বৃষ্টিময়_প্রেম #পর্বঃ৩৯,৪০

0
1266

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৩৯,৪০
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
৩৯

বৃষ্টির বেগ কমে এসেছে। বাতাস এখনও আগের মতোই বহমান। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছি দুজনে। নীরবতা ভেঙে পূর্ণ বললেন,

—ওই চকলেটটা কে দিয়েছিলো তোমায়?

চকলেটের কথা শুনে ভ্রু কুচকে গেল আমার। উনার মাথায় এখনও ওটা আছে? বিস্ময় চেপে ধীর কণ্ঠে বললাম,

—রায়হান ভাইয়া দিয়েছিলেন।

—কেন দিয়েছে?

—কেন দিয়েছে মানে? রাইসার থেকে শুনেছেন পরীক্ষায় ভালো করেছি তাই গিফট হিসেবে দিয়েছেন। এত প্রশ্ন করছেন কেন?

পূর্ণ জবাব দিলেন নাহ। চকলেটের কথা মনে হওয়ায় আমি বিছানার কাছে গিয়ে চকলেটটা তুলে খুলতে ধরবো তখনি পূর্ণ কেড়ে নিলেন হাত থেকে। অবাক হয়ে উনার থেকে সেটা নিতে যাবো কিন্তু উনি দিচ্ছেন না আমায়৷ বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলাম,

—আবার কি হয়েছে আপনার? চকলেটটা দিন না আমায়! আমি জানেন না আমার চকলেট কত পছন্দ! তবুও এরকম করছেন কেন?

—নাহ। তুমি খাবেনা এটা।

—কেন খাবোনা?

বিস্ময়ের চূড়ায় পৌঁছে প্রশ্ন করলাম আমি। পূর্ণ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। এরপর নিচু স্বরে বললেন,

—তোমার জন্য শুধু আমি চকলেট আনবো। অন্য কেউ কেন আনবে?

উনার কথায় চোখ সরু করে তাকালাম আমি। আনমনেই প্রশ্ন উঠলো উনি কি রায়হান ভাইয়ার থেকে জেলাস ফিল করছেন? কৌতুহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,

—আচ্ছা, আপনার কি হিংসে হচ্ছে রায়হান ভাইয়া আমায় চকলেট দিয়েছে তাই?

উনি এক পলক আমার দিকে তাকালেন, অতঃপর অন্যদিক মুখ ফিরিয়ে খুব ভাব নিয়ে বললেন,

—পূর্ণ কারও থেকে হিংসা করে না, বুঝেছো?

উনার ভাব দেখে হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি! দুনিয়া উলটে যাবে তবুও মহাশয়ের ভাব নেওয়া কমবেনা! তার চোখ-মুখের অভিভঙ্গি তার মনের কথার স্পষ্ট ইংগিত দিচ্ছে, অথচ উনি মুখে স্বীকার করবেন নাহ! যদি এই বিষয়ের উপর নোবেল দেওয়া হতো তবে নিঃসন্দেহে পূর্ণর ঝুলিতে দু-তিনটা এসে যেতো! উনার পেট থেকে কথা বের করে নেওয়া বিশ্বযুদ্ধ করার সমান। বিরক্ত হয়ে ভাবলাম আমি!

উনি অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন এই সুযোগে চকলেটটা তার থেকে কেড়ে নিয়ে কেটে পড়ছিলাম তখনি চোখ পাকিয়ে আমার হাত থেকে নিয়ে চকলেটটি এক পাশে ছুড়ে মারলেন উনি। বিস্ময়ে থতমত খেয়ে গেলাম আমি। পূর্ণ কিছু বলতে যাবেন তার আগেই প্রিয়ার গলা কানে এলো আমাদের,

—ওয়াও, এই চকলেটটা কে আনলো? আমার ফেবারিট।

তাকিয়ে দেখি প্রিয়া একহাতে চকলেটটি তুলে রুমে প্রবেশ করলো। পূর্ণ ওকে দেখে বললেন,

—তুই খাবি? তাহলে খা।

—ঠিক আছে। তবে যেটা বলতে এসেছিলাম তা হলো তোমাকে প্রান্ত ভাইয়া ডাকছিলো, বড় ভাইয়া।

প্রিয়ার কথায় মাথা নাড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন উনি। এদিকে আমি পূর্ণর আচরণে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। প্রিয়া চকলেটটা খেতে খেতে বললো,

—ভাইয়া চকলেটটা ছুড়ে ফেললো কেন, ভাবী? তুমি খাওনা এটা?

—কি যে? তোমার ভাইয়ের কথা! উনার মাথায় যে কি ঘুরে তা উনি ছাড়া কেউ জানেনা।

আমার কথায় হেসে উঠলো প্রিয়া। মুচকি হেসে দুষ্টু সুরে বললো,

—তবে আর যাই বলো, বড় ভাইয়া কিন্তু তোমার জন্য অনেক চিন্তা করে জানো? বাসায় যেয়ে তোমাকে না পেয়ে অস্থির হয়ে গিয়েছিলো।

—তাই? কিভাবে বুঝলে? উনি কি করছিলেন?

আগ্রহী দৃষ্টিতে বললাম আমি।

—রুমে যেয়ে যখন তোমাকে পেলোনা তখন পুরো বাসা খুজলো, আমরা বুঝেছিলাম তোমাকেই খুজছে তাও কেউ ইচ্ছা করেই তাকে কিছু বলিনি। পরে ভাইয়া নিজে থেকে এসে জিজ্ঞেস করে তোমার কথা। তখন ভাইয়ার চেহারা দেখে আমাদের সবার কি হাসি! পরে আম্মু তোমাদের এখানে আসার কথা বলেছে আর ভাইয়াকে ক্ষেপিয়েছেও তোমাকে নিয়ে। কিন্তু বড় ভাইয়া বরাবরের মতোই নির্বিকারভাবে ভাব নিয়ে ডায়লোগ দিয়েছে! কি বলেছেন জানো?

আমি কৌতুহলী কণ্ঠে মাথা নাড়লাম। প্রিয়া পূর্ণকে নকল করে বললো,

—আমার বউকে আমি খুঁজবোনা তো কে খুঁজবে, মা? এটা নিয়ে এত হাসাহাসির কি আছে?

প্রিয়ার অভিনয় দেখে আর পূর্ণ এসব বলেছেন ভেবে লজ্জায় পড়ে গেলাম আমি! নির্লজ্জ লোকটা এসব বলে এসেছেন বাসায়? এখন তো বড়াম্মুর সামনে যেতে আমার লজ্জা লাগবে! হঠাৎই আমার খোপায় বেধে রাখা মালা দেখে প্রিয়া বললো,

—আরেহ! বেলিফুলের মালা যে। কি সুন্দর স্মেল আসছে। বড় ভাইয়া এনেছে তাইনা? এজন্যই এত তাড়া ছিলো তার এ বাসায় আসার!

—এমন কিছুই না।

লাজুক হেসে বললাম আমি। প্রিয়া জ্ঞানী মানুষের মতো বললো,

—হ্যাঁ হ্যাঁ, সবই বুঝি। তাইতো বলি আজকাল আমার কাজপ্রেমী ভাই কিসের টানে বাসায় আসে!

—উফফো প্রিয়া, চুপ করবে তুমি?

—আচ্ছা চুপ করলাম। তোমাকে আর লজ্জা পেতে হবেনা। যাও!

প্রিয়ার সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে রুম থেকে বের হয়ে আসছিলাম। সিড়ির কাছে নিচে নামার সময় অসাবধানতাবশত প্রিয়ার স্যান্ডেলের উপর পা পড়ে যায় আমার। স্যান্ডেলে টান লাগায় ও টাল সামলাতে না পেরে সিড়ি দিয়ে পড়ে যেতে ধরে। আমি ভয়ে হকচকিয়ে প্রিয়াকে ধরতে যাবো এমন সময় এক পুরুষালি হাত ওকে ধরে ঠিক করে দেয়। আমি ভেবেছিলাম পূর্ণ বা প্রান্ত ভাইয়া হবেন হয়তো, তবে আআশ্চর্যজনক ভাবে ওটা ছিলেন রায়হান ভাই! প্রিয়াও আমার মতো অবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছে।

—দেখেশুনে চলাফেরা করবে।

প্রিয়াকে বললেন উনি। ঘোর কাটিয়ে উঠে প্রিয়া বলে উঠলো,

—থ্যাংকস, ভাইয়া। আপনি না থাকলে আজকে হাড্ডি একটাও আস্ত থাকতোনা আমার!

—সমস্যা নেই। এরপর থেকে দেখে হেঁটো।

রায়হান ভাইয়া মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে চলে গেলেন। ওদের দুজনের কথা শেষে আমি প্রিয়াকে বললাম,

—সরি বোন, আমি সত্যিই খেয়াল করিনি কখন তোমার স্যান্ডেলের উপর পা পড়েছে। আমার যে কি ভয় লেগেছিলো তখন! ভাগ্যিস ঠিক সময়ে রায়হান ভাইয়া এসেছিলেন।

—ইটস ওকে, ভাবী। আমি জানি তুমি ইচ্ছা করে পা দেওনি। উনি রাইসা ভাবীর বড় ভাই না?

আমি মাথা নাড়লাম। প্রিয়াকে হেসে বললাম,

—তুমি তখন যে তোমার প্রিয় চকলেটটি খেলে, ওটাও কিন্তু উনিই দিয়েছিলেন। তার মানে ওটার জন্যও তোমার থেকে একটা থ্যাংকস প্রাপ্য উনার।

প্রিয়া আমার কথা শুনে বিস্ময় নিয়ে কিছু বলবে তার আগেই আমাদের ডাক পড়লো নিচে। প্রান্ত ভাইয়া ডাকছেন প্রিয়াকে। হয়তো চলে যাওয়ার জন্য ডাকছেন ওকে। অতঃপর দুজনে আস্তেধীরে নিচে নেমে গেলাম।

_______________

পূর্ণ আর প্রান্ত বাসায় চলে গেছেন। আন্টির বাসায় র‍য়ে গেছি আমি, রাইসা আর প্রিয়া। আন্টির জিদের কারণে আমাকে রেখেই চলে যেতে হয়েছে পূর্ণর। আমিও মনে মনে খুশি হয়েছি। প্রিয়া বায়না ধরেছে ও আজ আমার সাথে থাকবে, আন্টিও খুশিমনে রাজি হয়েছেন। কাল তিনজন একসাথে বাড়ি যাবো। পূর্ণ যাওয়ার সময় আমার দিকে না তাকিয়ে চলে গেলেন। আমিও সেদিকে ভেংচি দিয়ে উপরে চলে এলাম রাইসা আর প্রিয়ার সাথে। আজ রাত তিনজন মনভরে গল্প করবো।

অনেকক্ষণ রাত জেগে সকালবেলা দেরিতে উঠেছি আমি। ফ্রেশ হয়ে উঠে দেখি বেলা ১২টা বাজে। অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে রুম থেকে বের হলাম। কেউ আমাকে ডাকেনি কেন? বের হয়ে দেখি বাহিরে কেউ নেই। আন্টি রান্নাঘরে কাজ করছেন আর দাদি বাহিরে চেয়ারে বসে পেপার দেখছেন। আন্টির থেকে জানলাম প্রিয়া আর রাইসা মার্কেট গিয়েছে। ওরা আমাকে রেখে গিয়েছে শুনে বেশ রাগ হলো আমার। আন্টি বললেন,

—আরে পাগলি, ওরা তোকে কত ডেকেছে তুই-ই তো উঠলি না। পরে আমিই বললাম অনেক রাত করে ঘুমিয়েছিস হয়তো ঘুম পুরো হয়নি তোর তাই ওরা একাই চলে গেলো।

এটা শুনার পর আর কিছু বলতে পারলাম না আমি। আন্টির সাথে কথাবার্তা বলে খেয়েদেয়ে উঠবো এমন সময় রাইসার কল এলো। রিসিভ করতেই রাইসা বললো,

—তুরফা, তুই উঠেছিস? কতক্ষণ ডাকলাম তোকে। মরার মতো ঘুমাচ্ছিলি। তাই তোকে ফেলে রেখে আসতে হলো।

—উঠেছি। তোরা কোথায় এখন? আর বাসায় যাবি কখন?

—সেটা বলার জন্যই ফোন দিয়েছি। প্রিয়ার শরীর ভালো লাগছিলোনা তাই আমরা বাসায় যাচ্ছি। বাসায় পৌঁছে তোর জন্য গাড়ি পাঠায় দিবো।

—কি হয়েছে প্রিয়ার? ঠিক আছে তো? গাড়ি পাঠানো লাগবেনা। বেশিদূরের রাস্তা নয় তো। আমি একাই চলে যাবো।

—রোদের মধ্যে ঘুরে মাথা ঘুরছিলো প্রিয়ার। তেমন কিছু না। কিন্তু তুই শিউর একা আসবি?

—হ্যাঁ, বাবা। কত একা যাওয়া আসি করেছি! তোরা আরামে বাসায় যা!

ফোন কেটে হাসলাম আমি। মনে মনে ভাবলাম এই তো পেয়েছি সুযোগ আরেকদিন এখানে থাকার! এবার দেখি পূর্ণর কেমন লাগে! উনার রিয়েকশন কি হবে ভেবে একদফা হেসে কুটিকুটি হয়ে গেলাম আমি! বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। ভাবলাম এতক্ষণে হয়তো বাসায় চলে গেছেন পূর্ণ, বড়াম্মুকে ফোন দিয়ে জানাবো আমি আজকেও আন্টির বাসায় থাকবো এমন সময় আমার ফোনে কল এলো পূর্ণর! ফোনের স্ক্রিনে উনার নাম দেখে চমকে উঠলাম আমি। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়! রিসিভ করবো কি করবোনা ভাবতে ভাবতেই কেটে গেলো কল! প্রায় সাথে সাথেই পুনরায় ফোন এলো। তবে আমি কিছু বলার আগেই পূর্ণর রাশগম্ভীর আওয়াজ,

—পাঁচ মিনিট টাইম দিলাম। বাসার বাহিরে এসো। তুমি আন্টিকে কি বলবে না বলবে আই ডোন্ট কেয়ার। আমি বাড়ির বাহিরে অপেক্ষা করছি, ভেতরে ঢুকবোনা। টাইম ওয়েস্ট না করে দ্রুত চলে আসবে।

আচমকা পূর্ণর ফোন পেয়ে আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। ধমকি দিচ্ছেন নাকি আমায়? আশ্চর্য তো! একবার যাবো ভেবেও পরে রেগে আমিও বের হলাম নাহ। সুন্দর করে বললেই তো আমি যেতাম! এভাবে ঝাড়ি দিয়ে বলা লাগতো? মিনিট পাচেক পার হতেই আন্টি এলেন আমার কাছে। এসে বললেন,

—কিরে তুরফা? তুই নাকি জামাইকে আসতে বলেছিস তোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য? আমাকে একবারও বললিনা। ছেলেটার নাকি কাজ আছে তাই তোকে বাসায় রেখেই চলে যাবে, এজন্য ভেতরেও ঢুকবেনা। আমাকে একবারও বলবিনা তুই? এভাবে করলে হয়?

আন্টি আছেন আন্টির কথায়। আমি আছি আমার চিন্তায়। বের হইনি বলে এভাবে আন্টিকে ফোন দিবেন? তাও আবার সব দোষ আমার উপর চাপিয়ে দিলেন! আমি নাকি উনাকে ডেকেছি! উনার পক্ষেই এসব সম্ভব! আর উপায় না পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আন্টির কথায় বাসা থেকে বের হলাম আমি।

_________________

রাস্তার ধারে সোডিয়ামের আলোর নিচে দাঁড়িয়ে আছেন পূর্ণ। যে আলোতে চিকচিক করছে উনার সুন্দর মুখশ্রী। এর মধ্যে জ্বলজ্বল করতে থাকা তার চোখজোড়া নজর এড়ালোনা আমার! রাগের আগুন জ্বলছে সে চোখে, যে আগুনে ভস্ম করে দিতে চাইছেন আমার ধুকপুক কর‍তে থাকা হৃদয়। উনার থেকে চোখ ফিরিয়ে ধীর কদমে হেটে গেলাম তার দিকে। গাড়ি ছাড়া এসেছেন আজ, আবার আন্টিকে বলছেন তার কাজ আছে। ব্যাপারটা কি?

#চলবে

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৪০
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা

পূর্ণর সামনে দাঁড়িয়ে আছি চুপচাপ, মুখ অন্যদিক ফিরে। উনি কিছু বলছিলেন না দেখে আড়চোখে উনার দিকে একবার তাকিয়েছি ঠিক এমন সময় পূর্ণ হঠাৎ রাগী গলায় বলে উঠলেন,

—সমস্যা কি তোমার? বাসায় যাবেনা কেন? কি শুরু করেছো?

উনার ধমকে চুপসে গেলাম আমি। মিনমিন করে বললাম,

—অনেকদিন পর এসেছি তো তাই কয়েকদিন থেকে যেতে চাইছিলাম…

—তাই না? তোমাকে চিনিনা আমি মনে করেছো? তুমি যে আমাকে ইচ্ছে করে জ্বালানোর জন্য এরকম করছো তা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছি আমি। অফিস থেকে এত ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরি কোথায় রেস্ট নিবো তা নাহ। তোমার জন্য এখানে ছুটে আসতে হয় আমার। আর তুমি সব বুঝেও ইচ্ছে করে এসব করছো!

পূর্ণর গলায় স্পষ্ট রাগ। উনার ক্লান্ত চোখমুখ বলছেন উনি অফিস থেকে ফিরেই এখানে চলে এসেছেন। তার কথায় যুক্তি আছে বটে, যদিও আমি ইচ্ছে করেই এসব করছিলাম তবুও আমার কাজের পেছনেও তো কারণ আছে। আমাকে তো জানতে হবে উনার অদ্ভুত আচরণের কারণ! আর কতদিনই বা পালিয়ে বেড়াবেন আমার কাছে থেকে? তাই খানিকটা শক্ত গলায়ই বললাম,

—তো কি করবো বলুন? আপনি আমাকে এ কয়দিন ইগ্নোর করেন নি? তাই আমিও করছি।

—আমি তোমাকে কবে ইগ্নোর করলাম?

অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন উনি। আমি সরু চোখে তাকিয়ে বললাম,

—করেছেন। দাদুবাড়ি থেকে আসার পর আপনি ঠিকভাবে আমার সাথে কথা বলছিলেন নাহ, আবার আমার দিকে তাকাতেনও না ঠিকমতো। যে-ই আন্টির বাসায় এসেছি তখন তো ঠিকি চলে এলেন। তাহলে বাসায় এতদিন কি হয়েছিলো আপনার?

—এতকিছু বুঝেছো তাহলে এটা বুঝোনি কেন ইগ্নোর করছিলাম বাসায় আসার পর?

আমি “না-বোধক” মাথা নাড়লাম। উনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

—তোমার থেকে এর বেশি কিছু আশা করিনি আমি৷ তুমি কবে বড় হবে তুরফা? কবে আমাকে বুঝতে শিখবে তুমি?

উনার কণ্ঠে কাতরতা। তার প্রশ্নে দিশেহারা বোধ করলাম আমি। কি বুঝিনি আমি? উনি যদি আমাকে পছন্দ করেন তবে বলতে দোষ কোথায়? কেন প্রকাশ করেন না পুরোপুরি? আমায় চুপ থাকতে দেখে পূর্ণ গম্ভীর মুখে বললেন,

—এখন তোমার পড়ালেখা করার সময়। অন্য সবকিছুর জন্য সারাজীবন পড়ে আছে, এসময়টা পড়ালেখায় ব্যয় করো। তোমার বয়সটা অল্প। এটা আবেগের স্রোতে ভেসে যাওয়ার সময়। আর আমি চাইনা আমার জন্য এখন তোমার সময় নস্ট হোক বা ভবিষ্যতে তুমি আফসোস করো। তাই এখন থেকে শুধু পড়াশুনার মনোযোগ দেও, তুরফা। আমাকে তুমি সারাজীবন নিজের পাশে পাবে, কিন্তু জীবনের এ সময়টা আর ফিরে পাবেনা। তাই বাসায় যেয়ে এডমিশনের জন্য পড়াশুনায় শুরু করবে আজ থেকে। বাকি সব চিন্তা আমার উপর ছেড়ে দেও। এখন অন্য কোনকিছু নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবেনা, বুঝেছো?

উনার কথায় স্তব্ধতায় কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম আমি। আমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে, আমার কথা ভেবে উনি নিজের অনুভুতিগুলো দমিয়ে রাখছেন? এমন ধৈর্যশীল পুরুষ আদৌ হয়? লোকটাকে যত গভীরভাবে বুঝতে শুরু করি ততই অবাক হই! উনার প্রতি সম্মান বেড়ে গেলো আমার। স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম উনার দিকে!
এদিকে আমার মুখে বিস্ময় দেখে পূর্ণ ইষৎ হাসলেন। আমার গাল টেনে দিয়ে বললেন,

—এখনই এত অবাক হয়োনা, তুর পাখি। তোমার যে আমার সম্পর্কে এখনো আরও অনেক কিছু জানা বাকি আছে। কিছুটা বিস্ময় সেদিনের জন্যও বাচিয়ে রাখো।

পূর্ণর আচরণে আজ যারপরনাই অবাক হচ্ছি আমি। কি বললেন উনি আমায়? তুর পাখি? নামটা শুনতে কত্ত আপন লাগছে! যেন কোন প্রেমিকপুরুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষকে ডাকছে! এই প্রথম তার থেকে এমন সম্বোধন পেয়ে, তার কথাগুলো শুনে মনের মধ্যে অনুভূতির ঢেউ খেলে গেলো আমার!

—আপনি এত ভালো কেন?

মুগ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করলাম আমি। আমার মুগ্ধতায় নিঃসংকোচ হাসলেন পূর্ণ। সোডিয়ামের আলোর নিচে যে হাসি ভয়ংকর সুন্দর লাগলো আমার কাছে! যে হাসি বুকে ঝংকার তুলে নির্দ্বিধায়! উনি খানিকটা ঝুকে এসে ফিসফিসিয়ে বললেন,

—একবার তোমার পরীক্ষা শেষ হতে দেও, আমি কতটা ভালো তার সবটাই হাতেকলমে দেখিয়ে দেবো তোমায়।

উনার কণ্ঠে অদ্ভুত মাদকতা ছিলো! যা অস্থির করে তুললো আমায়। ঢিপঢিপ করতে থাকা বুকে কোনমতে শুকনো ঢোক গিলে বললাম,

—বাসায় যাবেন নাহ?

—নাহ। আজ ঠিক করেছি তোমাকে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় রাত কাটাবো।

দুষ্টু হেসে বললেন পূর্ণ। আমি উনার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাতেই পূর্ণ ভ্রু কুচকে বললেন,

—এভাবে তাকাও কেন হ্যাঁ? আমি তোমার বড় ভুলে গিয়েছো? আমাকে চোখ রাঙ্গাও!

—আমার বরের দিকে আমি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে তাকাবো, আপনার কি?

পূর্ণর সেদিনের বলা কথাকে কপি করে বললাম আমি। উনি প্রথমে অবাক হলেও পুরোপুরি প্রকাশ করলেন নাহ। বাকা হেসে বললেন,

—সেইম কথাটা তোমায় আমি বললে কেমন লাগতো, তুরফা? একটু ভেবে দেখো তো।

উনার কথায় গাল গরম হয়ে গেলো আমার। অন্যদিক ফিরে বললাম,

—ছিহ! এখন চলুন তো। বাসায় যাবো।

বলেই হাটা শুরু করলাম আমি। উনার সাথে বেশি কথা বাড়ানোর ইচ্ছে হলোনা আমার, দেখা যাচ্ছে আমার কথায় আমাকেই ফাসিয়ে দিচ্ছেন বরাবরের মতো আর লজ্জার সম্মুখীন হতে হবে আমাকে! যা আমি এ মুহুর্তে চাইনা। পূর্ণ খানিকটা হেসে চুপচাপ আমার পাশে এসে হাত ধরে হাটতে লাগলেন। আমি প্রসঙ্গ ঘুরাতে জিজ্ঞেস করলাম,

—আজ গাড়ি নিয়ে আসেননি যে? কিভাবে যাবো আমরা?

—রাইসা বললো তুমি নাকি গাড়িতে বাসায় যেতে চাওনা। রিকশায় যাবে। তাই ভাবলাম রিকশায় করেই নিয়ে আসি তোমাকে। তবে আসল কারণ হচ্ছে ইচ্ছা করেই গাড়ি নিয়ে আসিনি। ভেবে দেখলাম একসাথে রিকশাভ্রমণও তো হয়নি আমাদের কখনো!

চোখ টিপে কথাটা বললেন পূর্ণ। বড় বড় চোখে উনার দিকে তাকালাম আমি। একিসাথে রাইসাকে বকলাম মনে মনে। কি দরকার ছিলো উনাকে বলার? পরমুহুর্তে ভাবলাম ভালোই হয়েছে, আমারও ইচ্ছে ছিলো বিয়ের পর জামাইয়ের সাথে এক ভরাসন্ধ্যায় রিকশাভ্রমণ করার। আজ অবশেষে সেই ইচ্ছেটাও পূর্ণর সান্নিধ্যে পূরণ হয়ে যাবে!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here