#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#পর্ব_৫
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা
ছোট্ট বিড়ালছানার মতো বোনটিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ভারী গলায় হেসে দু পাক ঘুরিয়ে নিল মেজর।
আদরের বোনটিকে দীর্ঘ আট আটটা মাস পর দেখলেন উনি। সেই কোর্স শুরুর দুইমাস আগে এসেছিলেন তিনি শেখাওয়াত বাড়িতে। বোনকে তার ভালোবাসার ভালোরাখার মানুষটার হাতে তুলে দিয়ে সেই গিয়েছিল আটমাস আগে। আর ফিরলেন এইমাত্র। আর বাড়িতে প্রবেশ করার আগেই বোনের হামলে পড়া।
খানসা বেগম রান্নাঘর থেকে ফের এসে দেখলেন মিনা এখনো তানজীবকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। কেঁদেই যাচ্ছে।
তিনি তাড়া দিয়ে বললেন।
— ও মিনা আরেহ ছাড়। ছেলেটা কতদূর থেকে এসেছে। এমা তুই কি আর ছোটটি আছিস? সেই কখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছিস। ছাড়। ছাড়।
তানজীব কড়াপড়া হাতটা আলতোভাবে বোনের মাথায় বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
— কতদিনের কান্না জমানো হয়েছে? এত কান্না কই থেকে আসে? রাহান এই কান্নার ব্যামো সাড়ার ঔষধ দিতে বলেছিলাম তোকে।
সাথে সাথে উপস্থিত বাড়ির সবাই হেসে উঠলো।
পেছনে হাত রেখে দাঁড়ানো রাহান ফোকলা হেসে বিড়ালের মতো ভাইয়ের বুকে গুঁজে থাকা মিনাকে দেখে বলল,
তোর বোন ঔষধই খেতে চায় না। রোগ সাড়বে কি করে?
আরেকচোট হেসে উঠলো সবাই।
মিনা তখনো ভাইয়ের বুক ঝাপটে ধরে আছে। তার চোখের নোনাজলে ভিজে উঠেছে জ্যাকেটের নিচে পড়া চকলেট রঙা টি শার্টটি।
যার ফেরার অপেক্ষায় মিনা দিনাতিপাত করে। মোনাজাতে অশ্রু জড়ায় ভাইটাকে ভালো রাখার জন্য। তাকে সামনে পেয়ে মিনা কথার বলার ভারসাম্যটুকু হারিয়ে ফেলেছে। এই আটটা মাস তার কাছে সহস্রশত বছর। এমন কখনো হয়নি।
যান্ত্রিক ফোনটির ওপাশে কতক্ষণই বা কথা বলতে পারে সে ভাইটার সাথে? সেই সপ্তাহখানেক যেতে না যেতেই ফোনটা আসলে ও যে শুনতে হতো গত ৭২ ঘন্টা ঘুমোয়নি বনু। এখন একটু ঘুমোয়? তোকে পরে ফোন দেব।
সেই পরের ফোনটা আসে আর ও তিন চার দিন পর ঠিক একই সুরে, একই ক্লান্তিজড়ানো গলায়।
মিনার বুক ছিঁড়ে ক্ষণে ক্ষণে কত দীর্ঘশ্বাস যে বের হয় তার খবর কি ভাই রাখে? অল্প বয়সে মা বাবাকে হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া দুইভাইবোন যেন একে অপরের পৃথিবী।
বোনটা ভাইয়ের চোখের মণি। যার টানে, যার মায়ায় এতএত দায়িত্ব কর্তব্যের ভীড়ে আর্মি অফিসার ও গুণতে থাকে কবে আসবে ঘরে ফেরার দিন।
—হয়েছে হয়েছে মিনা ছাড় এবার ছেলেটাকে। একটু জিরোতে তো দে। আর কত কাঁদবি? তানজীব এবার ওকে ছাড় বাবা। কিছু মুখে দে।
খানসা বেগমের কথায় একটু ও নড়লো না মিনা।
ভাইয়ের স্নেহের বাহুডোরে পড়ে রইলো বরঞ্চ। ডুকরে ডুকরে কেঁদে ভাসালো ইচ্ছেমত। আটমাস পর ভাইয়ের দেখা। আটটা মাস পর ভাইয়ের ছোঁয়া আর ভাইয়ের স্নেহ মমতার চাদরে মুড়িয়েছে সে। কেন সবাই এমন করছে? ভাইয়ের গায়ে সে বাবা মায়ের সুবাস পায় যে।
বোনের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মেজর স্নেহের পরশ লাগালো স্নিগ্ধ ললাটে, মাথায় ।
বিয়ে হলে নাকি মেয়েরা হুট করে বড় হয়ে যায়। কই বোনটা তো ছোটই রয়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে নাকের পানি আর চোখের পানিতে ভাসায়।
শরীরের, গালে, গলদেশের ছোট বড় গভীর ক্ষতচিহ্নগুলো দেখে দেখে আরও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো মিনা। বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো। নিশ্চয়ই ভীষণ কষ্ট হয়েছিল তখন। সেবা করেনি কেউ ভালোবেসে, যত্ন করে? ভাবতেই বুকটা ভার হয়ে আসে মিনার।
এগুলো ওগুলো কি করে হয়েছে? কিসে আঘাত পেয়েছ? কখন পেয়েছ?কিভাবে পেয়েছ? অবরুদ্ধ ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় এমন অনেক প্রশ্নে অস্থির করে তুললো সে ভাইকে।
ভাই ভীষণ নির্বিকার চিত্তে জবাব দিল,
–এসব হবে আর যাবে। এসব নিয়ে কোনো প্রশ্ন শুনতে চাই না। কেমন আছে আমার বোনটা?
ভাইয়ের আদুরে প্রশ্নে চোখগলে আবার ও বৃষ্টি ঝড়তে লাগলো বোনের। রুদ্ধ কন্ঠে আবার ও কেঁদে ভাসিয়ে বলে উঠল,
আমি তোমাকে ওখানে রেখে কি করে ভালো থাকি?
সানজু ছুটে এল।
তানজীব হাত বাড়িয়ে দিল। আয় আয়।
মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
কি আশ্চর্য! পিচ্চিটা ও বড় হয়ে যাচ্ছে।
সানজু লজ্জা পেয়ে গুঁটিয়ে তানজীবের শক্ত বাহুর নিচে পড়ে রইলো । বলল
না আমি পিচ্চি নেই। এইটিন। হুহ।
দুবোনকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল তানজীব। সানজুর মাথা চাপড়ে দিয়ে বলল
যাহ দোয়া করে দিলাম। মিনির মতো তোর ও একটা বর জুটে যাক
সানজু ভীষণ রকম লজ্জা পেল। সবার মাঝে আবার ও হাসির ফোয়ারা বয়ে গেল একটা।
মিনা নাক টেনে কান্নাহাসিতে মিলে একাকার হয়ে ভাবলো তার তো আজ খুশির দিন। সে কাঁদছে কেন?
___________________
মেইন রোড পার হয়ে জয়পুরে ঢুকার সম্মুখেই প্রকান্ড একটি ফুলের উদ্যান। হরেক রকমের ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে উদ্যানটি। ম ম গন্ধে পাশের রাস্তাটি সুরভিত সরব থাকে সদা সর্বদা। তারপরেই হাইস্কুল,প্রাইমারি স্কুল, কিন্ডারগার্টেন। উত্তরেই গ্রামের বড় মসজিদটি । তার পাশেই বিশাল বড় খেলার মাঠ। মাঠের আনাচে কানাচে বসেছে ঝালমুড়িওয়ালা, ফুচকাওয়ালা, আইসক্রিম ওয়ালা। স্কুল ড্রেস পড়া কয়েকটা কিশোর কিশোরী। তরুণ তরুণী। কয়েকশত ছেলেপেলে মাঠে।
এক কাঁধে ব্যাগ হাতে কিছু সাদা খাতার বান্ডেল হাতে দাঁড়ানো শিক্ষিকা ও স্টুডেন্টদের অভিভাবকরা অনেকক্ষণ ধরে পরখ করছে আইসক্রিমওয়ালার কাছে থেকে আইসক্রিম কিনে ছোট ছোট বাচ্চাদের হাত ধরিয়ে দেওয়া সদ্য জয়ন করা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের যুবতী শিক্ষিকাকে। কালো সোনালী বাহারি ডিজাইনের সেলোয়ার-কামিজ পড়া যুবতীর ওড়নায় ঢাকা মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে গেছে লম্বা মজবুত একটি চুলের গোছা। ক্রিমরঙা একটি ব্যান্ডের বাঁধা বেণী। কালো কুচকুচে অঙ্গরূহ দেখতে ঢেপসা ভুজগের মতো চকচক করছে অরুণ আঁচড়ে। হলুদ রঙা লাবণ্যময় চেহারার যুবতীর টিকলো নাসিকার ডগায় চিকচিকে নিদাঘ।
তারপর হৈহল্লা করে বাচ্চাগুলো কাঁধে ব্যাগ চেপে ছুটে এল মায়েদের কাছে। রাহা ও তাদের পেছন পেছন এসে শান্তসুলভ ভঙ্গিতে মিষ্টি করে হাসলো।
নীল শাড়ি পরিহিতা কুন্তলা ম্যাডাম বললেন,
এসব কি দরকার ছিল রাহা?
রাহা বিনয়ী হাসলো শঙ্কিত হয়ে।
ওদের সাথে আমি প্রমিজ করেছি ম্যাম। যদি ওরা ঠিকঠাক এক্সামে ভালো করে তাহলে সবাইকে আইসক্রিম খাওয়াবো। আমি এসব এনজয় করি। প্লিজ ম্যাম রাগ করবেন না।
শিক্ষিকা মাথা নাড়াতে নাড়াতে ভেতরে চলে গেল। অতিথি শিক্ষক হিসেবে রাহা জয়ন করেছে মাসখানেকের কাছাকাছি হচ্ছে। হাতে এখনো বেতন উঠেনি। সে খুশি এ কাজে। কয়েকঘন্টায় তো পড়ায় মাত্র । যদিও চেয়ারম্যান সাহেবের এ নিয়ে ঘোরতর আপত্তি। উনার মেয়ে কেন এত অল্প বেতনের চাকরি করবে? কিন্তু মেয়ে নিজের মর্জিমতো চলে। শুধু এটুকুই পরিষ্কার করেছে সবার কাছে সে ভুল করলে সে জায়গায় গিয়ে শাসন করতে। অন্য কোথাও সে কারো হস্তক্ষেপ চায় না। তার পছন্দ না।
স্কুল গেইট পার করলো সে। বাড়িটা বেশিদূর না। আট মিনিটের পথ। হেঁটেই চলে যায় রাহা। মাঝেমধ্যে চড়ে বসে পরিচিত কারো ভ্যানগাড়িতে কিংবা রিকশায়। চেয়ারম্যান কন্যা হওয়ায় বেশ ভালোই সম্মান আর কদর করে গ্রামের মানুষ।
স্কুল থেকে ফেরার পথটা ভীষণ সুন্দর। রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছবাগান। গাছগাছালির পরেই অনাবিল খোলা ধানক্ষেত। ধানক্ষেতের কাজ করা চাষী। নতুন কালো কাঁকুড়ে পিচঢালা রাস্তার উপর দিয়ে শাঁ শাঁ করে চলে যাওয়া কয়েকটা রিকশা, ভ্যানগাড়ি। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর হেঁটে এল রাহা। মিলি আর মেঘনা সাথে থাকে কলেজ থেকে ফেরার সময়। ওরা তার দুই বান্ধবী। কিন্তু স্কুলে পড়াতে গেলে সেদিন সে একা।
হঠাৎ,…….
শাঁ করে ধেয়ে এল একটি কালো রঙের পুলিশের গাড়ি। গোঁফ পাকা একজন বয়স্ক লোক গাড়ি থামালো রাহার সামনে এসে। গাড়ি থেকে নামলেন তিনি পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে। গৌরবে।
রাহা ভ্রুকুটি করে চাইলো।
আসসালাম আলাইকুম।
ওয়ালাইকুমুস সালাম। কনস্টেবল আলীউল্লাহ বলছি। আপনার জন্য একটি চিঠি এসেছে। সেটা দিতেই যাচ্ছিলাম স্কুলের উদ্দেশ্য। যাক পথিমধ্যে দেখা হয়ে ভালোই হলো।
সাদা একটি কাগজ বাড়িয়ে দিলেন তিনি রাহার দিকে।
এটা আপনার চিঠি। এই চিঠির উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে যত্নে রাখতে বলেছেন চিঠি প্রেরক। প্রেরকের নাম ও দেওয়া নেই। বুঝে নিতে বলেছে।
রাহার মনে আতঙ্কের ঘনঘটা বেজে উঠেছে। বুকটা কাঁপছে অতর্কিত কোনোকিছুর আশঙ্কায়। কে পাঠাবে তাকে চিঠি? কার তাকে এত বিশেষ প্রয়োজন?
______________________
ঢিলেঢালা কালো পাতলা টি শার্টের বুকের কাছে হলুদ রঙা মাসলের হাতের আইকনের ছাপ বসানো টি শার্টটা গায়ে দিয়ে ভেজা মাথা ভর্তি চুল নিয়ে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল তানজীব। মিনি ছুটে আসলো।
ভাইয়া সকাল সকাল ঘুম উঠে গেলে কেন? আরেকটু ঘুমাও।
কড়াপড়া হাতটা দিয়ে বোনের মাথা মোচড় দিল তানজীব। নাক টেনে দিয়ে বলল
আজ অনেক দেরীতে উঠেছি। এতবেলা করে কখন ঘুম থেকে উঠেছি মনে নেই। তুই থাক। দৌড়ে চলে আসব। তোর ডাক্তারকে তুলে দে। অধীরের সাথে বেরোতে হবে।
বলেই একমুহূর্ত ও না দাঁড়িয়ে বিশেষ ভঙ্গিতে দৌড়ে বাড়ির বাইরে চলে গেল সে।
মিনা গলা আওয়াজ লম্বা করে বলল
কোথায় যাচ্ছ তুমি?
উত্তর না আসায় মিনা তার ঘরের দিকে পা বাড়ালো। ঘরে পা রেখে ঘরের সব জানালা খুলে দিল সে। সাথে সাথে তেজোদৃপ্ত অংশুমালীর খন্ডখন্ড টুকরো ঢুকে পড়ায় আলোয় ঝলমলে করলো উঠলো মিনার ঘরটা। চোখ গেল উদোম গায়ে উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে থাকা সৌম্যদর্শন পুরুষের দিকে। মিনা পা টিপে টিপে গেল । পিঠে আলতো হাত রেখে ডাকলো
উঠুন। আর নাইট ডিউটি নিলে খবর আছে। নিজে তো ডিউটি করে, সাথে আমাকে ও ডিউটি দিয়ে যায়। এই উঠুন।
বলতে না বলতেই পিঠে চিমটি বসিয়ে দিল মিনা।
উহ শব্দ করে উঠলো রাহান। নড়েচড়ে ফিরলো। চোখ কচলাতে কচলাতে কি ঘটলো সেটা বুঝে নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় নিয়ে বলল,
মিনি এদিকে আয়।
মিনা ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে এল।
কি? মাথা খারাপ?
বালিশ ছাড়লো রাহান। হাত পা ঝাঁড়া দিয়ে উঠে বললো
কি সমস্যা? তোর সব আঙুল আমি কেটে নেব। এমনিতে আঁচড়ে আঁচড়ে তো শেষ করে দিয়েছিস আমাকে। আবার চিমটি মারিস। তোর এত অত্যাচার সইতো কে? ভাগ্যিস ভালো জামাই পেয়েছিস।
মিনি কাছে তেড়ে এসে ঠোঁটের উপর হাত চেপে বলল
চোপ চোপ। আস্তে আস্তে। কেউ শুনে ফেলবে। আপনার গলাটা মাইকের মতো। উফফ।
সুযোগ বুঝে কোমর ধরে ধপাস করে মিনিকে নিয়ে আবার বিছানায় ঢেবে গেল রাহান। মিনির মুখের গরম নিঃশ্বাস ফেলে দুহাতে মুখের চুল সরিয়ে দিতে দিতে কুটিল হেসে বলল
এবার কোথায় যাবি?
মরে যাব।
কিহ?
মিনা সর্পিণীর মতো নড়তেচড়তে বলল
লজ্জায় মরে যাব কেউ এসে পড়লে।
রাহান গলার আওয়াজ করে হাসলো। মিনা ভাবলো লোকটার মাথা গেল নাকি?
মিনার ডান গালে নিজের ওষ্ঠপুট চেপে ধরে সময় নিয়ে ছাড়লো রাহান।
উঠে পড়লো তারপরেই। হাসতে হাসতে বড় গলায় আওয়াজ করে ডাকলো
সানজু দেখে যাহ।
মিনা পালায় পালায় করতে করতে উঠে বসলো। বলল
যাহ আমি আপনার সাথে আর কথায় বলব না।
রাহান হাসতে হাসতে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। মিনির সাথে এসব না করলে তার দিনটা ঠিক জমে না।
_____________
ঢাকা থেকে খবরটা আসার সাথে সাথেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে আশরাফ, আমজাদ কবির আর নোরার বড় জেঠু আজমল কবির।
এতদিন তারা চুপ! হঠাৎ করে বিয়ের দিন তারিখ ফেলে দিল। তাও দু’দিনের মাথায়। ভাইবন্ধু এবং কোনো পরিচিত অপরিচিত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিবর্গ বাদ গেল কিনা তা নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন আমজাদ সাহেব।
এক থেকে দুই কিছু এলোমেলো হলে মান সম্মান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
শহরের নামীদামী একটি ক্লাবে বিয়ের দিনটার বন্দোবস্ত হলো অতঃপর উচ্চমূল্যে।
এদিকে রায়হানি নিবাসেও একই দশা।
একদিনের মধ্যেই বিয়ের যোগাড়যন্ত্র শুরু হলো পুরোদমে। আলোচনা সাপেক্ষে ঠিক করা হলো নিয়মানুযায়ী বৃহস্পতিবার রাত্রে গায়ে হলুদ এবং শুক্রবার জুমার নামাজের পরই হবে আক্দ।
ঘরে সারে সারে নব্য ক্রয়কৃত জিনিসপত্রের রাশি জমল। ঘনিষ্ঠ যত আত্মীয় আছে সব আত্মীয়দের নিমন্ত্রণ জানানো হলো।
কেন এতদিন চুপ থাকা আর কেন হঠাৎ করে বিয়ের দিন তারিখ ফেলা তা নিয়ে একচোট আলোচনা হয়েছে। বারবারই একটা নাম উঠে এসেছে মেজর তাহমিদ। অধীরের প্রাণপ্রিয় বন্ধুর মধ্যে একজন। জীবনের এত বড় একটা উপলক্ষে বন্ধুরা থাকবে না এমনটা হয় না।
ডাক আসলেই ফিরতে হবে সীমান্তের পাড়ে। সে কয়দিন থাকছে কিংবা থাকবে তা নিয়ে মাথা ঘামালো না অধীর। এতদিন সবাই তার বলার অপেক্ষায় ছিল। এখন সে-সময়টা এসেছে তাই বলে দিয়েছে। তবে তার এমন খেয়ালিপনা দুপক্ষের মানুষকেই খুব হুলস্থুল অবস্থায় ফেলে দিয়েছে তা তার জানার বাইরে নয়।
কমবেশি একথা ওকথা কানে এসেছিল তানজীবের। অধীরের একরোখা স্বভাবের ব্যাপারে সে বরাবরই জ্ঞাত। অবাক হওয়ার কিছু নেই। বলার ও কিছু নেই। ডাক আসলে ফিরতে হবে এটা নিটোল ও ধ্রুব সত্য।
_________________
কাঁচা হলুদরঙা শাড়ি পরিহিত বধূটির সাথে তাল মিলিয়ে রাহা ও শাড়ি পড়েছে। খুবই সুশীল ভাবে সেজেছে। সাথে অন্তরা ও। বাড়িতে মেহমানের আনাগোনা। এত বড় একটা বাড়িতে ও কুলচ্ছে না আত্নীয় স্বজন। বাড়ির উঠোনের মজলিশ খানায় যেহেতু চেয়ারম্যান সাহেবের বন্ধু, নেতাজনতার আসর বসবে সেহেতু ছাদেই স্টেজ বানানো হয়েছে। পুরো বাড়িটা আলোয় ঝলমল করছে। গেইট পেরিয়ে রাস্তার মোড় পর্যন্ত আলোক বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। গ্রামের মানুষ পাড়ার মানুষ দলে দলে ছুটে এসেছে চেয়ারম্যানের বড় কন্যার বিয়েতে। এত এত আয়োজন আর এলাহি কান্ড তারা অনেকদিন পর দেখছে। খাওয়া দাওয়া চলছে বাড়ির উঠোনেই। মেহমানের এখনো আসা থামেনি।
ঝি’দের পেছনে ছুটতে ছুটতে রাহা সকাল থেকেই ক্লান্ত। নোরাকে সাজাতে আসা মেয়েগুলোর হাতে নিজে ও সেজে নিয়েছে এক সুযোগে। চুল আর শাড়ির নিজ দায়িত্বে পড়েছে। সবাই তাকে নোরার পাশে বসিয়ে মজা নিচ্ছিল এই বলে যে, বর কনফিউজড হয়ে যাবে কোনটা তার বউ?
রাহা একটু শান্তির জন্য বান্ধবী মিলা আর মেঘনাকে নিয়ে বাড়ির পেছনে চেয়ারে নিয়ে বসে গল্পগুঁজবে মত্ত হয়ে পড়েছিল । একটু পরপর আশরাফ আর বাবার ডাকে তাকে চাবির তোড়া নিয়ে আবারও ছুটতে হচ্ছে। খাতায় উপহার সামগ্রী নিয়ে আসা আত্মীয় নাম নোট করতে হচ্ছে। কি এক ঝামেলা! কেউ একটু শান্তিতে ঘুরতে দেবে না তাকে।
রায়হানি নিবাসে ও আয়োজন কোনোদিকে কম নয়। নেহাৎ বেশিই বলা যায়। বাড়ির ছোট ছেলে অর্থাৎ শেষ বিয়ে। তার উপর সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ। পুলিশে,উকিলে,ছাত্র,সাধারণ জনতা আজ তাদের বেশিরভাগ মেহমান। হলুদ ছোঁয়ানো পর্ব শুরু হতেই তার দূর সম্পর্কের কোনো এক আত্মীয় এসে গালে চওড়া করে হলুদ লাগিয়ে দিলেন। অধীর গাল থেকে হলুদ মুছে নিয়ে পাশে সুস্থির বসা তানজীবের গালে মেখে দিল। তানজীব হকচকিয়ে গেল।
আরেহ কি করছিস?
বিয়ে তো করবি না। তাই বউয়ের ছোঁয়া না লাগুক একটু হলুদের ছোঁয়া অন্তত লাগুক।
তানজীব গাল মুছতে মুছতে বলল
এটা একদম ঠিক হয়নি অধীর। তুই,,,
অধীর তার কথায় হো হো করে হাসলো। রাহানকে বলল
তোর শালাবাবুর শুধু বিয়েতে নয় হলুদে ও এলার্জি আছে ডাক্তার।
রাহান হেসে বাম চোখ টিপে বলল
আর্মি মানেই হেব্বি রোমান্টিক। এদের রসকষহীন ভাবা আমাদের সাধারণ জনতার জাতিগত ভুল দোস্ত। এটা করা মোটেও প্রমোদক নয়। কি ঠিক বললাম তো মেজর?
ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে বন্ধুর দিকে চোখ তুললো তানজীব। তার হাসি পাচ্ছে কিন্তু অভ্যাস নেই বিধায় হাসতে পারছে না। ইচ্ছে করছে দুটোকে। দাঁতে দাঁত চেপে নিচের ঠোঁট কামড়ে সে নির্লিপ্ত গলায় বললো,
ফুটবলের মতো দুজনকে দুটো দেব। দেন ফিনিশ।
অধীর আর রাহান একসাথে হো হো করে হেসে উঠলো। একে অপরের গায়ে ঢলে পড়লো। গলায় ছদ্ম হতাশা, হাপিত্যেশ মিশিয়ে বলল
না না আমাদের ফুটবল বানাস না ভাই। তোর পায়ে পড়ি। তোর ওই শক্ত পায়ের লাতি খেলে মরেই যাব। আমাদের বৌগুলো কই যাবে তখন। তুই দেশ সেবা করছিস কর। আমরা বরং বউ সেবা করি। কথা বুঝা গেল?
বলেই দুজন আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। তানজীব চুপচাপ তাদের হাসিতে মজে চুপ করে রইলো। পাহাড়ের সেই গোপনে কক্ষে অথবা মিটমিট করে জ্বলতে থাকা আবছা আলোর মিলিটারি টেন্টে একলা একা মেজরের ঠিক এই মুহূর্তগুলো ভীষণ মনে পড়ে। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে। হৃদয় প্রফুল্ল হয়। ক্লান্তি মুছে। যোদ্ধার এর চাইতে বেশিকিছুর প্রয়োজন নেই।
————-
হলুদ লাগানো পর্ব শেষে কেক কাটতে কাটতে পাশের কেউ একজন টিপ্পনী কাটলো অধীরকে।
আরেহ অধীর বউকে ছবিটবি পাঠাতে বলো । আমরা দেখব না?
সে স্টেজ ছেড়ে দিল। মিনা আর রোহিনী হৈহৈ করে উঠলো।
আরেহ অধীর ভাই কই যাও? মেহেদী পড়বে না?
আরেহ বোস। তোরা এত অধৈর্য কেন? তোদের ভাবি মশাইকে একটা ফোন দেই। বিয়ের দখলে আমাকে ও ভুলে গেছে নাকি? স্বার্থপর সব দুনিয়ার মানুষজন।
বলতে বলতে সূদুর ঢাকা থেকে যান্ত্রিক ফোনটির ক্রিং ক্রিং রিং পড়লো সেই জয়পুর গ্রামের তিনতলা ঝমঝমাট বিয়ে বাড়িটির নির্জন ঘরের এককোণায়। আলমিরায় চাবি ঘুরানো মেয়েটি থমকালো ফোনকলের আওয়াজে। ছুটে গিয়ে ফোনটা তুলতেই দেখলো জিজুর ফোন।
ভাইকন্যা নাইরাও তার পেছন পেছন চলে এসেছে। মেয়েটা একদম তার পিছু ছাড়তে চায় না। পাজি মেয়ে।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো রাহা । নাইরাকে নিয়ে ছাদ অব্দি যেতে যেতে তো ফোনটা কেটে যাবে। আপা এখন কেক কাটছে। কি করবে সে? ভাবা শেষ হতে না হতেই বাটন চেপে ফোনটা রিসিভ করে কানে দিল সে।
অধীর বাড়ির বাইরে বের হয়েছে ততক্ষণে।
আসসালামু আলাইকুম, আমি রাহা বলছি জিজু।
অধীর হাসলো একগাল। জবাব দেওয়ার আগেই
লনের এককোণায় থেকে ফোনকল শেষ করে এগিয়ে আসা ছাইরঙা পাঞ্জাবিতে সুশোভিত যুবককে ইশারায় ডাকলো। ফোন মিউট করে বলল
নে তোর সাথে কথা বলতে চাইছে। বলছে মেজরকে দরকার। নে কথা বল।
কে?
কথা বল আগে।
বলেই তানজীবের হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল অধীর।
বুদ্ধিদীপ্ত, ধারালো মস্তিষ্কের আর্মি অফিসার কিছু ভেবে উঠার আগেই রিনরিনে কন্ঠে ঝংকার তুলে কেউ একজন ফোনের ওপাশে হেসে উঠলো। কপালের সূক্ষ্ম ভাঁজ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে লাগলো মেজরের।
মেজরকে কি দরকার?
গমগমে রাশভারি গলার আওয়াজ ভেসে আসায় শিরদাঁড়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো রাহা। হাসাহাসি বন্ধ করলো ছোট্ট নাইরার সাথে।
কম্পিত কন্ঠমণিতে এক শিশির নম্রতা ঢেলে খুবই ছোট্ট করে প্রশ্ন করলো
কে আপনি?
কে আপনি?
দুটো প্রশ্ন দুদিক থেকে এসে ধাক্কা খেল একে অপরের সাথে। যার ফলাফল শূন্য। কিছুক্ষণ নীরবতা।
মেজর হঠাৎ ফোনের স্ক্রিনে তাকালো। তাতে লেখা
নেত্রী।
চোয়াল শক্ত হয়ে এল তানজীবের। দাঁতে দাঁত চেপে বসায় কটমট শব্দ হলো। নিজের বউয়ের ফোন তাকে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল?
আজকে হাতের কাছে পেলে নেতাগিরি একদম ঘুচিয়ে দেবে সে।
চলবে