#ধারাবাহিকগল্প_পর্ব_৪
#বিয়ে_নামক_ছেলেখেলা
১.
” কী অবস্থা তোমার সোহানা?”
“জ্বি ভালো। আপনি ঠিক ভাবে পৌঁছেছেন?”
“রওনা দিলাম গতকাল সন্ধ্যা ছয়টায়, আর এখন বাজে সকাল নয়টা। পাঁচ ঘন্টার রাস্তায় এতক্ষণে না পৌঁছালেই অস্বাভাবিক হতো।”
রাকিবের সাথে সোহানার কথা চালানোই মুশকিল লাগে, তবে রাগ বা খোঁচা দেওয়ার কারণও আছে, রাকিব চলে যাওয়ার পর এই পর্যন্ত সোহানা কল করে কোন খোঁজ খবর নেয়নি, এখনও ফোন রাকিবই দিল।
“না আসলে আমি রাতেই ফোন দিতাম, কিন্তু আমার হাতে ফোন নেই। আম্মার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে কথা বলতে অস্বস্তি লাগে।”
“ঠিক আছে, সমস্যা নেই। আর একটা ফোন নিয়ে নেও। টাকা লাগলে আমি দেব। পনের হাজারে হবে? বাড়ির কারো বিকাশ নাম্বার থাকলে দিও।”
“না আপনার টাকা পাঠানো লাগবে না। আমি আব্বাকে বলবো।”
“সমস্যা নেই, পনের হাজার দিতে পারবো, কাবিনের পনের লাখ আশা করো না, অত টাকা আমার নেই। ”
বিস্ময়কর হলেও সোহানার জন্য একটা টান হচ্ছে রাকিবের, টানটা কী শুধুই শারীরিক কিনা তা অবশ্য জানে না! এতদিন কোন নারী স্পর্শ পায়নি, তাই এর টানও অনুভব হয়নি, হঠাৎ বিয়ে সেই দ্বার খুলে দিলো।কাল রাত ঘুমোতে গিয়ে বারবারই সোহানার অভাব অনুভূত হয়েছে বিছানায়। তবে তা বোধহয় শুধুই একটা নরম দেহের অভাববোধ, না হলে সকাল হতেই কেন বিরক্তি আর রাগ টা ফিরে আসলো! নাস্তার টেবিলেই যখন রাকিবের আম্মু আব্বু পরবর্তী করণীয় আলোচনা করছিলেন, একবারও সোহানাকে সমর্থন করে রাকিবের মুখ দিয়ে কিছু বের হয়নি। অথচ মনে মনে রাকিব নিজেও বুঝেছে এই হঠাৎ বিয়েতে সোহানারও কোন হাত ছিল না, পুরোটাই সোহানার পরিবারের হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলাফল।
২.
“রাকিব সোহানার সাথে কথা হয়েছিল তোমার, ফোনটোন দেয় নাকি?”
ফোন রাকিব নিজেই দিয়েছে, হঠাৎ করে একথা মায়ের সামনে স্বীকার করতে পারলো না।
“সকালে কথা হয়েছে আম্মু, সোহানাই দিয়েছিল। এই এক দুই মিনিট কথা বলেছি। ”
“বেশি কথাবার্তার দরকার নেই। তুমি ফোন দিতে যেও না। আমরা ভালো করে খোঁজ খবর নেই। ঘটনা তো অবশ্যই আছে। তাছাড়া এভাবে ধরে বেঁধে আমার ছেলের সাথে তারা বিয়ে দিলো, আমার ভাইয়ের ফোন পর্যন্ত নিয়ে আটকে রাখলো। এমন পরিবারের সাথে সহজে সম্পর্কে যাব না আমরা। খুব মেয়ে বিয়ে দেওয়ার শখ ছিল, দিয়েছে। এবার বৌ কবে আনবো, না আনবো না সেটা আমাদের ইচ্ছে। ”
সাকিব চুপচাপ নাস্তা করছিল, এবার সে মুখ খোলে।
“আম্মু ঐ দিন আমাদের ফোন রেখে দেওয়ার আগে যখন শুরুতে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল, তখন কিছু সময় আমি গোপনে ভিডিও করেছি। আমার ফোন তো পাসওয়ার্ড দেওয়া থাকে, ফোন ওরা নিলেও খুলতে পারেনি বোধহয়, তাই দেখলাম ভিডিওটা ফোনেই আছে, বোধহয় চোখে পড়েনি। ”
“দারুণ কাজ করেছিস সাকিব, এটা একটা ভালো প্রমাণ। এখন মেয়ের খোঁজ খবর নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে খোজ নিবে তোর মামা রাকিব। পনের লাখ টাকা কাবিন কীভাবে উদ্ধার করে আমরাও দেখব।”
বাসার কারও সোহানাকে আনানোর কোন ইচ্ছে নেই বোঝা হয়ে গিয়েছে রাকিবের। সোহানাকে যে বড় মুখ করে বললো ফোন কিনতে টাকা দেবে, এটা মা শুনতে পেলে বাসায় একটা লঙ্কাকাণ্ড হয়ে যাবে। তারচেয়ে বরং টাকা না পাঠিয়ে এখন চুপচাপ থাকাটাই ভালো মনে হলো রাকিবের।
৩.
“বুঝলে আপা যা ধারণা করছি তাই। মেয়ের তো বিশাল বড় কেলেঙ্কারি আছে। ভার্সিটির এক হিন্দু ছেলের সাথে সেই রকম সম্পর্ক ছিল, দু’জন মিলে দেশের বাইরেও চলে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। ছিঃ ছিঃ, এই জন্য কোন বিয়ের কথা আগাতো না। আমাদের বোকাসোকা পেয়ে এভাবে ছেলে আটকে বিয়ে দিলো।”
” হাবিব ভাই আমার, এমন নোংরা মেয়ে আমার বড় ছেলের বৌ হিসেবে কোনদিন ঘরে তুলবো না। তুই একটা পথ বের কর।”
“আরে জেসমিন তুমি কান্নাকাটি করো না। আমি আর হাবিব উকিলের সাথে কথা বলেছি। উপায় আছে।”
শান্ত না হয়ে বরং মিসেস জেসমিনের রাগ গিয়ে পড়ে এবার স্বামী ওয়াকিল আহমেদের উপর। শত হোক প্রস্তাবটা ওয়াকিল আহমেদের মামাতো বেনের মাধ্যমে এসেছে, যিনি সোহানার আপন চাচী।
“তুমি চুপ থাকো, তোমার জন্য আজ এই অবস্থা।। কোথাকার কোন বোন, যার সাথে কোন নিয়মিত যোগাযোগ নেই, সে হঠাৎ করে ভাসুরের মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসলো, আর তুমিও কোন খোঁজ খবর না নিয়ে আমার ছেলেকে মেয়ে দেখতে পাঠিয়ে দিলে।”
“জেসমিন আমি কী বুঝেছি আলেয়া এত বড় প্রতারণা করবে। যতই হোক মামাতো বোন শ্বশুরবাড়ির হয়ে ভাইয়ের ছেলের সাথে অন্যায় করবে তা কোনদিন ভাবিনি। ”
বিপন্ন দুলাভাই, আর কান্নারত বোনকে সামাল দিতে হাবিব সাহেবই পরিস্থিতি সামলে নেন।
“আপা কেঁদ না। যা হওয়ার হয়েছে। আমরা উকিলের কাছে গিয়েছি। তিনি একটা উপায় বলেছেন। রাকিব অফিস থেকে আসুক, বলছি।”
৪.
রাকিবের পরিবার এক সপ্তাহ পর সোহানাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে বললেও আজ দুই সপ্তাহ চলে গেল, কোন খোঁজ খবর নেই। সোহানার আব্বা ফোন করলে রাকিব ফোন ওঠায় না, বেয়াই বেয়াইনো ও ফোন ধরেন না। মাঝেমাঝে মামা হাবিব সাহেব ধরেন, টুকটাক কথা যা বলেন সবই এখন অনুষ্ঠান করার অপারগতা নিয়ে বলেন। বেয়াইনের নাকি শরীর ভালো না, পিত্তে পাথর হয়েছে, এটা নিয়ে রাকিবের পরিবার ব্যস্ত আছে, তাছাড়া সামনে নাকি সাকিবের বোর্ড এক্সাম, তাই তারা এখন কোন অনুষ্ঠান করে সময় নষ্ট করবেন না।
পিত্তে পাথর, সাকিবের বোর্ড এক্সাম, এসব যে একটা অজুহাত এটা সোহানার আব্বার না বোঝার কোন কারণ নেই। মেজো ভাইয়ের কথা শুনে এভাবে সোহানার বিয়েটা না দিলেই বোধহয় ভালো করতেন, দিন রাত এখন এই মনে হয়। একমাসের উপর বাড়িতে আটকে রেখে মেয়েটার লেখাপড়ার ক্ষতি করলেন, এত ভালো ছাত্রী একটা সেমিস্টার পিছিয়ে গেলো। মেয়ের মুখের দিকে তাকালে নিজেকে অপরাধী লাগে।
আসলেই তো অল্প বয়সে আবেগে ছোটখাটো ভুল তো সন্তান করেই, সেসময় না বুঝিয়ে এভাবে ধরে বেঁধে সবাই মিলে শাস্তি দেওয়াটা কী ঠিক! তাছাড়া সোহানা তো বারবার বলেছে সে সুব্রতের সাথে কোন যোগাযোগ আর রাখবে না, সুব্রত দেশেও নেই, বিদেশে চলে গিয়েছে। একটু ভরসা নিজের মেয়েটাকেও ওনার করা দরকার ছিল। সবার কথায় ভয় পেয়ে কলঙ্কমোচনের জন্য এভাবে মেয়ের বিয়ে দিলেন, অথচ এই বিয়েই যেন সোহানার মিথ্যা কলঙ্ক স্থায়ী করে দিলো।
৫.
শাস্তিই তো আসলে সোহানাই পেল, রাকিব যোগাযোগ করে না ইদানীং, ফোন সোহানার আব্বা নিজেই কিনে দিয়েছেন যেন মেয়ে জামাইয়ের সাথে কথা বলতে পারে। শাশুড়ির ফোনে হয়তো মেয়ের জামাই ফোন দিয়ে কথা বলে না, কিন্তু বৌয়ের নিজের ফোনে বলবে, এমনটাই ওনার আশা ছিল। ফোন হাতে পেয়ে সোহানা ফোনও করেছে, রাকিব হ্যাঁ হু দুই একটা কথা বলে রেখে দেয়, নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ লাগে সোহানার।এত অপমান কেন ওর কপালে হবে, যোগ্যতা অনুযায়ী কোন দিকে কম ছিল সোহানা, কোনদিন ভাবেনি এমন তাচ্ছিল্যের স্বীকারও হতে হবে। রাগটা আর অভিমানটা রাকিবের চেয়ে নিজের পরিবারের উপরই বেশি আসে, এখন খুশি তো সবাই, এভাবে বিয়ে নামক ছেলেখেলা করে ওর জীবনের সাথে!
“ভাইজান আপনে এমুন ভাইঙ্গা পড়ছেন ক্যান। তারা সোহানারে তুলে নিবো না মানে, একশো বার নেব। রাকিবের সাথে সোহানার বিয়ে বৈধ, রাকিব সোহানার সাথে রাইতে থাইক্কা গেল না, এখন কী আর অস্বীকার করতে পারবো?”
কানে হাত দেয় সোহানা, ইসস বিয়ে টিকানোর জন্য রাকিবকে রাতে রেখে দেওয়া, সব কতদূর ভেবে করা। একটা বৈধ নারীদেহ দেখে ছেলে নিজেকে সামলাতে পারবে না, সম্পর্ক হবে, আর শারীরিক সম্পর্কে গেলে বিয়ে অস্বীকার করা যাবে না।
“ভাইজান কাল লন ঢাকার পথে মেলা করি। দেখি কী এমন অসুখ বেয়াইনের। সামনাসামনি কথা হইবো। আলেয়ারেও নিমু, যাই হোক মামতো হইলেও ভাই আলেয়ার। জোর করা, নরম হওয়া যা লাগে হমু আমরা। মাইয়ার সংসার না হই যাইবো কই।”
সোহানার কথা কেউ শোনে না। এভাবে সংসার সোহানা চায় না, আর পারছে না নিজেকে এমন ছোট করতে। নিজের ভার্সিটিতে ফিরতে চায়, ক্লাস করতে চায়। সে বোঝাতে চায় সময়ের সাথে এসব ঘটনা মানুষ ভুলে যাবে, কোন কলঙ্ক কপালে চিরস্থায়ী হয় না। কিন্তু তারপরও সোহানার পরিবারের মানুষজন এসব শুনতে নারাজ, তাদের কাছে এখন যেকোনো মূল্যে সোহানার সংসার প্রয়োজন।
(চলবে)