#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#পর্ব_২৩
লেখনীতে #পুষ্পিতা_প্রিমা
তানজীব ঘরে ঢুকার সাথে সাথেই বিছানায় শুয়ে পড়লো। ডান হাতে বালিশের উপর থেকে ফোন টেনে নিতেই রাহা ঘরে ঢুকে পড়লো। তাকে শুঁতে দেখেই হায়হায় করে উঠলো।
বলল,
সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে আর আপনি এখানে শুয়ে আছেন? উঠুন।
তানজীব ফোনে চোখ রাখলো। বলল
ওদের অপেক্ষা করতে বলো। কাজ করছি।
রাহা আলমিরা থেকে শার্ট বের করলো। বলল
ব্যান্ডেজ খোলামাত্রই এটা পড়ে নেবেন। আমি ব্যাগে দিচ্ছি। প্রেসক্রিপশনটা কোথায় রেখেছেন?
তানজীব উত্তর দিল না। কিছু একটা মনোযোগ দিয়ে করছে। রাহা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তার দিকে।
আপনি কি উঠবেন? মেজর!
চোখ তুললো তানজীব। ভুরু উঁচিয়ে বলল
কি হয়েছে?
আশ্চর্য আপনার তাড়া নেই কোনোকিছুতে। উনারা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। কেমন মানুষ আপনি?
রাহা এগিয়ে এল। তানজীবকে টানতে টানতে বলল
উফফ উঠুন না। আমি জিজু আর রাহান ভাইয়াকে ডাকি? ডাকব? আচ্ছা ডাকি।
রাহা দরজার কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তানজীব বেগে আক্রমণ করলো। রাহা ধপাস করে তার পাশে পড়তেই সতর্কতা সহিত সে ডান হাতে ভর দিয়ে ঝুঁকে বলল
কি সমস্যা?
রাহা চোখ গরম করে চাইলো। বলল
একদম ঝুঁকবেন না। সরুন। আমার কোমরে লেগেছে। উঠুন। কেউ যদি চলে আসে আমি আপনার এমন অবস্থা করব না।
তানজীব ভুরু নাচিয়ে বলল
কি করবেন?
রাহা আমতাআমতা করতে করতে বলল
কিছুনা সরুন।
সরব কেন? কথা শেষ করুন।
বলেই পেটের নিপাট ভাঁজে চিমটি কাটলো। রাহা কাতরস্বরে বলল
আল্লাহ গো। আমি এখন চিল্লিয়ে সবাইকে ডাকব।
ওকে।
রাহা চোখ রাঙিয়ে গলা উঁচু করে বলল
কি ওকে?
ডাকুন।
রাহা ফোঁপাতে লাগলো। বলল
আমি আপনাকে ছাড়ব না মেজর।
তানজীব হেসে উঠলো ঘর কাঁপিয়ে। গালে গাঢ় চুম্বন চিহ্ন এঁকে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল
না ছাড়লেই ভালো। গুড।
রাহা গালে হাত দিয়ে মুছলো। বলল
অসভ্য।
আপনি ভীষণ সভ্য।
রাহা কপাল কুঁচকে বলল
আমি কি করলাম?
সকাল সকাল…
রাহা ছুটে গিয়ে গাল চেপে ধরলো।
চুপ চুপ। লজ্জায় ফেলবেন না। উফফ আপনাকে দেখলে বোঝা যায় না আপনি এত ঠোঁটকাটা। ধুরর।
তানজীব তার হাতটা সরিয়ে বলল
ইয়েস ইউ আর রাইট। আমাকে দেখলে অনেককিছু বোঝা যায় না। বোঝায় যায়না আমি বোকা নারীর প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া প্রেমিক। বোঝা যায়?
রাহা চোখ ছোট ছোট করে নাক ফুলিয়ে বলল
আমি বোকা?
আলবাত বোকা। নইলে রোমান্সের সময় কেউ হাত ছোড়াছুড়ি করে? আজব!
রাহা বলল
আজব আপনি। এমন সময় আপনার এত রোমান্স করতে ইচ্ছে হলো কেন? আপনি একটা অসভ্য, অভদ্র।
রাহাকে রাগিয়ে দিয়ে ভারী মজা পেল তানজীব। হেসে গলা কাত করে বলল
হানিমুনে কোথায় যাবেন?
রাহা কেমন রসিক চোখে চাইলো। ব্যঙ্গ করে বলল….
হানি—মুন?
হু।
আপনি হানিমুন কি জানেন?
আমাকে এত বেরসিক ভেবে ভুল করবেন না মিসেস।
রাহার হাসি পেল।
আচ্ছা। ভীষণ রসিক আপনি। বিশ্বাস করলাম।
তানজীব হাসলো।
হুম করা দরকার।
তাতে কি যায় আসে?
তানজীব কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো
মানে? কিছু যায় আসেনা?
রাহা সোজা উত্তর দিল।
না। আপনার মতো অসভ্য লোকের সাথে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই আমার।
তানজীব আবারও পথ আটকে দাঁড়ালো।
আচ্ছা সভ্য হয়ে থাকব।
রাহা না পারতে হেসে উঠে বলল
আপনি কি যাবেন এখন?
না। আগে বলো।
আচ্ছা সেসব পরে। আপনি আয়নায় নিজেকে দেখেছেন? আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন। পরে বলব। ওকে?
তানজীব ধীরেধীরে মাথা দুলালো। মাথা নিচু ফিসফিস করে বলল
ওকে। কিন্তু আরেকটা কথা।
রাহা মৃদু হেসে চোখে চোখ রেখে বলল
আবার কি কথা?
তানজীব চুল সরিয়ে কানের কাছে ঠোঁট ছুঁয়ে দিতেই রাহা ফিক ফিক করে হেসে উঠে বলল
আপনি কি????
আ’ম ইয়োর মেজর…..
_________________
হসপিটাল থেকে তানজীবের অনডিউটি অফিসিয়াল গাড়িটা যাত্রা করলো পুলিশ হেড কোয়ার্টারের দিকে।
সেখানে তারা পৌঁছানোর সময় দেখলো মিডিয়ার দল দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায় দলে দলে । সাথে পুলিশের গাড়ির সাথে দু তিনটি মিলিটারি জিপ। গাড়ি সোজা গেইটের ভেতর প্রবেশ করতেই কনস্টেবল আর হাবিলদার কুর্নিশ জানিয়ে গাড়ির পেছন পেছন ছুটলো। তানজীব গাড়ি থামিয়ে গলা বের করলো জানালা দিয়ে। কনস্টেবল ছুটে এসে বলল
স্যার শরীর ঠিক আছে? সব ঠিকঠাক আছে?
তানজীব ধীরেসুস্থে জবাব দিল।
ঠিক আছি। একটা কথা বলেন তো। মিলিটারি জিপ কেন? আর মিডিয়া?
কর্নেল স্যার এসেছেন। আরও অনেকে। সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। হসপিটালে ছিলেন বলে ফোন করতে বারণ করা হয়েছে।
তানজীব দ্রুত গাড়ি থেকে নামলো।
কিছু কি হয়েছে? মিডিয়া কেন?
সাংবাদিকরা ইতোমধ্যে ঠেলাঠেলি করে তেড়ে আসছে গাড়ির দিকে। কনস্টেবল ভীতকন্ঠে বললেন
কিছু জানেন না? আপনি ভেতরে গেলেই বুঝতে পারবেন স্যার।
তন্মধ্যে আতসবাজির মতো ছুটে এল যুবতী জার্নালিস্টের প্রশ্ন। হাঁপাচ্ছে সেই যুবতী। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। ওয়্যারলেস ইউএসবি মাইক্রোফোন এগিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ছে একেকটা।
স্যার একজন মিলিটারির সাথে ডিএসপি পুলিশ অফিসারের কিসের শত্রুতা থাকতে পারে? কেন ডিএসপি রোস্তম শিকদারকে অ্যারেস্ট করা হলো? আপনাকে মার্ডার করার ষড়যন্ত্রের পেছনে উনার কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে?
তানজীব সেখানেই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পুলিশ এসে তাদের সরানোর চেষ্টা করছে। তানজীবের যাওয়ার পথ পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে। মুহূর্তেই চারপাশে টানটান উত্তেজনা।
সাথে সাথে আরও একটি দুর্দান্ত প্রশ্ন কানে এসে লাগলো তানজীবের।
স্যার ইতোমধ্যে আরও দুজনের নাম জড়িয়েছে এই ষড়যন্ত্রে। তাদের দুজনেই আপনার পরিচিত। এবং শোনা গেছে উনারা আপনার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর বাবা এবং জেঠু। আপনি এই ব্যাপারে কি বলবেন? একজন সেনা কমান্ডো, প্যারা স্পেশাল ফোর্স অফিসার যিনি নিজেই দেশের জন্য দশের জন্য লড়ে যান। প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাকে কেন কেউ মারতে চাইবে? তার চাইতে বড় কথা আপনার শ্বশুর কেন এই কাজটি করবেন? স্যার আমরা আপনার মুখে কিছু শুনতে চাইছি। এই শত্রুতার পেছনে কি বড় কোনো কারণ আছে? স্যার প্লিজ কিছু বলুন।
একের পর এক প্রশ্নের চোটে তানজীবের চোখদুটো রক্তাভ। চোয়ালের পেশি কঠিন হয়ে উঠলো মুহূর্তে। দপদপ করে জ্বলে উঠলো চোখের তারা। এমন নিরেট জবর আর্মি অফিসারের মুখাবয়বে কেউ আর অতিরিক্ত প্রশ্ন করার সুযোগ পেল না বটে কিন্তু পিছিয়েও গেল না। ভীড়ের মধ্যে দিয়ে হেঁটে সোজা অফিসের দিকে দ্রুতবেগে পা চালালো সে। কি ভেবেছিল কি হয়ে গেল?
রাহান আর অধীর গাড়ি থেকে নামলো দ্রুত। সাংবাদিকের জেরা থেকে অনেক কষ্টে নিস্তার পেল বৈকি। তবে পরপর একে একে পুলিশি গাড়ির আওয়াজে পরিস্থিতি উত্তেজনায় ভরপুর হয়ে এল। তাদের হার্টবিট দ্রুততর হচ্ছে। অনেকগুলো অফিসিয়াল পোশাক পরিহিত পুলিশ ও জার্নালিস্টের মাঝখানে আমজাদ কবির ও আজমল কবিরকে দেখে দু’জন সেখানেই থমকে গেল। আরও ভীষণরকম হতভম্ব হলো রাস্তার ওপাশে রাহা নোরা আর তাদের দু পরিবারের গাড়িগুলোকে দেখে।
__________________
ইমার্জেন্সি কক্ষের কাচের দরজা খুলে প্রবেশ করতেই জুনিয়র অফিসারেরা পা ঠুকে কূর্নিশ জানাতেই তানজীব মাথা নেড়ে এদিকওদিক চাইলো। আইএসপি অফিসার তানভীরুল হক এবং সিবিও অফিসারকে দেখে একপ্রকার থমকে দাঁড়ালো সে। তারা নিজেরাই এগিয়ে এল। হাতের ল্যাপটপ বিশালাকার লম্বাটে টেবিলের উপর রেখে মোটা মোটা দু তিনটা ফাইল টেবিলে ছুঁড়লো। উত্তেজিত গলায় বলল
স্যার আপনি বলেছেন আমরা পারব না। আমরা ঠিকই পেরেছি স্যার। বসুন সব ডিটেইলস এক্সপ্লেইন করা হবে এখন।
তানজীবের চাপা গর্জনে পুরো কক্ষ কেঁপে উঠলো যেন।
আমাকে ইনফর্ম করার দরকার ছিল তানভীর। হোয়াই ডি’নট ইউ ইনফর্ম মি? হোয়াই?
মেজর স্যারের এমন বিকার দেখে সবাই হতভম্ব। কোথায় ভেবেছে তারা বাহ্বা পাবে। আর্মি গুলোর মুখ দিয়ে কি পুলিশ আর গোয়েন্দাদের সুনাম বেরোয় না?
কাম ডাউন মেজর। দে ডিড ওয়েল।
অফিসিয়াল মিলিটারি পোশাকে কর্নেল স্যারকে দেখে গর্জন তর্জন ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ জানালো সে। পা ঠুকে বলল
বাট স্যার আই সেইড আই উইল হ্যান্ডেল দিজ কেস।
সো হোয়াট মেজর? আপনাকে কেস সলভ করার জন্য মিলিটারি পোশাক পড়তে দেয়া হয়নি। একজন সেনা কমান্ডোর কাজ দেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। ছোটখাটো কেস সলভ করা তার কাজ নয়। আপনি কি ভুলে যাচ্ছেন আপনার মিশন? গত দুদিনের আপনার সকল ফোন রেকর্ড আমার হাতে। এই কেসের ইনভেস্টিগেশন কেন পজ করতে বলেছেন আপনি? আমি আদেশ না দিলে ষড়যন্ত্রকারীরা পার পেয়ে যেত। তাদের সাথে আপনার কিসের শত্রুতা মেজর? আপনি আমাকে আনসার করতে বাধ্য। আপনি নিজেও জানেন না এই কেসটা কতদূর যেতে পারে।
তানজীব সটান দাঁড়ানো অবস্থা গলার স্বর নামিয়ে বলল
সরি স্যার।
আমার সরির দরকার নেই মেজর। আমি জাস্ট জানতে চাইছি একজন ডিএসপি অফিসারের সাথে আপনার কিসের শত্রুতা? আপনার জীবন সংশয় মানে দেশের একটি বেড়িবাঁধ নড়বড়ে হয়ে যাওয়া। আপনার অনেক দায়িত্ব মেজর।
আই নৌ স্যার।
আপনি জানেন না। আপনি নিজেই একবার ভেবে দেখুন এটা কি ধরণের নোংরা একটা কাজ যেটাকে আপনি লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। আপনি কি করে ভুলে গেলেন অপরাধকে প্রশয় দেওয়া ও এক প্রকার অপরাধ। আনসার মি মেজর।
কর্নেল স্যারের প্রশ্নের মুখে নিরেট মেজর সেনাও অনুচ্চ। চোখদুটো মেঝেতে নিবদ্ধ করে দুটো হাত পেছনে রেখে সরল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো ছ’ফুট উচ্চতার সেনা কমান্ডো। বাকিরা বোধহয় সাহস পেল কিছুটা তারপরও মেজর স্যারের দিকে কোণাচোখে তাকিয়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো
স্যার আমরা কি..
ইয়েস মিস্টার তানভীর। ইউ মে প্রসিড। মেজর আপনার জানার দরকার…
স্যার এখানে আমার ব্যাক্তিগত কিছু বিষয় জড়িত। আমি তাই…
আমি এখন আপাতত কোনো অজুহাত চাইনা মেজর। আপনি বিরাট ভুল করেছেন। এরজন্য আপনাকে জবাবদিহিতা করতে হবে মেজর। কোনো ছাড় নেই।
তানজীব চোখ বন্ধ করে দম নিল।
হাতের মুঠো ঘনঘন বন্ধ করে আবার খুলে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো।
বাই দ্য ওয়ে মেজর। আপনার মিসেস কেমন আছে?
হালকা মাথা দুলাতে গিয়ে থমকে গেল তানজীব। কঠিন চোখদুটো আটকে গেল কর্নেলের ক্রুর হাসিমাখা মুখে।
তাদের শাস্তি হওয়া উচিত মেজর। বিশেষ করে ডিএসপি রোস্তমের। সে আইনের পোশাক পড়ে আইন বিরুদ্ধ কাজ করেছে।
তানজীব সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে মাথা নামিয়ে বলল…..
ইয়েস স্যার। আমি রোস্তমের সাথে দেখা করতে চাই।
সিউর। ইউ মে গো নাউ।
থ্যাংকিউ স্যার।
তানজীব দ্রুত পা চালালো।
_________________
আকাশচুম্বী গর্জনে পুলিশ আর কনস্টেবলরা রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছে। কয়েদের লোহার গ্রিলে গায়ের জোর দিয়ে লাতি বসাচ্ছে রোস্তম একের পর।
তানজীব যেতেই কনস্টেবল আর পুলিশ কর্মকর্তারা সাবধান হয়ে দাঁড়ালো। সবাইকে সোজাসুজি হয়ে দাঁড়াতে দেখে রোস্তম হতচকিত হয়ে তাকালো সামনে। গ্রিল ধরে কপাল কুঁচকে তাকাতেই দেখলো দীর্ঘ বছর খানেক আগের কোনো এক কনফারেন্সে দেখা সেই খ্যাত ছ’ফুট উচ্চতার নিরেট স্পষ্টবাদী মিলিটারি অফিসারকে। স্পষ্ট দেখলো কপাল, মাথায়, বুকে অসংখ্য ব্যান্ডেজে মোড়ানো আহত মেজর সেনার ডহর দুচোখে আগুন জ্বলছে দপদপ করে। চাহনিতে তাচ্ছিল্য। ঘৃণা।
রোস্তম গ্রিল আঁকড়ে ধরলো শক্ত করে। মুখোমুখি তাকিয়ে পরখ করলো সেনা কমান্ডো অফিসারকে। তার চোখে বিন্দুমাত্র লজ্জা,ভীতি না দেখে ভীষণ অবাক তানজীব। দু হাতে গ্রিল ধরে মুখোমুখি প্রশ্ন করলো।
প্রথমত বিশ্বাস ভেঙেছ দ্বিতীয়ত মারার চেষ্টা। এসব করে কি পেয়েছ রোস্তম?
রোস্তম রাগে কিড়মিড় করতে করতে গ্রিলে লাতি বসিয়ে বলল
এই হাবিলদার তালা খোল।
তানজীব গ্রিল ঠোকা মেরে বলল
রিল্যাক্স। এই কয়েদে বড়, ছোট সব অপরাধীরাই থাকে রোস্তম। রিল্যাক্স। অনেক কিছু দেখার বাকি আছে।
এই মেজর একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নিন। কেউ আমার কিছু করতে পারবেনা। আমি দেখে নেব সবাইকে।
ওকে। দেখা যাক।
পেছন থেকে কেউ একজন ডেকে বলল
স্যার বাইরে আপনার ডাক পড়েছে।
রোস্তমের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে চলে গেল তানজীব।
পুলিশ হেড কোয়ার্টারের ফাঁকা মাঠ পুলিশ আর জার্নালিস্টে ঠাঁসা। কর্নেল স্যারের পেছন পেছন মাঠে পৌঁছুতেই সবার নজরে এল তানজীব। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। রাহান আর অধীর তাকে দেখে ছুটে এল ভীড় ঠেলে। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো। তানজীব হেঁটে আরও সামনে এগোতেই রাহান আর অধীরের দিকে চোখ গেল তার। তারা ইশারায় মাঠের মাঝখানে দেখিয়ে দিল কালো বোরকা পড়া কান্নারত একটি মেয়েকে। বুকের ভেতর আচমকা ছ্যাঁত করে উঠলো তার।
প্রাণো!
বাবা জেঠুর সাথে একটু কথা বলা সুযোগ পাচ্ছিলো না রাহা। অনেক কষ্টে ভীড় ঠেলে যাও এল, পরে নাগাল না পেয়ে পাগলের মতো কান্নাকাটি শুরু করেছে সে।
তানজীব এক পুলিশ কর্মকর্তাকে ডেকে সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো। সিনিয়র অফিসার সেই দূর থেকেই তানজীবের দিকে তাকাতেই তানজীব ইশারায় রাহাকে তার বাবা জেঠুর সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিতে বলল। অফিসার রাহাকে ডেকে নিল নিজেই। রাহা পাগলের মতো ছুটে এসে বাবার সামনে এসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। বলল
আব্বা আমায় ক্ষমা করো। আমি তোমাদের এমন পরিণতি চাইনি কখনো। এটা কি হলো? কেন করলে এমন?
বলতে বলতে আবারও কেঁদে উঠলো সে।
আমজাদ সাহেব কঠোর গলায় বললেন
আমি শুধু নোরা আর আশরাফের আব্বা। আমার আর কোনো সন্তান জীবিত নেই।
রাহা এলোমেলো সুরে কেঁদে উঠলো।
এভাবে বলো না আব্বা।
আমি বললাম তো আমি কোনো স্বার্থপরের বাবা নই। আমার বিশ বছরের আদর যত্ন ভালোবাসার কাছে অন্যের দু’দিনের ঠুনকো ভালোবাসা যার কাছে সবচাইতে বেশি সে আমার কেউ নয়।
রাহা গাল মুছলো। বলল
জেঠু তুমি বলো তোমরা একাজ করোনি। একবার বলো। আমি তোমাদের ছাড়িয়ে আনব।
আমাদের ছাড়ানোর দরকার নেই। এত দয়ার দরকার নেই আমাদের। তোর সাথে আমাদের সব সম্পর্ক তখন থেকে শেষ। কেন এসেছিস এখন? তোকে আমরা চিনিনা। বড় জেঠু আর বাবা পাগল ছোট রাহা মরে গেছে। তুই সে নস। এখন যাহ। কারো দয়া আমাদের দরকার নেই। তুই শান্তিতে থাক। আমরা দোষী না হলেও তোর আর ওই ছেলের কাছে ছোট হব না। ফাঁসি হলে হোক।
রাহা আমজাদ সাহেবের হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলল
না না এভাবে বলোনা। আব্বা তোমরা সত্যি মেজরকে মারতে চেয়েছ? এসব মিথ্যে, না? বলো মিথ্যে? আব্বা চুপ থেকোনা। ও আব্বা এত বড় শান্তি দিওনা আমাকে। একবার সত্যিটা বলো।
অফিসার কোথায় নিয়ে যাবেন নিয়ে চলুন। রাহা পথ আটকে বলল
আব্বা সত্যিটা বলে যাও। ও জেঠু সত্যিটা বলো একবার।
উনাদের নিয়ে যাওয়া হলো।
মহিলা পুলিশ কর্মকর্তা এসে রাহাকে ধরে রাখলো। বলল
ম্যাডাম শান্ত হোন প্লিজ।
রাহা তাদের সাথে ধস্তাধস্তি করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়লো। হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল
উনাকে ডেকে দিন।
কাকে ম্যাডাম?
মেজর তাহমিদ। এক্ষুণি।
মহিলাগুলো একে অপরের দিকে চাইলো।
কি হলো ডাকুন। উনাকে ডাকুন।
মহিলা পুলিশ রাহার পেছনে চোখ তুলে তাকিয়ে আবারও চোখ নিচে নামিয়ে মিনমিন করে বলল
স্যার এসেছেন।
রাহা সাথেসাথে পেছনে ফিরলো। তানজীবের ইশারায় জায়গাটা ফাঁকা হয়ে এল মুহূর্তেই । রাহা হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছে নিয়ে তানজীবকে পিছু করে দাঁড়ালো। ফোঁপানি তার কমছেনা।
তানজীব পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল
এজন্যই বলেছিলাম শক্ত হতে। পথচলা অনেক কঠিন হবে আগেই বলা ছিল।
রাহা সাথেসাথেই ফিরলো তার দিকে। তার চোখমুখ রক্তাভ। কঠিন গলায় বলল
সকাল থেকে এত কথা বললেন। একবারও তো বলেন নি তলে তলে এসব করছেন। এবার খুশি হয়েছেন আপনি?আপনার স্বাদ মিটেছে?
রাগের মাথায় বলছ নাকি সিরিয়াসলি?
ঠিক বলছি। আপনি তো আমায় সব বলেন এটা কেন বললেন না? আমি আপনার শত্রু যে বলেন নি।
তানজীব মুখ ভার করে চেয়ে রইলো।
রাহা তার বুকের বামপাশের শার্ট হাতের মুঠোয় টেনে নিয়ে বলল
হয়ত কথায় কথায় এমনি বলেছে, কিন্তু মারার অর্ডার নিশ্চয়ই রোস্তম শিকদার দিয়েছে। তাহলে আব্বা জেঠুকে কেন গ্রেফতার করা হলো? কেন?
তানজীব চোখমুখ শক্ত করে দাঁতে দাঁত এঁটে ঠোঁট কামড়ে ধরে চুপ করে রইলো। রাহা চট করে ছেড়ে দিল বুকের কাছের শার্ট। ক্ষতটা এখনো কাঁচা। সে এটা কি করলো?
তানজীব ছাড়া পেয়ে দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেল। রাহা হাতটার দিকে তাকিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠে বলল
মেজর যাবেন না।
বাকিরা ততক্ষণে রাহার খোঁজে চলে এসেছে। নোরা মিনা সবাই ছুটে এল। নোরা রাহাকে জড়িয়ে ধরে বলল
দেখ আব্বা আর জেঠু দোষ না করলে ওরা ছেড়ে দেবে। এভাবে কেন কাঁদছিস?
বলতে বলতে নোরা নিজেকেই আটকে রাখতে পারলো না। রাহা বলল
যদি দোষ করে? আমি মেয়ে হয়ে আব্বাকে ওখানে কি করে দেখব? আমি তো এমনিতেই আব্বাকে কষ্ট দিয়েছি আপা। আমি কি করব এখন? আমি মেজরকেও কষ্ট দিয়েছি। এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা আর কতদিন চলবে? আমি আর পারছিনা নিতে।
মিনা তার দুধের শিশুটাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল
আম্মা আব্বাকে মেরেও ও শান্ত হয়নি ওরা। এখন আমার ভাইটাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছে। কেন? কি করেছে ভাইয়া? কতগুলো বছর পর গ্রামে গেল? তাতেই মেরে ফেলতে হবে? কেন রে? তোকে ভালোবেসেছে বলে ওদের সাতখুন মাফ করে দিতে হবে?
রাহান বলল
মিনি কি বলছিস?
আমাকে বলতে দিন।
শোন রাহা আমি আর যাহোক আমার ভাইয়ের জীবন নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেব না। তোর বাপ জেঠু এটা ঠিক করেনি। ভাইয়া যেটা করেছে একদম ঠিক করেছে। তোর থাকতে ইচ্ছে হলে থাক, না হলে চলে যাহ। এটলিস্ট আমার ভাইয়ের মরণ চাওয়া মানুষগুলোকে আমি সহ্য করতে পারব না আমার চোখের সামনে।
রাহা বিস্ময় নিয়ে বলল
আমি তোমার ভাইয়ের মরণ চাই?
তোর বাপ জেঠুকে সমর্থন করা মানেই তাই দাঁড়ায়। কেন বারবার কোনো দোষ না করেও আমার পরিবারের পেছনে পড়ে থাকে তোর পরিবার? কি দোষ করেছে তারা? তোকে ভালোবেসেছে তাই বলে তাকে গাড়ির নিচে ফেলে মারতে হবে? আমার আম্মা আব্বা দুটোকে তো শেষ করলো। আর কত নিঃস্ব করবি তোরা?
নোরা বলল
এসব কি বলছিস মিনা? তুইও শেষমেশ আমাদের দোষ দিচ্ছিস?
সরি রে। তোর বোন আমাকে বলতে বাধ্য করলো। ও ভাইয়ার সাথে যে বিহেভটা করলো তা আমি দেখেছি। তুই আমার ভাইয়ার আশেপাশেও ঘেষবি না বলে দিলাম রাহা।
নোরা হাঁপিয়ে উঠলো। রাহান মিনাকে নিয়ে গেল একপ্রকার জোর করে। এই মেয়ে কখনো এভাবে কথা বলেনা। আজ কি হলো কে জানে?
নোরার শরীর অসুস্থ বিধায় অধীর চিন্তিত হয়ে পড়লো। রাহান বলল
এখন যতসম্ভব তাকে চিন্তামুক্ত রাখতে হবে। তাই অধীর চালাকি করে সান্ত্বনা বাণী শোনালো। বলল যে তানজীব নিজেই বলেছে সে তাদেরকে ছাড়িয়ে নেবে।
নোরা একটু স্বস্তি পেল। রাহাকে একপ্রকার জোর করে তাদের সাথে নিয়ে গেল। সে যেতে নারাজ ছিল। পরে তানজীবের কোনো দেখাসাক্ষাৎ না পেয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল।
নিজের ভুলের কারণে নিজেই নিঃশ্বব্দে চুপচাপ বিলাপ করছিল ঘরে বসে। নোরা জোর করেও কিছু খাওয়াতে পারেনি রাতে।
—–
তানজীব রাত বারোটার দিকে বাড়ি ফিরলো। বাড়ি ফিরে দেখলো পুরো শেখাওয়াত পরিবারের লোকজন তার অপেক্ষায় সোফায় বসা। মিনিও দুধের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বসা। সবাই তানজীবকে দেখে এই সেই প্রশ্ন করলো। তানজীব হ্যা না উত্তর করলো শুধু। সেলিম সাহেব বললেন
খবরদার ওদের ভুলেও ছাড়াতে যাবি বা বউয়ের কথা ভেবে। তোর বউও ওদের মতো নিমকহারাম। নইলে জামাইয়ের জীবন মরণের কথা না ভেবে অমন করে? তোকে ওই মেয়ে ভালোটালো বাসেনা। সব ঢং করে। কত্তবড় সাহস ওই কু** বাচ্চাগুলোর। ওই পুলিশ অফিসারের সাথে ওই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে ভালো হতো। একদম খাপে খাপ মিলতো। ওরা যেমন, ওই পুলিশ অফিসারও তেমন। তোর সাথে ওই মেয়ের কোনোদিকে যাচ্ছে না তো। আজকে ওই মেয়ের রূপ বেরিয়ে গেল। দেখলি? মিনিও তো ওই মেয়ের পক্ষ নিল। আজ সরূপ দেখলো তো। আমাদের কথা তো কানে নিস না।
তানজীব বিরক্ত গলায় বলল
আস্তে কথা বলো।
কেউ শুনতে পাবেনা। তোর বউ নেই এখানে।
তানজীব কপাল কুঁচকে বলল
কেন?
কেন মানে? ওই মেয়ের মুখ আছে এখানে আসার? তার বাপ জেঠা যা করেছে।
কোথায়? মিনি কোথায় ও? কোথায় রেখে এসেছিস?
তোমাকে অধীর ভাই বলেনি? নোরা ওকে নিয়ে গেছে।
আচ্ছা? আমার অনুপস্থিতিতে তাহলে এটাই হবে। ভালো।
নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে হনহনিয়ে চলে গেল সে। ফোনে হাজারবার ট্রাই করলো কিন্তু রাহা ফোন তুললো না ইচ্ছে করে। রাত বারোটাই মনে পড়লো তাকে?
চলবে….