বৃষ্টিময়_প্রেম #পর্বঃ২৯,৩০

0
1198

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ২৯,৩০
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
২৯

সকালবেলা প্রিয়ার ডাকে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। ঘুমু ঘুমু চোখ মেলে ওর দিকে তাকাতেই বললো,

—ঘুম ভালো হয়েছে, ভাবী? কখন যে তোমার কাথাটা টেনে নিয়েছিলাম ঘুমের মধ্যে বুঝতেই পারিনি আমি। তোমাকে আবার মাঝরাতে উঠে অন্য কাথা নিতে হলো। সত্যিই সরি।

সদ্য ঘুম থেকে উঠে প্রিয়ার মুখে এমন কথার আগামাথা কিছুই বুঝলাম না আমি। নিজের দিকে তাকাতেই খানিকটা চমকে গেলাম। আমার শরীর একটা মোটা কাথা দিয়ে মুড়ানো। কিন্তু এটা তো আমি নেইনি। আমি ক্লান্ত হয়ে ওড়না দিয়ে গা ঢেকেই এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম রাতে। তার মানে এটা নিশ্চয়ই পূর্ণ এনে দিয়েছেন? এই লোকটা আসলেই পাগল। কখন এসে আমায় কাথা দিয়ে মুড়িয়ে দিয়ে গেলেন আমি টেরও পেলাম নাহ! উনার কর্মকাণ্ড প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করছে আমায়!

আমাকে থম মেরে বসে থাকতে দেখে প্রিয়া মাথা ঝাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। তবে আমি ওর কথার কোন উত্তর দিলাম নাহ। হালকা হেসে ওর গাল টেনে দিয়ে উঠে গেলাম। পূর্ণর আচরণে আমার মনটা ফুরফুরে হয়ে গেছে! হঠাৎ মনে হলো উনি আমাকে কাথা দিলে নিজে নিশ্চয়ই কাথা ছাড়াই ঘুমিয়েছেন? উনার যদি ঠান্ডা লাগে? আমারও উনার জন্য কিছু করা উচিত।

ভাবতে ভাবতেই চলে এলাম চুলোর পাড়ে। যেখানে দাদি আর কাকিমা বসে ছিলেন ইতোমধ্যেই। তাদের৷ গল্পের মাঝেই আমাকে আসতে দেখে হাসিমুখে বসতে বললেন দাদি। আমিও বসলাম দাদির পাশে। চুলোর দিকে তাকিয়েই দেখি কাকিমা দুধচা করছেন সবার জন্য। আমাকে সেদিক তাকিয়ে থাকতে বললেন,

—তোর না দুধচা খুব পছন্দ ছিলো? এখনও খাস নাকি ভালো লাগেনা আর? সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সবাই চা খায় এখানে। মনে আছে তো?

কাকির কথায় মুচকি হেসে মাথা নাড়লাম আমি। দুধচা আমার ছোট থেকেই ভীষণ পছন্দ! বরাবরই বিশাল আকারের চা-খোর আমি! আমি জানি আমাদের দাদুবাড়িতে সবাই ঘুম থেকে উঠে চা খায় আর এটাও মনে আছে যে তাজওয়ার ভাইয়া অর্থাৎ পূর্ণ বাদে সবাই এটা খায়। উনার দুধচা একেবারেই পছন্দ নাহ। উনি কফি পছন্দ করেন। একিসাথে এটাও মাথায় এলো যে উনার ঠান্ডা লাগতে পারে আর উনার কফি খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু উনি তো এই চা খাবেন নাহ। আবার দাদি-কাকিমাদের সামনে লজ্জায় আমি উনার জন্য কফি বানাবো এটা বলতেও পাচ্ছিনা। ইতস্তত মুখে চেয়ে আছি নিচের দিকে। কাপে চা ঢালার আওয়াজে উপরে তাকাতেই দেখি কাকি বলছেন,

—চায়ের ট্রে-টা নিয়ে গিয়ে টেবিলে রাখ তো, মা। তোর চাচুরা সবাই হয়তো উঠে গেছে এতক্ষণে। টেবিলে চা না পেলে আবার মাথা ধরবে সবার।

কাকির কথায় হাসি পেলেও ট্রে নিয়ে টেবিলে রাখতে গেলাম আমি। চাচুরা সবাই সোফায় বসে আছেন। প্রান্ত ভাইয়াও চলে এসেছেন। আমায় দেখে সবাই হাসি দিলেন, বিনিময়ে আমিও হাসলাম। পূর্ণ এখনও উঠেননি হয়তো, উনাকে চোখে পড়লোনা। সবাইকে চা দিতে দিতে দাদি-কাকিমাও এতক্ষণে রুমে চলে এসেছেন তাই আমি এই সুযোগে আস্তে করে কেটে পড়লাম রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে।

কফি খুজে পেতে বেশি বেগ পেতে হলোনা। সামনের দিকেই ছিলো। আমিও চটজলদি পানি গরম দিলাম চুলোয়। কফি বানানো প্রায় শেষের দিকে। কফি মগে ঢেলে যেই না রান্নাঘর থেকে বেরোবো এমন সময় দাদি এলেন সেখানে। দাদিকে দেখে খানিকটা বিস্ময় আর লজ্জা ঘিরে ধরলো আমায়! হাতের কফিমগ নিয়ে আড়চোখে দাদির দিকে তাকালাম। উনি মুখ টিপে হাসছেন। কিছুটা ব্যঙ্গাত্বক সুরে বললেন,

—এই কফিটা কার জন্য নিয়ে যাচ্ছো, বোন? আমার জানামতে তো তুমি কফি খাওনা।

দাদির কথায় লজ্জায় আরেকটু নুইয়ে গেলাম আমি!

—উফফো, দাদি তুমিও না…

দাদি হালকা হেসে আমার থুতনি ধরে বললেন,

—এটুকুতেই লাজরাঙা হলে চলবে? পাগলি একটা। তুই যার জন্য কফি বানিয়েছিস সে কিন্তু ঘুম থেকে উঠেছে। এখনও ওর রুমেই আছে। নিয়ে যা ওখানে।

দাদির কথায় লাজুক হেসে রুমের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমি। পথিমধ্যে শুনতে পেলাম দাদির মিহি কন্ঠের হাসি। হাসতে হাসতেই বললেন,

—তোরা দুজন পারিসও বটে! একজন মাঝরাতে বউয়ের যাতে ঠান্ডা না লাগে সেজন্য চুপিসারে নিজের কাথা মুড়িয়ে দিয়ে যায়, আরেকজন সকালবেলা যাতে বরের ঠান্ডা না লাগে সেজন্য লুকিয়ে লুকিয়ে কফি বানায়! নতুন বিয়ের এগুলোই মজা! তোর দাদার সাথে আমিও এমন সুখের মুহুর্ত কাটিয়েছি। তোদের প্রেম আমাদের চেয়েও মধুর হোক দোয়া করি!

দাদির কথায় যেমন চমকে গেলাম তেমনি খুশিও হলাম। তার মানে উনি খেয়াল করেছেন পূর্ণ যখন এসেছিলেন? ইশ কি লজ্জা!! আর খুশি লাগলো ভেবে যে আমার আর পূর্ণর মধ্যের সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে। যতটা আমি ভেবেছিলাম তার চেয়ে ভালোভাবেই হচ্ছে!

______________

রুমে ঢুকে দরজা ভিজিয়ে দেখলাম পূর্ণ মাত্র ফ্রেশ হয়ে আসলেন। উদোম শরীরে তোয়ালা কাধে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন। সেদিকে এক পলক চেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলাম আমি! লোকটা যখন-তখন উদোম হয়ে ঘুরে বেরায় রুমের মধ্যে! কেমন একটা অসহ্যকর ব্যাপার। কিন্তু উনার মধ্যে কোন হেলদোল দেখলাম নাহ। আমাকে দেখেও উনি ধীরেসুস্থে মুখ মুছে বিছানায় তোয়ালা রেখে অপর পাশ থেকে টিশার্ট নিয়ে পড়লেন। আমি আড়চোখে উনার দিক চেয়ে কিছু না বলে বেডের সাইড টেবিলে কফির মগ রেখে ভেজা তোয়ালা হাতে নিয়ে চলে যাচ্ছিলাম রুম থেকে। এমন সময় উনি মুখ খুললেন,

—বাহ! আজকে সূর্য কোনদিক দিয়ে উঠেছে? তুমি তো দেখি একদম বউ বউ আচরণ শুরু করে দিয়েছো সকাল সকাল!

কিছুটা রসিকতা করেই বললেন উনি। তবে এই মুহুর্তে তার রসিকতা আমার পছন্দ হলোনা। চোখ ছোট করে কোমড়ে হাত দিয়ে বললাম,

—কেন? আমি বউ বউ আচরণ করলে এত অবাক হওয়ার কি আছে? আমি কি আপনার বউ নই?

—বাপরে! সকালবেলাই ঝগড়া করার জন্য রেডি হয়ে আছো দেখি। কাল এতরাত পর্যন্ত হেটেও এত এনার্জি? পিচ্চি মানুষ এত এনার্জি কই পাও?

পূর্ণর কথা শুনে আরেকবার গায়ে জ্বালা ধরলো আমার। কই আমি তার জন্য কফি বানিয়ে এনেছি, একটু ভালো কথা বলবেন! তা নাহ। লোকটার তেতো মুখে সবসময় তেতো কথাই চলে। এজন্যই আমি আজকে ইচ্ছা করেই চিনি দিয়েছি তার কফিতে। একটু চিনি খাওয়ার অতীব প্রয়োজন উনার জীবনে! আমি উনার কথাকে পাত্তা না দিয়ে বারান্দায় তোয়ালেটা নেড়ে দিয়ে আসলাম। ইতোমধ্যে উনি কফির মগ হাতে নিয়ে বিছানায় বসে পড়েছেন। এক চুমুক মুখে দিয়ে মুখ বিষিয়ে বললেন,

—উফফ, এত মিস্টি কেন? হোয়াট ননসেন্স, তুরফা? তুমি কি জানোনা আমি কফিতে এত চিনি পছন্দ করিনা? নিজে তো শরবত বানিয়ে খাও-ই সাথে আমাকেও খাওয়ানোর ধান্দায় আছো নাকি?

—জি! ইচ্ছা করেই দিয়েছি। বেশ করেছি। কারণ আপনার এটাই দরকার এখন। মিস্টিমুখ করবেন তবেই তো মিস্টি কথা বলবেন। সারাদিন আপনার তেতো কথা শুনতে শুনতে মেজাজটাই তেতো হয়ে উঠেছে আমার!

বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে বললাম আমি! এর মধ্যেই শুনলাম উনার চাপাকণ্ঠের বিরবির,

—মিস্টিমুখ যদি করতেই হয় এভাবে কেন করবো? আরও তো উপায় আছে করার।

—এই, আপনি কি বললেন? জোরে বলেন।

—কেন? শুনার জন্য খুব আগ্রহ হচ্ছে বুঝি?

—হতেই পারে। ফিসফিস করে কথা বলেন কেন? যা বলার জোরেই বলবেন।

—জোরে বলতে আমার সমস্যা নেই, তুমিই লজ্জা পাবে। তখন আবার আমার দোষ হবে।

আমি কিছুক্ষণ পিটপিট চোখে তাকিয়ে রইলাম উনার দেখে। তার দুষ্টু হাসি দেখে বুঝলাম উনি অবশ্যই ভালো কিছু বলেননি তাই মুখ বাকিয়ে ধীরস্বরে বললাম,

—ছিহঃ!!

পূর্ণ হেসে পুনরায় কফি মুখে দিতেই মুখ বিষিয়ে ফেললেন আবার। করুণ কন্ঠে বললেন,

—সত্যিই খেতে পাচ্ছিনা, তুরফা। কফিতে এত চিনি একটুও ভালো লাগেনা আমার।

তার চেহারা দেখে মায়া লাগলো আমার। আসলেই হয়তো চিনি দেওয়া উচিত হয়নি যেখানে উনি পছন্দ করেন না বিষয়টা। তাই হালকা হেসে বললাম,

—আচ্ছা রাখুন, খেতে হবেনা। আপনার ঠান্ডা লাগতে পারে ভেবেই নিয়ে এসেছিলাম। তবে খেতে না পারলে জোর করবোনা। ফেলে দিন।

আমি স্বাভাবিকভাবেই বলে চলে আসছিলাম রুম থেকে। আমার হাত ধরে যাওয়ার পথে বাধা দিলেন পূর্ণ। পেছনে ফিরে দেখি উনি চোখ-মুখ বন্ধ করে কফিটা শেষ করলেন। একটু পর ম্লান হেসে বললেন,

—সে আমার চিন্তায় কস্ট করে কিছু বানিয়ে আনবে আর আমি তা খাবোনা এটা কি আদৌও সম্ভব? তাকে বলে দিও একদিন চিনি বেশি খেলে কিছু হবেনা!

এরপর আমার হাতে মগ ধরিয়ে দিয়ে রুমের বাহিরে চলে গেলেন। তার পিছু পিছু আমিও বের হয়ে এলাম। উনি ডাইনিং এ বসে হাসিমুখে কথা বলছেন চাচুদের সাথে। তার সদ্য ভাংগা চেহারায় এক অদ্ভুত মায়া বিরাজ করছে! যে মায়ার তিলে তিলে ডুবে যাচ্ছি আমি! প্রতিদিন যেন নতুন এক পূর্ণকে আবিষ্কার করছি আমি! একদিকে উনি আছেন সবার সাথে হাসিঠাট্টায় মত্ত, আর এদিকে তার প্রলয়ঙ্কারী হাসি আর কথা যে প্রতিনিয়ত আমার বুকে ঝংকার তুলছে সে কি খবর কি উনার আছে?

#চলবে

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৩০
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা

সকাল পেরিয়ে দুপুর হতেই দাদুবাড়ি জুড়ে চাচাতো-ফুফাতো কাজিনদের আগমন শুরু হয়ে গেলো। আমার সাথে দেখা করতে এতক্ষণে যে যার অবস্থান থেকে ছুটি নিয়ে চলে এসেছে সবাই! সবার হৈচৈ কোলাহলে দাদুবাড়ি ভরে গেছে একেবারে! দোতলার বারান্দা থেকে সবাইকে নিচে নামতে দেখে উচ্ছাসিত হাসলাম আমি! রুমে গিয়ে দেখি পূর্ণ ফোনে কথা বলছিলেন। মুখটা বাংলার পাচের মতো গম্ভীর করে রেখেছেন। হয়তো অফিসের কারও সাথে কথা বলছিলেন। যাই হোক, উনি ফোন রাখতেই আমি এগিয়ে গিয়ে হাসিমুখে বললাম,

—শুনুন, আমি নিচে যাচ্ছি। আপনিও চলুন। সব কাজিনরা চলে এসেছে।

—তুমি যাও। আমি একটু পর যাবো।

ফোন টিপতে টিপতে বললেন পূর্ণ। কিন্তু আমার ভালো লাগলোনা বিষয়টা। সব কাজিন বাসায় এলো আমাদের সাথে দেখা করতে আর উনি এখনও ফোনের মাঝেই ব্যস্ত। বেড়াতে এসেও মনে হয় কাজ থেকে নিস্তার নেই লোকটার! তাই খানিকটা জিদ করেই বললাম,

—কেন? এখন কেন যাবেন না আপনি? সবাই এতদিন পর ঈদ ছাড়া একসাথে হয়েছে! আপনিও চলুন না আমার সাথে নিচে!!

পূর্ণ কিছু বলার জন্য উদ্যত হচ্ছিলেন তার আগেই উচ্চস্বরে ফোন বেজে উঠলো উনার। ফোনের দিক চেয়ে উনি গম্ভীর মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

—একবার কথা বললে বুঝোনা কেন, তুরফা? তোমার মতো ফাকা বসে নেই আমি। আমার আরও কাজ আছে। এখন যেতে পারবোনা আমি।

অনেকদিন পর পূর্ণর রাগী সুরের কথা শুনে একরাশ অভিমান ভর করলো আমার মনে। সামান্য নিচে যাওয়ার জন্য জিদ করলাম বলে উনি আমায় এভাবে বলবেন ? হঠাৎ করে কি হয় উনার? এভাবে রাগ দেখাচ্ছেন কেন? উনার মতো ব্যস্ত নই বলে যা ইচ্ছে তাই বলবেন নাকি আমায়! অযথাই অন্য কারও রাগ আমার উপর ঝাড়লেন! এতক্ষণে অভিমানের রেশ ধরে চোখে ভর করতে শুরু করেছে বিন্দু বিন্দু অশ্রুজল। সেগুলো নিচে পড়ার আগেই উনার দিকে না তাকিয়েই চুপচাপ নিচে চলে আসলাম আমি। উনি যদি আমার উপর অযথা রাগ দেখাতে পারেন তবে আমিও উনার সাথে কথা না বলে থাকতে পারবো। বয়েই গেলো উনার সাথে নিচে নামতে আমার!

_____________

নিচে পৌঁছাতেই কাজিনমহলের মুখোমুখি হলাম আমি। বরাবরই সবার সাথে গল্পগুজব, হাসিঠাট্টা করতে আমার খুব ভাল্লাগে। আর সেটা কাজিনদের সাথে হলে তো কথাই নেই! আমায় দেখেই সবাই ঝাপিয়ে পড়লো আমায় জড়িয়ে ধরার জন্য! আমিও খুশিমনে কথা বললাম সবার সাথে! একিসাথে পরিচয় হলো তাদের সাথে এতবছর পর নতুন করে! আমার ফুপাতো ভাই তাসিন আমায় বললো,

—কি রে তুরফা, এতবছর কোথায় লুকিয়ে ছিলি? তোর বিরহে যে একজন শহীদ হতে চলেছিলো সে-খবর কি আছে তোর?

তাসিন ভাইয়ার কথা মাথার উপর দিয়ে গেলো আমার। কার কথা বলছেন তিনি? ভ্রু কুচকে বললাম,

—কি বললে কিছুই তো বুঝলাম না ভাইয়া। ভালোভাবে বলো।

—বুঝবি কিভাবে? এখনও বুঝতে দেয়নি যে সে।

বলেই মুখ টিপে হাসলেন তাসিন ভাইয়া। এদিকে কড়া চোখে তার দিকে তাকিয়ে তাকে থামিয়ে দিলেন প্রান্ত ভাইয়া। গম্ভীর মুখে বললেন,

—অনেক কথা বলছিস, তাসিন। এবার থাম। ভাই শুনলে কিন্তু খবর আছে তোর।

—ভাই নেই দেখেই তো বলছি। ভাইয়ের সামনে এসব বলার সাহস আছে নাকি আমার!

কাচুমাচু মুখ করে বললেন তাসিন ভাইয়া। এদিকে উনাদের কথা শুনে বোকার মতো তাকিয়ে আছি আমি। কারণ তাদের কথার আগামাথা কিছুই মাথায় ঢুকলোনা আমার। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ছোট ফুপুর মেয়ে দিশা আপু মুখ বাকিয়ে বললো,

—আরে কাকে কি বলছো তোমরা? তুরফার মাথায় এত ঘিলু নেই যে ও বুঝবে। ছোটবেলা থেকে সেই বোকার বোকাই রয়ে গেলো। পূর্ণ যে কোন দুঃখে তুরফাকে বিয়ে করতে গেলো কে জানে!

দিশা আপুর কথাটা কিছুটা তাচ্ছিল্যপূর্ণ ছিলো যা ভালো ঠেকলোনা আমার কাছে। এতক্ষণ বাকি কাজিনরাও আমায় ক্ষেপিয়ে অনেককিছুই বলেছে কিন্তু তাদের কথা দিশা আপুর কথার মতো লাগেনি। আপুর কথা শুনে মনে হলো উনি যেন খানিকটা অপমানই করলেন আমায় কিন্তু কেন বিষয়টা বোধগম্য হলোনা আমার!

আমার চিন্তার মাঝেই নিচে এসে উপস্থিত হলেন পূর্ণ। উনার গম্ভীর মুখ এতক্ষণে স্বাভাবিক হয়েছে। আমাদের দিকে এগিয়ে এসেই বললেন,

—কি ব্যাপার? সবাই চুপ হয়ে গেলো কেন? আমার পিছে আমার বউকে বুলি করা হচ্ছিলো নাকি?

পূর্ণর কথা শুনে মুখ টিপে হাসলো সবাই। শুধু দিশা আপু বাদে। উনার চাহনিতে স্পষ্ট বিরক্তি দেখা যাচ্ছে। এদিকে পূর্ণর মুখে “আমার বউ” শুনে আজ কোনরুপ প্রতিক্রিয়া দেখালাম না আমি। অন্যসময় হলে লজ্জায় আড়স্ট হয়ে যেতাম হয়তো তবে আজ উনার উপর আমার অভিমানের পাল্লাটা ভারী! একটু আগেই রুমে রাগ দেখিয়ে এখন এসে সবার সামনে “আমার বউ” বলা হচ্ছে! ঢং যত্তসব।
এক পলক তার দিকে চেয়েই মুখ ফিরিয়ে নিলাম আমি। সেই সাথে কানে এলো প্রান্ত ভাইয়ার আওয়াজ,

—বড় ভাইয়া, তুমি কোথায় ছিলে? সবাই বড্ড মিস করছিলাম তোমায় এতক্ষণ। এখন তুমি এসেছো, আরও মজা হবে। এই বৃষ্টিমুখর দিনে নাস্তা খেতে খেতে সবার মিলে জম্পেশ আড্ডা দিবো।

নাস্তার কথা কানে ঢুকতেই এখান থেকে কেটে পড়ার বাহানা পেলাম যেন আমি। পূর্ণর সামনে থাকার কোন ইচ্ছেই হচ্ছেনা আমার আপাতত। তাই সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

—ভালো কথা মনে করে দিয়েছ, প্রান্ত ভাইয়া। আমি এক্ষুনি নাস্তা নিয়ে আসছি।

আমার সাথে যোগ দিলো রাইসাও। দুজন মিলে চলে যেতে লাগলাম রান্নাঘরের দিকে। যেতে যেতেই কানে এলো প্রান্ত ভাইয়া পূর্ণকে বলছেন,

—এই গাধা তাসিনটা তুরফাকে সব বলেই দিচ্ছিলো বড় ভাইয়া। সময় থাকতেই আমি ওর মুখ বন্ধ করে দিয়েছি। ঠিক সময়েই তুমি এসেছো।

প্রান্ত ভাইয়ার প্রতিউত্তরে পূর্ণ কি বললেন আমার শুনা হলোনা। রাইসার কথার নিচে চাপা পড়ে গেলো সেই কথা। রাইসার সাথে কথা বলতে বলতেই রান্নাঘরে প্রবেশ করলাম আমি।

_____________

শরতের মেঘাচ্ছন্ন আকাশে বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব। আমার সাথে সাথে যেন আজ মেঘেদেরও মন খারাপ! যেকোন সময় যেন মন ভালো করতে বৃষ্টি হয়ে ধরা দিবে ধরনীর বুকে। এমন মেঘলা দিনে ছাদের মধ্যিখানে আসর জমেছে কাজিনমহলের। সবার হৈ-হুল্লোড়ের ভীড়ে যেন চাপা পড়ে যাচ্ছে মেঘের গর্জন! দমকা হাওয়া ছুটতেই আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠলো সবাই। আমার সেদিকে মন নেই। একদৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। আজ আমিও চাইছি বৃষ্টি নামুক। যে বৃষ্টিতে মন খারাপ ধুয়েমুছে একাকার হয়ে যায়। যে বৃষ্টিতে দুটি মন মিলেমিশে এক হয়ে যায়। হঠাৎ প্রান্ত ভাইয়ার উচ্ছাসিত আওয়াজ কানে এতে তার দিকে ফিরলাম আমি। পূর্ণকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

—বড় ভাইয়া, আজকে সময়ও আছে, সুযোগও আছে। এমন বৃষ্টিবাদল দিনে গান ছাড়া আড্ডা কোনভাবেই জমেনা। অনেকদিন তোমার গান শুনা হয়না। আজ একটা গান শুনাও না প্লিজ। তাসিন তো গিটারও এনেছে। ও বাজাবে, তুমি গান গাবে।

প্রান্ত ভাইয়ার কথায় উল্লাসে মেতে উঠেলো বাকি কাজিনরা। সবাই তাড়স্বরে চিল্লিয়ে উঠে সায় জানালো প্রান্ত ভাইয়ার কথায়। এর মধ্যে পূর্ণকে সবাই ঘিরে ধরেছে গান গাওয়ার জন্য। এত মানুষের ভীড়ে উনি শান্তচোখে চেয়ে আছেন আমার দিকে। আর তার দৃষ্টি অনুসরণ হতেই চোখ সরিয়ে নিলাম আমি। মনে মনে খানিকটা অবাকও হলাম। উনি আবার গানও গাইতে পারেন? কখনো শুনলাম না তো আমি। পরে অবশ্য মনে হলো উনাকে কয়দিনই বা পেয়েছি আমি যে গান শুনাবেন! রাগ আর খোচা মার্কা কথা ছাড়া আমার সাথে তো বেশিরভাগ কোন কথাই বলেন নাহ উনি! নিমিষেই মনটা হাহাকার করে উঠলো আবার। দুঃখী মুখে এক বুক অভিমান নিয়ে পুনরায় আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘের খেলা দেখতে লাগলাম আমি।

কয়েক মুহুর্ত অতিক্রম হলো। গিটারের রিনিঝিনি তাল কানে আসতেই চোখ তীক্ষ্ণ হলো আমার। আড়চোখে চেয়ে দেখি তাসিন ভাইয়া ইতোমধ্যেই গিটারে সুর তুলছেন। পূর্ণও আকাশের দিকেই চেয়ে আছেন এখন।

সবাই “পূর্ণ ভাইয়া পূর্ণ ভাইয়া” বলে চিয়ার করছেন উনার জন্য। উনি একটু পর শ্বাস নিয়ে হালকা হেসে খোলা গলায় গাইতে আরম্ভ করলেন,

~তুমি চাইলে বৃষ্টি, মেঘও ছিল রাজী
অপেক্ষা শুধুই বর্ষনের,
মাতাল হাওয়া বইছে, দূরে পাখি গাইছে গান
বৃষ্টি তোমার আহবান

সাদা রঙের স্বপ্নগুলো দিল নাকো ছুটি
তাইতো আমি বসে একা,
ঘাসফুলেদের সাথে আমি একাই কথা বলি
ঘাসফুল গুলো সব ছন্নছাড়া

তুমি চাইলে জোছনা, স্বপ্নীল কোনো এক রাতে
আকাশটা ঘিরে প্রার্থনা,
চাঁদটা বলবে হেসে, জোছনা এলে শেষে
জানিও তোমার অভ্যর্থনা~

গানটা আমার অনেক প্রিয় একটা গান। এই গানটার মধ্যে যেন মিশে আছে কিছুটা একাকিত্ব, লুকিয়ে আছে দীর্ঘ অপেক্ষার কোন স্মৃতি। পূর্ণর খোলা গলায় গানটা সত্যিই বড্ড মানিয়েছে যেটা ছিলো আমার আশাতীত! এমন বিষন্ন দিনে এর চেয়ে মানানসই গান আর হতে পারে বলে আমার মনে হলোনা। না চাইতেও চোখ চলে গেলো পূর্ণর দিকে! উনিও মাত্রই তাকালেন আমার দিকে। চোখাচোখির মুহুর্ত দীর্ঘকায় হলো। দুই চোখে কিছু না বলা কথা প্রেরিত হলো। আচমকাই আকাশের বুক চিড়ে গুড়িগুড়ি বৃষ্টির বর্ষিত হলো। যেন বৃষ্টি এতক্ষণ এই মুহুর্তেরই অপেক্ষায় ছিলো!

বৃষ্টি নামতেই সবাই হইহই নিচে নেমে গেলো আম কুড়াতে। দাদুবাড়ি এসেছে আর বৃষ্টির দিনে আম কুড়োবেনা এমনটা তো আর হতে পারেনা! পূর্ণ এখনও শান্ত-নিশ্চুপ। সবাই এতক্ষণে নিচে নেমে গেছে তাই আমিও চুপচাপ চলে যাচ্ছিলাম তাদের পিছু পিছু। হঠাৎই পূর্ণ শান্ত গলায় ডাকলেন আমায়।

—একটু পরে গেলে হয়না, তুরফা?

মায়াময় সামান্য আবদার। অথচ এই ডাকেও আজ মন গললোনা আমার। এভাবেই আমিও সকালবেলা বলেছিলাম তাকে, বিনিময়ে তার রাগ ও অবহেলা ছাড়া কিছুই পাইনি। তাই পেছনে না ঘুরেই তার কথাকে উপেক্ষা করে চলে যেতে লাগলাম নিচে। কিন্তু পূর্ণ ধপাধপ পা ফেলে এসে হাত ধরে ফেললেন আমার। তার দিকে ঘুরিয়ে আমার দিক চেয়ে কাতর চোখে কোমল কন্ঠে বললেন,

—অভিমানের পাল্লাটা কি খুব বেশি ভারী? অনেক রাগ করেছো আমার উপর?

এবার আর নিজের অনুভুতিগুলোকে সামলাতে পারলাম না আমি। অভিমানগুলো বৃষ্টির মধ্যেই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো আমার! পূর্ণর মাঝে কি অদৃশ্য মায়া আছে আমি জানিনা। যে মায়া সর্বদাই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে দেয় আমার মনকে!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here