বিয়ে_নামক_ছেলেখেলা-০৬

0
555

#ধারাবাহিকগল্প_পর্ব_৬
#বিয়ে_নামক_ছেলেখেলা

১.
“শুনলেন তো ভাবি সোহানার কথা। এবার বুঝেন কে মিথ্যা বলেছে। সবার সামনে ফোন দিলাম, লাউড স্পিকারে শুনলেন তো কী বললো। আর কী বলার আছে বলেন? একটা মেয়ে নিশ্চয়ই এমন ব্যাপার নিয়ে মিথ্যে বলবে না।”

রাকিবের আম্মাও দমবার পাত্রী নন, ছেলের উপর মনে মনে বিরাট রাগ হলেও তা প্রকাশ করলেন না।

“আলেয়া, বললেই হলো! রাকিব ছিল কতক্ষণ ঐ বাড়িতে, একদিনে এতকিছু হয়? ছিঃ কেমন নির্লজ্জ মেয়ে আবার বলে ‘একবার না আমাদের মাঝে কয়েকবার সম্পর্ক হয়েছে ‘ ছিঃ ভালো মেয়ে এমন চটাং চটাং বলতে পারে।”

“ভাবি মানছি এভাবে ধরে বেঁধে বিয়ে দেওয়াটা অন্যায় হয়েছে। কিন্তু তোমরা এখন যা শুরু করেছ, সেটাও কম অন্যায় না। কী বাজে ভাবে সোহানাকে নিয়ে বলছো। অথচ রাকিব এত ভালো ছেলে হলে সোহানার কাছে বারবার কেন গেলো, বদ্ধ রুমের ভেতর তো কেউ রাকিবকে বাধ্য করে নি কোন সম্পর্ক করতে। সুযোগ বুঝে ষোলআনা নিল ঠিকই, কিন্তু এখন অস্বীকার করে। ডাকো তুমি রাকিবকে, সবার সামনে সত্য বলুক। আমাদেরও ভুল হয়েছে ভালো চাকরি আর শিক্ষিত পরিবার দেখে আমরা আর কোন কিছু ভাবিনি, বিয়ে দিয়ে দিলাম। এমন দূর্বল মনের ছেলে হবে জানলে আমরাও আগাতাম না, নিজের বৌ নিয়ে মিথ্যা বলা কী ভালো ভাবি?”

“বাদ দেও আলেয়া, যা হওয়ার হয়েছে। এখন কী সমাধান করা যায় তাই বলো।”

রাকিবের আব্বা আম্মা নরম হয়ে এসেছেন, ভাগনে ইতোমধ্যে বিবাহিত জীবনের শুরু করে ফেলেছে জেনে মামা হাবিব সাহেবও চুপচাপ হয়ে যান। রাকিব রুম থেকে সবই শুনছে, সবার সামনে এসে কথা বলার মতো সাহস তার নেই। সে সোহানাকে অস্বীকারও করতে পারে না, আবার সংসার করবে সে কথা বলার মতো সাহসও দেখাতে পারছে না, যা নিতান্তই কাপুরুষোচিত আচরণ।

সোহানার বাবাই কথা শুরু করেন,

“বেয়াইন সাহেব, আমি মেয়ের সংসার চাই। বড় মেয়ে আমার, বিশ্বাস করেন মেয়েকে এমন যা তা ভাবে বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে কোনকালেই আমার ছিল না। কত স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠালাম, এত ভালো ছাত্রী মেয়ে আমার, স্কুল কলেজে কোনদিন কারো দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। সে মেয়ে ভার্সিটিতে গিয়ে অন্য ধর্মের ছেলের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়াতে পারে এটা চিন্তারও অতীত। তবে এতটুকু ছাড়া বাকি সব মিথ্যা, সোহানা বিবাহবহির্ভূত কোন নোংরা সম্পর্কে যায় নি, আর এখন ও মন দিয়েই সংসার করবে। গ্রামের মানুষ তিলকে তাল বানিয়েছে, আর আমিও মানুষের কথার ভয়ে এমন ভাবে মেয়ের বিয়ে দিলাম। এখন আপনারা যা চান তাই হবে, তবে আমি মেয়ের সংসার চাই।”

বলতে বলতে কেঁদে দেন আহসান সাহেব। রাকিবের আব্বা আম্মার চোখেচোখে কথা হয়। মিসেস জেসমিনের সম্মতির ইশারায় হায়দার সাহেব আহসান সাহেবকে স্বান্তনা দেন।

“ভাই সাহেব, এই জিনিসটা আগেই পরিষ্কার করলে কী হতো? এভাবে জোরজবরদস্তির বিয়ে কেন দিলেন? এত তিক্ততা দিয়ে নতুন সম্পর্ক কী শুরু করা যায়?”

বেয়াইয়ের কথায় আহসান সাহেব আশার আলো দেখেন।

“বেয়াই সাহেব, যা তিক্ততা আছে আমরা মিটিয়ে ফেলবো। আপনারা কাবিনের টাকা কমাতে চাইলে তাও হবে। কাবিন কত ধরলে ভালো বলেন? সে অনুযায়ী রেজিষ্ট্রেশন হবে।”

এত নরম হয়ে যাওয়াটা সোহানার চাচার ভালো লাগে না, সোহানার সংসার এই কাবিনেই হোক, এমনটাই চান চাচা, এটা নাকি মেয়ের নিরাপত্তা। কিন্তু আহসান সাহেব যেকোনো কিছুর বিনিময়ে মেয়ের সংসার চান।
দু’পক্ষ মিলে সিদ্ধান্ত হয় কাবিন কমে সাত লাখ হবে। দু’সপ্তাহের ভেতর আয়োজন করে সোহানাকে নিয়ে আসবেন।

২.
“আম্মু সোহানাকে তাহলে মেনে নিয়েছ?”

“কিসের মেনে নেওয়া। তুমি যা করেছ, আর কী করার ছিল? এত টেনশনের ভেতর কী করে অতটুকু সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে না তুমি? মানে সুযোগ পাওয়া মাত্র স্বামী গিরি! মানুষের সামনে লজ্জায় পড়ে গেলাম, কত বড় মুখ করে বলেছি মামলা করবো, ছেলে তো বিয়ে মেনেই নেয়নি। ”

“আম্মু আমি তো সম্পর্ক হয় নাই এটা সরাসরি বলিনাই। আবার সোহানা যেমন বললো তেমন কিছুও না, সামান্য কাছে আসা, আর কিছু না।”

“তাহলে সোহানা এমন দৃঢ় গলায় কেমন করে বললো?”

“ওরা তো এমনই আম্মু। পুরো পরিবারই তো অনেক শক্ত, আমাদের মতো নরম না।”

মায়ের সামনে আরেকদফা মিথ্যে বললো রাকিব।

সবকিছু মোটামুটি ঠিকঠাক হওয়ার পর রাকিব আবার সোহানার সাথে যোগাযোগ শুরু করেছে, কিন্তু এমন কাপুরষ এক লোকের জন্য বিন্দুমাত্র ভালোবাসা আসে না সোহানার মনে। ফোনে কথা বলতে বলতে রাকিব যখন কথাগুলো ঘনিষ্ঠ দিকে নিয়ে যায়, শিহরিত হওয়ার পরিবর্তে সোহানার কেমন ঘিনঘিন লাগে। এই লোকটাই সবার সামনে তাদের মাঝে কোন সম্পর্ক হয়েছে তা অস্বীকার করেছে, নিজেকে স্বীকার করার সাহসটুকুও যার নেই, সে নিঃসন্দেহে কাপুরষ।

সোহানার পিরিয়ডের ডেট পার হয়েছে আজ চারদিন হলো, কথাটা কী রাকিবকে এখন জানাবে, না তুলে নেওয়ার পর, তাই ভাবছে। এখন বাড়ির বাইরে সোহানা একেবারেই যায় না, তাছাড়া আশেপাশের সব লোকাল দোকান পরিচিত। প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিট কিনলে কে আবার কী বলে কে জানে। আগামী সপ্তাহেই ছোটখাটো অনুষ্ঠান করে ওকে তুলে নেওয়ার কথা। আপতত বাড়ির সবাই হাফ ছেড়ে বেঁচেছে, যদিও মেজো চাচা কাবিনের টাকা এত কমিয়ে রেজিষ্ট্রেশন করার পক্ষে ছিলেন না, কিন্তু আহসান সাহেব রাকিবের পরিবারের কথাই মেনে নিয়েছেন। এসব কোন কিছুই এখন সোহানাকে স্পর্শ করতে পারে না। না সে সংসার জীবন শুরু হচ্ছে বলে খুশি, না বাবার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার জন্য দুঃখিত। তার মন শুধু চিৎকার করে বলে, ‘সবাই তোর সাথে অন্যায় করলো সোহানা। আসলে সুব্রতের অভিশাপ লেগেছে, জীবনে আর সুখী হবি না।’

সাহানা ভাবে, আচ্ছা এখন তো ফোন হাতে আছে, ক্যাম্পাসে একটু ফোন দিয়ে কী খোঁজ নেবে, সুব্রত কেমন আছে বা বিদেশে কবে গেল! কিন্তু দীর্ঘদিনের সংস্কার সোহানাকর মনকে বাঁধা দেয়। এখন সে বিবাহিত, তাছাড়া সুব্রত যদি তাকে ঘৃণা করে ভুলে গিয়ে থাকে তবে তাই ভালো। মাফ চাইতে আবার যোগাযোগ করার মানে হয় না।

৩.
“সোহানা তোমাকে আদর করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি জানো? তখন কিন্তু না না করতে পারবা না, আর কয়েকদিন মাত্র, এরপর আমার বাসায় নিয়ে আসব, ইচ্ছে মতো সারারাত আদর করবো।”

“তারপর? পরের দিন আন্টি যদি জিজ্ঞেস করেন, ‘ কী করলে বৌয়ের সাথে রাতে’ তখন কী বলবেন? সারারাত লুডু খেলেছিলাম বলবেন? ”

“এভাবে বলছো কেন? যা চলে গিয়েছে তা টানো কেন?তাছাড়া আমি কী তোমার মতো নির্লজ্জ, যে সবার সামনে বলবো ‘একবার না আমাদের কয়েকবার সম্পর্ক হয়েছে’।

” সত্যিটা বললে নির্লজ্জ, আর আড়ালে এমন কথা বলা খুব ভালো? অস্বীকার করা ভালো? ”

“সোহানা তখন পরিস্থিতি এমন ছিল, তাছাড়া আমি অস্বীকার করলাম কই, আম্মু বাড়িয়ে বলেছে। আর এখন এমন সেক্সুয়াল কথা বলা কী আমার অপরাধ? হ্যাসবেন্ড ওয়াইফে রোমান্টিকতা থাকবে না?”

“আপনি হয়তো রোমান্টিকতার সংজ্ঞাই জানেন না।”

“আচ্ছা কে জানে সংজ্ঞা, তোমার প্রেমিক। কিভাবে কথা বলতে তোমরা, আমাকেও একটু শিখাও।”

“রাকিব আমি ফোন রাখি, আপনি রেগে উল্টোপাল্টা বলছেন। মাথা ঠান্ডা হলে ফোন দিয়েন। আর আমি যদি অন্যায় বলে থাকি, স্যরি।”

ফোন রাখলেও মেজাজ খিচড়ে যায় রাকিবের। এমনিও সোহানা ঘনিষ্ঠ কথাবার্তায় সাড়া দেয় না বলে রাকিবের ভালো লাগে না। রাকিবের মতে বিয়ে হয়ে গিয়েছে, এখন তো হ্যাসবেন্ডের সাথে এমন কথাবার্তায় সাড়া দেওয়াই যায়। তার মনে হয় সেহানা এখনো ভার্সিটির ঐ ছেলেকে মনে রেখেছে, তাই স্বামীর সাথে ক্লোজ হতে পারে না।
আচ্ছা কতটা ক্লোজ ছিল সোহানা ঐ ছেলের সাথে, যতটা ক্লোজ একটা পুরুষ আর নারী হয় বিয়ের পর!!! এই এক বিশ্রী চিন্তায় রাকিবের ঘুম হারাম হয়ে যায়, অথচ সোহানার ঠান্ডা ব্যবহার, সাড়া না দেওয়ার পেছনে যে তারও কোন ভুল থাকতে পারে, একবারও তা মাথায় আসে না।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here