বৃষ্টিময়_প্রেম #পর্বঃ৯,১০

0
1173

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৯,১০
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
০৯

ফজরের সময় ঘুম থেকে উঠার মাধ্যমে আজকের দিন শুরু হলো। এমনিতেও রাতে তেমন ঘুমাতে পারিনি আমি। পরেরদিন কোন জরুরি কাজ থাকলে সেই রাতে আমার ঘুম ধরেনা। এ আমার এক বহু পুরনো বাজে স্বভাব! আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবুও আজ ভোরেই উঠেছি, বোনের বিয়ে বলে কথা! আজ বিশ্রামের সুযোগ নেই হাতে!

নামাজ পড়ে রুমের বাইরে বের হতেই দেখি আন্টিও উঠে গেছেন। টুকটাক কাজ করাও শুরু করে দিয়েছেন। আমাকে আসতে দেখে আলতো হাসলেন তিনি। আমি আন্টিকে জড়িয়ে ধরে বললাম,

—রাইসার বিদায়ের কথা মনে করে তোমার অনেক মন খারাপ, তাইনা আন্টি?

—না রে মা। আমি ঠিক আছি।
(মলিন সুরে বললেন আন্টি)

—দেখতে পাচ্ছি তো তুমি কতটা ঠিক আছো! দেখো আন্টি, আমি জানি তোমার মন খারাপ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। একমাত্র মেয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে আজকে, এটা যেকোন মায়ের কাছেই খুব কস্টের ব্যাপার। কিন্তু তুমি যদি এভাবে ভেঙে পড়ো তবে রাইসার কি হবে বলো তো? ওর জন্য হলেও নিজেকে সামলাতে হবে তোমার। আর তুমি মন খারাপ করো কেন? আমি আছিনা? রাইসার অভাব পূরণ করতে না পারলেও আমি তোমায় মন খারাপ করে থাকতে দিবোনা, বুঝেছো?

আমার কথা শুনে আন্টি হালকা হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আমায়। তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনা জল। পৃথিবীর সব মায়ের মন বোধহয় এমন নরমই হয়!!

_________

শাড়ি পড়ার জন্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কুচি ঠিক করার চেস্টা করছি। কারণ শাড়ি পড়ার ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা একেবারেই নেই বললেই চলে। শাড়ি আমার ভীষণ পছন্দ হলেও ক্ষেত্রবিশেষ ব্যতীত শাড়ি ছুয়েও দেখা হয়নি কখনো। যতবার পড়েছি আন্টি সাহায্য করেছেন কিন্তু আজ তিনি ভীষণ ব্যস্ত তাই নিজে নিজেই চেস্টা করতে হচ্ছে আমায়। ইউটিউব দেখে কোনরকম দেখতে মানানসই লাগার মতো শাড়ি পড়ে ফেললাম আমি। মাঝপথে যেন এটা খুলে না যায় সেই দোয়া করতে লাগলাম মনে মনে! বিয়েবাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে এরকম অবস্থা হলে লজ্জায় কাউকে মুখই দেখাতে পারবো না আমি!

তবে এখন বেশি কিছু ভাবার সময় নেই, মেকাপ করাও বাকি আছে এখনো। এদিকে রেডি হয়ে রাইসাকে দেখতে যেতে হবে ওর রুমে। চিন্তাভাবনার মধ্যেই আলতো হাতে মেকাপ করে নিলাম আমি। চুলগুলো পুরোপুরি না আচড়িয়ে হালকা এলোমেলো করে খোলাই রাখলাম। আয়নায় তাকিয়ে দেখলাম, নাহ দেখতে খুব একটা খারাপ লাগছে না! নীলরঙা শাড়িতে বেশ ভালোই দেখাচ্ছে আমাকে!

রাইসার রুমে নক করতেই গেট খুলে দিলো পার্লারের আপুটা। তাকে পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতেই লাল টুকটুকে জামদানীতে রাইসাকে দেখতে পেলাম আমি! ভীষণ সুন্দর লাগছে ওকে! আজ তো প্রান্ত ভাইয়া ওকে দেখে পাগল হয়ে যাবেন ভেবে হাসলাম আপন মনেই। আমাকে দেখে রাইসাও প্রশংসা করলো আমার। আমাদের কথার মাঝেই ওর বাকি কাজিনরা প্রবেশ করলো রুমে। পার্লার থেকে রেডি হয়ে এসেছে সবাই আজকে। খুব ভালো লাগছে প্রত্যেককে! ওদের থেকে জানলাম বাইরে আত্মীয়স্বজনরা সবাই চলে এসেছেন যে যার মতো। ড্রয়িংরুমে বসে আছেন সবাই।
এখন অপেক্ষা শুধু বরপক্ষের আসার!

সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম রাইসার রুমে। বিয়ে পরবর্তী আলোচনা নিয়ে ওকে বেশ ক্ষেপানো হচ্ছিলো। রাইসা লজ্জা পেলেও বাকিরা সবাই বেশ উপভোগ করছিলাম ব্যাপারটা! আমাদের গল্পের মধ্যে রুমে প্রবেশ করলেন রায়হান ভাইয়া। এসেই জানালেন বরপক্ষ এসে গেছে। এটা শুনেই রাইসা হাত খামচে ধরলো আমার। বুঝলাম ও নার্ভাস হয়ে গেছে বেচারি। ওর হাতের উপর হাত রেখে ভরসার আশ্বাস দিলাম ওকে। তারপর সবাই মিলে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো বউকে তার বরের কাছে।

মুখোমুখি বসে আছেন প্রান্ত ভাইয়া ও রাইসা। ভাইয়ার পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন তার দুই ভাই-বোন ও কাজিনরা। আর রাইসার পাশে দাঁড়িয়ে আছি আমি, রায়হান ভাইয়া সহ ওর বাকি কাজিনরা। একটু পরেই কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করবেন! বেশ এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে সবার মধ্যে! প্রান্ত ভাইয়ার কাজিনদের অবশ্য ভাবই আলাদা। পাঞ্জাবির সাথে সানগ্লাস পড়ে দাঁড়িয়ে আছেন সবাই। কে কোনদিক তাকিয়ে আছে কিছু বুঝা যাচ্ছে না। পূর্ণ ভাইয়ার রোগ কি সবার লাগলো নাকি ভাবতে লাগলাম আমি।

ভাবতে ভাবতেই চোখ গেলো পূর্ণ ভাইয়ার দিকে! ফর্সা শরীরে নেভি-ব্লু রং এর পাঞ্জাবি দারুণ মানিয়েছে। হাতা গুটিয়ে রেখেছেন কনুই পর্যন্ত। তবে তার ঠোঁটের কোণায় সুক্ষ্ম হাসির রেখা দেখা যাচ্ছে। এই লোকটা হাসতেও পারে? অবাক হয়ে গেলাম আমি। তবে তার মুচকি হাসির কারণটা কি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম নাহ আমি।

আমার চিন্তার মধ্যেই রায়হান ভাইয়া ডাকলেন আমায়। তার দিকে তাকাতেই হাসিমুখে বললেন,

—শাড়িতে বেশ সুন্দর লাগছে তোমায়। নিজে নিজেই পড়েছো নাকি?

হঠাৎ করেই তার মুখে নিজের প্রশংসা শুনে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম আমি। হালকা হেসে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম নিজেই পড়েছি। রায়হান ভাইয়া আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু কাজি সাহেবের কথার প্রভাবে মাঝপথেই থামলেন তিনি। যথারীতি বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। প্রান্ত ভাইয়াকে কবুল বলার কথা সাথে সাথেই উনি গটগট করে তিনবারই বলে দিলেন। রাইসাও প্রথমে একটু সময় নিলেও পরে ঠিকি কবুল বললো। সাইন করা এবং বাকি ফর্মালিটিজ শেষ হওয়ার মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন তারা!

বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই মেহমানদের খাবার সেশন চালু হলো। এক এক করে ব্যাচে ব্যাচে খেতে গেলেন সবাই। আংকেল-আন্টির সাথে আমি ও রায়হান ভাইয়া তদারকি করছি মেহমানদের। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম ছবি তুলায় ব্যস্ত বাকি সবাই। শুধু পূর্ণ ভাইয়াই এক পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছেন। নিশ্চয়ই অফিসের ফোনই হবে! ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকলাম সেদিকে। এই লোকটার কি এমন কাজ যে নিজের ভাইয়ের বিয়েতেও তাকে অফিসের লোকের সাথে ফোনে কথা বলতে হবে?
একটা দিন কি ছুটিতে থাকা যায়না! আজব। পরে ভাবলাম উনি যাই করুক, আমার কি?

হঠাৎ উনি আমার এদিকে তাকাতেই আমি দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিলাম অন্যদিকে! ভাগ্যিস দেখেননি আমায়। নয়তো না জানি কি মনে করতেন উনার দিকে এতক্ষণ তাকিয়ে থাকার জন্য! ছিঃ!!

একটু পর প্রিয়াকে দেখলাম আপন মনে ছবি তুলছে নিজের। সাথে একা একা ভিডিও করছে চারপাশের! মেয়েটা বড়ই চঞ্চল। মুচকি হেসে ভাবলাম আমি!

__________

দুই ব্যাচ খাওয়া শেষ হতেই আস্তে আস্তে কিছু মেহমান চলে যেতে শুরু করেছে অল্প অল্প করে। এতক্ষণ চারদিকে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে আমার শাড়ির অবস্থা নাজেহাল প্রায়। কোনরকম কুচি হাতে ধরে নিজ রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। উদ্দেশ্য এই এলোমেলো শাড়িকে ঠিক করে পড়া! তাড়াহুড়োর মধ্যে সামনের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে রায়হান ভাইয়াকে আমার দিকে আসতে দেখে লজ্জায় ও চিন্তায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম আমি! কোনদিক যাবো না যাবো ভাবতেই শাড়ির কুচি পায়ের নিচে পরায় পড়ে গেলাম মাটিতে। আমাকে হঠাৎ করে পড়তে দেখে অবাক হয়ে এগিয়ে এলেন রায়হান ভাইয়াও কিন্তু আমার শাড়ির আচলে পা পিছলে আমার সাথে পড়ে গেলেন উনিও।

হঠাৎ করেই যে এত বিশ্রি পরিস্থিতিতে পড়বো আমার কিছুতেই মাথায় আসেনি! রাগে-ভয়ে-লজ্জায় যেন থম মেরে আছি আমি। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিনা। রায়হান ভাইয়াও অপ্রস্তুতভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন হতভম্ব হয়ে! তিনিও এইরকম পরিস্থিতি আশা করেন নি আমার মতো! কোনমতে নিচের শাড়ির আচল দিয়ে গা ঢেকে মাটি থেকে উঠতে যাবো এমন সময় কিছু মহিলার আওয়াজ শুনলাম,

—দেখো দেখো, বিয়েবাড়ির মধ্যেই কি শুরু করেছে এরা? লজ্জাশরমের মাথা খেয়েছে আজকালকার ছেলেমেয়েরা।

তাদের কথায় অলরেডি আরও লোকজন ভীড় জমাতে শুরু করেছেন। তাদের কথা শুনে ও এত মানুষ দেখে আমার মাথা ঘুরে উঠলো। না জানি কি ভাবছে সবাই আমাদের নিয়ে? ছিহ!! এর মধ্যে রায়হান ভাইয়া ততক্ষণে উঠে দাড়িয়েছেন। আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। হঠাৎ করেই যেন মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে আমার। এরই মধ্যে সামা আপু এগিয়ে এসে আমাকে টেনে তুলে শাড়ির আচল দিয়ে ভালো করে মুড়িয়ে দিলেন আমায়। আংকেল-আন্টিসহ পূর্ণ ভাইয়ারাও চলে এসেছেন এতক্ষণে! না জানি আমায় কি ভাবছেন তারা! আড়চোখে পূর্ণ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি সানগ্লাস খুলে ফেলেছেন এতক্ষণে। শক্ত হাতের মুঠোয় চেপে ধরে আছেন সেটাকে। দূর থেকে মনে হলো তার হাত যেন কাপছে তবে সেটা আমার চোখের ভুল কি না জানিনা!

লজ্জায়-অপমানে মাথা নিচু করে রেখেছি আমি। এদিকে রায়হান ভাইয়া বিয়েবাড়ির সবাইকে বুঝাতে শুরু করেছেন যে আমাদের মধ্যে যা ভাবছেন তারা, তেমন কিছুই হয়নি কিন্তু কেউ তার কথা মানতে নারাজ! মনে হচ্ছে পরিস্থিতি অন্যদিকে চলে যেতে শুরু করেছে।

_____

নিজ রুমে বসে চোখের জল ফেলছি আমি! কস্মিনকালেও ভাবিনি এইরকম জঘন্য পরিস্থিতিতে পড়বো আমি। তাও আবার রায়হান ভাইয়ার সাথে! যাকে আমি এতটা সম্মান করি। এখন তো তার দিকে চোখই মিলাতে পারবোনা আমি আর। দাদি ইতোমধ্যেই রেগে হইচই শুরু করে দিয়েছেন! তার শান্তশিষ্ট নাতিকে নাকি রুপের জালে ফাসিয়েছি আমি। পরের মেয়ে কোনোদিন আপন হয়না! তার কথা শুনে মনে কস্ট লাগলেও ঠিক কি রিয়েকশন দিবো ভেবে পাচ্ছি না আমি! প্রমাণই বা কি আছে আমার কাছে? কিছুই তো করার নেই আমার। আমি বললেও কেউ বিশ্বাস করবেনা হয়তো।

আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের এলোমেলো চেহারার দিকে তাকালাম আমি। কেদেকেটে কাজল লেপ্টে গেছে চোখের চারপাশে। ভাবলাম আদৌ এটা লেখা ছিলো আমার কপালে? কি দোষ করেছি আমি!
এই অপমানের দাগ কিভাবে মিটাবো আমি নিজের চরিত্র থেকে? কিন্তু আমার চোখের জলের সাক্ষী হিসেবে সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ নেই পাশে।

#চলবে

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ১০
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

আত্মসম্মান। শব্দটা ছোট হলেও তার গুরুত্ব ব্যাপক। একজন মানুষ সবকিছু হারালেও দিনশেষে আত্মসম্মানের জোরেই মাথা উচু করে দাড়াতে পারে। ঠিক তেমনি একজন সব পেয়েও যদি আত্মসম্মানকে বিসর্জন দেয় তবে নিজের চোখে নিজেই সে ছোট হয়ে যায়! একিভাবে আজকের ঘটনায় শুধু আমার চরিত্রেই নয় বরং প্রশ্ন উঠেছে আমার আত্মসম্মানের উপরেও। এতটা বছর যাদের বাসায় থাকলাম, যাদের সাথে মিলেমিশে আপন করে নিলাম আমি দিনশেষে একটা সামান্য দূর্ঘটনায় আমাকে দোষ দিতে একবারও খারাপ লাগলোনা তাদের?

কত সহজেই না বলে দিলেন দাদি যে পরের মেয়ে কখনও আপন হয়না! তবে এতদিন তাদের সাথে আমার যে এত ভালো সম্পর্ক সেটা কি নিছক অভিনয়? ঘটনার গম্ভীরতায় আমায় সর্বদা সাপোর্টকারি আন্টিও চুপ হয়ে গেছেন আজকে। একদিকে তার ছেলে অন্যদিকে আমি। বুঝলাম উনি দ্বিধায় আছেন৷ তবে আমি কোন দ্বিধায় নেই।

আজকে দাদির বলা কথাগুলো আমার আত্মসম্মানে আঘাত হেনেছে। এই ঘটনার পরেও যদি আমি এই বাসায় থাকি তবে নিজের চোখে আমি নিজেই ছোট হয়ে যাবো। আত্মগ্লানি আমায় কুড়ে কুড়ে খাবে রোজ। তাই এত বছরেও যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস পাইনি আজ কিছু মুহুর্তের মাঝেই এমন শক্তপোক্ত ডিসিশন নিয়ে ফেললাম আমি। দুই হাতে চোখের পানি মুছে আলমারি থেকে ব্যাগ বের করে গুছাতে লাগলাম। এতদিন বিভিন্ন কাজের জন্য বরাদ্দ টাকা থেকে যে কয় টাকা জমা করেছি সব বের করলাম। উদ্দেশ্য এখন একটাই। এই বাড়ি ছেড়ে বের হওয়া। কাউকে কোন জবাবদিহি করবোনা আমি, কাউকে প্রমান দিবোনা। যার যা মনে করার করুক।

আলতো হাতে রুমের দরজা খুলে বাইরে উকি দিলাম কেউ আছে নাকি দেখার জন্য। তবে সবাই বসারঘরে জটলা পেকে থাকায় রুমের এদিকে কাউকে দেখা গেলোনা। বুঝলাম এখনি সময় চলে যাওয়ার। তাড়াতাড়ি ভেতর থেকে আমার ব্যাগ নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই রাইসাকে আমার দিকে আসতে দেখলাম। ওকে এই সময় আশা করিনি আমি! ভেবেছিলাম এতক্ষণে ওর বিদায় হয়ে চলে যাওয়ার কথা। তবে বেশিকিছু ভাবার আগেই ও এসে বললো,

—তুরফা, ড্রয়িংরুমে চল। তোকে ডাকছে।

—কে ডাকছে আমায়? আর কেনই বা ডাকছে? কারো কাছেই কোন জবাবদিহিতা করতে পারবোনা আমি আগেই বলে দিচ্ছি। তোরা যা ভাবার ভাব।

রাইসা আমার কথাকে পাত্তা না দিয়ে আমার হাত চেপে ধরলো শক্ত করে। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে ওর থেকে নিজের হাত সরানোর চেস্টা করতেই ও মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললো,

—দেখ তুরফা, অলরেডি অনেক দেরি হয়ে গেছে। এতক্ষণ শশুড়বাড়ি পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিলো আমার কিন্তু এখনও যাইনি। তারপরেও তুই যাবিনা?

এবার ওর কথা শুনে অপরাধবোধ জাগলো আমার ভেতর। ইশ রে বেচারি। কোথায় এই সময় বাসরঘরে বসে থাকার কথা ছিলো ওর আর এইসময় বাসায় বসে তামাশা দেখতে হচ্ছে ওকে! আর কিছু না বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত ব্যাগ নিচে রেখে রাইসার সাথে চললাম ড্রয়িংরুমের দিকে।

__________

বিয়েবাড়িতে আসা বেশিরভাগ মানুষ জড়ো হয়েছে এই বিশাল ড্রয়িংরুমে। এত আলো থাকার পরেও গুমোট, থমথমে পরিবেশ। রায়হান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন এক কোণায়, উনার পাশে গোমড়া মুখে দাদি বসে আছেন। অপরপাশে প্রান্ত ভাইয়াসহ তার ফ্যামিলি। প্রান্ত ভাইয়ার পাশে তাকাতেই পূর্ণ ভাইয়ার দিকে চোখ গেলো আমার। উনি সরাসরি তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে, তার চাহনি দেখে বুকের মাঝে ধক করে উঠলো আমার! মুখ অন্যদিকে করলাম আমি। ভাবতে লাগলাম কেনই বা ডাকা হয়েছে আমায় এখানে? চারদিকে হালকা গুঞ্জন শুনা যাচ্ছে। তার মানে আসলে কেউই জানেনা কেন সবাইকে একত্রিত করা হয়েছে এক জায়গায়!

আমার ভাবনার মাঝেই ইষৎ কেশে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো প্রিয়া৷ সবার মনোযোগ ওর দিকে যেতেই কয়েক ধাপ এগিয়ে রুমের মাঝখানে এলো সে। সবাই আগ্রহ নিয়ে ওর দিকে তাকাতেই বলে উঠলো,

—আমি প্রিয়া। আশা করি সকলে চিনেছেন। জামাইয়ের একমাত্র ছোট বোন। ফটোগ্রাফি করার বহু পুরোনো শখ আমার। নিজের ভালো লাগার জন্যই বিভিন্ন ছোটখাটো মুহূর্তের ছবি তুলে রাখি..

প্রিয়ার কথার মাঝখানেই দাদি বিরক্তির সুরে বলে উঠলেন,

—তোমার ছবি তুলতে ভাল্লাগে ভালো কথা। তে সেটা এতগুলা মানুষরে ডাকে কওয়া লাগবে? বাইরে যেয়ে ছবি তুলো, ভিডিও করো। কে মানা করসে!

—ও যখন কিছু বলতে চাইছে ওকে কথাটা পুরোপুরি বলতে দিন দাদি। নিশ্চয়ই টাইমপাস করার জন্য এই সময় সবাইকে ডাকা হয়নি।

প্রান্ত ভাইয়ার কড়া আওয়াজে বেলুনের মতো চুপসে গেলেন দাদি। যতই হোক নতুন জামাই বলে কথা, তার কথার উপর দিয়ে যাওয়া দাদি ঠিক মনে করলেন না তাই চুপ হয়ে গেলেন৷ দাদিকে চুপ হতে দেখে প্রিয়া আবার বলতে শুরু করলো,

—তো যা বলছিলাম। আমার ভিডিওগুলো নেহাৎ স্মৃতি ধরে রাখার জন্যই করে থাকি আমি। সাধারণত কাউকে দেখাইনা। তবে আমার কোন কাজ যদি কারও উপকারে আসে তবে সেটা সবাইকে দেখাতে আমার কোন আপত্তি নেই।

বলেই ও রাইসার দিকে তাকাতেই দেখি সে একটি প্রজেক্টর নিয়ে আসলো। ব্যাপারটা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে দুরুদুরু বুকে চেয়ে দেখতে লাগলাম ওদের কাজকর্ম। পুরো ঘরজুড়ে পিনপতন নীরবতা।

প্রিয়ার ফোনের সাথে কানেক্ট করতেই ভিডিও চালু হলো। বিয়েবাড়ির বিভিন্ন ছোটখাট মুহুর্ত ভিডিও দেখা গেলো। বর-বউয়ের কবুল বলা, সাইন করা, পর্যায়ক্রমে মেহমানদের খেতে চলে যাওয়া৷ ভিডিওর শেষ পর্যায়ে দেখা গেলো আমাকে। নিজেকে স্ক্রিনে দেখতেই চোখ বড় হয়ে গেলো আমার, শুকনো ঢোক গিললাম আমি। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আশেপাশে তাকিয়ে দেখছি আমি কেউ আছে কি না তারপর নিরিবিলি পেয়ে নিজের শাড়ির কুচি ধরে হেটে চলছি। সামনে এগিয়ে যেতেই রায়হান ভাইয়াকে দেখে চোখ বড় করে তাকিয়ে সরে যেতে ধরলাম আমি। এরপরের ঘটনা তো সবার জানা। ঘটনাটি মনে হতেই লজ্জায় অসস্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেললাম আমি। আর দেখতে পারবোনা আমি! ওই বাজে ঘটনা মনে করতে চাইনা আর!!

কিছুক্ষণ কোন আওয়াজ না পেয়ে আস্তে করে এক চোখ খুললাম আমি। ভিডিওটা বন্ধ হয়ে গেছে! বন্ধ স্ক্রিনের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন পূর্ণ ভাইয়া। তার হাতে প্রিয়ার ফোন। মনে মনে ভাবলাম তবে কি তিনিই বন্ধ করে দিয়েছেন ভিডিওটা?

এতক্ষণে চারপাশে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। যেই আন্টিরা আমার নামে বাজে কথা বলেছিলেন উনারা নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন। হয়তো এখন কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না! দাদিও থম মেরে বসে আছেন। প্রিয়া যে এমন ভিডিও দেখাবে তিনি আশা করেন নি তার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। সবার রিয়েকশন দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম আমি। কেননা তাদের ভেতরের কুৎসিত মন তো ঠিকই দেখে ফেলেছি আমি।

আন্টি হঠাৎ এগিয়ে আসলেন আমার দিকে। আমায় জড়িয়ে ধরে বললেন,

—আমি জানতাম তোর কোন দোষ নেই এখানে। তুই কখনোই এরকম হতেই পারিস না।

আন্টির কথা শুনে চুপচাপ চেয়ে রইলাম আমি। তাদের সবার প্রতি আমার চাপা অভিমান যেন আমাকে তাদের সাথে পুনরায় সহজ হতে দিচ্ছেনা। একটু পরেই কুৎসা রটনাকারী দুই আন্টির একজন নিজেদের পক্ষে বলে উঠলেন,

—মানছি ওটা একটা দূর্ঘটনা ছিলো। তবে এই ক্ষেত্রে আমাদেরকেও দোষ দেওয়া যাবেনা। চোখের সামনে দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েকে এমন আপত্তিকর পরিস্থিতিতে দেখলে যেকেউই অন্যকিছু ভাববে…

—তাই বলে না জেনে শুনে একজনের নামে এইরকম মিথ্যা অপবাদ দিতে আপনাদের বিবেকে বাধলো না? লাইক সিরিয়াসলি? আপনার নিজের মেয়ে হলে এমনটা করতে পারতেন?

আন্টির কথা শেষ না হতেই পূর্ণ ভাইয়ার গম্ভীর পুরুষালি আওয়াজে আমি সহ থমকে উঠলো পুরো ঘর। ভয়ে চুপ মেরে গেলেন সেই আন্টিটা। কিছু বলার সাহস পেলেননা নাকি ভাষা পেলেন না, সেটা ঠিক বুঝলাম না আমি। তবে তাকে চুপ করতে দেখে পাশের আন্টিটা বলে উঠলেন,

—একি বাসায় একসাথে সম্পর্কহীন দুই ছেলেমেয়ে বড় হলে তাদের মধ্যে যে কিছু থাকবেনা এটা ভাবাও কি অস্বাভাবিক বলো? তাই আমরা এমন কিছু ভাবলে ভুল কোথায় এখানে?

আন্টির কথা শুনে রাগে-ঘিন্নায় কুচকে গেলো আমার মুখ। মানুষের চিন্তাভাবনা এতটা নিচে কিভাবে হয়? একটু পরেই আবার পূর্ণ ভাইয়ার আওয়াজে মুখ তুলে তাকালাম আমি।

—তাহলে আপনার কথামতে তো তাহলে এক ছাদের নিচে ছেলেমেয়ে থাকাই যাবেনা। থাকলেই তাদের মধ্যে প্রেম হয়ে যাবে নাকি? একটু পর উনি থেমে বললেন, তবে সেটা বড় কথা না। আসল কথা হচ্ছে যে একটা মানুষ ধাক্কা লেগে আরেকজনের উপর পড়তেই পারে। এটা নিয়ে এমন কাহিনি করার কোন মানে হয়? হাউ রিডিকিউলাস!

—ঠিকই বলেছো ভাইয়া। আমার তো ভাবতেও অদ্ভুত লাগছে। কতটা লজিকবিহীন অপবাদ!
পূর্ণ ভাইয়ার কথায় সায় দিয়ে উঠলেন প্রান্ত ভাইয়া।

এদিকে তাদের দুই ভাইয়ের কথা শুনে দুই নাম্বার আন্টিটাও আর কিছু বলতে পারলেন না। মুখ কালো করে চেয়ে রইলেন। অন্যদিকে দাদি চারদিক চেয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলে উঠলেন,

—হয়েছে এখন, থামো সবাই। এসব হইচই-ঝগড়াঝাটি বিয়েবাড়িতে হইতেই থাকবো। এগুলা কোন ব্যাপার নাহ। কেউ কিচ্ছু মনে করেনি। তাইনা রায়হান,তুরফা?

দাদি আমাদের দিক চেয়ে থাকলেও আমি কোন জবাব দিলাম না। একিভাবে রায়হান ভাইয়াও দেখি চুপ হয়ে আছেন, তার মুখ দিয়েও কোন কথা বের হচ্ছেনা। হয়তো ঘটনার গাম্ভীর্যে আমার মতোই হতভম্ব হয়ে গেছেন তিনিও! যাই হোক, আমার ও রায়হান ভাইয়ার কাছে থেকে কোন জবাব না পেয়েও দাদি গায়ে মাখলেন না ব্যাপারটা। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সবাইকে বিদায়ের প্রস্তুতি নিতে তাড়া দিতে লাগলেন যেন এতক্ষণ কিছুই ঘটেনি বাসায়! একজন মানুষ এতটা স্বার্থপর কিভাবে হয় আমি বুঝলাম নাহ!

___________

ড্রয়িংরুম থেকে আস্তেধীরে বের হয়ে রাইসার রুমে চলে গেলাম আমি। কারণ ওখানে রাইসার সাথে প্রিয়াও আছে। আমার উদ্দেশ্য ওকে থ্যাংকস বলা। রুমে ঢুকতেই দেখি রাইসা ও প্রিয়া কথা বলছে। আমাকে ঢুকতে দেখে চুপ হয়ে গেলো ওরা। আমি মলিন হেসে বিছানায় গিয়ে বসলাম ওদের পাশে।

—থ্যাংক ইউ, প্রিয়া। আজ তোমার জন্য মানুষের সামনে আমার নির্দোষিতা প্রমাণ হয়েছে।
আস্তে করে বললাম। আমার কথায় প্রিয়া মুচকি হেসে ওয়েলকাম বললো। কিছুক্ষণ পর নিরবতা কাটিয়ে হঠাৎ বলে উঠলো,

—ভিডিও ক্রেডিট আমার হলেও ধন্যবাদটা কিন্তু বড় ভাইয়ার প্রাপ্য আপু। আমি তাকে ভিডিওটা দেখানোর পর আমাকে সবার সামনে কথা বলার সাহস ও-ই দিয়েছে আর এসব প্ল্যান-সেটাপ বড় ভাইয়াই করেছে আমাদের তিনজনকে নিয়ে!

প্রিয়ার কথায় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম আমি! দেখলাম ওর কথায় মাথা নাড়লো রাইসা। অর্থাৎ ও আর প্রান্ত ভাইয়াও এর মাঝে শামিল ছিলো?

মুহুর্তের মধ্যেই যেন চোখ অস্পষ্ট হয়ে আসলো আমার। পূর্ণ ভাইয়া আমার জন্য এতকিছু করলেন আর আমি জানলামও না? ওই রাগী-গম্ভীর লোকটার প্রতি হঠাৎ করেই শ্রদ্ধা ও সম্মানে ভরে উঠলো মন। যেখানে আমার এতদিনের সম্পর্কের মানুষগুলোই আমার উপর বিশ্বাস করলো না, আমার পক্ষে একটা কথা বলার সাহস পেলোনা সেখানে উনি মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়ে আমার জন্য এই কাজটি করলেন! সত্যিই জীবন বড়ই অদ্ভুত। কখন কোন মানুষ এসে জীবনে কোন ভূমিকা রাখে কেউ ভাবতেও পারেনা!!

মনে মনে কৃতজ্ঞ হয়ে ভাবলাম উনাকে ভদ্রতার খাতিরে হলেও সরাসরি একবার ধন্যবাদ জানানো উচিত আমার। পরক্ষনে মনে হলো, উনার সামনে গেলেই যেখানে আমার মনের মধ্যে ভয়ের উথাল-পাতাল ঢেউ সৃষ্টি হয়, সেখানে তাকে নিজ থেকে ধন্যবাদ কিভাবে দিবো? ভ্রু কুচকে বসে বসে ভাবতে লাগলাম আমি।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here