পুষ্পবৃষ্টি,পর্ব-১

0
1112

#পুষ্পবৃষ্টি,পর্ব-১
#ফারিয়া নাজনীন

তখন আমি কেবল দশম শ্রেণিতে উঠেছি। প্রতি ক্লাসের সেরা শিক্ষার্থীর নাম ঘোষণা হয়েছিল সেদিন। তাদেরকে প্রিন্সিপাল স্যার নিজে হাতে ব্যাচও পড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমিও সেই শিক্ষার্থীগুলোর মাঝে একজন। দশম শ্রেণির সেরা শিক্ষার্থীর পদ পেয়েছিলাম। হবে নাই-বা কেন! ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল আমি। যদি সবচেয়ে মনোযোগী আর নিয়মিত শিক্ষার্থীর নাম লিস্ট করা হত, তবে সেখানেও আমার নামই হয়ত প্রথমে থাকত। এবারের যে বিজ্ঞানমেলা হয়েছিল সেখানেও আমার প্রজেক্টটা ফার্স্ট হয়েছে। আর আমার গাওয়া গান শুনে যে স্কুলের সবাই মুগ্ধ হয়েছে বারবার, এ কথাও আমার অজানা নয়।

এসবই ভাবতে ভাবতে আর নতুন পাওয়া ব্যাচটা দেখতে দেখতে বাড়ি ফিরছিলাম সেদিন। হুট করেই পায়ে একটা ঢিল এসে লাগাতে সেদিকে নজর দিলাম। দেখলাম ঢিলের সাথে একটা মোড়ানো কাগজ। কৌতুহলবশতই কাগজটা পড়ার জন্য তুলে নিলাম।

“১৯৭১ সালে পাকি’স্তানী শা’স’কগোষ্ঠীর বি’রুদ্ধে ল’ড়া’ই করে, ত্রিশ লক্ষ শহী’দের র’ক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের মাতৃভূমি স্বা’ধীন করেছি। বহু আত্ম’ত্যা’গ মিশে আছে এ স্বাধী’নতার সাথে। কিন্তু আমরা কি আদৌতে স্বাধী’ন হয়েছি? যদি না প্রাণ খুলে একটু মনের কথা বলতে পারি, তবে এ কেমন স্বাধী’নতা? তাই আমাদের নিজেদের ব্যক্তি স্বাধী’নতা রক্ষার্থে আমাদের কি উচিত না, পেটে কথা চেপে অসহায় পেটকে না ফুলি’য়ে কাঙ্খিত মানুষকে সে কথা বলে দেওয়া? কী বলুন, উচিত না?”

এতটুকু পড়ে আমার মুখ দিয়েও আচমকা বেরিয়ে এলো,
“হ্যাঁ, উচিতই তো।”
কিন্তু এরকম একটা উদ্ভট চিরকুট এখানে কেন? আমি হয়তো আমার প্রশ্নের উত্তরখানি ভাবার সময়টুকুও পেলাম না। হুট করে সামনে একজন লাফিয়ে পড়ল। যার ফলে একটু চমকিয়ে দুকদম পিছিয়েই গেলাম। কিন্তু সেই লাফিয়ে পড়া প্রাণীটি এসব কিছুকে পাত্তা দিল বলে মনে হলো না।

“হ্যাঁ, উচিত তো! এজন্যই তো আমি আপনাকে বারবার আমার মনের কথা বলতে যায়। কিন্তু আপনি তো একদম শুনতেই চান না। আর কতবার বলব, আমি আপনাকে ভালোবাসি। একটুখানি কথা বলতে চাই আপনার সাথে। যদি না, আপনাকে মনের কথা খুলে বলতেই না পারি, তবে আমার নিজের কোনো ব্যক্তিস্বাধী’নতা থাকল?”

বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে এলো আমার। আবার এই ছেলে! এর জ্বালাতন তো আর নেওয়া যাচ্ছে না। পথে-ঘাটে যেখানে পাচ্ছে অস’ভ্যতা করে যাচ্ছে। এর সাহস দেখে কে বলবে যে এই ছেলে সবেমাত্র ক্লাস নাইনে উঠেছে। আমার থেকে তো বছরখানেকের ছোটই হবে। একটু দম নিয়ে, চোখ-মুখ শক্ত করে আমি বললাম,

“তোমার ব্যক্তি’স্বাধী’নতা তুমি অন্য কোথাও দেখাও। একদম আমার সাথে এসব বেয়া’দবি করবে না। এরকম অস’ভ্যতার ফল কিন্তু খুব খারাপ হবে। তুমি বোধহয় ভুলে গেছ যে, তোমার বাবা-মা দুজনকেই চিনি আমি। এসব চিরকুট দিয়ে, পথ আগলে উল্টোপাল্টা বলা কোথ্থেকে শিখে এসেছো, হ্যাঁ! পাড়ার বখা*টেদের দলে নাম লিখিয়েছো নাকি?”

আমার কথায় সে কিছুটা দমে গেল, কিন্তু পুরোপুরি চুপ হলো না। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই তাকে চুপ করিয়ে দিলাম।

“একদম কোনো কথা না। আর আমাকে বির’ক্ত করতে যেন না দেখি। শোনো ছেলে, তোমার এখন এসব করার বয়স না। যাও বাড়ি গিয়ে পড়তে বসো। পড়াশোনা নিশ্চয় বাদ দিয়ে দেওনি।”

ছেলেটাকে আচ্ছামতো বকে পেছন ঘুরে, পুনরায় নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বেশ কিছুদূর গিয়েছিলামও বটে। কিন্তু পিছন থেকে হঠাৎ কিছু কথা ভেসে আসল,

“সব ঠিক আছে। কিন্তু আপনি হঠাৎ পাড়ার বখা’টেদের কথা তুললেন কেন। কেউ কিছু বলেছে নাকি! তবে শুধু আমাকে একবার তার নামটা বলবেন, আমি তারপর দে’খে নেব। পুষ্পকে কিছু বললে, এই আরাফ তাকে একদম ছে’ড়ে দেবে না।”

উফ! এই ছেলে কোনোদিনই আমার কথা শুনবে না। আচ্ছা বদমা’শ একটা। রাগে গজগজ করতে করতে সেদিন আমি বাড়ি পৌঁছেছিলাম। বাড়ি গিয়ে মায়ের সাথে আবার আরেক চোট হলো। অবশ্য এ তো নিত্যদিনের ঘটনা। আমার মায়ের সংসারের যাবতীয় ছোটখাট সমস্যা, এই ধরুন, হাত থেকে পরে কাচের কোনো গ্লাস বা প্লেট ভে’ঙে গেছে, তাহলে আমার মায়ের মুখ থেকে শোনা যাবে,

“হাত থেকে পড়’বেই তো, পড়ারই কথা। আমি কী এক চিন্তায় থাকি নাকি! মেয়েটাও তো হয়েছে বাপের মতো। খালি নাকের ডগায় আছে রা’গ আর হাবভাব এমন যেন এক সংসার কান্ধে উঠানো গম্ভীর গিন্নিমা।”

আবার ধরুন, তরকারিতে বেশি নুন দিয়ে ফেলেছে বা জিনিসপত্র বেশি দামে কিনে একটু ঠকেছে, নাহলে অন্য কোনো সমস্যা, সবকিছুতেই তার শেষ হয় আমার আর বাবার রাগ আর গাম্ভী’র্যতা নিয়ে।

আমার মায়ের কাছে আবার আরাফ খুব পছন্দের। শুধু আমার মায়েরই নয়, আমাদের পাড়ার কমবেশি সবারই পছন্দের। যেকোনো প্রয়োজনেই এই সদা হাস্যোজ্জ্বল ছেলেটাকে খুঁজে পাওয়া যায়। আরাফ যে আমাকে এরকম বি’রক্ত করে, এটা সবাই মোটামুটি জানে। কিন্তু তারা এটাকে মজা হিসেবেই ধরে নিত। ধরবেই তো, এরকম বাচ্চা বয়সে আরও বয়সে বড় কোনো মেয়েকে, তারউপর মেয়ে প্রচন্ড গ’ম্ভীর আর চুপচাপ। উঁহু, তার এই আবেগকে মজা করা হিসেবে ধরাই যায়!

আমারও মাঝে মাঝে রাগ হতো। মনে হতো এরকম মজা কি আমার সাথেই করতে হলো? আমি কি এতটাই সস্তা! এসব ভেবে খুব বাজে’ভাবে কথাও শোনাতাম ওকে। কিন্তু সে কি আর আমার কথা শুনে থেমে থাকার বান্দা! ঠিকই আবার সামনে এসে দাঁড়াতো। তারপর সেই মুখস্ত বাণী।

” ভালোবাসি তো আপনাকে। যাই বলেন না কেন, না দেখে আর থাকতে পারি না। কী করব! পুরোপুরি ফেঁ’সে গেছি!”

আমি এসব কথা সব তার ফাজলামি ভেবে খুব বির’ক্ত হতাম। কিন্তু সেবার হয়তো প্রথম তার আবেগমিশ্রিত কথাগুলো আমাকে ছুঁয়েছিল। তখন আমি ভার্সিটিতে পড়ছি আর আরাফের ইন্টার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তখনও কিন্তু তার অত্যা’চার বন্ধ হয়নি। তার মুখস্ত ভালোবাসার বাণী শোনানোও অব্যাহত ছিল। আমি কোথাও বেড়াতে গেলেও রেহাই পেতাম না। ধরুন, আমি কোথাও ঘুরতে বা কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে গেলাম, ঠিকই যাওয়ার পরের দিন দেখতাম আরাফ ওই এলাকাতেই তার কোনো আত্মীয় খুঁজে ঠিক চলে গেছে। তারপর সামনে এসে তার সেই বাণী!

“ভালোবাসিতো তাই না দেখে থাকতে পারি না।”

সেদিন সারাদিনই বৃষ্টি ছিল। সন্ধ্যার পর আমি কফি নিয়ে পড়ার টেবিলে বই নিয়ে বসলাম। এই আটটা বাজবে ঠিক এমন সময় দেখি জানালায় শব্দ হচ্ছে। আমাদের এক তলা বাড়ির পেছন দিকে ঘরটা আমার। আমি ঘার ঘুরিয়ে দেখি আরাফ দাঁড়িয়ে আছে। সেবার প্রথম সে আমার জানালায় এসে দাঁড়িয়েছিলো। রেগেমেগে কিছু বলতেই সে বলা শুরু করল,

“কিছু বলবেন না প্লিজ। আমার হাতে একদম সময় নেই। নয়টায় বাস। দাদু খুব অসু’স্থ তাই গ্রামে যেতে হবে। জানিনা কতদিন সেখানে থাকতে হবে। কিন্তু ভাববেন না, আমি ঠিক দুদিন পর এসে আপনাকে দেখে যাব।”

এরপর একটু হেসে মাথা চুলকিয়ে আবার শুরু করল,

“আসলে আপনাকে না দেখে আমি একদমই থাকতে পারি না। আপনি কিন্তু নিজের খেয়াল রাখবেন। ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় রিকশা না পেলে একদম হেঁটে যাবেন না। আর ছাতা নিয়ে বেরোবেন। এখন বৃষ্টির পানি গায়ে লাগলে কিন্তু খুব শরীর খারাপ হবে। ইশ! দেরি হয়ে যাচ্ছে। গেলাম আমি।”

ছেলেটা সামনে থেকে চলে গেল। এইযে আমাকে বৃষ্টির পানি থেকে সতর্ক করে গেল, অথচ আমি স্পষ্ট দেখলাম সে বৃষ্টিতে ভিজে কাঁপতে কাঁপতে আমাকে কথাগুলো বলে গেল। আবার কিছু কথা ভেসে আসাতে আমার মনোযোগ সেদিকে গেল।

“জানেন পুষ্প, এরকম এক বৃষ্টির দিনে আপনাকে দেখেছিলাম। তখন আমরা এখানে নতুন এসেছি। আপনি তো ভীষণ চুপচাপ, তাই আপনার সাথে তখনও কথা হয়নি৷ শুধু আপনার নামটুকুই জানতাম। একদিন বিকাল বেলা প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফিরছিলাম। আপনিও হয়তো তখন বাড়ি যাচ্ছিলেন। হুট করে বৃষ্টি নামল। অসময়ে বৃষ্টি নামাতে আমি খানিকটা বিরক্তই হয়েছিলাম। কিন্তু সামনে তাকিয়ে দেখি আপনি হাসিমুখে বৃষ্টির পানিগুলো ছুঁয়ে দিচ্ছেন। বিশ্বাস করুন, সেদিন আপনার ওই হাসিমুখ সোজা আমার চোখে নয় একদম বুকে যেয়ে লেগেছিল। বৃষ্টির পানিতে আপনাকে এত স্নিগ্ধ, এত পবিত্র লাগছিল! ঠিক যেন একটা ফুটন্ত পুষ্প। আচমকায় আমার মুখ দিয়ে সেদিন একটা শব্দ বেরিয়েছিল। জানেন সেটা কী? ‘পুষ্পবৃষ্টি’। আমার তখনই মনে হয়েছিল। এরকম পুষ্পবৃষ্টি যদি আমি সারাজীবন দেখতেই না পারি, তবে এ জীবনই বৃথা। আমার সারাজীবন বৃষ্টিবিলাস করতে শুধু এই পুষ্পকেই লাগবে।”

তার চোখমুখে সেদিন আমি আকুলতা দেখেছিলাম। সময় যেন থমকে গিয়েছিল। এমন আবেগমিশ্রিত অনুভূতি! আমার শব্দভান্ডার যেন শূণ্যের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছিল। কিছু বলতে পারলাম না। শুধু মনে হচ্ছিল, এমন সর্ব’নাশা অনুভূতির অস্তিত্ব কি আসলেই বিদ্যমান?

“আমি আপনাকে না দেখে থাকতে পারি না। এজন্য এতগুলো বছরে তেমন কোথাও ঘুরতেও যায়নি। গেলেও সেদিনই ফিরেছি নাহলে পারেরদিন। এইযে আজ যাচ্ছি, আমি জানি ইচ্ছে হলে কালই এসে আপনাকে দেখে যেতে পারব। তবুও কেন যেন মন মানছে না। মনে হচ্ছে, আপনার থেকে বহুদূরে চলে যাচ্ছি। বুকের ভেতর প্রচন্ড দ’হন হচ্ছে। আচ্ছা, এমন কেন হচ্ছে! আপনি কি জানেন, পুষ্প? কেমন হারিয়ে ফেলার কষ্ট অনুভব হচ্ছে। কিন্তু আপনি তো হারিয়ে যাননি। বিশ্বাস করুন, সুযোগ থাকলে যেতামই না। আপনি কিন্তু নিজের খেয়াল রাখবেন। ভাল থাকবেন। আসছি।”

সে চলে গেল। কিন্তু আমার ভেতরে রেখে গেল একরাশ অনুভূতি। সেরাতে ঘুম আর চোখে এসে ধরা দিল না। সারারাত আরাফকে নিয়ে ভাবলাম। বাইরে ঝুম বৃষ্টি আর আমার ভেতরে নতুন আবেগের সূচনা। কিন্তু তখনও আমি জানতাম না, পরেরদিনই জীবন আমাকে ঠিক কতবড় চমক দেবে। আর সেই চমকে ভেতরে সদ্য জন্ম নেওয়া আবেগের সূচনাতেই সমাপ্তি ঘটবে। আমি এসবকিছুর টেরটুকুও পেলাম না।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here