মোহঘোর #পর্বঃ৪০,৪১

0
422

#মোহঘোর
#পর্বঃ৪০,৪১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
৪০

এলোথেলো চুলে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল রেহাংশী। তার উদ্ভাসিত চোখ জোড়া বিস্মিত। রেহাংশীর উপস্থিতি বুঝতে পেরে সপ্রতিভ হলো ইনজাদ। মখমলে হেসে তার দিকে তাকিয়ে বলল—

“এসো।”

রেহাংশী এলোমেলো নরম পায়ে এগিয়ে এলো। তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল ইনজাদ। বেদনাবিধুর আননে রাজ্যের মায়া! রেহাংশীর শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল ইনজাদ। স্বল্প ঘুমের চোখ দুটো শ্রান্ত, চাহনিতে শিথিলতা। ইনজাদ ফিচেল গলায় বলল—

“খোলা চুলে তোমায় ভালো লাগে। তাই বলে সবসময় নয়। চুল বাঁধনি কেন? কী অবস্থা হয়ে আছে!”

ইনজাদ আলতো হাতে মুখের আশেপাশের অবাধ্য হয়ে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দেয়। কপালে লেপ্টে থাকা কেশের বহর আঙুলের সাহায্যে সরিয়ে দেয়। মোলায়েম স্বরে বলল—-

“বেঁধে নাও।”

রেহাংশী নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে আদেশ প্রাপ্ত ভৃত্যের মতো চুল বেঁধে নেই। ছোট্ট করে হাসল ইনজাদ। মায়ময় গলায় বলল—

“এসো।”

রেহাংশীকে টেবিলে নিয়ে বসায় ইনজাদ। পরোটার ওপর ডিমের আস্তরণ লাগিয়ে ভেজে রেখেছে। রেহাংশী চোখ তুলে তাকিয়ে বলল—

“আপনি রান্নাঘরে গেলেন কেন?”

চেয়ার টেনে রেহাংশীর পাশে বসল ইনজাদ। সহজ গলায় বলল—

“কেন, রান্নাঘরটা কী আমার নয়?”

” এসব করতে কে বলেছে আপনাকে?”

“বলেনি তো। শোনার প্রয়োজনবোধ করিনি। খেয়ে নাও। কাল থেকে কিছুই খাওনি। শরীর খারাপ করবে।”

“আপনি আর রান্নাঘরে যাবেন না।”

রেহাংশীর কণ্ঠে কঠোরতার আভাস পেল ইনজাদ। স্থির অধরে চঞ্চল হেসে বলল—

“ওকে, ওকে যাব না। খেয়ে নাও। আমি আসছি।”

“আপনি খেয়েছেন?”

“হুম। তুমি খাও।”

রেহাংশীর পেলব কপালে শুষ্ক ঠোঁট ছোঁয়াল ইনজাদ। চেয়ার থেকে উঠে নিজের কক্ষে ফিরল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। আচানক মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। মোবাইলের স্ক্রিনের নামটা দেখে ভ্রূ কুঁচকালো ইনজাদ। রিসিভ করল বিনা দ্বিধায়।

“হ্যালো!”

“হাই! কেমন আছ?”

ইনজাদ ঠান্ডা স্বরে বলল–

“ভালো। তুমি?”

সিন্ধুজা কথার জবাব না দিয়ে বলল—

“রেহাংশী কেমন আছে?”

“আগের চেয়ে ভালো।”

ওপাশের যুবতীর দীর্ঘশ্বাস টের পেল ইনজাদ। দুই প্রান্তে মৌনতা নেমে এলো। ইনজাদ কথা খুঁজে পেল না। সিন্ধুজা অনুরক্তির সুরে বলল—

“ড্যাডের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি। আমি কল্পনাও করতে পারিনি এভাবে সম্পর্ক জুড়ে যাবে আমাদের!”

ইনজাদ কথা বলল না। শুনে গেল। সিন্ধুজা পূনরায় বলল—

“আমার বায়োলজিক্যাল ফাদারের ডেথের পর ড্যাড আমাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবেসেছে। কখনো পর বলে অবহেলা করেনি। কিন্তু নিজের রক্তের সম্পর্কের সাথে এমনটা…!”

সিন্ধুজার গলা বসে গেল। সে কিছুটা সময় নিয়ে বলল—

“ড্যাড সত্যিই অনুতপ্ত ইনজাদ। কাল ফেরার পর থেকে নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখেছে।”

ইনজাদ ঠাস করেই বলে উঠে—

“এতে তার অন্যায় তো ঢাকা পড়বে না। একটা বাচ্চা মেয়ে তার শৈশব, কৈশোর কাটিয়েছে বাবা-মায়ের ভালোবাসা ছাড়া। পরিবারের প্রতিটি মানুষ, যাদের ও অক্লান্ত ভালোবেসেছে তাদের থেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ছাড়া কিছুই পায়নি। ”

“আমি মানছি ইনজাদ, ড্যাড যা করেছে ভুল করেছে। কিন্তু তার একার ভাগীদার সে নয়।”

“মানে?”

সিন্ধুজা গাঢ় শ্বাস ফেলল। উন্মুক্ত গলায় বলল—-

“ড্যাডের সাথে মমও দোষী। দোষী আমরা সবাই। মম শুধু নিজের সন্তানের কথা ভেবেছেন। নিজের প্রতিপত্তি, অর্থ দিয়ে ড্যাডকে আটকে রাখতে চেয়েছেন। এছাড়া কোনো পথ ছিল না। কারণ, তাদের মাঝখানে সৌরভ এসে দাঁড়িয়েছে। আমার মামারা, আমার বায়োলজিক্যাল ফাদারের সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে চেয়েছিল। মমের পাশে এসে দাঁড়ায় ড্যাড। এক টুকরো ভরসার হাতকে সে হারাতে চায়নি। ভুল করেছিল মম। রেহাংশীর মায়ের ক্যান্সার ছিল। যা ড্যাড কাউকে জানায়নি। তার চিকিৎসার টাকার জন্যই সে শহরে এসেছিল। কিন্তু….। ড্যাড ভুলে করেছিল। তার ওই অবস্থায় রেহাংশীর মাকে ছেড়ে আসা উচিত হয়নি। জীবনের শেষ দিনগুলো না জানি কত কষ্টে পার করেছেন তিনি। রেহাংশীকে আনতে গিয়েছিল ড্যাড। কিন্তু, ওর ঘৃণার কাছে হেরে গেল সে। যেইবার বাড়ি গিয়ে রেহাংশীকে ড্যাড পায়নি, ওর বড়ো মা বলেছিল, রেহাংশীকে ওর মামারা নিয়ে গিয়েছিল। ও ওখানেই থাকবে। ড্যাডের সাহস হয়নি ওই বাড়িতে যাওয়ার। সে তার সমস্ত সম্পত্তি রেহাংশী নামে করে দিয়ে এসেছিল। মমও এটাই চেয়েছিল। নিজের সন্তানদের খুশির জন্য তিনি স্বার্থপর হয়েছেন।”

“এসব কে বলেছে তোমাকে?”

“মম বলেছে। ড্যাড কারো সাথে কথা বলছে না।”

“রেহাংশীর বড়ো মাকে তো আমার সহ্য-ই হয় না। এতটা জঘন্য কোনো মানুষ হয় কী করে! ওর মামারা তো কিছুদিন পরই ওকে ফিরিয়ে দিয়ে যায়। আর স্যার! আরেকবার খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলেন না? সম্পত্তি লিখে দিলেই সন্তানের প্রতি সব দায়িত্ব শেষ?”

“আই এম সরি ইনজাদ।”

“তুমি কেন সরি বলবে? এতে তোমার কোনো দোষ নেই। ”

“আচ্ছা, রাখছি আমি। রেহাংশীর খেয়াল রেখো। কোনো হেল্প লাগলে জানিয়ো আমাকে। আপন না হই, কিন্তু বোন তো। ”

“ওকে, বাই।”

ইনজাদ লাইন কেটে তীব্র শ্বাস ফেলল। সম্পর্কের জটিলতায় সে পর্যদুস্ত।

দেহভঙ্গিমা বদলাতেই রেহাংশীকে দেখতে পেল। নিষ্প্রাণ দুই আঁখি মেলে ভ্যালভ্যাল করে চেয়ে আছে। তার স্থির চাহনির বিপরীতে হাসল ইনজাদ। পা বাড়িয়ে কাছে গিয়ে দাঁড়াল। গতকালের বিষয়ে আর একটি কথাও নয়। এই জটিল সম্পর্কের টানা-পোড়েন থেকে রেহাংশীকে বের করে আনতে চায় সে।

“রেডি হও। আজ মানান ভাইয়ের মেয়ের জন্মদিন। তোমাকে স্পেশালি যেতে বলেছে।”

রেহাংশী শক্ত করে জবাব দিলো।

“যাব না আমি।”

“যেতে হবে রেহাংশী। যাও তৈরি হয়ে নাও।”

রেহাংশী আড়ষ্ট হয়ে রইল। ইনজাদ প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে ফের বলল—

“দাঁড়িয়ে আছ কেন? শাড়িটা চেঞ্জ করে নাও। নাকি আমি হেল্প করব?”

“না।”

“ফিক করে হেসে ফেলে ইনজাদ। চটপটে গলায় বলল—

“তাহলে তাড়াতাড়ি রেডি হও।”

“জোর করছেন কেন?”

রেহাংশীকে নিজের কাছে টেনে নেয় ইনজাদ। বক্ষপুটে সমাহিত করে বলল—

“ভালোবাসায় জোর করতে হয়। তাতে অন্যায় হয় না। এইটা অধিকার। আর জোর করে তো অধিকার আদায় করিনি, অর্জন করে নিয়েছি।”

রেহাংশী তার বিধ্বস্ত, ধ্বসে পড়া মনে দুই হাতে আঁকড়ে ধরল ইনজাদকে। অতল বিশ্বাস তার অন্তঃকরণে বাসা বাঁধতে শুরু করল। এই মানুষটাকে সে বিশ্বাস করতে পারে, ভরসা করতে পারে। রেহাংশী গাল ঘষতে থাকে ইনজাদের বুকে। আদুরে সুরে বলল—

“দাওয়াত তো দুপুরের। এখন যাব কেন?”

“তোমাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাব। তাড়াতাড়ি রেডি হও।”

“কোন শাড়ি পরব?”

“যেইটা তোমার ইচ্ছে।”

“আপনি বলুন।”

“তোমাকে তো আমার শাড়ি ছাড়াও ভালো লাগে।”

রেহাংশী মাথা সরিয়ে কয়েকটা দূর্বল ঘুষি বসায় ইনজাদের বুকে। ইনজাদ সরল হেসে বলল—

“আরে, সবসময় নেগেটিভ ভাবো কেন? আমি তো বলেছি তোমাকে সবকিছুতেই আমার ভালো লাগে। ডার্টি মাইন্ড!”

রেহাংশী কপাল কুঁচকে বলল—

“আপনার।”

“হ্যাঁ, তা তো দেখলাম-ই কার।”

রেহাংলী লজ্জায় নেতিয়ে গেল।

“ধুর! যান এখান থেকে।”

সশব্দে হেসে উঠে ইনজাদ।
,
,
,

অতিরিক্ত জনসমাগমে নিজেকে ধাতস্থ করতে পারে না রেহাংশী। তার মনে অজানা আশঙ্কা ঢোল পিটাতে থাকে। মানানের মেয়ে তুষ্টির জন্মদিনে ছোটো ছোটো বাচ্চাদের সাথে তাদের বাবা-মায়েরও আগমন ঘটেছে। এত অচেনা মানুষের মাঝে নিজেকে ঘুটিয়ে নিচ্ছে রেহাংশী। কিন্তু তার ঢাল, তার ছায়া, তাকে ছেড়ে নড়ছে না। ইনজাদ শক্ত করে রেহাংশীর হাত চেপে ধরে রেখেছে। ছাড়বে না সে। যে হাত পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একবার সে ধরেছে, সে হাত কোনো কিছুর বিনিময়ে সে ছাড়বে না। বাচ্চাদের ছোটাছুটিতে রেহাংশীর ভার মন একটু একটু করে হালকা হতে লাগল। মন খারাপের জমাট মেঘ তুলোর মতো উড়তে লাগল। মানানের মেয়ে তুষ্টি চট করে রেহাংশীর কোমড় জড়িয়ে ধরল। আহ্লাদী গলায় বলল—

” আনটি এসো, তুমি না কী গান করো? পাপা বলেছে। এসো, গান শোনাও।”

হাত সরাল তুষ্টি। ধাতস্থ চোখে চেয়ে রইল। রেহাংশী ভয়ে আঁতকে ওঠল। গান আর সে। এ তো ভয়ংকর ব্যাপার! ইনজাদের চোরা হাসিতে রেহাংশীর ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় তাকে জানান দিলো, এ আকাশ ভাঙা বিদঘুটে কাজ তার স্বামীর। রেহাংশী টের পেল তার উদরে কারো স্পর্শ। ইনজাদের ঠোঁটে দুষ্ট হাসির ছল! পেছনে দিকে মানুষ না থাকায় তার পূর্ণ ফায়দা তুলছে ইনজাদ। লোক সমাগম থেকে খানিকটা দূরেই দাঁড়ানো তারা। তুলতুলে, পেলম, মসৃণ উদরে স্বামীর পুরুষালী গহন স্পর্শে ঝনঝনিয়ে উঠল রেহাংশীর দেহ। তার কণ্ঠরোধ হয়ে এলো। ভাঙা কণ্ঠে বিধুর হয়ে বলল—

“কী করছেন আপনি? হাত সরান।”

“তাহলে হাসো। মুখের মধ্যে কী আলাদিনের চেরাগ লুকিয়ে রেখেছ না কি তোমার দাঁত হীরে দিয়ে বাঁধানো! হাসো বলছি।”

“হাসব না। কী করবেন আপনি?”

“কী করছি টের পাচ্ছ না? এখন কিন্তু সবার সামনে…।”

ইনজাদ আর রেহাংশীর অগোছালো কথার মানে তুষ্টির বোধগম্য হলো না। সে ভাসন্ত চোখে চেয়ে রইল। ইনজাদ কণ্ঠ খাদে নামিয়ে তার অর্ধেক কথার বাকিটুকু রেহাংশীর কান ফুঁকে দিলো।

“এখন সবার সামনে চুমু খেয়ে নেবো।”

রেহাংশী নাকের ডগায় বিরক্তি ঝুলিয়ে বলল—

“হাত সরান না।”

“আগে হাসো।”

রেহাংশী নিজেকে সংবরণ করতে পারল না। সবকিছু ভুলে ইনজাদের ডান বুকে ঠাসা এক কামড় বসিয়ে দিলো। তুষ্টি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে চিৎকার করতে গেলে তার মুখ চেপে ধরে ইনজাদ।

“এই, তুষ্টিমনি, চিৎকার করে না। চকলেট নাও। আর আনটির কথা কাউকে বলো না। কেমন?”

ইনজাদ হাত সরাতেই তুষ্টি ভাবুক গলায় বলল—

“তুমি ব্যাথা পাওনি আঙ্কল?”

“উঁহু। ব্যাথা পায়নি। তুমি যাও, আর কাউকে বলবে না, ওকে? তাহলে আনটিকে সবাই পঁচা বলবে। কিন্তু আনটি তো ভালো, তাই না?”

“তাহলে কামড় দিলো কেন?”

ইনজাদ ঝলমলে হেসে তুষ্টির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল—-

“তোমার জন্য চকলেট এনেছি, কিন্তু আনটির জন্য আনিনি তাই। যাও, এখন।”

“আচ্ছা।”

তুষ্টি যেতেই সোজা হয় ইনজাদ। রেহাংশীর দিকে তাকিয়ে বলল—

“দাঁতের জোর বেড়েছে! বুকটা আমার ড্রাকুলার দাঁত দিয়ে ফুটো করে দিলে!”

রেহাংশী ভাবান্তরহীন । এমনটা করা তার উচিত হয়নি। মানুষটা ব্যাথা পেয়েও হাসছে!

চলবে,,,

#মোহঘোর
#পর্বঃ৪১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

ম্লান বিকেল! দিবাকরের ঝিমুনি ধরা নিষ্প্রাণ আভা। একটু পরেই টুপ করে ধূসর আকাশের ওই নিষ্প্রভ আলোক টুকরোকে গিলে নেবে সায়াহ্নের আঁধার। ঝিম ধরা শহরের বুকে মিহি কুয়াশার চাদর নামছে। বারান্দায় শিঁড়দাড়া দৃঢ় করে দাঁড়িয়ে আছে ইনজাদ। তার প্রস্ফুটিত চোখ সূদুরে।

কলিং বেল বাজলো! ইনজাদ সরব হলো। কক্ষে প্রবেশ করে বিছানার দিকে তাকাল। রেহাংশীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন মুখে অপরিমেয় মোহ। ইনজাদ মুচকি হাসল। ফের বাজলো কলিং বেল। ইনজাদ দ্রুত পা চালালো। পাছে রেহাংশীর ঘুম ভেঙ্গে যায়!

দরজা খুলতেই বিস্মিত হলো ইনজাদ। জিবরান খন্দকার দাঁড়িয়ে। গলায় কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে ইনজাদ—

“স্যার আপনি?”

জিবরান খন্দকারের কণ্ঠে জোর নেই। মুমুর্ষু রোগীর মতো চেয়ে আকুল গলায় বললেন—

“রেহাংশী….।”

“ভেতরে আসুন।”

জিবরান খন্দকার ভেতরে প্রবেশ করলেন। এদিক-ওদিক চাহনিতে কাউকে খুঁজতে লাগলেন। ইনজাদ গাঢ় স্বরে বলল—

“বসুন স্যার।”

জিবরান খন্দকার খেলনা হারানো বাচ্চাদের মতো মুখ করে বললেন—

“রেহাংশী…. ওকে একবার দেখতে দেবে?”

“আপনি বসুন, স্যার।”

জিবরান খন্দকার কাউচে বসলেন। তার অস্থির চাহনি একবার রান্নাঘরে, একবার শয়ন কক্ষের দিকে ঘুরতে লাগল। তিনি অসহনীয় চিত্তে কিছু খুঁজছেন। তার অধৈর্য, উৎপীড়িত, মন মস্তিষ্কের সান্ত্বনার জন্য ইনজাদ বলে উঠে—

“রেহাংশী ঘুমোচ্ছে স্যার। ঘুমের ঔষধ দিয়েছি। যতক্ষণ জেগে থাকবে ততক্ষণ শুধু কাঁদবে।”

জিবরান খন্দকার আঁখুটে গলায় বললেন—

“একবার ওকে দেখতে দেবে আমায়?”

“নো, স্যার।”

জিবরান খন্দকার কণ্ঠ মলিন করে বললেন—

“শুধু একবার দেখতে দাও!”

“নো, স্যার। আমি চাই না আপনি ওর মুখোমুখি হোন। অনেক কষ্টে সামলাচ্ছি ওকে আমি। কী করে পারলেন আপনি এমন করতে? নিজের সন্তান, নিজের রক্তকে এভাবে ভুলে যেতে? একবারো ভাবেননি আপনি ছাড়া ওর কী হবে?
বাবা-মা ছাড়া একজন সন্তানের কী অবস্থা হয়? আপনি জানেন, ওর বড়ো মা আর তার মেয়েরা ওর সাথে কেমন ব্যবহার করত? ইভেন আপনার মা?
খেতে দিতো না রেহাংশীকে, বাড়িতে কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও ওকে দিয়ে কাজ করাতো। ওর বিয়ে ঠিক করেছিল কার সাথে জানেন? রতনের সাথে; একজন জেল ফেরত আসামী। আর কিছু শুনতে চান?”

জিবরান খন্দকার ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। জমাট চোখের বান ছুটেছে। ইনজাদ অপ্রস্তুত হলো। জিবরান খন্দকার অপরাধী মুখ করে বললেন—

“আমি জানি আমি ভুল করেছি। অনেক বড়ো ভুল করেছি। শহরের রঙ চকচকে জীবন আমার সত্যিকারের অস্তিত্ব মিটিয়ে দিয়েছে। আমি ভাবিনি আমার মেয়েটা এত কষ্টে আছে! ভাবীকে একবার ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলল- রেহাংশী ভালো আছে। আমার প্রতি ঘৃণার কারণে আমি আর ওর সামনে যাইনি। ভাইয়াকে বলেছি, ওকে দেখে রাখার জন্য। এখানে এলে সাবরিনা ওকে মেনে নিতো না। আর আমি ওদেরও ছাড়তে পারছিলাম না। আমি ভাবতে পারিনি, আমার মেয়েটার সাথে ওরা এমন করবে! ”

“তাই বলে, এত বছরে একবারো খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলেন না? সত্যি আপনার মেয়ে ভালো আছে কি না?”

“স্বার্থপর, স্বার্থপর হয়ে গেছি আমি। সাবরিনার প্রতি আমার মোহ বোঝার পূর্বেই সৌরভে জন্ম। আমি সবকিছুর বিনিময়ে জয়ার চিকিৎসার টাকা পাই। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল! নিজের দোষে আমি জয়াকে হারিয়ে ফেললাম। সাবরিনার প্রাক্তন স্বামীর হঠাৎ অ্যাকসিডেন্ট হয়। তার সব সম্পত্তি পেয়ে যায় সিন্ধুজা।সিন্ধুজার মামারা উঠে-পড়ে লাগে সেই সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে। এইসব কিছুর মাঝে এমনভাবে মিশে গেলাম যে নিজের মেয়েকে ভুলে গেলাম। আমি ভেবেছি ও ভালো থাকবে। কিন্তু জয়ার মতো ওরা আমার মেয়েটার সাথেও এমন করবে আমি ভাবিনি। ক্ষমা চাইব না আমি। আমি ক্ষমার যোগ্য নই। শুধু একটিবার ওকে আমায় দেখতে দাও। একবার ইনজাদ!”

ইনজাদ শক্ত কণ্ঠে বলল—

“না, স্যার। আমি আপনাকে সে অধিকার দিতে পারি না। আপনি আসতে পারেন। ওই বাড়ির সাথে রেহাংশীর কোনো সম্পর্ক নেই, আর না আপনার সাথে। ও এখন শুধু আমার স্ত্রী, আমার আম্মা-বাবা পুত্রবধূ। ওর ওপর আর কারো অধিকার ফলাবে না।”

জিবরান খন্দকার হৃদয়ভেদী কণ্ঠে বললেন—-

“মরার আগে একবার কী ওর মুখ থেকে বাবা ডাক শুনতে পারব না?”

ইনজাদের মন কেঁপে ওঠল। তবুও দৃঢ়তার সাথে বলল—-

“আমার জানা নেই। আপনি এখন আসতে পারেন। রেহাংশী যেকোনো সময় উঠে যাবে। আর আপনাকে এখানে দেখলে…।”

জিবরান খন্দকার পরাস্থ হলেন। চোখের ধারা মুছে নিয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একজোড়া নুপূর বের করেলেন। ইনজাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন—-

“একবার আমার কাছে নুপূর চেয়েছিল। দিতে পারিনি। এইগুলো একবার ওর পায়ে পরিয়ে দিয়ো। আমি ভেবে নেবো ও আমাকে ও ক্ষমা করে দিয়েছে। ”

জিবরান খন্দকার ভারাক্রান্ত মন নিয়ে উঠলেন। তিনি যেতেই নিজের কক্ষে এলো ইনজাদ। দেহভঙ্গি বদলেছে রেহাংশী। পাতলা চাদরের বাইরে তার টলটলে পা দুটো বেরিয়ে আছে। ইনজাদ পায়ের দিকটায় এসে দাঁড়াল। রেহাংশীর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি করে বলল,” সরি, রেহাংশী! বুড়ো মানুষটা একটা আবদার করেছে।”
,
,
,
আড়মোড়া ভেঙে চোখের পাতা খুলে রেহাংশী। ভারী পল্লব প্রসারিত করে চাইতেই কৃত্রিম বাতির ঝলমলে আলো তার চোখের কোটরে বিঁধে গেল। পায়ে পায়ে ঘষা লাগতেই অপ্রস্তত হলো রেহাংশী। বিধ্বস্ত শরীরটা টেনে উঠে বসল। জ্বলজ্বলে, রুপালি নুপুরে অবাক হলো সে। পলেই মুখের ভাবভঙ্গি বদলে গেল। টেনে-হিচড়ে খুলতে চাইল নুপুর। অপরিণত মস্তিষ্কের মনুষ্যের মতো কাজ! নুপুরের শক্ত ধাতুর ঘর্ষণে পায়ের গোড়ালি এবড়ো-থেবড়ো। ঝরতে লাগল রক্ত। ইনজাদ মাত্রই ভেতরে এলো। রেহাংশীকে অপ্রকৃতিস্থর মতো আচরণ করতে দেখে ছুটে এসে হাত ধরল। উদ্বেলিতে কণ্ঠে বলল—

“কী করছ এসব? পাগল হয়ে গেছ?”

এলোমেলো চুলে, চোখের পানির সাথে একাকার হয়ে আছে মুখ। রেহাংশী রোদনভরা কণ্ঠে বলল—

“কেন পরিয়েছেন এসব? ওই লোকটা কেন এসেছে এখানে? কেন ওই লোকটার সাথে কথা বলেছেন?”

“দেখো, রেহাংশী আমার কথা শোনো।”

“কোনো কথা শুনতে চাই না। এগুলো খুলুন, খুলুন বলছি। সব ফেলে দেবো আমি, সব।”

এলোপাথাড়ি টানা -হেচড়ায় রেহাংশীর পায়ের অবস্থা বেহাল। ইনজাদ ধমকে ওঠল।

“ওকে খুলছি। প্লিজ, স্টপ দিস।”

শান্ত হয় রেহাংশী। ইনজাদ নুপুরের লক খুলতেই তা ছোঁ মেরে নিয়ে নেয় রেহাংশী। ছুড়ে ফেলে মেঝেতে।
ফুঁসতে থাকে রাগে। ইনজাদ মেঝের ওপর বসে তার উরুর ওপর পা রাখে রেহাংশীর। বিছানার ওপর থাকা তোয়ালে নিয়ে পায়ের রক্ত মুছে দিতে দিতে বলল—-

” এমন করে কেউ! কী অবস্থা করেছ!”

ঝপ করে ইনজাদের বুকের মাঝে সিদিয়ে যায় রেহাংশী। ইনজাদ চমকে যায়। দুই হাতে স্বামীকে জড়িয়ে তার বক্ষপুটে মাথা রাখে রেহাংশী। ইনজাদ আলতো করে জড়িয়ে রাখে রেহাংশীকে। সরস গলায় বলল—

“বিছানায় বসো রেহাংশী। ঠান্ডা লেগে যাবে।”

রেহাংশী অস্পষ্ট স্বরে বলল—

“উঁহু।”

“এত রাগ!”

“ওই লোকটাকে আমি কোনোদিনও ক্ষমা করব না। খুনি!”

ইনজাদ চুপ রইল। রেহাংশী পূনরায় অধিকার নিয়ে বলল—

“আপনি আর ওদের ওইখানে কাজ করবেন না। ওদের কারো সাথে কথা বলবেন না। আমরা গ্রামে চলে যাব। আপনি তো অনেক পড়ালেখা করেছেন! আপনার তো অনেক বুদ্ধি! আপনিও বড়ো আব্বুর মতো সদরে ব্যাবসা করবেন। আমরা গ্রামে থাকব। আম্মা আর বাবার সাথে থাকব। আমার কিচ্ছু চাই না। শাড়ি, গহনা কিচ্ছু না। আমি তিনবেলা খাবোও না। তবুও এই শহর ছেড়ে দিন আপনি। এই শহরের বাতাস বিষাক্ত। আমি আপনাকে হারাতে পারব না।”

ইনজাদ সরল গলায় বলল—-

“তুমি ভাবলে কী করে তোমাকে না খাইয়ে রাখব আমি?”

“আমরা এই শহরে থাকব না। আমরা গ্রামে থাকব। আপনি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না। কোনো টাকা- পয়সা চাই না আমার। ঘরের সব কাজ করে দেবো আমি। আম্মাকে কিছু বলার সুযোগ দেবো না। আপনার সব কথা শুনব। শুধু শহর থেকে আমাকে নিয়ে চলুন। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে এখানে।”

ইনজাদ আরেকটু শক্ত করে নিল হাতের বাঁধন। বিশাল আকাশের টুকরো মেঘের মতো ইনজাদের বক্ষের সাথে মিশে গেল রেহাংশী। আপাতত কোনো কথা বলল না ইনজাদ। সময় সঠিক নয়।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here