#পুষ্পবৃষ্টি,পর্ব- ৪ এবং শেষ পর্ব
ফারিয়া নাজনীন
এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বলল,
“জানি না আমি কী আছে অদূরে
জানি আমি কী লেখা জীবনের শেষ লাইনে
শুধু জানি তোমায় আমি বাঁধতে চাই
এক সমুদ্র পরিমাণ ভালোবাসার নামে।”
এবার আমি আর কান্না আটকাতে পারলাম না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম।
_______________
তারপরের ঘটনা তেমন বিস্তৃত বলার কিছু নেই। খুবই সংক্ষেপ কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া বিশাল। আরাফ তার পরিবার এবং আমার পরিবারের সবাইকে রাজি করিয়ে নিল। আমি প্রথমে অমত করলেও পরে সকলের অনুরোধে মত বদলিয়ে ছিলাম। দেখি নাহয় জীবনকে আরেকবার সুযোগ দিয়ে। হারানোর তো আর কিছু নেই, তবে একবার শুরু করেই দেখি। আমার যে একটা গোছানো সংসারের বড্ড লোভ! সংসার করতে চাই আমি।
কিন্তু নতুন শুরু যে আমাকে নতুন ভাবে বেঁচে থাকার প্রেরণা দেবে তা তখনও বুঝিনিহ। জীবন আমার থেকে ঠিক যতটা সুখ কেড়ে নিয়েছে, তার হাজার গুণ বেশি ফেরত দিয়েছে। এইযে বিয়ের বেশকিছু বছর কেটে গেছে। এখনও রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে, তাকিয়ে দেখি এক জোড়া নির্ঘুম চোখ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যে দৃষ্টিতে মিশে আছে চমক আর একরাশ মুগ্ধতা। মাঝেমাঝে আবার সে দৃষ্টিতে ভয়ও দেখতে পাই। ভীত হয়ে থাকা মুখখানি দেখে আমার অন্তর কেঁপে ওঠে। এই ভয়ের কারণ চাইলেও তাৎক্ষণিক উত্তর মেলে না। বেশকিছুক্ষণ নিজের সাথে ভয়টা আকড়ে রেখে ধীরে ধীরে আমার মুখমন্ডল, আমার শরীরে আলতো করে স্পর্শ মাখিয়ে দেয়। তারপর বেশ বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নেওয়ার পর তার উত্তর পাওয়া যায়।
” আপনি আমার কাছেই আছেন তো, পুষ্প। আমি ভাবছিলাম এটা কোনো স্বপ্ন কীনা। হয়তো ঘুম ভেঙেই দেখব আপনি আমার থেকে অনেক দূরে চলে গেছেন। এজন্যই তো ভয় হয়। তাই ছুঁয়ে নিশ্চিত হলাম, এটা স্বপ্ন কীনা। ”
আমি অবাক হয়ে যাই। প্রতিউত্তরে কিছু বলার খুঁজে পাই না। মস্তিষ্কে শব্দরা এলোমেলো হয়ে জট বাঁধিয়ে ফেলে। শুধু চোখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি।
কিন্তু আমার জীবনে সবচেয়ে সুখের দিন হলো আমার মেয়ের জন্মের দিন। আমি সেদিনও কেঁদেছিলাম। সুখের কান্না! প্রথম সন্তান হারিয়ে, দ্বিতীয় সন্তান গর্ভে থাকাকালীন বড্ড ভয়ও হতো। আমার এই সন্তান হারিয়ে গেলে কীভাবেই-বা বাঁচতাম আমি। হয়তো পাগল হয়ে যেতাম। আরাফ যখন প্রথম মেয়েকে কোলে নিলো তখন তারও সে কী কান্না! একেকবার “আম্মা” “আম্মা” বলে ডাকছে আর কেঁদে উঠছে। আমি তখন মুগ্ধ দৃষ্টিতে বাবা মেয়ের ভালোবাসা দেখতাম।
” দেখেছেন পুষ্প এই বৃষ্টিটা কত খারাপ। আজকে কোথায় তুমুল বৃষ্টি হবে তা নাহয়ে কাঠফাটা রোদ হচ্ছে। বৃষ্টি কি জানে না, আমি আনন্দের দিন গুলোতে আমার পুষ্পবৃষ্টি দিয়ে সেলিব্রেট করতে চাই! আমার কাছে আমার পুষ্প আছে কিন্তু বৃষ্টিটাই বদমাইশ, একদমই আসছে না।”
আমি আরাফের কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠি। অতিরিক্ত খুশিতে ছেলেটা বোধহয় পাগল হয়ে গেছে। হুট করে আরাফ আবার বলে ওঠে,
“পুষ্প, আজ থেকে আমি আর ওই বদমাইশ বৃষ্টির আশায় থাকব না। আমার কাছে তো পুষ্প আছেই। আজ থেকে বৃষ্টিও এলো। আমার মেয়ে, আমার বৃষ্টি। ওর নাম আমি বৃষ্টি রাখলাম।”
আরাফ বোধহয় ওর কথাটুকু শেষও করতে পারল না। তখনই বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। কাঠফাটা রোদ মাখানো দিন হুট করে মেঘলা দিনে পরিণত হয়ে গেল। তখনও তো জানতাম না, বৃষ্টি নিয়ে আফসোস করার পর এই ঝরে পরা বৃষ্টির স্থায়ীত্ব পুরো তিনদিন হবে। আরাফ তখন হেসে বলে ওঠে,
“দেখেছেন পুষ্প, এই বৃষ্টিটা কত হিংসুটে। যেই শুনল অন্য বৃষ্টি চলে এসেছে, তখনই সেও চলে এল। ইশ হিংসুটে বৃষ্টি”
আমি আরাফের দিকে তাকিয়ে থাকি। কেমন উজ্জ্বল দেখাচ্ছে ছেলেটাকে। চোখমুখে খুশির ঝিলিক দেখেই তার আনন্দের পরিমাণ আন্দাজ করা যাচ্ছে। হঠাৎ সে বৃষ্টিকে আমার কোলে দিয়ে আমাদের দিকে চেয়ে থাকে। মিনিমিনিয়ে কিছু বলে ওঠে। সে কথা আমার কান পর্যন্ত পৌঁছায় না৷ কিন্তু আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, তার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হচ্ছে,
“পুষ্পবৃষ্টি, আমার পুষ্পবৃষ্টি!”
(সমাপ্ত)