বিয়ে_নামক_ছেলেখেলা #শেষপর্ব

0
877

#বিয়ে_নামক_ছেলেখেলা
#শেষপর্ব

১.
“সোহানা টেস্ট রেজাল্ট কী এসেছে?”

“কিছু না মামী।”

রাকিবের মামা মামী সকাল সকাল এসে হাজির হয়েছেন। দুই গলি সামনেই ওনাদের বাসা, তাই যখন তখন আসতে কোন সমস্যা নেই। সকাল হতেই সবাই চাপা উত্তেজনা নিয়ে বসে ছিলেন, এখন সোহানাকে রুম থেকে বের হতে দেখে মামীর আর তর সয় না। সোহানা নেগেটিভ বললেও জেসমিন সুলতানার বিশ্বাস হতে চায় না, মিথ্যাও তো বলতে পারে সোহানা। রাকিব অবশ্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

“সোহানা ঠিক মতো টেস্ট করেছ?”

সোহানাকে প্রশ্নটা করেই ফেলেন রাকিবের আম্মু।

“জ্বি।”

“দেখ সোহানা এখনকার দিনে কিছু লুকানো যায় না। তুমি নেগেটিভ বললে, আমরাও বিশ্বাস করলাম। কিন্তু ফাইনাল চেক করার জন্য একটু পর তোমাকে হসপিটালে নিয়ে যাব, আলট্রাসাউন্ড করলে নিশ্চিত হওয়া যাবে।”

সোহানা আজ সকালে আর শাড়ি পরেনি, নিজের আটপৌরে সুতির সালোয়ার কামিজই পরে নিয়েছে। পনিটেইন করে চুল বাঁধা, হাতে বেল্টের ঘড়ি, কানে ছোট একজোড়া মুক্তোর দুল, আর কোন গয়না নেই, প্রসাধনী বলতে গালে বুলানো হালকা পাউডারের ছোঁয়া, এই বেশে এখন সোহানাকে নতুন বৌ কম, ভার্সিটির ছাত্রীই বেশি মনে হচ্ছে। সকাল সকাল সোহানাকে এমন বেশে দেখে সবাই ভেতরে ভেতরে একটু অবাক হলেও, মাথায় এখন অন্য চিন্তা, তাই এটা নিয়ে আর মাথা ঘামালেন না।

“আন্টি আমি যে কোথাও যাব না। তবে আপনি কী এবার বাড়াবাড়ি করছেন না? আপনারা সবাই বাড়াবাড়ি করছেন। অবশ্য শুধু আপনাদের দোষ না, এরজন্য দ্বায়ী আসলে আমার নিজের পরিবার। আমার জীবনটা একটা ছেলেখেলা বানিয়েছেন সবাই মিলে। আমি প্রেগন্যান্ট হলে কী ফাইনাল কথাবার্তা বলতেন, সেটা এখন শুনি? কাবিনের টাকা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন?”

শান্তশিষ্ট, চুপচাপ সোহানা একদম বিপরীত রূপেই যেন হাজির আজ সকালে। একটু থতমত খেলেও জেসমিন সুলতানা নিজেকে সামলে নেন।

“এত টাকা টাকা করো কেন তোমরা? প্রতারণার প্রমাণ পেলে এক পয়সাও দেব না, মামলা করবো তোমার পরিবারের নামে।”

“আন্টি এটা খুব ভালো হয়। মামলা করেন, আমার পরিবারের একটা শিক্ষা হওয়ার দরকার আছে। এই যে আমি তাদের মেয়ে, তাদের সম্পত্তি তো না, যে যেভাবে মন চাইবে, যার গলায় ঝুলাতে মন চাইবে ঝুলিয়ে দিবে, এই বোধটুকু তাদের নেই। হ্যাঁ অস্বীকার করবো না, আমি ভিন্নধর্মাবলম্বী ছেলের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছিলাম, কিন্তু বিবাহবহির্ভূত শারীরিক কোন কিছু ছিল না। সমাজ, পরিবার আর ধর্মের বিরুদ্ধে যাওয়ায় সেই প্রেমের সম্পর্ক থেকেও আমি বের হয়ে এসেছি। কিন্তু এই ছোট একটা অপরাধের এত বড় শাস্তি কী আমার প্রাপ্য ছিল? তারা কেন তাদের মেয়ের উপর ভরসা রাখতে পারেনি, বরং ধরে বেঁধে একটা কাপুরুষের গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে ভাবলো আমার একটা গতি করেছে!”

সরাসরি সবার সামনে কাপুরুষ বলায় রাকিবের বেশ মানে লাগে। এতদিন চুপ থাকলেও, আজ যেন তার গায়ে তেলের ছিটা পড়েছে। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। রাকিবের পরিবারও সোহানার কথায় হতভম্ব।

“এই তুমি কাকে কাপুরুষ বলো? বেয়াদব মেয়ে। তোমাদের সাত জনমের ভাগ্য আমার সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে। এভাবে ট্র্যাপে ফেলে বিয়ে না দিলে তোমার মতো মেয়েকে আমি কোনদিন বিয়ে করতাম না।”

রাকিবের উত্তেজিত কথাগুলো শুনে হাসি পায় সোহানার, ঠান্ডা ভাবে হাসি মুখেই উত্তর গোছায়,

“প্রেম করেছি, এতটুকু ছাড়া যোগ্যতায় কোন দিক দিয়ে আমার মতো মেয়ে যায় না??? আপনার একটা ভালো চাকরি ছাড়া একটা ভালো মেয়ে পাওয়ার কী যোগ্যতা আছে? আজ কাপুরষ বলায় খুব গলাবাজি করলেন, অথচ আপনার যে একটা ভয়েস আছে সেটা বিয়ের দিন থেকে এই দেড় মাসে একদিনও বুঝতে পারিনি। কখনো মামার আড়ালে, কখনো মায়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পুরুষ হয়েই সামনে এসেছেন। আপনার সাথে তো আমার বিয়েটা স্বাভাবিক ছিল না তাই না? তাহলে অস্বীকার করলেন না কেন বিয়েটা? সুযোগ পাওয়া মাত্র স্বামীত্ব ফলিয়েছেন, অথচ মায়ের আঁচলের নিচে আসতেই বৌয়ের সাথে কাটানো রাত বেমালুম অস্বীকার করলেন। কাল যখন আলাদা রুমে শুয়েছি, তখন কেন বললেন না বৌ আমার, আমার সাথেই থাকবে! তা না করে সবাই ঘুমালে রাতের আঁধারে রুমে ঢোকার চেষ্টা করেছেন, আবার অফারও দিয়েছেন, বাচ্চা এবোরেশন করে নতুন শুরু করবেন। নিজের সন্তানকে স্বীকার করার সাহস যার নেই, সে কাপুরষ নয়তো কী?”

রাকিব রাতে লুকিয়ে সোহানার রুমে গিয়েছে শুনে রাকিবের আব্বা আম্মা খুব রেগে যান। নিজেদের ছেলের এই ছ্যাছড়ামি জেসমিন সুলতানার অসহ্য লাগে।

“আম্মু তুমি ওর কথা বিশ্বাস করো না। মিথ্যা বলছে।”

রাকিবের মুখে মিথ্যে কথায় অবাক হয় না সোহানা। জানতো এমনই হবে।

“ভাবি সত্যিই বলছে। তুমি রাতে উঠে গিয়েছিলে, ভাবিই দরজা খুলেনি।”

বসার ঘরে এসে দাঁড়ায় সাকিব। অযথা সবাই মিলে একটা মেয়েকে হেনস্তা করা আর ভালো লাগছে না সাকিবের।

“আম্মু আমরা সবাই কী এখন অতিরিক্ত করতেছি না। ভাবির ফ্যামিলি অপরাধ করছে, কিন্তু এই বিয়ে ভাবিরও জোর করেই দেওয়া হয়েছে। অথচ সবাই মিলে শুধু ভাবিকেই কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। আর ভাইয়া কাল সত্যি গিয়েছিল, আমি সব শুনেছি দেখেছি। ভাইয়া ভাবছে আমি ঘুমাচ্ছি, তাই চুপিচুপি উঠে গিয়েছিল।”

২.
সাকিবের কথার পর আর কোন কথা থাকে না। সোহানা চোখের ভাষায় সাকিবকে কৃতজ্ঞতা জানায়।

“আন্টি এবার আমার নিজের সিদ্ধান্ত জানানোর পালা। আমি বলেছিলাম আমার সিদ্ধান্ত সকালে আমি নিজে জানাব।”

“তোমার আবার কী সিদ্ধান্ত?”

“আমি যাচ্ছি। বাড়িতে না, আমার ভার্সিটিতে ফিরে যাচ্ছি, সামনে ফাইনাল এক্সাম। দোয়া করবেন। বিয়ে নামক এই ছেলেখেলায় আমাদের সবারই অনেক ক্ষতি হয়েছে, তবে সবচেয়ে বেশি হয়েছে আমার নিজের। তবে এই শেষ, আমার সাথে কোন অন্যায় আমি আর হতে দেব না। এই প্রেমের সম্পর্কে আমার সাথে একটা ছেলেও ছিল, তার সামাজিক ভাবে কোন ক্ষতিই হয়নি, সে বিদেশে সেটেল্ড এখন। আর একই কাজে আমার অবস্থা দেখেন, নিজের পরিবারই অচ্ছ্যুত করে দিলো। আপনারা চিন্তা করবেন না, একটাকাও নেব না আমি, নিজের আত্মসম্মান বিক্রি করতে বিয়ে বসিনি। ডিভোর্সের শর্তে আমি নিজেই কাবিনের টাকা মাফ করে দেব। এই ছেলেখেলা আমি এবার শেষ করবো।”

“যা বলছো ভেবে বলছো মেয়ে? একবার এখান থেকে চলে গেলে আর ফিরিয়ে আনব না। তোমার পরিবারকে জানিয়ে তারওর বের হও।”

কাঁধের ছোট ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সোহানা।

“আন্টি আমার মা কে সকালেই জানিয়েছি, তারপর আপনাদের সামনে আসলাম। সমস্যা হলো এই বিয়ের ছেলেখেলাটাই সবার কাছে আসল, আমি বা আমার মন কারো কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। ওনারাও একই জবাব দিয়েছেন, একবার এই বাড়ি থেকে, সংসার থেকে বেরিয়ে গেলে আর ফিরে আসার কথা ভাবতে না। দোয়া করবেন যেন কোনদিন ভাবা না লাগে। আপনাদের দেয়া সব গয়না আর শাড়ি রুমেই রেখে এসেছি, আসি এখন।”

৩.
রাকিব এই নিয়ে তিনবার এসেছে ভার্সিটিতে। কিন্তু সোহানা নিজের সিদ্ধান্তেই অটল আছে।

হলে ফিরে আসার পর বন্ধুরা নতুন করে শুরু করাতে অনেক সাহায্য করেছে। বাবা মা ও এখন নিয়মিত যোগাযোগ করছেন। মনে মনে পাহাড় সমান অভিমান থাকলেও মা বাবাকে ফেরাতে পারে না সোহানা। তবে এবার আর ইমোশনাল হয়ে বাড়ি ফিরে যায়নি, আর কোন ছেলেখেলার অংশ হতে চায় না সোহানা। হাত খরচ চালাতে একটা কোচিং এ ক্লাস নিচ্ছে, টিউশনিও করে দুটো। যদিও নিজের পড়ার চাপও কম না, কিন্তু লড়াইটা যে সহজ নয়। নিজের জন্য আর অনাগত সন্তানের জন্য থামলে চলবে না। সন্তানের জীবনটা যে সে কারো হাতের পুতুল বানাতে চায় না।

“সোহানা তুমি মিথ্যা কেন বলেছিলে? দেখ বাচ্চা তোমার একার না, আমারও। তুমি এভাবে একতরফা আলাদা হতে পার না।”

“আমি মিথ্যা কিছু বলিনি। এই বাচ্চা আপনারা স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন না, তাই ওর আগমনের কথাও জানানোর প্রয়োজন বোধ করিনি। তাছাড়া জানলেও কী হতো? আপনি তো বাবা হতে রাজি ছিলেন না। স্পার্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না।”

“যা হয়েছে তারজন্য বারবার ক্ষমা চাইছি, এবার চলো নতুন করে শুরু করি। আম্মুও রাজি হয়েছে এখন।”

“আম্মু রাজি না হলে আসতেন না?”

হেসে দেয় সোহানা।

“বাদ দিন, স্পার্ম যেহেতু আছে আবার বাবা হতে পারবেন ব্যাপার না। এই বাচ্চা শুধুই আমার। প্রেগন্যান্সির সময় তালাক হয় না, তাই তালাক ঝুলে আছে। বেবি হয়ে গেলেই আপনি মুক্ত হয়ে যাবেন, আসি কেমন।”

রাকিব আহত চোখে তাকিয়ে থাকে, জানে অপরাধটা অনেক বড়, তাই ক্ষমাটাও এত সহজ নয়। অপেক্ষায় আছে বেবিটা দুনিয়ায় আসার আগে হয়তো সোহানা ক্ষমা করে দিবে, নয়তো বেবির জন্মের সাথেই আলাদা হতে হবে তাদের। জানে না ক্ষমা পাবে কি না, সোহানার চোখের দৃঢ়তায় বড় ভয় হয় রাকিবের, সব হারানোর ভয়।

(শেষ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here