বৃষ্টিময়_প্রেম #পর্বঃ১৯,২০

0
1142

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ১৯,২০
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
১৯

শরৎ এর মেঘগুলো উড়ে বেরাচ্ছে আপন গতিতে। গাড়ির জানালা দিয়ে আকাশের দিক চেয়ে চেয়ে মেঘের ছোটাছুটি দেখছিলাম আমি। আচমকাই মেঘমালা জড়ো হয়ে আচমকা ঝরে পড়লো ধরনীর বুকে! এই অসময়ে বৃষ্টি দেখে অবাক হলাম আমি। প্রায় সাথে সাথেই মনে এলো পূর্ণ ভাইয়া তো বাহিরে গেছেন, আর উনি তো ছাতাও নিয়ে যাননি! ভিজে যাবেন তো!! এই লোকটাও না! কি দরকার ছিলো এই মাঝরাস্তায় থেমে গাড়ির বাইরে যাওয়ার? পূর্ণ ভাইয়ার সাথে সাথে বৃষ্টির উপরও রাগ হলো আমার!
কি দরকার ছিলো এ অসময়ে বৃষ্টি আসার? উনি গাড়িতে আসার পর বৃষ্টি এলেই হতো!

খানিক বাদে নিজের চিন্তাভাবনার উপর নিজেই বেশ অবাক হলাম আমি! বিয়ে হতে না হতেই পূর্ণ ভাইয়ার জন্য এত চিন্তা করছি? নিজের এহেন আচরণকে নিজেরই ধারণার বাইরে মনে হচ্ছে আমার। হয়তো “বিয়ে” নামক পবিত্র বন্ধনের এটাই শক্তি! দু’দিন আগেও যাকে নিয়ে কিছু ভাবিনি, এখন তার জন্য চিন্তায় ছটফট করছে মন! আমার চিন্তাভাবনার মধ্যেই গাড়িতে ফিরে এলেন পূর্ণ ভাইয়া। মেরুন পাঞ্জাবিটা এটুকুতেই বেশ ভিজে গেছে, চুল বেয়ে পানি পড়ছে উনার! ভিজে যেন প্রচন্ড বিরক্ত উনি!

তার হাতে একটা বাদামি রঙা প্যাকেট। সেদিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম আমি। তবে উনি প্যাকেটটা কোলে রেখেই চুলে হাত দিয়ে মাথা ঝাকালেন বার কয়েক, তার চুল থেকে পানির ছিটেফোঁটা আমার গায়েও পড়লো। আমি চুপচাপ তাকে লক্ষ্য করছি। উনি এক পলক চাইলেন আমার দিকে। তারপর হঠাৎ করেই আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার শাড়ির আচল টেনে নিয়ে উনার মাথা মুছতে শুরু করলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি! বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটছে যেন! পিটপিটিয়ে কোনরকম উনার কর্মকান্ড দেখে যাচ্ছি আমি।
উনি নিজের কাজ করতে করতে আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন,

—এভাবে কি দেখছো?

—আ-আমি আপনাকে রুমাল দিচ্ছি, ওটা দিয়ে মাথা মুছেন। এটা আমার বিয়ের শাড়ি।
ইনিয়ে-বিনিয়ে বললাম আমি।

উনি থেমে ভ্রু কুচকে আমার দিকে এক মুহুর্ত তাকালেন, এরপর পুনরায় মাথা মুছে বললেন,

—বরই যদি না থাকে তবে বিয়ের শাড়ি দিয়ে কি করবে তুমি??

পূর্ণ ভাইয়ার মুখে এই প্রথম “বর” কথাটা শুনে একটা শিহরণ জাগলো মনে। একটি অচেনা অনুভূতিতে ছেয়ে গেলো আমার মন! তবে উনার না থাকার কথা শুনে কেন যেন খারাপ লাগলো আমার। এভাবে কেন বললেন উনি? আমি কি ওরকম কিছু বলেছি?
শুষ্ক মুখে বললাম,

—এটা আমার আম্মুর শাড়ি, এজন্যই বলছিলাম। অন্য কোন কিছু মিন করিনি আমি।

আমার কথায় পূর্ণ ভাইয়া থেমে গেলেন। সুন্দর করে শাড়ির আচলটি আমার কোলের উপর দিয়ে সরে গেলেন দূরে উনার জায়গায়। হাফ ছেড়ে যেন বাচলাম আমি! এতক্ষণ উনি কাছে থাকায় হৃদপিঞ্জর ছটফট করছিলো আমার। একটি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম! একটু পর উনি বাদামী রং এর প্যাকেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

—এটা নেও।

উৎসুক হাতে প্যাকেটটা নিয়ে খুললাম আমি। ভেতরে কি আছে বের করতেই দেখি চিকেন বিরিয়ানি আর সাথে একটি চামচ! বিরিয়ানি দেখে যেমন অবাক হলাম ঠিক তেমনি পেটের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পুরনো ক্ষুধা নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলো আমার! এমনিতেই বিরিয়ানি আমার খুব প্রিয়, এটা চোখের সামনে দেখে খাওয়ার লোভ সামলানো দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে আমার জন্য! কিন্তু উনার সামনে খেতে লজ্জাও লাগছে। তাই বললাম,

—এটা কেন এনেছেন?

উনি সামনের দিকে তাকিয়েই গম্ভীর গলায় বললেন,

—বিরিয়ানি নিশ্চয়ই মানুষ খাওয়ার জন্যই আনে। খেতে দিয়েছি, চুপচাপ খাও।

উনার কথা শুনে যেমন চমকে গেলাম ঠিক তেমনি ভালো লাগাও ছেয়ে গেলো অন্তরে। লোকটা এই বৃষ্টির মধ্যে আমার জন্য খাবার আনলেন! অতোটাও খারাপ না উনি। আনমনে ভাবলাম। পরক্ষণেই মনে হলো আমি খাইনি এটা উনি কিভাবে জানেন? আমি তো উনাকে বলিনি। তাই জিজ্ঞেস করলাম,

—আচ্ছা, আপনি কিভাবে জানলেন আমার ক্ষুধা লেগেছে? আমি তো আপনাকে বলিনি।

আমার কৌতুহলী কণ্ঠ শুনে এবার উনি তাকালেন আমার দিকে। বললেন,

—বিয়ের সময় যেরকম চেহারা করে রেখছিলে দেখে মনে হচ্ছিলো যেকোন মুহুর্তে অজ্ঞান হয়ে যাবা। এক সপ্তাহ অনাহারে আছো এমন লাগছিলো তোমাকে দেখে। শুধু আমি কেন, যেকেউ বুঝবে!!

উনার কথা শুনে অবাক হলাম আমি, তার মানে উনি আমাকে লক্ষ্যও করেছিলেন বিয়ের সময়? কই আমি তো দেখলাম নাহ! আমি তো উনাকে সবসময় ব্যস্তই দেখেছি। উনি আবার লুকিয়ে লুকিয়ে কখন দেখলেন আমাকে কে জানে! একিসাথে ভীষণ লজ্জাও পেলাম। তাই বলে আমার চেহারা দেখে এতোই অনাহারী মনে হচ্ছিলো? ছি! লজ্জা লজ্জা!!
আমার চিন্তার মাঝেই উনার রাগী গলার ধমক শুনে কেপে উঠলাম আমি,

—খাচ্ছোনা কেন? বৃষ্টির মধ্যে কস্ট করে নিয়ে আসলাম, এখন না খেলে সত্যিই মাঝরাস্তায় ফেলে রেখে যাবো তোমাকে।

উনার কথা শুনে ভয়ে তাড়াতাড়ি খেতে শুরু করলাম। এমনিতেও ক্ষুধা লেগেছে তার মধ্যে রাস্তাও চিনিনা, পূর্ণ ভাইয়ার বিশ্বাস নেই। সত্যিই ফেলে রেখে যেতে পারেন। তাই চুপচাপ খেয়ে নেওয়াই ভালো। বিরিয়ানিটা খুব মজা। খেতে খেতেই ভাবলাম উনাকে একবার ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। তাই বললাম,

—থ্যাংকস, ভাইয়া।

পূর্ণ ভাইয়া হঠাৎ গাড়ি ব্রেক করায় ভড়কে গেলাম আমি। গলায় বেজে গেলো খাবার। উনি আমার চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে পানি এগিয়ে দিলেন। পানি খেয়ে স্বাভাবিক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

—কি হলো, ভাইয়া? আবার গাড়ি থামালেন যে? আপনারও ক্ষুধা পেয়েছে? খাবার আনতে যাবেন আবার? আমার থেকে নিতে পারেন।

উনি হতাশ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বললেন,

—তুমি কি বললে আমায়??

তার কথায় ভ্রু কুচকে গেলো আমার। আমি আবার কি বলেছি এমন? তাই না বুঝে বললাম,

—কি বলেছি, ভাইয়া? আমি সত্যিই বুঝিনি।

—বুঝবে কিভাবে? তুমি তো স্টুপিড। তোমার না বুঝাটাই স্বাভাবিক। তুমি বুঝবে আমার এ আশাটা করাও বোকামি।

রাগী গলায় বললেন কথাটা। হয়তো আনমনেই কিছু ভুল বলেছি তাই আমি দুঃখী মুখ করে বললাম,

—সরি, ভাইয়া। প্লিজ আমাকে বলুন কি বলেছি। তাছাড়া আমি বুঝবো কিভাবে?

আমার কথায় যেন উনি খানিকটা নরম হলেন। ধীর গলায় বললেন,

—এত ভাইয়া ডাকছো কেন তুমি আমায়? আমি কি এখন তোমার ভাই লাগি?

এবার পূর্ণ ভাইয়ার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালাম আমি। এই সামান্য একটা বিষয়ের জন্য উনি এমন রিয়েক্ট করছেন? লোকটা আসলেই অদ্ভুত!! আমতা আমতা করে বললাম,

—তাহলে কি বলে ডাকবো? নাম ধরে ডাকতে বলবেন না, কেমন যেন লাগে আমার। আপনি তো আমার চেয়ে অনেক বড়।

আমার কথা শুনে উনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর রাশভারি আওয়াজে বললেন,

—আর যাই ডাকো, ভাইয়া ডাকবেনা। এটা শুনতে আমার কেমন যেন লাগছে।

অতঃপর আবার গাড়ি চালানোতে মনোযোগ দিলেন। উনার কথায় চুপচাপ মাথা নাড়লাম আমি। ভাবতে লাগলাম কি বলে ডাকবো উনাকে? সিরিয়ালের নায়িকাদের মতো “ও গো শুনছো?” বলবো? একটু পর নিজের ভাবনায় নিজের মনেই হাসলাম আমি কিন্তু উনাকে এটা বলে ডাকা অসম্ভব আমার জন্য! লজ্জায় মরেই যাবো আমি! তাই এ কথাটা নিজের মাঝেই লুকিয়ে রাখলাম। তারপর পুনরায় খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম।
__________________

বড়াব্বুর বাসায় পৌঁছাতেই সবাই হাসিমুখে বরণ করে নিলেন আমাদের। সবার কিছুক্ষণ গল্প-গুজব করে বড়াম্মু আমাকে ফ্রেশ হওয়ার জন্য পূর্ণ ভাইয়ার রুমে নিয়ে গেলেন। হাতে নতুন একটি কামিজ ধরিয়ে দিয়ে গোসলে পাঠালেন আমায়। সারাদিনের ধকল শেষে গোসল করে খুব আরাম লাগছে। আমি বের হতেই দেখি বড়াম্মু আমায় দেখে মুচকি হেসে এগিয়ে এলেন। বললেন,

—আমি জানি তুই শাড়ি পড়তে পারিস না ঠিকমতো। এজন্যই কামিজ দিয়েছি যাতে তোর সুবিধা হয়। তবে কাল সকালে কিন্তু শাড়ি পড়তে হবে মা তোকে, ট্রাই করে দেখিস। না পারলে আমাকে ডাকবি, ঠিকাছে?
বড়াম্মুর কথায় মাথা নেড়ে উষ্ম হাসি দিলাম আমি। একটু পরেই রুমে পূর্ণ আসবেন বলে উনি চলে গেলেন।

চুপচাপ বিছানায় বসে আছি। পূর্ণ আর আমি এক রুমে থাকবো ভেবেই আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। এই প্রথম কারো সাথে রুম শেয়ার করবো ভাবতেই লজ্জায় কুকড়ে যাচ্ছি আমি। একটু পর দরজা খোলার শব্দে মাথা তুলে তাকালাম। পূর্ণকে আসতে দেখে বুকের মাঝে ধুকপুকানি বেড়ে গেলো। দরজা লাগিয়ে রুমের এগিয়ে আসতে লাগলেন উনি। উনার এগিয়ে আসার সাথে আমার নিশ্বাসের তীব্রতা বাড়তে লাগলো…!!

#চলবে

কেমন লেগেছে জানাবেন অবশ্যই ❤️

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ২০
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা

বিছানায় গুটিশুটি মেরে বসে আছি। পূর্ণ রুমে ঢুকেই ওয়াশরুমে চলে গেলেন। বেশ খানিকক্ষণ সময় পর শাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুমের দরজা খুলে বের হলেন। দরজা খুলার শব্দ হওয়ায় সেদিকে তাকাতেই আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো! উনি ট্রাউজার পড়ে খালি গায়ে বেরিয়ে এসেছেন। উনার ভিজা ফর্সা শরীর বেয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পারছে পানি! সেদিকে তাকিয়েই গাল গরম হয়ে গেলো আমার! দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিলাম আমি! আচ্ছা এই লোকটার কি মাথা-টাথা গেছে নাকি? উনার রুমে যে একটা জলজ্যান্ত মেয়ে বসে আছে সেদিকে কি হুশ আছে তার? নাকি আমি রুমে আছি সেটা ভুলেই গেছেন?

আড়চোখে তাকিয়ে দেখি আলমারি থেকে টিশার্ট বের করে পড়ে ফেললেন উনি। সেটা দেখে স্বস্তি পেলাম আমি। উনি বেডের দিকে এগিয়ে আসতেই চোখাচোখি হলো আমাদের। আরেকদফা অসস্তিতে পড়লাম আমি! উনি চুপচাপ এসে আমার পাশে বসলেন। এদিকে এসির মধ্যেও আমি দরদর করে ঘামছি। পূর্ণ আমার দিকে না তাকিয়েই এসির পাওয়ার কমিয়ে দিলেন। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

—কি ব্যাপার? এত ঘামছো কেন? কোন অসুবিধা?

আমি ধীর গতিতে মাথা নাড়লাম যে না, কোন অসুবিধে হচ্ছেনা আমার। কিজন্য অসস্তি হচ্ছে সেটা উনাকে না-ই বলি! আমাকে চুপ দেখে পূর্ণ আর কোন কথা বললেন নাহ। একটু পর দেখি উনি আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। উনাকে এগিয়ে আসতে দেখে চোখ বড় হয়ে গেলো আমার। এদিকে আসছেন কেন এভাবে? মতলব তো ভালো লাগছেনা উনার! তবে খাটের একদম কিনারায় বসে থাকায় বেশি পিছাতেও পারলাম না আমি! চোখ-মুখ কুচকে বিছানার চাদর খামচে ধরে খাটের সাথে লেগে থাকলাম কোনরকম। একটু পর কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে চোখ খুলে দেখি উনি আমাকে পাশ কাটিয়ে ল্যাপটপ নিলেন সাইড টেবিল থেকে। তারপর নিজমনে ল্যাপটপ অন করে কাজ করতে লাগলেন। এদিকে নিজের চিন্তাভাবনায় নিজেই লজ্জা পেলাম আমি! কিসব ভাবছিলাম ছিহ!!

—কাল কি আপনি অফিস যাবেন?

আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম আমি। আমার প্রশ্নে একবার ভ্রু তুলে তাকালেন উনি। তারপর পুনরায় ল্যাপটপের স্ক্রিনে মনোযোগ দিয়ে বললেন,

—হ্যাঁ।কেন? কাল কোন বিশেষ কিছু আছে নাকি?

উনার কথায় বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুচকে ফেললাম আমি। এত রসকসহীন কেন লোকটা? বিয়ের পরেরদিন কেউ অফিসে যায়? অবশ্য পরে ভাবলাম বাসায় থেকেও উনি কি করবেন? আমাদের তো আর প্রেমের বিয়ে নয়। আমরা প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলিনা তেমন তাই উনার বাসা থেকেও বিশেষ লাভ নেই। এর চেয়ে অফিসই যাক উনি! উনার দিকে তাকিয়ে দেখি তার দৃষ্টি সোফায় রাখা আমার মেজেন্টা কালারের জামদানি শাড়ির উপর। একটু পরেই উনি বললেন,

—এটা কি মা দিয়েছে?

উনার কথায় মাথা নাড়লাম আমি।

—কাল সকালে শাড়ি পড়বে?

আবারও গালে হাত দিয়ে একি ভঙিতে মাথা নাড়লাম আমি। উনি এবার কঠিন গলায় বললেন,

—শাড়ি পড়তে পারো তুমি? নাকি সেদিনের মতো কালকেও খুলে যাবে?

এবার আর চুপ করে থাকতে পারলাম না আমি। রাগে ছাড়খাড় হয়ে গেলো অন্তর। উনি আবার ইনসাল্ট করছেন আমাকে! আমি কি ইচ্ছা করে কিছু করেছি! শাড়ি পড়তে না পারা কি আমার দোষ? তাই রেগেমেগে বললাম,

—আমার অনুষ্ঠান ছাড়া খুব একটা শাড়ি পড়া হয়নি কখনো। তাই পড়তে পারিও না ঠিকমতো। সবসময় আন্টিই পড়িয়ে দিতেন, ওইদিন আন্টি খুব ব্যস্ত ছিলেন তাই নিজে নিজেই পড়েছি। এ ব্যাপারে আমাকে খোটা দিবেন না কখনো বুঝেছেন?

আমাকে রাগতে দেখে উনি মোটেও বিচলিত হলেন নাহ। এক পলক আমাকে দেখে আবার কাজ করতে করতে বললেন,

—কাল সকালে ঠিকমতো শাড়ি পড়তে পারবে তো? কাল আবার কোনভাবে শাড়ি খুলে গেলে সবার সামনে আমার প্রেস্টিজ নস্ট হয়ে যাবে। এ রিস্ক আমি নিতে পারবোনা। তোমার মান-সম্মান থাকুক না থাকুক, আমার বেশ আছে তাই এখনি শাড়ি পড়া প্র‍্যাক্টিস শুরু করবে তুমি। ইউর টাইম স্টার্টস নাও।

উনার কথায় যেন আকাশ থেকে পড়লাম আমি! এই রাতের বেলা ক্লান্ত শরীর নিয়ে আমি শাড়ি পড়া প্র‍্যাক্টিস করবো? বলে কি লোকটা? পাগল নাকি উনি? বিস্ময় চেপে কোনমতে বললাম,

—আপনার কি মাথা নস্ট হয়ে গেছে? এখন ঘুমানো বাদ দিয়ে শাড়ি পড়বো আমি?

উনি কাজ রেখে এবার আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। তার চাহনি দেখে থমকে গেলাম আমি। এভাবে কেন তাকিয়ে আছেন হঠাৎ?

—বাইরের লোকজন তো মনে করবে এমনিতেও আজ রাতে তোমার ঘুম হবেনা। তাহলে রাত জাগলেও বা ক্ষতি কি??

কথাটা বলেই পুনরায় কাজ করতে লাগলেন উনি। উনার কথাটা বুঝতে আমার কয়েক সেকেন্ড লাগলো। অর্থ বুঝতে পেরে লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম আমি। লোকটা এমন বেহায়ার মতো কথা বলতে পারেন জানতাম না তো! কিছুক্ষণ থম মেরে থাকতেই উনি বললেন,

—কি হয়েছে? একবার বলেছি কানে যায়নি? নিজে নিজেই শিখে নেও। অন্যের উপর নির্ভরশীল না হয়ে সব বিষয়েই স্বাবলম্বী হওয়া দরকার সবার! তাই তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করো, নয়তো বাইরের লোকদের ধারণা সত্যি হতেও পারে!

উনার কথায় লজ্জায় অসস্তিতে মাথা ঘুরলো আমার। চোখ বড় বড় করে তাকালাম। মুখ দিয়ে আপনা-আপনিই বের হলো “ছিহঃ!!” তারপর তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে কামিজের উপরই শাড়ি পড়ার চেস্টা করতে লাগলাম ইউটিউব দেখে। নিজের কপালের উপর নিজেরই দুঃখ লাগছে এখন! কেউ কখনো শুনেছে বাসর ঘরে বর বউকে দিয়ে শাড়ি পড়ানো প্র‍্যাক্টিস করায়? এটা কেমন মানুষের সাথে ফেসে গেলাম আমি খোদা!!

বেশ কয়েকবার ব্যর্থ চেস্টা করে ক্লান্ত হয়ে গেলাম আমি। এদিকে পূর্ণ মনের সুখে বিছানায় হেলান দিয়ে নিজের মতো কাজ করেই যাচ্ছেন ল্যাপটপে। আমাকে শাড়ি পড়তে দিয়ে নিকে কাজের মধ্যে যেন ডুবে গেছেন। উনাকে দেখে মাথায় রাগ চড়ে গেলো আমার। নিজে হেলান দিয়ে আরাম করছেন আর আমি কস্ট করে শাড়ি পরবো? পারবোনা আর আমি। যেটুক শিখেছি যথেষ্ট শিখেছি। এরপর যা হবার দেখা যাবে। আর বড়াম্মু তো বলেছেনই আমি ঠিকমতো না পারলে তাকে ডাকতে। তাহলে তো আমার টেনশনই নেই। অযথা এই লোকের কথা শুনে কেন কস্ট করবো আমি? আমার কি রেস্টের দরকার নেই??

শাড়ি খুলে রেখে সোফায় ছুড়ে ফেললাম তারপর কিছু না বলেই বিছানায় বসে পড়লাম আমি। ভেবেছিলাম উনি হয়তো কিছু বলবেন এত তাড়াতাড়ি কেন উঠে এসেছি তবে আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি কিছু বললেন নাহ। মনে মনে একটা সস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি! আড়চোখে উনার দিকে তাকিয়ে বেডের সাথে হেলান দিলাম। উনি এখনও কাজ করে যাচ্ছেন, এদিকে আমি ঘুমের চোটে ঢলে পড়ছি একটু পর পর। হঠাৎ উনার গম্ভীর আওয়াজে ঝিমুনি কেটে গেলো আমার।

—এভাবে না ঝিমিয়ে সরাসরি ঘুমালেই পারো।

ঘুমুঘুমু চোখে উনার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লাম আমি। যেন এটারই অপেক্ষায় ছিলাম এতক্ষণ। উনার যত কাজ করার করুক! পারলে সারারাত ল্যাপটপ নিয়েই থাকুক! কিন্তু আমি এখন ঘুমালেই বাচি! বিছানায় গা এলিয়েই ঘুমপাখিরা উড়ে এলো আমার কাছে। অতঃপর কিছু বুঝে উঠার আগেই ঘুমের রাজ্যে প্রবেশ করলাম আমি!!

________________

সকাল সকাল শাড়ি হাতে দাঁড়িয়ে আছি। বাথরুমে ঠিকমতো পড়তেও পাচ্ছিনা। আয়না দেখে পড়তে পারলে ভালো হতো। দরজার ফাকা দিয়ে উকি মেরে দেখলাম পূর্ণ এখনও ঘুমিয়ে আছেন উপুর হয়ে। ঘুমালে সব মানুষকেই খুব ইনোসেন্ট লাগে, উনাকেও ব্যতিক্রম লাগছেনা! এখন কে দেখে বলবে বাচ্চার মতো উপুর হয়ে ঘুমানো এই লোকটা জেগে থাকলে এতটা গম্ভীর হয়ে যান? যাই হোক, উনি উঠার আগেই আমাকে রুমে গিয়ে শাড়ি পড়ে ফেলতে হবে। তাই পা টিপে টিপে রুমে প্রবেশ করলাম আমি!

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুচি করছি আমি, ড্রেসিং টেবিলের উপর ফোন রেখেছি, ওখানেই ইউটিউব দেখে দেখে শাড়ি পড়ার চেস্টা করছি। কাল রাতে প্রাক্টিস করার ফলে কিছুটা উপকারই হয়েছে আমার। বেশ সহজেই পড়ে ফেললাম শাড়ি। বড়াম্মুকেও ডিস্টার্ব করতে হলোনা এই সকালে। যাক উনার কথায় কিছুটা লাভবান তো হয়েছি। মনে মনে ভাবতে ভাবতেই শাড়ির আঁচল পিন গিয়ে গেথে নিলাম। হালকা সেজে বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে শেষবার নিজেকে আয়নায় দেখলাম। একদম নতুন বউ নতুন বউ লাগছে!! সাথে সাথেই মনে হলো আমি তো নতুন বউই!! নিজের ভাবনায় নিজেই হেসে পুনরায় আয়নায় তাকাতেই পূর্ণকে নড়েচড়ে উঠে বসতে দেখে পিছন দিকে ঘুরলাম আমি। উনি ঘুম থেকে উনি আড়মোড়া ভাংলেন। আমি কিছু না বলেই জানালার পর্দা সরিয়ে দিলাম। কালকের বৃষ্টির পর সকালের মিস্টি রোদ হাসিমুখে প্রবেশ করলো রুমজুড়ে!

পূর্ণ ঘুমুঘুমু চোখে চেয়ে রইলেন আমার দিকে। ঠিক যেমনটা চেয়েছিলেন এ বাসায় প্রথম আসার দিন। তবে আমি অবাক হলাম উনার ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা দেখে। উনি কি হাসছেন নাকি? ভ্রু কুচকে সেদিকে চেয়ে থাকলাম আমি। ঘুমের রেশ মনে হয় কাটেনি উনার! কিছুক্ষণ পর না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,

—কি হয়েছে? হাসছেন কেন?

আমার কথায় ভ্রু কুচকে তাকালেন উনি। একবার চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষন পর মাথা ঝাকিয়ে চোখ খুললেন। এরপর মুখটা আবার বাংলার পাচের মতো গম্ভীর করে বললেন,

—এভাবে সং সেজে বাইরে যাচ্ছো কেন? যে কারও হাসি পাবে তোমাকে দেখে।

কথাটা বলে আমাকে পাশ কাটিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলেন বাথরুমে। উনার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে রইলাম আমি। আয়নায় নিজেকে পরখ করে দেখলাম আরেকবার! নাহ খারাপ তো লাগছেনা আমায়! বেশ ভালোই দেখাচ্ছে কিন্তু তাও উনার মুখ থেকে ভালো কথা তো বেরোবে নাহ! খারাপ লোকটা সকাল সকালও ছাড়লোনা আমায়! রাগাতেই হবে আমাকে!

কথাই বলবোনা আমি উনার সাথে! কটমট করে উনার দিকে তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম আমি। যাওয়ার আগে লক্ষ্য করলাম উনার বাথরুমের দরজা আধখোলা রয়ে গেছে, বাথরুমের আয়না বরাবর দাঁড়িয়ে আছেন উনি! সেখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে উনার ঠোঁটের কোণে আবারও সেই মুচকি হাসি!!

পুনরায় ভ্রু কুচকে গেলো আমার। অদ্ভুত তো!! লোকটার হয়েছে কি সকালবেলা? এভাবে একা একা লুকিয়ে লুকিয়ে হাসছেন কেন??

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here