#বেসামাল_প্রেম,পর্ব_৪১
#জান্নাতুল_নাঈমা
পরপর ছ’বার হাঁচি দিয়ে বুক ব্যথা হচ্ছিল হৈমীর। সাতবারের সময় কফির মগ হাতে রুমে ঢুকল রুদ্র। ছাই রঙা শর্ট প্যান্ট পরা সে৷ গলায় ঝুলছে সাদা তোয়ালে। সদ্য স্নান করা উন্মুক্ত বক্ষে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কালচে লোমগুলো। ধবধবে ফর্সা বুকে নিদারুণ এক সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ। কফির মগে শেষ দু’টো চুমুক দিল। ব্যস্তার সঙ্গে। এরপর আধখাওয়া মগটা এগিয়ে দিল হৈমীকে। এরই মাঝে কয়েকবার কাশিও হয়েছে মেয়েটার। তাই সে বলল,
-” এটা নাও। ”
ভোরবেলায় গোসল করাতে কিছুটা চটে আছে হৈমী। কতবার অনুরোধ করল অন্তত সাতটা, আটটার দিক করুক। রুদ্র শোনেনি৷ এখন তার যে ঠাণ্ডা লেগে গেল এর জন্য দায়ী রুদ্রই৷ তাই গায়ের সঙ্গে ভালোভাবে কম্বল জড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল সে। জড়োসড়ো হয়ে বসে রইল আপনমনে। রুদ্র গিয়ে তার সামনে বসল। কফি এগিয়ে দিয়ে বলল,
-” নিতে বলেছি। ”
এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল হৈমী। রুদ্র মুখের কাছে মগ নিয়ে বলল,
-” হাত বের করতে হবে না৷ এভাবেই খেতে পারো। ”
চট করে চোখ তুলে আবার দৃষ্টি নত করে ফেলল সে। রুদ্র বাঁকা হেসে ঠোঁটের সঙ্গে মগ ছোঁয়াল৷ খুব একটা এনার্জি না থাকায় অবাধ্যতা করল না হৈমী৷ চুপচাপ বাকি অর্ধেক কফি খেল সে। রুদ্র জিজ্ঞেস করল,
-” কেমন ফিল করছ? আর ইউ ওকে? ”
উত্তর দিল না হৈমী। নিঃশব্দে হাঁটুতে থুতনি ভর করে বসে রইল৷ রুদ্র টের পেল তার লজ্জা, অস্বস্তি, কিঞ্চিৎ অভিমান। চোখ পড়ল ভেজা চুলগুলোতেও। যা তার ধবধবে সাদা বিছানা, কম্বল অনেকটাই ভিজিয়ে দিয়েছে। তাই নিজের গলায় থাকা তোয়ালে এগিয়ে দিল। বলল,
-” চুলের পানিতে বিছানা ভিজছে। চুলগুলো ভালোভাবে মুছে নাও। ”
সাড়া দিল না হৈমী৷ যেন সে শুনতেই পায়নি কিছু। রুদ্র আশ্চর্য হয়ে বসে রইল। এটাত বিপদ ঘটল। এই মেয়ে কথা বলে না কেন? তৎক্ষনাৎ সে মনে করার চেষ্টা করল শেষ কখন কথা বলেছিল হৈমী? আর কী কথা বলেছিল? তার মন, মস্তিষ্ক দু’টোই চলে গেল গভীর রাতে। নিবিড় আলিঙ্গনের মুহুর্তটুকুতে। সেই মুহুর্তে হৈমী কথায়, বাঁধায় এক বিন্দু গুরুত্বও সে দেয়নি। সত্যি বলতে দিতে পারেনি। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউকে আচমকা থামিয়ে দিতে পারেনি। ঐ ছোট্ট, নরম দেহের মাঝে খুঁজে নিয়েছিল তার পৌরুষ সত্ত্বার সমস্ত সুখ। বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল সে।
তাদের দুজনার বৈবাহিক সম্পর্কের পরিপূর্ণ রূপ দিতে। বেসামাল হয়ে ওঠেছিল সেই ঘনীভূত মুহুর্তটায়। শরীর জুড়ে কেবল চলছিল উত্তাল প্রেম। যেই প্রেমের উত্তাপে পুড়তে পুড়তে অসহনীয় হয়ে ওঠেছিল মেয়েটা৷ বেসামাল তাকে সামলে ওঠতে গিয়ে নিজেও হয়ে পড়েছিল পুরোদস্তুর বেসামাল।
রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল রুদ্র। নিজ উদ্যেগে হৈমীর চুলগুলোতে তোয়ালে পেঁচিয়ে দিল। বলল,
-” ঠিকঠাক ভাবে মুছে নাও। রিতুকে আসতে নিষেধ করে দিয়েছি আজ৷ ওর আসার প্রয়োজন নেই। তোমাকেও কিছু করতে হবে না। সাদা ভাত, ডিম পোজ দিয়ে সকালটা মানিয়ে নিই। দুপুরবেলা বাইরে থেকে খাবার আনাব। ”
খাওয়ার একদম রুচি নেই হৈমীর। তবুও রুদ্রর জন্য সাদা ভাত, ডিম পোজ করতে হবে ভেবে ওঠতে উদ্যত হলো সে৷ রুদ্র তার শারীরিক কন্ডিশন টের পেয়ে বাঁধা দিল। রুক্ষতা বর্জন করে স্বাভাবিক স্বরেই বলল,
-” তোমাকে কিছু করতে হবে না। আজকের জন্য আমি ম্যানেজ করে নিতে পারব। ”
সাতটার মধ্যেই ভাত, ডিম পোজ নিয়ে রুমে হাজির হলো রুদ্র। হৈমীকে বলল,
-” হাতটা ধুয়ে এসো৷ এখানে বসেই খাব। ”
কথা মতোন হৈমী ধীরেসুস্থে ওঠে দাঁড়াল। শরীরে একদম বল নেই তার। হঠাৎই কেন যেন ভীষণ কান্না পাচ্ছে খুব কষ্টে কান্না সংবরণ করল সে। পরনে তার লেডিস টিশার্ট আর প্লাজু। রুদ্র একবার তাকিয়ে দেখল তাকে। সম্মুখের এই পিচ্চি মেয়েটা তার বউ৷ গতরাতে এইটুকুন পিচ্চির সঙ্গে বাসর সেরে ফেলেছে। মনে মনে হাসল সে। ভাবল, পিচ্চিটাকে এবার বড়ো করতে হবে, আধপাগলাটে বউটাকে এবার মানুষ বানাতে হবে৷ শুধু একটাই প্রার্থনা তার মাথাটা যেন ঠান্ডা থাকে সুস্থ, স্বাভাবিক থাকে। সকল দুঃস্বপ্ন যেন সুস্বপ্ন হয়ে ধরা দেয়।
দুজনে আজ একসঙ্গে, এক প্লেটেই খাবার খেল। সে শুনেছে এতে স্বামী -স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা বাড়ে। সম্পর্কে গভীরতা সৃষ্টি হয়, সম্পর্ক মজবুত হয়৷ খাওয়া শেষে রুদ্র দু’টো টেবলেট সামনে ধরে গ্লাস এগিয়ে দিল হৈমীর। চুল আঁচড়াচ্ছিল হৈমী৷ সে জানত এমন একটা পরিস্থিতি তার আসবেই আসবে। তবুও অবুঝের মতো তাকিয়ে রইল। রুদ্র বলল,
-” একটা ব্যথার আরেকটা… ”
বাকিটুকু বলতে পারল না সে। কিন্তু হৈমী ঠিকি এবার কথা বলল,
-” এটা বার্থ কন্ট্রোল টেবলেট তাই তো? ”
কথাটা রুদ্রের বুকে অস্বস্তির তীর হিসেবে বিঁধল। চোখ, মুখ দৃঢ় করে সে উত্তর দিল,
-” হ্যাঁ। ”
-” সরি, আমি একটা ওষুধও খাব না। প্রয়োজন নেই। একদম ঠিক আছি আমি। ”
রুদ্রর মনে হলো হৈমী আচমকাই অনেক বেশি ম্যাচিওরড হয়ে গেল৷ তার কথা, মুখোভঙ্গি সেটা তীব্র ভাবে মনে করিয়ে দিল তাকে। সে দৃঢ়স্বরে বলল,
-” কথা না বাড়িয়ে ওষুধগুলো খাও। ”
-” আপনি শর্ত ভুললেও আমি ভুলিনি। শর্ত আপনি ভেঙেছেন আমিও ভাঙব। ”
শক্ত জবাব হৈমীর। সহসা রুদ্র অস্থির হয়ে ওঠল। সামান্য ক্রোধে তার চোয়াল দৃঢ় হলো। শক্ত চোখে তাকিয়ে পুনরায় ঠাণ্ডা মেজাজে বলল,
-” হৈমী আমায় রাগিও না। ”
হৈমী সরে গেল তার পাশ থেকে। গিয়ে বসল ডিভানে। তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলল,
-” আপনিও আমাকে রাগাবেন না। ”
রুদ্র ঘনঘন শ্বাস নিল। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করল প্রাণপণে। ওঠে এসে হৈমীর পাশে বসল। নমনীয় স্বরে বলল,
-” বাচ্চামো করছ। ”
-” আমার ভালো লাগছে না প্লিজ। আমার পাশ থেকে সরুন আপনি, আপনাকে এখন আর সহ্যই হচ্ছে না।”
-” সহ্য করতে হবে না শুধু এগুলো খাও। হা করো দেখি। ”
তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল হৈমী। সরে এসে বসল বিছানায়। দু’হাতে মাথা চেপে ধরল সে। বলল,
-” প্লিজ আমার সাথে এমন করবেন না। ”
আশ্চর্য হয়ে ওঠে এলো রুদ্র। সহসা ধমক দিয়ে বলল,
-” এবার সত্যি ফাইজলামি হচ্ছে কিন্তু। ”
-” তাই হলে সারারাত আপনিও আমার সাথে ফাইজলামি করেছেন। ”
অধৈর্য হয়ে পড়ল রুদ্র। মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে গ্লাস রাখল পাশে। হাত বাড়িয়ে হৈমীর মুখের কাছে ওষুধ গুলো নিল। জোরপূর্বক মুখে দেয়ার চেষ্টা করায় হৈমী ছিটকে গেল। বলল,
-” আমি ওষুধ খেতে পারি না৷ বমি হয় আমার প্লিজ। ”
রুদ্র গ্লাস সহ ওঠে দাঁড়াল। সাইট টেবিলে গ্লাস রেখে হৈমীর কাছে এসে জোর পূর্বক মুখে ওষুধ গুলো ঢুকিয়ে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। গ্লাস নিতে নিতে বলল,
-” নড়বে না, এই কথা শোনো নড়বে না তুমি। ”
বলতে বলতেই পানিটাও খাওয়িয়ে দিল। দূর্ভাগ্যবশত একটা টেবলেট পড়ে গেল বিছানায়। আরেকটা আচমকা গিলে ফেলল হৈমী। রুদ্র খেয়াল করে দেখল, ব্যথার টেবলেটটা পড়ে গেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। রাশভারি স্বরে বলল,
-” সব সময় এত বেশি বোঝো কেন? আমি যা করছি আমাদের ভালোর জন্য করছি। ব্যস আর কিছু না। ”
সহসা মুখ চেপে কেঁদে ওঠল হৈমী। বলল,
-” আপনি একটা সেলফিশ। ”
রুদ্র বিছানা পরিষ্কার করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তীব্র ক্রোধে এবার শব্দ করে কাঁদতে লাগল হৈমী। চিৎকার করে বলল,
-” জোর যার মুল্লুক তার তাই না। আর একবার আমার কাছে আইসেন, খু”ন করে ফেলব। ”
চট করে দরজার বাইরে থেকে উঁকি দিল রুদ্র। অমায়িক ভাবে হেসে বলল,
-” জোর যার মুল্লুক সব সময় তারই হয় ডার্লিং। এই সত্যিটা মানতে শেখো। ”
হুহু করে কেঁদে হৈমী বলল,
-” আপনি খুব খারাপ, আপনি আমাকে কখনো ভালোবাসতে পারেন না কখনোই না। এটা ভালোবাসাই না। আপনি আমাকে ভালোই বাসেন না। ”
-” ভালোবাসা বিবৃতি করার জিনিস নয়, ভালোবাসা হচ্ছে অনুভূতি। যা একদিনে অনুভব করা যায় না৷ বছরের পর বছর যাবে ধীরেধীরে তুমি বুঝতে পারবে। কোনটাকে ভালোবাসা বলে। ”
কথাগুলো বলে আর এক মুহুর্ত দাঁড়াল না রুদ্র। দরজা লক করে কিছুক্ষণের জন্য বেরিয়ে গেল সে। হৈমী কাঁদতেই থাকল আর বার বার বলতে লাগল,
-” আপনি খুব স্বার্থপর। নিজের বেলায় সব সময় ষোল আনা উশুল করেন। আর আমার বেলায় দুআনাও রাখেন না। ”
চলবে….
Waiting for next,,,,,,,, hurry up plz