#পাথরের_মৃত্যু
পর্ব-৪
ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে নিজেকে অনেকটা সামলে নিল রুদ্র। ঘরের চারদিকে তীক্ষ্ণ নজর বোলাল৷ পরিপাটি করে গোছানো। ফ্ল্যাটটা বারোশো স্কয়ার ফিট হবে। বসার ঘরে কাঠের সোফা, টি টেবিলে সাজানো ফুলদানিতে তাজা রজনীগন্ধা, একটা কাচের কর্ণার ভর্তি পুতুল আর দেয়ালের সাথে লাগানো টেলিভিশন। সোফা, জানালার পর্দার রঙ, ঘরের লাইটিং সবেতেই একটা স্নিগ্ধ সুন্দর রুচির পরিচয় পাওয়া যায়।
রুদ্র বসতে বসতে প্রশ্ন করল, “আপনি কিভাবে জানলেন আমরা আসব?”
“ঘটনার মধ্যে আমিও জড়িয়ে গেছি৷ পুলিশ আমার কাছে আসবে না?”
“ঠিক ধরেছেন। আপনার গল্প আমি পড়েছি। পুরো ব্যাপারটাই রহস্যজনক। এতটা কাকতালীয় মিল কী করে হলো বলুন তো?”
“জানি না। আমি নিজেও ভীষণ অবাক হয়েছি।”
রুদ্রর অবশ্য মনে হলো না মেয়েটা ততটাও অবাক হয়েছে। বলার কথা তাই বলছে। তার আগ্রহ বেড়ে গেল মেয়েটার প্রতি৷ কথা বলার সাথে সাথে তায়েবার গালে হালকা টোল পড়ে। ঠোঁট গোল হয়ে আসে। রুদ্র অনেক কষ্টে সেদিক থেকে মনোযোগ সরাল।
“আচ্ছা, আপনি ইকরাম চৌধুরীর নাম দিয়েই গল্পটা লিখলেন কেন?”
“উনি আমাকে হেনস্তা করার চেষ্টা করছিলেন, আমি উল্টে ওনাকে করে দিয়েছি। দ্যাটস ইট! আমার কোনো ধারণাও ছিল না তার সাথে পরদিন এরকম হবে।”
“আপনার গল্পের খুনীর হাতিয়ার কী ছিল?”
“ছুরি।”
“এই ব্যাপারটাই শুধু মেলেনি। বাকি প্রায় সবই মিলে যাচ্ছে…”
“হ্যাঁ। কিন্তু মোটিভ?”
“ইকরাম চৌধুরীকে খুনের মোটিভ এখনো পরিষ্কার নয়।”
“আমার গল্পে কিন্তু মোটিভ ছিল প্রতিশোধ। প্রেমিকাকে ধোঁকা দিয়ে বিয়ে করার বদলে সাবেক প্রেমিককে খুন। এদিক থেকে এমনিতেও মেলার কথা নয়। আমি যতদূর জানি ইকরাম চৌধুরীর বিয়ে হয়েছিল অনেক আগেই। আর তার স্ত্রী মারা গেছেন গত বছর।”
“হ্যাঁ। এবার আপনাকে কিছু প্রশ্ন করব, ঠিকঠাক জবাব দেবেন।”
“করুন।”
“আপনি খুনের দিন কোথায় ছিলেন?”
“বাসায়।”
“কোনো প্রমাণ আছে?”
তায়েবা উত্তর দেবার আগেই কাজের মেয়ে চা নাস্তা নিয়ে এলো। তায়েবা হাসিমুখে বলল, “প্রমাণ আপনার সামনে। ও ছিল বাসায়। আমি সেদিন নয়টার দিকে ঘুম থেকে উঠেছি, তারপর ঘরেই ছিলাম। দুপুরের দিকে খবরটা জানতে পারি।”
রুদ্র কাজের মেয়েটার দিকে ফিরে বলল, “আপনার নাম?”
“জুলি।”
“ম্যাডাম গতকাল সকালে বাসায় ছিল?”
“জি।”
“আপনার বাড়ি কোথায়?”
“নরসিংদী।”
“এখানে আত্মীয়স্বজন নেই?”
“না। কাজের জন্য স্যারের সাথে আসছি।”
“স্যার কোথায় ছিলেন গতকাল সকালে?”
“স্যার সক্কালে উইঠা বাজারে গেছিল। আইছে দুপুরবেলা।”
“আচ্ছা। যেতে পারেন…
” আপনি বলুন মিস তায়েবা, আপনার বাবা কোথায় এখন?”
“বাবা বিকেলে হাঁটতে বের হন। তার ডায়বেটিস। হেঁটে একেবারে মাগরিবের নামাজ পড়ে ফেরেন।”
“আচ্ছা!”
“আপনারা কিছু নিচ্ছেন না কেন? প্লিজ নিন…চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
অন্য সময় হলে রুদ্র কঠোর স্বরে বলত, এখানে খেতে আসিনি। তবে এখানে বলতে পারল না। এত মিষ্টি করে বললে না করা যায় না।
সে একটা আপেলের টুকরো তুলে নিতেই নাজমুল গ্রীন সিগন্যাল পেল যেন। হামলে পড়ল খাবারের ওপর। বেচারা দুপুরে কিছু খাওয়ার সময় পায়নি।
“আমি এক মিনিট ভেতরে যেতে পারি?”
“জি অবশ্যই।”
তায়েবা উঠে ভেতরের ঘরে চলে গেল। ফিরল ঠিক এক মিনিট পর। তার হাতে একটা বই। সেটা সে রুদ্রের হাতে দিয়ে বলল, “এটা আমাকে গতকাল ইকরাম চৌধুরী দিয়েছিলেন।”
“উপহার?”
“জি। ভেতরের পাতায় একটা চিঠিও আছে। আমার মনে হলো আপনাদের এটা কাজে লাগতেও পারে, তাই নিয়ে এলাম।”
রুদ্র বইয়ের পাতা উল্টে চিঠিটা বের করল।
“প্রিয়দর্শিনী,
আপনার সাথে ক্ষীণ সময়ের পরিচয়ে এতটাই অভিভূত হয়েছি যতটা জীবনে কখনো হইনি৷ আপনার মতো একজন ব্যক্তির সাথে আমি জটিলতার সম্পর্ক তৈরি করতে চাই না, বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে চাই। আমি একা মানুষ, কেন যেন মনে হয় আপনি আমার খুব ভালো বন্ধু হতে পারবেন। আপনি কি আগ্রহী? জবাবের অপেক্ষায় রইলাম৷
– ইকরাম চৌধুরী”
রুদ্র অবাক হয়ে বলল, “এরা সেই গল্প লেখার পরের ঘটনা?”
“জি।”
“আপনি কোনো জবাব দিয়েছিলেন?”
“না। বইটা র্যাপিং করা ছিল। বাসায় এসে খুলে দেখি এটা। যোগ্য জবাব মুখের ওপর দেব বলে অপেক্ষায় ছিলাম পরের দিন মেলায় যাবার। কিন্তু এর মাঝে এই কান্ড হয়ে গেল!”
রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ট্রেঞ্জ!”
সে উঠে দাঁড়াল। বলল, “বই আর চিঠি নিয়ে যাচ্ছি। আপনাকে আবার ডিস্টার্ব করব প্রয়োজন হলে।”
“জি অবশ্যই।” মিষ্টি হাসল তায়েবা। রুদ্রের মনে হলো যতটা সুন্দর তারচেয়ে বেশি নিষ্পাপ।
***
ইকরাম চৌধুরীর মৃত্যুতে শোকাহত লেখক পাঠকের দল আজ বইমেলায় লেখক হত্যার বিচার চেয়ে মানববন্ধন করছে। কালো পোশাকে একদল লোক দাঁড়িয়ে আছে ব্যানার হাতে৷ এই মানুষগুলো সত্যিই শোকাহত। অকালে এমন উজ্জ্বল নক্ষত্রকে হারিয়ে ফেলার দায় যার তার বিচার চাইতে উন্মুখ সকলে।
এদিকে মেলায় ইকরাম চৌধুরীর বই বিক্রি হচ্ছে হু হু করে। সাথে বাদ যাচ্ছে না তায়েবা তারান্নুমের বইও। কৌতুহলী পাঠকেরা যেন বই পড়েই তাদের রহস্যের সমাধান করে ফেলবে!
এদিকে লেখকগণ, যারা সেদিনকার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, তারা ফেসবুকে নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন। সেদিন যে যাই বলুক না কেন, আজ প্রায় সবাই ইকরাম চৌধুরীর পক্ষে কথা বলছেন৷ আর তায়েবা হয়ে গেছে ভিলেন৷ কেউ কেউ অবশ্য তার পক্ষেও। কাকতালীয় ব্যাপার স্যাপার নিয়ে লেখা হচ্ছে বিস্তর।
এদিকে মিডিয়াও পড়ে আছে খুনের রহস্য নিয়ে। বিপত্নীক, অন্তর্মূখী অতি সরল জীবনযাপন করা এই জনপ্রিয় লেখকের মৃত্যুর পেছনে কার হাত থাকতে পারে? জল্পনা কল্পনায় ভেসে যাচ্ছে গোটা দেশ।
ওপরমহলের চাপ বাড়ছে। রুদ্রের ওপর নির্দেশ দেয়া হয়েছে বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে তদন্তের সুরাহা না হলে কেস অন্যত্র হ্যান্ডওভার করা হবে। সবার আগে যেন এই কেসটা নিয়ে তদন্ত করা হয়।
সব মিলিয়ে বলা যায় খুনের তৃতীয় দিনে একেবারে আগুন লেগে গেছে।
সবগুলো সূত্র একত্র করে তদন্তের একটা খসড়া তৈরি করছিল রুদ্র। ফরেনসিক রিপোর্ট পাওয়ার আগে হাত কামড়াতে হচ্ছে। আজ বিকেলে নাকি পাওয়া যাবে। তার আগে যা অবস্থা ছিল তা থেকে উঠে আসা যায়নি।
ইকরাম চৌধুরীর আত্মীয় পরিজন যা ছিল, কারোর সাথেই তার তেমন যোগাযোগ ছিল না৷ তার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের সম্পর্কে কিছু জানাই যায়নি৷ শোনা গেছে, পালিয়ে বিয়ে করায় তার স্ত্রীর পরিবার তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে। মৃত্যুর পরে কী হয়েছিল সে ব্যাপারেও পরিষ্কার কোনো ইঙ্গিত নেই।
দারোয়ান হোসেন আলী আর কাজের মেয়ে সুমা তাদের বক্তব্যে অটল আছে। হোসেন আলীকে সাময়িক জামিন দেয়া হয়েছে, তবে সুমাকে ছাড়াতে কেউ আসেনি। রুদ্র তাতে খুশিই হয়েছে। মেয়েটাকে চাপ দিয়ে আরও কথা আদায় করতে হবে। কিছু তো অবশ্যই লুকিয়ে যাচ্ছে৷
***
দুপুরের দিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো নাজমুল।
“স্যার..ওইযে ফোন নাম্বারটা, ওইটা ওপেন হইছিল। ট্রেস করা গেছে। সেই নাম্বার ‘গ্র্যান্ড রেস্টইন’ হোটেলে রয়েছে। সেখানে খোঁজ নিতে গিয়ে শুনি এই নাম্বার যার ছিল সে খুন হয়েছে।”
“হোয়াট?”
“জি স্যার। এক্ষুনি যেতে হবে আমাদের।”
“চলো!”
হোটেলে পৌঁছে লাশটা দেখা গেল। যে থানার আন্ডারে হোটেলটা পড়ে সেখানকার পুলিশেরা ঘর সার্চ করছে৷ লাশটা দেখল রুদ্র। বুকে ছুরি বিঁধিয়ে মারা হয়েছে। মহিলার বয়স ত্রিশ-বত্রিশ হবে। গায়ের রঙ ফরসা, দেখতে বেশ ভালো।
তদন্তকারী অফিসারকে সে নিজের আসার কারণ ব্যাখ্যা করে প্রশ্ন করল, “এই মহিলার ব্যাপারটা কী? কে সে?”
“যতদূর জানলাম এর নাম রোমানা। সম্ভবত পতিতা গোছের হবে। নামকরা এক বিজনেসম্যানের সাথে এখানে এসেছিল। সেই লোকের নাম না জানাই ভালো। পলিটিক্যাল। তবে সে খুনের সাথে জড়িত না হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। সে বেরিয়ে যাবার পর মেয়েটা খাবার অর্ডার করে। সেই খাবার দিতে গিয়ে লাশের সন্ধান পাওয়া যায়। কেসটা নিয়ে একভাবে ভাবছিলাম, এখন আপনার কথায় অন্যরকম লাগছে। এর সাথে ইকরাম চৌধুরী খুনের কী সম্পর্ক থাকতে পারে সেটা বুঝতে পারছি না।”
“হতে পারে পেশাগত সম্পর্ক। মহিলার থেকে সার্ভিস নিতেন।”
“সেটা হতে পারে। কিন্তু খুন হবে কেন? দুটো খুন কি একটা অপরটার সাথে জোড়া লাগানো?”
“হতেই পারে! সিসিটিভি ফুটেজ নেই এই ঘরের সামনে?”
“আছে। এটাই সবচেয়ে গন্ডগোলের জায়গা। দেখাচ্ছি চলুন।”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু