পাথরের_মৃত্যু,পর্ব-১১ (শেষ পর্ব)

0
643

#পাথরের_মৃত্যু
পর্ব-১১ (শেষ পর্ব)

“আচ্ছা রুদ্র কায়সার সাহেব আপনি যদি জানতে পারেন আপনি, এমনকি দেশের বড় একটা অংশ স্রেফ ভুলের পেছনে ছুটেছে তাহলে কেমন লাগবে?”

“মানে?” রুদ্র তায়েবার দিকে খুবই বিরক্ত চোখে তাকাল। তায়েবাকে আজও ডানা কাটা পরীদের মতো দেখাচ্ছে সবুজ শাড়ি, গাঢ় কাজল আর আধখোলা চুলে, তবু বিরক্ত না হয়ে পারছে না রুদ্র। তখন থেকে হেয়ালি করে যাচ্ছে৷ একটার পর একটা অদ্ভূত কথা বলছে৷ কী চাইছে বোধহয় নিজেও জানে না৷

“মানে হলো আপনাদের মাইন্ড নিয়ে জাস্ট গেম খেলা হয়েছে৷ ভেরি ওয়েল প্লেইড গেম। একবারও কেউ ভাবেনি এমন হতে পারে।”

“সেই গেমটা কী বলবেন?”

“বাংলায় প্রবাদ আছে না, ঘরের শত্রু বিভীষণ, কিছুটা তেমন।”

রুদ্র হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “এবার আপনি সোজাসুজি যা বলার বলুন, নয়তো আমি উঠলাম।”

তায়েবা মিষ্টি হেসে বলল, “আপনি কিছু খান৷ দু’জন বিশেষ অতিথি আসার কথা৷ এলেই আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পাবেন।”

রুদ্র ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। মাথা ব্যথা হয়ে যাচ্ছে রীতিমতো।

তায়েবা ট্রেতে করে লম্বা গ্লাসে শরবত জাতীয় ঘোলাটে পানীয়ে আর পেয়ালাতে সাদাটে কোনো বস্তু এনে রাখল রুদ্রের সামনে। রুদ্র সরু চোখে সেগুলোর দিকে তাকাতেই খিলখিল করে হেসে উঠল তায়েবা৷ চোখ মটকে বলল, “অফিসার, এইযে সাদা জিনিসটা হচ্ছে এলএসডি। খেলেই কিন্তু শেষ…”

রুদ্র খানিকটা ভড়কে যেতে গিয়েও গেল না৷ তায়েবা হেসে ফেলেছে৷ প্রাণখোলা হাসি৷ তবু একটু সতর্ক হয়ে খেলো রুদ্র। তায়েবা যদিও পরে বলল ওটা মিষ্টি। ইউটিউব দেখে সে নিজে বানিয়েছে।

প্রায় সন্ধ্যার দিকে কলিংবেল বাজল। কাজের মেয়ে এসে দরজা খুলে দিল। ভেতরে যে দু’জন ঢুকল তাদের একজন রুদ্রর পরিচিত। জোবায়ের আহমেদ। অন্যজন মহিলা। মনে হলো কোথায় যেন দেখেছে তাকে, কিন্তু ঠিক মনে পড়ল না৷ দু’জনেই খানিকটা বিধ্বস্ত।

জোবায়ের রুদ্রের দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে তায়েবাকে বলল, “স্যরি, এত জ্যাম ছিল রাস্তায়৷ আসতে যে পেরেছি তাই বেশি৷ ওকে কিছু খেতে দিন।”

তায়েবা দ্রুত আরও দুই গ্লাস শরবত আর মিষ্টি নিয়ে এলো৷ খাওয়াদাওয়া হলে মেয়েটা খানিকটা সুস্থ বোধ করল বলে মনে হলো।

লাল রঙের সালোয়ার কামিজ পরা মেয়েটা৷ দেখতে নতুন বউদের মতো টুকটুকে। তবে বয়সের ছাপ পড়ে গেছে চেহারায়৷

তায়েবা এবার এসে রুদ্রর মুখোমুখি বসল৷ বলল, “এবার আপনাকে সব বলা হবে। কিছু সত্য প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হবে।”

“বলুন।”

“আমার কথা আগে বলি। আমার দিকটা যদিও অতটা ইম্পর্টেন্ট নয়, তবু ক্যারিফিকেশনের জন্য জানিয়ে রাখা৷

আমি কানাডায় মায়ের সাথে থাকতাম। বাবা অনেক চাইতেন দেশে ফিরি, তার সঙ্গে থাকি। কিন্তু আমার মাকে ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করত না৷ তারপর মা মারা গেলেন, একা হয়ে যাওয়ার আগে আমি দেশে ফিরলাম। তবে এত দ্রুত ফেরার আমার কোনো ইচ্ছে ছিল না৷ সেটা ঘটল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটা কারণে। সেটাই এই গল্পের মূল ঘটনা।

আপনি অনেকটা আন্দাজ করতে পেরেছেন৷ ফেসবুকের বদৌলতে আমার পরিচয় ঘটে জোবায়ের আহমেদের সাথে। তারও আগে পরিচিত হই আমার প্রতিবেশী তনয়া আফরিনের সাথে৷ তনয়া যখন প্রথম আমার সাথে দেখা করতে আসে, মনে আছে সেদিন কিছু লিখছিলাম। সে আমার লেখালেখি দেখে নিজেও লেখার কথা বলল। আমাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে দেরি হলো না৷ সে আমাকে সব বলল। ইকরাম চৌধুরীর সাথে তার সম্পর্কের কথা বলল। লোকটার ধোঁকাবাজির কথা বলল।

তনয়া ভালো মেয়ে ছিল৷ ওকে কথায় ফাঁসিয়েছিল ইকরাম৷ বলেছিল বউয়ের সাথে সম্পর্ক খারাপ, বউ তাকে কোনো শান্তি দেয় না, ডিভোর্স দেবে, তাকে বিয়ে করবে ইত্যাদি৷ এসব বলে প্রেমের শুরু হলেও বিছানা পর্যন্ত নিতে দেরি হয়নি। ও যে খুব সৎ ছিল তাও বলব না৷ এক সময় তো ইকরাম তাকে নিজের বাড়িতে পর্যন্ত নিয়ে যেত। তখন তনয়া বুঝতে পারে যে ওর বউয়ের সাথে সম্পর্ক ভালো না হলেও মনিকা আসলে ভালো মেয়ে। ইকরামই যত নষ্টের মূল। মনিকার সাথে ইকরামকে প্রচন্ড খারাপ ব্যবহার করতে দেখেছে সে। মনিকার সামনেই তনয়ার সাথে এক ঘরে সময় কাটিয়েছে। মানে জঘন্য অবস্থা। তনয়া পরে নিজেও খুব রিগ্রেট করত তার অতীতের জন্য। যাহোক, পরে ওর বিয়ে হয়ে যায় আর ইকরামের হাত থেকে বেঁচে যায়।

কিন্তু মনিকা কী করত বলুন তো?”

রুদ্র তাকিয়ে রইল তায়েবার দিকে। বলল, “আপনি মনিকার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন?”

“জি। আর সেটা সম্ভব হয় জোবায়েরের মাধ্যমে।”

জোবায়ের সামান্য হেসে বলল, “স্যার, আপনাকে কিছু মিথ্যে বলেছি। সেজন্য দুঃখিত।”

“আপনার ভূমিকাটা বলবেন এবার?”

তায়েবা বলল, “আগে আমার অংশ শেষ করি৷ আমি জোবায়েরের মাধ্যমে মনিকার কথা জানতে পারি। আর ওর জন্যই তাড়াতাড়ি দেশে ফিরি৷ আমার ইচ্ছে ছিল ওকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরা। সত্যগুলো প্রকাশ করা।”

“কোন সত্য?”

“বলা হবে আপনাকে।”

রুদ্রের মনে হলো তার এতদিনের তদন্ত সব শুধু শুধুই! আসল ঘটনা এমন যে সে ধারণাও করতে পারেনি।

এবার জোবায়ের বলতে শুরু করল।

“স্যার, মনিকার সাথে আমার পরিচয়ের ঘটনা তো আপনাকে বলেছিই। আমি ওকে পছন্দ করতাম। প্রেমের প্রস্তাবও দিয়েছিলাম, কিন্তু মনিকা রাজি হয়নি। আর আমাদের সম্পর্কটা আর সামনে এগুতে পারেনি।”

“তাহলে মনিকার প্রেগন্যান্সি?”

“ওটা আসলে বানিয়ে বলেছিলাম।”

“হোয়াট!” রুদ্র বিষ্মিত, একি সাথে রাগও হলো।

“ঘটনা পুরোটা শুনলে আপনি বুঝতে পারবেন।”

রুদ্র চোখমুখ শক্ত করে বলল, “বলুন।”

“আমি এরপর মনিকাকে আর কোনো ডিসটার্ব করিনি। তবে আমরা ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। আস্তে আস্তে মনিকা আমাকে তার জীবনের সব ঘটনা খুলে বলে। আর আমি সবকিছু তায়েবাকে বলি। তারপর যা হয়েছে সেসব আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী হয়েছে।”

“কিন্তু হয়েছেটা কী? ইকরাম চৌধুরীকে কে খুন করেছে?”

তায়েবা মুচকি হেসে বলল, “কেউ না। সে মারা গেছে হার্ট অ্যাটাক করে।”

রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কথাটা সত্যি৷ ইকরাম চৌধুরী হার্ট অ্যাটাক করেই মারা গেছেন। কিন্তু তার আগে তার মাথায় বাড়ি দেয়া হয়েছিল। হৃদযন্ত্র দুর্বল হওয়ার কারনে ওই বাড়ি খেয়ে ভয় পেয়ে মরে গেছেন। কিন্তু মৃত্যুটা যেহেতু মাথায় বাড়ির কারনে হয়নি, তাই কেসটা দুর্বল হয়ে গেছে৷ খুনীর কোনো ট্রেস না পাওয়ায় হয়ে গেছে ক্লোজড। রুদ্র এতদিন যে তদন্ত করছিল সবটা নিছকই নিজের কৌতুহলবশত।

এবার সে বলল, “আচ্ছা, মানলাম ইকরাম চৌধুরী খুন হয়নি। কিন্তু তাকে খুনের চেষ্টা করা হয়েছে। সেটা কে করেছে?”

এবার তায়েবা আর জোবায়েরের চোখ ঘুরে গেল ঘরে থাকা অন্য মেয়েটার দিকে, যার সাথে রুদ্রর এখনো পরিচয় হয়নি। ওরা কিছু বলার আগেই রুদ্র প্রশ্ন করে বসল, “আপনি মনিকা চৌধুরী তাই তো?”

মেয়েটার চোখ ফুলে আছে৷ এর মধ্যে বোধহয় কাঁদছিল। নাক লাল, ঠোঁট কথা বলতে গিয়ে বেঁকে যাচ্ছে। তবু বলল, “হ্যাঁ, আমি মনিকা। তবে চৌধুরী নই।”

“আমি শিওর ছিলাম আপনি বেঁচে আছেন! এখানে অন্য কাহিনী আছে। আপনাদের ডিভোর্সে হয়েছিল?”

“না।”

“আপনার মৃত্যুর কথাটা কে রটিয়েছিল?”

“আমি নিজেই।”

“কিভাবে?”

“আসলে আমাকে খুন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু আমি মরিনি। ধরে নেয়া হয়েছিল আমি মৃত।”

“কাহিনী কী?”

জোবায়ের বলল, “আমি বলি মনিকা?”

“না। আমিই বলব।”

মনিকা উঠে চোখে পানি দিয়ে এলো। এবার বেশ স্পষ্ট গলায় বলল, “শুরু থেকে বলি।

আমি মনিকা। চার ভাইয়ের এক বোন হওয়ায় আমার আদরের সীমা ছিল না৷ তবে আমিও সেই আদরের মর্যাদা রাখতে পারিনি। ভুল করেছি একাধিকবার। শেষ ভুলটা ছিল ইকরামের সাথে বের হয়ে আসা।

আমার লেখালেখির হাত ভালো ছিল ছোটোবেলা থেকেই। ছদ্মনামে পত্রিকায় লিখতাম। বড় হয়ে অভ্যাসটা একটু কমে এসেছিল। গ্রামে থাকতাম, মেয়ে লেখালেখি করে এটা লোকজন খুব ভালো চোখে দেখত না৷ যার কারনে প্রকাশ্যে আসা হয়নি কখনো।

ইকরামের সাথে বিয়ের পরপর আমি অবসর আর লেখালেখির সুযোগ দুটোই পেয়ে যাই৷ প্রচুর গল্প লিখতাম৷ সে সময় ইকরাম ছোট্ট একটা চাকরি করত। সংসারে অভাব লেগেই থাকত। একদিন সে প্রস্তাব দিল আমার লেখাগুলো কোনো প্রকাশকের কাছে পাঠাবে। যদি রাজি হয় তাহলে লেখা ছাপা হলে কিছু টাকা পাওয়া যাবে।

আমি রাজি হলাম। কিন্তু ভয় ভয় করতে লাগল। ইকরাম লেখা জমা দিল। একসময় ছাপাও হলো৷ কিন্তু আমি আবিষ্কার করলাম গল্পে লেখকের নাম দেয়া হয়েছে ইকরাম চৌধুরী।

আমার চোখ তখনো ভালোবাসার পর্দা দিয়ে ঢাকা। অন্ধভাবে তার প্রতি বিশ্বাসের কারনে ঘটনাটা আমাকে আঘাত দিলেও তার প্রতি আঙুল তুলতে দেয়নি। সে আমাকে তখন বুঝিয়েছিল ছেলেদের নামে গল্প ছাপা হলে কাটতি বেশি হয়। দেশে নারী লেখকদের লেখা কেউ পড়ে না। তাই আজ থেকে আমি লিখব, তার নামে ছাপা হবে।

এরপর থেকে তাই হতে লাগল। ইকরাম জনপ্রিয় হয়ে গেল রাতারাতি। আমি তাকে নিজের অংশ ভাবতাম। সে আমাকে এতটাই ভালোবাসায় ডুবিয়ে রেখেছিল যে আমি তার বিরুদ্ধে ভাবতেও পারতাম না। বইয়ের পাঠ প্রতিক্রিয়া, প্রশংসা শুনে মনে হতো সেগুলো আমাকে করা হচ্ছে। তাকে কোনো পুরষ্কার দেয়া হলে সে ঘরে এসে আমাকে ধরিয়ে দিয়ে বলত, নাও এটা তোমার।

আমি সরল বিশ্বাসে তার হয়ে লিখে যেতাম৷ নিজেকে খুব সুখী মনে হতো। আসলে এখন বুঝতে পারি বোকার স্বর্গ কতটা সুন্দর হয়৷

আমার বিশ্বাসে প্রথম চিড় ধরল যখন তাকে অন্য মেয়েদের সাথে চ্যাটিং করতে দেখলাম৷ প্রেমের গল্পের জন্য সে জনপ্রিয় হয়েছিল, সেই সাথে হয়েছিল নারী প্রিয়। অজস্র নারী ভক্ত গজিয়ে উঠছিল দিনে দিনে। আমার হিংসে হতো। ওর সাথে অভিমান করে বসে থাকতাম৷ ও আমাকে বলত, ওদের পাঠক হিসেবে হাতে রাখতে অল্পস্বল্প কথা বলে। এর বেশি কিছুই নয়।

কিন্তু একদিন আমি সব ধরে ফেললাম৷ প্রচুর মেয়ের সাথে সে অনলাইনে কথা বলে। তার মাঝে দু’একজনের সাথে সে শারীরিকভাবে ঘনিষ্ঠও হয়েছে। আমার তখন কী পরিমাণে ধাক্কা লেগেছিল আমি কখনো বলে বোঝাতে পারব না।

আমি তখন আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। খুব মনে পড়ছিল বাবা ভাইদের কথা। কিন্তু তারা তো আমাকে মৃত মনে করে৷ ওই বাড়ির দরজা চিরতরে আমার জন্য বন্ধ হয়ে গেছে।

আমি সব জেনে গেছি জানতে পেরে প্রথমে ইকরাম খুব কান্নাকাটি করল। অসংখ্যবার মাফ চাইল। পায়ে ধরে পড়ে রইল৷ কিন্তু আমার শক্ত বিশ্বাসের যে ভিত নড়ে গেছে তা আর জোড়া লাগানো সম্ভব না।

আমি তাই নিরব হয়ে গেলাম৷ লেখালেখিও বন্ধ করে দিলাম৷ ইকরাম পড়ল বিপদে। সে নিজে লিখতে পারে না, আমি না লিখলে চলবে কিভাবে?

তাই অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও যখন লাভ হলো না, তখন গায়ে হাত তুলতে শুরু করল। বাড়িতে মেয়ে নিয়ে আসত আমাকে জ্বালাতে। নিজেও খারাপ মেয়েদের সাথে ওঠাপড়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দিল বহুগুণে।

আমার তখন পরিচয় হয়েছে জোবায়েরের সাথে। ওকে আমি সব বলতাম৷ ও আমাকে বলেছিল দুনিয়ার সামনে সব তুলে ধরতে। ইকরামের মুখোশ খুলে দিতে। তায়েবার সাথেও তখনই পরিচয়। সে আমাকে অনেক বুঝিয়েছে। অনেকটা সাহস দিয়েছে।

তারপরেই আমি রাজি হই সব প্রকাশ করতে। ইকরাম কিভাবে যেন সেটা বুঝে গিয়েছিল। তারপরেই ঝামেলাটা শুরু হয়। সে উঠে পড়ে লাগে আমাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলার জন্য৷

হঠাৎ আমি জানতে পারি আমি প্রেগনেন্ট। বহুদিন ধরেই আমরা বাচ্চা নেবার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু হয়নি। আমি এতটা খুশি হয়েছিলাম যে এটাও ভেবে ফেলেছিলাম ওকে ক্ষমা করে দেব।

কিন্তু বিধি বাম! ইকরাম খবরটা জানার পর খুশি তো হলোই না উল্টে আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করল। ভাবল বাচ্চাটা ওর না৷”

এই পর্যন্ত বলে আর পারল না মনিকা। মুখে ওড়না চেপে ফুঁপিয়ে উঠল। তায়েবা তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

বাকি অংশ বলল জোবায়ের।

“এরপর ওই পিশাচটা ওকে খুন করার পরিকল্পনা করে। ওই লোকের চেনা পতিতাকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়। মনিকার পরিচারিকা হিসেবে রাখা হয় পিংকিকে। যে সেদিন খুন হয়েছে। পিংকি একদিন মনিকাকে ঘুরতে নিয়ে যায় ব্রীজের ওপর। সেখান থেকে কথা ছিল মনিকাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবার।

কিন্তু পিংকি শেষ পর্যন্ত পারেনি। উল্টে মনিকাকে সাহায্য করেছিল। তাকে লুকিয়ে রেখে বলেছিল পানিতে ফেলে দিয়েছে।

ইকরাম তখন সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয় মনিকা বাপের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে মারা গেছে। তখন থেকে জগতের কাছে ও মৃত।

মনিকা পিংকির আশ্রয়ে থেকেই একদিন ভাইদের কাছে যায়৷ ক্ষমা চায়। ওর অবস্থা দেখে তারা ফেরাতে পারেনি৷ ওখানেই থাকে মনিকা। কিন্তু কথাটা এখনো কেউ জানে না।

এদিকে পিংকি ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে ইকরামকে। তখন ইকরাম পিংকিকে সরিয়ে দেবার পরিকল্পনা করে।

মনিকার ডেলিভারির পর ও খুবই ডেস্পারেট হয়ে গিয়েছিল প্রতিশোধ নেবার জন্য। তাই সে ঠিক করে ইকরামকে মেরে ফেলবে। আমরাও সাপোর্ট করি ওকে। খুব সূক্ষভাবে প্ল্যান করি আমরা তিনজন মিলে। আমি আর তায়েবা ওকে সাহায্য করেছিলাম। একটা পিশাচকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিলে কিছুই হতো না৷ আর যে লোকটা নিজের বাচ্চাকে পর্যন্ত খুনের চিন্তা করতে পারে তার বেঁচে থাকার কোনো অধিকারও নেই।

প্রথমে আমরা ইকরামকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করি। মনিকার কাছে ডুপ্লিকেট চাবি ছিল। পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকত মনিকা। ঘরে নিজের চিহ্ন রেখে আসত। লোকটার হার্ট দুর্বল ছিল বলে ইচ্ছে ছিল ভয় দেখিয়ে মেরে ফেলবে।

সে সময় ও লুকিয়ে থাকত বুকশেলফের পেছনের ছোট্ট ঘরে। ঘরটার কথা ইকরাম জানত না। ওটা বাড়ি করার সময় মনিকা নিজে করিয়েছিল। সেখানে লুকিয়ে ও নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করত। আর সুযোগ পেলেই বের হয়ে আসত। এমনই একদিন ইকরামকে মারার চেষ্টা করে মনিকা।

কিন্তু পারেনি। ওর হাতে হয়তো কারো খুন লেখা ছিল না। আমি আর তায়েবা তাতে খুশি।

তবে স্যার, আপনি চাইলে কেস ওপেন করতে পারেন। এটেম্পট টু মার্ডার কেস।”

“যদি সেটা জানতেনই তাহলে সব বললেন কেন?”

“তায়েবার জন্য।”

তায়েবা বলল, “আপনাকে আমি বিশ্বাস করি। আমি জানি আপনি কতটা পাগল হয়েছেন সবটা জানতে। আর এটাও জানি একজন মায়ের প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছেটাকে আপনি নিশ্চয়ই বুঝবেন। আপনার মধ্যে মানবিকতা আছে রুদ্র। যে মরে গেছে তার মরে যাওয়ার কথা ছিল বলেই সে মরেছে।”

রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাপারটা হজম করার চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে বলল, “আচ্ছা, কিছু প্রশ্নের সমাধান হয়নি।”

তায়েবা একটু হেসে বলল, “বলুন কী প্রশ্ন।”

“ওই ভল্টের মতো ঘরটাতে ডিভোর্স পেপার, চিরকুট, এসব ছিল কেন?”

“ওসব আপনাকে বোকা বানানোর জন্য রাখা হয়েছিল।” হেসে বলল তায়েবা।

“বাহ! আর হাতের লেখা নিয়ে খুবই কনফিউজড হয়ে আছি আমি।”

“ওকে! আমি বুঝিয়ে বলছি৷ ইকরামের বাড়িতে আপনি দুই টাইপের হাতের লেখা পেয়েছেন৷ তার মধ্যে একটা ইকরামের, একটা মনিকার। আসলে আপনি যেটা ইকরামের ভাবছেন সেটা মনিকার হাতের লেখা। কারণ বেশিরভাগ পান্ডুলিপি, ডায়েরি, নোট এসব মনিকা লিখত। ইকরাম লিখত না বললেই চলে।

আমি আপনাকে বইয়ের ভেতর ইকরামের লেখা বলে যে চিরকুট দিয়েছিলাম সেটা মনিকা লিখে দিয়েছিল৷ আর কিছু?”

রুদ্র মাথা চেপে বসে রইল কিছুক্ষণ। একসময় সোজা হয়ে বলল, “কেসটা অত জটিল নয় কিন্তু!”

জোবায়ের হেসে বলল, “সেজন্যই তায়েবার মাথা থেকে বের হওয়া প্ল্যানগুলো কাজে লাগাতে হয়েছে। কথা ছিল উল্টোপাল্টা কথা বলে আর আজেবাজে এভিডেন্স ঢুকিয়ে দিয়ে পুলিশের মাথা খারাপ করে দেয়া। আর গল্পগুলো যে মনিকার সেটার জট তো ছিলই।

কিন্তু পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা সবকিছু অন্যরকম করে দিল।”

বাইরে এশার আজানের শব্দ শোনা গেল। রুদ্র মনিকার দিকে তাকাল। স্থির দৃষ্টি চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “যেতে হবে আমাকে। বাবু খুঁজছে।”

জোবায়ের রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা যেতে পারি স্যার?”

রুদ্র মাথা ঝাঁকাল শুধু। জীবনে প্রথমবার সে অপরাধীকে চোখের সামনে দিয়ে চলে যেতে দিল। কথাটা সত্যি, কারো কারো পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার ফুরিয়ে যায়।

ওরা চলে যেতেই মনিকা বলল, “আপনি কি আমার সাথে ডিনার করে যাবেন?”

রুদ্র বলল, “নাহ। উঠি আজ।”

তায়েবার মুখ একটু গোমড়া হলো। সেটা লক্ষ্য করে রুদ্র বলল, “শুধু শুধু আপনাকে কষ্ট দেব কেন?”

তায়েবা রহস্যময় হাসি হেসে বলল, “আমার মোটেও কষ্ট হবে না জনাব। ভালো লাগবে। আপনি চাইলে ডিনারের পার্মানেন্ট সঙ্গীও হতে পারেন, মাইন্ড করব না।”

রুদ্র অবাক চোখে তাকাল। কী সুন্দর লাগছে তায়েবাকে। ওর চোখের কোণে চকচকে একটুখানি মুক্তোর মতো জল। সে বলল, “আমি রাজি।”

(সমাপ্ত)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here