নিরাপদ_ঘর,(তৃতীয় ও শেষ পর্ব)

0
726

#নিরাপদ_ঘর,(তৃতীয় ও শেষ পর্ব)

১.

আমার সময়গুলো তখন কাটছিলো খুবই মনমরা অবস্থায়। স্কুলেও সেসময় আমার বিষয়টা নিয়ে শিক্ষক মহলে ও ছাত্রীদের মধ্যেই টুকটাক আলেচনা চলছিলো।

জহির স্যার আকার ইঙ্গিতে ঠিকই আমাকে ক্লাসে অপমান করতেন। সে অবস্থায় আমি ইংরেজি ক্লাসের কোন লেখা কখনো ক্লাসে দেখাতাম না স্যারকে।
পুরো ক্লাস আমি লিখার অভিনয় করতাম, লিখতাম কিন্তু লেখাটা দেখাতাম না। বান্ধবীরা খাতা দেখালে ওদের সাথে সাথে আমিও খাতাটা আমার ব্যাগ এ ঢুকিয়ে নিতাম।
বাসায় আব্বু আম্মু কেও কখনো বলি নাই স্যার এধনের আচরণ করেন আমার সাথে!

ধীরে ধীরে দেখা গেলো আমি হীনমন্যতায় ভুগতে শুরু করলাম । আমার নিজের ব্যাপারে আমার একটা ধারণা হলো আমি ইংরেজিতে খুবই খারাপ, আমাকে দ্বারা ইংরেজিতে পাশ করা সম্ভব হবে না।
পপি গাইডের রচনা, প্যারাগ্রাফ এসবই আসতো বরাবর পরীক্ষায়। আর আমার আব্বু আমাকে এই গাইড কিনে দিবেন না। যার ফলে কোন পরীক্ষা এলেই আমি ভয়ে, আতংকে অস্হির হয়ে উঠতাম।

ঠিক এ সময়টাতেই আমার জীবনে পজেটিভ একটা ঘটনা ঘটলো।

আমাকে পড়ানোর জন্য যে গণিত স্যার আসতেন আমাদের বাসায়, তিনি তাঁর পরিচিত একজন ইংরেজি স্যারকে একদিন তিনি আমাদের বাসায় নিয়ে আসলেন।

সেই ইংরেজি স্যার সব ঘটনা শুনলেন। তারপর বললেন তিনি নিজেই খুবই ব্যস্ত মানুষ। রাত দশটার আগে উনার কোন সময় নাই।

আর আমার একটা টেস্ট নিবেন স্যার। তাতে যদি আমি খুব ভালো করি তাহলেই শুধু তিনি আমাকে পড়াবেন নয়তো, উনি আমাকে পড়াবেন না।

যথারীতি আমি টেস্টের জন্য তৈরি হয়েছি জানি না স্যার আমাকে কি লিখতে দিবেন, কোত্থেকে প্রশ্ন করবেন, পরীক্ষার আগে দিনরাত শুধু ইংরেজিই পড়লাম এবং স্যারের নেয়া টেস্টেও বেশ ভালো নাম্বার পেলাম।

২.

আমার ইংরেজি স্যার মোহিত স্যারকে যথেষ্ট সম্মান জানিয়ে বলছি তিনি আমার জীবনে একজন আলোকিত মানুষ হয়ে সেসময়টাতে এলেন।

যেই রাত দশটায় আমার উনার কাছে পড়ার আপত্তি ছিলো সেই রাত দশটার জন্য আমি রোজ অপেক্ষা করে থাকতাম। কোন মূখস্ত বিদ্যার ধার তিনি ধারতেন না। এক একদিন আসতেন এক এক টপিকের উপর ইংরেজিতে আমাকে কিছু ধারণা দিতেন মুখে মুখে তারপর বলতেন

– ” জননী এখন তুমি লিখো তো তোমার মতো করে!”

ইংরেজি যেনো এক মজার জগত হয়ে দাঁড়ালো আমার কাছে!! যেনো এক মজার খেলা।

আর গণিতের স্যার যিনি আমাকে বাসায় পড়াতেন তাঁর ঋণও আমি কখনো শোধ করতে পারবো না। দু’জন স্যার আমাকে পড়াতে বসলে কখনো ঘড়ির দিকে তাকাতেন না। ঘন্টার পড়া চলতো ঘন্টা দুয়েক। পড়াশোনা চলছে পুরোদমে দশম শ্রেণির ফলাফলের সময় এলো আমি ফলাফল আনতে স্কুলে গেলাম।

লাইনের খুব পিছনেই দাঁড়ালাম , আমি জানি আমি এবার মেধাতালিকা বা প্রথম দশজনেও থাকবো না। কারণ ইংরেজি পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে জানতে পারলাম জহির স্যার যা সাজেশন দিয়েছেন তার ছাত্রীদের হুবহু প্রশ্ন এসেছে। তাদের পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে তারা খুবই খুশি।

ফলাফল ঘোষণা করা হলো আমি এবারও চতুর্থ হয়েছি তবে দুই সেকশান মিলিয়ে চতুর্থ, আর আমার সেকশানে আমি হয়েছি দ্বিতীয়!

যারপরনাই আনন্দিত হয়ে যখন আমি দৌড়ে স্টেজের দিকে যাচ্ছিলাম তখন আমার এক বান্ধবী ইয়া আল্লাহ গো বলে চিৎকার দিয়ে পিছনে কেঁদে উঠলো। সেই কান্নাটা আমি আজও ভুলি নাই। মাঝে মাঝেই সেই কান্নার কথা মনে হয়। কারও সাফল্যে যখন কোন বন্ধু ভেঙে পড়ে, সে তার কতোবড় বন্ধু!!

৩.

রিপোর্ট কার্ড খুলে দেখলাম আমি ইংরেজিতে ৫০ পেয়েছি কিন্তু সাধারণ গণিতে ৯৯ আর উচ্চতর গণিতে ৯৮। তারমানে গণিতের নাম্বারদুটি এবার আমাকে বাঁচিয়ে দিলো।

রাতে আসলেন আমার বাসার ইংরেজি শিক্ষক মোহিত স্যার। স্যার আমার বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নটা দিয়েই বাসায় আমার আবার পরীক্ষা নিয়েছিলেন। কিন্তু খাতাটা তিনি আমার সামনে দেখেন নি, বলেছিলেন যেদিন আমার রেজাল্ট হবে স্যারও সেদিন সেই পরীক্ষার রেজাল্ট দিবেন।

একই পরীক্ষায় স্যারের কাছে আমি পেলাম ৭৮ কিন্তু স্কুলের খাতায় পেলাম ৫০!!

৪.
মোহিত স্যার আমার আব্বু আম্মু দুজনকেই একসাথে ডাকলেন। উনাদের সামনে বললেন –”আমার এই জননী ইংরেজিতে খুব ভালো ফলাফল করবে, আপনারা দেখবেন।”
স্কুলের নাম্বার আর উনার দেয়া নাম্বারের পার্থক্যটাও বুঝালেন। আম্মু খুব রাগারাগি করে বললো এটা নিয়ে স্কুলে কথা বলা দরকার।

স্যার বুঝালেন আম্মুকে –”আপনি কি চান দিদি? মেয়ে বোর্ড পরীক্ষায় ভালো করুক? সেটাই হবে! এখন স্কুলের পরীক্ষার নাম্বার নিয়ে আমার জননীকে আর কোনদিন বকবেন না।”

মোহিত স্যার আরও বললেন আমার স্কুলের ইংরেজি পরীক্ষার প্রশ্নগুলোতে তিনি বাসায় আমার পরীক্ষা নিবেন এবং এটাই হবে আমার আসলে পাওয়া নাম্বার, আম্মুকে বুঝানোর জন্য স্যার এই পদ্ধতিতে আমাকে পড়াতে লাগলেন। যা আমাকে মানসিকভাবে অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী করে তুললো।

এবার আমার আম্মুও বুঝলো, আমার বাসার বকাবকিও কমে আসলো। আমার ঘর হলো আমার জন্য নিরাপদ ঘর। যেখানে আমি আমার সব কথা বলতে পারি!

এরপর আমি আমার বাবা মায়ের আশানুরূপ ফলাফল করতে পেরেছিলাম এস এস সি তে।

তবে সেই ভয়ংকর সময়গুলো এখনো আমাকে ভাবায়, আতংকিত করে, বিমর্ষ করে তুলে একজন শিক্ষকের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ।

সেসময় হয়তো ঝোঁকের বশে আমিও কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম যদি আমার আব্বু আম্মু আমার পাশে না দাঁড়াতেন।

৫.

আজ ওই ঘটনার ২২ বছর পর আমিও একজন শিক্ষক
আবার একজন মা।

আমি আমার সন্তানের জন্য একজন নিরাপদ অভিভাবক হতে চাই। আমার সন্তানসম ছাত্র ছাত্রীদের কাছে ভরসার নাম হতে চাই।

পরীক্ষার আগে তাদের সামনে পদার্থবিজ্ঞানকে ভয়ংকর দৈত্যের মতো না দাঁড় করিয়ে একটা রূপকথার সুন্দর গল্পের মতো দাঁড় করাতে চাই।
তারা যখন হাসিমুখে বলে না মেডাম পারবো কঠিন কিছু না। সেই শান্তি আমার কাছে পাহাড়সম আনন্দের।

সবাই পড়াশোনা করবে, সবাই বোর্ড স্টান্ড করবে, সবাই ডাক্তার ইন্জিনিয়ার হবে, তাহলে আমরা কিভাবে আর একজন রুনা লায়লা বা একজন জয়নুলকে খুঁজে পাবো!! একজন নজরুল একজন হুমায়ুন আহমেদকে পাবো?

বাচ্চারা শিখুক আনন্দে, মজায়, আগ্রহ ভরে। তাদের উপর কোনকিছু আরোপিত করাটা যেমন ঠিক না, তেমনি আমাদের দেখা অপূরনীয় স্বপ্নগুলোও তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া ঠিক না।

সন্তানের কাছে জানতে চান সে কি হতে চায়? তার স্বপ্নগুলো কি? সেগুলো ছুঁয়ে দেখতে তাকে সাহস দিন, সাহায্য করুন।
তাকে কখনো বলবেন না,
তোমাকে ডাক্তার হতে হবে,
ডাক্তার না হলে তোমার জীবন শেষ,
এ জীবনের কোন দাম নাই, মরে যাও না কেন?
তোমার মতো সন্তান আমি কিভাবে পেটে ধরলাম!!

তাদেরও কষ্ট হয়, তারাও মানুষ। তারা বাঁচতে চায় নিজের মতো করে নিজেদের স্বপ্নে।

সব শিশুর অধিকার আছে একটা নিরাপদ ঘর পাবার।
পারপিতা, সানজানার মতো আর কারও বুকের ধন যেনো আত্মহত্যার মতো পথ বেছে না নেয়। আজ নিরাপদ একটা ঘর পেলে আমাদের ঝলমলে মেয়েরা এভাবে ঝরে পড়তো না।

আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here