অঘমর্ষণ (অন্তিম পর্ব)

0
640

#গল্প: অঘমর্ষণ (অন্তিম পর্ব)
লেখা: মারইয়াম জামীলা

১১.

সানসেট রুফটপ লাউঞ্জের কাস্টমারদের একটা জটলা কাঁচের রেলিঙের বাইরে বিপদজনকভাবে দাঁড়ানো মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। ইতোমধ্যে মেয়েটা কয়েকবার হুমকি দিয়েছে তার কাছে যাবার চেষ্টা করলে ‘ভালো হবে না’। এক পা বাড়িয়ে দিলেই নয় তলা থেকে পড়ে গিয়ে শরীরের পরিণতি নিশ্চিত বেগুন ভর্তা, পোস্টমর্টেমের জন্য কিছু আস্ত থাকলেও সে ডাক্তার সাহেবদের কপাল। উৎসুক হয়ে থাকা মানুষ আর মেয়েটার মাঝে তফাত কেবল একটা অগভীর সুইমিং পুলের। এতক্ষণের বিরতিহীন বারিষে মেয়েটার পরনের কাপড়চোপড় ভিজে গাঢ় রঙ ধরেছে। মাথায় ভাঁজ করে বাঁধা হিজাবটা বাতাসের দাপটে এক কোনা ছেড়ে সমানে উড়ছে। বারিধারার সাথে পাল্লা দিয়ে বাতাসের প্রবলতাও কয়েক মিনিটে গতি হারিয়েছে বেশ। বৃষ্টির কণাগুলো বাতায়নে নিখুঁত করে না দেখলে দৃশ্যমান মনে হয় না। রেস্তোরাঁর এই অংশে বড় বড় ছাতা বসানো হয়েছে গোল টেবিলের উপর। প্রতি টেবিলের দখলে চারটা করে চেয়ার। সুইমিংপুলের নীল পানিতে ছয় থেকে সাতটা কৃত্রিম লাল শাপলা হাসছে। বাতাসে খাবারের মুখরোচক সুঘ্রাণ, কাঁচা ফুলের সৌরভ মাতানো বাসরের মতোই সাজানো পরিবেশ, প্রত্যেকটা কর্মী পা হতে মাথা পর্যন্ত পরিপাটি হয়ে নতুন হুকুমের অপেক্ষা করে, দিনের বেলাতেও আর্টিফিশিয়াল ঘাসের কার্পেটের উপর হাঁটার জায়গায় দু’পাশে হারিকেন জ্বলছে। কিন্তু এই গোঁছানো কৃত্রিম সৌন্দর্যে কারো বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই এই মুহূর্তে। পরিবেশের প্রতি বিরক্ত কিছু মানুষ নাটক দেখার ভঙ্গিতে কপাল বটে চেয়ে আছে।

একটা মেয়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচামেচি করে বলছে, “…আজকে যদি আমি মারা যাই তবে এর দায় কে নেবে? আমাদের খোঁড়া আইন না এদেশের আটপৌরে জনগণ? আজকে এখন, এই মুহূর্তে আমি মারজানা মেহুল আখতার এখান থেকে যদি লাফিয়ে পড়ে জীবন বিসর্জন দেই তবে এই লজ্জা কি প্রশাসন নিবে? আমাকে দিনের পর দিন পথেঘাটে একা পেলেই কিছু মানুষের শরীরে বন্দি নরপিশাচরা উত্ত্যক্ত করে যাচ্ছে, আমাকে দিয়ে জোর জবরদস্তি করিয়ে ভিডিও বানাচ্ছে আবডালে বসে… আর এদিকে অফলাইন অনলাইনে এসব দেখে একদল আনন্দ লুটছে। তারপর হুট করে এসে গায়ে পড়ে সেসব উল্লেখ করে ঝামেলা করছে। পাবলিক প্লেসেই তারা এসব করছে, এই রেস্টুরেন্ট তার বোবা সাক্ষী। আপনারাই বলুন, যদি কোনোদিন এই অবস্থা নিয়ে ধর্ষিতা হই সমাজ কী আমাকে বিন্দুমাত্র সহমর্মিতা দেখাবে না কি দাবি করবে, ‘এই মেয়ে আগে থেকেই এমন ফষ্টিনষ্টি করত, এখন দেখাই যাচ্ছে আসল চেহারা’! আমাকে বলুন এই দেশে এত আইন আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রেখে কী লাভ যদি বিশৃঙ্খলাই থেকে যায়? কী লাভ যদি কোনো এক সকালের পত্রিকাকে ধর্ষণ, খুন আর গুম সংবাদমুক্ত না করতে পারেন? কী লাভ যদি ভুক্তভোগীকে সমাজের কাছ থেকে পাওয়া দোষারোপের কবল থেকে বাছতে মৃত্যুর কাছে ধর্ণা দিতে হয়? আমি তো বলব, সমাজের চোখে ওই পাপিষ্ঠ মানুষগুলোর আত্মহত্যা দেখার আগে আইনের বলি দিন, অন্তত বিনা আফসোসে আমরা মরব। আমাদের ভুক্তভোগীদের কী করা উচিত তাও বলে দিন। কোন বিধানটা এখন আপনারা আমাকে জানাবেন, আত্মহত্যা মহাপাপ না এই জীবন তোমার অভিশাপ?” মেয়েটার কথা সামান্য চাপা পড়ল আকাশের গর্জনে। তারপর আবারও শোনা যেতে লাগল বজ্রের উত্তাপে, “আজকে আমি মানুষ হাসাতে এখানে দাঁড়াইনি, আমি এত জনগণকে সাক্ষী রেখে মানসিক চাপে দগ্ধ হওয়া এই দেশের শেষ আত্মহত্যাকারী নারী হতে এখানে এসেছি। আমি চাই এই মৃত্যু দৈনিক পত্রিকাগুলোর পাতায় পাতায় মানবিকতার ভিত নাড়িয়ে পুনরুত্থান ঘটাক, আইনের গাফেল সিপাহিদের চোখে একটু রোদ উদ্ভাসিত হোক, আমার সমালোচনাকারী বাবা-মায়েরা নিজেদের ছেলেমেয়েদের বিষয়ে মনোযোগী হোক…”

সাংবাদিক কিংবা ইউটিউব সাংবাদিকদের কেউ কেউ দু’চারটা প্রশ্ন ছুঁড়ছে, কেউ কেউ চাপা গুঞ্জন সৃষ্টি করে অস্পষ্ট অনেক কথাই বলছে, ফাঁকা বুলি আওড়িয়ে কেউ কেউ মিথ্যা সান্ত্বনার দোহাই দিচ্ছে। লোকমুখের নিসৃত বাণীর প্রতি ভ্রূক্ষেপহীন মেয়েটা, সে নিরবচ্ছিন্নভাবে উচ্চকণ্ঠে বলছে নিজের কথা। গলার স্বরের উপর চাপ বেশি পড়ায় মাঝে মাঝে দু’একবার কাশিও এসেছে। বলার এক পর্যায়ে সে লাফ দিতে উদ্যত হলো। নিচে দেখা যাচ্ছে অনেক মিডিয়াকর্মীই এসে উপস্থিত হয়েছে। মিডিয়াকর্মীদের একদলের মনোযোগ তার দিকে, অন্য একটি অংশ ক্যামেরা তাক করেছে ভেজা রাস্তায় স্প্রে পেইন্ট দিয়ে লেখা একটি বাক্যের প্রতি,
”আত্মহত্যার চেষ্টাকারীর শাস্তি দণ্ডবিধির ৩০৯ নং ধারা অনুযায়ী এক বছর কারাদণ্ড।”
এক অপরিচিতা মহিলার পাশে দাঁড়ানো একটা মেয়ের হাতে স্প্রে পেইন্টের বোতল দেখেই বোঝা গেল এই কর্মের সম্পাদক সে। কারো কাছ থেকে একটা মেগাফোন জোগাড় করে সারা জীবনের সমস্ত ভক্ষণকৃত ফাস্টফুডের শক্তি একত্র করে চেঁচাচ্ছে, “জেলখানায় নান গ্রীল পিৎজা কোনোটাই পাওয়া যায় না। ওখানে এক বছর পার করে এলে ক্যাভিয়ার খাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ পাকস্থলীটাও অখাদ্যে অভ্যস্ত হয়ে যাবে”।

এত মানুষের ভিড়ে উপরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার একটুও চিনতে কষ্ট হলো না এই মেয়েটাই আয়েযা। শূন্যে বাড়িয়ে দেওয়া পা পিছিয়ে নিল সে অশ্রুসিক্ত লোচনে, মুখে ফুটে উঠেছে স্মিত হাসির রেশ। বড়ই আকষ্মিক সে মুহূর্ত!

১২.

– “আমি তো আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মহাপাপ লেভেলের কাজটা থেকে সরে এসেছি, এবার আপনাদেরকেও উচিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে দুই মহাপাপী দলকে আইনের আওতায় আনা।” আত্মপক্ষ সমর্থন করে যুক্তি দেখাল মেহুল।

পাশে আয়েযাও মাথা নাড়ছে সমানে। কণ্ঠে আবেগ ফুটিয়ে বলল, “জি আংকেল, একজন আইনকে সম্মান দেখিয়ে অপরাধের মুখ থেকে ফিরে এসেছে। আইনের লোকেরা কি তাকে সম্মান করবে না? তাকে ভালো হওয়ার সুযোগ দিবে না? দুই মহাপাপী দলকে খুঁজে আনবে না?

– “দুই মহাপাপী দল?” ভ্রুকুটি করলেন অফিসার।

– “এক পাপিষ্ঠ গোষ্ঠী তো আমার সাথে খারাপ আচরণ করছে সেটা তো বলেছি, আর এই যে মেয়েটার চেহারার এদিকটা দেখুন, যারা একাজটা করেছে ওরা দ্বিতীয় গোষ্ঠী।” আয়েযার দিকে ইশারা করে মেহুল।

– “কিন্তু এই কথাগুলো তো আগেই বলা যেত, মরতে যাওয়ার কী দরকার ছিল?”

– “আর বলবেন না আংকেল; আসলে এখানে আসা আর মরতে যাওয়া, দুইটার আগেই ওর কাউন্সিলিং টেবিলে বসা উচিত ছিল। ও যে কোন প্রকারের উন্মাদিনী সেটা বলারও সীমা আছে। ওর মধ্যে দুইটা ক্ষতিকর জিনিস তাল বেতাল আকারে বাড়ে, প্রথমটা পাগলামি, দ্বিতীয়টা শরীরের মেদ-চর্বি। এই যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে আমার মাথাও অর্ধেক খেয়ে…” আয়েযা কথাগুলো বলতে মেহুলের প্রতি দৃষ্টি ফেলল। মুখ ফুলিয়ে মারমুখো উদ্বেগ। বাকি কথাটা চেপে গেল আয়েযা।

– “উনি কী সত্যি বলছেন?” পুলিশ সদস্য জিজ্ঞেস করলেন।

– “আরে! আপনি পাগলকে জিজ্ঞেস করছেন পাগলামির কথা? আক্কেলদাঁত কি এই বয়সেই পড়ে গেল না কি?” আয়েযাই জবাবটা সমানে সমানে দিলো।

মেহুল অবশ্য চুপ থাকার ধৈর্য রাখতে পারেনি। যেন তার পাগলামির প্রমাণ স্বরূপ বলে উঠল, “সামান্য মরতে গেলাম আর পাগলামি হয়ে গেল, হ্যাঁ? এই মানুষের বাচ্চা ঘোড়াকে জিজ্ঞেস করুন আংকেল, আমি যতবার ক্যান্টিনে খেতে না যাওয়ার অভিমানে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি তার একবারও অনশন ভাঙাতে এগিয়ে আসেনি ও। আমি টানা সতেরো ঘণ্টা আঠারো মিনিট বিশ সেকেন্ড না খেয়ে মহোন্নত ক্ষুধার যন্ত্রণা ভোগ করার পর যখন পেট ভরে বিষ খাওয়ার শখ করেছি তখন এই আবুলের বিবি হাবলি কী করল জানেন? বলে কি না পেট ভরে খেতে দিবে না, ওইখানেও তাকে ভাগ দিতে হবে? এই মানুষের বাচ্চা আইনলঙ্ঘনকারিণী ঘোড়াকে এই পৃথিবীতে যথেষ্ট সহ্য করেছি, মরার পর হাশরের মাঠে এক সেকেন্ডও পারব না। উফ!”

– “তুই আগে ঠিক কর্ আমাকে কোন নামে ডাকবি, আবুলের বিবি হাবলি না কি মানুষের বাচ্চা ঘোড়া? নিজে তো একটা অঘটনটন…”

– “অঘটনঘটনঘটীয়ান; একটা নামে আমাকে ঠিক করে পারিস না আবার নিজে আবুলের বিবি ঘোড়া ডাকনামের স্বপ্ন দেখিস। আবুল ঘোড়ারা তোকে দেখে গাল লাল করে ফেলে লজ্জায় জানিস না?”

– “কেন বিবি সাহেবা এলে আবুল ঘোড়ারাও লজ্জা পায় না কি? তাছাড়া তুই বলেছিলি…”

– “অ্যাই যে, এসব কী হচ্ছে? এখানে এসে ঝগড়া শুরু করেছেন? যাকে যেটা জিজ্ঞেস করছি সে শুধু সেটা বলবেন, অন্যজন চুপ থাকবেন।” পুলিশ অফিসার টেবিল চাপড়ে যথাক্রমে দু’জনের দিকে ফিরলেন। মেয়েদুটোর কথা কষাকষিতে এখন ঠিক কার কাউন্সিলিং করা প্রয়োজন তিনি বুঝে উঠছেন না। সম্ভবত কাউন্সিলিং তার নিজেরই প্রয়োজন।

– “আংকেল, নিজেরাই দেখলেন একটু আগে মৃত্যুর সাথে এক দফা দাবা খেলে এসেছি। এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না, প্লিজ। এখানে ভালো গ্রিল থাকলে দেন। আমার পেট অশান্তি তো জগত ভ্রান্তি।” মেহুল চেয়ারে পিঠ ফেলে নেতিয়ে পড়ে কুচি বোরকার উপরে পেট হাত চেপে ধরে।

মেহুল আত্মহত্যা থেকে বিরত হয়ে পিছিয়ে আসার পর পরই ডজন খানেক মাইক আর ক্যামেরা উড়ে এসে জুটেছিল। কে জানে কার ফোনকল পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেদের বদনাম আর সহ্য করতে না পেরে তারাও হানা দিয়েছে এখানে। মেহুলকে সেখান থেকে জিপে তুলে থানায় নিয়ে আসা হয়। ফেসবুক লাইভ আর ইন্টারনেটের কল্যাণে ইতোমধ্যেই ভাইরাল গার্ল মেহুলের এইসব কর্মকাণ্ডও আলোড়ন ফেলে দিলো। থানায় এনে সমানে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে মেহুলের। আয়েযাও আছে। পুলিশের আগে থেকেই সন্দেহ ছিল এরা একে অপরকে চিনে; না হয় কে কার চিকেন গ্রিল, পিৎজা খাওয়ার অফারে আত্মহত্যা থেকে ফিরে আসে! উত্তরে আয়েযা অবশ্য বলেছিল, “আমাদের মিরপুরের গ্রিল খেয়েছেন কোনো জনমে? একবার খেয়ে দেখবেন, ভবিষ্যতে নতুন কোনো গ্রিলের ঘ্রাণ নাকে আসলে আপনিও সুইসাইড ডেট পিছিয়ে দিবেন!”

– “হ্যাঁ, বেঁচে যখন আছো তখন পেট পূজোর দিন বহুত আসবে। এখন আমাদের বলো যে সামাজিকভাবে হেনস্তার খপ্পরে পড়েছ তাই বলে জেদের বসে সরাসরি গিয়ে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে যাবে এত মানুষের সামনে? কই এই মেয়েটা তো যায়নি। গালে একটা বাজে চিহ্ন নিয়েও বেঁচে আছে এত বছর। এত বড় একটা ফাজলামো করে এখন আইনের গল্প ফাঁদছো?” পাশ থেকে টেকো মাথার এক পুলিশ অফিসার ওদের উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন। এতক্ষণ ক্যারাম খেলার উপযুক্ত চকচকে মাথার তালু ক্যাপে ঢাকা ছিল। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হয়েও এতটা সময় চুপচাপ সবার কথা শুনেছিলেন। তবে এবারে সীমাটা সহ্যের অতিরিক্ত হয়ে গিয়েছে।

এমন মোক্ষম প্রশ্নের জবাব মেহুলের কাছে ছিল না। আয়েযার কাছে অবশ্য ছিল। তাও শব্দের জবাব না, জব্দের ফন্দি। একেবারে ভ্যাঁ ভ্যাঁ সুরে কেঁদে ভাসিয়ে ফেলল আয়েযা। কয়েক মিনিটেই এক গ্লাস ডুবো ডুবো চোখের পানি ঢেলে মেহুলের হিজাব টেনে ধরে বিলাপের সুরে বলতে থাকল, “গেলি না কেন, মরে গেলেই ভালো করতি না? ওইদিন আমাকেও মরতে দিলি না, আজকে নিজেও মরলি না। এবার দেখ, আমার এই দৃশ্যমান দাগ আর তোর অদৃশ্য দাগ, দুইটাকেই টাক্কু আংকেল কীভাবে বলছে… অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ…।”

থানার প্রবেশদ্বারে মিডিয়াকর্মীদের জটলা লেগে আছে, সাথে নারীবাদী হই হুল্লোড়ে মাতা একদল গলাবাজ আর মানবাধিকার সংস্থার মানুষজন। মেয়েদুটো বের হলেই প্রশ্নবানে ঝাঁঝরা করে দিবে মগজ। পুলিশেরও আজ বোধহয় নিস্তার নেই। উপর মহল থেকে ইতোমধ্যেই বারকয়েক ফোনকল এসে গিয়েছে। এক টেবিল চতুষ্কোণ আকৃতিতে উপবিষ্ট পুলিশ অফিসাররা চোখাচোখি করছেন মাঝেমধ্যে। ইন্টারনেট জগতে বাংলাদেশ জুড়ে তোলপাড় সাড়া ফেলেছে ঘটনাটা। এমন তুখোড় আলোচিত মেয়েটাকে ন্যায় বিচার পাওয়ার ব্যবস্থা না করে দিলে দেশবাসীর পক্ষ থেকে যে সাংঘাতিক বেইজ্জতি কপালে জুটবে সেটা ভেবেই হয়ত তারা জানালেন, “ঠিক আছে, আপনারা এবার আসতে পারেন। আমরা এ ব্যাপারে সুষ্ঠু তদন্ত করার পর অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করব…”।

১৩.

পুলিশি ঝামেলা মিটিয়ে গেটের কাছে এসে মেহুলের কাঁধ ঝাঁকিয়ে দিয়ে আয়েযা বলল, “কী মারাত্মক একটা নাটক বানিয়েছিস তুই! আমি তো ভাবতেই পারিনি, জল পাহাড়ের চূড়াতেও যে গড়িয়ে যাবে।”

– “আগেও বলেছিলাম, এই দেশেও আইন আছে, আইন। শুধু তার প্রয়োগ নেই। যদি হতো, তো রাতারাতি সব দূর্নীতি ধ্বসে পড়ত। আইন হচ্ছে একটা দেশের জন্য অঘমর্ষণ।”

– “অঘমর্ষণ? যে মন্ত্রে পাপ দূরীকরণ হয় মানে পাপনাশক বাণী?”

– “হ্যাঁ, আইন থাকলে পাপের শাপ কাটানো যায় অর্ধেক, বাকিটা ক্ষয় হয় মানসিকতায় ধুয়ে।”

– “মানলাম, এসব তুই ইচ্ছে করে সাজিয়েছিস আলোচনায় এসে বিচারের দাবি তোলার জন্য আর মানুষকে সচেতন করতে। তো একটাবার কি আমাকে আর আর অর্ণাপুকে বলা যেত না?”

– “বললে কী হতো? তুই টাকলা ওসির সামনে ওভাবে কৃত্তিম ক্রন্দন অভিনয়টা আরও ভালো করে করতি, তাই না?” পালটা প্রশ্ন করে ভ্রুকুটি করল মেহুল।

– “ইয়া আল্লাহ, ইয়া মাবুদ, যার জন্য অভিনয় করলাম সেই বলল আমারে অভিনেত্রী। বন্ধুত্বের এই লজ্জা তোমার খাতায়ই তোলা থাক, হাশরের মাঠে এক সেকেন্ডও সহ্য করতে না পারার দিনে ঐ খাতার সব হিসাব আমাকে বুঝিয়ে দিও খালি।” কপাল চাপড়ে গ্রাম্য নারীদের ভাবে কথা বলল আয়েযা।

– “আচ্ছা থাক, থলের ইঁদুর বিড়াল সব তো দেখলাম। এবার অভিনয় না করলেও হবে।”

– “হ্যাঁ করব না, যেদিন তুই এসব পাগলামি করতে করতে পাবনায় যাওয়ার উপযুক্ত হয়ে যাবি সেদিনও অভিনয় করে তোকে বাঁচাতে আসব না বলে দিচ্ছি। কিন্তু আমাকে একটা কথা বল্ যে তুই মাঝখান থেকে আন্টিকে কেন ডেকে এনেছিস?”

– “আর কী করতাম আমি? উনি যে আমার মা সে কথা বলার জোর আছে আমার? না কি গলার জোরে বলব উনার আগের স্বামীই আমার বাবা? যেখানে এই কথাটা বাবার পরিবার পর্যন্ত স্বীকার করে না। এত সহজে এই দুনিয়ায় কেউ কাউকে মেয়ে বলে মেনে নেয়? ঘটনা ভাইরাল হলে যেমন বিচারটা সহজে হয়, মানুষ ভাইরাল হলেও মূল্য মিটার তরতর করে উপরে ছুটে। এক ওসিলায় আমার পরিচয় দেশবাসীর সাথে উনিও জানলেন, ভবিষ্যতে অন্তত আমাকে মেয়ে হিসেবে মেনে নিয়ে পরিচয়টা বলতে লজ্জা পাবেন না। আমার জানা আছে খুব করেই, বিনা দ্বন্দ্বে কিংবা বিনা স্বার্থে আয়েযা ছাড়া কেউ আমার জন্য এগিয়ে আসবে না।” শেষোক্ত কথাটা ক্ষীণস্বরে নিজের জন্যই আওড়ালো মেহুল।

– “হোস্টেল ছেড়ে আসা, আত্মহত্যার নাম করে জনগনের সামনে এসে হম্বিতম্বি ভাসন দেওয়া, ঘাড়ে ভূত চাপা যন্ত্রের মতো মন্ত্র বলে অভিনয় করা, আলোচনায় এসে কৌশলে আইনের ন্যায্য বিচারের দাবি করা… সবদিক থেকে আসলেই প্ল্যানটা ভালো ছিল। তবে মাঝখান থেকে বেচারা গুষ্ঠি সানসেট রেস্টুরেন্টের মালিকদের হয়রান করে ফেলেছিস। এটুকু বাদে জনতায় আলোড়ন ফেলে সুবিচার পাওয়ার চিন্তাটা অমাবস্যায় চাঁদ ওঠানোর মতো আইডিয়া ছিল।”

– “এখন ওইসব রেখে ভাবতে থাক বাইরে থাকা মৌমাছির হামলাটা কীভাবে সামলাবি। তারপর মামণির বিষয়ে মাথা ঘামাব।” মেহুল ললাটে ভ্রুজোড়ার মাঝখানে তর্জনী চেপে ধরে আসন্ন বিপদের কথা আয়েযাকে স্মরণ করায়।

মেহুল আর আয়েযা দুজনেই বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়। তৃতীয় ধাপে নাটকে অংশগ্রহণ করতে হবে মিনিট দুয়েকের মাথায়। জীবনের যত দুঃখ মনে করা যায় তারা সব ভেবে ভেবে চোখভর্তি পানির হৃদ বানালো, তারপর গেটের বাইরে এসে মুখটা বাংলা পাঁচের আকারে এনে প্রস্তুতি নিল আরেক চোট অভিনয়ের।

(চলবে… ইনশাআল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here