মনের মাঝে তুমি #পর্বঃ ১২ (অন্তিম পর্ব )

0
687

#গল্পঃ মনের মাঝে তুমি
#পর্বঃ ১২ (অন্তিম পর্ব )
#লেখিকাঃ আয়েশা মণি

মিহরাব বই মেলায় গিয়ে ১৩ নাম্বার স্টল খুঁজতে লাগল। অল্প সময়ের মধ্যে পেয়েও গেল। তবে সেখানে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। কম করে হলেও দু’শত মানুষ দোকানটা ঘিরে আছে। সবাই একে অপরকে ঠেলাঠেলি করছে। মানুষের মাথার জ্বালায় দোকান দেখা যাচ্ছেনা।

মিহরাবকে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখে পাশের দোকানের একজন লোক বলল, কি সাহেব! বই লাগবে? এদিকে আসেন। মিহরাব বলল না, মানে এই ১৩ নাম্বার স্টলে এত ভীড় কেনো? অন্যান্য দোকান গুলোতে তো ১০ জন মানুষও নেই।

– হা,হা হা,মেলায় এসেছেন অথচ এটা জানেন না? যে ঐ ১৩ নাম্বার স্টলে কার বই আছে?

– কার বই আছে?

– আরে সাহেব! এই স্টলে লেখিকা তুবা জান্নাতের বই আছে। এবছরের উপন্যাস জগতের সেরা লেখিকা।
এ বছর যত লেখকের বই বের হয়েছে সব স্টলেই পড়ে আছে। আমরা পাঠকদের ডেকে ডেকে বই বিক্রি করছি তবুও নিতে চাইছেনা। অথচ তুবা জান্নাতের বই একই ফ্যামেলীর সবাই নিচ্ছে।

দোকানদারের কথা গুলো যেন বিশ্বাসই হচ্ছেনা, তুবা আজ তাকে এত বড় সারপ্রাইজ দিবে ভাবতেই পারেনি মিহরাব।

খুঁশিতে মনটা মাতোয়ারা হয়ে উঠছে।
মিহরাব শত মানুষের ভীর ঠেলে স্টলে প্রবেশ করলো।

তুবা সেই সময় অটোগ্রাফ লেখায় ব্যস্ত ছিলো।
পাঠকরা বই কিনে অটোগ্রাফের আশায় দাড়িয়ে আছে।অন্যদিকে আরো পাঠক এসে ভীর জমাচ্ছে।
গার্ডিয়ান রা সামাল দিতে পারছে না। সবার’ই বই কিনার সাথে সাথে প্রবল ইচ্ছে তুবা’র সাথে একটু কথা বলতে, কিন্তু সেটা হয়ে উঠছেনা।

মিহরাব স্টলের ভেতরে প্রবেশ করতেই যেন মনে হল অন্য এক জগতে প্রবেশ করেছে। যথেষ্ট বড় দোকানটা! ভর্তী সুন্দরভাবে সাজানো হাজার হাজার বই।
সব গুলোতেই তুবার নাম। সেই দোকানে আর অন্য লেখকের বই নেই। অসাধারণ প্রচ্ছদ, তার উপর বড় করে লেখা “মনের মাঝে তুমি”

বইটার নাম দেখে মিহরাবের মনটা আরো নেঁচে উঠল।
এত খুঁশি বোধহয় সে জীবনে হয়নি।তারপর একটা বই হাতে নিয়ে উন্মাদের মত চুমু খেতে লাগল।

তুবা আড় চোঁখে দেখছে তার প্রিয়তমের পাগলামী। কতটা ভালোবাসলে এতটা পাগল হওয়া যায়?
তুবা’র এখনি ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে মিহরাবকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু এত লোকের মাঝে এটা করা মোটেও ঠিক হবে না।

মিহরাব চোঁখ বন্ধ করে প্রাণ ভরে বইয়ের ঘ্রাণ নিচ্ছে।
মিহরাবের কান্ড দেখে সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই বলছে এইযে আপনি কি করছেন? সরেন। কিন্তু মিহরাব কারো কথাই শুনতে পাচ্ছেনা।দোকানের মালিক তুবাকে বলল ম্যাডাম! ঐ লোকটা কি সব করছে? তুবা হাতের ইশারায় বুঝালো, থাক।
দোকানদার আর কিছু বলল না।

মিহরাবের এতক্ষণ পর মনে হল তুবার কথা, সে চোঁখ মেলে এদিক সেদিক তাকাতে লাগল। কিন্তু আশেপাশে প্রতিবন্ধি এমন কোন মেয়েকে দেখতে পেলোনা।
মনে মনে ভাবল হয়তো তুবা আসেনি। কিন্তু তুবাকে যে এখন দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছে।

ক্রমেই পাঠকদের ভীর বাড়তেই আছে। এখন প্রায় লোক ৪০০/৫০০ এর মত চলে এসেছে।

এত মানুষের ভীরে তুবাকে আমি কি করে পাবো?
ভাবতেই চোঁখ পড়ল স্টলের ভেতরে বইয়ের স্তুপের আড়ালে একজন হাত মোজা পা মোজা ওয়ালা কালো বুরখা পরিহিতা কারো উপর। কোন একটা মেয়ে মনে হচ্ছে। এই মেয়েটি কে? তুবার পরিবর্তে সে কেন অটোগ্রাফ লিখছে? মেয়েটি অটোগ্রাফ লিখছে আর কর্মচারীরা এক এক করে পাঠকদের হাতে পৌঁছে দিচ্ছে। হয়তো তুবা প্রতিবন্ধি তাই এত অটোগ্রাফ লিখতে অক্ষম সেজন্য এই মেয়েটিকে বসিয়ে দিয়েছে।

মিহরাব এক দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল।
তুবা বুঝতে পারল মিহরাব তাকিয়ে আছে। তাই সে আর না তাকিয়ে পারলো না।

তুবা মিহরাবের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাঁচাল, তারপর চোঁখ মেরে দিল। মিহরাব ব্যবাচাকা খেয়ে গেল।

এবার তুবা তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
মিহরাব বুঝতে পারছে না মেয়েটি কেন তাকে দেখে এরকম করছে। সে হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইল।
তুবা এগিয়ে এসে মিহরাবের হাত ধরে সকল পাঠকদের উদ্দেশ্য করে বলল।

প্রিয় পাঠক/পাঠিকারা! আজ আমি আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি। এতদিন আপনারা অনেক চেয়েছেন আমার সাথে একটু কথা বলার কিন্তু হয়ে উঠেনি। আর হয়তো হবেওনা। তাই আজ আমি আমার পরিচয় দিচ্ছি।

আমি তাহিয়া জান্নাত তুবা,
মা হারা এয়াতিম একজন মেয়ে।
বাবার নাম মারুফ। তিনি সামান্য একজন চাকুরী জিবি। তবে সৌভাগ্যক্রমে বর্তমান আমি ঢাকার নামকরা বিজনেস ম্যান আহমাদ সাহেব এর এক মাত্র পুত্র বধু। এম, বি বি এস ডক্টর মিহরাব সাহেব এর স্ত্রী।
আজ আপনাদের দোয়া আর আমার প্রিয় স্বামীর অনুগ্রহ, অনুপ্রেরণায় আজ আমি লেখালেখির জগতে ক্ষুদ্র এক লেখিকা। আমার হাজারো জমানো অনুভূতি দিয়ে লেখা আপনাদের জন্য এই ছোট্ট উপহার
“মনের মাঝে তুমি” উপন্যাসটা।

( তাহিয়ার কথা শুনে মিহরাবের চোঁখ বড় বড় হয়ে গেল,কালো নিকাব দিয়ে মুখ ঢেকে থাকার কারনে বুঝা যাচ্ছেনা, সে আসলেই তার স্ত্রী তাহিয়া কিনা। এটা কি করে সম্ভব?)

তাহিয়া এবার মিহরাবের দিকে তাকিয়ে হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, আমার একটু একটু করে জমানো ভালোবাসা। আমার হৃদয়ের স্পন্দন। আমার অক্সিজেন। আমার নয়ন। আমার ভোরের সূর্য।
আমার প্রিয় স্বামী এখন দূরে নয়,আপনাদের’ই সামনে।
যার চোঁখে আমার চোঁখ, যার হাতে আমার হাত।

সবার দৃষ্টি মিহরাবের দিকে পড়ল।
তাহিয়ার কিছু ভক্ত এক ঝুড়ি ফুল এনেছিল।
তারা সকলেই মারহাবা মারহাবা বলে মিহরাব আর তাহিয়ার উপর ফুলের বৃষ্টি ঝড়াল।

সেই ফাঁকে তাহিয়া মিহরাবের কানে ফিসফিস করে বলল, এই! কেমন সারপ্রাইজ দিলাম?
জানোতো? আমিই তোমার তাহিয়া, আমিই তোমার তুবা। তুমিই আমার মিহরাব, তুমিই আমার ভোরের সূর্য।

মিহরাব স্তব্ধ হয়ে গেছে, খুঁশিতে সে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।

তাহিয়া বলল, I really love u..

এবার মিহরাব আর নিযেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না। ভুলে গেল এটা পাবলিক প্লেস। সে তাহিয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আর আবেগ ঝড়া কন্ঠে বলল,এই পাগলি! তুই কেন আমার সাথে এত দিন লুকোচুরি খেলেছিস? কেন তুই বলিসনি তুই আমার সেই কলিজা। কেন আমায় এভাবে কষ্ট দিলি বল? তুই কেন বললিনা? তুই আমার তুবা,যে কিনা আমার ভালোবাসা।

– আরে পাগলু যদি আগেই সব বলে দিতাম, তাহলে আজকের দিন পেতে না।

কিন্তু তুমি আমায় মিথ্যে কেন বলেছিলে যে তুমি প্রতিবন্ধি?

– কৈ মিথ্যেতো তো বলিনি আমি আমিতো সত্যিই তোমার ভালোবাসায় প্রতিবন্ধি। তুমি কি জানো?
কত বার আমি তোমার সাথে কথা বলতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি?

পাগলিরে! এত বড় সারপ্রাইজ যে আমি নিতে পারছিনা। যাকে, জেগে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। হাজারো বার কল্পনায় আকতাম। হাজারো আকাঙ্খা বুঝে চাপা দিয়ে রাতে ঘুমাতে যেমন আর অথচ এটাই জানতামনা সে আমার নিযের স্ত্রী যে আমার শুধুই আমার।

ইতি মধ্যেই সেখানে মিহরাবের বাবা মা উপস্থিত হলেন।

– আহমাদ সাহেব এগিয়ে এসে বললেন সুবহানাল্লাহ,
হুর গেলমানের মিলন হয়েছে।

বাবা’র আওয়াজ শুনে মিহরাবের হুশ হল, এটা পাবলিক প্লেস। সে দ্রুত তাহিয়াকে ছেড়ে দিল।

তাহিয়া শ্বশুর শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলল বাবা! মা! আপনারা এখানে?

আবিদা বেগম বললেন,আমার এত সলেব্রেটি বৌ’মার খবর আমাদের নিকট পৌঁছতে কি আর সময় লাগবে নাকি?

তাহিয়া লজ্জা পেল।
তারপর মেহনাজ বলল ভাবী! ভাইয়্যা কি জেনে গেছে তুমিই তাহিয়া?

– হুম।

এ মা! তাহলে এখন ভাইয়্যা আবার তোমায় ছেড়ে দিবেনা তো?

আহমাদ সাহেব বললেন, কে আমার মিষ্টি বৌ’মাকে ছেড়ে দিবে শুনি? তার ঠ্যাং ভেঙ্গে দিবো।

– মিহরাব ভালোবাসা মিশ্রিত সুরে বলল, ছেড়ে দেওয়ার জন্য কি ভালোবেসেছি? সারা জীবন হৃদ মহলে বন্ধি করে রাখবো।

তাহিয়া আর মিহরাবের পবিত্র ভালবাসা দেখে পাঠকগন বিষ্মিত হয়ে গেল। তাদের প্রায় সবার চোঁখ’ই ছলছল। তাদের পরম প্রিয় লেখিকার রিয়েল লাইফেই এত বিষ্ময়কর কাহিনি ভাবতেই পারেনি তারা।

এদের মাঝে দূরে দাড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন তাহিয়ার বাবা মারুফ সাহেব।

হঠাৎ এই খুঁশির আমেজে তাহিয়ার চোঁখ পড়ল তার বাবার উপর।সে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গিয়ে বলল বাবা!
তুমি? তাহিয়ার বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলল, মা’রে আজ তোর এত সম্মান। যদি তোর মা দেখতেন কত খুঁশিই না হতেন। তোকে আমি বাবা হয়েও ভালোবাসা আদর স্নেহ দিতে পারিনি, অথচ কত শত মানুষ তোকে ভালোবাসে। মা’রে! তুইযে হিরের একটা টুকরো তোকে আমরা চিনতে ভুল করে কত’ই না অবহেলা করেছি। কত কষ্ট করেছিস তুই জীবনে। আজ তুই পূর্ণতা পেয়েছিস। ভালোবাসা, শান্তি, সুখ সব পেয়েছিস, যা তোর পাওয়ার ছিলো। তোর বিশুদ্ধ মন আজ বিজয়ী হয়েছে। আমায় ক্ষমা করে দে মা। তোর সাথে বড় অন্যায় করেছি।

– প্লিজ বাবা, এভাবে বলো না।
আমার তোমার প্রতি কোন অভিযোগ নেই।

তোর মা (সৎ) আর তাবিয়া তাদের এখন নিযের কৃত কর্মের জন্য অনুতপ্ত। তারা লজ্জায় তোর সামনে আসতে পরেনি। তুই তাদের ক্ষমা করে দে মা।

– বাবা! আমার আল্লাহ বান্দাদের এত অপরাধ ক্ষমা করে দেন। আর আমি তার বান্দা হয়ে ক্ষমা করবো না?
আমি সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি বাবা।

তাহিয়ার কথা শুনে তার বাবা খুঁশি হলেন।
মিহরাবের বাবা এগিয়ে এসে বললেন থাকনা বিয়াই সাহেব। আপনারা নিযেদের ভুল বুঝেছেন এটাই অনেক। তাছাড়া আপনার মেয়েকে আর আমরা কষ্ট পেতে দিবোনা। সে জীবনে প্রচুর কষ্ট করেছে। আজ এত মর্যাদা সে তার নিয যোগ্যতায় পেয়েছে।
আল্লাহ পাক তাকে নিশ্চয়ই উত্তম প্রতিদান দিবেন।
এরপর জোড়ে বললেন, সবাই দোয়া করবেন আমার বৌ’মার জন্য। যেন আমার বৌ’মা দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানেই সম্মানিত হন।

সকল পাঠকরা এক বাক্যে বলে উঠল আমিন।
আল্লাহ আমাদের প্রিয় লেখিকাকে ভালো রাখুন।
তার থেকে আমারা জীবনে অনেক কিছু শিখলাম।
তাকে দেখে আমাদের জীবনটাই বদলে গেল।
আজকের পর থেকে আমরা তাকে অনুসরণ করবো।
আমরা নামাজ পড়বো, পর্দা করবো, অন্যের প্রতি অনুগ্রহ করবো। সকলের ভুল ক্ষমা করে দিবো।
আমরা এখন থেকে ধৈর্যের সাথে সব কাজ করবো।
তবেই জীবনে সফলতা অর্জন করতে পারবো।

– রাইট।

– মিহরাব বলল, আচ্ছা এবার তো তোমাদের লেখিকা সাহেবাকে ছুটি দাও।

কয়েকজন পাঠক বলল, জ্বি সাহেব সাহেবা আপনারা যান। আরে তোমরা সবাই ভীর ছাড়ো, সবাই তো এতক্ষণ চুপ করে ছিলে। এবার সেভাবেই চুপচাপ বই আর অটোগ্রাফ নিয়ে নিযেদের বাড়ি চলো। প্রিয়দের এবার ছেড়ে দিতেই হবে, তারা রোমান্স করবেতো।

তাহিয়া লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
মিহরাব তার বাবাকে বললো, তোমরা পেঁছনে অন্য গাড়িতে আসো। আমরা দুজন তোমাদের গাড়িতে চলে যাচ্ছি।

– ঠিকআছে।

সবাই বলল, সাবধানে যেও ফীআমানিল্লাহ।

মিহরাব তখন দুম করে তাহিয়াকে কোলে তুলে নিল।
তারপর গাড়ির দিকে পা বাড়াল।

– তাহিয়া বলল, এই! কি করছো সবাই দেখছেতো।

চুপ, একদম চুপ।
অনূভুতির আড়ালে, কি চমক দেখালে।
এক অদ্ভুত ভালোবাসায় জড়িয়ে
আমায় পাগল করে ছাড়লে।
নড়ে চড়ে উঠোনা, কোন কথা বলোনা না,
চুপটি করে থাকো প্রতিবন্ধি হয়ে,
এই, মনের মাঝে – তুমি।

#সমাপ্তী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here