বিয়ে_নামক_ছেলেখেলা-০৭

0
483

#ধারাবাহিকগল্প_পর্ব_৭
#বিয়ে_নামক_ছেলেখেলা

১.
“বেয়াই পুরোনো কথা কিছু মনে রাখবেন না। মেয়েটাকে আপনাদের হাতে দিলাম, নিজের মেয়ের মতো আদর শাসন সব করবেন, শুধু অযত্ন করবেন না, অনুরোধ থাকলো।”

বলতে বলতে কেঁদে দেয় সোহানার বাবা আহসান সাহেব। সারাদিন পাথরের মতো মুখ করে থাকলেও এখন আর নিজেকে আটকাতে পারে না সোহানা।

“শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। আশা করি শুরুটা খারাপ হলেও সোহানা তার ব্যবহারে আমাদের মন জয় করে নেবে। চিন্তা করবেন না।”

কথাটা সোহানার শাশুড়ি জেসমিন সুলতানার।

অবশেষে সেই দিন এসেই গেলো, কাঁদবে না কাঁদবে না করেও চোখের জল বাঁধ মানলো না, যতই হোক নিজের পরিবার, নিজের মানুষজন, বাড়ির আঙিনা এসব ছেড়ে যাওয়াটা সহজ নয়। তার উপর বিদায়টা যখন হয় এত উৎকন্ঠা মনে নিয়ে। নতুন জীবনের শুরুটা কেমন হবে জানে না সোহানা, তবে সহজ নয় তা বেশ বুঝতে পারছে, কষ্টটা হলো পুরোনো জীবনের শেষ স্মৃতিটাও যে আনন্দময় রইলো না। সাজানো গাড়িতে বসে রিলের মতো চোখে ভাসে ফেলে আসা দিনগুলো।

স্কুল কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়, কখনোই খারাপ ছাত্রী ছিল না, বাড়ির আদরের লক্ষী মেয়েটাই হয়ে ছিল সবসময়। সেই মেয়েটাই অচ্ছুৎ হয়ে গেল হঠাৎ করে। রাকিব আর তার পরিবারকে দোষ দিবে কী সোহানা, সোহানার নিজের পরিবারও কী তার উপর বিশ্বাস রেখেছিল! কত বার বলার চেষ্টা করেছে সুব্রতের সাথে শুধুই প্রেমের সম্পর্ক ছিল, যা সে শেষ করে দেবে, কিন্তু তারপরও কেউ বিশ্বাস রাখেনি, গত আড়াই মাস ধরে একরকম গৃহবন্দী জীবন কাটিয়েছে, যেন সে বিরাট অপরাধী। অথচ যত বেশি সোহানার বাবা মা সোহানাকে গোপন করতে চেয়েছে সমাজ থেকে, ততবেশি সমাজ সোহানাকে ভুল বুঝেছে। এই যে রাকিবের মনে এত সন্দেহ এরজন্য সোহানার নিজের পরিবার কম দ্বায়ী নয়, এমন ধরে বেঁধে বিয়ে, যেকোন মূল্যে সংসারে ঢোকানোর চেষ্টা, এগুলো করলে কী মেয়ের সম্মান হয় নতুন পরিবারে! তারা তো ধরেই নেয় খুঁত নিশ্চয়ই আছে, নাহলে এভাবে মেয়ে কেন দেবে, কলঙ্ক যা রটেছে, তা কিছু তো বটেই, না হলে বাড়িতে কেন আটকে রাখবে।

সন্দেহ, অবিশ্বাস আর অসন্তুষ্টি নিয়ে শুরু হওয়া একটা সম্পর্ক কতদূর সুন্দর করা যাবে জানে না সোহানা। রাকিবের পরিবার সমাজে সম্মানীত, রাকিব ভালো চাকরি করে, এসবই ঠিক আছে, কিন্তু এগুলো বিবাহিত জীবনে সুখী হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, একথাটা কেউ বুঝলো না। রাকিব মানসিক ভাবে ভীষণ দূর্বল, লোকের কথায় প্রভাবিত হয়, তার উপর স্ত্রীর প্রাক্তন সম্পর্ক নিয়ে তার মনে দানা বেঁধেছে সন্দেহ, এই সব কিছু একপাশে রেখে রাকিব আর সোহানার পক্ষে আত্মিক ভাবে কতটা কাছে আসা সম্ভব?? খুব বুঝতে পারে সোহানা, সেদিনের সেই রাগ করে ফোন রেখে দেওয়ার জের রাকিব এখনো মনে পুষে রেখেছে, গত তিনদিন ঠিক ভাবে আর কথাও বলেনি। সোহানাও চেষ্টা করেনি মান ভাঙানোর, তার মন টানে না, রাকিবের কথা ভেবে ভালোবাসা ভালোলাগা কিছুই অনুভব করে না। এ এক জীবন্মৃত সম্পর্ক যেন।

২.
“গাড়ি কী পথে কোথাও থামানো যাবে? আমাকে একটু ফ্রেশ হতে হবে।”

একটা মাইক্রোবাসে করে বরযাত্রী এগারোজনের সাথে সোহানা রওনা হয়েছে শ্বশুরবাড়ি, আলাদা করে বরের গাড়ি ফুল দিয়ে সাজায়নি কেউ। এত দায়সারা বিয়েতে এগুলো কারো করতে ইচ্ছে হয় না।

“সামনে পনের বিশ মিনিট পর ভালো হাইওয়ে রেস্টুরেন্ট পাওয়ার কথা। তখন থামানো যাবে।”

সোহানার শ্বশুর হায়দার সাহেব উত্তর দেন। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরেই অস্বস্তি চেপে বসে আছে সোহানা, এখন তলপেটে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে, সাথে বমি বমি ভাব। একটা মুহূর্ত আর এই কাতান শাড়ি, গয়না পরে বসে থাকতে পারছে না।

“ভালো লাগবে না, রাস্তার পাশে সাধারণ কোন হোটেল হলেও হবে। আমার খুব খারাপ লাগছে।”

রাকিবের আম্মা জেসমিন সুলতানা বিরক্ত হোন, এমনিও নতুন বৌ নিয়ে মনে কোন আনন্দ, আদিখ্যেতা নেই, তাই সোহানা যাই বলুক ওনার বিরক্ত লাগাই স্বাভাবিক।

“আরে এমন শাড়ি গয়না পরে যাতা হোটেলে নামা যায় নাকি? তার উপর তোমার পরনে সোনার গয়না, বিপদ আপদের কোন সময় আছে? আমি তো ভাবলাম পথে আর থামতেই নিষেধ করবো, একবারে ঢাকায় চলে যাই, হাইওয়ের বিশ্বাস নেই। ”

বলে কী শাশুড়ি, ঢাকা পর্যন্ত দূর আর পাঁচ মিনিটও এভাবে বসে থাকলে বমি করে দেবে নিশ্চিত। গয়না খুলতে শুরু করে সোহানা, জেসমিন সুলতানা সহ গাড়ির অন্যরাও অবাক সোহানার কাজকারবারে। রাকিব এতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেও, এবার সেও বিরক্ত হওয়া শুরু করে।

“সোহানা কী সমস্যা?”

“গয়না গুলো খুলে রাখি, তাহলে তো নামতে সমস্যা নেই, তাই না? আমার আসলে অনেক শরীর খারাপ লাগছে।”

শেষ পর্যন্ত গাড়ি থামাতে বাধ্য হয় রাকিব। সোহানাকে নিয়ে নিজেই এগিয়ে যায় ওয়াশরুমের দিকে। সোহানার মুখের দিকে তাকিয়ে এখন রাকিবের মনে হচ্ছে শুধু শুধু ঢং করছে না সোহানা, আসলেই তার শরীর খারাপ লাগছে, কেমন এলোমেলো পা ফেলে হাঁটছে, মনে হচ্ছে শাড়িতে জড়িয়ে পড়ে যাবে যেকোন সময়।

“তোমার কী মোশন সিকনেস আছে? গাড়িতে উঠলে বমি হয়? রওনা দিলাম দুই ঘন্টাও হয়নি, এত খারাপ কেন লাগছে তোমার?”

“না মোশন সিকনেস নেই।”

আর বেশি কথা বলা হয় না সোহানার, ওয়াশরুমে ঢুকেই এতক্ষণ আটকে রাখা সব কিছু ছেড়ে দেয়। বমি করতে করতে একসময় ওর মনে হচ্ছিল ও মারাই যাবে। এত জোরে জোরে শব্দ হচ্ছিল যে জেসমিন সুলতানাও এগিয়ে আসেন।

“রাকিব ঘটনা কী? এই দু’ঘন্টার জার্নিতে এমন অবস্থা তে হওয়ার কথা না।এমন তো না গ্রামের মেয়ে জীবনে গাড়িতে উঠেনি। চেহারাও কেমন ফ্যাকাসে, কেমন অস্থির হয়ে গেল গাড়িতে। তুই জানিস কিছু?”

“আম্মু আমিও বুঝতেছি না, শরীর তো বেশিই খারাপ মনে হচ্ছে।”

“অন্য ঘটনা আছে, আমি নিশ্চিত।”

“কী ঘটনা আম্মু।”

“বাদ দে, এখন বাইরের মানুষজন আছে। বাসায় গিয়ে সোহানার সাথে সরাসরি কথা বলবো।”

জেসমিন সুলতানাকে চিন্তিত দেখে রাকিবও ভয় পায়। ভয় টা সোহানাকে নিয়ে নয়, ভয়টা ভয়ের কারণটা কে সেটা নিয়ে। হ্যাঁ সোহানার সাথে একদিন কাটিয়েছি সে, কিন্তু বিয়ের প্রথম রাতেই কী কেউ প্রেগন্যান্ট হয়!!! একটা অবিশ্বাসের বাতাস রাকিবের মনে দোলা দিয়ে যায়। একটু আগেও সোহানার জন্য মমতাবোধ করলেও এখন কেমন একটা বিতৃষ্ণা জাগে।

৩.
সোহানার বিয়ের খবর অনেক আগেই পেয়েছে সুব্রত, এমনটাই হওয়ার কথা ছিল, তারপরও মিথ্যা আশার জাল বুনেছে। যখন থেকে মন্ট্রিল ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপের আবেদন করেছে, তখন থেকে সোহানাকে শুধু বুঝিয়েছে একবার দেশের বাইরে সেটেল হয়ে গেলে তাদের দু’জনের এক হতে কোন বাঁধা থাকবে না। অথচ সে খুব ভালো করেই জানতো দীর্ঘদিনের পারিবারিক সংস্কার ভেঙে এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস সোহানার কখনো হবে না। তারপরও শেষ পর্যন্ত সে সোহানাকে রাজি করাতে পেরেছিল, আবেগের আতিশয্যে বন্ধু বান্ধবের সাথে শেয়ারও করে ফেলেছিল, তারই ফলশ্রুতিতে এক কান দুই কান হয়ে কথা সোহানার পরিবার পর্যন্ত চলে যায়।

সোহানার ব্যাপারটা বোঝে সুব্রত, শুধু কষ্ট লাগে একবার কী সোহানা নিজ থেকে কথা বলে সম্পর্কটা শেষ করে দিতে পারত না! এভাবে সিম বন্ধ করে, নাম্বার পাল্টে কেন গায়েব হয়ে গেলো। বাবা মায়ের মৃত্যুর পর দিদি ছাড়া এ পৃথিবীতে আর কেউ নেই সুব্রতর। দিদি আর জামাইবাবু বছর চারেক আগে কানাডায় সেটেল্ড হয়েছেন, এখন সেও চলে এলো পোস্ট গ্রাজুয়েশন করতে। দেশে ফিরে যাওয়ার শুধু একটাই কারণ ছিল, সোহানা। সেই সোহানাই যখন আর তার নেই, দেশে আর ফিরে যাওয়ারও কোন কারণ নেই।

সোহানার ফেসবুক দীর্ঘদিন ধরে ইনএকটিভ, তাছাড়া বিবাহিত সোহানার নতুন জীবনে যোগাযোগ করে ঝামেলা আনতে চায় না সুব্রত, যে চলে গিয়েছে, তার পিছু হেঁটে লাভ নেই। ফোনটা বের করে সোহানার নাম্বার ডিলিট করে দেয় সুব্রত, কষ্ট হলেও তার জীবনে সোহানা অধ্যায়ের এখানেই ইতি।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here