ভালোবাসি তোকে ❤পর্ব- ৫
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি উনি আমার হাতের ওপর হাত দিয়ে রেখেছেন। আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম ওনার ঘুমন্ত মুখটার দিকে কতো নিষ্পাপ লাগছে একদম বাচ্চা বাচ্চা। চিন্তাই করা যায়না এই লোকটা এতো বদরাগী। তারপর আস্তে উঠে বসে ওনার ফোনটার দিকে তাকালাম। গতকাল সকালের সেই ফোনের কথা মনে পরতেই কলটা কার ছিলো জানার আগ্রহ বেড়ে গেল। ফোনটা ধরতে যাবো তখনি উনি নড়েচড়ে উঠলেন। আমি চমকে গিয়ে সরে এলাম। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ওয়াসরুমে চলে গেলাম ফ্রেশ হতে। শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে এসে দেখি আদ্রিয়ান ভাইয়া উঠে গেছেন। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে একটু গলা ঝেড়ে বললাম,
— “আপনি কফি খাবেন? মনিকে পাঠিয়ে দিতে বলবো?”
উনি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন,
— ” কেনো? তুমি আনতে পারবেনা?”
আমি মুখ গোমড়া করে বললাম,
— ” আমি নিয়ে আসলে আপনার মনে হবে আমি আপনার বউ হতে চাইছি।”
উনি শান্ত চোখে কিছক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। আমিও কিছু না বলে নিচে চলে গেলাম আর মনিকে দিয়েই ওনার কফিটা পাঠিয়ে দিলাম।
বিকেলে আমরা সবাই আমাদের বাড়িতে গেলাম। আপি আর ইফাজ ভাইয়াও এসছে। আদ্রিয়ান ভাইয়া বাড়ির সবার সাথেই ভালোভাবেই কথা বলেছে মিশেছে। ওনাকে দেখে কেউ অনুমানও করতে পারবেনা যে কী চলছে ওনার মনে। তবে সকাল থেকেই উনি ল্যাপটপে কোনো একটা কাজ নিয়ে খুব বেশিই বিজি। আমাদের বাড়িতে এসেও কাজ করছে। একটা কথা বরাবরই ভাবায় আমাকে উনি তো জাস্ট একজন ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু ওনার অতিরিক্ত ব্যাবস্তার কারণ সবার কাছেই অজানা। ওনার একটা নিজস্ব ল্যাবও আছে যেখানে কিছু এমপ্লয় ছাড়া উনি আদিব, আর ইশরাক ভাইয়ারই ঢোকার অনুমতি ছিলো। রাতে ওনার পাশে হেলান দিয়ে বসে বসে এসবই ভাবছি আর উনি কাজ করছেন। হঠাৎ ল্যাপটপটা অফ করে উনি বললেন,
— ” চলো ছাদে যাই।”
আমি ভ্রু কুচকে তাকালাম ওনার দিকে হঠাৎ ছাদে যাওয়ার সখ কেনো হলো? তাও আমায় নিয়ে। আমি কথা না বাড়িয়ে মাথা নাড়লাম।ছাদে গিয়ে উনি ছাদের উঁচু করে রাখা দেয়ালটার সাথে হেলান দিয়ে নিচে বসে আমার দিকে তাকিয়ে ওনার পাশে বসতে বললেন।আমি ওনার কথামত ওনার পাশে গিয়ে বসলাম। আমি শুধু অবাক হয়ে ওনাকে দেখছি। আজ আবারও সেই মাসখানেক আগের আদ্রিয়ান ভাইয়াকে দেখতে পাচ্ছি। বেশ কিছুক্ষণ দুজনেই নিরব ছিলাম।নিরবতা ভেঙ্গে উনি আমার হাতে ওনার দুহাতের মধ্যে নিয়ে বললেন,
— ” আই এম সরি অনি। আসলে বিয়েটা হুট করে হয়েছে তারওপর ইশরাক.. সব মিলিয়ে মাথা ঠিক ছিলোনা আমার। তোমার সাথে ওরকম খারাপ ব্যবহার করাটা আমার ঠিক হয়নি।”
আমি শুধু তাকিয়ে আছি ওনার দিকে ওনার চোখদুটো লাল হয়ে আছে। উনি আবারও বললেন,
— ” জানো অনি আমি, আদিব আর ইশরাক বেশিরভাগ সময় একসাথে ছাদে আড্ডা দিতাম। আর ইশরাক তো সবসময় মাতিয়ে রাখতো। আমাদের আড্ডার প্রাণ ছিলো ও।”
আমি নিচের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলাম এগুলোর কিছুটা জানি আমি তবুও ওনাকে থামাচ্ছিনা, নিজের মনের কথা বলে অন্তত নিজেকে হালকা করুক। উনি আবার বললেন,
— ” আচ্ছা? এমন হওয়ার কী খুব দরকার ছিলো? বেশ তো ছিলাম আমরা। হাসি মজায় আনন্দে বেশ ভালো কাটছিলো। তাহলে ভুলটা কোথায় ছিলো? ভালো কিছূ করার পরিণাম কী এটাই হয়?”
আমি এতোক্ষণ ওনার কথার মানেগুলো বুঝলেও এখন বুঝতে পারছিনা। কী বলতে চাইছেন উনি? কী ভালো কিছু করতে চেয়েছিলেন ইশরাক ভাইয়া। এসব হিসেব মেলাতে মেলাতেই উনি আবার বললেন,
— ” জানো ইশরাকের বাবা মা কীভাবে তরপে তরপে মরছে? ইশরাকের বউটাও জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছে। পুরো পরিবারটা শেষ হয়ে গেছে। সকালেও ফোনে প্রচুর কাঁদছিলো মেয়েটা। পাঁচ মাসের প্রেগনেন্ট ও। অথচ ওর বাচ্চাটা বাবা বলে ডাকার মতো কাউকে পাবেনা।”
আমি অবাক হয়ে গেলাম। তারমানে সকালে উনি নূর আপুর সাথে কথা বলছিলেন আর আমি কীসব ভাবছিলাম। ছিঃ! হঠাৎ করেই উনি বলে উঠলেন,
— ” সব দোষ আমার। সব আমার জন্যে হয়েছে। আমার জন্যেই ইশরাক আজ আমাদের মাঝে নেই। আমার ভুলের জন্যেই ওকে মরতে হয়েছে। কেনো আমি আগে থেকে কিছুই আন্দাজ করতে পারিনি? কেনো? আমি খুনি? এই তুমি জানো তোমার হাজবেন্ট একজন খুনি? তুমি এই খুনির সাথে থেকোনা অনি। হয়তো একদিন তোমাকেও খুন করে ফেলবো। তুমি আমার কাছে সেফ নও। সেফ নও তুমি আমার কাছে। আমি শেষ করে দিয়েছি একটা পরিবারকে। আমার পরিবারও আমার জন্যে শেষ হয়ে যাবে সব শেষ হয়ে যাবে। সব। ”
এসব আওরাতে আওরাতে উনি আমার কাধে মাথা রেখে দিলেন। আমি শুধু স্তব্ধ হয়ে ওনার কথাগুলো শুনছি। ইশরাক ভাইয়ার মৃত্যুর সাথে ওনার কী সম্পর্ক? উনি কেনো নিজেকে দায়ী করছেন। ইশরাক ভাইয়া যখন মারা গেছেন তখন তো উনি ওনাদের বাড়িতে ছিলেন। আমাদের সামনে, তাহলে? নিজেকে কেনো খুনী বলছেন উনি? কেনো?
ওনার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি ঘুমিয়ে পরেছেন। দেয়ালে কিছুটা সাপোর্ট আছে তাই আমার প্রবলেম হচ্ছে না। আমি হাত দিয়ে ওনাকে একটু ধরে আবারও চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলাম। আর সেই দিনের কথা ভাবতে লাগলাম,
আপির রিসিপশনের অনুষ্ঠান। কালকে আমি বিয়ের আপির সাথেই এই বাড়িতে এসছি। সবাই মিলে বেশ মজাও করেছি কিন্তু উনি ওতটা সময় দিতে পারেননি আমাদের। কাজে ব্যস্ত ছিলিন। বাড়ির দায়িত্ববান ছেলে কী না। তাতে ভালোই হয়েছে ওনার লেগ পুলিং এর হাত থেকে তো বেঁচে গেছি। কাল আমার গলা থেকে হারটা খুলতে বাধ্য করেছে। আরে ভাই র্যাস হলে আমার হবে তাতে তোর কী? সবাই মিলে গল্প করতে বসেছি। সবাই থাকলেও ইশরাক ভাইয়াকে কোথাও দেখতে পাচ্ছিলাম না। আদ্রিয়ান, আদিব ভাইয়া দুজনেই কনটিনিউয়াসলি ফোন করছেন ওনাকে। ফোন বন্ধ। আদিব ভাইয়া বললেন,
— ” হঠাৎ কী হলো ওর? শালা সবসময় এমন করবে?”
আদ্রিয়ান ভাইয়াও নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে আবারও ফোনে ট্রায় করতে করতে বললেন,
— ” আসুক আজকে। যদি অবস্থা খারাপ না করেছি তো।”
প্রথমে সিরিয়াসলি না নিলেও পরে ওনারা চিন্তায় পরে গেলো। আমরাও ভাবছি যে যে লোকটা অনুষ্ঠানে থাকার জন্যে এতো লাফালাফি করছিলো হঠাৎ করে তার কী হলো? সবার আড্ডা দেওয়ার মুড শেষ হয়ে গেল। অতিথীরা খেয়ে চলে গেছেন। ইশরাক ভাইয়ার পরিবারকেও ফোন করা হয়েছে তারা কিছূই জানেননা। সময় যতো যাচ্ছে ওনাদের অবস্থা ততো বেশি খারাপ হচ্ছে। হঠাৎ করেই আদ্রিয়ান ভাইয়ার ফোন এলো উনি হকচকিয়ে ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে কিছু একটা বলল যেটা শুনে ওনার হাত থেকে ফোনটা পরে গেলো। ওখানে বসে পরলেন উনি। ওনার সারা শরীর কাঁপছে, কপাল ঘেমে আছে। আদিব ভাইয়া তাড়াতাড়ি ফোনটা নিজের কাছে নিয়ে কানে নিয়ে বললেন,
— ” হ্যালো? হ্যালো? কে বলছেন?”
ওপাশ থেকে আবারও কিছু বলল যেটা শুনে ওনার চোখ দিয়ে একফোটা জল গড়িয়ে পরলো। আদ্রিয়ান ভাইয়া কিছূ একটা ভেবে উঠে দৌড় লাগালো। আদিব ভাইয়াও আঙ্কেলদের ইশরাক ভাইয়ার বাড়িতে যেতে বলে আদ্রিয়ানের পিছে পিছে দৌড় লাগালো। আমরা সবাই বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি। মানিক আঙ্কেল বললেন,
— “‘ নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে, গিয়ে দেখতে হবে!”
আব্বুও মাথা নাড়লেন। আমরা সবাই গেলাম ঐ বাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম বাড়ির গার্ডেন এরিয়াতে অনেক ভীর হয়ে আছে। আমার বূকের মধ্যে এক অজানা ভয় কাজ করছে কোনো গন্ডগোল হয়নিতো? আমরা ভীর ঠেলে ভেতরে গেলাম। যা দেখলাম তাতে চমকে গেছি আমি। একটা লাশ সাদা কাপড় দিয়ে ডেকে রাখা হয়েছে। আদ্রিয়ান শক্ত হয়ে বসে আছে লাশটার পাশে। আমাদের দেখানোর জন্যে লাশটা মুখ থেকে কাপড় সরাতেই আমি পুরো জমে গেলাম। আমার পা থরথর করে কাঁপছে। নিজের চোখকে আজ ভুল প্রমাণ করতে খুব ইচ্ছে করছে। ইশরাক ভাইয়ার রক্তাক্ত মুখটা দেখে সব কিছু অন্ধকার লাগছে।এই মানুষটাই কাল রাত অবধি আমাদের সাথে হাসি মজা করে বেড়িয়েছে, সবাইকে মাতিয়ে রেখেছে আজ সে নেই? ইশরাক ভাইয়ার বাবা মা ছেলে হারিয়ে পাগলের মতো করছেন। নূর আপু কাঁদতে কাঁদতে বারবার সেন্সলেস হয়ে পরছেন। ভালোবেসে বিয়ে করেছেন ওনারা, আপু এক মাসের প্রেগনেন্ট। এক সপ্তাহ আগেই জেনেছে। সেদিন কত্তো খুশি ছিলো ভাইয়া। সবাইকে ট্রিট দিয়েছিল। শুধু একটা কথাই বলছিলো বারবার “আমার বেবি হবে, আমাকে বাবা বলে ডাকবে, আমাকে?” অথচ সন্তানের মুখটাও দেখতে পারলোনা। কিছু কিছু দমকা হাওয়া আনন্দগুলোকে এক নিমিষেই ফিকে করে দেয়। তখন সেই আনন্দগুলোর কথা মনে পরলে আর আনন্দ হয়না, বুকের মধ্যে গ্রাস করে একরাশ বিষাদ আর যন্ত্রণা ।
#চলবে..