দেবী,৪১

0
328

#দেবী,৪১
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।

আজ সকাল থেকেই কাকন এর মন একদম চাঙ্গা। কতদিন পর আবার মহিলাশালায় যাবে। শশুড় বাড়ি রাজপ্রাসাদ হলেও বাবার বাড়ির ভাঙা ঘরে অন্যরকম শান্তি। অন্যরকম সুখ। কাকনের তো আর বাবার বাড়ি নেই তবে কাকন মহিলাশালায় নিজের বাড়ি অনুভব করে। অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে। মাঝে মাঝে কাকনের ইচ্ছে করে রুহুল যদি সিরাজী মঞ্জিলের না হতো তবে মহিলাশালার পাশে ঘর বাধতো দুজনে।রুহুল যতক্ষণ কাজে থাকতো কাকন ততক্ষণ ফাতিমার সাথে থাকতো। যেখানে কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম থাকতো না।

জোহর নামাজ পড়ে রুহুল মঞ্জিলে এসেছে। তারপর খেয়ে কক্ষে গেছে। হয়তো বিকেলে আবার কাজে যাবে রুহুল। দুপুরের খাওয়ার পর সকল কাজ সেড়ে কাকন এখন রুহুলের কাছে এলো। তবে কাকনের আসার কারণ দুটো। এক মহিলাশালায় যাওয়ার কথা বলা আর দ্বিতীয় টি হলো মঞ্জিলের মানুষদেরকে রাজি করিয়ে দেওয়া যেন কাকনকে যেতে দেয় । কাকন কক্ষে এসে দেখলো রুহুল আলমারী খুলে শার্ট বের করছে। কাকন রুহুলের দিকে চেয়ে বিছানায় বসলো। তবে নরম তুলতুলে বিছানা শক্ত মনে হলো। কাকন বিছানা থেকে উঠে দেখলো কাগজ দিয়ে মোড়ানো চার কোনা কিছু একটা।যা দৈর্ঘে-প্রস্থ্যেও বেশ বড়। কাকন জিনিসটি স্পর্শ করলো তারপর রুহুল কে জিজ্ঞেস করলো, “কি এটা? ”
রুহুল শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললো, “নিজেই খুলে দেখুন বিবিজান। ”

কাকন কাগজ গুলো সুন্দর করে ছাড়ালো এবং সব কাগজ ফেলে দেওয়ার পর যা দেখলো তাতে কাকনের চোখ মুখ উজ্জ্বল করা হাসি দেখা গেলো। কাকন হেসে রুহুলের দিকে তাকালো। রুহুল কাকনের পাশে দাড়িয়ে বললো, ” কি পছন্দ হয়েছে তো?”

–“হুম খুব, এটা তো দারুণ হয়েছে।”
–“আমি নিজেও এইমাত্র দেখলাম। বকুল দিয়ে গেছে। ওর ওই মামাতো ভাই নয়ন সে অনেক সুন্দর করে ফ্রেমে বন্দী করে এই ছবিখানা পাঠিয়েছে।”

কাকন ছবিটি পরখ করছে। গোলাপ ফুল গুলোর সামনে তারা দম্পতি দাড়িয়ে আছে। ছবিতে রুহুলের মনোমুগ্ধকর হাসি টিতে কাকন হাত ছোয়ালো। বললো, ” আপনাকে ছবিটিতে সত্যি খুব সুন্দর লাগছে। ”

রুহুল বললো, ” না,আমাকে নয়। আপনাকে তো আমার চেয়েও সুন্দর লাগছে। আপনার এই লাজুক হাসিটি যে আমার হৃদয়ে তীর এর মতো লাগে সেটা কি জানেন।”

–“আপনি পরপুরুষের সামনে আমার কাধে হাত রেখেছেন এই জন্যই তো লজ্জা পেয়েছিলাম। আর তাছাড়া উনিও হাসতে বললো তাই একটু হেসেছিলাম।”

–“আপনার লজ্জা আর হাসি দুটো মিলেই লাজুক হাসি হয়েছে। তবে যদি ছবিটি রঙিন হতো তাহলে আরো সুন্দর হতো। আমার বিবিজানের উপচে পড়া রুপ এই ফটো খানায় আরও পড়তো। ”

কাকন বললো,”গোলাপ গুলো সুন্দর লাগছে তাই না?”
–“উহু আমার রক্তজবা ফুলটাকে বেশি সুন্দর লাগছে।”
–“রক্তজবা তো আমার কানে গুজে দিয়েছিলেন। এটা বেশি একটা সুন্দর লাগছে না। গোলাপ ফুল গুলোই বেশি সুন্দর লাগছে ঠিকভাবে দেখুন। ”

–“আমি আপনার কানের জবার কথা বলিনি বিবিজান। আমি আমার রক্তজবার কথা বলেছি।”
–“আপনার রক্তজবা মানে? ”
–“আমার রক্তজবা ফুল তো আপনি বিবিজান।”
–“আমি? ”
–“হ্যাঁ আপনি, আপনি আমার জীবনের ফুটন্ত রক্তজবা। যে তার রঙ এবং সৌন্দর্যে আমায় আকর্ষিত করেছেন। আপনিই আমার প্রিয় ফুল,আমার রক্তজবা ফুল।”

কাকন রুহুলের কথায় আবারো প্রেমে পড়লো। এই মানুষটা এত সুন্দর করে কিভাবে কথা বলে কাকন ভেবে পায় না। এত ভালো কি করে বাসতে পারে স্ত্রী কে। কাকন রুহুলের উদ্দেশ্যে বললো,” এতটা ভালোবাসবেন না আমায়। ভয় করে খুব। আপনি যে আমার সুখের প্রদীপ। যে আমার জীবনে সুখ নিয়ে এসেছেন। যদি প্রদীপ হারিয়ে যায়। ”

–“আপনার এই সুখ কোনো দিনো হারাবে না। বরং আপনাকে আরো সুখ দেবো। ফটো টা হাতে দিন আমার।”
রুহুল কাকনের হাতে থেকে ছবিটি নিলো। তারপর দেয়ালে হাতুড়ি দিয়ে লোহার তাড়কাটা গেথে দিলো। ছবির পেছনে থাকা ছোট দড়ির সাথে ঝুলিয়ে দিলো ছবিটি। রুহুল কাকন কে সেই ছবিটির সম্মুখে নিয়ে গেলো। কাকনের কাধে হাত রেখে দুজনে পাশাপাশি দাড়ালো ছবিটির সামনে। কাচে হালকা দুজনকেই দেখা যাচ্ছে। রুহুল বললো, “এই ছবিটি এখানেই থাকবে। ঠিক বিছানা বরাবর যেন শুয়ে থেকেও আমরা আমদের দেখতে পারি। আর আপনার যখন আমার কথা মনে পড়বে আপনি তখনি এই ছবিটি দেখবেন। আর আমার যখন আপনার কথা মনে পড়বে তখন আমি চেয়ে চেয়ে দেখবো। ”

কাকন হেসে বললো, ” এই জন্যই বুঝি এভাবে বাধাই করেছেন আপনি । ”

–“না আরেকটি কারণ আছে। যখন আমরা বুড়ো বুড়ি হয়ে যাবো তখন তো আমার কিশোরী বিবিজান কে দেখার সখ হবে তখন এই ফটোখানা দেখে নেবো। আর আমার নাতি নাতনিদের দেখাবো যে তাদের দাদাজান কত সুদর্শন পুরুষ ছিল। ” কথাটি বলেই রুহুল কাকন কে চোখ টিপ মারলো।

কাকন রুহুলের চোখে চোখ রেখে বললো, “ভালোবাসার মানুষকে দেখতে ফটোর প্রয়োজন হয়না। চোখ বুজে অনুভব করলেই তার ছোয়া, তার হাসি ,তার সুপ্রিয় মুখখানা মনের আয়নায় ভেসে ওঠে।”

রুহুল কাকনের কথায় কাকনের ললাটে অধর ছোয়ালো। তারপর বললো, “আমি আপনার ভালো বাসার মানুষ।তার মানে আপনি আমায় ভালোবাসেন?”

কাকন রুহুল কে জড়িয়ে ধরে বললো, “জানি না!”
–“কসম খোদার বিবিজান, আপনার মুখে ভালোবাসি না শুনে আমি আপনাকে মরতে ও দেবো না। ”

কাকন নিজেকে ছাড়িয়ে ইচ্ছে করেই বললো, “তবে আমার মরন যেন আপনার হাতেই হয়! ”

রুহুল গম্ভীর স্বরে বললো, “আপনাকে ভালোবেসে নিজেই মরেছি বহুদিন, নতুন করে আপনাকে হত্যা
করে দ্বিতীয়বার মরতে চাই না।”

–” বেশ তবে আমার সকল আয়ু আপনার হোক।”
–“আমার আপনার আয়ু চাইনা। আমার আপনার ভালোবাসা চাই। আমার আপনাকে চাই। ”
___________________________

বিকেলে সকলের থেকে বিদায় নিয়ে কাকন সিরাজী মঞ্জিল থেকে বেরিয়ে গেলো। উদ্দেশ্য মহিলাশালা।
কাকনের মন টা খারাপ কারণ রুহুলকে জানানোর পর রুহুল জানায় তার কাজ আছে। আমলাপাড়ায় যাওয়া খুব দরকার। তাই সে যেতে পারবে না। রুহুল সকল ব্যবস্থা করে দেয় তবে একা যেতে দেয় নি। উল্টে তড়িপাকে সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে। রুহুলের প্রতি এক বাক্স অভিমান জমাতে জমাতেই গরুর গাড়ি মহিলাশালায় পৌছে গেলো। কাকন নেমে মহিশালার ভিতরে গেলে তড়িপা আবার রওনা হলো নিজ উদ্দেশ্যে।

কাকন মহিলাশালার উঠোনে পা রাখা মাত্রই সকলে কাকন কে ঘিরে ধরলো। যারা আগে কাকন কে অপছন্দ করতো তারাও এখন কাকনের সাথে ভালো ব্যবহার করে। রিতা কাকন কে দেখেই জড়িয়ে ধরলো। অবাক করা বিষয় হলো নুপুর ও এসেছে। এতদিন পর কাকন কে পেয়ে ওরা খুব খুশি। কাকন বাড়ান্দায় বসে থাকা নুপুরের কাছে গেলো।
নুপুরের শরীর টা,অনেক দুর্বল। শশুড় বাড়িতে অনেক কাজ করতে হয় এজন্য নুপুরের স্বামী সোহাগ ওকে এখানে রেখে গেছে। কাকন নুপুর এর কাছে বসে নুপুর কে জড়িয়ে ধরলো। নুপুর ও খুশি হলো। এই মহিলাশালায় শত মেয়েরা থাকে তবে কাকনের নিকটবর্তী সই ছিল নুপুর, রিতা, আর ফুল। ওরা কাকনের চেয়ে বয়সে কিছুদিনের বড় হলেও ফাতিমার আদেশে আপা বলে ডাকতে হয়েছে। ফাতিমা বেয়াদবি সহ্য করতে পারে না। আর কাকন ও বড়দের নাম ধরে ডাকা পছন্দ করে না তাই কাকন ও সম্মান করতো।

কাকন বললো, ” ভালো আছো আপা।”
–“হ্যাঁ ভালো আছি। তোর কি খবর?”
–“আলহামদুলিল্লাহ। ”
নুপুর কাকন কে বললো, ” কাকন আমার তো একটা হইলো তা তোর ডা কবে হইবো?”

কাকন বললো, “আমার দেরি আছে আপা। ”
–“দেরি আছে মানে?”
–“উনি যখন চাইবে তখন ই হবে আরকি। ”
–” তোর সুয়ামি তো তরে অনেক ভালোবাসে তাইলে পোলাপান নেয় না কেন? ”

–“সময় হলে একাই হবে আপা। আল্লাহর ইচ্ছে আর মানুষের চেষ্টা থাকলে সব হয়। আর ওনার ধারণা আমি এখনো ছোট। অপরিপক্ক। ”

–“চপ তর সুয়ামি রে কইবি বাচ্চা নিতে। বাচ্চা হইলো সংসারের খুটি। খুটি ছাড়া সংসার টিকে না। ”
–“আচ্ছা আপা, বলবো”

–‘শোন আমার কথায় গোসা করিস না। আমি তর ভালা চাই কাকন । এই কয় মাসে বুঝছি সুয়ামিরে হাতে করার অস্ত্র হইলো পুয়াতি হওয়া। জানোস হেতি আমারে এখুন আরো যত্ন করে, আদর করে। আমার যাতে কাম না করুন লাগে এই জন্য এইখানে পাঠায়া দিছে। এই জন্যই তরে কইলাম। ”

কাকন নুপুরের কথায় বললো, “আমাকে উনি এমনিই অনেক যত্ন করে আপা। বাচ্চা হলে কি তাহলে আরো করবে? ”
–“হ করবোই তো। আর তাছাড়া তুই তো পোলাপান পছন্দ করস।আগে রিপারে কত কোলে রাখতি তুই।”

কাকনের মনটা খারাপ লাগলো। তিন বছরের রিপা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। কাকন বললো,
“হুম সব হবে আপা। উনি আগে সিরাজপুরে কর্তা হোক। তা ফুল আপার খবর কি রিতাপা। ”

রিতা মুখ ছোট করে বললো, “আর ফুলের কথা কইস না রে কাকন।মাইয়াডা এত ভালা আছিল শেষমেশ ওই বদজাত ভাগ্যে জুটলো।মাইরা ধইরা শেষ কইরা দেয়।”

কাকন অবাক হয়ে বললো,”আপার গায়ে হাত তোলে?”
–“হ রে কাকন। চরম অত্যাচার নির্যাতন করে। ”
–“উনি কেমন স্বামী। কয়েক মাস হলো বিয়ে হয়েছে এখনি নির্যাতন করা শুরু করেছে। ”

নুপুর সায় মিলিয়ে বললো, “শুনছি রোজ রাইতে মদ খাইয়া আইসা ফুল রে পিটায়। আহারে মাইয়াডার হাড়গিলা বাহির হইয়া গেছে জানোস। ”

ফুলের এমন কথা শুনে কাকনের কষ্ট হলো। নিজের সই এর এমন অবস্থা সে সহ্য করবে না। কাকন বললো, “বিয়ের আগে খোজ খবর নেয় নি কেউ?”

–“আর খোজ। আমাগো কি আর কেউ খোজ নেওয়ার মানুষ আছে। ভাত ডাই তো জোটে সিরাজি গো দৌলতে। তা না হইলে বাপ মাও মরার পর ভিক্ষা কইরা খাওন লাগতো।”

কাকম বললো, “ফাতিমা আপা ফুল আপার এমন দশার কথা জানে? ”
–“হ জানে। শেষ বার ফুল পালায়া আইছিল। হাইরে কি কান্দুন। কিন্তু ফাতিমা আপা রাখে নাই । কারণ হেতি কয় সুয়ামিরে অসন্তুষ্ট করা যাইবো না।”

–“তাই বলে দিনের পর দিন এভাবে কষ্ট পাবে। ”

–“কি আর করার কাকন। আমারে দেখ আমিও কি কম নির্যাতিত হই। কিন্তু হেতি ঠিক আছে দেইখা তাও শান্তিতে আছি। তারা তো আগেই পোলার আশায় রইছে। মাইয়া হইলে যে কি হইবো খুদায় জানে।”

কাকন বললো, ” আমাকে ফুল আপার শশুড় বাড়ির ঠিকানা টা বলতে পারবে রিতা আপা?”
–” ওই যে নিমতলি গেরামের রহিম মুন্সির ছুডো পোলা। এক নাম্বারের পিচাশ। ফুলের কপাল ডাই পোরা জন্মের আগেই বাপ হারাইছিল, জন্মের পর মা আর এখুন এমন স্বামী পাইছে। তুই এগুলা জাইনা কি করবি? ”

–“আমি সিরাজী সাহেব কে বলবো ফুল আপার স্বামীকে ভয় দেখাতে যেন উনি আর ফুল আপার সাথে খারাপ আচরণ না করে।”
–“হ এইডা তুই ঠিক কইছা কাকন। তর সুয়ামির কথার অমান্য করতে পারবো না।”

কাকন বললো, ” আর অমান্য করলে ও পরিনাম ভয়াবহ হবে। নারীদের ওপর যারা নিজেদের পুরষত্বের গরম দেখায় তারা পুরুষ নয় তারা হলো কাপুরুষ ।”
______________

সকলের সাথে গল্প করে কাকন ফাতিমার কাছে গেলো। ফাতিমার কোলে কাকন মাথা রাখলো। কাকনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ফাতিমা বললো, “আমার কাকন আমারে ভুইলাই গেছে। আইজ মনে পড়ছে? ”
–“আপনাকে আমি কখনো ভুলবো না আপা।”
–“হ এই জন্যই তো আইসোস না।”
কাকন আহ্লাদি স্বরে বললো, ” আর আপনি বোধহয় খুব যান আমার কাছে। ”

–“আমি হইলাম গরিব চাকরানি। তাই আমি কি আর সবসময় রাজপ্রাসাদে যাইবার পারি?”

–“কেন পারেন না,অবশ্যই পারেন। আপনি আমার শশুড় বাড়িতে আমার মায়ের পরিচয়ে যাবেন।”
–“সেইডা হয় না আর তাছাড়া কাম কাজ ও বাইড়া গেছে। নতুন দালান ডার কাম শেষের দিক। ”
–আপা। ”
–“কিছু কইবি? ”
কাকনের অনেক কিছু বলার ছিল তবে মুখ ফুটে বললো, “আপনার শরীর ভালো আছে আপা। ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ কিনেছিলেন? ”
–” কবিরাজ দেখাইছিলাম।”
–“কিন্তু আমি যে বলেছিলাম বড় বাজারের কাছে ওই বুকের ডাক্তারকে দেখাতে।”

–“আরে কবিরাজ দেখাইয়াই কাম হয়। ডাক্তার খালি বড়ি দেয় আর ট্যাহা নেয়। তার চেয়ে কবিরাজ চাচাই ভালো। পানিপড়া আর ঝাড়ফুক দেয় সাইরা যায়।”

কাকন আঁচলের গিট খুলে আরো কিছু টাকা দিলো। তারপর বললো, “আগামীবার এসে যেন শুনি ডাক্তার দেখিয়েছেন। তা না হলে আমি আর আসবোই না কোনোদিন মহিশালায়। ”

ফাতিমা কাকনের কথায় বললো, ” ট্যাহা লাগবো না কাকন। আমি ডাক্তার দেখামু। তাও তুই আসিস। যাগো নিজ হাতে পাইলা বড় কইরা দেই তারা বিয়ার পর আমারে ভুইলা যায়। একমাত্র তুই আমারে ভুলোস নাই। আগের মতোই আছা। ”

–” মা হারিয়ে আরেক মা দিয়েছিল আল্লাহ তায়লা। এই মাকে যদি ভুলে যাই আল্লাহ আমায় ভুলে যাবেন।”

ফাতিমা ভেজা চোখে বললো, ” আল্লাহ আমারে এইজন্যই নিঃসন্তান বানাইছিল যাতে শেষ বয়সে তোর মা হইবার পারি। তুই ই আমার সন্তান। ”
___________________

রিতা উঠোন ঝাড় দিচ্ছিলো। কিছুক্ষণ বাদেই মাগরিবের আজান হবে। আম কাঠালের পাতায় উঠোন নোংরা হয়ে আছে। রিতার চোখ গেল গেইটের দিকে। দেখলো কেউ একজন উকি দিচ্ছে। রিতা ঝাটা হাতেই এগিয়ে গেলো। ঝাটা উচু করে বললো,”এই ব্যাডা, এই কেডায় আপনে। মহিলাশালায় কি করেন। জানেন না এইখানে পুরুষ গো আসার অনুমতি নাই? ”

রুহুলের কথা মতো সাজু গরুর গাড়ি নিয়ে এসেছিল। এই গাড়িতে কাকন কে উঠিয়ে দিতে হবে। কিন্তু এই ভাবে যে কেউ ঝাটা নিয়ে সাজুকে কেউ প্রশ্ন করবে ভাবে নি। সাজু বললো, ” আমি এইখানে ভাবিমার লিগা আইছি। তারে নেওয়ার জন্য আইছি। ”

–“ভাবিমা রে নেওয়ার লিগা মানে। ওহ আপনে কাকনের কথা কইতাছেন। ”
–“আজ্ঞে হ্যা। আমারে সিরাজী সাব ভাবিমারে গরুর গাড়িতে তুইলা দিতে কইছে। ”
–“আচ্ছা খাড়ান, আমি কাকন রে ডাইকা নিয়া আসতাছি। ”

রিতা তারপর কাকন কে ডাকলো। ফাতিমা, নুপুর ওরা সকলেই কাকন কে বিদায় দিলো। কাকন গরুর গাড়িতে উঠে পড়লো। আবার কবে আসা হবে জানা নেই। ছোট নিশ্বাস ফেলে বিদায় নিলো।
সাজু সাথে যাবে না তবে চেনা গাড়ির মালিক বিধায় কাকন খুব সহজেই যেতে পারবে। সাজু রিতার দিকে আবার তাকালো। পা থেকে মাথা অব্দি দেখে নিলো। রিতাকে ভালোই লাগলো সাজুর। ফাতিমা ভিতরে গেলে সাজু ডাকলো,” এই মাইয়া তোমার নাম কি? ”
রিতা বললো, ” আমারে কইতাছেন?”
–“হ এইখানে তো আর কোনো পরী নাই। ”
সাজুর কথা রিতার ভালো লাগলো না। ঝাটা উচু করে বললো, ” পিচাশ পোলা, যা ফোট এইখান থিকা। মাইয়া মানুষ দেখলে পিরিতি জাইগা উঠে তাই না।”

সাজু হেসে যেতে যেতে বললো, ” চইলা গেলাম ঝাটাওয়ালি পরী। তয় আমার একখান জিনিস রাইখা গেলাম। যা খুব শীঘ্রই নিয়া যামু। ”
_____________________

কাকন সিরাজী মঞ্জিলে আসলো। অন্দরমহলে ঢুকে বসার ঘরে গেলো। দেখলো সেখানেই সকলে গল্প করছে। কাকন সকলের সাথে দেখা করে দোতলায় গেলো।দোতলার সিড়ি পার করেই তিনতলায় আলো দেখতে পেলো। এতদিন পর তিনতলা হতে আগত আলো কাকনের হৃদগতি বাড়য়ে দিলো। কাকন দ্রুত সেদিকে গেলো। মনের মধ্যে অসম্ভব ভয় কাজ করছে এই ভেবে যে আবার কি নতুন কেউ মরলো নাকি।কাকন পা টিপে টিপে তিন তলায় গেলো। দেখলো ডান দিকের তিননম্বর কক্ষটি খোলা। কাকন এগিয়ে গেলো সেদিকে।

দরজার ফাকা অংশ দিয়ে দেখলো জামাল আর দুলাল সিরাজী দাড়িয়ে আছে। একটা বড় লোহার ট্রাংক দেখা যাচ্ছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে বছর শতেক আগের হবে হয়তো । কাকনের উৎসুক মন বার বার দেখতে চাচ্ছে কি আছে। জামাল যখন কিছুটা সরে গেলো কাকন তখন স্পষ্ট দেখলো হরেক রকমের তলোয়ার এর ভরপুর ট্রাংকটি। এত অস্ত্র জীবনের প্রথম দেখলো কাকন। তার ই মাঝে দুলাল সিরাজী তীর-ধনুক বের করলেন। কাকন তীর টি দেখে কাপতে শুরু করলো। দুলাল সিরাজীর কণ্ঠ শুনতে পেলো।দুলাল সিরাজী বলছে,” এইডা আমার দাদা আমারে দিছিলো।বিলাল যদি সুভারে বিয়া না করতো তাইলে আমার এই প্রিয় জিনিস টা অপবিত্র হইতো না।”

জামাল বলল,”ভাইজান যদি বিয়া না করতো তাইলে এত কিছু হইতোই না সিরাজী মঞ্জিলে। আর ওই মা* রে বিয়া না করলে আমার মহীও বাইচা থাকতো।”

দুলাল সিরাজী বললো, “সুভা তোর পোলাডারে খুন করলো আর তুই ছাইড়া দিবি জামাল?”

–“আব্বাজান আমি আর পাপে জড়াইবার চাই না। রুহুল কাউরে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেয় না। আমি এখুন মহীর আম্মারে নিয়া সুখে থকবার চাই। আমি ভালো হইয়া গেছি। ”

দুলাল সিরাজী জামালের কথা পাত্তা দিলো না। নিজের মতো করে বললো, “ওইদিন খুব ভাব দেখাইছিল সুভা তাই না জামাল। আমার বংশ তুইলা কথা কইছিল। আমারে থাপ্পড় দিছিলো। তরে যদি আমি সুযোগ কইরা দেই সুভারে হত্যা করার তাইলে কি তুই পারবি?”

–“আব্বা আপনে কি কইতাছেন?”
–“ঠিকই কইতাছি।আমি তরে সুযোগ কইরা দিমু।”
–“কিন্তু আব্বা রুহুল যদি শুনে?”
–“আর শুনবো কেমনে ওরে তো ঢাকা পাঠামু?।”
–“সত্যিই আব্বাজান? ”
–“হ তোর মহীরে খুন করার প্রতিশোধ নিবি।রুহুলের দায়িত্ব নেওয়ার আগেই খুন করবি। কারণ আমি জানি সুভা রুহুল রে দায়িত্ব নিতে দিবো না। সুভা আমাগো বংশ ঘেন্না করে। ওর একমাত্র পোলা এই বংশের দায়িত্ব নিক ও এইডা চাইবো না।”

–“তাইলে ওইদিন রুহুল রাজি হইলো কেন?”
–“কারণ সে চায় না তার বউ কলঙ্কিত হোক। আর তার প্রিয় আম্মা জেলে পচুক।”

–“আব্বাজান আপনের এত বুদ্ধি।”
জামাল ধনুক টি ট্রাঙ্কে রাখলো তারপর বললো, “আমার দাদাজানের খুব বুদ্ধি আছিল কিন্তু আমার আব্বাজান বোকা কিছিমের আছিল। রুহুল হইছে আমার দাদাজান আর আমার মতো আর তুই হইছা আমার আব্বাজানের মতো। ”

জামালের মুখ চুপসে গেলো। দুলাল সিরাজী আবারো বললো, ” সুভা আমার সামনে দাড়ায়া আমার বংশ রে থুথু দিছিল তাই না। ওর জিভ আমারে দিবি। যে হাত দিয়া থাপ্পড় দিছিলো ওই হাত আর ওরে টুকরা টুকরা কইরা সিরাজপুরের জঙ্গলে ফালাইয়া দিমু। জন্তু জানো’য়ারেরা খাইবো ”

জামাল বললো, “আব্বা আমার রুহুলরে ভয় করে। আর তাছাড়া আমি এখুন ভালো হইয়া যাইবার চাই। সুভার ক্ষতি কইরেন না। রুহুল ছাড়বো না আমাগো।”

দুলাল সিরাজী রেগে বললেন, “আর সুভা বাইচা থাকলে রুহুল কর্তা হইতে পারবো না। তাই অগ্রহায়ণ মাসেই সুভার লাশ সিরাজী মঞ্জিল থিকা বাহির হওয়া চাই।”
–“ঠিক আছে আব্বা, তা ওরে কি দাফন করমু নাকি
ওই অন্ধকার ঘরেই রাখুম।”
–“না ওরে টুকরা টুকরা কইরা জঙ্গলে ফালায়া দিবি।”

ওদের কথা শুনে আৎকে উঠলো কাকন। সুভাকে হত্যা করার পরিকল্পনা চলছে। কাকন জীবিত থাকতে সুভার ক্ষতি করতে দেবে না। সুভাযে তার সবচেয়ে আপন। ট্রাঙ্ক বন্ধের আওয়াজেই কাকন সেখান থেকে চলে এলো। কাকনকে যে যদি তারা দেখে কাকন সুভাকে তো রক্ষা করতেই পারবে না উল্টো দুজনের ই বিপদ হবে। মাথার ভিতর এক সৌরজগৎ সমান চিন্তা নিয়ে কাকন দৌড়ে নিচে নেমে এলো।কি করবে এখন কাকন?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here