইটাকে ছোটো বেলায় ডানো না খাইয়ে একটু খাঁটি গরুর দুধ খাওয়াতে তাহলে মাথায় ঘিলু হতো।”

ন্যাকা গলায় চিৎকার করে উঠে ত্রিণা—

“আম্মু, তুমি কিছু বলছ না কেন?”

“কী বলবে রে, গাধি!”

“আব্বু তোমার বোনের ছেলেকে কিছু বলবে?”

ত্রিমুল পারভেজ মির্জার সাথে কথা বলছিলেন। কথার মাঝখানে মেয়ের চিৎকার করা কণ্ঠে বিরক্ত হলেন। মেয়েটা এত বড়ো হয়েও বাচ্চাদের মতো আচরণ করে! অতি আহ্লাদে এমন অবস্থা। তমালিকা গাল ফুলিয়ে বসে আছেন নিজের কক্ষে। উটকো রাগ হচ্ছে তার। একে তো বিয়েটা হয়েছে তার অনিচ্ছায়। এখন এই মেয়েটা তার ছেলের সাথেই শহরে চলে যাবে। কী হবে, কীভাবে থাকবে তা নিয়ে ভীষণ ভাবনায় মগ্ন তিনি।

সুরমা চমৎকার গলায় বললেন—

“ঢাকা গিয়ে আবার আমাদের ভুলে যেয়ো না। সময় করে বউকে নিয়ে আসবে কিন্তু।”

ইনজাদ একগাল হেসে বলল—

“যাব। তোমরা এখন যেয়ো না। কয়েকটা দিন আম্মার কাছে থাকো। আম্মার এই রাগ কমলে যেয়ো।”

ত্রিনা নাক ফোলায়। প্রতিবাদ করে বলল—

“এই তুমি একদম যাবে না আমাদের বাসায়। শুধু রেহাংশী যাবে।”

“এই রেহাংশী কী রে?”

জোড়া লাগানো ওষ্ঠাধর এপাশ ওপাশ করে ভেঙচি কাটে ত্রিনা। প্রসন্ন হেসে বলল—

“রেহাংশীকে আমি মিষ্টি বউ বলে ডাকব। ওকে?”

রেহাংশী লাজুক চোখে তাকায়। চোখের পাতায় লজ্জা নিয়ে মাথা নিচু করে। এতকিছুর মাঝে নিজের বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে তার। মানুষগুলো তার সাথে যাই করেছে, কিন্তু আগলেও রেখেছে। তার বাবার মতো ছেড়ে তো দেয়নি। জুলহাস খন্দকারকে খুব মনে পড়ছে রেহাংশীর। খাওয়া থমকে যেতেই উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন ছুড়ে সুরমা—

“না খেয়ে বসে আছ কেন?”

রেহাংশীর ভাবনা কাটতেই দেখে তার পাশে ইনজাদ নেই। নিজের কক্ষ থেকে বের হয়ে আসতে আসতে উচ্চ গলায় বলল—

“চিন্তা করো না। আমি না খাইয়ে রাখব না। কিন্তু চাকরিটা ছুটে গেলে না খেয়েই থাকতে হবে। তাড়াতাড়ি করো রেহাংশী। সময় নেই আমার হাতে।”

রেহাংশী নম্র গলায় সুরমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল—

“আমি আর খাবো না।”

তিনি চমকে উঠে বললেন—

“খাবে না কেন? না খেলে হবে! শোনো, আগের নিজের শরীর ঠিক রাখবে। ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করবে। তারপর বরের চিন্তা।”

রেহাংশী হালকা করে মাথা ঝাঁকায়। পূনরায় বলল তার খেতে ইচ্ছে করছে না। মাথার ঘোমটা আরেকটু ঠিক করে ফিরে যেতেই উদ্যত হলে সকলের চক্ষুর অগোচরে আলতো করে রেহাংশীর হাত চেপে ধরে ইনজাদ। চাপা স্বরে বলল—

“ডোন্ট ওয়ারি। তোমার শরীর আর মন দুটোর-ই খেয়াল রাখব আমি। কারণ, দুটোর-ই মালিকানা চাই আমার। একটাতে পোষাবে না।”

টেনে হাত ছাড়িয়ে নেয় রেহাংশী। নাকের উপর চশমাটা ঠিক করে তীর্যক চোখে তাকায় ত্রিনা। ঝিলমিল করা গলায় বলল—

“মিষ্টি বউয়ের কানের কাছে কী বলছ তুমি?”

ইনজাদ বিব্রতকর কণ্ঠে বলল—

“নিজের হুলিয়ার সাথে সাথে চশমার পাওয়ার চেঞ্জ কর গাধি।”

সুরমা মেয়েকে নিভিয়ে দিয়ে বললেন—

“সবকিছুর মধ্যে তোর কথা বলতে হবে কেন? যা ঘরে যা।”

“ভ্যা।”

ইনজাদ ঠোটভর্তি হেসে নিজের কক্ষে ফিরে আসে। রেহাংশী বিছানায় স্থির বসে আছে। মন ভার হচ্ছে তার। কেন এমন হচ্ছে তা সে জানে না। ইনজাদকে দেখেই শশব্যস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। চট করে বলল—

“চলুন না ও বাড়িতে। সবাইকে একবার দেখে আসি।”

টেবিলের ওপর থেকে হাত ঘড়িটা নিয়ে শক্ত চোখে তাকাল ইনজাদ। রেহাংশী নির্বিকার।

” বললাম তো সময় নেই। মামা সিএনজি এনেছে। দুপুরের আগেই আমাকে ঢাকা পৌঁছাতে হবে। জলদি এসো। আরেকটা কথা, বাস জার্নির অভ্যাস আছে?”

রেহাংশী ঋণাত্মক সুরে বলল—

“না। নানু বাড়িতে হয় রিকশাতে গিয়েছি আর না হয় সিএনজিতে।”

“তাহলে আম্মার কাছ থেকে দুটো বমির ট্যাবলেট নিয়ে খেয়ে নাও। এসব করে আমার ঝামেলা বাড়িয়ো না। সহ্য করতে পারি না আমি।”

রেহাংশী ক্ষুণ্ণ চোখে তাকায়। বমি করার অভ্যাস তার নেই।
তমালিকা রুষ্ট। কিছুতেই তিনি ছেলের দিকে তাকাচ্ছেন না। তার পা ধরে বসে আছে ইনজাদ। অনুনয় করেও রেহাংশীর দিকে মন গলাতে পারল না। কিন্তু ছেলে বাড়ি থেকে বের হতেই ঝরঝর করে কেঁদে বাতাস ভারী করে তুললেন।
,
,
,
জানালার ফুরফুরে বাতাসে ঘুমিয়ে পড়েছে ইনজাদ। বাস চলছে তার নিজ গতিতে। রেহাংশী নীরব চোখে চেয়ে আছে জানালা দিয়ে। সাঁই সাঁই করে সব পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছে বাস। চেনা রাস্তা, ওই আকাশ, এই যে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকা রেইনট্রি! সব মাড়িয়ে ইট-পাথরের শহরে চলে যাচ্ছে সে। এখন আর বৃষ্টি এলেই মৃত্তিকা ভেজা গন্ধ আসবে না, ঝিরিঝিরি বৃষ্টির নৃত্য দেখা হবে না, ঘুম ভাঙলেই শোনা হবে না পাখির কিচিরমিচির। মন খারাপ হলে ওই ছাদে যাওয়া হবে না, পাড়ার বাচ্চাদের সাথেও দেখা হবে না। প্রতিবেশী চাচিদের বিয়ের অনুষ্ঠানে সেই গেইটে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে বর দেখা হবে না, বলা হবে না বর এসেছে, বর এসেছে। শীতের রাতের কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ যখন মিহি কুয়াশায় ত্বরান্বিত হবে, থরথর কাঁপনে ছাদে দাঁড়িয়ে দেখা হবে না ওই দূরের তালগাছ। ইচ্ছে হলেই নদীর ধারে যাওয়া হবে না। বুক ভারী হয়ে উঠে রেহাংশীর। কান্না পাচ্ছে তার। আপন মানুষগুলো চোখের অপ্রিয় হলেও, বুকের কাছে তারা।

নির্বিঘ্নে চোখের পাতা মুদন করে তন্দ্রা-বিলাসে মত্ত ইনজাদ। টিকেট নিতে আসা লোকটার দিকে ক্ষুদ্র চোখে চাইল রেহাংশী। তাদের সামনে সিটেই সুপারভাইজার দাঁড়ানো। রেহাংশী হালকা করে নাড়া দিলো ইনজাদকে। আঁখিপক্ষ্ম মেলে তাকায় ইনজাদকে। বিভ্রান্ত গলায় প্রশ্ন করল—

“কী?”

“টিকেট নিতে এসেছে।”

ঘাড় নাড়ালো ইনজাদ। বুক পকেট থেকে টিকেট বের করে দুই আঙুলের মাঝে চেপে সামনের সিটের হেডবোর্ডের ওপর রাখে। রেহাংশীর দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল—

“খিদে পেয়েছে?”

“উঁহু।”

“ওয়াশরুম?”

ব্রীড়াময় চাহনিতে না বোধক উত্তর করে রেহাংশী। ইনজাদ ঘুমে কাতর স্বরে বলল—

“কিছু লাগলে আমাকে বলো। চুপ করে থেকো না। আমার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে রেহাংশী।”

“আপনি ঘুমান।”

সুপারভাইজার ততক্ষণে তার কাঙ্ক্ষিত অংশ কালেক্ট করে নিয়েছে। নির্ভয়চিত্তে আবারও ঘুম জড়িয়ে আসে ইনজাদের চোখে। তার ঘুমন্ত মুখশ্রীতে প্রগাঢ় চোখে অল্পক্ষণ চেয়ে থাকে রেহাংশী। ক্লান্ত চোখেও যেন সজীবতার দ্বার খুলে রেখেছে ইনজাদের ভরাট মুখ, ওই ঠোঁট। হালকা বাতাসে ইনজাদের সামনে চুলগুলো এলোমেলো উড়ছে। বাসের জঙ্গমতায় তার মাথা দুলছে তবে তাতে ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে না। আনমনেই ইনজাদের বাজুর দিকটায় মাথা রাখে রেহাংশী। খুব যতন করে, আবেশিত চিত্তে। মাথাটা ঘোরাতেই তার নাক ঠেকে ইনজাদের বাজুতে। একটা অকৃত্রিম, ক্ষীণ, মিষ্টি পুরুষালী ঘ্রাণ ধাক্কা মারে রেহাংশীর নাকে। রেহাংশী বেশ কিছুক্ষণ সেভাবেই স্থির হয়ে থাকে। আজ তার ভয় লাগছে না, ঘৃণাও না। বাবার পরে সব পুরুষকে ঘৃণা করার মাঝে শুধু জুলহাস খন্দকারকেই বিশ্বাস করত রেহাংশী। আজ এক অচেনা, অজানা, অজ্ঞাত পুরুষ তার কত আপন হয়ে গেছে যে, সে তার সাথে সুদূর পথ পাড়ি দিচ্ছে। সংসার নামক গন্তব্যে। চিকচিক রোদ ঢুকছে জানালা ভেদ করে। তা খরখরিয়ে পড়ছে ইনজাদের বুকের ওপর। পর্দা টেনে দেয় রেহাংশী। যে তার শরীর ও মনের দায়িত্ব নিয়েছে তাকে যত্ন করাও তার দুর্দমনীয় অধিকার।

চলবে,,,

#মোহঘোর
#পর্বঃ১৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

হড়বড় করে থাই গ্লাস পুশ করে ভেতরে ঢুকল ইনজাদ। সামনের ব্যক্তিকে দেখে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে সালাম দিয়ে ওঠল। ভদ্রলোক চমকিত চোখে চেয়ে বললেন—

“এত দেরি?”

ইনজাদ থতমত খেয়ে বলল—

“সসসরি স্যার, আই এম রিয়েলি সরি।”

ব্যগ্রতা নিয়ে ঘড়ির স্বচ্ছ কাঁচে চোখ ফেলল ইনজাদ। দুটো বিশ। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। রেহাংশীকে ফ্লাটে একাই রেখে এসেছে। কোনো মতে হাত -মুখ ধুয়ে শার্ট চেঞ্জ করে বেরিয়ে এসেছে।

‘জে. কে. সিন্ধুজা রেস্টুরেন্ট ‘ নামের নতুন একটি রেস্তোরাঁয় ম্যানেজার পদে যোগ দেয় ইনজাদ। মেহমাদের সুপারিশে স্বল্প পরিশ্রমে জবটা তার হয়ে যায়। রেস্তোরাঁর মালিক অমায়িক মানুষ। পারিবারিক কোনো কাজে আজই তাকে দেশ ছাড়তে হবে। তাই কাল বিলম্ব না করে রেস্তোরাঁর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। মিলাদের পর আশেপাশের বিভিন্ন দোকানে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। রেস্তোরাঁর কাজে নিয়োজিত ইমপ্লয়িরা সবাই উপস্থিত। নতুন রেস্তোরাঁর প্রচারের জন্য আগামী এক সপ্তাহ টুয়েন্টি ফাইভ পার্সেন্ট ছাড় রেখেছেন মালিক কর্তৃপক্ষ।

সন্ধ্যার গাঢ় আঁধার নেমে এসেছে। কাঁচঘেরা রেস্তোরাঁর ভেতর আলোর ঝলকানি। বেলুন, তাজা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। দিনের আলোর মতোই সব ঝকঝকে, স্বচ্ছ, স্পষ্ট। ভদ্রলোক বিদায় নিয়েছেন বিকেলেই। সমস্ত দায়িত্ব নির্ভরতার সাথে তুলে দিয়েছেন ইনজাদের একার হাতে। ইনজাদ স্টাফদের সাথে কথা বলছে। বেশিরভাগ সার্ভিস বয়-ই ছাত্র। তাই পার্ট-টাইমে কাজ করবে তারা। দুটো শিফটে। অ্যাকাউন্টেন্ট মানান বয়সে ইনজাদ থেকে একটু বড়ো হবেন। লোকটিও অমায়িক চরিত্রের মানুষ। রান্নাঘরের কাজের জন্য যেসব লোক আর শেফ রাখা হয়েছে তাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি যত্নের সাথে বুঝিয়ে দিচ্ছে ইনজাদ। বাঁগড়া করল তার মুঠোফোন। মোবাইল ফোন বেজে উঠতেই অপ্রস্তুত হয় সে। একপাশে গিয়ে রিসিভ করতেই ওপাশের মানুষের ভয় মেশানো অধৈর্য কণ্ঠ—

“তুই তাড়াতাড়ি বাসায় আয়।”

ইনজাদ কপাল কুঞ্চি করে। তার চোখের পল্লব ঘনঘন ওঠানামা করছে। বিচলিত কণ্ঠে শুধাল—

“কী হয়েছে রে?”

মেহমাদ গম্ভীর স্বরে বলল—

“রেহাংশী ঠিক আছে? ও দরজা কেন খুলছে না?”

“মানে?”

“সে আধা ঘণ্টা যাবত নক করে যাচ্ছি। কোনো সাড়া শব্দ নেই।”

এসির শিরশিরে হাওয়াতেও ইনজাদের মনে হলো সে ঘামছে। তার আশেপাশে কোথাও জ্বলন্ত কুন্ডলি আছে। যার তাপ তাকে আচানক গলিয়ে দিচ্ছে। ভীত গলায় বলে উঠে ইনজাদ—

” আরে না, মে বি ঘুমোচ্ছে।”

“দেখ ভাই, ঘুম তো আমরাও যাই না কি! সেই কখন থেকে নক করছি… দরজা খুলছেই না। আমি খাবার এনেছিলাম। ভাবলাম দিয়ে দিই।”

ইনজাদের গলা শুকিয়ে আসছে। ঢোক গিলতে পারছে না। শিড়দাঁড়া বেয়ে জলস্রোত নেমে যাচ্ছে। চোখ মেলে পুরো রেস্তোরাঁয় চোখ বোলাল। অধর ছড়িয়ে শ্বাস ফেলল। হাতের সাহায্যে মুখের ঘাম মুছতে লাগল। শুষ্ক ঠোঁট জিব দিয়ে ভিজিয়ে একটা লম্বা শ্বাস টেনে নিল। ইনজাদের মনে হলো তার পায়ে কেউ কয়েক মন পাথর বেঁধে দিয়েছে। তাই সে নড়তে পারছে না। বিবশ নয়ন, বিচলিত অন্তঃকরণ, ভয়াল চিন্তায় বুঁদ হয়ে গেল ইনজাদ।
,
,
,
কলিং বেলে চাপ পড়তেই ফট করে দরজা মেলে ধরে মেহমাদ। উদ্বিগ্ন চোখে সে এক প্রাণহীন দেহকে দেখল। ইনজাদের পা চলছে না। অবিশ্বাস্য তার ভাবাবেশ। কোনো শব্দ ছাড়াই একে অন্যের চোখে দিকে তাকাল। ইনজাদের হৃৎকম্পন ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। ফ্লাটে ঢুকতেই বামদিকে একটা বেডরুম। ভেতরের দিকে আরও দুটো বেডরুম পাশাপাশি যা দরজার সমান্তরালে। বামদিকের কক্ষটাই ইনজাদের। সে নরম পায়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আলতো হাতে দু’বার দরজায় আঘাত করে। দরজার পাটাতনে কান পাতে। না, কোনো শব্দ হলো না। ভেজা শার্ট লেপ্টে আছে গায়ের সাথে। ইনজাদের শ্বাস ভারী হচ্ছে। মেয়েটা ঠিক আছে তো!
কপাল বেয়ে ঘামের নহর নামছে। অবিন্যস্ত চিন্তা-ভাবনার ইতি ঘটিয়ে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিল সে। মোহনীয় গলায় ডাকল—

“রেহাংশী! রেহাংশী!”

খট করে একটা আওয়াজ হলো। দরজার পাটাতন পেছতে লাগল কক্ষের ভেতরের দিকে। মেহমাদ হতভম্ব। ইনজাদ কক্ষের ভেতরে পা রাখল। ভেতরে সম্পূর্ণ প্রবিষ্ট হতেই দরজা চেপে গেল। মেহমাদের কপালে ভাঁজ পড়ে। ঘটনার বিস্তৃত সে পরে জানবে। আপাতত তার গলা ভেজানো প্রয়োজন।

ঘাড় ঘোরাল ইনজাদ। দরজার সাথে লেগে দাঁড়িয়ে আছে রেহাংশী। নতজানু মুখটা বিষণ্ণ, বিমর্ষ। ইনজাদ অসহনীয় শ্বাস ফেলল। কণ্ঠে তীক্ষ্মতা টেনে বলল—

“রেসপন্স করছিলে না কেন? পাগল হয়ে গেছ তুমি?”

কেঁপে উঠল রেহাংশী। বুকের কাঁপন থামিয়ে সংকীর্ণ চোখে ইনজাদের দিকে তাকাল। জলভরা সেই চোখ দেখতেই ইনজাদের অস্ফুট রাগ নিভে গেল। ব্যথাতুর কণ্ঠে বলল ইনজাদ—

“কেন এমন করলে বলোতো? আমার কী অবস্থা হয়েছে দেখেছ? ভয় পেয়ে গেছি। যদি কিছু হয়ে যেত তোমার?”

“আমি ঠিক আছি।”

রেহাংশীর মিহি কণ্ঠে ঝাঁঝিয়ে উঠল ইনজাদ। ধমকে উঠে বলল—

“তাহলে দরজা কেন খুলছিলে না?”

প্রত্যুত্তর করল না রেহাংশী। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। নিশ্চুপ, নীরব। ইনজাদ ধৈর্য হারা গলায় বলল—

“ও আমার ফ্রেন্ড। আমরা একই ফ্লাটে থাকি। তোমাকে জাস্ট…।”

“আপনার ফ্রেন্ড হলেও সে পুরুষ। আর সব পুরুষ এক নয়।”

রেহাংশীর ভয়ের কারণ প্রতীত হলো ইনজাদের মস্তিষ্কে। ছোট্ট কক্ষটায় একটা ডাবল বেড যা জানালার সংলগ্নে পাতা। বিছানার এ পাশে একটা পড়ার টেবিল আর তার সাথে চেয়ার। তারপর কক্ষ থেকে বের হওয়ার দরজা। দরজার ওপাশটায় একটা বুকশেল্ফ আর তার পাশেই ছোট্ট কাবার্ড। কোণার দিকটায় ওয়াশরুম। ইনজাদ মাথার দুই পাশ চেপে ধরে বিছানায় বসে। ঝিমঝিম করছে মাথার ভেতরে। কীভাবে সে ছুটে এসেছে ইনজাদ নিজেও জানে না। ঘর্মাক্ত মুখটা উঁচু করে তাকাল রেহাংশীর দিকে। তার দৃষ্টি নিম্নমুখী। টেবিলের দিকে চাইল ইনজাদ। যাওয়ার সময় বিরিয়ানির প্যাকেট রেখে গেছে তা এখনো সেখানেই পড়ে আছে। অসহিষ্ণু গলায় প্রশ্ন ছুড়ে ইনজাদ—

“খাওনি কেন?”

“খেতে ইচ্ছে করছিল না।”

“কী করতে ইচ্ছে করে তোমার?”

মাথা তুলে তাকাল রেহাংশী। টলটলে চোখ। আর কিছু বলতে পারল না ইনজাদ। বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে বের হয়ে চলে যায় সোজা রান্নাঘরে। ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেয়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে শান্ত করে। ছোটো ছোটো পা ফেলে মেহমাদের কক্ষের দিকে এগোয়। বিছানায় আধশোয়া বসে পায়ের ওপর ল্যাপটপ রেখেছে সে। খটাখট চলছে আঙুলের ক্রিয়া। ইনজাদ মনক্ষুণ্ণ গলায় বলল—

“সরি ইয়ার, আসলে ও একটু ভয় পেয়ে গেছে। এর আগে ঢাকা আসেনি কখনো।”

মেহমাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো ভাবাবেশ হলো না। ল্যাপটপের স্ক্রিনে আঁখি নিবদ্ধ রেখেই বলল—

“মাঠে নামার আগে সব খেলোয়াড়রাই নার্ভাস ফিল করে। একবার মাঠে নেমে গেলে, পিচে দাঁড়ালেই সব নার্ভাসনেস শেষ। আর খেলা শুরু হলে তো কথাই নেই। ব্যাট-বলের সংঘর্ষে শুধু একটা ছক্কা! দর্শকও খুশি, ব্যাটসম্যানও খুশি। তুই নিশ্চয়ই এখনো ওপেনিং করিসনি। বেচারি তাই একটু ভয়ে আছে। ”

ইনজাদ দাঁত-মুখ খিচে এসে মেহমাদের পিঠের ওপর তাল বর্ষণ করে। দুই বন্ধুর দস্তাদস্তিতে মেহমাদের বুকের ওপর পড়ে ইনজাদ। ল্যাপটপ বিছানায় ছিটকে পড়ে। মেহমাদ ফিচেল হেসে বলল—

“কী শুরু করলি! সর আমার ওপর থেকে। এমনিতেও খেলা শুরু করতে ডিলেএ করেছিস। তোর বউ এখন এই অবস্থায় তোকে দেখলে নির্ঘাত সন্দেহ করে বসবে!”

ইনজাদ আরও কয়েকটা ডাসা কিল বসায় মেহমাদের বুকের ওপর। গলা মুক্ত করে বলল—

“শালা,অশ্লীল!”

ইনজাদ সরে আসতেই উঠে বসে মেহমাদ। শ্বাস ফেলে বলল—

“বিয়ে হতে না হতেই বাসর করার জন্য উতলা হয়ে পড়েছিস, আর এখন আমাকে অশ্লীল বলছিস? শালা, এক লাথি মারব তোর পশ্চাতে।”

খলখল করে হেসে উঠে ইনজাদ। বিছানার ওপর ধপ করে শুয়ে পড়ে। বিক্ষিপ্ত আওয়াজ হয়। সিলিং থেকে চোখ সরিয়ে মেহমাদের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত হাসে। উজ্জ্বল চোখে চেয়ে বলল—

“আমি সত্যিই ওকে ভালোবেসে ফেলেছি।”

মেহমাদ পা টানটান করল। পেছন দিকে হেলান দিয়ে ল্যাপটপ তুলে নিল হাতে। হাসি হাসি মুখে বলল—

“বলেছিলাম তোকে আমি।”

“ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। বিশ্বাস কর, ওকে এক নজর দেখার জন্য পাগল হয়ে গেছিলাম আমি। কিন্তু যেতে পারিনি ওর সামনে। চোখ মেলাব কী করে!”

মেহমাদ নরম করল চাহনি। শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে আছে। ইনজাদ শূন্যে তাকাল। স্বর ভারী করল। নিভে গেল তার চোখ। বুকের শ্বাস বাড়ল। বলল—

“মেয়েটা যা করেছে আমার পরিবারের জন্য তার ঋণ আমি শোধ করতে পারব না।”

মেহমাদ প্রতিবাদ করল। তীক্ষ্ম কণ্ঠে বলল—

“শোধ কীসের রে? ভালোবাসায় দেনা-পাওনা কীসের? ভালোবাসার বিনিময়ে শুধু ভালোবাসা দিতে হয়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক পবিত্র। সেখানে কোনো হিসেব হবে না। ”

ইনজাদ হাসল। হৃদয় ভেজা হাসি। চোখের পাতায় দোল খেলল খুশির হাওয়া। লাফ মেরে উঠে বসে। কপট রাগ দেখিয়ে বলল—

“দুপুরে খাবার রেখে গেছি, খায়নি। ”

মেহমাদ চট করে তাড়া দিয়ে বলল—

“টুলের ওপর যে প্যাকেট আছে ওটা নিয়ে যা। ”

ইনজাদ হাত ঘড়িতে সময় দেখল। ভ্রু কুঞ্চি করে উঠে দাঁড়াল। প্যাকেটটা নিয়ে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। গিয়ে ঢুকল রান্নাঘরে। খাবার গরম করে প্লেটে করে নিয়ে একবারে ঢুকল নিজের কক্ষে। তাকে দেখেই সচল হলো রেহাংশী। শব্দ করেই টেবিলে প্লেট রাখে ইনজাদ। কঠোর দৃষ্টি তার। শার্টের বোতামে হাত লাগিয়ে বলল—

“খেয়ে নাও।”

ইনজাদ আর কোনো বাক্য নিঃসৃত করল না। শার্ট খুলে ঝুড়িতে রেখে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোজা চোখ ফেলে টেবিলে। খাবার ওভাবেই পড়ে আছে। ইনজাদের ভেজা চুলে তোয়ালে ছোয়ানো। ভেজা চোখচ্ছেদ প্রশস্ত করে গাঢ় গলায় বলল—

“বসে আছ কেন?”

রেহাংশী মিহি গলায় বলল—

“আপনি খাবেন না?”

“আমাকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। আমি না খেয়ে থাকি না। এই, তোমার খিদে পায় না? সকালেও ঠিক মতো খাওনি, দুপুরেও খেলে না। আবার এখনো চুপ করে বসে আছ।”

ইনজাদ বিছানার পায়ের দিকটায় বসে। তার পিঠ দেখতে পাচ্ছে রেহাংশী। দৃষ্টি স্থির হয়। ইনজাদের পৃষ্ঠদেশের বাঁকে তার গাঢ় সম্মোহিনী চাহনি। তার পেশিবহুল শরীরের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে ফড়িংয়ের মতো ছুটছে রেহাংশীর লজ্জামিশ্রিত চাহনি। পর্বতের মতো অটল শিরদাঁড়া। ইনজাদ নিজ কাজে মশগুল। চুলের পানি মুছতে মুছতে বলল—

“নিজের খেয়াল রাখতে শেখো। সারাক্ষণ তো আমি পাশে থাকব না। বাচ্চাদের মতো জেদ ধরলে হবে না। খেয়ে নিতে হবে নিজ গরজে।”

কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ায় ইনজাদ। পরদেশীর ভোলা মন কেন বোঝে না লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে তার বিষবাণ! বিষের নেশা যে তারও লেগেছে। ইনজাদের অবিন্যস্ত চিকুর ভেদ করে ওই ভরাট দুই আঁখি বিদীর্ণ করছে রেহাংশীর কোমল নারী হৃদয়কে। তার উচ্চ গ্রীবা, প্রশস্ত বক্ষপুট, ফুলে উঠা বাহুর প্রতিটি ভঙ্গি চূর্ন-বিচূর্ণ করছে প্রিয়তমার নারীসত্তাকে। ঘোরগ্রস্ত ওই দৃষ্টিতে বেড় লাগায় ইনজাদ। তেঁতে উঠে বলল—

“এখনো বসে আছ তুমি? খাচ্ছ না কেন?”

ঘোর ভাঙ্গে রেহাংশীর। আচ্ছন্ন গলা ভেদ করে সরল উক্তি করল।

“খাচ্ছি।”

“যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।”

চেয়ার টেনে রেহাংশীর সান্নিধ্যে বসে ইনজাদ। চলাচলের জন্য তিন ফুটের খালি জায়গাটুকুই বরাদ্দ। কয়েক সেন্টিমিটারের দূরত্বে বসা ইনজাদের অঘোষিত প্রেমাত্মক নজরে আবৃত করে নিল রেহাংশীকে। ছোটো ছোটো লোকমা মুখে দিচ্ছে সে। তার দন্তের ঝিলিক, মেদহীন চোয়ালের বিশেষ ভঙ্গিমা, চোখের পলকের নির্দিষ্ট সীমা, পদ্মকোমল অধরের ভাঁজ। সবকিছুই অবলোকন করছে ইনজাদ। বিছানায় আসন পেতে বসেছে রেহাংশী। কোলের মাঝে থালার স্বগৌরবিত স্থান। রেহাংশীর ঠোঁট নড়ে। দুলে উঠে ইনজাদের বক্ষস্পন্দন। কম্পিত হয় তা তূরন্ত বেগে। প্রিয়তমার অধরপল্লবে নিমগ্ন হওয়ার গহন প্রয়াস তার। ইনজাদ পিঠ আলগা করে। তার শব্দহীন গতি বুঝতে সময় নিল রেহাংশী। ছোট্ট চুমু বসাল রেহাংশীর তুলতুলে গালে। শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল সে। ইনজাদ চোখের বিজলী ফেলল। একটানে রেহাংশীর খোঁপা খুলে বলল—

“এলোকেশী, অবিন্যস্ত চুলে কেড়ে ছিলে কার প্রাণ?
দোহাই তার, মুক্তি দাও, বেঁচে থাকার আহ্বান।
এলোকেশী, ঝরা কেশে জড়িয়ে ছিলে কার শ্বাস?
রজনী জাগিয়া সে তোমায় ভেবেছে অবিরাম।
এলোকেশী, বাড়িয়ে দাও তোমার দুই হাত
বক্ষপিঞ্জিরায় আবদ্ধ হয়ে সে তোমার হয়েই থাক।”

মিষ্টি করে হাসে রেহাংশী। তার চোখে ভেসে উঠে অপ্রতিরোধ্য প্রাণোচ্ছ্বাস। ইনজাদ অধরের কোণ প্রসারিত করে। চেয়ারে গিয়ে বসে পূনরায়। অনুরক্তির সুরে বলল—

“চুল খোলা রেখো। তোমায় ভালো লাগে দেখতে।”

লজ্জানত মুখে মিহি হাসি। ইনজাদ গাঢ় স্বরে বলল—

“ভয় লাগছে? আজ কিন্তু অন্ধকারেই ঘুমাতে হবে তোমায়?”

ভুত দেখার মতো চমকিত গলায় বলে উঠে রেহাংশী—

“উহু, আমি অন্ধকারে ঘুমাতে পারব না।”

“আমি কাছে থাকলেও না?”

“কাছে? কতটা কাছে?”

“যতটা কাছে থাকলে তোমার ভয় করবে না।”

ইনজাদের অপ্রকাশিত কথার ধার বুঝতে পারল রেহাংশী। তার ছোট্ট ,গোলগাল মুখটা লাল টমেটোর মতো হয়ে ওঠল। ইনজাদ দুষ্ট হাসে।
,
,
,
সবুজাভ বাতির নরম, ম্রিয়মান, টিমটিমে আলোতে তন্দ্রালুভাবে আচ্ছন্ন দুই নর-নারী। দেয়াল ঘেঁষে শুয়ে আছে রেহাংশী। জানালার পর্দা ফিরফিরে পবনে দোদুল্যমান। থাই ভেদ করে ভরাট চাঁদের স্নিগ্ধ কিরণে জ্বলজ্বল করছে তার লতানো দেহ। রেহাংশীর স্থির দৃষ্টি সেই চন্দ্রিমাতে বিদ্ধ।

বিছানার এপাশটায় শুয়ে আছে ইনজাদ। তার পৌরষসত্তা বিক্ষিপ্ত, উত্তেজিত, বেপরোয়া। এই ছোট্ট কক্ষটায় একসময় শুধু তার নিবাস ছিল। আজ এক জীবন্ত নারীদেহ তার পাশে। চিরায়ত পুরুষালী স্বভাব থেকে নিজেকে দূরে রাখা এতটা সহজ নয়। সে এতটাও শুদ্ধ পুরুষ নয় যে বিবাহিত স্ত্রীকে পাশে রেখে হাওয়ায় চোখ বুলিয়ে যাবে! নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে তার। নিষ্পেষিত অন্তরিন্দ্রিয়তে উচাটনে বিধ্বস্ত ইনজাদ উঠে বসে। তার এহেন কার্য হেতু ঝট করে ভীতিকর এক পরিস্থিতির অনুমান করে উঠে বসে রেহাংশী। ভীতসন্ত্রস্ত গলায় বলল—

“কী হয়েছে?”

এ মেয়ে বোকা? কিছু বোঝে না? না কী বুঝেও না বোঝার কঠোর প্রচেষ্টা! অকপট, অবিমিশ্র, শুদ্ধ ছল!
ইনজাদ তাকাল। এক আস্ত নজরে চন্দ্রকিরণের মোহাচ্ছন্ন মায়ায় ঐকান্তিকভাবে চেয়ে রইল পাশের মুক্তকেশীর ওই চন্দ্রাননে। সবুজাভ ক্ষীন বাতি আর চাঁদের আলোর প্লাবনে বিভ্রান্ত সে। হৃদয় কাঁপানো সেই কামিনীর পদ্মাক্ষীর আবছা দৃশ্যতে অস্থির হয়ে উঠে ইনজাদ। চোখ ফিরিয়ে ড্রয়ার হাতরে সিগারেটের প্যাকেট বের করে উঠে দাঁড়ায়। ভয়মিশ্রিত স্বরে উৎকন্ঠা নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে রেহাংশী—

“কোথায় যাচ্ছেন?”

ইনজাদ মিইয়ে গলায় প্রত্যুত্তর করে—

“কোথাও না। তুমি ঘুমাও, আমি আসছি।”

“এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন?”

রেহাংশীর কণ্ঠের ব্যস্ততা বলছে সন্ত্রস্ত সে।

“ঘুমাও তুমি। আমি এক্ষুণি ফিরে আসছি।”

দরজা খুলে ড্রয়িংরুমে আলুলায়িত পায়ে পায়চারি শুরু করে ইনজাদ। সময় চলতে থাকে। সিগারেট জ্বলতে থাকে একের পর এক।
একসময় থমকায় ইনজাদ। সময় তখন মধ্যরাত্রি। নিজ কক্ষে ফিরে আসতেই অক্ষিযুগল আবদ্ধ হয় রেহাংশীর কোমলাঙ্গ দেহে। অপ্রকৃতিস্থতা কামিনীর দুর্গম কমনীয়তা আচড়ে পড়ছে ইনজাদের চক্ষুদর্পণে। খসে পড়া শাড়ীর আঁচল, হাঁটু অব্দি জড়ানো শাড়ির ফাঁক-ফোকর গলিয়ে নিষিদ্ধ অঙ্গের হাতছানি। ইনজাদ স্থবির। চোখের গতিপথ পরিবর্তন করে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। আপাতত তার দীর্ঘ ঘুম প্রয়োজন।সুদীর্ঘ ঘুম।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here