#দেবী,৩৯
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।
রুহুল তার দাদাজানের কাছে যাচ্ছিলো ব্যবসায়িক কথা বলতে। কিন্তু পথিমধ্যে দেখা হয়ে গেলো বকুলের সাথে। রুহুল বকুলকে দেখেই আলিঙ্গন করল। বললো, “কি রে কি অবস্থা তোর, কখন এসেছিস।ল? ”
–“সন্ধ্যায় এসেছি। সে আছি বেশ,তা তোর কি খবর? ”
–“আমার খবর কি আর তোর নেওয়ার সময় আছে তুই তো আমায় ভুলেই গেছিস। আর তার চেয়েও বড় কথা হলো বিয়ের আগে কত চিঠি লিখতি এখন কেবল আমার বোন টাকেই চিঠি লিখিস।আগে তো চিঠি লিখে পাগল করে দিতি যে কবে আসতে হবে তোর। ”
–“আসলে ব্যস্ত থাকি তো তাই আর কি। ”
–“বুঝি সব ই বুঝি। কাজের সময় ভাই ভাই কাজ ফুরালে খবর নাই তাই না। ”
বকুল মনে মনে নিজেকে দোষ দিল। আসলেই তো বিয়ের আগে রুহুল কে কত চিঠি দিয়েছে বিয়ের প্রস্তাবের জন্য। নিজের দোষ লুকাতে বকুল বললো, “তোর জন্য একটা জিনিস নিয়ে এসেছি বন্ধু। ”
–“আজ কি সুর্য উত্তর দিকে উঠেছে নাকি তোর মতো কিপটা আমার জন্য উপহার এনেছে।”
–“ধুর শা’লা সত্যিই বলছি। উম এক কাজ কর ছাদে আয় ওইখানে দেবো। অনেকদিন হলো একসাথে আমাদের গল্প হয় না। ”
রুহুল হেসে বললো, “বেশ নিয়ে আয় আমি ছাদে অপেক্ষা করছি। তাড়াতাড়ি আসবি কিন্তু । ”
রুহুল কিছু একটা ভেবে নিজের কক্ষে গেলো। টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিলো। অনেক দিন পর খাওয়ার সখ জেগেছে রুহুলের। আর যেহেতু বকুল ও এসেছে সকল চিন্তা ভাবনা আজ ধোঁয়ার সাথে উড়য়ে দেবে।
রুহুল সিগারেটের প্যাকেট টা শার্টের পকেটে ভড়বে তার আগেই কেউ ছিনিয়ে নিলো। রুহুল পাশে তাকিয়ে দেখলো কাকন দুহাত কোমড়ে রেখে নাক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমন মুখ করে রেখেছে যেন এখন রুহুল কে আস্ত চিবিয়ে খাবে।
রুহুল মুখ ছোট করে বললো, “বিবিজান আসলে ”
–” আপনি এসব তামাক দ্রব্য খান? ”
–” আরে না আমি এগুলা খাবো কেন। এগুলো তো বকুল খেতে চেয়েছিল তাই আর কি।”
–” এগুলো খেলে মুখ নাপাক হয় আপনি জানেন না। আর তার চেয়েও বড় কথা উনি খেতে চাইবে আর আপনি দেবেন হ্যাঁ। ”
–” বিবিজান আপনি তো জানেন ই আমাদের মঞ্জিলে মেহমানদের আপ্যায়ন করা পুণ্য হিসেবে মানা হয়। আর তাছাড়া ও তো আমার প্রিয়বন্ধু আর বোনের স্বামী। ওর কথার খেলাপ করা কি ঠিক হবে।”
–“বেশ উনি খাবে তো দাড়ান দিচ্ছি।”
কাকন প্যাকেট খুলে একটা রুহুলের হাতে দিলো। আর বাকি গুলো কয়েক টুকরো করে জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দিলো। রুহুল কিছু বলতে চাইলো তবে সাহস পেলো না। এর আগেও কাকন দেখেছিল এবং নিষেধ ও করেছিল। রুহুল এর মুখ টা একদম ছোট হয়ে গেলো। সে তো এগুলো সব ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছিল। আর এটা তো বিদেশি সিগারেট। একবারের জন্য ছুতেও পারলো না রুহুল।
কাকন বললো, “এটা আপনি বকুল ভাইকে দেবেন। আর হ্যাঁ খবরদার আপনি কিন্তু স্পর্শ ও করবেন। আমাকে ছুয়ে কথা দিন আপনি আর কোনোদিনো ধুমপান করবেন না।”
রুহুল নিরুপায় হয়ে গেলো। সে সিগারেট খায় না কিন্তু সপ্তাহে অন্তত একটা টান না দিলে ভালো লাগে না। রুহুল কাকনের দুকাধে হাত রেখে বললো, ” বিবিজান আমি আপনাকে ছুয়ে এই কথা দিতে পারবো না।আমি তো সবসময় খাইনা।মাঝে মাঝে এক-দু টান দেই আরকি।আপনাকে ছুয়ে মিথ্যে কিথা দিতে পারবোনা।”
–“ওই এক দু টান ও আর দেওয়া চলবে না। আপনি জানেন না এগুলো স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। সেদিন তো পত্রিকায় ও দেখলাম ছাপা হয়েছে এক বিখ্যাত গায়কের কথা। যিনি ধুমপান করে শ্বাসনালিতে কি যেন হয়েছে। তাই আপনি আর ছোবেন না। ”
কাকন কে একদম গিন্নীর মতো লাগছে। কোমড়ে এক হাত দেওয়া। চুল গুলো খোপা করা। নাক ফুলিয়ে রেগে রেগে কথা বলা দেখে রুহুল উচ্চস্বরে হেসে দিলো।
কাওন অবাক হয়ে বললো,”এভাবে হাসছেন কেন্ হ্যাঁ?”
–“আপনাকে একদম গিন্নী গিন্নি লাগছে। গিন্নীদের মতো স্বামী কে শাসন করতে পারেন দেখছি। ”
–“কখনো কখনো গিন্নী হতে হয়। ”
–“গিন্নী তো হলেন খুব শীঘ্রই অন্যকিছু ও হবেন।”
–“অন্যকিছু হবো মানে? ”
–“এটা আপনার জন্য চমক । তবে এটুকু বলতে পারি জানার পর আমার চেয়ে বেশি খুশি আপনি হবে। ”
—“না এখুনি বলুন না!”
–“ঠিক আছে বলতে পারি তবে তার আগে একটা জিনিস চাই আমার। ”
–“কি জিনিস? ”
–” এখন একটা চুমু দিতে হবে আর মাঝে মাঝে একদুটান দেওয়ার অনুমতি।”
কাকন মুখ ফুলিয়ে বললো “শোনা লাগবে না আমার। যান যা খুশি করুন গিয়ে আমি কিছুই বলবো না। ”
কাকনের মুখ ফুলানো দেখে রুহুল বললো, “এই রে না না আর খেতে চাইব না। আপনি যা বলবেন তাই। আমি খাবো না আমার সুন্দরী বিবিজান।”
–“সত্যিই তো। ”
–” তিন সত্যি। এই যে কান ধরছি। ”
রুহুলের কান ধরা দেখে কাকন ঝঙ্কার তুলে হাসি দিল। রুহুলের করা এই বাচ্চামি গুলো কাকন কে খুব হাসায়। আর রুহুল পলকহীন ভাবে এই হাসি দেখলো। এই সেই হাসি যা রুহুল এর সবচেয়ে প্রিয়। এই হাসি দেখতে দেখতে মৃত্যু হয়ে গেলেও ভয় নেই রুহুলের। কতদিন পর কাকন এমন করে হাসলো। রুহুলের মনে প্রেমের বীজ যে এই হাসিই রোপণ করেছিল।
_________________________
বাগানের হরেক রকমের সুগন্ধময় ফুলের গন্ধ ছাদ অব্দি পৌছে গেছে। সুগন্ধে মো মো করছে। এ অবশ্য নতুন কিছু নয়। চাদের পুর্ণ আলোয় দুই বন্ধু ছাদের কিনারায় বসে আছে। রুহুল সিগারেট ধরালো।নিজে একটান দিয়ে বকুল কে দিল।
বকুল সিগারেট হাতে নিয়ে বললো, ” তোর দাম্পত্য জীবন কেমন চলছে রে? ”
–“বেশ ভালোই আছি বিবিজানের সাথে।বলতে পারিস জীবনের সেরা সময়গুলো ওনার সাথেই কাটাচ্ছি।”
–“তোর ই কপাল। তোর বোন টা আমায় একটুও ভালো বাসে না। ”
–“এই একদম আমার বোন কে নিয়ে কিছু বলবি না। মুখ ফাটিয়ে দেবো বলে দিলাম। ও বাচ্চা মেয়ে।”
–“আমায় মারলে তোর বোন ই কষ্ট পাবে হ্যাঁ। ”
–“এই জন্যই তো কিছু বলতে পারি না। ”
তারপর বকুল আর কিছুই বললো না। এমন ভাব করলো যেন সে অনেক কিছু ভাবছে। রুহুল বললো, –“কি রে কি ভাবছিস? ”
–“একটা জিনিস ভাবলাম বুঝলি?”
–“কি জিনিস। ”
–“আমাদের সম্পর্ক টা আরো গাঢ় করবো।”
–“বন্ধু ছিলি এখন ছোট বোনের স্বামী হয়েছিস আর কি হতে চাস?”
–“বেয়াই হতে চাই! ”
–“মানে কি যাতা বলছিস, তুই উলটা পালটা কিছু খেয়েছিস নাকি? ”
–“আরে ধুর কি খাবো উলটা পালটা। তুই কি আদোও কিছু খাইয়েছিস নাকি আমাকে।”
–“তুই কি বলতে চাইছিস সেটা বল তো? ”
–“আমি আমাদের বন্ধুত্ব টা অটল রাখতে চাই।”
–“সে তো থাকবেই! ”
–” হ্যাঁ তবে যদি আরো করা যায় মন্দ কি! ”
–“বকুল তোর কথার আগা মাথা কিছুই বুঝছি না।”
–” আমি তোর ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দেবো।”
–“কিহ, ছেলে কই পেলি আর মেয়েই বা কই পেলি?”
–“হয়নি তবে হবে। দেখ যা ই হোক না কেন শেষ বয়সে তোকে আমি আমার বেয়াই হিসেবে দেখতে চাই। ”
রুহুল অবাক হয়ে বললো, “তুই এত কিছু কিভাবে ভেবে রেখেছিস ভাই। তুই তো দেখি কঠিন মানুষ। ”
–“এইটা আমি আগেই ভেবে রেখেছিলাম কিন্তু তখন তো আর জানতাম না যে তুই আমার শা’লা হবি।”
–“আগে বাবা তো হতে দে তারপর তোর বেয়াই হবো।”
–“এতদিন ধরে বিয়ে হয়েছে আর এখনো বাপ হতে পারলি না তুই। রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। ”
–“শা’লা একটা মারবো। রবিনের বউ অল্প বয়সে বাচ্চা দিতে যেয়ে মারা গিয়েছিল মনে আছে তোর। সেই ভয়ে আমি বাবা হতে দেরি করছি তবে এখন আমার বিবিজান বড় হয়েছে।তাই খুব শীঘ্রই বাবা হবো।”
–“তাও ভালো।আগামী বার এসে যেন সুখবর টা পাই।”
–“পাবি ইন শাহ আল্লাহ। খুব শীঘ্রই পাবি। এখন কিসের উপহার দিবি দে দেখি।”
–“তোর এই সুখবরের জন্যই একটা অগ্রীম উপহার তোর আর আমার ভাবির জন্য। নয়ন দিয়েছে আসার সময় নিয়ে এসেছি। ”
রুহুল খুশি হয়ে বললো, “অবশেষে পেলাম। আচ্ছা আমি যাই বিবিজান কে দেখিয়ে আসি ”
–“আরে পরে যা।”
–“না ওনাকে আগে দেখাবো। তুই ও গিয়ে শুয়ে পড়।”
_______________________
মহীবুলের মা জায়নামাজে বসে মোনাজাতে কাদছেন। দুখী মানুষরা কোথাও সুখ না পেলেও নামাজে পায়। আল্লাহর ইবাদতে যে পরম সুখ। মহীবুলের মা এর নিরব কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তবে শুধু বারবার আল্লাহ শব্দ টাই কর্ণগোহর হচ্ছে। জামাল কক্ষে এসেছে অনেক্ষণ। সচারাচর এই সময়ে তার কক্ষে আসা হয় না। যৌবন কাল থেকেই সে তার বেশির ভাগ রাত পাড় করেছে তার একান্ত কক্ষে। প্রথম স্ত্রী এসব বিষয়ে তর্ক করেছিল বলেই সে নিজ হাতে হত্যা করেছিল। অন্যদিকে মহীবুলের মা শান্ত শিষ্ট হওয়ায় যেমন খুশি তেমন ভাবে জীবন যাপন করেছে। অর্ধেক রাত নেশায় পার করে তারপর স্ত্রীর কাছে এসেছে। দেহের মিলন অনেক ঘটেছে তবে মনের মিলন বোধহয় আজ অব্দি করতে পারেনি জামাল তার অর্ধাঙ্গিনীর সাথে।
জামাল এখনো দাঁড়িয়ে আছে। মনের ভিতরে লজ্জা, অসস্থিবোধ, অনুশোচনা সব কাজ করছে। নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার প্রথম ধাপ হলো স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাওয়া।
বেশ কিছুক্ষণ পর মহীবুলের মা মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজ উঠিয়ে গুছিয়ে রাখলো।
জামাল কে দেখেই মাথা নিচু করে বললো, ” আমি বুঝি নাই আপনে আইছেন। তাইলে আরো আগে মোনাজাত শেষ করতাম। আপনের কি কিছু লাগবো? ”
জামাল অত্যন্ত শান্ত ভাবে বললো, ” নামাজে কি কোনো দিন আমার জন্য কিছু চাস নাই মহীর আম্মা?”
মহীবুলের মা জামালের দিকে চাইলো। জামাল আবারো বললো, “কোনো দিন কি চাস নাই যাতে আমি ভালা হইয়া যাই, তরে যাতে ভালোবাসি। আর অত্যাচার মারধোর না করি। ”
মহীবুলের মা জামালের মুখে এমন কথা মাথা নিচু করে ফেললো আবারো। কি উত্তর দেবে সে। এমন কোনো ওয়াক্ত নেই যেখানে সে তার স্বামী আর পুত্রের ভালোবাসা-যত্ন চায় নি আল্লাহ তায়লার কাছে।
জামাল আবারো বললেন, “কি হইল কথা কস না কেন। উত্তর দে আমি শুনবার চাই। ”
মহীবুলের মা ঠোঁট চিপে কান্না আটকাতে চাইলেন। মুখ ফুটে কিছু বলতে ও যেন কিছু বাধা দিচ্ছে।
জামাল নিজ স্ত্রীর পায়ের কাছে বসে পড়লেন। দু’পা জড়িয়ে ধরে কাদতে শুরু করলো। এমন ভাবে পা জড়িয়ে ধরায় মহীবুলের মা চমকে গেলো। মহীবুলের মা নিজের পা ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু ছাড়াতে পারলো না। শেষে বাধ্য হয়ে নিজেই বসে পড়লেন মেঝেতে। জামাল স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কাদলেন। কাদতে কাদতে বললেন,”আমারে মাফ কইরা দে মহীর আম্মা। আমি সারাজীবন তরে দুঃখ দিছি। কোনোদিন ভালোবাসি নাই। তর উপর খালি জুলুম করছি।”
–“আমার পাও ছাড়েন। আপনে আমার সুয়ামি আপনে আমার পাও ধরলে আমার গুণা হইবো।”
–” না তোর কোনো গুনা হইবো না। গুনাতো আমার হইছে তোর লগে করা অন্যায়ের গুনা। মহীর আম্মা আমারে মাফ কইরা দে। মাফ কইরা দে। ”
–“আপনে আমার স্বামী। আপনের উপর কোনো ক্ষোভ নাই যে মাফ করমু। আমি তো আপনেরে কোনো দিন দোষীই মনে করি নাই পাপি হইবেন কেমনে।”
–” আমি আমার সব ভুল বুঝবার পারছি। যেইখানে সবাই বউ সন্তান নিয়া সুখে আছে সেইখানে আমি আমার একমাত্র পোলাডারে হারাইলাম তরে ও সুখ দিতে পারি নাই। আইজ আমি নিস্ব। সব আমার পাপের ফসল।”
–“এগুলা কইয়া আর কি হইবো কন।আমার মহীও ফিরা আইবো না। আর না আমার কষ্টের দিন গুলা ফিরা আইবো। আমি আপনেরে ক্ষমা কইরা দিলাম।আপনে আপনের ভুল বুঝিতে পারছেন এইডাই মেলা।”
–“তুই এতডা ভালা না হইলেও পারতি মহীর আম্মা। অন্তত আইজ আমার এত কষ্ট হইতো না তোর জন্য।
তরে ও সুখ দিবার পারতাম। ”
–” আপনে যে আমারে ভালোবাইসা জীবনের প্রথমবার বুকে নিছেন এইডাই আমার সারাজীবনের বড় সুখ।”
–” আমি আর কোনোদিন তরে কষ্ট দিমু না। বাকিডা জীবন তরে রানির মতো কইরা রাখুম। আমি ভালা হইয়া যামু দেহিস তুই। ”
–” হুম হইবেন। আমার আর কিছুই চাই না আপনার ভালোবাসা ছাড়া। আপনের ভালোবাসাই আমার সুখ।
________________
রুহুল ছাদ থেকে কক্ষে এসে উপহারটি বিছানার ঠিক মাঝ বরাবর রাখলো। উহু রুহুল নিজে এটা কিছুতেই খুলবে না। সে চায় তার বিবিজান খুলুক এবং সে যেন চমকে যায়। রুহুল এর এখন একটাই কাজ কাকন কে খোজা। রাত তো আর কম হলো না। রুহুল কক্ষের দড়জা চাপিয়ে কাকন কে খুজতে গেলো।
রুহুল কাকনের খোজ করলে জানলো কাকন বিলালের ঘরে। রাতে বিছানা ঠিক করতে হয় তাই কাকন সাহায্য করতে গেছে সুভা কে।এখন অবশ্য মালেকাও স্বামীর সেবা করে। তবে কাকন নিজেও সেবা করতে পছন্দ করে।
সুভা দুহাতে স্বামীকে ধরে রেখেছে আর মালেকা বিছানা ঠিক করে দিচ্ছে। আর কাকন ওষুধ গুড়ো করছে। রুহুল কে দেখেই কাকন চেয়ার এগিয়ে দিলো বসতে কিন্তু রুহুল বসলো না বরং নিজে বিলাল কে ধরলো। সুন্দর করে আধশোয়া করে দিলো নিজের আব্বাকে। কাকন পানির সাথে ওষুধ মিশিয়ে নিজেই খাইয়ে দেয় তবে রুহুল হাত এগিয়ে দিলো কাকনের দিকে। কাকন ও ওষুধ টুকু রুহুলের হাতে দিলো।
রুহুল খুব নিখুতভাবে ওষুধ খাইয়ে দিলো। তারপর চোখ মুছে দিলো। রুহুল তার আব্বার এমন দশা দেখে খারাপ লাগে। তার আব্বা তো সেই পুরুষ যে তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছে। অথচ আজ তার আব্বার এই নির্মম দশায় ছেলে হিয়েও সুস্থ করতে পারছে না। নিজেকে অক্ষম মনে হয়। রুহুল ডাকলো, “আব্বা, ”
তারপর বিলালের হাত নিজের গালে রেখে বললো,
” আর কত কাদবেন আব্বা। আপনার এমন দশা যে আর আমাদের সহ্য হয় না। আম্মাদের দেখেছেন কতটা কষ্ট পাচ্ছেন তারা। সুস্থ হবেন না। ”
বিলাল সিরাজী নির্বিকার ভাবে শুধু চেয়ে থাকলো।তার চোখ যে কত কি বলতে চায় তা কেবল আল্লাহই বোধহয় জানে। রুহুল বিলালের হাত ছেড়ে দিয়ে সুন্দর করে তা বিছানায় রেখে দিলো। সুভার দিকে তাকালো। সুভা নিজের চোখের পানি আড়াল করতে ঘর থেকেই বেড়িয়ে গেলো। রুহুল ঠিক ই লক্ষ করল তার দুই আম্মার চোখেই পানি। রুহুল তার আব্বার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, ” ছাড়বো না। কাউকে ছাড়বো না। আপনাদের চোখের প্রত্যেকটা জলের মুল্য দিতে হবে তাদের যারা আপনাদের এই অবস্থা করেছে। ”
কাকন রুহুলের চোখে পানি দেখলো। রুহুলের চোখ টলমল করছে যেন এখনি জলস্রোত বইবে। কাকন রুহুলের কাধে হাত রাখলো বললো, “ভেঙে পড়বেন না এভাবে। আপনার চোখে এমন পানি দেখতে চাই না আমি। আব্বার সাথে করা অন্যায়কারীর শাস্তি আপনি নিশ্চয়ই দেবেন।নিজ হাতে দেবেন ইন শাহ আল্লাহ।”
রুহুল কাকনের কথায় কোনো উত্তর দিলো না।তবে রুহুলের চোখে প্রথমবারের মতো পানি দেখে কাকনের ভিতর ফেটে গেলো। প্রিয়তম রুহুলের করুণ চোখ-মুখ অত্যন্ত বেদনাদায়ক কাকনের কাছে।
_____________________
সামিয়া নিজ কক্ষে ঘুমের ভান করে আছে। বকুলের সাথে দ্বিতীয় বারের মতো এক কক্ষে রাত কাটাতে হবে। মনের ভিতর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সামিয়ার। কাথা দিয়ে মাথা ঢেকে শুয়ে আছে। কাথার নিচে দাত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে। অতিরিক্ত চিন্তায় নখ কাটা সামিয়ার বদ অভ্যাস। দরজা খোলার শব্দেই যেন সামিয়ার জান যায় যায় অবস্থা।
বকুল কক্ষে এসে সামিয়াকে এভাবে কাথা মুড়িয়ে শুয়ে থাকতে দেখে হাসলো। বকুলের মতো বুদ্ধিমান পুরুষ বেশ বুঝেছে যে সামিয়া কেন এমন করে আছে। বকুল পরখ করতে চায় যে আসলেই সামিয়া ঘুমিয়েছে কি না।
বকুল আলো নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। কাথার ভিতরে যেয়ে সামিয়ার পায়ে শুরশুরি দিলো। সামিয়ার পায়ে শুরশুরি অনুভব হতেই বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠল। বকুল হাসতে শুরু করলো। তারপর বললো,”কি সামিয়ারানি আরো অভিনয় করবে হ্যা?”
–“আপনে খুব খারাপ। আমার ঘুম নষ্ট কইরা দিলেন।”
–“বাহ তুমি ঘুমিয়েছিলে বুঝি? ”
–“হ, ঘুমাইছিলাম ই তো। ”
–” আচ্ছা আসো আমি ঘুম পারিয়ে দেই তোমায়। ”
–“না আপনের ঘুম পারান লাগবো না। আমি নিজেই ঘুমাইতে পারি। ”
–না আমি যেহেতু তোমার ঘুম নষ্ট করেছি আমিই নাহয় ঘুম পারিয়ে দেবো।”
–” আচ্ছা মানুষ তো আপনে এত জালাইয়েন না তো।”
–“জালালাম কই। শুনোনা, শুনেছি সুন্দরী নারীদের নাকি ঘুমালে আরো সুন্দরী লাগে। তাই আজ তুমি ঘুমাবে আর আমি চেয়ে দেখবো তোমার রুপ। ”
–“হ কইছে ঘুমাইলে তো মুখ আরো তেল তেল দেখা যায়। আপনের তখন আমারে আর ভাল্লাগবে না
তাই আপনে ঘুমান আপনের মত। আর আমি আমার মতো ঘুমামু। ”
–“আচ্ছা ঘুমাতে হবে না। কাছে আসো একটু। কতদিন একসাথে গল্প করা হয় না। ”
–“আপনের মতলব বুঝি, আপনে বেশি সুবিধার না।”
–“হাহাহা কি বুঝো শুনি? ”
–“কমু না! ”
–“বেশ বলতে হবে না। আমি নিজেই বলছি আমার মতলব কি।আমার মতলব তো অনেক কিছুই।তবে আজ একটু ঘুমাতে চাই। শান্তির ঘুম। কতদিন তোমায় বুকে নিয়ে ঘুমানো হয় না। একটু আসো না। ”
সামিয়া ও তো চায়। তাই সামিয়া বললো, “আমিও ঘুমাইতে চাই আপনের বুকে।”
–“তাহলে আসো। দেরি কিসের। ”
লজ্জাসরম কে আল্লাহ হাফিজ জানিয়ে সামিয়া ঝাপ দিলো স্বামীর বুকে। সুখের ঘুম দেবে তারা দুজন এখন।
চলবে…….