#ডাহুক_নদীর_তীরে,পর্ব-১০,১১
#হালিমা রহমান
১০
দূরে কোথাও একটা কুকুর উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলো।রাতের নিস্তব্ধতাকে একদম চিড়ে ফালা ফালা করে ফেললো হতচ্ছাড়া প্রাণীটা।এক মুহূর্তের জন্য সোনালীর সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে।মনের কোনে জমে তীব্র ভয়।কোনো বিপদ আসতে চললো নাকি?সোনালী দু’ বার আল্লাহর নাম জপে।এই যাত্রায় বেঁচে ফিরতে পারলে এসব কাজ ছেড়ে দিবে–এই প্রতিজ্ঞাও করে মনে মনে।
_” মিস সোনালী, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?”
ফোনের কথা ভুলেই গিয়েছিল সোনালী।ডিপার্টমেন্ট হেডের কথা শুনে দাঁতে জ্বীভ কাটে।ব্যস্ত সুরে বলেঃ” ইয়েস স্যার,শুনতে পারছি।”
_” গিভ মি ইয়োর কোড নম্বর।”
_” এস.এম.জি.ফোর।”
_” ওখানের কী অবস্থা?”
_”এখন অবধি ভালো স্যার।কিন্তু কতক্ষণ এরকম অবস্থা থাকবে তা বলতে পারছি না।”
_” মুখোমুখি হয়েছেন?”
_” জ্বি স্যার।”
_” কেমন লাগলো?”
_” আহমেদ ইউসুফ খুব আকর্ষণীয় একজন পুরুষ।খুব বেশি কথা বলে না বোধহয়।তবে একটা জিনিস আমার চোখে পড়েছে স্যার।”
_” কি?”
_” এখানে একটা মেয়ে আছে।তথা নাম।ওর দিকে ইউসুফ কিভাবে যেন তাকায়।তথার দিকে তাকানোর সময় ওর চোখের দৃষ্টি বদলে যায়।আমার মনে হয়,তথা আহমেদ ইউসুফের পছন্দের একজন মানুষ।”
_” দুজনের দিকেই নজর রাখো।আহমেদ ইউসুফের অতীত ইতিহাস ভুলে যেওয়া না। আরেকটা কথা মনে রেখো, তোমরা সবাই কিন্তু বিপদে আছো।এক পা এদিক-ওদিক করো না।”
_” একটা কথা বলব, স্যার?”
_” বলো।”
_ ” এতো ঝামেলা করার কি দরকার,স্যার? এরচেয়ে বন্দুকের ছয়টা বুলেট ওই হারামজাদার পেটে ভরে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়।ওর মতো শয়তানের বাচ্চা পৃথিবীতে না থাকলে কি হবে?”
_” মিস সোনালী, স্ল্যাং ইউজ করবেন না।এজন্য আপনার শাস্তি হতে পারে।দূরে আছেন বলে ভাববেন না আপনি নিয়ন্ত্রণহীন।”
থতমত খায় সোনালী।মেয়েটার এই এক দোষ। কথার আগে মুখ দিয়ে গালি বেরিয়ে যায়।সোনালী নিচু স্বরে বলেঃ” সরি স্যার। তবে আমার বুদ্ধিটা কিন্তু মন্দ নয়। ”
_” আহমেদ ইউসুফের অপরাধের প্রমাণ নেই। প্রমাণ থাকলে অনেক আগেই তাকে ধরতাম আমরা। প্রমাণ জোগাড় করতেই আপনি সেখানে গেছেন।তাছাড়া, ওর হাত অনেক লম্বা।প্রমাণ ছাড়া একরাতও রাখা যাবে না।তাহলে বুঝতেই পারছেন,প্রমাণ হাতে না আসা পর্যন্ত আমরা কিছুই করতে পারব না।”
_” বুঝতে পারছি স্যার।”
_ ” নজর রাখুন ওর উপর।বিন্দু পরিমাণ প্রমাণ মিললেই,টিম বি তাদের কাজ শুরু করে দেবে।আপনিও ঢাকা ফিরতে পারবেন।তবে একটা কথা মাথায় রাখবেন,আহমেদ ইউসুফ যেকোনো সময় দেশ ছাড়তে পারে।দেশ ছাড়লে আমরা আর কিছুই করতে পারব না।তাই দেশে থাকতেই যা করার করতে হবে।”
_” আমাদের হাতে বোধহয় এখনো একমাস সময় আছে স্যার।”
_” বলা যায় না।সব কাজে ইউসুফ উপস্থিত থাকে না।সাবধানে থাকবেন মিস সোনালী। আশা করছি সফলতার সাথে কাজ শেষ করার পর আবার আপনার সাথে দেখা হবে।”
_” ইনশা….”
আর কথা বলতে পারে না সোনালী।তাড়াতাড়ি লাইন কেটে ফোনের আলো বন্ধ করে।ঘামে মেয়েটার পরনের শার্টটা ভিজে গেছে।একে গুমোট আবহাওয়া তার উপর ভয়।সোনালীর অবস্থা পুরো নাজেহাল।সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে।হৃৎপিণ্ডের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে সোনালী আল্লাহকে ডাকে।পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা অশ্বত্থ ও কৃষ্ণচূড়া গাছের পিছনে নিজেকে আরেকটু গুটিয়ে নেয়।কোনোক্রমেই এখন সে ধরা পড়তে চায় না।
জমিদার বাড়ির পাকা রাস্তাটুকুতে দুই জোড়া জুতোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।মসৃণ পথে বিশ্রি শব্দ তুলে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ইউসুফ ও মামুন।সোনালী ঘাড়টাকে একটু নিচু করে বাড়ির লোহার গেটের দিকে তাকায়।গেটটা এখনো তালা দেওয়া।এরা গেট দিয়ে আসেনি।বাড়ির ভিতরের কোনো এক জায়গা থেকে এসেছে।সোনালী যখন বাইরে এসেছে তখন এরা কেউ বাড়িতে ছিল না-এটা নিশ্চিত।তবে কি এবাড়িতে কোনো গুপ্তকক্ষ আছে?অথবা টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করা হতো এমন কোনো ঘর আছে?প্রাচীন আমলের বাড়িতে এসব টর্চার সেল থাকাই স্বাভাবিক।আগের দিনের রাজা-বাদশাহ-জমিদারেরা অপকর্ম করার জন্য হরহামেশাই এসব তৈরি করতো। তাছাড়া, আহমেদ বংশের জন্য এসব স্বাভাবিক বিষয়। জমিদার আহমেদ জুলফিকার যেদিন জমিদার হয়েছিলেন,সেদিন নাকি ভোরবেলাতেই এক কৃষককে একশ চাবুক মেরে আধমরা করে ফেলেছিলেন।দরিদ্র কৃষকের অপরাধ ছিল অতি সামান্য। সকালবেলা ক্ষেতে যাওয়ার সময় তারসাথে জমিদারের দেখা।দরিদ্র-বৃদ্ধ কৃষক জমিদারকে চিনতে পারেননি। তাই রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঝুকিয়ে কুর্নিশ না করে বৃদ্ধ তাড়াহুড়ো করে ক্ষেতে চলে যাচ্ছিলেন।এটাই চোখে লাগে জমিদারকে।বৃদ্ধের এতোবড় দুঃসাহস দমিয়েছেন চাবুক দিয়ে। এতো গেল একদিনের কথা।তার সময়ে এদিকের মানুষের অবস্থা ছিল সবচেয়ে শোচনীয়।আবার মুক্তিযুদ্ধের সময়েও এই আহমেদ জুলফিকার ছিলেন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। বৃদ্ধ বয়সেও মানুষকে শান্তিতে থাকতে দেননি।প্রায় প্রতিদিন এখানে নারকীয় অত্যাচার চলতো।এ গ্রামের বহু বীর সন্তানের রক্ত মিশে আছে এ বাড়ির মাটিতে।এরকম একটা বাড়িতে টর্চার সেল বা পাতাল ঘর থাকাটা স্বাভাবিক।ইউসুফ ও মামুন কি সেখানেই ছিল নাকি অন্যকোথাও ছিল?নাকি এরা বাড়ির পিছনে জঙ্গলে ছিল।এতো এতো চিন্তার ভার নিতে পারে না সোনালী।একটুখানি মাথা তুলে কেবল ইউসুফ ও মামুনের দিকে তাকিয়ে থাকে।ডানহাত জিন্সের পকেটের ভিতর ঢুকিয়ে রিভলবারটাকে শক্ত করে চেপে ধরে।কোনোভাবে ধরা পড়লেই গুলি চালিয়ে দেবে।অকারণে এদের হাতে মরবে কেন?
পাকা রাস্তাটুকুতে পা না থামলেও, বাড়ির কাঠের দরজার সামনে এসে পা থেমে যায় ইউসুফের। ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থাকে বিশাল দরজার দিকে।ইউসুফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মামুনও দাঁড়িয়ে যায়।বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করেঃ” ঘরে যাবেন না স্যার?”
_” দরজাটা খোলা কেন, মামুন?তুমি কি এই দরজা দিয়ে বেড়িয়েছিলে?”
_” না স্যার।আমি তো পিছনের দরজাটা ব্যবহার করেছিলাম”
_” তাহলে এটা কে খুললো?”— কথা বলতে বলতেই চারদিকে চোখ বুলায় ইউসুফ।অনেক অন্ধকার দেখে মোবাইলের আলো জ্বেলে নেয়।আলো ঘুড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখে।কিন্তু কোনোকিছুই নজরে আসে না তার।মামুন আশ্বস্তের সুরে বলেঃ” কেউ নেই স্যার। আমিই বোধহয় ভুলে দরজাটা লাগাইনি।অকারণে চিন্তা করছেন আপনি।”
_”এই ভুলটা আর কখনো করবে না।রাত নামার সাথে সাথেই দরজা আটকে দেবে।মনে রাখবে এখানে কিন্তু কোনো গার্ড নেই।বিপদ কোনদিক দিয়ে আসে তা বলা যায় না।আগে থেকেই সতর্ক হতে শিখো।”— শেষদিকে খানিক কঠিন শোনায় ইউসুফের কন্ঠ।মামুন ইউসুফের কথার শেষে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়। ইউসুফকে প্রবেশ করার জন্য দরজা খুলে দেয়।ইউসুফের পিছে পিছে সেও ঢুকে।ইউসুফের সামনে খুব নির্বিকার আচরণ করলেও ঘটনাটা খুব ভাবাচ্ছে মামুনকে।কাহিনিটা কি হলো?মামুন তো দশটার দিকেই দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়েছিল।নাকি দেয়নি?বিভ্রান্ত হয়ে যায় মামুন। কপাল কুঁচকে দরজার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে।ঘন্টাখানেক আগে দরজা লাগিয়েছিল না লাগায়নি তা মনে করতে পারে না।
_” মামুন, ডিরেক্টরের দিকে নজর রেখো তো।একপাল শক্তিমান ছেলে নিয়ে এখানে শুটিং করতে এসেছে।আহাম্মক কোথাকার।”
_” ওকে স্যার।”
ইউসুফ উপরে চলে গেলে মামুনও দরজা আঁটকে দেয়।তবে মাথা থেকে বিভ্রান্তিটুকু ঝেড়ে ফেলতে পারে না।কাল থেকে ভালোভাবে নজর রাখতে হবে।এ বাড়িতে কয়েকটা সিসি ক্যামেরা আছে।কিন্তু জিনিসগুলো নষ্ট।একা থাকতো বলেই কখনো সিসি ক্যামেরার দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি।তাই একবার নষ্ট হওয়ার পর আর নতুন করে লাগানো হয়নি।বিরাট ভুল হয়ে গেছে।ভবিষ্যতের চিন্তা মাথায় রাখা উচিৎ ছিল।তবে ভুলের জন্য খুব বেশি অনুতপ্ত হয় না মামুন।বিকল্প খুঁজে নেয় মুহূর্তেই।কালকে থেকে সবার উপর নজর রাখবে।কারো উল্টো-পাল্টা কাজ-কর্ম চোখে পড়লেই কট করে ধরে ফেলবে।এই ভেবে নিচ তলায় তার জন্য বরাদ্দ ঘরে চলে যায়।মামুন নামের ছেলেটা আহমেদ ইউসুফের যোগ্য শিষ্য বটে।
হাত-পা-মেরুদন্ড-ঘাড় সব একসাথে গুটিয়ে বসে ছিল সোনালী।বাড়ির দরজা বন্ধ হতেই হাত-পা ছড়িয়ে মাটিতে লেপ্টে বসে পড়ে সে।এতোক্ষণের আটকে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়ে।হাঁপড়ের মতো উঠা-নামা করে তার বুক।আকাশের দিকে তাকিয়ে লম্বা দম নেয়।বাম হাতের উল্টোপিঠে ঠোঁটের উপর জমে থাকা ঘামগুলো মুছে নেয়।তারপর পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছে নেয় সারা মুখ,গলা,ঘাড়। বেশ কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় সোনালী।বাড়ির সব আলো নিভে গেছে।আশপাশটা পুরো ভূতের বাড়ির মতো লাগছে। মনে হচ্ছে যেন,পথ ভুলে ভুল করে সোনালী মানুষের রাজ্য ছেড়ে ভূতের রাজ্যে চলে এসেছে।এখনই ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করবে,নুপুরের আওয়াজ পাওয়া যাবে,মানুষের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসবে দূর থেকে।ভূতের ছবিগুলোতে তো এসবই দেখায়।অবশ্য এসব ঘটনা ঘটলেও খুব বেশি অবাক হবে না সোনালী।এই শয়তানের বাড়িতে জ্বিন-পরী না অস্বাভাবিক। অন্ধকারেই পাপাচারে পূর্ণ বাড়ির দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে সোনালী।সবকিছুর শেষ আছে।আহমেদ ইউসুফের পাপেরও শেষ আছে।তার শেষটাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে সোনালী।হাতেনাতে শুধু ধরার অপেক্ষা।প্রমাণগুলো একবার হাতে আসুক শুধু।রিমান্ডের মার আর বিখ্যাত ডিম থেরাপি কি জিনিস,তা হাড়ে হাড়ে বুঝবে এই হারামজাদা।বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে আরেকচোট হাসে সোনালী। দরজা-জানলা সে থোড়াই কেয়ার করে।এক পথ বন্ধ হয়েছে তো কি হয়েছে? আরো কত পথ আছে।আগে-পিছে নজর বুলিয়ে বাড়ির পিছনে পা বাড়ায় মেয়েটা।নিশাচর প্রাণীর মতো উবে যায় সারি সারি বয়স্ক গাছের আড়ালে।
***
খোলা জানলা দিয়ে ঝুপ করে এক চিলতে আলো ঢুকলো ঘরের ভিতর।আকাশে তেজি সূর্যের খরখরে রোদ।তপ্ত রোদ চোখ-মুখ ছুঁয়ে দিতেই ঘুম ভেঙে যায় তথার।আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে।দেয়াল ঘড়ির দিকে একবার নজর দেয়।সাতটা বাজে সবে।আজকে বোধহয় খুব গরম পড়বে।সাতটা বাজেই সূর্যের তাপে ত্বক পুড়ে যায়।তথা একবার সোনালীর দিকে তাকায়।উপুর হয়ে শুয়ে আছে মেয়েটা।ঘামে পিঠ ভিজে আছে।তথা নেমে জানলায় পর্দা টেনে দেয়।সোনালীকে ডাকে না আর।মেয়েটা ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক।
তৃপ্তি সহকারে ঘুমাতে পেরে শরীরটা খুব ফুরফুরে লাগছে তথার।ব্রাশ করে ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুতেই শরীরে আলাদা প্রশান্তি আসে।এদিকের পানি অনেক ঠান্ডা যা এই গরমে স্বস্তি দেয়।সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই খুব ক্ষুধা পেয়ে গেল তথার।হাম্মামখানা থেকে বেরিয়ে রুম থেকে পার্টস নেয়।এবাড়িতে রুমে রুমে গোসলের জায়গা নেই।গোসল করতে হয় দোতলার এককোনে অবস্থিত হাম্মামখানায়।এটা নাকি আগে অন্দরমহলের মেয়ে -বউদের গোসলের জায়গা ছিল।বিশাল এক ঘরে বালতিতে বালতিতে পানি রাখা।এখন অবশ্য দুটো ঝর্ণা ও সাত-আটটা পানির কল আছে।এগুলো নতুন লাগানো হয়েছে।
তথা নিচে নেমে কাউকেই দেখতে পায় না।কেউ বোধহয় ঘুম থেকে উঠেনি এখনো।তথা এদিক-ওদিক নজর বুলিয়ে বাড়ির বাইরে পা রাখে।দিনের আলোয় সবটা চকচক করছে।বিশাল কয়েকটা নারিকেল গাছ আছে এখানে।উঠোনের থেকে একটু দূরে গেলেই বিশাল এক পুকুর নজরে পড়ে।ঘাট বাধানো পুকুর।ঘাটের একাংশ ভেঙে ইট বেরিয়ে আছে।একটা আমগাছ হেলে আছে পুকুরের পানির দিকে।একটা গাছের সরু পাতা বেরিয়ে আছে ঘাটের পাশ দিয়ে।গাছটা চিনে তথা।ওদের গ্রামে এটাকে পাটিগাছ বলে।ঘাস দিয়ে পুরো জায়গাটা পূর্ণ হয়ে আছে।পুকুরটা অব্যবহৃত। তথার খুব ভালো লাগলো এদিকটা।তথাদের ব্যস্ত শহরে সকালের এমন স্নিগ্ধ দৃশ্য দেখা যায় নাকি?পুকুরের দিকে ভালোভাবে তাকাতেই শাফিনকে চোখে পড়ে।ওপাড়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে তথার দিকে।তথা চোখ ফিরিয়ে নেয়।শাফিনকে তার মোটেও পছন্দ না।লোকটার কথা-বার্তা কেমন যেন নিম্নশ্রেণীর। প্রথমদিন তথাকে কি বাজে ইঙ্গিতটাই না করলো!তথা নাকি সুন্দর বলে চান্স পেতে কষ্ট হয়নি।ছিঃ! কি বাজে কথা।
_” কামিনী ফুল, আপনি এদিকে কি করছেন?”
তথা হতাশ চোখে তাকায় ইউসুফের দিকে।আবার কামিনী ফুল।হাহ! কতবার বলবে,ওর নাম তথা।তথা খানিক বিব্রত হয়ে বলেঃ ” আপনি আবার ভুল করছেন।আমি কামিনী ফুল নই,আমি তথা।”
_” আচ্ছা,বাদ দিন।এদিকে কি দেখছেন?এটা তো দেখার মতো পুকুর না।”
_” এদিকটা খুব সুন্দর।”—তথা অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নেয়।লোকটা মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর।খুব বেশি তাকিয়ে থাকা যায় না।চোখ ধাধিয়ে যায় একদম।
_” এদিকেই দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি কোথাও যাবেন?”
_” এখানে কোনো খাবারের দোকান পাওয়া যাবে? যেকোনো একটা শুকনো খাবারের প্রয়োজন ছিল আমার।”
_” আপনার ক্ষুধা পেয়েছে?”
_” হ্যাঁ, কিছুটা পেয়েছে।”
_” তাহলে চলুন কিছু খেয়ে আসি।এদিকে নাকি একটাই চায়ের দোকান আছে।অবশ্য আমিও খুব বেশি একটা চিনি না। ”
ইউসুফের সাথে পা মেলায় তথা।কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করেঃ” আপনি কি গ্রামে ছিলেন না কখনো?জন্মের পরেই ঢাকা চলে গেছেন?”
_” আমার জন্ম তো এইদেশে না।বিদেশে জন্মেছি আমি।”
_” কোন দেশ?”
_” পাকিস্তান।আমি জন্মগত পাকিস্তানী।আমার বাপ-দাদারা এদেশের হলেও আমি পাকিস্তানের। আপনাদের দেশের মানুষেরা আমার বংশের সবাইকে মেরে ফেলেছে।শুধু আমার বাবা-মাই বাঁচয়ে পেরেছেন ওদের হাত থেকে।”
_” কেন?আপনার বংশ কি এমন করেছিল?আপনারা না জমিদার ছিলেন?–তথার আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে।তা দেখে মুচকি হাসে ইউসুফ। তথার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে উদাস গলায় বলেঃ” আমরা বংশগত রাজাকার।মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বংশের সবাই শান্তি কমিটির সদস্য ছিল।যুদ্ধের শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতেই তাদের প্রাণ গেছে।”
চলবে….
#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-১১)
#হালিমা রহমান
ইউসুফের কথা শুনে খুব অবাক হয়ে গেল তথা।চোখদুটো বড় বড় করে বললঃ” আপনি রাজাকারের বাচ্চা?”
_” গালি দিলেন নাকি প্রশ্ন করলেন?”
_” না,না গালি দেইনি।এমনি জিজ্ঞেস করলাম।”
_” একাত্তরে এই বাড়ি ছিল শান্তি কমিটির অফিস।আমার দাদা ছিলেন কমিটির চেয়ারম্যান। মুক্তিযুদ্ধের ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি।আর বাদবাকি সদস্যরাও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল।”
_” দেশের স্বাধীনতা চায়নি কেন তারা?”
_” তা তো আমি জানি না।আমি তখন পৃথিবীতে ছিলাম না।মুক্তিযুদ্ধের বহু বছর পরে আমার জন্ম।আই ওয়াজ বর্ন ইন নাইন্টিন এইটি সিক্স।”
_” ছিয়াশি! তারমানে আপনার বয়স পঁয়ত্রিশ।কিন্তু আপনাকে দেখলে মনেই হয় না। আপনাকে দেখলে মনে হয় আপনার মাত্র সাতাশ-আটাশ বছর।”
_” প্রশংসা করলেন কামিনী ফুল? “—মুচকি হাসে ইউসুফ।
ইউসুফের কথার বিপরীতে তথাও হাসে।মৃদু হেসে বলেঃ” ধরে নিন।”
_” মাসে মাসে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালি জেন্টস পার্লার আর জিমে।সকাল- বিকাল ব্যায়াম করি,ডায়েট কন্ট্রোল করি।এতো কিছুর পরে বয়স বুঝবেন কি করে?আমি খুব স্বাস্থ্য সচেতন এবং শৌখিন।”
_” তা আপনাকে দেখলেই বুঝা যায়।”
_” আপনার কি ক্ষুধা চলে গেছে?চা খাবেন না?”
_” হ্যাঁ, চলুন।”
ইউসুফের সাথে পা মেলায় তথা।দু-পা এগোনোর পর কিছু একটা ভেবে মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়।যা ভেবেছিল ঠিক তাই।শাফিন এখনো একইভাবে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।সে কি ভাবছে কে জানে।তবে তথা জানে,এরপর শাফিনের সাথে দেখা হলে সে কি বলবে।শাফিন নিশ্চয়ই বলবে,তথা সুন্দর বলেই একদিনের মাথায় বাড়ির মালিকের সাথে ভাব জমাতে পেরেছে।মেয়ে হয়ে তাদের লাভই হয়েছে।এবার মনে মনে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেয় তথা।আবার যদি শাফিন এমন কিছু বলে তবে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেবে তার গালে।এতো নোংরা মন-মানসিকতার মানুষ চড়-থাপ্পড়েরই যোগ্য।
কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে কিছু ফুল পড়ে আছে।টকটকে লাল রঙের ফুল। সেখানে পুনম দাঁড়িয়ে আছে।সুন্দর ফুলগুলোর ছবি তুলছে পুনম।পরনে স্লিভলেস টপস। তথা চোখ ফিরিয়ে নেয়।পোশাকের ব্যাপারে সে এখনো অনেকটাই রক্ষণশীল। এমন খোলামেলা আবরণ কেন যেন সহ্য করতে পারে না সে।গেট পেরিয়ে বাইরে চলে এলো দুজনে।সুনসান রাস্তা।এদিকটায় খুব বেশি মানুষ আসে না বোধহয়।তীব্র রোদে গা পুড়ে যায়।পাকা রাস্তাটা মিশে গেছে সামনের একটা ক্ষেতে।দূর থেকেই দেখা যায়, সেখানে কয়েকজন কৃষক কাজ করছে।তথা মাথায় ওড়নার আঁচল টেনে ঘোমটা দেয়।রোদের তাপে মাথাটা একদম গরম হয়ে যাচ্ছে।
_” আপনাকে একদম নতুন বউয়ের মতো লাগছে,কামিনী ফুল।”
_” তাই নাকি?”
_ ” হুম।খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আপনাকে।একটা ছবি তুলি?”
ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা টানে তথা।মাথা নেড়ে বলেঃ” না,না ছবি তুলবেন কেন?আপনার ফোনে আরেক মেয়ের ছবি দেখলে আপনার বউ নিশ্চয়ই খুব রাগ করবে।”
ইউসুফের পা থেমে যায়,কপাল কুঁচকে যায়।মেয়েটা খুব বেশি বুঝে।ও কখন বলল ও বিবাহিত?
_” আমি এখনো বিয়ে করিনি।তবে করব সামনে।”
_” এখনো বিয়ে করেননি! আমি আপনাকে যত দেখছি ততো অবাক হচ্ছি।এই বয়সে ছেলেরা বাবা ডাক শোনে।আর আপনি নাকি বিয়েই করেননি।অতি আশ্চর্য! ”
_” ব্যবসা-বাণিজ্যে খুব ব্যস্ত থাকতে হয়। বিয়ে করার সময় কোথায়?”
_” কীসের ব্যবসা আপনার?”
_”এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট। আমার কাজকে আমি জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসি।”
_” ভালো।আপনি এখানে থাকেন নাকি পাকিস্তানে?”
_” বেশিরভাগ সময় পাকিস্তানেই থাকা হয়।এখানে আসি মাঝে মাঝে।এখানের মানুষদের সাথে তাল মিলাতে পারি না আমি।তাছাড়া,বাঙালিদেরকে খুব বেশি পছন্দও করি না।তাদেরকে দেখলেই খুব প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে করে।ওদের জন্যই আমার পুরো বংশ মরেছে।ইউজলেস ন্যাশন একটা।আই হেইট মোস্ট অফ দ্যা পিপল অফ ইয়োর কান্ট্রি।আমার দেখা সবচেয়ে খারাপ মানুষটাও বাঙালি ছিল।”
তথার পা থেমে যায়।ইউসুফের কথাগূলো ভিতরটাকে নাড়িয়ে দেয় একদম।কেমন একটা গা জ্বালা করা অনুভূতি হয়।অনুভূতিটা নতুন।এটা কি দেশপ্রেম?দেশ মায়ের প্রতি ভালোবাসার কথা শুধু বাংলা গল্প-উপন্যাস-কবিতা ও রচনায় পড়েছে।বাস্তবে খুব বেশি একটা দেশপ্রেম চর্চা করা হয় না।তবে ইউসুফের কথাগুলো চাবুকের মতো গায়ে লাগে।আত্মসম্মানের ভীতটাকেও নাড়িয়ে দেয় একদম।তথাও তো বাঙালি জাতির একজন।তার মানে তথার সঙ্গও নিশ্চয়ই ইউসুফের ভালো লাগছে না।বাঙালি জাতি এতোটা ঘৃণিত এই মানুষটার কাছে?ইতর কোথাকার। যুদ্ধের সময় যে তার বংশ নিজের জাতির সাথে প্রতারণা করেছে,সেটা মনে পড়ছে না?ফালতু।স্বাভাবিকভাবেই ইউসুফের কথাগুলো গায়ে লাগে তথার।রাগ উঠে খুব।তবে রাগটুকু দেখায় না তথা।বড় এক দম নিয়ে রাগ গিলে নেয়।
_” কামিনী ফুল,থেমে গেলেন যে?চলুন।”
_” আপনি যান, মি.আহমেদ।আমার ক্ষুধা নেই।”
_” সে কি মাত্রই তো বললেন…”
_” এখন আর ক্ষুধা নেই।আমিও বাঙালি।আপনার অপছন্দের জাতি।আপনি আগেই বলতে পারতেন,আমার সঙ্গ আপনার পছন্দ হচ্ছে না।অকারণে আমার সামনে আমার জাতিকে অপমান করলেন।আমি তো আপনার সাথে জোর করে আসতে চাইনি।বরং আপনিই নিয়ে এসেছেন।”
তথার পুরো কথা বোধগম্য হয় না ইউসুফের।বোকার মতো প্রশ্ন করেঃ” আপনার সঙ্গ খুব পছন্দ আমার।ইনফ্যাক্ট,আপনার সঙ্গ আমার আকাঙ্খা। এ কথা কেন বলছেন?”
_” বাঙালি জাতিকে আপনি পছন্দ করেন না,ঘৃণা করেন।আমি এই জাতির মেয়ে।আপনার কথা অনু্যায়ী আমাকেও আপনার পছন্দ না।খুবই ভালো কথা।তবে, পরের বার
কথা বলতে হলে সাবধানে কথা বলবেন মি.আহমেদ ইউসুফ। আপনার শরীরেও এই ইউসলেস জাতির রক্তই বইছে।নিজের জাতি সম্পর্কে এতো বাজে কথা কিভাবে বললেন?আমরা খুব দয়ালু জাতি বলেই রাজাকাররা এখনো এদেশে থাকতে পারছে।আপনার বাড়িতে থাকছি বলে খুব আফসোস হবে আমার। আমাদের আত্মসম্মান খুব বেশি তো তাই অপমান করার পরে সেখানে মুখ ডোবাতে পারি না।
চুক্তিবদ্ধ না হলে এখানে আর থাকতাম না আমি।বাধ্য হয়ে থাকতেই হবে।”
গটগট করে বাড়ির দিকে চলে যায় তথা।রাগে তার শরীরটা ফেটে যাচ্ছে।ইকবাল মিয়া সবসময় একটা কথা বলেন।রক্তের দোষ অথবা গুণ কেউ কখনো এড়িয়ে যেতে পারে না।আজ এই কথাটার সত্যতা হাড়ে হাড়ে টের পেলো তথা।রাজাকারের রক্ত বলেই নিজের জাতি সম্পর্কে এভাবে বলতে পারলো।তথা নিশ্চিত মুক্তিযুদ্ধের সময় ইউসুফ পৃথিবীতে থাকলে সেও বংশের মতো কুখ্যাত রাজাকার হতো।একপেট ক্ষুধা নিয়ে আবারো বাড়িতে ঢুকলো তথা।সকাল সকাল মেজাজটা খুব খারাপ হয়ে গেছে।বেয়াদব একটা লোক।ফালতু।
এদিকে ইউসুফ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়।গরমে ঘাম দেয় তার শরীরে।কপাল বেয়ে পড়ে নোনা পানি।ইউসুফ সেদিকে খেয়াল দেয় না।ঘামটুকু মুছেও নেয় না।রাগে তার শরীর জ্বলছে। ইউসুফের রাগ সবসময় নাকের ডগায় থাকে।মেয়েটার খুব সাহস। শুধু তথা বলে আজ রক্ষা।তথার জায়গায় অন্যকেউ থাকলে আজকে তার কি হাল হতো তা নিজেও ভাবতে পারে না ইউসুফ।রাস্তার পাশের বিশাল আমগাছে সজোরে লাথি দেয় সে।কপাল চেপে ধরে।মেয়েটাকে যতটা সহজ ভেবেছিল,ততোটা সহজ নয়।একে বাগে আনতে খুব কষ্ট হবে ইউসুফের।
***
_” কি গো আব্বা,সকাল সকাল কই যাও?”
খালেদা বানুর কথায় হাঁটা বন্ধ করে ইরফান।মুচকি হেসে ডাইনিংয়ে বসে থাকা মায়ের দিকে চলে যায়।চেয়ার টেনে বসে পড়ে জন্মদাত্রীর পাশে।
_” ধানমন্ডি যাব,মা।”
_” রেস্টুরেন্টে? ”
_ ” হ্যাঁ। অনেকদিন যাওয়া হয় না।তাই ভাবলাম আজ একটি ঘুরে আসি।”
_” আলহামদুলিল্লাহ, আমার আব্বার বুদ্ধি হইছে।মাইনষের উপরে ভার দিয়া কি আর ব্যবসা চলে?ব্যবসা সামলানো অনেক কঠিন ব্যাপার।হাড়-মাংস এক কইরা, রক্ত পানি কইরা ব্যবসা চালাইতে হয়।তোমার বাপেরে দেখ নাই?এরকম কষ্ট করতে হয় জীবনে।আজকে থেকা পত্যেকদিন যাইবা, ঠিক আছে?”
ইরফান মাথা নাড়ে।খালেদা বানু কথা একটু বেশি বলেন।সংসারের শুরুর দিকে খুব বেশি কথা বলতেন না।অবশ্য কথা বলার সময় ছিল কোথায়?সারাদিন তো সেই টিনশেড হোটেলের চটের বস্তার আড়ালেই থাকতে হতো।দুঃখের দিনের কথা কেউ শুনতে চায় না।তাই খালেদা বানুর বান্ধবী-টান্ধবী খুব বেশি ছিল না।সারাদিন একাই থাকতেন।মুখ বন্ধ রেখে কথা জমিয়ে রাখতেন।আজ সুখের দিনে তার বন্ধু-বান্ধবীর অভাব নেই।রোজ বিকালে তার ঘরে চায়ের আসর বসে।রাজ্যের কথা হয় সেখানে।খালেদা বানুও তার ঝাপি খুলে বসেন।জমিয়ে রাখা কথাগুলো এখন বন্যার পানির মতো মুখ দিয়ে বেরোয়।তিনি এখন আর কথা জমিয়ে রাখতে পারেন না।জমিয়ে রাখা কথাগুলো পেটের ভিতর কেমন যেন গুড়গুড় করে।
_” আব্বা, নাস্তা খাইলা না যে?”
_” ক্ষুধা নেই মা।”
_” এই কথা কইলে চলব?একটা কড়কড়া কইরা ডিম ভাইজা দেই।কয়ডা ভাত খাও।নাকি রুটি খাইবা?ডিম-পরোটা দিমু?”
_” না,মা।তাহলে ভাতই দাও।কম পেয়াজ দিয়ে একটা ডিম ভাজতে বলো।আর রাতের বাসি ডাল আছে নাকি?”
_” হ আব্বা, আছে।খাইবা?”
_” হুম।দাও তাহলে।”
খালেদা বানু সন্তুষ্টির হাসি হেসে ছেলের খাবার আনতে যান।ছেলে-মেয়েদের খাবারের ব্যাপারে তিনি খুব সচেতন।এই একটা বিষয়ে তিনি কাজের লোকদের উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন না।
ইরফান চেয়ারে হেলান দেয়।ব্লেজারটাকে খুলে পাশের চেয়ারে রাখে।আজকে একটা নতুন সকাল তার জন্য।আগে তো ঘুম থেকে উঠে কোনোমতে ব্রাশ করেই তথার বাড়ির দিকে ছুটতো।তথা এই সময়ে ভার্সিটিতে যায়।তাকে পাহারা দিতে হবে না?রিকশা ঠিক করে দিতে হবে,বাজে ছেলেরা যাতে নজর না দেয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।তথার পিছু পিছু ভার্সিটি পর্যন্ত যেয়ে আবার ফিরে আসতো ইরফান।এলাকায় আসতে আসতেই অনেক সময় দশটা বেজে যেতো।বাড়ি ফেরা হতো না তখনো।এলাকার কোনো একটা দোকান থেকে দুটো পরোটা আর খানিক ডাল-ভাজি অথবা একটা ডিম পোচ দিয়েই নাস্তা সাড়তো।তারপর কিছুক্ষণ এলাকার পঞ্চায়েত আর কিছুক্ষণ পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানে আড্ডা চলতো।এরকম এদিক-ওদিক ঘুরে ঠিক বারোটা বাজে আবার তথার ভার্সিটির সামনে চলে যেত।আবারো তথাকে পাহারা দিয়ে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে এসে তারপর নিজের বাড়িতে ফিরতো ইরফান।রেস্টুরেন্টে মোটেও যেতে ইচ্ছে করতো না তার।সেখানে তো আর তথা নেই।বিগত দিনগুলিতে প্রেয়সীর জন্য কত কত পাগলামি করেছে ইরফান।ঘটনাগুলো মনে করে কিছুক্ষণ নিজের মনেই হাসে সে।কালকের সকাল আর আজকের সকালে রাত-দিন তফাৎ। কালকেও তথার সাথে এই সময়ে বাস স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিল ইরফান।কাল সে ছিল কান্ড-জ্ঞানহীন এক পাগল প্রেমিক।আর আজ? আজ সে মোহমুক্ত এক কাঠখোট্টা কর্মজীবী। নিজেকেই আজ চিনতে পারে না ইরফান।কেমন যেন নতুন নতুন লাগে সব।ইরফান স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।অবশেষে সেই হৃদয়হীনার কাছ থেকে মুক্তি মিললো।ইরফান আর কখনো তথার দিকে ফিরে তাকাবে না।তথাকে পুরোপুরি বয়কট করেছে সে।তথার কথা মন থেকে মুছে ফেলত চেষ্টা করে ইরফান।তথার সাথে আর কখনো দেখা না হওয়ার প্রার্থনাও করে মনে মনে।
_” হা করো আব্বা।আমিই খাওয়ায় দেই।তোমার আর হাত দেওয়ার দরকার নেই।”
ইরফান মায়ের কথার অবাধ্য হয় না।স্কুল পড়ুয়া বাচ্চাদের মতো মায়ের হাত থেকে একের পর এক লোকমা মুখে নেয়।
_” আব্বা,আমার তো বয়স হইছে।নাতী-নাতিন নিয়া খেলার বয়স হইছে আমার।এহন একটা সঙ্গীর দরকার।তোমার বাপে কয়দিন ধইরাই তোমার বিয়ার কথা কইতাছে।তোমার কি কোনো পছন্দ আছে,আব্বা?”
বিয়ের কথা শুনে বিষম খায় ইরফান।অন্য সময় হলে হয়তো পছন্দ হিসেবে তথার নাম বলেই দিতো।কিন্তু এখন বললো না।একটু পানি খেয়ে গলা শক্ত করে উত্তর দেয়ঃ” আমার কোনো পছন্দ নেই,মা।তোমার পছন্দই আমার পছন্দ।”
খালেদা বানুর মুখে হাসি ফুটে।ইরফানটা ভীষণ লক্ষ্মী। এমন সোনার টুকরা কয়জনের কপালে জুটে?
_” তাইলে মাইয়া দেখা শুরু করি?”
_” করো।”
ইরফানের গলা শুকিয়ে যায়।ভাতগুলো গলা চিড়ে নিচের দিকে নামছে যেন।ভিতরের অস্থিরতা বাড়ে।তবে সেসব পাত্তা দেয় না সে।নিজের মনকে ছেলে ভুলানো কথা শুনিয়ে শান্ত করে।আবারো চেয়ারে হেলান দেউ ইরফান।মনে মনে বলেঃ” খুব বাঁচা বাঁচলাম।হৃদয়হীনা লৌহ মানবীর কবল থেকে একেবারের জন্য মুক্তি পেয়ে গেলাম আমি।”
এই সান্ত্বনায় ইরফানের মন ভালো হলো কিনা কে জানে! মানুষের মন তো।বাইরে থেকে একে বুঝা একেবারেই দুঃসাধ্য।
চলবে….