#পাথরের_মৃত্যু
পর্ব-৯
পরদিন সকালে রুদ্র প্রথম যে কাজটা করল তা হলো মনিকার বাপের বাড়িতে খোঁজ নেয়া। কাজটা সহজ ছিল না, তবে ইকরাম চৌধুরীর বাড়িতে পাওয়া কিছু সূত্র ধরে কয়েকটা ফোনকল করে নারায়নগঞ্জের দিকে খোঁজ করে পেয়ে গেল ঠিকানা।
মনিকার বাড়ির অবস্থা হুলস্থুল। বিশাল বড়লোক এরা। বাড়িতে ওর বৃদ্ধ বাবা আর চার ভাই আছেন। এরা রুদ্রকে খাতির করে বসালেও বোনের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাল না৷ এমনকি মনিকার মৃত্যুর ব্যাপারে বললেও নির্লিপ্ত গলায় বলল, “ভালো হয়েছে। ও এমনিতেও আমাদের কাছে অনেক আগেই মরে গেছে।”
“এত বিতৃষ্ণার কারণ কী?”
কেউ উত্তর দিল না।
জায়গাটা গ্রাম এলাকা। রুদ্র ঠিক করল ঘুরেটুরে দেখবে একটু। এতটুকু জেনেছে যে মনিকা এখানেই বড় হয়েছে। কোনো তথ্য যদি পাওয়া যায়!
অবশেষে একসময় এক মহিলার কাছে খানিকটা জানতে পারল সে। মনিকা নাকি কোন হিন্দু ছেলের প্রেমে পড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। অনেক খুঁজেপেতে ফেরত এনেছিল ভাইয়েরা। সেই কলঙ্ক বহু চেষ্টায় ঢাকতে না ঢাকতে আবার ঢাকার কোনো এক ছেলের সাথে পালিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে৷ এমন কাজ করার পর বাড়ির আদরের একমাত্র মেয়ে পর হয়ে গেছে। ভাইয়েরা সত্যিই ওর মুখ দেখতে চায় না। যে পরিমাণে বেইজ্জতি হয়েছে তারপর বোনকে দেখতে না চাওয়াটা খুব স্বাভাবিক।
রুদ্র ঢাকায় ফিরল ভার মন নিয়ে। দিনটা ভালো গেল নাকি খারাপ বুঝতে পারল না৷
সে কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছে কেসটা ভালো করে সুরাহা করতে। থানার ডিউটি থাকলে বাইরের জিনিস নিয়ে মাথা ঘামানো যায় না।
পরদিনটা তার গেল তায়েবা তারান্নুমের ব্যাক স্টোরি কতটা সত্যি সেটা খুঁজে বের করতে। তবে সেরকম কিছু খুঁত খুঁজে পেল না৷ তায়েবা সত্যিই কানাডা ছিল আর সেখানেই পড়াশুনা করে স্রেফ কিছুদিন আগে ফিরেছে।
রহস্যময়ভাবে এই কেসের সাথে জড়িয়ে গেছে যেন! মনো হচ্ছে তায়েবার রহস্য ভেদ করতে পারলে পুরো জট খুলে যাবে!
আজ একবার আবার তায়েবার সাথে দেখা করতে যাবে বলে ঠিক করল রুদ্র।
আজ সে পুলিশের পোশাক পরে নেই৷ তায়েবার কথা ভেবেই বোধহয় সুন্দর একটা নেভি ব্লু শার্ট, অফ হোয়াইট প্যান্ট, সাদা কেডস পরে নিল। চুলগুলো আঁচড়ে নিল পরিপাটি করে। আর চোখে একখানা সানগ্লাস ঝুলিয়ে নিল। সে উপরি কামাই করে না বলে অল্পই আয় হয়। সেখান থেকেও অল্প করে জমিয়ে চার হাজার টাকার সানগ্লাস কিনেছিল। সেখানা পরার সুযোগ হয়নি তেমন। ডিউটির সময় পরলে লোকে বলবে ঘুষের টাকায় ফুটানি দেখাচ্ছে! এবার সুযোগ চলে এলো।
দুপুর বারোটার দিকে তায়েবার বাড়িতে উপস্থিত হলো সে৷
তায়েবার বাবা বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। তিনিই দরজা খুললেন। রুদ্রকে দেখে উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন, “আরে রুদ্র কায়সার সাহেব যে!”
সেদিন থানায় গিয়ে তাকে কেসের তদন্ত করতে নিষেধ করেছিলেন এই ব্যক্তিই। আজ তাকে খুব হাসিখুশি দেখাচ্ছে। খাতির করে রুদ্রকে নিয়ে সোফায় বসালেন তিনি। তায়েবাকে ডাকলেন, “তায়েবা…কই তুমি? এসে দেখো কে এসেছে..”
রুদ্রর মনে হলো লোকটা এমনভাবে ডাকছে যেন সে বিশেষ অতিথি। পুলিশকে কেউ এত সমাদর করে?
তায়েবা এসে রুদ্রকে দেখে হাসল। ওর পরনে হালকা গোলাপি রঙের সুতির সালোয়ার কামিজ। কান, গলা খালি। কব্জিতে একটা কালো রাবার ব্যান্ড আটকানো। ঘরোয়া পোশাক। অথচ রূপ ঠিকরে বের হচ্ছে যেন! ওর দিকে তাকালে মনে হবে, পৃথিবী রসাতলে যাক! আমি শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। তায়েবা আশেপাশে থাকলে চারদিকের বাতাসও যেন বদলে যায়।
তায়েবা হাসিমুখে বলল, “কী সাহায্য করতে পারি বলুন?”
“কিছু প্রশ্ন করতাম।”
তায়েবার বাবা বললেন, “আমি থাকতে পারি?”
রুদ্র একটু ভেবে বলল, “আপনি না থাকলেই ভালো হয়।”
তিনি “ফাইন” বলে উঠে পড়লেন। খবরের কাগজটা নিয়ে চলে গেলেন ভেতরের ঘরে। প্রায় সাথে সাথে কাজের মেয়েটা ঢুকে চা বিস্কুট দিয়ে গেল।
রুদ্র প্রশ্ন করার আগে একটু গুছিয়ে নিতে চায়ের কাপে চুমুক দিল। অতিরিক্ত মিষ্টি!
তায়েবা ওর মুখ দেখে বলল, “মিষ্টি বেশি?”
“হুম।”
খিলখিল করে হেসে উঠল তায়েবা। বলল, “আমি বলেছি বেশি চিনি দিতে। অফিসার সাহেব যাতে তেঁতো প্রশ্ন করতে পারেন তাই আগেই ব্যবস্থা!”
রুদ্র একটু হাসল। ইচ্ছে করছে তায়েবাকে বলতে, “কোনো প্রশ্ন করব না৷ তুমি শুধু আমার সামনে বসে কিছুক্ষণ কথা বলো।”
যদিও সেসব বলা হলো না। রুদ্র শরবতের মতো চায়ে আরেকবার চুমুক দিয়ে বলল, “আপনি ইকরাম চৌধুরীকে কবে থেকে চেনেন?”
তায়েবা একটু ভেবে বলল, “সম্ভবত তিন/চার বছর হবে। মানে তিনি যখন থেকে একটু বেশিই পপুলার হয়ে উঠেছিলেন তখন৷ বুঝতেই পারছেন, বিদেশে থেকে দেশের লেখকদের খুব একটা ফলো করা হয়নি আমার।”
“আর মনিকা চৌধুরীকে কবে থেকে চেনেন?” সরাসরি প্রশ্ন না করে আঁধারে ঢিল ছুড়ল রুদ্র। কিন্তু ঢিলটা লাগল না। তায়েবা একটু অবাক হয়ে বলল, “মনিকা চৌধুরী কে?”
“ইকরাম চৌধুরীর প্রাক্তন স্ত্রী।”
“উনাকে আমি চিনি না। চেনার কথাও না।”
“সত্যি বলছেন?”
“জি।”
লাই ডিটেক্টর থাকলেও তায়েবার কথায় মিথ্যা খুঁজে পেত কিনা সন্দেহ! রুদ্ররও সন্দেহ রইল না যে তায়েবা সত্যি বলছে।
সে এবার প্রশ্ন করল, “আপনি জোবায়ের আহমেদ নামের কাউকে চেনেন?”
“ঠিক কোন জোবায়েরের কথা বলছেন?”
“আপনি কতজন জোবায়েরকে চেনেন?”
“উমম…দু’তিনজন হবে! আমাদের গেটের দারোয়ানের নামও জোবায়ের।” বলে আবারও শব্দ করে হেসে ফেলল তায়েবা।
রুদ্র এবার একটু কঠিন থাকার চেষ্টা করল। বলল, “দেখুন, এভাবে হাসলে হবে না৷ এটা খুনের কেস। সেটার সুরাহা হোক আগে। আপনি ইউটিউবার জোবায়েরকে চেনেন না?”
“না। আমি সোশ্যাল মিডিয়াতে খুব কম সময় কাটাই।”
“ওহ।”
“আর কিছু?”
“জি। আপনি তনয়া আফরিনকে চেনেন?” এই প্রশ্নটাও আন্দাজে ঢিল ছোড়বার মতো। তনয়া আফরিন হলো সেদিন জীবন তালুকদারের বলা লেখিকা মেয়েটা যার সাথে ইকরামের সম্পর্ক ছিল, তারপর বিয়ে হয়ে সে চলে যায়।
তায়েবা একটু থমকালো। একটু ভাবল। শেষে বলল, “চিনি৷ কেন বলুন তো?”
“কিভাবে চেনেন?”
“আমার প্রতিবেশী ছিল।”
“তার বিয়ের আগের কাহিনী জানেন?”
“হ্যাঁ।
” ইকরাম চৌধুরী সম্পর্কিত কাহিনী?”
“জানি। ইকরাম চৌধুরীর সাথে ওর অ্যাফেয়ার ছিল। বিয়ের পর চলে যায় ব্যাস।”
“এতটুকুই।”
“জি ঠিক এতটুকুই।”
“বাহ!
” তার সাথেও কেসের সম্পর্ক আছে?”
“থাকতেও পারে!”
“মাই গড!”
“সে কি এখন কানাডাতেই?”
“অবশ্যই। আমাদের যোগাযোগ হয়। ও এক্সপেক্ট করছে। আট মাস রানিং।”
“ভালো।”
“আরও প্রশ্ন আছে?”
“আপাতত না। আরেক কাপ চা খাওয়াবেন?”
“অবশ্যই।”
“আপনার হাতের?”
“আচ্ছা বসুন।”
রুদ্রের সামনে টেবিলের ওপর একটা খাতা। সে মূলত খাতার লেখা দেখতে চায় বলেই তায়েবারে সরিয়ে দিতে চাইল। সে ইচ্ছে হলেই এ বাড়ির কিছুতে হাত দিতে পারে না৷ ওয়ারেন্ট নেই। এখন গুপ্তচরবৃত্তি করতে লুকোচুরি ছাড়া উপায় কী?
খাতায় তেমন কিছু ছিল না৷ কয়েকটা হাবিজাবি বাজারের হিসেব। তবে দৃষ্টি আকর্ষণ করল একটা জিনিস। তায়েবার হাতের লেখা। সুন্দর মুক্তোর মতো লেখা! হাতের লেখা নিয়ে এই কেসে যে কিছু জট আছে সেটা বোঝা যাচ্ছে।
তায়েবার ফিরে আসার শব্দে খাতাটা রেখে দিল রুদ্র। চা খেতে খেতে সাধারণ কিছু কথা বলল তারা। তায়েবা এবার নিজের জন্যও চা এনেছে৷ ওর তুলিতে আঁকা ঠোঁট দিয়ে চায়ে চুমুক দেয়াও অন্যরকম শৈল্পিক দেখাচ্ছে। রুদ্রের চোখ চলে যাচ্ছে অজান্তেই। দৃষ্টিতে মুগ্ধতা।
শেষে যাওয়ার আগে সে নিজের ছোট্ট নোটবুক বের করে তায়েবার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “অটোগ্রাফ প্লিজ!”
তায়েবা হাসিমুখে অটোগ্রাফ দিল।
***
মজার বিষয় হলো মনিকা চৌধুরীর কোনো ছবি পাওয়া যায়নি৷ এখনকার দিনে যেখানে প্রতিদিন শখানেক ছবি গ্যালারিতে জমা হয় সেখানে একজনের কোনো ছবি কেন পাওয়া যাবে না?
মিডিয়ার সাংবাদিকদের সামনে কখনো মনিকা আসেনি৷ ইকরামের বাড়িতেও কোনো ছবি নাই।
তাই রুদ্র জোবায়েরকে ফোন করে ছবি চাইল। জোবায়ের যেহেতু প্রেমিক ছিল, তার কাছে ছবি থাকতে পারে।
কিন্তু তাও পাওয়া গেল না। সে নাকি মনিকাকে ভুলতে চায় বলে সব নষ্ট করে ফেলছে।
অদ্ভুত এক পরিস্থিতি! সবাই মিথ্যে বলছে, বোঝা যাচ্ছে, তবু কাউকে ধরা যাচ্ছে না।
রুদ্র আজও রাতে সোশ্যাল মিডিয়া খুলে বসল। তয়েবা তারান্নুমের ফেসবুক প্রোফাইলটা খুঁজে বের করে সেটা স্ক্রল করতে করতে চলে গেল অনেক নিচে। মনিকা চৌধুরী গুম হওয়ার সময়টাতে। সেখানে এমন কিছু পেল যে রুদ্র হা হয়ে গেল।
কেসের জট বোধহয় এরপর খুলতে শুরু করবে!
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু