বৃষ্টিময়_প্রেম #পর্বঃ১৭,১৮

0
1180

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ১৭,১৮
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
১৭

ছাদের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি আমি, পাশেই রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন পূর্ণ ভাইয়া। আমাকে ও পূর্ণ ভাইয়াকে বিয়ের ব্যাপারে একান্তে কথা বলতে ছাদে পাঠানো হলো। আমরা কথা বলার পরই বড়াব্বুরা চলে যাবেন। আমি আড়চোখে চেয়ে আছি উনার দিকে। তবে পূর্ণ ভাইয়ার দৃষ্টি আমার দিকে নয়, দূর আকাশে অস্ত যাওয়া সূর্যের দিকে।
পড়ন্ত সূর্যের রক্তিম আভা উনার ফর্সা মুখে আছড়ে পড়ছে, সূর্যের লালিমা ও উনার পুরুষালি সৌন্দর্য মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে! সেদিকে নির্লজ্জের মতো নিষ্পলক চেয়ে আছি আমি। একটু পর হুশ ফিরতেই মনে মনে বকা দিলাম নিজেকে!
ভাগ্যিস উনি খেয়াল করেননি নয়তো কি ভাবতেন এভাবে উনার দিকে চেয়ে থাকার জন্য??

উনার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য গলা কেশে উনার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। উনি কিছু না বলেই এক পলক আমার দিকে চাইলেন। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে উনি চেয়ে থাকায় অসস্তিতে পড়ে গেলাম আমি। মুখ অন্যদিক করে ধীর গলায় বললাম,

—আপনি নির্দ্বিধায় “না” বলতে পারেন, বুঝেছেন?

আমার কথা শুনে ভ্রু কুচকে গেলো উনার। দুই ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কি বলছি। বিরক্তিতে চোখ কুচকে গেলো আমার। উনি কি জানেন না আমি কি বিষয়ে বলছি? নাকি ইচ্ছা করে আমার মুখ দিয়ে বিয়ের কথা উচ্চারণ করানোর জন্য এমন করছেন? বিয়ের কথা বলতে কি লজ্জা লাগেনা আমার? খুব খারাপ তো এই লোকটা!! আসলেই উনি কোনদিন ভালো হবেন নাহ।

—আপনি কি জানেন না আমি কোন বিষয়ে বলছি?
চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম উনাকে।

—নাহ তো। আমি জানিনা। বলো আমাকে, কোন বিষয়ে কথা বলছো তুমি?

এবার মুখ খুললেন উনি। বাকা হেসে বললেন কথাটা। উনার হাসি দেখে আমার গা জ্বলে গেলো। অনেককিছু বলতে যেয়েও বহুকস্টে নিজেকে থামিয়ে দাতে দাত চেপে উনাকে বললাম,

—দেখুন,, আপনি নিজেও জানেন আমি কোন বিষয়ে কথা বলছি। বড়াব্বু আমাদের দুইজনকে ভাবার জন্য সময় দিয়েছে কিন্তু আমরা দুজনই জানি আমাদের উত্তর কি। তাই আপনি ইজিলি মানা করে দিতে পারবেন। কোন ঝামেলাই আর হবেনা!

আমার কথা শুনে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। এক কদম এক কদম করে এগিয়ে আসতে লাগলেন আমার দিকে। উনার এগিয়ে আসায় ভড়কে গেলাম আমি। তাল মিলিয়ে পিছাতে লাগলাম আমিও। অবশেষে রেলিঙের কাছে পৌঁছে যাওয়ায় থামতে হলো আমাকে! আমি ততক্ষণে ভ্রু কুচকে দেখছি উনাকে, উনি মনোযোগ দিয়ে দেখছেন আমাকে! তার মতিগতি বুঝার চেস্টা করছি আমি।
হঠাৎ একটু পর উনি আমার কাছে থেকে সরে গিয়ে চোখ টিপ মেরে ফিসফিস করে বললেন,

—দেখা হচ্ছে কাল।

বলে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হেটে চলে গেলেন নিচে। উনার কথার মাথামুণ্ডু বুঝলাম না আমি। কাল আমাদের দেখা হচ্ছে এটা তো আমি জানিই! কাল কাবিন হোক বা না হোক, আমি তো বড়াব্বুর বাসায় এমনিতেও যাবো সুতরাং এভাবে চোখ টিপ মেরে কথাটা বলার কি আছে আমি বুঝলাম নাহ। লোকটা আসলেই অদ্ভুত!! অবচেতন মনে হঠাৎ প্রশ্ন এলো উনি আবার বিয়েতে “হ্যাঁ” বলবেন না তো? অবশ্য পরক্ষণেই নিজের চিন্তাকে হেসে উড়িয়ে দিলাম আমি। চুপচাপ হেটে চলে গেলাম নিচে বড়াব্বুদের বিদায় দিতে!!

________________

গোমড়া মুখে বসে আছি মাটিতে। হাতের জামাকাপড় চারদিকে ছড়ানো-ছিটানো।
আন্টি একটু আগেই ফোনে কথা বলছিলেন বড়াম্মুর সাথে। পূর্ণ ভাইয়া নাকি উনার জবাব দিয়েছেন। যেহেতু আমি শিওর ছিলাম উনি না বলবেন তাই মনের সুখে ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম বড়াব্বুর বাসায় যাওয়ার জন্য। কিন্তু আন্টির কাছ থেকে শুনলাম পূর্ণ ভাইয়া নাকি “হ্যাঁ” বলেছেন বিয়ের জন্য। এটা শুনেই আমার মাথা নস্ট হয়ে গেছে! উনি কিজন্য রাজি হলেন আমায় বিয়ে করতে? আশ্চর্য তো!

তখন লোকটাকে এতবার বললাম নির্দ্বিধায় না বলে দিতে কিন্তু উনি শেষ মুহুর্তে এসে পল্টি মারলেন কেন? ভালোই পল্টিবাজ তো লোকটা।
রাগে আমার গা রিরি করে উঠলো!!

আন্টি এসে আস্তে করে আমার পাশে বসলেন। আমার থমথমে মুখ দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

—তোর কি মন খারাপ? পূর্ণ বিয়েতে রাজি হয়েছে শুনে রাগ হচ্ছে তোর??

কিছু না বলে ছলছলে চোখে তাকিয়ে রইলাম আন্টির দিকে। উনি তা দেখে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

—দেখ মা, আমি জানি এই মুহুর্তে সিদ্ধান্ত নিতে তোর অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। হবেই না বা কেন? বিয়ের ব্যাপার, হুট করে সিদ্ধান্ত নেওয়াও যায়না। তবে তোর অভিভাবক হিসেবে আমি তোকে উপদেশ অবশ্যই দিতে পারি। কিছু কথা বলতে চাই। শুনবি?

আমি আস্তে করে মাথা নাড়লাম। কারণ বাবা-মা যাওয়ার পর থেকে উনিই আমাকে মানুষ করেছেন। আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সব ক্ষেত্রে ডিসিশন নেওয়ার সময় উনার মতামত দেওয়ার অধিকার আছে। আমি তাকে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারিনা। শুনলাম আন্টি বলছেন,

—আমি পূর্ণকে আগে থেকে চিনিনা। তাই ওর সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারবোনা ঠিকি কিন্তু এই কয়দিনের পরিচয়ে আমার এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে ছেলেটা সত্যিই চমৎকার! বাহিরে থেকে ওকে গম্ভীর মনে হলেও ওর মনটা কত ভালো সেটা আমি সেদিনই টের পেয়েছি যেদিন তোকে আর রায়হানকে নিয়ে গুজব রটে! আমরা তোর চেনা মানুষেরাই যেখানেই ভাবতে পাচ্ছিলাম না কিভাবে কি করবো সেখানে ও নিজ দায়িত্বে ওর বোনের সাথে প্ল্যান করে তোকে নির্দোষ প্রমাণ করে। অচেনা এক মেয়ের জন্য কয়জনই বা এরকম করবে বল? পূর্ণ সেদিনই আমার মনে ধরেছিলো। এমন দায়িত্ববান আর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষের হাতে তোকে তুলে দিলে আমার আর কোন চিন্তা থাকবেনা। আমি নিশ্চিত থাকতে পারবো ও সারাজীবন তোর খেয়াল রাখবে।

আন্টির কথা শুনে থমকে গিয়েছি আমি। হঠাৎ করেই মনের মধ্যে ঘুরতে থাকা ঝড় যেন কিছুটা শান্ত হয়েছে। আমাকে উনার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে আন্টি পুনরায় বললেন,

—আর একটা কথা না বললেই নয়। রায়হানের সাথে যেহেতু তোর বিয়ের কথাটা উঠেছিলো তাই সেই বিষয়েও আমি বলবো। রায়হান আমার ছেলে হলেও আমি চাইনি ওর সাথে তোর বিয়ে হোক কেননা এই বাসায় আমার শাশুড়ির হুকুম ছাড়া কিছু হয়না। এতদিন বহু কস্টে তোকে উনার অত্যাচার থেকে আগলে রেখেছি আমি। এভাবে সারাজীবন রাখতে পারবো সেটার গ্যারান্টিও নেই। তাই আমি নিজেই চাই তুই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যা, যেখানে তুই নিজের মতো করে বাচতে পারবি। নিজের সংসার, নিজের পৃথিবী হবে তোর। তোকে ছাড়া থাকতে কস্ট হলেও তোর বাকি জীবনের খুশির জন্য হাসিমুখে আমি তোকে এ বাসা থেকে বিদায় জানাতে চাই। আমি চাই আমার এ মেয়েটা আজীবন খুশি থাকুক!!

ছলছলে চোখে বলা আন্টির কথাগুলো আমার ভেতরকে নাড়িয়ে দিয়েছে। আসলেই উনি খুব ভালোবাসেন আমায়, একদম নিজের মেয়ের মতোই। এজন্যই এতকিছু বললেন। আন্টির প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসায় ছেয়ে গেলো আমার মন। উনি আমাকে ভাবার আরেকটু সময় নিয়ে চলে গেলেন। ঠান্ডা মাথায় ভেবে আমি আন্টির কথা মেনে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি পূর্ণ ভাইয়াকে বিয়ে করবো। জীবন যখন নতুন ধাপে প্রবেশ করার হাতছানি দিচ্ছে আমায় তখন আমার এক কদম আগে বাড়াতে দোষ কোথায়? আল্লাহর নাম নিয়ে আমিও “হ্যাঁ” বলে দিলাম বিয়েতে। এখন যা হবার তা দেখা যাবে ভবিষ্যতে!!

_________________

চোখের পলকে রাত পেরিয়ে দিন হয়ে গেলো। বিয়ের চিন্তায় বলতে গেলে নির্ঘুম রাতই কাটিয়েছি আমি এক প্রকার। ৮টা বাজতেক ডাক দিলেন আন্টি আমাকে। সকাল সকাল গোসল করে ফ্রেশ হতে বললেন। এক প্রকার পুতুলের মতোই সবকিছু করলাম আমি। একেবারেই ঘরোয়া আয়োজনে কাবিন হবে বলে বেশি কেউ নেই বাসায়। রায়হান ভাইয়াও নাকি অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে চলে গেছেন সকালবেলাই। অবশ্য উনি সত্যিই অফিসের কাজে গেছেন নাকি অন্য কারণে আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না কারণ উনার ছুটি আরও বাকি ছিলো যতদূর জানতাম। যাইহোক এখন এসব ভাবার সময় নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলাম আমি।

কিছুক্ষণ পরই বড়াব্বুর বাসা থেকে বড়াম্মু এসেছেন আমার জন্য শাড়ি নিয়ে। আমার আম্মুর বিয়ের শাড়ি নাকি ছিলো উনার কাছে, সেটা নিয়েই আসছেন আমার জন্য। মায়ের শাড়ি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ বুকের সাথে চেপে ধরে রাখলাম আমি, যেন আনমনেই মা-কে অনুভব করার প্রচেষ্টা। বড়াম্মু আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন উনি খুব খুশি হয়েছেন আমার সিদ্ধান্তে, বাসার সবাইও নাকি খুব খুশি! উনার বড়ছেলের অবশেষে বিয়ে হবে এই আনন্দে উনি নাকি ঘুমাতে পারেননি গতকাল! আমি আলতো হাসলাম উনার কথা শুনে। আমাকে ভালো করে নতুন বউয়ের মতো রেডি হতে বলে চলে গেলেন বড়াম্মু।

আন্টি নিজহাতে সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে তার মনের মতো করে সাজালেন আমাকে। এরপর থুতনি ধরে চুমু খেয়ে মাশাল্লাহ বললেন। আয়নায় নিজেকে বধুরুপে দেখে নিজেই চমকে গেলাম আমি। বেশ খানিকটা লজ্জাও লাগলো। বেশ ভালোই লাগছে দেখতে আমায়!
একটু পরই পূর্ণ ভাইয়ারা আসবেন। উনার আসার কথা ভেবেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেলো আমার। সত্যিই তার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে?? মনে পড়ে গেলো আমাদের বৃষ্টিতে প্রথম দেখা হওয়ার মুহুর্ত, আমাদের ঝগড়াগুলো, উনার আড়াল থেকে আমাকে সাহায্য করা। সময় কত দ্রুত চলে যায়!!

কিছুদিন আগেই উনার সাথে পরিচয় হলো আর খানিকক্ষণ বাদে আমাদের বিয়ে?? কি থেকে কি হয়ে গেলো, কখনো কি ভেবেছিলাম আমি?
ধুকধুক করতে থাকা হৃদয়ে বড়াব্বুদের আসার অপেক্ষা করতে লাগলাম আমি!!

#চলবে

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ১৮
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা

“বরপক্ষ এসে গেছে” তিন শব্দের কথাটিই আমার মনে শিহরণ জাগানোর জন্য যথেষ্ট ছিলো! ঠান্ডা হাত-পা যেন আরেকটু গুটিয়ে গেলো আমার! মাথা নিচু করে নিজরুমে চুপচাপ বসে আছি। একটু পরই রুমে প্রবেশ করলো রাইসা। এসেই আমার পাশে দাঁড়িয়ে মুখটা তুলে দাত কেলিয়ে মাশাল্লাহ বললো। আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,

—এত দেরি করে আসলি কেন তুই? বিয়ে হতে না হতেই তো আমাকে ভুলে গেছিস!!

—সরি তুর সোনা, তুই বিয়ের জন্য রাজি হয়েছিস শুনে আমি কাল রাতেই আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোর ভাইয়া আসতে দেয়নি! পরে আমিও ভাবলাম এখন তো আমি ছেলেপক্ষের তাই আজকেই এলাম। আমি এখন তোর বোন না, তোর হবু জা। বুঝেছিস? সম্মানের সাথে কথা বল আমার সাথে!

ওর কথা বলার ধরন দেখে হেসে ফেললাম আমি! আমার হাসি দেখে রাইসা বললো,

—জানিস তুরফা, আমার না বিশ্বাসই হচ্ছেনা তুই আর আমি একি ঘরের বউ হয়ে থাকবো! আমি সবসময় এটাই চাইতাম যেন আমরা দুজন আলাদা না হই আর এখন এটা সত্যি হতে দেখে আমি এক্সাইটমেন্টে থাকতে পাচ্ছিনা!! আর সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো পূর্ণ ভাইয়া বিয়ের জন্য রাজি হয়েছেন?? ওহ মাই গড!! আমি জাস্ট ভাবতে পাচ্ছিনা এই অসম্ভব কীভাবে সম্ভব হয়ে গেলো?? সত্যি করে বল তো, তুই কোন জাদুটোনা করিস নি তো পূর্ণ ভাইয়ার উপর??

ওর কথা শুনে আমি চোখ পাকিয়ে তাকালাম ওর দিকে। ও ভেটকি হাসি দিয়ে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। আমিও আর কিছু বললাম নাহ! আমরা দুজন কিছুক্ষণ গল্প করার মধ্যেই আন্টি এলেন। এসেই বললেন,

—বরপক্ষ এসে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুরফাকে নিয়ে বের হতে হবে। আর তুরফা, তুই কি এখনও খাবিনা? সকাল থেকে খাওয়ার কথা বলছি কিন্তু তোর খাওয়ার নাম-গন্ধই নেই! কাল রাত থেকে কিছু খাসনি। এভাবে চললে হবে? দেখা যাচ্ছে বিয়ের আসরেই অজ্ঞান হয়ে যাবি!
রেগে বললেন আন্টি।

—ওফফো আন্টি তুমিও কিসব বলছো? আমি কি সিরিয়ালের নায়িকা যে একদিন না খেলেই অজ্ঞান হয়ে যাবো?
হেসে বললাম আমি কিন্তু আন্টি চোখ পাকিয়ে তাকালেন আমার দিকে তাই নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,

—আমার প্রচন্ড নার্ভাস লাগছে আন্টি। একটুও খেতে মন চাচ্ছেনা। কেমন যেন বমি বমি লাগছে, খুব অসস্তি হচ্ছে মনের ভেতর।

আন্টি এবার একটু নরম হয়ে গেলেন। আমার পাশে বসে গালে হাত রেখে বললেন,

—দেখ মা, বিয়ের আগে এটা হওয়া খুব স্বাভাবিক। সব মেয়েরই এমন লাগে। তাই তোরও লাগছে। চিন্তা করিস না, ঠিক হয়ে যাবে।

আন্টি আর কিছু বলার আগেই আংকেল নক করে রুমে আসলেন। উনি এসেই বললেন

—কি করছো তোমরা?? বাহিরে ছেলেপক্ষরা সবাই আছে। কাজি সাহেবও এসে গেছেন। তাড়াতাড়ি তুরফাকে নিয়ে এসো।

আংকেলের কথা শুনে উনার সাথে বের হয়ে গেলেন আন্টি। তার পাচ মিনিট পর আমাকে নিয়ে বের হলো রাইসা। দুরুদুরু বুকে এগিয়ে চললাম আমি, নিজের নতুন জীবনের দিকে।

_________________

মেরুন রঙা পাঞ্জাবি পড়ে বসে আছেন সামনে পূর্ণ ভাইয়া। আড়চোখে এক পলকে উনাকে দেখে নিলাম আমি। যেহেতু বিয়েটা খুব সাদামাটাভাবে হচ্ছে তাই উনিও বেশ সাদামাটা লুকেই এসেছেন৷ কিন্তু এই সাদামাটা লুকেই উনাকে কি মারাত্মক লাগছে আনমনে ভাবলাম আমি! ব্রাশ করা চুলগুলো সামনের দিকে হালকা এলোমেলো, হাতের ঘড়িতে টাইম দেখছেন। এখন কিসের সময় দেখছেন? বিয়ে শেষ করেই আবার অফিস যাবেন নাকি? অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম আমি! অবশ্য উনার পক্ষে এটাও সম্ভব!!
এদিকে সামনে যে উনার হবু বউ বসে আছে সেদিকে কোন খেয়াল আছে উনার? আসলেই অনেক বোরিং একটা লোক। মুখ ফুলিয়ে ভাবলাম আমি!

পূর্ণ ভাইয়ার এক পাশে দাঁড়িয়ে প্রান্ত ভাইয়া, প্রিয়া। অন্যপাশে বড়াব্বু ও বড়াম্মু। তাদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম পূর্ণ ভাইয়া বাদে সবাই আমার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছেন। তারা কি দেখলো নাকি আমি উনার দিকে চেয়েছিলাম? ইয়া আল্লাহ! ছিঃ ছিঃ!!
তাদের হাসিতে লজ্জায় আরও বেশি অসস্তিতে পড়ছি আমি। একেতো কিছু না খাওয়ায় মাথা এমনিই ঘুরছিলো, এখন লজ্জায়-অসস্তিতে যেন আরও ভনভন করছে মাথার ভেতর আমার!

এদিকে কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু সেদিকে আমার খেয়াল নেই, মাথার উপর ফ্যান থাকা সত্বেও ক্রমাগত ঘেমেই চলেছি আমি। তখন আন্টিকে খাওয়ার কথা হেসে উড়িয়ে দিলেও এখন সত্যিই শরীর খারাপ লাগছে আমার!! ইশ একটু খেতে পারলে ভালো লাগতো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাইসার হাত শক্ত করে চেপে ধরলাম আমি। ও কাধে হাত দিয়ে সাহস দিচ্ছে আমায়। বেচারি বুঝতে পাচ্ছেনা আমার শরীর খারাপ লাগছে, হয়তো ও মনে করছে আমি নার্ভাস তাই সান্ত্বনা দিচ্ছে ওভাবে। এদিকে ক্ষুধায় আমার পেটের মধ্যে রীতিমতো মহাভারত শুরু হয়ে গেছে!! কিন্তু এখন কাউকে খাওয়ার কথা বলাও যাবেনা কারণ, কানে এলো কাজি সাহেব এতক্ষণে আমাকে কবুল বলার জন্য জিজ্ঞেসও করেছেন।

“কবুল” শব্দটা শুনেই গলার মধ্যে শব্দগুলো দলা পেকে গেলো ছোট্ট একটা শব্দ অথচ তার কত জোর!! কোনমতে নিঃশ্বাস নিয়ে ধীর গলায় বলে ফেললাম “কবুল”। এক এক করে তিনবার কবুল বলে পিছনের দিকে গা এলিয়ে দিলাম আমি। আন্টি এসে ধরলেন আমায়। উনার সাথে ঠেশ দিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিলাম আমি। একটু পর পূর্ণ ভাইয়ার রাশভারি আওয়াজে “কবুল” শুনে বুকের ভেতর ধক করে উঠলো আমার। কাজি সাহেবের মুখে “বিয়ে হয়ে গেছে” শুনে মনের মধ্যে শিহরণ বয়ে গেলো আমার! সবার মুখে “আলহামদুলিল্লাহ” ধ্বনি শুনে রন্ধ্রে রন্ধ্রে কম্পন উঠলো!

আমি ও পূর্ণ ভাইয়া এখন থেকে স্বামী-স্ত্রী?
এত দ্রুত ঘটে গেলো ব্যাপারটা যে বিস্ময়তার রেশ লেগে আছে আমার চোখে-মুখে।

এদিকে মন বলছে আমার এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার বিদায়-ঘন্টা বাজছে!!

______________

গাড়িতে বসে আছি জানালার পাশে, সব ফর্মালিটিজ শেষ, এখন চলে যাওয়ার পালা। বাহিরে আন্টি কেদে কেদে পূর্ণ ভাইয়ার হাত ধরে বারবার আমার খেয়াল রাখার জন্য বলছেন যা বুঝতে পাচ্ছি দূর থেকে। তবে উনি কি বলছেন তার উলটোদিক হয়ে থাকার কারণে আমি বুঝতে পাচ্ছিনা। এদিকে আয়নায় নিজের শুকনো মুখ আর চোখের নিচের লেপ্টে যাওয়া কাজল দেখে ভাবলাম, জীবন কতটা চমকপ্রদ! সারাজীবন ভেবেছিলাম যেদিন আমি নিজের পরিবার ফিরে পাবো সেদিন নাচতে নাচতে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। অথচ আজ নাচতে নাচতে দুরের কথা হাসতে হাসতেও যেতে পাচ্ছিনা। সবার থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় আন্টির অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকালেই যেন তার এত বছরের ভালোবাসার কথা মনে পড়ে বারবার আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছি আমি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলাম আসলেই উনাকে বড্ড মিস করবো আমি!

আমার চিন্তাভাবনার মধ্যেই পূর্ণ ভাইয়া এসে গাড়িতে বসলেন আমার পাশে। আমাকে পূর্ণ ভাইয়ার গাড়িতে বসিয়ে বড়াব্বুরা সবাই অন্য গাড়িতে করে যাচ্ছেন। ওই গাড়ি ড্রাইভ করবেন প্রান্ত ভাইয়া আর আমাদের গাড়ি ড্রাইভ করছেন পূর্ণ ভাইয়া।

এতক্ষণ যাবত বসে আছে অথচ উনি কিছু বলছেন না। প্রচন্ড বিরক্তিতে মেজাজ খারাপ হচ্ছে আমার, সেই সাথে চোখে ভর করছে রাজ্যের ঘুম। রেগে উনার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলাম, আচ্ছা, লোকটা এত কম কথা বলে কেন? এতটা গম্ভীরতা আমার সহ্য হচ্ছেনা!! তবে আমি কিছু বলতে চেয়েও পরে ভাবলাম থাক না! উনার যদি আমার সাথে কথা না বলে থাকতে কোন অসুবিধে না হয় তাহলে আমিও কিছু বলবোনা! হুহ!

জানালা দিয়ে রাস্তা দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম এমন সময় গাড়ি হঠাৎ ব্রেক করায় ভড়কে গেলাম আমি। পাশে তাকিয়ে দেখি সিটবেল্ট খুলছেন পূর্ণ ভাইয়া। এই মাঝরাস্তায় উনি আবার কই যাবেন? আমাকে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছেন না তো? আমি তো একবার মাত্র গিয়েছি বড়াব্বুর বাসায়। রাস্তাও ঠিকমতো চিনিনা। আমি তাহলে কিভাবে যাবো?? তাই ভয়ে ভয়ে উনাকে বললাম,

—আমাকে ছেড়ে যেয়েন না, প্লিজ।

উনি গাড়ির দরজা খুলে আমার কথায় থেমে অবাক চোখে তাকালেন আমার দিকে। অতঃপর দরজা লাগিয়ে আমার দিকে ফিরে বললেন,

—হোয়াট?? কি বললে তুমি, আরেকবার বলো?

আমি আগেকার মতোই ধীর গলায় বললাম,

—আমাকে এই মাঝরাস্তায় ছেড়ে চলে যেয়েন না, প্লিজ। আমি সত্যিই রাস্তা চিনিনা ঠিকমতো।

—কিহ!! তুমি ভাবছো আমি তোমাকে এখানে গাড়িতে ফেলে রেখে একা বাসায় যাচ্ছি?

উনি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করলেন আমায়। আমি বোকার মতো মাথা নাড়লাম। পূর্ণ কিছুক্ষণ হতাশ দৃষ্টিতে আমাকে দেখে বললেন,

—কাকে বিয়ে করলাম আমি? সত্যিই তুমি আমার ধারণার চেয়েও বেশি স্টুপিড, তুরফা। তোমাকে গাড়িতে একা রেখে গেলে আমি বাসায় কিভাবে যাবো? আর গেলেও বাসায় যেয়ে সবাইকে আমি কি বলবো? ওহ গড!! ইউ আর রিয়েলি ক্রেজি!!

চোখ পাকিয়ে বললেন উনি। উনার কথায় প্রথমে অবাক হলাম আমি। তার কথায় লজিক আছে। তবে মাঝরাস্তায় আর কিজন্য গাড়ি থামাবেন আমি কিভাবে জানবো? উপরন্তু স্টুপিড বলায় আবারো রাগ হলো আমার। আমিও চোখ পাকিয়ে বললাম,

—তো এই মাঝপথে গাড়ি থামিয়েছেন কেন? আমি আর কি ভাববো? এমনিতেই তো কোন কথা বলছিলেন না এতক্ষণ, তাই আমি ভাবতেই পারি আপনি আমার সাথে থাকতে চাচ্ছেন না। এজন্যই ভেবেছিলাম আমায় ফেলে চলে যাচ্ছেন এখানে। আর কোন কারণ হবে গাড়ি থামানোর?

—সিরিয়াসলি? এই তোমার বুদ্ধি? আমি চুপ করে ছিলাম কারণ আমি এমনিতেও কম কথা বলি। আর তাছাড়াও তুমি কেদেকেটে ভুত হয়ে গেছো, এখন যে ঝগড়া করছো দেখতে পুরো পেত্নীর মতো লাগছে। ভয় পেয়ে কখন না জানি আমার হার্ট অ্যাটাক হয়!

উনার কথা শুনে রাগে বোম হয়ে গেলাম আমি। আমাকে একই সাথে ভূত-পেত্নী দুইটাই বানিয়ে দিলেন? এই লোকের সাথে আমি একটু আগে বিয়ে করেছি? নিজের কপালের উপর নিজেরই দুঃখ লাগছে এখন। কথাই বলবো না আমি তার সাথে আর! রেগে মুখ ফুলিয়ে চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলাম আমি। ভেবেছিলাম উনি হয়তো সরি-টরি কিছু বলবেন কিন্তু নাহ! উনি তো পূর্ণ ভাইয়া! আমাকে পাত্তা না দিয়েই গাড়ির দরজা খুলে বাইরে চলে গেলেন।
আড়চোখে উনার যাওয়ার দিকে অভিমানী চোখ চেয়ে রইলাম আমি!

লোকটা এমন করে কেন সবসময় আমার সাথে? আর এই মাঝরাস্তায়ও বা কি কাজ আছে উনার?? দরজা খুলার চেস্টা করে দেখলাম উনি লক করে রেখে গেছেন আমায়! আরেকদফা মেজাজ খারাপ হচ্ছে উনার উপর!! কি এমন করতে গিয়েছেন উনি?

হতাশ হয়ে গাড়ির সিটের সাথে হেলান দিয়ে ভাবতে লাগলাম আমি..!!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here