বিয়ে_নামক_ছেলেখেলা,পর্ব২

0
635

#বিয়ে_নামক_ছেলেখেলা,পর্ব২

১.
“টাকা দেন দুলাভাই, টাকা না দিলে রুমে যেতে দেব না কিন্তু। ”

সোহানাদের বাড়িটা ইংরেজি অক্ষর এল শেপের, ফ্লোর আর হাফ ওয়াল পাকা, উপরে টিন। এলের মাথার একদম শেষ ঘরে রাকিব আর সোহানার বাসর ঘর সাজানো হয়েছে। বাসর ঘর বলতে মফস্বল শহরে হঠাৎ রাতে ফুলের আয়োজন কী করবে, কিছু গাঁদা ফুলের লহর, আর টেবিলের উপর গন্ধরাজ, গোলাপ, জবা ফুলের জগাখিচুরি করে সাজানো ফুলের টব। সম্ভবত এই ফুলগুলো নিজেদের বাগানে ফোঁটা। রুমে ঢোকার আগে কয়েকজন ছোকরা বয়সী কাজিন আর ভাবি টাকা দাবি করেন, রাকিবের ইচ্ছে করছিল কয়েকটাকে ধরে চটকনা দিতে, কিন্তু এ বাড়িতে সে এখন একা, তাই ক্রোধ দমনই শ্রেয়। দুই হাজার টাকা দিয়ে আপাততঃ সে মুক্তি হয়।

সেই দশ পনের মিনিটের সাক্ষাৎ, এর পর এখন সোহানার সাথে আবার দেখা হলো। বিয়ে পড়ানোর সময় এত হুলুস্থুল ছিল যে কনের দিকে তাকানোর সুযোগও হয়নি। বড় সাদাসিধা সাজ সোহানার, লাল শাড়ি নয়, হালকা গোলাপি কাতান শাড়ি পরনে, হাতে গোলাপি কাঁচের চুড়ি, গলায় কানে হালকা গয়না।।শাড়িটা নতুন মনে হচ্ছে, হয়তো পাত্র দেখানো উপলক্ষে কেনা হয়েছে।

“তোমার শাড়িটা কী নতুন?”

বিয়ের রাতে বরের মুখে প্রথম কথায়, এমন আজব প্রশ্ন বোধহয় কেউ শোনেনি। সোহানা অবাক হলেও মাথা নেড়ে সায় দেয়।

“কে কিনলো শাড়ি? পাত্র দেখা উপলক্ষে কেনা?”

সোহানা একটু বিব্রত বোধ করে, হঠাৎ রাকিব শাড়ি নিয়ে কেন এত কৌতূহলী। তবে এবার আর ঘাড় নেড়ে নয়, মুখেই উত্তর দেয়।

“মেজো চাচী ঢাকা থেকে এনেছেন। আম্মা আব্বা টাকা দিয়েছিলেন। দাম বোধহয় চার হাজার।”

“মেজো চাচী মানে, আব্বার মামাত বোন, আলেয়া ফুপু তাই না? কখন কিনলেন? ঢাকায় আমাদের বাসায় যে দিন সাতেক আগে গিয়েছিলেন তখন আসার সময় কিনলেন? ”

“জ্বি।”

“তারমানে ফুপুও এই ঘটনায় জড়িত। তোমরা সবাই মিলে আগে থেকেই এই পরিকল্পনা করেছিলে। নিশ্চিত ছিলে হঠাৎ আব্বার দূরসম্পর্কের মামাতো বোন গিয়ে ভাসুরের মেয়ের জন্য প্রস্তাব দিলে আব্বা না করতে পারবে না। ঠিকই ছেলেকে দেশের বাড়ি পাঠাবে। তবে দূরত্বের জন্য আমরা বেশি মানুষ আসতে পারব না, ফলে আটকানো সহজ হবে। বাহ্ ছেলে ধরার কী চরম বুদ্ধি। আমাদের জন্য আচানক বিয়ে হলেও তোমাদের জন্য পুরো পরিকল্পনা করে সাজানো। ”

সোহানা হতভম্ব চোখে তাকিয়ে থাকে, সহসা মুখে কথা আসে না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার রাকিবই কথা বলে।

“সোহানা সত্যি করে বলতো কাহিনি কী? তুমি দেখতে সুন্দর, বয়স হয়নি, তোমার পরিবার স্বচ্ছল, তুমি ভালো জায়গায় পড়াশোনা করো, তাহলে এমন করে বিয়ে দেওয়ার কারণ কী? ভার্সিটিতে কোন অকাম কুকাম করেছ?”

২.
রাকিবের অভিযোগে লজ্জায় সোহানার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। দুচোখ ছাপিয়ে জল নামে। এমন করে বিয়ে কী সেও চেয়েছিল!
সোহানা যে ভীষণ কল্পনা বিলাসী মেয়ে ছিল, বিয়ে নিয়ে কত কত স্বপ্ন ছিল, ম্যাচিং করে হলুদে সবাই শাড়ি গয়না পরবে, ঢাকার বিয়ের মতো এখানেও কাজিনরা নাচবে। ঘর ভর্তি কাজিন সোহানার, পরিবারের বড় মেয়ে, এমন জোর জবরদস্তির বিয়ে কী সোহানা কোনদিন চেয়েছে!

কিন্তু এ মুহূর্তে রাকিবের চোখে চোখ রেখে অভিযোগ খণ্ডানোর সাহস হয় না, মনে জোর পায় না।

“তার মানে কিছু একটা আছে তাই না? তুমি প্রেগন্যান্ট না তো?”

এবার সোহানা জোরে জোরে মাথা নাড়ে।

” না না, এসব কী বলছেন। ছিঃ ”

রাকিবের মুখের কাঠিন্য একটু কমলেও স্বাভাবিক হতে পারে না। রাকিবের জায়গায় অন্য কেউ হলেও হয়তো এমনই অভিযোগ করতো। এমন ভাবে বিয়ে যে কারো মনে প্রশ্ন আনবে। আবার রাকিবের সব অভিযোগ যে মিথ্যে বলে জোর গলায় অস্বীকারও করতে পারে না সোহানা। এটাও রাকিবের মন খাট্টা করতে যথেষ্ট।

রাকিবের চোখে চোখ রাখলেই সোহানার নিজেকে দূর্বল লাগছে। সোহানা কেন জোর গলায় বলতে পারছে না যে সে কোন অকাম কুকাম করেনি। হ্যাঁ উঠতি বয়সের আবেগ ছিল, আর আবেগটা সোহানার কাছে অন্যায় নয়, তার কাছে তার আবেগটা সত্যি। কিন্তু তার পরিবার জানা মাত্র বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে গেল। ভালো একটা পাত্রের খোঁজে গত পনের দিন ধরে সোহানার পরিবার হন্যে হয়ে গিয়েছেল।

সে সময় সোহানার মেজোচাচী আলেয়া বেগমের মাথায় আসে দূরসম্পর্কের ভাইয়ের ছেলে রাকিবের কথা। নিরীহ, ছিমছাম পরিবার রাকিবদের, এক বার বিয়ে হয়ে গেলে আর কোন ঝামেলা করবে না, এমনটাই বোঝায় মেজো চাচী। চাচা চাচী ঢাকা গিয়ে দ্রুত সব ঠিক করে আসেন। ঠিক করেন পাত্রী পছন্দ হয়েছে বললে বিয়ে পড়িয়ে দেবেন। খোঁজ খবর করার সময় দিলে কী শুনতে কী শুনবে, শেষে গত দুইবারের মতো এই বিয়েটাও হবে না।

৩.
“দেখুন আপনি রেগে আছেন জানি, তবে বিশ্বাস করেন এভাবে বিয়েতে আমিও রাজি ছিলাম না। আমার পরিবার বাধ্য করেছে।”

সোহানার ঠান্ডা কোমল স্বরেও রাকিবের মনের খাট্টা ভাব যায় না। এমন গুন্ডার মতো আটকে বিয়ে দিলে কে সহজ হতে পারে।

সোহানা আগেই চেয়েছিল সব বলতে, কিন্তু সুযোগ পেল কই। গতবার ছেলে পক্ষ দেখে যাওয়ার পর সব কিছু যখন ঠিক হয়, সোহানা তখনই ছেলেকে ফোনে সব জানাতে চেয়েছিল। কিন্তু আম্মা, চাচী কেউ রাজি হননি। লাভ কী হলো, ছেলের পরিবার কী না কী শুনে, বুঝে বিয়ে ভেঙে দিল। সোহানা যতই বোঝাতে চায় সহজ সত্যটা আগেই বলা উচিত, ততই অবুঝের মতো আচরণ করেন মুরুব্বিরা। এবার তো যা করলো তা যেন বিয়ে নামক ছেলেখেলা। এমন বিরূপ পরিবেশ তৈরি করে হওয়া বিয়ের ভবিষ্যত কতটা মধুর হবে, তা নিয়ে সোহানা নিজেও আতংকিত। তাছাড়া পরিবার যা ভুল ভাবে সোহানা তা ভুল ভাবে না। পরিবারের কাছে গত বিশদিন সে গৃহবন্দী, এক রকম জোর করে আটকে রেখে তাকে বিয়ে দিল পরিবারের মানুষজন।

৪.
রুমের সাথে এটাচ বাথরুম আছে। রাকিবের জন্য পরিষ্কার টাওয়াল, টিশার্ট এনে রাখা হয়েছিল। রাকিব ফ্রেশ হয়ে এসেছে। সোহানাও শাড়ি পাল্টে সুতির সালোয়ার কামিজ পরে নিয়েছে। রাকিব বালিশের উল্টো পাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়েছে। মনে মনে একটু স্বস্তি বোধ করে সোহানা। রাকিবের মনে হচ্ছে স্বামিত্ব খাটানোর পরিকল্পনা নেই। এমনিও এই রুমটা ছোট, একটাই খাট। এখানেই ঘুমাতো হবে। সোহানা বাতি নিভিয়ে আলগোছে শুয়ে পড়ে।

সারা দিনের উত্তেজনায় হোক আর ক্লান্তিতে হোক, সোহানার চোখ জুড়ে ঘুম নামে। কিন্তু পনের কী বিশ মিনিট যেতে না যেতে নিজের কোমরের কাছে শক্ত হাতের বাঁধন টের পায় সোহানা। কেউ যেন টেনে নিজের দিকে নিচ্ছে। মুহূর্তে ঘুম ছুটে গিয়ে সতর্ক হয়ে যায় সোহানা। বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু নিজের চেয়ে শক্তিতে বেশি রাকিবের সাথে পেরে ওঠে না।

“প্লিজ আজ না। এখনো তো আমাদের ভালো করে পরিচয়ও হয়নি।”

“ন্যাকামি করো না সোহানা। ভালো করে পরিচয় না হওয়া লোককে বিয়ে করতে পারলে, অথচ এখন কাজের সময় ঢং করছো। আমারতো ধারণা তোমার এসব অভিজ্ঞতা আগেই হয়েছে, তুমি পাকা খেলোয়াড়ই হবা।”

ব্যথায়, না রাকিবের কথায়, কোনটার জন্য চোখ ছাপিয়ে জল নামে বুঝতে পারে না সোহানা। হাতের কাঁচের চুড়িগুলো পুরুষালি হাতের চাপে ভাঙার পটাপট শব্দ হয়, হাতে কাচঁ ভাঙা আঘাতের ব্যথা। সোহানার মনেরও শত টুকরো কী হয়নি, যদিও তার শব্দ আর আঘাত অদেখাই থেকে যায়।

৫.
“সোহানা তুমি কী ভার্জিন?”

“কেন আপনার কী মনে হয়? সন্দেহ আছে?”

“না মানে ব্লিডিং হয়নি কোন। কিছুটা ব্লিডিং তো হওয়ার কথা।”

রাকিবের কথার উত্তর দিতে রুচিতে বাঁধলো সোহানার। কিন্তু বুঝতে পারছে রাকিব উত্তর চায়, উত্তর না পেলে সে নিজের মতো ভেবে নিবে।

“শুনেন আমার বয়স চব্বিশ বছর চলছে। আমি বাচ্চা মেয়ে তো না যে বিছানা রক্তে ভেসে যাবে। কষ্ট তো পাচ্ছিলামই, কিন্তু আপনি তো তাও থামেননি। রক্ত দেখার অপেক্ষায় ছিলেন?”

এবার রাকিবই বিব্রত হয়ে যায়। আসলেই রাতে মাথায় কী ভর করেছিল কে জানে, সোহানা ছটফট করলেও ছাড়েনি সে। তাছাড়া এটা রাকিবের অন্যায় মনে হয়নি তখন। তার বিয়ে করা বৌ, প্রথম রাতে কাছে আসার আবেগটা বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক মনে হয়েছে। আর সোহানার না না টাও তখন এত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি।
আসলে বন্ধুদের কাছে তো এমনই শুনেছে, প্রথম রাতেই বিড়াল না মারলে বৌ কন্ট্রোলে থাকে না। এমনিতে বিয়ে হলো এমন যা তা ভাবে, এরপর যদি বৌ কন্ট্রোলে না থাকে, জীবন জাহান্নাম হয়ে যাবে। বিব্রত হলেও সোহানার কাছে নিজের ভুল স্বীকার করে না রাকিব।

“দেখ আমি কী অন্যায় কিছু করেছি? বিয়ের রাতে তো স্বামী স্ত্রীর এমন সম্পর্কই স্বাভাবিক। আর মেয়েরা নাকি অমন না না করে। তাই এটাকে অন্য ভাবে চিন্তা করিনি।”

কিসের স্বপ্নের রাত কিসের কী, সারা শরীরে এক অদ্ভুত জ্বলুনি হচ্ছে সোহানার। রাকিবও যে খুব ভালো আছে তা না। প্রথম নারীদেহের সান্নিধ্যে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারালেও সোহানার সাথে যেন কোন মানসিক মিলন হয়নি। একই বিছানায় এক আকাশ সমান মানসিক দূরত্বে থাকা দুজন মানুষ যেন শুধু জৈবিক প্রয়োজনেই মিলিত হয়েছে, যাতে একজনের ইচ্ছে থাকলেও, আরেকজনের তাও ছিল না।

৬.
“আঙ্কেল আমি আজ ঢাকা ফিরে যাব। এখন তো দশটা বাজে, বারোটার বাস পাব না?”

“আজ তো আর অফিস করতে পারবা না, এই ভরদুপুরে গিয়ে কী করবা? সন্ধ্যায় যাও বাবা। আর আমি তো সোহানার আব্বা, আমাকে আঙ্কেল বলো না। আমি তোমার বাবার মতো।”

রাকিব চুপচাপ খেয়ে উঠে যায়। অবাক হচ্ছে বাবা বা মা কেউ এখনো সোহানার পরিবারের সাথে ফোনে কোন যোগাযোগ করলো না কেন!

রাকিব একটু আড়াল পেয়ে ভোরে ফোন দিয়েছিল, কিন্তু রাকিবের আম্মা বললেন এখন কোন ঝামেলা করতে না। কোন তর্কাতর্কি বা ঝামেলায় গেলে ক্ষতি করতে পারে। আপোষে ওদের ম্যানেজ করে রাকিবকে ঢাকা চলে আসতে বললেন। বাকিটা ওনারা পরে দেখবেন। রাকিবও মায়ের কথা মতো সকাল থেকে কারও সাথে কোন আর্গুমেন্টে যায়নি।

“রাকিব বাবা, বেয়াইন ফোন দিয়েছিলেন আমাকে। আলহামদুলিল্লাহ বিয়াইন যত দ্রুত সম্ভব সোহানাকে বরণ করার আয়োজন করতে চান। আমরাও তাই চাই। এক সপ্তাহের মাঝে ছোটখাটো আয়োজন করে আমরা সোহানাকে তোমার হাতে তুলে দেব ইনশাআল্লাহ। ”

সোহানার বাবা আর চাচার কথায় রাকিব অবাক হয়ে যায়, মা সত্যি এভাবে বিয়ে মেনে নিয়েছেন, কোন ঝামেলা হবে না!
সোহানার পরিবারও ভীষণ খুশি, খুশি আলেয়া ফুপু, মেজো চাচা সহ পরিবারের সবাই। তাদের মনে হচ্ছে কাল এভাবে ধরে বেঁধে বিয়ে পড়ানোর ফলাফল ভালোই হয়েছে, সব কত দ্রুত সমাধান হলো।

মনে শান্তি এলো না শুধু সোহানার, কেন জানি সোহানার মনে হচ্ছে সব এত সহজ কখনো হবে না, সকালে সে লুকিয়ে রাকিবকে বাসায় কথা বলতে শুনেছে, তার মনে হয়েছে রাকিব বা তার পরিবার কেউ এমন বিয়েতে খুশি না। আচ্ছা পনের লাখ টাকা কাবিনে কী আসলেই রাকিবকে আটকে রাখা যায়
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here