#পাথরের_মৃত্যু
পর্ব-৮
আজ বাকি ঘরগুলো খুঁজতে বের হয়েছে রুদ্র। প্রথমেই ইকরাম চৌধুরীর বেডরুম৷ প্রথমদিন অনেক কিছুই অজানা ছিল। সেজন্য আপাতদৃষ্টিতে যেগুলো প্রয়োজনীয় মনে হয়নি সেগুলো ধরা হয়নি। আজ প্রতি ইঞ্চি খুঁটিয়ে দেখতে হবে।
আজকে বাড়িটা আরও বেশি অদ্ভুতুড়ে লাগছে৷ পুলিশের লোক হয়ে গা ছমছম একেবারেই মানায় না। তবুও রুদ্র কয়েকবার পেছন ফিরে তাকাল।
খাটের নিচটা একবার দেখল। সেখানটা গতদিনই খুব ভালোভাবে দেখা হয়েছিল। ব্যবহার করা প্রোটেকশনের প্যাকেটগুলো সেখানেই পাওয়া গেছে৷ ওগুলো ম্যাচ করেছে ইকরাম চৌধুরীর সাথে। তার মানে দাঁড়ায় ওগুলো তারই ব্যবহার করা৷
খাটের ওপর থেকে বিছানার চাদর আর তোষক তুলে দেখল সে। পেল না কিছু। তবে তোষকের একটা প্রান্ত দেখে মনে হলো সদ্য সেলাই করা হয়েছে। সেটা একটানে খুলে ফেলল রুদ্র। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক গোছা চুল। কালো কুচকুচে রেশমী চুলগুলো! রুদ্রর গা টা শিরশির করে উঠল। কালো জাদুর করা হয়েছে নাকি? পেটের ভেতরটা পাক খেয়ে উঠল। তবে সে এভিডেন্সের ব্যাগে চুলগুলো রাখতে ভুলল না৷
এই ক’দিনেই ধুলো পড়ে গেছে ফার্নিচারগুলোতে। ঘরের এক কোণে জালের সাথে আটকে আছে পেটমোটা একটা মাকড়সা। মাকড়সার গায়ের রঙ কালো, তাতে সোনালী ছোপ ছোপ। মাকড়সা দেখে এমনিতে গা ঘিনঘিন করলেও আজ যেন একটু ভরসা পেল৷ মনে হলো একটা জীবন্ত প্রাণী অন্তত আশেপাশে আছে।
খাটের ওপর বালিশের সেলাই খুলেও দেখল রুদ্র। আর কিছু পাওয়া গেল না।
সেদিন টেবিলের ড্রয়েরটাতে একটা জিনিস দেখে খটকা লেগেছিল। ড্রয়েরটা খুলল সে। ভেতরে ফাইলপত্র।
দুটো ফাইল নিল সে৷ দুটোতে একই গল্প লেখা, কিন্তু দুই রকমের হাতের লেখা। অনেকক্ষণ পড়ে একটা জিনিসই সে বুঝতে পারল, আর সেটা হলো একটা আরেকটার কপি করা। কিন্তু আজকের যুগে কে খাতা কলমে লেখে? তাও এক গল্প দুইবার? এই দু’জন কারা?
বের করার একটা সুযোগ আছে৷ মিলিয়ে দেখা গেল এর মধ্যে একটা লেখা ইকরাম চৌধুরীর। অন্যটা কার? চেনা হাতের লেখা মনে হচ্ছে.. কেন গল্পটা সে দেখে দেখে কপি করেছে? প্রকাশক নয়তো? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
সে প্রকাশক জীবন তালুকদারকে ফোন করে জেনে নিল ইকরাম চৌধুরী বেশ কয়েক বছর ধরে তার পান্ডুলিপির সফট কপিই পাঠাচ্ছেন৷ হার্ড কপির যুগ আগেই শেষ। তবে প্রুফ দেখার জন্য প্রিন্টেড কপি যেত লেখকের বাড়িতে।
রুদ্র অবশ্য সেরকম কিছু পেল না৷ শুধু দুটো হাতে লেখা পান্ডুলিপি।
একটু পরে মনে পড়ল হাতের লেখাটা কেন চেনা মনে হচ্ছিল। ওটা আসলে মনিকার হাতের লেখা। কিন্তু সে কেন স্বামীর বই কপি করবে? কোনো খারাপ উদ্দ্যশ্য ছিল কি?
শার্লক হোমস তো দু-তিনটে সূত্র দিয়ে ভেবে ভেবে জটিল থেকে জটিলতর কেস সমাধান করে ফেলতেন৷ আর তার ক্ষেত্রে হচ্ছেটা কী? হাজার হাজার সূত্র পেয়ে গেছে, কিন্তু সবই এত জট পাকানো যে তার মস্তিষ্ক একেবারে অকেজো হবার জোগাড়!
এরপর আরও দু’ঘন্টা সময় নিয়ে বাথরুম, রান্নাঘর আর পেছনের বারান্দা ভালো করে দেখে ফেলল সে৷ দুটো জিনিস পেল এর মাঝে।
এক. বাথরুমের ঔষধের বক্সে একটা জন্মনিরোধক পিল, যেটা একা থাকা পুরুষের বাড়িতে থাকা অস্বাভাবিক। দুই. গোলাপ ফুলের টবের মাটি খুড়ে পাওয়া একটা কাশির সিরাপ। সেটা ওখানে কেমন করে গেল সে এক প্রশ্ন!
আচ্ছা গতকাল বুড়ো যে বলল, সেটাই কি ঠিক? কেসটা নিয়ে তার ঘাঁটাঘাঁটি করা কি উচিত হচ্ছে না?
ইকরাম চৌধুরীর বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরপর পুলিশ অফিসার শওকতের ফোন পেল রুদ্র। সেই হোটেলের মহিলার মার্ডার কেস।
“হ্যালো!”
“আপনার সাথে কথা আছে। আজ একবার দেখা করুন থানায় এসে।”
“কখন?”
“পারলে এখনই।”
রুদ্র গাড়ি ছোটাল। কী যে অপেক্ষা করে আছে আজ কে জানে!
***
চায়ে চুমুক দিতে দিতে রুদ্র বলল, “এবার বলুন। আর রহস্য করে রাখবেন না।”
শওকত হেসে বলল, “আরে বলছি বলছি। কেসের সুরাহা কিছুই হয়নি৷ শুধুই প্যাঁচ আর প্যাঁচ! তবে আপনারটার সাথে মেলালে কিছু মিলতে পারে সেজন্য আপনার সাথে দেখা করতে চাইলাম।”
“কী কী পেলেন দেখিয়ে ফেলুন তাহলে।”
“মহিলার নাম পিংকি৷ আসল নাম কি না জানি না। একটা ছোটো ফ্ল্যাট ভাড়া করে একাই থাকত শহরের উত্তরের প্লটে। স্বাধীন ব্যবসা ছিল। কারো আন্ডারে কাজ করত না। বুঝতেই পারছেন পেশাটা কী, বেশ্যাবৃত্তি।
ওর নিয়মিত যেসব ক্লায়েন্ট ছিল তার মধ্যে প্রায় সবারই খোঁজখবর, পিংকির সাথে যোগাযোগের দিনক্ষণ, সম্পর্ক কেমন ছিল এসব খুঁটিনাটি বের করে ফেলেছি। সন্দেহ করার মতো তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। শুধু সমস্যা হলো এই ইকরাম চৌধুরীকে নিয়ে। এই লোক তো পিংকির আগেই মরেছে। তাহলে তার ব্যাপারে খবর কিভাবে পাই?
আমার একটা ধারণা আছে। আপনাকে বলি৷ আমার মনে হয় টাকাপয়সা বা এ জাতীয় কোনো বচসা থেকে ইকরামের সাথে পিংকির শত্রুতা হয়েছে। পিংকি খুব বাছা বাছা ক্লায়েন্টদের নিজের বাড়িতে নিত। ইকরাম ছিল সেরকম একজন। লাস্ট কয়েকদিন তাদের সম্পর্ক ভালো ছিল না বলেই মনে হয়। কারণ ইকরামের অনেকগুলো কল পিংকি ধরেনি বা কেটে দিয়েছে৷ এরপর ইকরামই লোক লাগিয়েছে পিংকিকে হত্যা করার জন্য। কিন্তু পিংকি কিছু একটা বুঝতে পেরে উল্টে ইকরামকেই আগের দিন খুন করে। সবশেষ ফলাফল, দুজনেরই মৃত্যু৷
আপনি কী বলেন? হতে পারে এমন?”
রুদ্র গুম হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। সব এত সরল? তাহলে জটিলতা তৈরি হচ্ছে কোথায়? আসলেই যদি এটা হয়ে থাকে তাহলে তো কেসটা জলের গড়িয়ে যাওয়ার মতো সহজ৷
কিন্তু জল কি এত সহজ বস্তু? সেও তো কঠিন হলে আয়তনে বেড়ে যায়৷ জলেরও বিশ্বাস নেই৷ মানুষে তো নয়ই। কেসটা এত সরল মোটেই না৷ পিংকি তো এর একটা অংশ শুধু। বলা যায় পুরো বইয়ের কয়েক পৃষ্ঠা। বাকি বইটার অন্ধকার পর্বগুলো অজানা। শুধু কিছু কিছু অংশে আলো পড়ছে। তৈরি হচ্ছে শব্দ। পুরো বই কবে পড়া যাবে কে জানে!
রুদ্রকে চুপ করে থাকতে দেখে শওকত বলল, “আপনার কি ভিন্ন মত? সেই কেসের কতদূর কী হাল?”
“কেসটা ক্লোজ হয়ে গেছে।”
“তার কারণ?”
“পোস্টমর্টেম রিপোর্ট।”
“মানে কী?”
রুদ্র পুরোটা খুলে বলল শওকতকে। শওকত গোঁফে তা দিতে দিতে শুনে গেল পুরোটা। শেষে ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বলল, “চালিয়ে যান। এমন কেস খুব একটা হাতে আসে না।”
“আপনি এখন কী নিয়ে আছেন?”
“নকল টাকার গ্যাং এর পেছনে পড়ে আছি। এরা এত ধূর্ত একেকটা! জীবন শেষ। যাকগে, চা খাবেন আরেক কাপ?”
“হয়ে যাক!”
***
রুদ্র সেখান থেকে একবার নিম্নবিত্ত এলাকাতে ঢু দিল। সুমা আর হোসেন আলীকে কিছু প্রশ্ন করা দরকার ছিল মনিকার মৃত্যু সম্পর্কে। তারা যেহেতু তখনও বহাল ছিল, কিছু তো জানার কথা।
সুমার বক্তব্য ছিল এমন, “সাহেবের লগে আফার তখন অনেক ঝগড়া লাগত। তাই আফা রাগ কইরা বাপের বাড়িতে চইলা গেছিল। এরপর আর ফিরত আসতে পারে নাই। সেইখানেই মইরা গেছে।”
“আপার বাপের বাড়িটা কোথায় জানো?”
“না।”
হোসেন আলীর বক্তব্য মিলে গেল সুমার সাথে।
রুদ্রর মাথা চক্কর দিচ্ছে। সে এবার জোবায়ের আহমেদকে ফোন করে জিজ্ঞেস করল, “মনিকার বাপের বাড়ি কোথায় ছিল?”
“জানি না তো। বাপের বাড়ির সাথে ওর কোনো সম্পর্ক ছিল না।”
এরপর রুদ্র সুমা আর হোসেন আলীর কথা খুলে বললে জোবায়ের হেসে বলল, “বুঝলেন না স্যার, ওই শয়তান মনিকাকে খুন করে গুম করে ফেলেছে। তারপর এর কাছে এক কথা বলছে, ওর কাছে আরেক কথা।”
একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফোন রাখল সে। এমনও তো হতে পারে, জোবায়ের নিজেই দুটো খুন করেছে! এখন তো তাই মনে হচ্ছে! জটায়ুর ভাষায়, লোকটা হাইলি সাসপিশাস!
***
রাতে শুয়ে শুয়ে জোবায়ের আহমেদের ইউটিউব ভিডিওগুলো আবারও দেখছিল রুদ্র। রাত দুটো বাজলে প্রায় দেড় বছরের সবগুলো ভিডিও মোটামুটি দেখে ফেলল সে।
তাতে কাজ হলো কিছু তা বলা যায়৷ জোবায়েরের বছরখানেক আগের একটা ভিডিও ছিল দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে। যেটা সে বানিয়েছে সেই সময়টাতে যখন ইকরাম আর মনিকার ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে। পেপারে সাইন করার কিছুদিন পরের তারিখে। এটা কী ইঙ্গিত করে? সে সময় জোবায়েরের অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল? যদিও ভিডিও সে কারণে এটা বলা ভুল। লোকটার তো অনেক টাকা। হতে পারে এমনিতেই বানিয়েছে। কিন্তু আরেকটা জিনিস তাকে ভাবিয়ে তুলল।
ঠিক কবে মনিকা চৌধুরী মারা গেছে এটা জানা যায়নি, তবে সময়টা আন্দাজ করা যাচ্ছে।
সে সময়ের মধ্যেই জোবায়েরের দুটো হাসির ভিডিও এসেছে৷ একটা সে সময়ের ভাইরাল হওয়া একটা টিকটক ভিডিও নিয়ে, অন্যটা আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে নিয়ে।
যে সময়ে একটা লোকের প্রেমিকা গুম হয়ে গেছে, যে তার সন্তানের মা হতে যাচ্ছিল, সে কি এ ধরণের কোনো কন্টেন্ট তৈরি করতে পারে?
ভাবতে ভাবতে রুদ্র বড় করে হাই তুলল। তার মস্তিস্ক যথেষ্ট ক্লান্ত। আর নিতে পারছে না।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু