মনের মাঝে তুমি,০২,০৩

0
844

গল্পঃ মনের মাঝে তুমি,০২,০৩
লেখিকাঃ আয়েশা মণি

পর্বঃ ২

– পাত্র পক্ষ চলে এসেছে। পাত্রের সঙ্গে পাত্রের মা, বাবা আর আন্টি এসেছে। মেয়ে সবারই খুব পছন্দ হয়েছে। আর ছেলেরও মেয়েকে পছন্দ হয়েছে।

মেয়ের বাড়ির লোকেরা তো আগে থেকেই ছেলের উপর ক্রাশ খেয়েছে। ছেলেটি ভীষণ সুন্দর দেখতে।
ছেলেটির বর্ণনা দিতে গেলে মাথা থেকে পা পর্যন্ত বর্ণনা দিতে হবে। ঘন কালো সিলকি চুল। ৪ আঙ্গুল সমপরিমাণ ফর্সা ললাট। জোড়া লাগানো ভ্রু। ভ্রুর নিচে কুচকুচে মনি বিশিষ্ট এক জোড়া বড় বড় চোঁখ।
তীরের মত একটা নাক। নাকটা কথা বলার সময় স্বল্পতেই লাল টুকটুকে হয়ে যায়। ঠোঁটটা একটু মেয়েদের মত চিকন। খাওয়ার সময় ঠোঁটটাতে তৈল লেগে চিকচিক করে উঠে। গালের সাইড থেকে নিয়ে থুতনি ঢাকা এক মুষ্টি কালো চাপ দাড়ি। দাড়িতে যেন তার ফর্সা চেহারাটা আরো সূর্যের আলোর মত টগবগ করছে। সিমিত লম্বা ঘাড়। ঘাড়ের ডান পাশে একটা তিল। ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতা আর মধ্যম সাস্থ্য মিলিয়ে মাশা-আল্লাহ দেখার মত একটি ছেলে। আর যোগ্যতাও অনেক। লন্ডন থেকে এম বি বি এস ডক্টর হয়ে সেখানকারই একটা বড় হসপিটালের ডক্টর হয়েছেন। তার সাথে নিজস্ব একটা ক্লিনিক।

ছেলেটার নাম মিহরাব। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে।
অবশ্য ছোট একটা বোন আছে। নাম মেহনাজ।
সে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে।

মিহরাবের বাবা আহমাদ সাহেব বড় বিজনেস ম্যান।
আর মা আবিদা বেগম পূর্বে হাই স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। আপাতত গৃহিনী।

সব মিলিয়ে মারুফ সাহেবের কাছে খুব পছন্দ হয়েছে।
তার মত সাধারন একজন ব্যাংক এর মেনেজার এর মেয়েকে এত বড় আর ভালো ফ্যামেলী পছন্দ করেছে এটাই তার কাছে অনেক।

অবশ্য আবিদা বেগমের কাছে সাফা বেগমের চালচলন তেমন একটা পছন্দ হয়নি। তবুও ছেলে যখন মেয়েকে পছন্দ করেছে। তাই তারা এত মাথা না ঘামিয়ে তাবিয়ার হাতে রিং পড়িয়ে দিলেন।

সাফা বেগমের খুঁশি কে দেখে? মেয়েকে এত ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পারবে সেটা তিনি কল্পনাও করেননি।
আর তাবিয়া, সেও ঝোঁকের বসে মনে মনে খুব আনন্দই পাচ্ছে।

– আহমাদ সাহেব বললেন, আমার ছেলে সবেমাত্র দেশে এসেছে। কিছুদিন সে দেশটা ঘুরে ঘুরে দেখবে।
দেশের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করবে। আপনাদের মেয়েকে ভালোভাবে চিনবে জানবে। তাই বিয়েটা একটু দেরীতে হবে।

– মারুফ সাহেব কিছু বলতে যাবে তার আগেই সাফা বেগম বললেন, তাহলে এঙ্গেজমেন্ট টা হয়ে যাক।

– এঙ্গেজমেন্ট আগামী শুক্রবার হবে ইনশাআল্লাহ। সেদিন এসে মেয়েকে নেকলেস পড়িয়ে যাবো।

-নেকলেস পড়িয়ে এঙ্গেজমেন্ট হবে, ভাবতেই আনন্দে আটখানা হয়ে যাচ্ছে সাফা বেগম। মেয়ে বুঝি এবার সুখ রাখার জায়গা পাবেনা।

– আচ্ছা বিয়াই সাহেব এবার আমরা উঠি।
কাল ছেলে মেয়ে একে অপরের সাথে কথা বলে পরিচিত হয়ে নিবে।

– মারুফ সাহেব মুখে হাসি টেনে বললেন জ্বি অবশ্যই।

গেস্টরা চলে গেলে তাবিয়া এক দৌড়ে তাহিয়ার রুমে গেল। তারপর তাহিয়াকে ঘুরাতে ঘুরাতে বলল আপু! আপু! আপু! আই এম ভেরী হ্যাপী।

তাহিয়া তাবিয়ার খুঁশির ব্যাপার টা বুঝতে পারলোনা।
ইতিপূর্বে বিয়ের সমন্ধ এলে তাবিয়া ভ্রু কুচকে না বলে দিতো। অথবা গোমড়া মুখে তাহিয়ার কাছে এসে বলতো যা তো আপু ঐ ভুটকু পাত্রটাকে বিয়ে করে আমাকে উদ্ধার কর। আমার দ্বারা বিয়ে শাদী হবে না। আমিতো প্রেম করতে পছন্দ করি। এক জনের গলার মালা হয়ে সারা জীবন ঝুলতে পারবোনা। আজ সেই তাবিয়া এত খুঁশি, সত্যিই ভাববার বিষয়।

– তাহিয়া শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো, কিরে বোন! তোকে এত খুঁশি দেখাচ্ছে কেন?

– জানিসতো আপু! আজ যে ছেলেটা আমাকে দেখতে এসেছিলো তাকে দেখতে একদম রাজপুত্রের মত।
ওয়াও! কিযে হ্যান্ডসাম আর কতটা স্মার্ট না দেখলে বোঝানো সম্ভব না। উফফ একদম ফাটাফাটি।

– পাগলী বোনটা আমার। তুইও তো দেখতে কম সুন্দরী নস।

– তাতো বটেই। আমি সুন্দরী বলেই তো এত সুন্দর বর পাচ্ছি। তুই কেন সুন্দরী হলিনা? তুই সুন্দরী হলে তুইও আমার মত বর পেতিস।

– শোন! প্রিয় বোন আমার। সুন্দর/সুন্দরী নিজের ইচ্ছাতে হওয়া যায়না। আল্লাহ যাকে যেভাবে সৃষ্টি করেছেন তাকে সেভাবেই সন্তুষ্ট থাকা উচিৎ।

– হুম, তুই আবার অতিরিক্ত প্রভূ ভক্ত।

– এরকম বলতে নেই বোন। আমাদের সকলেরই উচিৎ আল্লাহ প্রেমী হওয়া। দেখিসনা কত যত্ন করে ভালোবেসে আল্লাহপাক সঠিক সঠিক স্থানে নাক চোঁখ মুখ স্থাপন করে কত সুন্দর করে আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ চাইলে আমাদের কপালের উপর চোঁখ আর মুখের নিচে নাক বসিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা করেননি। তিনি খুব ভালোবেসে মনোযোগ দিয়ে আমাদের সৃষ্টি করেছেন। তাই আমাদের উচিৎ সর্ব প্রথম তার প্রশংসা করা এবং তাকে ভালোবাসা। তারপর দুনিয়ার মানুষকে নিয়ে ভাবা। একবার ভেবে দেখেছিস? যে আল্লাহ এই অপূর্ব সৌন্দর্য মণ্ডিত পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। চোঁখ ধাঁধানো মায়া ভালোবাসা আর সৌন্দর্য দিয়ে মানব সৃষ্টি করেছেন। নাজানি তিনি কতটা সুন্দর। যিনি মানুষের অন্তরে এত ভালোবাসা দিয়েছেন। নাজানি তার অন্তরে কত অফুরন্ত ভালোবাসা।

– হুম আপু, আমার মনে হচ্ছে তুই ঠিকই বলছিস।
একদিন আমিও তোর মত প্রভূ ভক্ত হয়ে যাবো। সেজন্য একটু সময় দে।

– আল্লাহ কবুল করুন (আমিন)

– আচ্ছা আপু আমি আসি, তুই থাক।

– ঠিকআছে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে এল।
কিন্তু রাতের কোলে আজ চাঁদ নেই। আছে এক দল মেঘ। আকাশটাকে ছেঁয়ে অন্ধকার আচ্ছন্ন হয়ে আছে।

তাহিয়ার মনেও মেঘ জমেছে। সে যে জানালা দিয়ে সূর্যকে হাসতে দেখে। সেই জানালা খুলে আজ বসে আছে আকাশের কান্না দেখবে বলে। আকাশ কাঁদলে আজ সেও কাঁদবে। কেনো কাঁদবে জানেনা। তবে কাঁদবে প্রচুর কাঁদবে।

অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ২০ মিনিট পর ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি বর্ষিত হতে লাগল। তাহিয়াদের ঘরটা হাফ বিল্ডিং। পুরো অংশ ইটের দেয়াল।শুধু চালটা রঙিন টিনের। সেই টিনের চালে ঝুপঝুপ বৃষ্টির আওয়াজটা ভীষণ আবেগী শুনতে লাগছে। মনে হচ্ছে মা ছাড়া ছোট্ট শিশু মায়ের দুধ পানের জন্য হুমরে কাঁদছে।

তাহিয়ার চোঁখেও অশ্রু নেমে আসতে দেরী লাগলোনা। তার মন আকাশেতো সেই ১৬ বছর আগে থেকেই মেঘ জমে আছে। শুধু বৃষ্টি বর্ষিত হতে দেয়নি। এর আগেও সে অগণিত বার কেঁদেছে। তবে আজকের কান্নাটা অন্যরকম। সে আজ একা নয়, প্রকৃতির সাথে কাঁদছে।
প্রকৃতি তাকে কান্নার ভাষায় নিজের আবেগ প্রকাশ করছে আর তাহিয়া প্রকৃতির কাছে কান্নার ভাষায় নিজের আবেগ প্রকাশ করছে।

কাঁদতে কাঁদতে তাহিয়া চলে গেল সেই আঠার বছর আগের অতীতে।

৭ বছরের ছোট্ট মেয়ে তাহিয়া। আবছা আবছা মনে পড়ে আজও সেই কাহিনি গুলো। হ্যা তার জীবনে ঘটে যাওয়া গুলোকে কাহিনিই বলে।

তাহিয়ার মায়ের নাম ছিলো মারুফা।
মা আর বাবার দুজনের নামের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিল ছিলো। মারুফ + মারুফা। দুজনের মধ্যে প্রচুর ভালোবাসা ছিলো। কিন্তু তার মায়ের গায়ের রং কালো থাকাতে বাবা হুট করেই একদিন দ্বিতীয় বিয়ে করে নিয়ে বাসায় ফিরল। সাথে একটা ৩ বছরের মেয়ে সন্তানও।

মেয়েটা মারুফ সাহেবের নয় তার দ্বিতীয় স্ত্রী সাফা বেগমের পূর্বের স্বামীর ঘরের মেয়ে।

তাহিয়ার মা এসব সহ্য করতে পারেননি। পারেননি ভালোসার মানুষটিকে অন্যের হয়ে যেতে। তাই স্ট্রোক করে অল্প বয়সেই তাহিয়াকে ইয়াতিম করে দিয়ে ইহকাল ত্যাগ করেন। তাহিয়ার মা ছিলো একজন আদর্শ বউ আর আদর্শ মা। সেই অল্প দিনেই তাহিয়াকে ইসলামিক যে আদর্শ গুলো শিক্ষা দিয়েছেন সেগুলোর প্রভাব তাহিয়ার মাঝে আজও বিদ্যমান। ৭ টি বছর তার মা তাকে এতটাই ভালোবাসা আদর স্নেহ মমতা দিয়ে ছিল যে, কেউ সারা জীবনেও বোধহয় এতটা ভালোবাসতে পারবেনা।

তাহিয়া ছোট সময় থেকেই মায়ের সঙ্গে জায়নামাজের পাশে বসে নামাজ পড়ার চেষ্টা করতো। আবার মায়ের নামাজ শেষ হওয়া অবদি অপেক্ষা করতো। মা প্রতি ৫ ওয়াক্ত নামাজেই শেষ করে পবিত্র মুখে তাহিয়ার কপালে চুঁমু একে দিতেন।

আজ মাকে তার প্রচুর মনে পড়ছে। আজ আর বাঁধ মানছেনা। তাই শব্দ করেই কাঁদছে।

কান্না যেন থামতেই চাইছেনা। সে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের গানের একটা কলি বলে উঠল।

– পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি আপন,
সে আমার মা, মা জননী।

মা শুধু ভালোবাসে, কিছু চায়না
হাসি মুখে মেনে নেয় শত বায়না।
অন্যের মা কেনো মা হয়না?
মায়ের মমতা তারা দিতে জানেনা।
এইতো রিতী এটাই নিতী
এটাই হয়তো চির নিয়তী।

গানটা শেষ না হতেই মাথার উপর কারো হাতের স্পর্শে তাহিয়া আঁতকে উঠল!

চলবে……

গল্পঃ মনের মাঝে তুমি

লেখিকাঃ আয়েশা মণি

পর্বঃ ৩

– তাহিয়া পেঁছন ফিরে তাকিয়ে দেখল তার বাবা।
দ্রুত চোঁখের পানি মুছে বলল, বাবা তুমি!

– হ্যারে মা। তোর খুব মন খারাপ তাইনা?

– না, মানে সেরকম কিছুনা। তুমি কিছু বলবে?

– নাহ্, কিছু বলবোনা। আমি জানি আজ তোর ভীষণ মন খারাপ। তুই আজ ঘুমাতেও পারবিনা। তাই আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দেই তুই ঘুমা।

এত বছর পর বাবার একটু আদর পেয়ে তাহিয়া আরো আবেগ প্রবণ হয়ে গেল। সে বাধ্য মেয়ের মত শুয়ে পরল। আর তার বাবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

– কতদিন পর এই পরম আদর। মা মারা যাওয়ার পর বাবা শেষ কবে এভাবে আদর করেছে মনে নেই।
আজ এই আদর পেয়ে তাহিয়ার চোঁখে ৫ মিনিটেই ঘুম চলে এল।

– তাহিয়া ঘুমানোর পর মারুফ সাহেব বেশ কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজের রুমে গেলেন।
আজ কেন জানি মেয়েটার জন্য মনটা কেমন করছে।
সত্যিই আমি যা করছি মোটেও ঠিক করছিনা। অন্যায় হচ্ছে আমার। আমি আমার মেয়েটাকে রিতীমত ঠকিয়ে যাচ্ছি।

কিন্তু কি করবো? আমার যেন মাঝে মধ্যে কি হয়ে যায়। কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক কোন কিছুর প্রতি সেরকম খেয়াল থাকেনা। কেন আমার সাথে এমনটা হয়? এসব ভাবতে ভাবতে মারুফ সাহেব ঘুমিয়ে গেলেন।

– সকালে উঠে প্রতিদিনের মত ফজরের নামাজ পড়ে, রৌদ্র স্নান করে ইশরাকের নামাজ পড়ে নাস্তা বানাতে গেল। নাস্তা বানানো শেষ হলে সবাইকে খায়িয়ে নিজে কিছু খেয়ে নিল।

তারপর একটু রেস্ট নিতে নিজের রুমে গিয়ে বসতেই তাবিয়া চেঁচাতে চেঁচাতে এসে বলল আপু! আপুরে! আমার চুলটা একটু বেধে দে তো।

– আমি!

-হ্যা তুই। এই দেখ অনলাইন থেকে এই স্টাইল টা ডাউনলোড দিয়েছি। এটা একবার দেখে তারপর ঠিক সেভাবেই বেধে দিবি।

– কিন্তু বোন, এরকম স্টাইলে চুল বাধলেতো বোরখার নিকাব বাঁধতে পারবিনা!

– আরে ধুর, এত সুন্দর স্টাইলে মাথা বাঁধলে কি বোরখা পরবো নাকি? উড়না গলায় ঝুলিয়ে গাউন পরে বের হবো।

– কিন্তু বোন তুই যাচ্ছিস কোথায়?

– আরে তোর মনে নেই? আজ মিহরাবের সাথে পার্কে দেখা করবো।

– এটা কি ঠিক হবে বল? এভাবে মাথার চুল বের করে পর পুরুষদের সামনে গেলে কত গুনাহ্ হবে জানিস?

– জানি, সব জানি। মিহরাব পর পরুষ নয়। সে আমার হবু বর।

– বিয়ে হওয়ার আগ পর্যন্ত সে পর পুরুষ। বিয়ের নিয়তে একবার দেখা জায়েজ সে হিসেবে দেখেছে। কিন্তু বার বার দেখা করা, বা এভাবে খোলামেলা ভাবে সামনে যাওয়া একদমই নাজায়েজ।

– তুই এখন আমাকে ওয়াজ শুনাসনা তো।
চুল বাঁধতে এসেছি বলে এত কথা?
যাহ্ লাগবেনা তোকে চুল বাঁধতে।

সাফা বেগম বলে উঠলেন। আরে কাকে কি বলছিস?
ও এসব পারলে তো? কোনদিন আধুনিক স্টাইলে চুল বেঁধেছে? পারেনা বলতে না পেরে এত কথা শুনালো।
তুই পার্লারে যেতিস।

– এতো টাইম নেই বলেইতো আপুকে বলেছিলাম।
দ্রুত বের হতে হবে আমাকে, মিহরাব ওয়েট করছে।

– তাহিয়ার মা চিরুনি হাতে নিয়ে বলল আয় আমি বেঁধে দেই।

সে খুব ট্রাই করেও সেই স্টাইলে চুল বাঁধতে পারলোনা।
তা দেখে তাহিয়া না চাইতেও ফিক করে হেসে দিল।

– কিরে, অকর্মা মেয়ে হাসছিস কেনো? নিজের তো মুরাদ নেই এসব করার। আবার আমি পারছিনা বলে হাসছিস?

– তাহিয়ে মায়ের হাত থেকে চিরুনি নিয়ে বলল, আমি সুন্দর হতে না পারি অকর্মা নই মা।

সাফা বেগম কপাল কুচ করে সরে বসল।

তাবিয়া বলল আপু! এবার যদি তুই না পারিস তাহলে খবর আছে। মা মেয়ে দুজনের মাথা আমি বেল করে দেবো। (তাহিয়া তাবিয়ার কথায় কিছু মনে করলোনা, কিন্তু এই একই কথা যদি তাহিয়া বলতো তাহলে হয়তো সাফা বেগম আর তাবিয়া দুজনে মিলে তাহিয়াকে এতক্ষণ ইচ্ছা মত চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলতো।)

৩ মিনিটেই তাহিয়া খুব সুন্দর করে তাবিয়ার চুল বেঁধে দিল। তাবিয়া আয়নার সামনে দাড়িয়ে ভীষণ খুঁশি।

-বাহ্ চমৎকার আপু, হুবহু অনলাইনে দেওয়া স্টাইলটাই নকল করেছিস। এক নজর দেখেই এত নিখুঁত ভাবে কি করে বাধলিরে?

– সেটা কোন ব্যাপারনা। তুই যাহ তোর টাইম হয়ে গেছে।

– হুম থ্যাংক আপু।

তাবিয়া একটা পিংক কালারের গাউন পরে আর একটা জরজেট ওড়না গলায় ঝুলিয়ে বেড়িয়ে গেল।
তাহিয়াকে এত সুন্দর করে চুল বাঁধতে দেখে সাফা বেগম জব্দ হয়ে ঠোঁট বাকিয়ে চলে গেল।

– তাবিয়া গেইট থেকে বের হতেই দেখল একটা কালো গাড়ি। তারপর গাড়ি থেকে মিহরাব বেড়িয়ে এসে মিহরাব বলল হাই সুন্দরী।

– হাই,কেমন আছেন?

– কেমন আর থাকি বলো? তোমার জন্য সেই কখন থেকে ওয়েট করছি।

– আমি তো ঠিক টাইমেই বের হলাম।

– টাইম দেখো।

– ওপস, সরী। ৭ মিনিট লেইট হয়ে গেছে।

-ইট’স ওকে। গাড়িতে বসো।

তাবিয়া চট করে ড্রাইভিং সিট এর পাশের সিটে বসল।

– আরে আরে কি করছো?

– কি আবার করলাম?

– তুমি আমার পাশের সিটে বসলে কেনো?

– আজব ছেলেতো আপনি! আমি তাহলে কোথায় বসবো?

– না মানে আমি চেয়ছিলাম। আমার পাশে সিটে কোন দিন কোন মেয়ে বসবেনা। আমি এই সিট টা স্পেশালি আমার বউয়ের জন্য রেখেছিলাম।

– আরে কি বলছেন আপনি? আমিতো আপনার হবু বউ।

– হুম হবু বউ। কিন্তু বউ তো আর না।

– তাবিয়ার মনটা খারাপ হয়ে গেল।

– মন খারাপ হলো? আরে এমনি বলেছি। মন খারাপ হয়ে গেলে সরী। তবে তুমি যখন পাশের সিটে বসেই গেছো। আমার বউকে তাহলে পেঁছনের সিটে বসাবো।যাতে আমি আমার প্রিয়তমাকে আয়নাতে দেখতে পারি। আয়নার দিকে তাকিয়ে চোঁখে চোঁখে প্রেম করবো।

– দারুন রোমান্টিক ছেলেতো আপনি। বাট, আপনি এমনভাবে বলছেন যেন আমাকে নয় অন্য কাউকে বিয়ে করবেন।

– হা, হা, হা, তোমার সাথে ফান করলাম।

-সত্যি!

-হুম।

টুকটাক কথা বলতে বলতে ওরা পার্কের সামনে চলে এল। তারপর সারাদিন পার্ক, রেস্টুরেন্ট, সিনেমা হলে ঘুরাঘুরি করে বিকেলে মিহরাব তাবিয়াকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে নিজের বাসায় গেল।

বাসায় পৌঁছতেই আবিদা বেগম (মিহরাবের মা) জিজ্ঞেস করলো, বাবা, মেয়েটাকে কেমন লাগল?

– মা, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা কেমন লাগল। তবে দেশটা বেশি সুন্দর।

– মিহরাবের মা কিছু বুঝলেন না ছেলের হাব ভাব দেখে। কারন ছেলের চোঁখে কোন মেয়ের জন্য সেরকম কোন ফিলিংসই নেই।

– আচ্ছা বাবা ফ্রেশ হয়ে আয় কিছু খাবি।

– না মা, একদম ক্ষুদা নেই। দেশি রেস্টুরেন্টে পছন্দ মত খাবার খেয়ে নিয়েছি।

– ঠিকআছে নিজের রুমে গিয়ে রেস্ট নে।

এদিকে তাবিয়া বাসায় পৌঁছেই মায়ের কাছে সব রোমাঞ্চের কথা বুটিয়ে বুটিয়ে বলছে। সাফা বেগম তো খুঁশিতে আটখানা। মেয়ের সুখেই তার সুখ। বড় মেয়ের সুখ দুঃখ নিয়ে তার কোন মাথা ব্যাথা নেই।

তাহিয়া বাড়ির পেঁছনের বারান্দায় বসে নকশি কাঁথা সেলাই করছে। বাড়ির পেঁছন দিকটাই কিছু ফুল আর ফলের গাছ রযেছে। অনেকটা বাগানের মত। আর সেখানে পাঁখিদের কুজন শুনা যায়। বিকেল বেলা নীল আকাশে স্বাধীন ভাবে উড়ে বেড়ায় পাঁখি গুলো। এগুলো দেখলে তাহিয়ার মনটা একদম ফ্রেশ হয়ে যায়। তাই সে সেখানে বসে কাঁথা সেলাই করছে, আর মনে মনে ভাবছে। তাবিয়া খুব খুঁশি হয়েছে। আল্লাহ যেন ওর আশা পূরণ করেন। মেয়েটা গৃহ বন্দী হোক। সব সময় বেপরোয়া ভাবে চলা ফেরা করে। কত ছেলেদের পকেট ফাঁকা করে। কত ছেলেদের মন ভেঙ্গে দেয়। ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হয়ে গেলে ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ের আগে আমি আর কোন কিছুতে বাঁধা দেবো না । যা চাই করুক, এখন কিছু বললে উল্টো ভাববে আমি ওর ভালো চাইনা। তার থেকে ভালো বিয়ে টা হয়ে গেলে নিরবে সব বুঝিয়ে বলা যাবে। শশুড় বাড়ির কথা ভেবে আর স্বামীর ভালোবাসা পেয়ে আমার বোনটা অনেক ভালো মেয়ে হয়ে যাবে।

বোনের কথা ভাবতে ভাবতেই সে এসে হাজির।

– আপু তোর ফোনটা দে তো।

– এই নে, কি করবি?

– দেখ কি করি।

তাবিয়া দুষ্টুমি করে তাহিয়ার ইমো নাম্বার থেকে কয়েকটা আজে বাজে মেসেজ লিখে মিহরাবের নাম্বারে পাঠিয়ে দিল।

– কি করলি বোন?

– তোর ইমো নাম্বার থেকে কয়েকটা বাজে মেসেজ পাঠালাম।

– কাকে?

– মিহরাবকে।

– কেনো? এটা তুই মোটেও ঠিক করলিনা।

– আরে একটু ঝাঁকিয়ে দেখবো কতটা পিওর ছেলে। যদি সেও মেয়েদের মেসেজ দেখে ন্যাকা ন্যাকা মেসেজ করে তাহলে বুঝবো ভালো ছেলে নয়। আর যদি রিপ্লাই না দেয় তাহলে বুঝবো ভালো ছেলে।

– আমার বিশ্বাস সে রিপ্লাই দিবেনা তুই দেখে নিস। তবে আমার নাম্বার থেকে মেসেজ করে ঠিক করলিনা। কি ভাববে বলতো?

– আরে আপু, নিজের বোনের এইটুকু হেল্প করবিনা? তাহলে কেমন বড় বোন?

– আচ্ছা ঠিকআছে।

২০ মিনিট হয়ে গেল মিহরাব রিপ্লাই দিলোনা।

তাহিয়া বলল দেখলিতো? রিপ্লাই দিবেনা। তোর হবু বর খুব ভালো ছেলেরে। যা তোকে এত টেনশন করতে হবেনা। নিজের রুমে যা।

– তাবিয়া উঠে দাড়াতেই যাবে ঠিক তখনি তাহিয়ার ফোনে মিহরাবের কল এল।

তাবিয়া বলল দেখলি আপু! মোটেও ভালো ছেলে নয়।

– তোর যেরকম চিন্তা ভাবনা তুই সবাইকে সেরকম ভাবিস।

– আচ্ছা ভাবলামনা। তুই কলটা রিসিভ কর।

– আমি, পারবোনা বোন। ক্ষমা কর।

– তোকে এটা করতেই হবে। না হলে তোর সাথে কথা বন্ধ।

– ঠিকআছে আমি রিসিভ করছি।
তাহিয়া রিসিভ করে সালাম দিল।
মিহরাব সালাম ফিরিয়ে বলল। আপনার মত জঘন্য মেয়ে আবার সালামও দিতে জানেন?
বাহ্ দারুন। কি চরিত্র আপনার। এই সমস্ত মেসেজ যারা করতে পারে তারা যে কতটা নিচু আর সস্থা মানসিকতার মেয়ে তা আমার বুঝা শেষ। কোন সাহসে আপনি আমাকে এই সব মেসেজ করেছেন? আপনার কি লজ্জা সরম নেই নাকি? ছিহ্, ফালতু মেয়ে কোথাকার। আর যদি এই নাম্বারে মেসেজ করেছেন তো আপনার জিভ টেনে ছিড়ে ফেলবো। অসভ্যের গোড়া।

একাধারে এতগুলো কথা বলে মিহরাব কল কেটে দিল। তাবিয়া তার উত্তর পেয়ে গেছে। তার হবু বর খুব ভালো ছেলে, তাই সে আনন্দে নিজের রুমে চলে গেল। তাহিয়া যার জন্য এত ভাবে, তার জন্য তাবিয়া
একটু অনুতপ্তও হলোনা যে, বোনকে নিজের জন্য কত গুলো অপমান সহ্য করতে হলো।

তাবিয়া চলে গেল৷ তাহিয়া কান্নায় ভেঙ্গে পরলো।
সে এ জীবনে অনেক কটু কথা শুনেছে। তবে আজ পর্যন্ত কেউ তার চরিত্রের দিকে আঙ্গুল তুলতে পারেনি। আর সেই স্থানে বিনা অপরাধে তাকে এত বাজে কথা শুনতে হলো। যেখানে সে জানতোই না তাবিয়া কি মেসেজ করেছে। এই অপমানটা সে সহ্য করতে পারছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। উড়না দিয়ে মুখ ঢেকে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here