মোহঘোর #পর্বঃ৪৬

0
705

#মোহঘোর
#পর্বঃ৪৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে ত্রিনা। একটা শপিংমলের গ্রাউন্ড ফ্লোরের কর্ণারে দুটো ফাস্টফুডের দোকান। তার একটাতে বসে আছে রেহাংশী আর ত্রিনা। ছোট্ট ফাস্টফুড দোকানের দরজা পুশ করে ভেতরে ঢুকতে হয়। তিন মিটার দরজা। বাকিটুকুতে কাঁচের দেয়াল। বাইরে থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। দুই পাশে দুটো টেবিল। প্রতিটি টেবিলের সাথে এপাশ- ওপাশ মিলিয়ে চারটি চেয়ার। মাঝখানে সংকীর্ণ জায়গা। দুটো ছেলে ভেতরে দাঁড়ানো। তাদের সামনেই কাঁচের তৈরি উঁচু পাটাতন। বক্স সিস্টেম করা এই জায়গাতে বিভিন্ন খাবার রাখা।একজন ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে, আরেকজন কাঁচের বক্সের এপাশে। তাদের দুইজনের কৌতূহলী নজর বাম দিকের টেবিলে বসা রেহাংশী আর ত্রিনার দিকে। রেহাংশী উসখুস গলায় বলল—

“তোমার ভাইয়া কোথায়?”

ত্রিনা চোখের কোণ সংকীর্ণ করল। থতমত খেয়ে বলল—

“চলে আসবে। আরেকটু অপেক্ষা করো। ”

রেহাংশ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। দেয়াল সেটে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আবার ত্রিনার দিকে তাকাল। ত্রিনার চোরা চাহনি ছেলেটির দিকে। রেহাংশী কণ্ঠে মলিনতা এনে বলল—

“তোমার ভাইয়া কোথায় গেছে? আসছে না কেন এখনো?”

ত্রিনা নরম স্বরে বলল–

“চলে আসবে, চলে আসবে।”

রেহাংশীর অন্তঃকরণে বিষাদ নামলো। চোখের চাহনি নিষ্প্রভ করে বলল—

“মিথ্যে বলেছে তুমি, তাই না? তোমার ভাইয়া আসবে না। কোথায় গেছে সে? কথা বলছ না কেন?”

ত্রিনা ভয়জড়িত সংকীর্ণ কণ্ঠে বলল—

“মিষ্টি বউ, তুমি বসো। ভাইয়া একটু পরই চলে আসবে।”

রেহাংশী ব্যতিব্যস্ত হয়। মস্তিষ্কের স্নায়ুতে জোরালো চাপ ফেলে। ফ্যাকাশে, কাতর আর ক্ষুব্দ চাহনির অন্তরালে বুকের জমাট বাঁধে একরাশ ভয়। গলা খাদে নামে তার। অন্তঃকরণে ব্যথা। চোখের দর্পণ অচিরেই অজ্ঞাত কারণে ভিজে ওঠে।
রেহাংশী শ্বাস ফেলে। কল করে ইনজাদকে। রিসিভ করল না ওপাশের মানব। ভীত হলো রেহাংশী। ঘনঘন শ্বাস ফেলে ভয়াতুর কণ্ঠে বলল—

“কোথায় তোমার ভাই? আসছে না কেন সে? মিথ্যে বলেছ তুমি।”

রেহাংশীর চোখ টলটল করছে। ঝুম বৃষ্টি নামবে বলে। ভীতসন্ত্রস্ত ত্রিনা। ইনজাদ বলেছে, ঠিক সময়ে চলে আসবে সে। ত্রিনার শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে লাগল। মস্তিষ্ক ঝিমঝিম করছে। রেহাংশী চোখের জল ছেড়ে দেয়। ঢোক গিলে ত্রিনা।

আচানক গভীর স্বরে পেছন ফিরে রেহাংশী। ইনজাদ দাঁড়িয়ে আছে। রেহাংশী পল ব্যয় করল না। ছুটে গেল ইনজাদের বুকে। খামচে ধরে শ্বাস ঘন করে বলল—

“কোথায় ছিলেন আপনি? আমার ফোন কেন ধরছিলেন না?”

ইনজাদ পুরো দোকানটায় চোখ বোলাল। দরজার সাথে ঝুলে থাকা ফিতা টান দিতেই কাঁচের দেয়ালে পর্দা নেমে এলো। ইনজাদ আলতো করে হাত রাখল রেহাংশীর পিঠে। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল—

“সবাই দেখছে রেহাংশী।”

রেহাংশীর হুশ ফিরল। ইনজাদকে ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল–

“আপনি ফোন কেন ধরছিলেন না?”

“ফোন সাইলেন্ট ছিল।”

ইনজাদ রেহাংশীর হাত ধরে এগিয়ে যায় সামনে। চেয়ারে বসাল তাকে। নিজেও বসে ত্রিনাকে বলল—

“তোর খাওয়া হয়েছে?”

আনন্দে আত্মহারা ত্রিনা ফুরফুরে গলায় বলল–

“হ্যাঁ,হ্যাঁ। খাওয়া শেষ আমার।”

“তাহলে বাসায় যা।”

“আচ্ছা।”

“যেতে পারবি তো?”

“আরে পারব, পারব। ”

“সাবধানে যাবি। সোজা বাসায় যাবি। কোনো দরকার হলে আমাকে ফোন করিস। আম্মাকে বলবি, আমার আসতে লেট হবে।”

ত্রিনা সরস হেসে বলল–

“আচ্ছা।”

ত্রিনার যাওয়ার পর রেহাংশীর দিকে মনোযোগী হলো ইনজাদ। দুইজন পাশাপাশি বসেছে। রেহাংশীর সামনে খাবার রাখা। কিন্তু তার কৌতূহলী নজর ইনজাদের দিকে। ইনজাদ নরম চোখে চেয়ে বলল—

“খাও, আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি।”

চট করে কিছু না ভেবেই বলে উঠে রেহাংশী—

“আমিও যাব।”

ইনজাদ ঘাড় ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে দুটোকে দেখল। সেখান থেকে চোখ নামিয়ে রেহাংশীর দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে বলল—

“আমি ওয়াশরুমে যাচ্ছি রেহাংশী। অন্য কোথাও না। বসো তুমি।”

রেহাংশী দমে রইল। ইনজাদ যাওয়ার মিনিট খানেক পর একটা বাচ্চা কণ্ঠ শুনতে পেল রেহাংশী। চকিতে তাকাল সে। চোখের পাতা পূর্ণ প্রকাশ করে চেয়ে রইল রেহাংশী। ধীরগতিতে উঠে দাঁড়াল। তার স্থির কায়ায় আচমকা ঝড় সৃষ্টি হলো। দৌড়ে এলো সৌরভ। রেহাংশীকে জড়িয়ে ধরে বলল—

” আপু!”

রেহাংশী শ্বাস ফেলতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে কেউ তার গলা চেপে ধরেছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। তবুও নিজেকে ধাতস্থ রেখে বলল—

“কে তোমার আপু? আমি কারো আপু নই। ছাড়ো আমাকে। ছাড়ো বলছি।”

সৌরভ শক্ত হয়ে রইল। দৃঢ় কণ্ঠে বলল—

“না, ছাড়ব না। তুমি আমার আপু। আমি সব শুনেছি। সিস আমাকে সব বলেছ। তুমিও আমার আপু।”

রেহাংশী উত্তেজিত হলো। দাপিয়ে উঠে বলল—

“বললাম তো আমি কারো আপু নই। ছাড়ো আমাকে।”

রেহাংশী সৌরভের হাত জোরপূর্বক সরিয়ে এনে তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। তৎক্ষণাৎ ভেতরে ঢুকে জিবরান খন্দকার। সৌরভকে দাড় করিয়ে রেহাংশীর দিকে তাকায়। রাগে কাঁপছে রেহাংশী। তার চোখ-মুখের রঙ বদলে গেছে। শীতল নদীর ঢেউ আচমকা উত্তাল হয়ে উঠল। জিবরান খন্দকার আঁখুটে গলায় বললেন–

“বাবাকে মাফ করবি না?”

রেহাংশী ফুঁসলে উঠে বলল–

“কেন এসেছেন আপনি? কেন এসেছেন? চলে যান, চলে যান এখান থেকে।”

সৌরভের চোখ আর্দ্র হয়। জমাট গলায় বলল—

“আপু ড্যাডকে ক্ষমা করে দাও। প্লিজ, ফরগিভ হিম। প্লিজ। আই বেগ ইউ। হি লাভস ইউ ভেরি মাচ। প্লিজ আপু।”

“না, কোনোদিনও না। আমি কাউকে ক্ষমা করব না। চলে যাও তোমরা। কাউকে চাই না আমার, কাউকে না।”

রেহাংশী কঠিন হয়ে রইল। সামনের ছেলে দুটোর দিকে তাকিয়ে বলল—-

“আপনারা আমার স্বামীকে ডাকুন, দয়া করে তাকে ডাকুন। আপনাদের ওয়াশরুম কোথায়?”

ছেলে দুটো হতবুদ্ধি হয়ে একে অপরের দিকে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকাতে লাগল। ইনজাদ প্রবেশ করতেই তার বুকের ওপর ভেঙ্গে পড়ে রেহাংশী। রোদন ঝরা কণ্ঠে বলল—

“এদেরকে চলে যেতে বলুন। আমি এদের ছায়াও দেখতে চাই না। কাউকে চাই না আমার। কোনো বাবা নেই আমার। এই লোকটা আমার মায়ের খুনি। আমি কখনো মাফ করব না এই লোকটাকে।”

সৌরভ ভ্যা ভ্যা করে কান্না শুরু করে। জিবরান খন্দকার মর্মাহত গলায় বললেন—

“রেহাংশী! মা আমার! একবার….।”

“প্লিজ স্যার, প্লিজ। যান আপনি।”

সৌরভ তার বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকল। জিবরান খন্দকার ছেলের মাথা বুকে চেপে ধরে নীরবে বেরিয়ে গেলেন সেখান থেকে। ইনজাদ রেহাংশীর মাথায় হাত রেখে বলল—

“শান্ত হও রেহাংশী। চলে গেছেন তারা। চলো।”

রেহাংশীকে নিয়ে ফাস্টফুডের দোকান থেকে বেরিয়ে আসে ইনজাদ। শপিংমলের বাইরে এসে একটা ট্যাক্সিতে রেহাংশীকে বসিয়ে আবার ফাস্টফুডের দোকানে ফিরে আসে সে। ছেলে দুটোকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলল—-

“ধন্যবাদ। আর সরি। আমি ভাবিনি ও এতটা রিয়েক্ট করে ফেলবে।”

“ইটস ওকে স্যার।”

ইনজাদ তাদেরকে তাদের ন্যায্য মূল্য পরিশোধ করে। পুরো দোকানটা ঘণ্টা খানেকের জন্য রিজার্ভ করেছিল সে।

জিবরান খন্দকার আহত চোখে চেয়ে আছেন। সৌরভের বাচ্চা দুই চোখ কেঁদে কেঁদে অস্থির। ইনজাদ গাঢ় স্বরে বলল—

” এর চেয়ে বেশি কিছু আমি করতে পারব না। দেখলেন তো কীভাবে রিয়েক্ট করে! সময় দিন ওকে। সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। প্লিজ!”

জিবরান খন্দকার কথা বললেন না। শুধু চোখের জল ফেললেন।
,
,
,

বিছানায় বসল রেহাংশী। পা দুটো একসাথে চেপে ধরল। তার সুডোল পায়ের পাতা মেঝে ছুঁইয়ে আছে। মাত্রই সাইক্রিয়াটিস্ট রোমেলার কাছ থেকে ফিরেছে তারা। ঘর্মাক্ত শার্ট গা থেকে খুলছে ইনজাদ। রেহাংশী নিষ্প্রাণ চোখে চেয়ে বলল—

“আমাকে আপনার পাগল মনে হয় তাই না?”

ইনজাদ কঠোর গলায় বলল–

“সাইক্রিয়াটিস্ট পাগলের ডাক্তার নয়।”

ইনজাদ ওয়াশরুমে ঢুকল। রেহাংশী পা তুলল বিছানায়। হেডবোর্ডের সাথে হেলান দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। রেহাংশী বিড়বিড় করতে লাগল,” আমি পাগল। আমি সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছি। আপনার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছি। এই পাগলিটাকে ভালোবাসতে পারবেন পরদেশী?”
,
,
,
টিমটিমে নরম আলোর আচ্ছাদন। নিশীথের মধ্য প্রহর। ঘুমে আচ্ছন্ন সবাই। কিন্তু রেহাংশীর চোখের ঘুম উবে গেছে। আজকাল তার ঘুম হয় না। দিনটা ভালো কাটলেও, রাত কাটে বিষণ্ণ, বিমর্ষ, তন্দ্রাহীন। ইনজাদের ফ্ল্যাটে দুটো বেডরুম। একটাতে তার মামা আর বাবা থাকেন। ইনজাদ আর রেহাংশীর কক্ষে তার মা, মামি, রেহাংশী আর ত্রিনা। তমালিকা আর সুরমা বিছানায় থাকেন। মেঝেতে পাটি বিছিয়ে তার ওপর ম্যাট্রেস রেখে ঘুমায় রেহাংশী আর ত্রিনা। ইনজাদ ড্রয়িংরুমে কাউচে থাকে।

ইনজাদের সংস্পর্শ বিহীন রাতগুলো কাটতে চায় না রেহাংশীর। দিনভর চোখের দর্পণে যার প্রতি প্রতিচ্ছবি এঁকে বেড়ায়, রাত হতেই সে অস্পষ্ট হয়ে যায়। সইতে পারে না সে। সারারাত তরপাতে থাকে। নিচ্ছিদ্র বিষক্রিয়ায় তার অঙ্গ লীন হতে থাকে।
ত্রিনা জড়িয়ে ধরে রেখেছে রেহাংশীকে। চোখ জ্বলছে রেহাংশীর। ত্রিনার হাতটা বুকের ওপর থেকে সরিয়ে উঠে বসে সে। ঘুমন্ত শাশুড়ি আর ত্রিনার মুখের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ধীরপায়ে বেরিয়ে আসে কক্ষ থেকে। রেহাংশী চকিত হয়। পুটপুট করে কারো কথার স্বর শুনতে পাচ্ছে সে। ব্যস্ত হাতে ড্রয়িংরুমের লাইট জ্বালাতে দেখে ইনজাদ জেগে আছে। এক পা কাউচের হেডবোর্ডে উঠিয়ে কারো সাথে মোবাইলে কথা বলছে সে। রেহাংশীকে দেখেই বিব্রত হলো। কল কেটে উঠে দাঁড়িয়ে বলল—

“তুমি এখানে? ঘুমাওনি?”

রেহাংশী দপদপিয়ে উঠে বলল—

“কার সাথে কথা বলছিলেন আপনি?”

ইনজাদ চমকে উঠে বলল—

“কী বলছ এসব?”

“বুঝতে পারছেন না? এত রাতে কার সাথে কথা বলছিলেন আপনি?”

“রেহাংশী! বিহেভ ইউর সেল্ফ।”

রেহাংশীর উচ্চ কণ্ঠে ঘুমন্ত জনতারা জেগে ওঠে। দুই কক্ষের পাঁচজন লোক ছুটে আসে ড্রয়িংরুমে। ইনজাদের মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে এলো। সে উদ্ভাসিত চোখে চেয়ে রইল। তমালিকা ঘুমো ঘুমো চোখে প্রশ্ন ছুড়লেন—

“কী হয়েছে?”

রেহাংশী দাপিয়ে উঠে বলল—

“আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করুন।”

দাঁত কিড়মিড় করে ইনজাদ। তমালিকা আর সুরমা রেহাংশীকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। ইনজাদকে কথা বলতে নিষেধ করলেন পারভেজ মির্জা। ইনজাদ চুপ করে রইল। রেহাংশী থামল না। চূড়ান্ত উগ্রতা দেখিয়ে বলল–

“এই জন্য আমাকে পাগল সাজাতে চান তাই না? যেন আমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারেন! ওই সিন্ধুজার সাথে কথা বলছিলেন তাই না? আপনার কী মনে হয় আমি কিছু বুঝি না?”

তমালিকা কী করবেন ভেবে পেলেন না। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কী করা উচিত তা ভাবতে সময় নিলেন সকলে। সহসা রেহাংশীর হাত ধরে তাকে কক্ষের ভেতরে নিয়ে গেল ইনজাদ। ভেতরে দিকে ছুড়ে ফেলেই দরজা লাগিয়ে দিলো। বাইরে থেকে আঁতকে উঠল সকলে।

ইনজাদ ঝলসানো চোখে চেয়ে রইল। রেহাংশীর নিশ্চল চাহনি। ইনজাদ কল ব্যাক করে রেহাংশীর কানে ধরল। ওপাশ থেকে মেহমাদ বলে উঠল—

“শালা ঘুমাতে দিবি না আমাকে? বলেছি তো সকালে দেখা করব।”

জ্বলন্ত আগুনের কুন্ডলি দপ করে নিভে গেল। রেহাংশী ঘনঘন শ্বাস ফেলতে লাগল। তার বুক উঠানামা করতে লাগল বেগতিক হারে। ইনজাদ বজ্রকঠোর কণ্ঠে বলল—

“আর কী চাও তুমি? আর কী চাও আমার কাছে? কেন করছ এসব তুমি?”

রেহাংশী তীক্ষ্ম স্বরে বলল—

“আপনি এই শহর কেন ছাড়ছেন না? কেন যেতে চাইছেন না? সিন্ধুজার জন্য?”

ঝপাৎ করে রেহাংশীর গালে চড় বসাল ইনজাদ। ছিটকে পড়ল রেহাংশী। ভরা যমুনা নিয়ে তাকাল ইনজাদের দিকে। ইনজাদ খলবলিয়ে বলল—

“তোমার চিন্তাধারা এতটা জঘন্য আমি কখনো ভাবতেও পারিনি! এত কিছু করার পরও তোমার বিশ্বাস নেই আমার ওপর? এই তোমার ভালোবাসা?”

রেহাংশী মেঝেতে বসে রইল। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ইনজাদ ফুঁসে উঠে বলল—

“তোমাকে ভালোবাসাই আমার ভুল হয়েছে। তারচেয়ে বড়ো ভুল তোমাকে বিয়ে করে। সব ছেড়ে দিয়েছি তোমার জন্য আমি। তবুও সন্দেহ, সন্দেহ, সন্দেহ! কেন রেহাংশী?
আমার ভালোবাসা আমার দূর্বলতা? আমার আম্মা- বাবা কত কষ্ট করেছেন আমার জন্য, কত টাকা খরচ করেছেন আমার পেছনে। কিন্তু আমি কী করেছি তাদের জন্য? কিচ্ছু না। কিচ্ছু করতে পারিনি। কেন তুমি আমাকে সুযোগ দিচ্ছ না? জব তো ছেড়ে দিয়েছি। তাদের সাথে যোগাযোগ করাও। তবুও এত সন্দেহ! কেন রেহাংশী? কীসের জন্য? কী খামতি রেখেছি আমার ভালোবাসায়?
আসলে তুমি আমাকে কখনো ভালোই বাসোনি। আমি তোমার মোহ ছাড়া আর কিছুই নই। এক মোহঘোরে পরিচয় আমাদের। আর তার খেসারত দিয়ে যাচ্ছি আমি।”

রেহাংশী বাকশূন্য। তার অরব চোখের নীরব কান্নারা ঝরছে নিরবধি। দরজার পাটাতনে সমানে চামড় মেরে যাচ্ছে বাইরে দাঁড়ানো উৎসুক, কৌতূহলী, ভীত মানুষগুলো। ইনজাদ দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে। সকলের বিস্মিত চাহনি। ধপ করে কাউচে বসল সে। আর্ত গলায় বলল—

“আমার ভালোবাসা ওর সন্দেহের কাছে হেরে গেছে আম্মা। ও আমাকে বিশ্বাস করে না। ও কী করে ভাবল এসব? সব ছেড়ে দিয়েছি ওর জন্য আমি। তবুও..।”

তমালিকা ইনজাদের পাশে এসে বসলেন। কাঁধে হাত রেখে বললেন—

“এমন বলিস না। মেয়েটার মাথা ঠিক নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

ত্রিমুল আশ্বাস দিয়ে বললেন—

“আপা ঠিক বলছে ইনজাদ। রেহাংশীকে একটু সময় দে। মেয়েটা অনেক সহ্য করেছে।”

সুরমা মিহি কণ্ঠে বললেন—-

“তোমার মামা ঠিক কথা বলছেন। আমরা বরং ওকে গ্রামে নিয়ে যাই। তুমিও চলো। কিছুদিন ওখানে থাকলে ওর ভালো লাগবে।”

ইনজাদ আশার চোখে পারভেজ মির্জার দিকে তাকাল। তিনি ইশারায় সম্মতি দিলেন । মৌনতার ঘনঘটায় চলে গেল অনেকটা সময়। রেহাংশী কক্ষের বাইরে এলো না। ত্রিনা গুটিগুটি পায়ে ইনজাদের কক্ষে গিয়ে ঢুকল। দৈবাৎ চিৎকার করে উঠে ত্রিনা।

“ভাইয়া! আব্বু! জলদি এসো।”

ত্রিনার কণ্ঠে মৌনতার চাদর ফেড়ে সপ্রতিভ হয় সকলে। চপল পাঁচ জোড়া পা তাদের গতি বাড়ালো অচিরেই।
হতভম্ব সবাই! চোখের কোটর থেকে চোখ বেরিয়ে আসবে যেন! শোণিতে মাখোমাখো রেহাংশী। মেঝেতে বসে বিছানার সাথে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে। ইনজাদের দুনিয়া থমকে গেল। তূরন্ত বেগে গিয়ে রেহাংশীর মাথা বাম হাতে তুলে নিল। তমালিকা আর্তনাদ করে উঠলেন। থরথর করে কাঁপতে লাগল তার দেহ। সুরমা মুখে হাত চাপা দিয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলেন। পারভেজ মির্জা আর ত্রিমুল নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তারা ভাবছেন, সব মিথ্যে হয়ে যাক। ইনজাদ পাগলের মতো আওড়াতে লাগল।

“ওঠো, রেহাংশী! কথা বলো। সরি বিষবাণ। রাগ করো না । কথা বলো। কথা বলো।”

রেহাংশীর শান্ত দেহ পড়ে রইল। হাতের শিরা থেকে আঠালো তরলে সয়লাব সফেদ মেঝে। সেই রক্তিম শোণিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে ঔষধের খালি পাতা। জ্বর, ঠান্ডা, গ্যাস্টিকসহ বিভিন্ন রোগের ট্যাবলেটের খালি পাতা। বুক কেঁপে উঠল ইনজাদের। অভিমান! অভিমান করেছে তার বিষবাণ। এই যে মৃত্যুবাণ। নিঃশেষ করে দিচ্ছে পরদেশীর প্রানের শ্বাস। বিছানার ওপর পড়ে থাকা কাগজটা হাতে তুলে নিল ত্রিনা। ইনজাদের হাতে দিতে চোখের পল্লব প্রশস্ত করে সে। তাতে লেখা–

‘পরদেশী’
আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি। হয়তো কখনো আপনাকে বলতে পারিনি। অপারগতা নয়, আপনাকে হারানোর ভয়! আমারও মাও তার স্বামীকে ভীষণ ভালোবাসত। তার পরিণতি আমাকে পাথর বানিয়ে দিয়েছে। জন্মদাতার প্রতি আমার বিতৃষ্ণা, কখনো কোনো পুরুষকে নিয়ে আমায় ভাবতে দেয়নি। কিন্তু জানি না কী হলো! আপনাকে আমি ভালোবেসে ফেললাম। কেন এমন হলো পরদেশী? কেন?

আমি কখনো আপনার কষ্টের কারণ হতে চাইনি। বিশ্বাস করুন, যদি আমার প্রাণটা আমার কাছে চেয়ে নেন, আমি আপত্তি করব না। কিন্তু আপনাকে কারোও সাথে ভাগ করে নেওয়ার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারব না। যদি আমার শ্বাস চলে তাহলে আপনি আমার। আর যদি এই নিঃশ্বাস ফুরিয়ে যায়, আমি আপনাকে মুক্ত করে দিলাম।

নিজেকে অনেক বোঝাতে চেয়েছি। কিন্তু পারছি না। আমি জানি আপনার কষ্ট হচ্ছে। হয়তো আপনার জায়গায় জিবরান খন্দকার, কিংবা রতনের মতো কেউ হলে আমায় কবেই ফেলে চলে যেত! কিন্তু আপনি এখনো আমাকে শেকড়ের মতো আঁকড়ে রেখেছেন। এত ভালো না বাসলেও পারতেন পরদেশী। তাহলে এত কষ্ট পেতে হতো না আপনাকে। আমি সত্যিই নিরুপায়!

জীবনের পূর্ণতার খাতায় আপনি ছাড়া আমার কেউ নেই। সেই আপনাকে আমি হারাতে পারব না। আমার জন্য আপনি সব ছেড়ে দিয়েছেন। বিনিময়ে আমি আপনাকে কী দিয়েছি? শুধু সন্দেহ!
আমি কী করব বলতে পারেন? নিজেকে অনেক বোঝাতে চেয়েছি। কিন্তু ব্যর্থ আমি। আর পারছি না আমি। অতীত আমাকে ভাবতে দিচ্ছে না পরদেশী। আমার সুখের জন্য আমি আপনার সুখ কেড়ে নিচ্ছি। আর স্বার্থপর হবো না আমি।

আপনি বলেছিলেন, পরদেশী না হয় পর-ই থাকুক। আপনি সত্যিই আমার পর হয়ে গেলেন। মুক্তি দিয়ে গেলাম আমি আপনাকে। এই ‘মোহঘোর’ থেকে মুক্তি। ভালো থাকবেন পরদেশী। আপনি ভালো থাকুন। আপনার ভালোবাসা নিয়েই আমি চললাম। আপনার ঘৃণা নিয়ে আমি বাঁচতে পারব না।

“আপনার বিষবান”

থরথর করে কাঁপতে লাগল ইনজাদের ডানহাত। চোখের পল্লবের অস্থিরতা বুক কাঁপিয়ে তুলছে তার। কাগজের টুকরোটা ছুড়ে ফেলল দূরে
বিধুর গলায় বলল—

“রেহাংশী! রেহাংশী! কথা বলো, প্লিজ। আমি ভুল করে ফেলেছি। প্লিজ ওঠো।”

রেহাংশীর শিথিল দেহ পড়ে রইল ইনজাদের বাম হাতের ডোরে। তার চোখের পল্লব সিক্ত। সয়লাব হলো নেত্র কোটর। থৈ থৈ জলের বান। রুদ্ধশ্বাসে চেয়ে আছেন তমালিকা। মেয়েটা কী করল?
ত্রিনার ঠোঁট কাঁপছে। একটু আগেই আগুনের ফুলকির মতো জ্বলে উঠা মেয়েটা কেমন শীতল হয়ে গেল! পারভেজ মির্জা হতভম্ব হয়ে গেলেন। ওষ্ঠাগত কথারা অধর ফাঁক করে বের হতে পারছে না। ত্রিমুল আর সুরমার বিস্ফোরিত চাহনি।

ইনজাদ গাল চেপে ধরল রেহাংশীর। জোর হাতে চাপ দিয়ে বলল—

” এই, এই মেয়ে ওঠো, ওঠো রেহাংশী। প্লিজ চুপ করে থেকো না। এমন করলে কেন তুমি? ওঠো না প্লিজ।”

ইনজাদ ঝাপসা চোখে তার মায়ের দিকে তাকাল। আকুল আবেদন করে বলল—

“আম্মা, আম্মা! বলেন না ওকে উঠতে। ও কথা বলছে না কেন আম্মা? আম্মা বলেন না ওকে কথা বলতে। আমি আর কখনো ওর সাথে রাগ করব না আম্মা, ওর গায়ে হাত তুলব না। আম্মা বলেন না। ও তো আপনার কথা শোনে। বলেন না আম্মা।”

ইনজাদের পাগল প্রায় অবস্থা। চারদিকে তাকাতে লাগল। ত্রিনার দিকে তাকিয়ে বলল—

“এই ত্রিনা, বলনা তোর মিষ্টি বউকে উঠতে। ও কথা বলছে না কেন বলতো? এত রাগ করলে হয়! বলনারে কথা বলতে। এই রেহাংশী! কথা বলো প্লিজ, কথা বলো নারে।
মামা, বলো না ওকে কথা বলতে। আরে তোমরা কেউ ওকে কিছু বলছ না কেন?”

ইনজাদ বুঝতে পারছে না কী করবে। চোখের জলের স্ফীত প্রস্রবণে সে কিছুই দেখতে পারছে না। খপ করে সুরমার হাত ধরে উদ্ভ্রান্তের মতো বলল—

“মামি, ও মামি! বলোনা ওকে উঠতে! ওর এত রাগ কেন মামি? তুমি তো জানো আমি খারাপ নই। একবার একটা প্রশ্ন করেছিলাম বলে, আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। মামি, আমি ওকে ভালোবাসি। বিশ্বাস করো। ওই কয়েকটা দিন আমি ঘুমাতে পারিনি। এই মেয়েটা আমাকে বুঝলই না। ওর জেদের কারণে আমি সব ছেড়ে দিয়েছি। তবুও মেয়েটা আমাকে বিশ্বাস করল না। ও বোঝে না কেন, ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না? কেন বোঝে না ও?”

ইনজাদ থামল। ভেজা চোখে চাইল রেহাংশীর রক্তশূন্য মুখে। নিমীলিত চোখে অধর ছুঁইয়ে বলল–

“ওঠো বিষবাণ! কথা দিচ্ছি। সব ছেড়ে দেবো আমি। চলে যাব তোমাকে নিয়ে এ শহর ছেড়ে। একটু বিশ্বাস করো আমায়। এই তোমাকে ছুঁয়ে বলছি। ওঠো না, প্লিজ!”

ইনজাদের চোখের পানি রেহাংশীর ওষ্ঠাধর গলিয়ে ভেতরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু….।”

তমালিকা মাথা চাপড়াতে লাগলেন। কী হলো এসব! কেন হলো? ত্রিনা চেপে ধরল তমালিকার মাথা। সুরমা ইনজাদের পিঠে হাত বোলাতে লাগল। চিৎকার করে বলল—

“আরে আপনার চুপ করে আছেন কেন? ফোন করেন অ্যাম্বুলেন্সকে। ইনজাদ রুদ্ধশ্বাসে বলল—

“বাবা, দেখোনা কী করেছে ও? আমি হেরে গেলাম বাবা। তুমি ওকে দেখে রাখতে বলেছিলে আমায়। আমি পারিনি । জীবনে প্রথমবারের মতো তোমার ছেলে হেরে গেল বাবা। আমার ভালোবাসা হেরে গেল বাবা, হেরে গেল!”

ইনজাদ বুকে জড়িয়ে নেয় রেহাংশীকে। আজ কেন সে শুনতে পাচ্ছে না তার বিষবানের হৃৎস্পন্দন? কেন থমকে যাচ্ছে পৃথিবী? ত্রিমুল দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন। কল করলেন অ্যাম্বুলেন্সকে। পারভেজ মির্জা দাঁড়ালেন। অনুভূতিশূন্য দৃষ্টি তার। চোখের পানিতে কপোল ভিজে যাচ্ছে। ছেলের পাগলামো তাকে পাথর বানিয়ে দিয়েছে। ছেলের আর্তনাদ তাকে স্থবির করে দিয়েছে। তিনি নির্লিপ্ত স্বরে বলে উঠলেন—

” ও বাঁচবে তো ত্রিমুল? রক্তের দরিয়া বইয়ে দিয়েছে। মেয়েটা আমার ছেলের কথা একবারো ভাবল না? আমার ছেলেটাকে জীবন্ত মেরে ফেলল! ওর মোহঘোর আমার ছেলের জীবন কেড়ে নিল। তাকিয়ে দ্যাখ, প্রাণ থেকেও আমার ইনজাদ মৃত!”

ত্রিমুল তার চঞ্চল, চপল, আকুল চোখ জোড়া নিবদ্ধ করল ইনজাদের দিকে। রেহাংশীকে দুই হাতে বুকে জড়িয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে ইনজাদ। ইনজাদের পায়ের গোড়ালি রক্তস্নান করেছে। জাগতিক কোনো মোহ নেই তার। চোখের ধারা নামছে শ্লথ গতিতে। ইনজাদের চোখ জ্বলে যাচ্ছে। তবুও সে অনিমেষ চেয়ে আছে শূন্যে!

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here