#ধারাবাহিকগল্প_পর্ব_৩
#বিয়ে_নামক_ছেলেখেলা
১.
সুব্রত আর সোহানা একই ডিপার্টমেন্টের দুই বছরের সিনিয়র জুনিয়র। বিশ্ববিদ্যালয়ে পহেলা বৈশাখের দিন আয়োজন করা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে চমৎকার রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিল সুব্রত। সেই মুগ্ধ শ্রোতাদের তালিকায় ছিল সোহানারও নাম।
ছোটবেলা থেকেই গান শেখার প্রচন্ড আগ্রহ ছিল সোহানার, কিন্তু রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে সোহানা কখনোই সেই অনুমতি পায় নি। তার পরিবারে মেয়েদের নাচ, গান করা ভালো দৃষ্টিতে দেখা হয় না।
“ভাইয়া আপনি এত চমৎকার গেয়েছেন। খুব ভালো লেগেছে। ”
“ধন্যবাদ। কোন ইয়ার?”
এইভাবেই শুরু সোহানা আর সুব্রতের পথচলা। সোহানার কাছে এক নিষিদ্ধ আবেগ ছিল এই সম্পর্ক, তবে আবেগটা মিথ্যে ছিল না। বাড়ি থেকে যখন বিয়ের চাপ আসা শুরু করে তখন সোহানা বুঝতে পারে সময় হয়েছে বিচ্ছেদের, সোহানার সাহস নেই ভিন্নধর্মাবলম্বী কাউকে মা বাবার সামনে নিয়ে হাজির করার। নিজের আবেগের লাগার টানার সিদ্ধান্ত নেয়। ক্যাম্পাসে সুব্রতের মুখোমুখি না হয়ে একরকম পালিয়েই বেড়াতে থাকে। কিন্তু সুব্রত ততদিনে নিজেদের ভবিষ্যতের কথা বহুদূর ভেবে ফেলেছে। সম্পর্কে জড়ানোর পর হঠাৎ এভাবে সোহানা ওকে এড়িয়ে যাবে তা সে কখনোই ভাবেনি।
“সোহানা আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছ কেন? তুমি জানো আমি অনেক উদারমনা, তুমি কোন ধর্মের সেটা আগেও আমার জন্য বড় ব্যাপার ছিল না। এখনো নেই। ”
“আমি ভুল করেছি সুব্রত। তুমি উদারমনা হলেও আমার পরিবার অনেক রক্ষণশীল, তারা কখনো এমন সম্পর্ক মানবেন না। আর আমারও এত সাহস নেই, আমি সমাজ আর পরিবার চ্যুত হতে পারব না।”
তারপরও সুব্রত হাল ছাড়ে না, সোহানাকে বোঝাতে থাকে, দিনের পর দিন সুব্রতের অনুরোধ আর আবেগের প্রকাশে সোহানা গলতে বাধ্য হয়। অবশেষে তারা ঠিক করে কোর্ট ম্যারেজ করে নেবে। সুব্রত স্কলারশিপ পেয়েছে, খুব শীঘ্রই দেশের বাইরে যাচ্ছে। একটু গুছিয়ে সেহানাকেও নিয়ে যাবে। বিয়ে করে নিলে তো সুব্রতই সোহানার অভিভাবক হবে, একবার দেশের বাইরে চলে গেলে আর সমস্যা হবে না, পরিবার না মানলে তারা দেশের বাইরেই সেটেল্ড হবে।
সোহানা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেলা ক্লাবের সদস্য ছিল। জেলা ভিত্তিক ক্লাব আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেন নিজ জেলার ছেলেমেয়েরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা পরিবারের মতো থাকতে পারে। সোহানা আর সুব্রতের প্রেম যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গরম আলোচনার বিষয়, তখন সোহানার মাথায়ও আসেনি, ক্লাবের হাত ধরে এত মাইল দূরে থাকা বাবা মায়ের কানে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা চলে যাবে। ক্লাবের সদস্য প্রায় দেড়শো, এরই একজন জুনিয়র সদস্য মিরণ, সোহানার চাচাতো ভাই হিসামের স্কুল ফ্রেন্ড। ক্লাবের সদস্য হয়েই তার কানে আসে সোহানা আর সুব্রতের প্রেম কাহিনি। আসলে সে ক্লাবে এসেছিল সোহানার খোঁজেই। মিরণ, হিল্লোলের কাছে শুনেছিল তার বড় বোন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তাই জেলা ক্লাবে এসে সোহানার খোঁজ করছিল, নিজ এলাকার সিনিয়র আপু ভাইদের সাথে পরিচয় থাকার সুবিধা আছে ভার্সিটিতে। সেই সুবিধা নিতে এসে অন্য গল্পই কানে আসে মিরণের।
তারপরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত, সোহানা অন্য ধর্মের কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে, বিয়ে করে বিদেশ যাওয়ার পরিকল্পনা করছে, এসব কানে আসা মাত্র বাড়িতে ঝড় বয়ে যায়। সোহানার বাবা তখনই সোহানাকে কানে ধরে নিয়ে আসবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু চাচা বাঁধা দেন, ওনার মতে এতে সোহানাকে নিয়ে আসা গেলেও সোহানার প্রেমিকের কানে কথা চলে যেতে পারে, তাতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কোন ঝামেলাও হতে পারে। তারচেয়ে সোহানাকে আপোষে এনে আটকে ফেলা ভালো, এবং যত দ্রুত সম্ভব ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দিবেন, এটাই সিদ্ধান্ত হয়।
“সোহানা তোর আব্বার হার্ট অ্যাটাক হইছে, অবস্থা ভালো না মা। তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়।”
মায়ের একটা ফোন কলে সোহানা আর ভাবার সমস্যা পায় না। তার মাথায়ও আসেনি বাবার হার্ট অ্যাটাকের খবর মিথ্যে হতে পারে। বাড়ি আসা মাত্র এক রকম গৃহবন্দী হয়ে পড়েছিল সোহানা। তার ফোন নিয়ে নেওয়া হয়েছিল, এবং এরপর পনের দিনের ভেতর রাকিবের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়। সুব্রতের সাথে যোগাযোগ করার কোন সুযোগও পায়নি, জানে না ছেলেটা ওকে ভুল বুঝেই বিদেশে পাড়ি দিল কি-না।
মিরণ ছেলেটা যে শুধু সোহানার পরিবারেকে এই প্রেমের কথা জানিয়েছে তা না, মিরণের সুবাধে এলাকার সবাই এই কথা জানে এখন। আর গুজবের ডালপালা ছড়িয়ে এমন হলো, কেউ বলে সোহানা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করেছে, কেউ বলে লিভ ইনে ছিল, কারো মতে পেটে বাচ্চাও এসেছে তাই বাপ মা তাড়াহুড়ায় বিয়ে দিয়েছে।
সোহানা তার মতো করে ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করেছে, সুব্রতের সাথে আর সম্পর্ক না রাখার কথা দিয়েছে, অনুরোধ করেছে এভাবে না বিয়ে দিতে, এতে সবার মনের সন্দেহই সঠিক মনে হবে, সবাই ভাববে আসলেও গুজবগুলো সত্যি, তাই এভাবে বিয়ে হলো।
বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করতে সোহানারও আর আপত্তি ছিল না, শুধু চেয়েছিল শেষ একবার সুব্রতকে সব ব্যাখ্যা করে না করে দেবে, ও নিশ্চয়ই বুঝতো, তাছাড়া ও তো দেশের বাইরে চলেই যাচ্ছে, বিয়ে না করলে আর দেখা হওয়ার সম্ভবনা নেই।
যাই হোক, বিয়ের কথা এগিয়েও সোহানার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেমের কথা পাত্রপক্ষ জানলে বিয়ে ভেঙে দেয়। তাই এইবার রাকিবের বেলায় আর কোন সুযোগ নিতে চায়নি সোহানার পরিবার। তাদের মনে হয়েছে একবার বিয়ে পড়ানো হলে, আর বড় অঙ্কের কাবিন ধরলে ছেলে চলে যাওয়ার পথ থাকবে না। বাড়ির আর মেয়ের সম্মান ফেরাতে এই পথই তাদের সঠিক মনে হয়েছে।
২.
“সোহানা তোমার ফোন কই? ফোন ব্যবহার করো না?”
“করি, এখন হাতে নেই। আম্মার ফোনে ফোন দিতে পারেন।”
“তোমার ফোন নেই কেন? ফেসবুক ব্যবহার করো?”
“আমার ফোন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আর ফেসবুকে খুব একটা ঢোকা হয় না।”
“ফোন নষ্ট হলে নতুন নেওনি? সিম কী করলে? ভার্সিটির কেউ কল করে না?”
“করলে আম্মার ফোনে করে। সিম ঢোকানো হয়নি।”
“সিম আমাকে দাও, আমি নতুন ফোনে ঢুকিয়ে দেব।”
“লাগবে না, আব্বা নতুন ফোন আনবেন।”
“সোহানা ঝেড়ে কাশো এবার। সমস্যা কী? আমি বোকাসোকা হতে পারি, কিন্তু এত বেকুবও না যে যা বলবা তাই বিশ্বাস করবো। যাক বাদ দাও, আস্তে আস্তে কানে সবই আসবে। লুকাবে আর কয়দিন।
তোমার ফেসবুক আইডি আর পাসওয়ার্ড দাও এখন, আমার ফোন থেকে ঢুকি।”
“ফেসবুক পাসওয়ার্ড যার যার পার্সোনাল বিষয়। আমি তো আপনার কাছে চাইছি না।”
“আমার এখানে সেখানে মুখ মারার ঘটনা নেই।”
“আমার আছে?”
“আছে তো অবশ্যই। না থাকলে ফোন কেন নিয়ে গেল তোমার? এভাবে ধরে বেঁধে কেন বিয়ে দিল? তোমাকে আমার চার আনার বিশ্বাস নেই। ”
তাহলে বিয়ে করলেন কেন, প্রশ্নটা মুখে এসেও আটকে যায় সোহানার, বিয়ে তো রাকিব ইচ্ছে করে করেনি, সোহানার পরিবার অনেকটা জোর করেই দিল। রাকিব খুবই খারাপ ব্যবহার করছে আড়ালে, অথচ সোহানার বাড়ির মানুষগুলো ভাবছে তারা বিশাল বড় একটা কাজ করলেন, মেয়ের ভবিষ্যত নিরাপদ করলেন। আচ্ছা সোহানার সাথে রাকিবের সম্পর্ক সবসময় এমনই থাকবে!
৩.
দুপুরের খাওয়া শেষে রাকিব বিছানায় কিছুক্ষণ রেস্ট নিতে আসে। সন্ধ্যা ছয়টার বাসে ঢাকা ফিরবে। রাকিবের আম্মা আব্বা বলেছেন বাসে না ওঠা পর্যন্ত কোন রকম ঝামেলায় যেতে না, একবার রাকিব ভালোভাবে ঢাকা এসে পৌঁছাক, তারপর তারা ভেবে দেখবেন ভবিষ্যতে কী করা যায়। এ বাড়ির সবাই জানে রাকিবের পরিবার স্বাভাবিক ভাবে সব মেনে নিয়েছেন, আগামী সপ্তাহে ছোটখাটো অনুষ্ঠান করে তারা সোহানাকে নিয়ে যাবেন।
একটা জগে পানি আর একটা গ্লাস নিয়ে রুমে ঢোকে সোহানা। গ্লাস আর জগ রেখে বেরিয়ে যাবে ভেবে নেয়। কিন্তু রাকিব উঠে দরজা লাগিয়ে দিলো।
“দরজা লাগালেন যে এই দিনের বেলায়।”
“একটু পর ঢাকা চলে যাব। তোমাকে একটু আদর করে যাই।”
“এই না বললেন আমাকে চার আনা বিশ্বাসও করেন না।”
“তা করি না। কিন্তু এটা আমার অধিকার। আমি তো কোন অপরাধ করিনি।”
রাকিবের অধিকার আদায়ের ফাঁকে সোহানা ভাবতে থাকে, অপরাধ কী তবে সোহানা করেছে! আর তার অধিকারটা কী, আর কেই বা দেবে!
(চলবে)