দেবী,৪৯

0
307

#দেবী,৪৯
লেখিকাঃ শবনম রাবাহ (স্রোতস্বিনী)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।

সাজু সবাইকে আদেশ করলো নিজ নিজ দায়িত্বে থাকতে। তারপর রুহুলের আদেশ মতো লাশ ধেয়ানোর মানুষ নিয়ে আসা হয়েছে। রাতের আধারেই মশাল জালিয়ে লাশ ধোয়ানো হবে। আর তারপর হয়তো জোহরের পর দাফন করা হবে। রক্তাক্ত লাশ গুলো দেখে সকলেই ভয় পাচ্ছে। কোনোমতো মাথা কাপড় দিয়ে পেচিয়ে ধোয়ার জন্য নিয়ে গেলো। একে একে সকলেই বসার ঘর থেকে বেড়িয়ে গেছে।তবে ফজরের পরেই সিরাজী মঞ্জিলে যে লোক দিয়ে পরিপূর্ণ হবে রুহুল নিশ্চিত। কারণ তাদের কাছে ফেরেস্তা স্বরুপ দুলাল সিরাজী মরে গেছে তারা আসবেই। মিথ্যে কান্না হলেও একবার কাদবেই। দুলাল সিরাজী যতোই কঠোর হোক টাকা পয়শা দিয়ে সাহায্য করে। সকলক্ষেত্রে সিরাজপুরে তার অবদান শীর্ষে। তবে রুহুলের ভয় লাগছে যদি সিরাজপুর বাসী ক্ষীপ্ত হয়ে দেবীর কোনো ক্ষতি করে। তারা তো দুলাল সিরাজীর দোষ দেবে না বরং দেবী হিন্দু বলে দেবীকেই দোষারোপ করবে। সেই সাথে সুভাকেও হেনস্তা হতে হবে। এত গুলো মানুষের সাথে লড়াই করতে আপন মানুষের সাহায্য দরকার। অথচ রুহুলের আপন মানুষ গুলোই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।রুহুলের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা তো এদুটো নারীই।রুহুলের মনের শক্তি নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।

বসার ঘর এখন সম্পুর্ন ফাকা। রয়েছে কেবল সুভা, দেবী, রুহুল আর দুলাল আর জামালের বিষাক্ত রক্ত। রুহুল দেবীর থেকে দূরে রয়েছে। সুভা আর দেবী পাশাপাশি।দেবীর গায়ের রক্ত গুলো শুকিয়ে গেছে। রুহুল মনের ভেতর অনেক সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলো দেবীর দিকে। গলা অব্দি আটকে রয়েছে অজস্র না বলা কথা। ঢোক গিলে রুহুল দেবীর হাতে আলতো করে হাত রেখে ডাকলো,”বিবিজান! ”

রুহুলের মুখের বিবিজান ডাক দেবীর অন্তরে প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউ তুলে দিলো। তবে সেই ঢেউ দেবীর মস্তিষ্কের ঘৃণার মেরিনের কাছে হেরে গেলো। মনে পড়ে গেলো দুলাল সিরাজীর বলা সেই শেষ কথা।
_________________

দেবী হাতুড়ি দিয়ে দুলাল আর জামাল দুজন কেই আঘাত করছিল। জামাল জিজ্ঞেস করে, “তুই আমাগো মারলি কেন, আহ আল্লাহ বাচাও?”

–“সত্যি বলতে তোদের আরো কষ্ট দিয়ে বৈশাখ মাসে খু’ন করতাম। কিন্তু আফসোস তোরা আম্মাকে খুন করতে চাচ্ছিলি এই জন্য আজই তোদের শেষ করবো।”

দুলাল দু’হাত জোর করে বলে,”আমরা আর মারমু না সুভারে মাফ কইরা দে কাকন। মারিস না। ”

–“তোরা কি ভাবছিস তোদের আম্মার জন্য মেরেছি। ভুল তোদের মেরেছি আমার বাবা-মার জন্য। আমি দেবাশীষ ঠাকুর এর মেয়ে। আমি সেই দেবী।”

দুজনেই যেন আজরাইল কে দেখছে এমন ভাব করে। দুলাল অবাক হয়ে বলে,” কিন্তু জামাল যে কইছিল
ও তোরে খু’ন করছে।”

জামাল বলে,”তার মানে তুই মরস নাই। ওই ভয়াবহ ঝড় তুফানেও মরস নাই। জন্তু খায় নাই তরে?”

–“না আমি মরিনি। মরলে তোদের পাপের শাস্তি কে দিতো। তোরা পাপি তোদের ক্ষমা নেই । তোরা আমার মাকে মেরেছিস আমার বাবা কেও খুন করেছিস।”

কথাটি বলে আরো কয়েক বারি মারে। দুলাল সিরাজী আর্তনাদ করতে করতে বলে, “আমি মারি নাই, রুহুল, রুহুল মারছে তোর বাপরে।”

দেবীর হাত থেমে যায়। জামাল নিজের মাথায় হাত রেখে বলে,”খোদার কছম রুহুল খুন করছিল।”

দেবীর দুচোখ বেয়ে বেদনার অশ্রু ঝড়ে। রাগে ক্ষোভে দুলাল আর জামাল কে মারতেই থাকে। দুলালের বলা শেষ কথাটি দেবীকে আরো ক্ষেপিয়ে তোলে। ওরা মরে যাওয়ার পর ও দুলাল সিরাজী কে অনবরত আঘাত করতেই থাকে দেবী।
__________________

দুলাল সিরাজীর বলা কথাটি মনে হতেই দেবী রুহুলের হাত ঝারি দিয়ে সরিয়ে দিলো। বললো, “আমার নাম দেবী। আমি কোনো খুনির বিবিজান নই। আপনি
খুনি, আমার বাবার খুনি।”

রুহুলের বুঝতে বাকি নেই দেবী জেনে গেছে।আর এই কথাটা যে দুলাল অথবা জামাল বলেছে রুহুল বুঝল। ঠিক এই ভয়টিই রুহুল পাচ্ছিলো।দেবী আবারো কাদতে শুরু করলো। বললো, ” কেন ভালোবাসা শেখালেন আমায়। কেন মিথ্যে নাটক করলেন। আপনি আমায় ভালোবাসেননি বরং ভালোবাসার নাটক করে গেছেন। খুনিরা কোনো দিন ও ভালোবাসতে পারে না। আমি, আমি কল্পনাও করতে পারিনি আপনি সেই পুরুষ যে আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসার পুরুষের হত্যাকারী। ঘৃণা করি আপনাকে, আজ এই মুহুর্ত থেকে ঘৃণা করি আপনাকে রুহুল সিরাজী। ”

দেবীর কান্না আর ঘৃণা ভরা বাণী রুহুলের সহ্য হলো না। বেরিয়ে গেলো বসারঘর থেকে। তবে মুখোমুখি হলো সাজুর। রুহুল বিশ্রামশালায় চলে গেলো। দুহাতে মাথা চেপে বসে পড়লো। সাজু রুহুলকে অনুসরণ করেই সেখানে গেল তারপর পানি এগিয়ে দিলো। রুহুল এর অস্থির লাগছে। তাই সব টকু পানি খেয়ে নিল। তবে রুহুলের অস্থিরতা কমলো না।
সাজু অনেকবছর পর রুহুল কে এমন অবস্থায় দেখলো। সাজু বুঝলো তিন বছর আগে ও রুহুল এমন অস্থির হয়ে গিয়েছিল। তাহলে কি রুহুল সত্যিই খুন করেছে। এজন্যই বোধহয় রুহুল সেদিন পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল এবং দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
সাজু রুহুলের কাধে হাত রেখে বললো, “আপনি সত্যিই ভাবিমার বাপরে খুন করছেন?”

রুহুল সাজুর দিকে তাকালো। বললো, “হ্যাঁ। আমিই খুন করেছিলাম তাকে। তবে জানতাম না নিয়তি সেই খুনের জন্য এত বড় সাজা দেবে আমায়। ”

সাজু আবারো বললো,”ভাবিমারে অনেক ভালোবাসেন তাই না সিরাজী সাব। কষ্ট হইতাছে খুব?”

রুহুল কপালে পড়া চুল গুল হাতের আঙুলের সাথে পিছনে দিল।চোখের কোণে জমে থাকা জল বৃদ্ধাঙ্গুল এর দ্বারা মুছে বললো, “এত সহজে ভালোবেসে ফেলেছি যে সে আমায় ঘৃণা করে এই কথাটি তার মুখে শুনে সহ্য হচ্ছে না। আমি তার ভালোবাসা ছাড়া বাচতে পারবো তবে ঘৃণা নিয়ে একমুহূর্ত ও নয়। ”
________________

রুহুল চলে যাওয়ার পরপর ই সুভা ডাকলো,”দেবী!”

দেবী সুভার দিকে তাকালো না। সুভা আবারো বললো,”আমার খোকার খুব বেশি দোষ নেই দেবী। ”

দেবী ব্যাঙ্গ করে বললো, “হুহ এত কিছুর পর ও নিজের ছেলের পক্ষেই আপনি তাই না আম্মা।”
–“না আমি সত্যের পথে। তবে আমার খোকা কিছুটা হলেও নির্দোষ। আর কিছুটা শাস্তিও পেয়েছে। ”
–“এই দুনিয়ায় আল্লাহর পর বড় রক্ষক হলো মা। ছল চতুরতা দিয়ে হলেও সন্তান কে রক্ষা করবেই। আপনিও তার ব্যতিক্রম নন আম্মা।”
–“তাহলে তোমায় বলে রাখি আমি কিন্তু রুহুলকে ভালোবাসিনি। শুধু জন্মই দিয়েছিলাম।”
–“মানে?”

সুভা দেবীর আরো নিকট এলো। বললো, “আমার অতীত শুনবে? ”
দেবী মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালো।
সুভা বললো, “মানুষ কে ভালোবেসো তবে অন্ধবিশ্বাস করো না কোনো দিন। অন্ধবিশ্বাস তোমার ভালোবাসার মানুষকে অন্য কাউকে ভালোবাসতে সাহায্য করবে। তোয়াম্র অন্ধবিশ্বাস এর সুযোগ নিবে। আমি বিলাল কে ভালোবাসতাম কম বিশ্বাস করতাম বেশি। এজন্য নিজের পরিবার পরিজন ছেড়ে ওর হাত ধরে চলে এসেছিলাম। কিন্তু সিরাজপুরের মাটিতে পা রাখার সাথে সাথেই নিজের প্রেমিক বিলালকে হারিয়ে ফেলি। আবিষ্কার করি এক অন্য বিলালকে যে তার পিতৃভক্ত।সেদিন দুলাল সিরাজী আমাকে বের করে দিতে বলে কিন্তু বিলাল আমায় নিজের সাথে রাখতে চায়।

নিজেদের মান সম্মান কেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয় সিরাজীরা। মান হানির ভয়ে দুলাল সিরাজী হুকুম করে সিরাজী মঞ্জিলের চৌকাঠে পা রাখার আগেই আমাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। নিজের অতীত কে ত্যাগ করতে। সেদিন ভালোবাসার টানে নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করি। বিসর্জন দেই সুভাষিণী ঠাকুর কে জন্ম হয় এক নতুন সুভার। বিয়ে করিয়ে দেওয়া হয় আমাদের রাতারাতি। প্রথম সব ঠিক থাকে কিন্তু পরে আমি বুঝতে পারি বিলাল আমাকে নয় আমার রুপ কে ভালবাসতো। ভালোবাসতো আমার সৌন্দর্য্যকে। আবার কখনো কখনো মনে হতো ও আমায় ভালোবাসে। বিয়ের ১ বছরের মাথায় দুলাল সিরাজীর কথায় বিলাল মালেকা কে এই বাড়ি নিয়ে আসে। পরে জানতে পারি অনেক আগে থেকে তাদের বিয়ে ঠিক করা ছিল। অর্থাৎ বিলাল আমায় ঠকিয়েছে। আমি প্রতিবাদ করিনি কেননা ভালোবাসার মানুষের কাছে যারা ঠকে তারা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী হলেও দুর্বল হয়ে যায়। তার পর সিদ্ধান্ত নেই এই মঞ্জিল থেকে পালিয়ে যাবো। কিন্তু আমার জীবনের কাল হয়ে আমার গর্ভে আসে খোকা। পালিয়ে যাওয়ার সময় মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম সিরাজী মঞ্জিলের পিছনের গেইটের কাছে। সেদিন আমার শাশুড়ি আমার চেহারা দেখেই বুঝে যায় আমি মা হতে চলেছি। তবে আমি বুঝিনি আমার ভিতর আরেক সত্তা আছে। আমি মা হবো জেনে খুশি নয় বরং কষ্ট হয়েছিল। কারণ আমি অন্তরসত্তা জেনে আমার শাশুড়ি, শশুড় সকলেই আমায় চোখে চোখে রাখতে শুরু করে। এমন কি বিলাল ও আমায় চোক্ষে হারাতে শুরু করে। আমি পালানোর সুযোগ টুকু পাই নি। তাদের এসকল আদিক্ষেতা আমি গ্রহণ করতে পারছিলাম না। তারা যে আমার সন্তানের জন্য এমন করছে সে আমি জানতাম। এ বংশের প্রথম সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সাথে সাথেই কর্তা হবে তাদের পুর্বপুরুষদের নিয়ম। আর এই জন্যই তারা আমার সন্তানের প্রতি আকৃষ্ট হয়। আমি বুঝে গিয়েছিলাম এই সন্তানের জন্যই নিজের জীবন গড়ার শেষ সুযোগ টুকু হারিয়ে ফেলবো। যখন ৯মাস তখন মালেকা আমায় সিড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। আমি জানতাম মালেকা হিংসে করে তাই এমন করছে। তবে ওর প্রতি রাগ হয় নি। ওর বয়স তখন মাত্র ১৬ ছিল। আমার ওকে ভালোই লাগতো। খুব চেয়েছিলাম সন্তান টা যেন পৃথিবীর আলো না দেখে। অন্তত আমি বেচে যাবো। কিন্তু আল্লাহ ওকে আলো দেখায়। জন্ম নেয় আমার খোকা। গায়ের রঙ থেকে শুরু করে গঠন সব যেন নিখুত হয়। ওর আব্বা, দাদা সকলেই ওকে দেখে মনেপ্রাণে খুশি হয়। পুরো সিরাজপুরে উৎসব এর আয়োজন করা হয়। কিন্তু সারাজীবন এর জন্য আমার জীবনের সুখ কেড়ে নেওয়া হয়। এই বাড়িতে আমাকে রাখাই হয়েছিল তাদের সম্মান আর রুহুলের জন্য। দুলাল সিরাজীর কাছে তাদের সম্মান সবার আগে। আমি চলে গেলে নানা দুর্নাম হবে। বাড়ির বড়বউ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া মানে পরপুরুষ এর সাথে গেছে এটাই ভাববে সবাই। সিরাজী মঞ্জিলে তাই তারা জোর করে রেখে দেয়। অন্যদিকে খোকা আমায় আর ওর আব্বাকে একসাথে রাখতে চাইতো। আমি কাদলে আমায় জড়িয়ে ধরতো। কিন্তু আমার কষ্ট কমতো না আরো মনে পড়তো ওর জন্য সেদিন পালাতে পারি নি। আমার করা খারাপ আচরণের জন্য ও অনেক কষ্ট পেতো। তবে আমি এই দুনিয়ায় বেচেই আছি কেবল খোকার জন্য। না হলে দুলাল সিরাজী অনেক আগেই হত্যা করতো আমায়।জানো আমি না থাকলে খোকা ও থাকতো সিরাজী মঞ্জিলে। আর আমার খোকা আমায় অসম্ভব ভালোবাসে। তোমার থেকেও বেশি ভালো বাসে। আমায় ছাড়া সে থাকতেই পারতো না। আমি না খেলে সেও মুখে ভাত তুলতো না। ঢাকায় লেখাপড়া করলেও সপ্তাহে একদিন আসতো কেবল আমায় একপলক দেখার জন্য। আমায় বলতো আমায় দেখলে নাকি মনে হয় আল্লাহর সেরা সৃষ্টি দেখছে। বলতো আমায় ছাড়া ওর ঢাকায় থাকতে কষ্ট হয়। তবে তিন বছর আগে একটা ভুলের জন্য ও চলে যেতে চেয়েছিল। ওকে আমি তেয্য ঘোষণা করেছিলাম। ”

দেবী অবাক হলো একটা মা কি করে এমন করতে পারে।সুভা আবারো বললো, “সিরাজপুর এমন এক জায়গা যেখানে এক লোকমুখে বানানো নিয়ম রাখা হয়। বিধর্মীদের থাকতে দেওয়া হবে না। অন্য ধর্মের মানুষদের ঘৃণা করে এরা। অথচ আল্লাহ মানুষ কে ভালোবাসতে বলেছেন সুষ্ঠু ভাবে ধর্মের জন্য দাওয়াত দিতে বলেছেন। অথচ এনারা ধর্মের নামে মানুষ খুন করছে। আমাকে যে কালিমা পড়িয়ে মুসলমান বানিয়েছিল সে যদি কাউকে বলে দেয় সিরাজীদের মান নষ্ট হবে। সেই ভয়ে তারা সেই মানুষ টিকেও খুন করে। আর ফেলে রাখে সেই গুপ্ত কক্ষটিতে। লাশ দেখে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগবে কে খুন করেছে ইনসাফ না দিতে পারলে বদনাম হবে তাই গুপ্তকক্ষে ফেলে রাখতো। মহিলা শালার ফাতিমার স্বামীকেও দুলাল সিরাজী খুন করেছিল। কেন জানো কারণ মদ খেয়ে বিলাল তার কাছে আমার পরিচয় বলে দিয়েছিল। বেচারা পরের দিন বিলালকে জিজ্ঞেস করতেই বিলাল তাকে হত্যা করে। আজ ও কংকাল আছে ওই কক্ষে। অথচ ফাতিমা নিজেও জানে না।

তিন বছর আগে আমার দাদা অনেক কষ্টে সিরাজপুরে এসেছিল সেদিন। দাদা আমার খোজে সিরাজী মঞ্জিলের বাইরে প্রহরীদের জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু পরনে হিন্দুর বেশ এ থাকায় প্রহরীরা ঢুকতে দেয় না। দাদা অনেক অনুরোধ করে বলে যেন ওনাকে একটা বার আমার সাথে দেখা করার সুযোগ দেওয়া হয়। প্রহরী ওনার অনুরোধে মঞ্জিলের ভিতরে প্রবেশ করে তারপর আমাকে জানায়। আমি রন্ধনশালায় ছিলাম।দাদার কথা আমি জানার পর দৌড়ে দাদা এর কাছে যাই। আটাশ বছর পর দাদা কে দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নি জাপটে জড়িয়ে ধরেছিলাম আমি। চোখের পানি যেন বাধা মানে নি। তারপর অন্দরমহলে নিয়ে আসি। আমি ভুলে গিয়ে ছিলাম যে নরকে নিয়ে আসতে চলেছিলাম আমার দাদা কে। তাকে যে এতটা অপমানিত হতে ভাবতে পারি নি। ওই দুলাল সিরাজী আর তার রক্তচোষা বংশধরেরা আমার দাদাকে অপমানিত করে। নানা নোংরা কথা বলে। এরপর ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে চায়। আমি মুখ বুজে সহ্য করতে পারছিলাম না। আমি প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার দাদা আমায় বাধা দেয়। দাদা বারবার বলছিল আমায় আবার এনে দিয়ে যাবে। শুধু মা আমাকে দেখার অনুরোধ করছে আমি যেন সাথে যাই। কিন্তু দুলাল সিরাজী বলে আমি যদি যাই সারাজীবন এর আমার জন্য এই মঞ্জিলের চৌকাঠ বন্ধ। আমিও সেদিন বলেছিলাম যে বেশ তাই হবে।তারপর একপ্রকার তর্ক বেজে যায়। দুলাল সিরাজী রন্ধনশালার দরজা বন্ধ করে দেয় বাইরে থেকে। ভেতরে সকল মহিলারা ছিল তারপর দুলাল দোতলায় চলে যায় আমি ভেবেছিলাম সে হয়তো মেনে নিয়েছে। বিলাল বার বার আমায় বাধা দিচ্ছিলো। অনেক সময় পর সকলের বাধা উপেক্ষা করে আমি দাদার হাত ধরে চলেই যাচ্ছিলাম কিন্তু..! ”

–“কিন্তু ? কিন্তু কি আম্মা?”
–” মা কে দেখার জন্য ছুটে যাচ্ছিলাম। দাদার হাত ধরে বাড়ির চোকাঠ মাড়াবো ঠিক তখনি আমার দাদা কে ধারালো ছুরি দ্বারা পিছন থেকে আঘাত করে। তারপর আরেকবার আঘাত করে। শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে দাদা।আমার দাদার রক্ত দিয়ে সিরাজী মঞ্জিলের চৌকাঠ রাঙা হয়ে যায়। আর সেই আঘাত করেছিল খোকা আর ওর হাতে ছিল ধারালো ছুরি। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম আমার খোকা আমার দাদাকে হত্যা করলো। তারপর আমার চোখের সামনে মহী, হেলাল, জামাল সেই গুপ্ত কক্ষে দাদাকে ফেলে রাখে। কিছুই করতে পারছিলাম না, আমি নিরুপায় ছিলাম।

পরে জানতে পারি খোকা যা করেছিল তা দুলাল সিরাজীর চক্রান্ত ছিল। সেদিন খোকা কক্ষে ঘুমিয়ে ছিল। দুলাল সিরাজী ওকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। মিথ্যে কথা বলেছিল খোকার কাছে যে দাদা আমায় মাকে দেখানোর বাহানায় নিয়ে যেয়ে হত্যা ও করতে পারে। সেই সাথে মঞ্জিলের মান সম্মান সব নষ্ট হয়ে যাবে আমার জন্য। আমি যে হিন্দু ছিলাম খোকা জানতো না। হঠাৎ করে জেনে অবাক হয়। আমি হিন্দু এ কথাটি সিরাজপুর বাসিও জেনে যাবে। সিরাজপুরে সবাই আমাকে ঘৃণা করবে ।আর দ্বিতীয়বার আমি এখানে আসতে পারবো না। আর আমাকে কেউ ঘৃণা করবে খোকা সেটা মেনে নিতে পারবে না।সেই সাথে আমাকে হারানোর ভয়। দুলাল সিরাজী কুবুদ্ধি দেয় আমার দাদাকে হত্যা করার। সেদিন আমার খোকা স্বার্থপর এর মতো খুন করেছিল আমার দাদা কে।আমায় হারানোর ভয়ে বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিল। খুন করার আগে একবার ভাবেনি যে সে ঠিক করছে নাকি ভুল করছে। আমার খোকা মাতৃপ্রেমে অন্ধ ছিল আমায় ভীষণ ভালোবাসে। সেদিন আমি ওকে অসংখ্য থাপ্পড় মারি। সেই সাথে থুথু ছুড়ে মারি দুলাল সিরাজীর মুখে এমনকি থাপ্পড় ও মেরেছিলাম। অভিশাপ দেই এই বংশ কে। আর সেই সাথে খোকাকে ত্যায্য ঘোষণা করি। টানা এক বছরের অধিক খোকার সাথে কথা বলা তো দূর মুখ ও দেখি নি। আমি নিজেও দাদার শোকে কাতর ছিলাম। কিন্তু বিলাল আহত হওয়ার পর কথা বলা শুরু করি তবে স্বাভাবিক ভাবে নয়। আমার ঘৃণা ওর সহ্য হচ্ছিল না। সিদ্ধান্ত নেয় বিদেশ যাবে।
কিন্তু একের পর এক বাধায় যেতেই পারে নি। ”

বাবার মৃত্যুর কথা শুনে দেবীর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়তে শুরু করলো। তার বাবা কে কতটা নির্দয় ভাবে খুন করা হয়েছিল। কাদতে শুরু করলো দেবী। বললো, “উনি কি করে বাবাকে খু’ন করতে পারলো। আমি ওনাকে এই সিরাজপুরের শ্রেষ্ঠ পুরুষ ভাবতাম। উনিই খুনি আমার বাবার খুনি। আমি ওনাকে ভালোবাসতাম তবে আমার বাবার হত্যাকারীর কোনো ক্ষমা হতে পারে না। উনি পাপি আমার বাবার হত্যাকারী।”

–“খোকা যা করেছে অন্যায়, ভুল করেছে। তবে আমি বলব এইসব কিছুর জন্য আমিই দায়ী। সেদিন যদি বিলালের হাত ধরে না চলে আসতাম এত কিছুই হতো না। আর না তোমার বাবা -মা মৃত্যুবরন করতো।আমাকেও খুন করো দেবী বাচতে চাই না। ”

–“না,,আপনি কোনো কিছুর জন্য দায়ী নন। সব কিছুর জন্য দায়ী আমি। আমার জন্য সব হয়েছে। আমি যদি বাবাকে দিব্যি না দিতাম, মাকে নিয়ে না আসতাম আজ আমার বাবা-মা দুজনেই বেচে থাকতো। আমি বাবা-মা হারা হতাম না। আমিই আমার বাবা-মায়ের খুনি। আমার জন্য শুধু আমার জন্য এমন হয়েছে। আজ তিনটে বছর হলো ভিতরে ভিতরে দহন জ্বলছে আমার। নিজের উপর ঘৃণা হয় নিজে আমি নিজের বাবা মায়ের হত্যা কে সাদরে আমন্ত্রণ করেছি।”

সুভা দেবীকে বুকে জড়িয়ে নিলো। বললো, “দাদার মৃত্যুর সাথে সাথে আমিও মরে গেছি। এই জগতে আমার আপন বলতে কেউ নেই। কিন্তু প্রথম দেখায় তোকে আমার ভালো লেগেছিল। হয়তো রক্তের টান। আমি এটা বলবো না যে আমার খোকাকে ক্ষমা কর শুধু বলবো ওকে হত্যা করিস না। ওর কোনো দোষ নেই। আমাকে হারানোর ভয়ে এমন করেছে। জানিস খোকা হরিপুর এ ও গিয়েছিল তোদের খোজে। ক্ষমা চাইতে কিন্তু তোদের কাউকে পায়নি। বাড়ির বাইরে তালা ঝুলেছিল। ও তো জানতোই না বৌদির হত্যার কথা। এমন কি নিজের বিয়েতে ও দাওয়াত দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সে তো আর জানতো না যে সেই তুই ওর সহধর্মিণী হবি। আমার খোকা সেরা পুত্র এবং সেরা স্বামীও বটে। ওকে একটা সুযোগ দে। আমি জানি তুই ওকে ভালোবাসিস দেবী।”

দেবী সুভাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। বললো, “না আমি ওনাকে ভালোবাসি না। আমার বাবার খুনিকে ভালো বাসি না। ”
কথাটি বলেই দেবী দৌড়ে নিজের কক্ষে ছুটে গেলো। দরজা আটকিয়ে দরজার কাছেই পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়লো। তিন বছর পর আজ আবারো একইরকম অসহায় অনুভব হচ্ছে। রুহুলের প্রতি ঘৃণা মুখে বললেও মন থেকে আসছে না। হাটুতে মুখ গুজে কাদতে শুরু করলো দেবী।

অন্যদিকে রুহুল মাথা নিচু করে বসে আছে। হৃদয়ের উথাল পাথাল এ নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। এ জীবনে বোধহয় দেবীর ভালোবাসা পাওয়া হবে না। কোনোদিন বোধহয় ভালোবাসি নামক মধুর শব্দ শুনতে পাবে না দেবীর মুখ হতে। রুহুলের চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো এক ফোটা নোনাজল। যা জানান দিচ্ছে কতটা কষ্ট হচ্ছে রুহুলের।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here