বৃষ্টিময়_প্রেম #পর্বঃ৪৩,৪৪

0
1347

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৪৩,৪৪
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
৪৩

রেস্টুরেন্টের ছাদে বসে আছি কাউচে। রাইসা ও আমাকে বসিয়ে রেখে বন্ধুদের সাথে কথা বলতে গেছেন দুই ভাই। চেয়ে চেয়ে চারপাশ দেখছি। কথায় আছে বন্ধুদের কাছে গেলে গম্ভীর মানুষও চঞ্চল হয়ে উঠে, সবাই নিজেদের শৈশবে ফিরে যায়। কথাটা পূর্ণর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়! কিভাবে হেসে হেসে কথা বলছেন উনি সবার সাথে, প্রাণোচ্ছল হাসি! দেখলেই মনটা ভরে উঠছে আমার! উনাকে এভাবে প্রাণখুলে হাসতে সচারাচর দেখা যায়না তবে যখন হাসেন তখন চারপাশের সবকিছু ছাড়িয়ে শুধু উনাকেই দেখতে ইচ্ছে করে! তবুও বেহায়া চোখদ্বয়ের দৃষ্টি ফিরিয়ে অপরপাশে তাকালাম।

বামপাশে তাকাতেই ছাদের এক কোণে চোখ পড়লো রায়হান ভাইয়ার উপর! রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে কথা বলছেন কারও সাথে। মাঝেমধ্যে দু-একবার হাসছেনও! মাথাটা আরও খানিকটা এলিয়ে দিতেই চোখ পড়ে প্রিয়ার উপর। রেলিঙের অপর পাশে দাঁড়িয়ে দিব্যি অনর্গল কথা বলছে রায়হান ভাইয়ার সাথে! তাদের দুজন এভাবে একসাথে দেখে কিছুটা অবাকই হয়ে গেলাম আমি! প্রিয়া বেশ ফাস্ট, আসতে না আসতেই রায়হান ভাইয়াক খুজে বের করে গল্প করাও শুরু করে দিয়েছে! তাই তো বলি ওকে খুজে পাওয়া যাচ্ছিলোনা কেন!

আড়চোখে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলাম তাদের। দুজনের জুটিটা নেহাৎ মন্দ হয়না! বেশ লাগছে একে-অপরকে একসাথে! এরই মাঝে হাতে টান পড়ায় পূর্ণ মনে করে আমি বললাম,

—আপনি এসেছেন?

—না। তোর উনি এখনো আসেনি। এটা আমি। এদিকে তাকা, তখন থেকে কোনদিকে তাকিয়ে আছিস? কি দেখিস?

রাইসার গলায় পাশ ফিরে ওর দিকে সরু চোখে তাকালাম। সামনে তাকিয়ে দেখি পূর্ণ আর প্রান্ত দিব্যি খোশগল্পে ব্যস্ত বন্ধুদের সাথে। কি এমন কথা বলছেন সবাই? হয়তো অনেকদিন পর এক হয়ে পুরনো স্মৃতি আলোচনা করছেন সবাই! কে জানে? রাইসাকে কিছু বলবো এমন সময় প্রান্ত ভাইয়া এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। রাইসা ও আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

—তোমরা যাও। ওখানে বড় ভাইয়া আছে ওর বন্ধুদের সাথে। আমারও বন্ধু আছে কিছু। পরিচয় করিয়ে দেবে তোমাদের সাথে। প্রিয়াটা যে কোথায় গেলো, আমি ওকে নিয়ে আসছি!

প্রান্ত ভাইয়ার মুখে প্রিয়ার কথা শুনে বিচলিত হয়ে গেলাম আমি। যদি রায়হান ভাইয়ার সাথে ওকে দেখে ফেলেন? সন্দেহ করতে পারেন তো! তাই আমতা আমতা করে বললাম,

—ভাইয়া, আপনি রাইসাকে নিয়ে যান। আমি প্রিয়াকে নিয়ে আসছি। একটু আগেই দেখলাম ওকে, আপনার কস্ট করে খুজতে হবেনা।

—তাই? ওকে দেখেছো তুমি? তাহলে নিয়ে আসো। তবে জলদি এসো তুরফা, নয়তো না নিয়ে যাওয়ার অপরাধে আমাকে তোমার জামাইয়ের রাগের শিকার হতে হবে!

প্রান্ত ভাইয়ার কথায় হাসলাম আমি। ওরা চলে যেতেই দ্রুত কদমে প্রিয়ার কাছে গেলাম। রায়হান ভাইয়া আমাকে এক পলক দেখে চুপ হয়ে গেলেন। উনার সাথে কুশল বিনিময় শেষে প্রিয়াকে নিয়ে অন্যদিক চলে এলাম আমি। ওর মাথায় গাট্টা মেরে বললাম,

—নিজেকে একটু কন্ট্রোল করা শিখো, পাগলি। এখনি তোমার ভাই আসছিলো এদিকে। আমি উনাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাইসার সাথে পাঠিয়ে দিয়েছি! প্রান্ত ভাইয়াকে তো চিনোই? একবার সন্দেহ করলে কিছু হওয়ার আগেই সব শেষ হয়ে যেতো তোমার!

—আল্লাহ! তাই? আমার তো কথা বলতে বলতে কিছু মনেই ছিলোনা। থ্যাঙ্কিউ, ভাবী। এ যাত্রায় বাচিয়ে দিলে।

—হুম ঠিক আছে। এখন চলো তোমার ভাইদের কাছে। ওদের বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে।

প্রিয়া কিছু বলার আগেই পেছন থেকে বাহুতে টান পড়লো আমার! একটু আগের ঘটনা মনে হতেই রাইসার কথা মাথায় এলো। তাই পেছনে না তাকিয়েই বিরক্তিকর সুরে বললাম,

—আবার টানছিস কেন? যাচ্ছি তো আমি!

কোন সাড়াশব্দ না পাওয়ায় পেছনে তাকাতেই চোখে পড়লো পূর্ণর বিস্ময়কর চাহনি। অবাক স্বরে বললেন,

—কি বলছো এসব? তুই করে বলছো কেন?

এবার উনাকে দেখে থতমত খেয়ে গেলাম আমি। পূর্ণকে দেখে ভীত সুরে আমি বললাম,

—আপনি? সরি আমি বুঝিনি। ভেবেছিলাম রাইসা হবে তাই তুই করে বলেছি৷ একটু আগে ও এভাবে টেনেছিলো তো তাই আর কি!

আমার চেহারা দেখে মৃদু হাসলেন পূর্ণ। নাক টেনে দিয়ে বললেন,

—আচ্ছা বুঝেছি! ভয় পেতে হবেনা। আমি কিছু বলবোনা তোমায়।

পূর্ণর কথায় ইষৎ হাসলাম আমিও। এদিকে প্রিয়া গলা পরিষ্কার করে বললো,

—এক্সকিউজ মি, আমিও কিন্তু এখানেই আছি। ভুলে যেয়োনা কেউ।

প্রিয়ার কথায় লজ্জা পেয়ে গেলাম আমি। পূর্ণ ওর দিকে চোখ পাকিয়ে বললেন,

—তাই না? তুই এখানে আছিস বলেই তো তোকে খুজে পাচ্ছিলাম না আমরা। সব জায়গা বাদ দিয়ে ছাদের কোণার দিকে কি করিস তুই?

—ক-কিছু না, বড় ভাইয়া। আ-আমি তো এমনিই এসেছিলাম।

তোতলানো কণ্ঠে বললো প্রিয়া। পূর্ণ একবার সন্দেহের চোখে ওর দিকে তাকিয়ে পরমুহুর্তেই মুখ স্বাভাবিক করে সামনে যেতে যেতে বললেন,

—সব কথা বাদ। এখন সামনে চলো সবাই। আমার বন্ধুরা অপেক্ষা করছে। রায়হানও এসেছে। রাইসার সাথে কথা বলছে দেখলাম। ওর সাথে দেখা হয়েছে তোমাদের? চলো দেখা করবে সবার সাথে।

আমি ও প্রিয়া আড়চোখে একে-অপরের দিকে তাকিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ উনার সাথে এগিয়ে চললাম। উদ্দেশ্য সবার সাথে পরিচয় হওয়া!

__________________

পূর্ণ উনার বন্ধুদের সামনে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমাকে দেখে সবাই হাসিমুখে সাক্ষাত করলো। পূর্ণকে অবশেষে বিয়ে করাতে রাজি করানোর জন্য আমাকে অভিনন্দন জানালো সবাই। উনাদের কথায় আমি হাসবো না কাদবো বুঝছিলাম নাহ। রিশাদ নামের এক বন্ধু তো বলেই ফেললো,

—অবশেষে তোর উইকেট পড়ছে, মামা! আমি তো ভাবছিলাম তুই সারা জীবন সালমান খান হয়েই থাকবি। অল থ্যাংকস টু তুরফা ভাবী।

উনার মুখের কথা ছিনিয়ে আরেক বন্ধু বললো,

—একদম মনের কথা বলছিস, দোস্ত। কতদিন ওয়েট করছি পূর্ণর বিয়ে খাবো বলে। কিন্তু এ শালা তো বিয়ের দাওয়াতই দিলোনা।

—আমার তো মনে হয় ডিরেক্ট আমাদের চাচা বানায়ে তারপর জানানোর প্ল্যান ছিলো পূর্ণর। তাই না মামা?

উনার বন্ধুদের কথায় হোহো করে হেসে উঠলেন প্রান্ত ভাইয়া। রাইসা ও প্রিয়াও দেখি মিটিমিটি হাসছে। এদিকে আমি লজ্জায় অজ্ঞান হয়ে যাবো যাবো অবস্থা। ভেবেছিলাম পূর্ণ রাগ করবেন বা কিছু বলবেন অথচ জনাব দেখি নিজেও মজা নিচ্ছেন। ঠোঁট কামড়ে হেসে বন্ধুদের বললেন,

—বউ আমার এখনও ছোট। তাই আপাতত তোদের চাচা হওয়ার শখ পূরণ করতে পাচ্ছিনা। আপাতত আরও কয়েক বছর ওয়েট কর, যেমনটা আমি করছি!

—ওহহো মামা, তুমি দেখি বাপ হওয়ার জন্য খুব এক্সাইটেড। সব তো মনে হয় অলরেডি প্ল্যান করে রেখেছো!

উনাদের কথায় চোখ বড় বড় হয়ে গেলো আমার। অসভ্য লোকটা বলছে কি মানুষের সামনে? উনার বন্ধুরাও বা কেমন বেহায়ার মতো কথা বলছে! লজ্জায় আমার নাকের ডগা পর্যন্ত লাল হয়ে গেলো। পূর্ণ হয়তো সেদিকে খেয়াল করলেন। কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেলেন। গম্ভীর মুখে বললেন,

—কিছু বলতে চেয়েছিলাম তোদের কিন্তু তুরফা লজ্জা পাবে তাই ওর সামনে বলবোনা। আমি চাইনা ও আনকম্ফোর্টেবল হোক।

অতঃপর আমার দিকে ঘুরে বললেন,

—তুমি কিছু মনে করোনা। আমার অনেক পুরনো বন্ধু তো এরা। আমরা সবাই এমন ফ্রি ভাবেই কথা বলি নিজেদের সাথে। অসস্তি লাগলে বলবে?

আমি আড়চোখে উনার দিক তাকিয়ে মাথা উপর-নীচ করে “হ্যাঁ” বললাম। রিশাদ ভাইয়া প্রান্ত ভাইয়ার কাধে চাপড় দিয়ে বললো,

—বুঝলে ছোট ভাই, তোমার বড়দা তো দেখি একদম বউভক্ত হয়ে গেছে! পূর্ণ এত নরম সুরে কথা বলতে পারে! তুমি কোনদিন ভেবেছিলে?

—এটা তো কেবল শুরু। আরেহ তোমরা তো এখনও আসল কাহিনিই জানোনা।

হেসে বললেন প্রান্ত ভাইয়া। পূর্ণ উনার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাতেই রিশাদ ভাইয়া ও অন্য বন্ধুদের নিয়ে সাইডে চলে গেলেন তিনি। এতকিছু হয়ে গেলো অথচ রায়হান ভাইয়ার খোজ নেই। কোথায় যে গেছেন উনি আমি বুঝতে পারলাম নাহ! একটু পর আরও গল্পগুজব করে খেতে চলে গেলাম সবাই।

খাওয়ার পর নাকি গানের আয়োজন হবে! এদিকে পূর্ণকে গান গাওয়ার জন্য রাজি করাচ্ছে সবাই। অন্যদিকে তাকিয়ে দেখি রায়হান ভাইয়ার হাতেও গিটার! যা দেখে অবাক হয়ে গেলাম আমি! তাহলে কি উনি গিটার আনতে গিয়েছিলেন নাকি? উনিও কি গান গাইবেন নাকি? তাহলে তো আজ বেশ ভালোই আসর জমবে! উচ্ছাসিত চোখে গানের আসর শুরু হওয়ার অপেক্ষা করলাম আমি!

#চলবে
#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৪৪
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা

পাশাপাশি চেয়ারে বসে আছি আমি আর পূর্ণ। আমাদের সাথে বসে আছেন রিশাদ ভাইয়া, প্রিয়াসহ পূর্ণর কিছু বন্ধু। আমাদের মুখোমুখি বসে আছেন রায়হান ভাই, তার পাশে রাইসা, প্রান্ত ভাইয়ারা। হাসিঠাট্টা,গল্প-গুজবের মাঝেই গিটারের টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। দমকা হাওয়া বইছে যা শিহরণ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। দুইপক্ষ মিলে গানের কলি খেলা হবে। রিশাদ ভাইয়া শুরু করলেন প্রথমে,

“ইস্টিশনের রেলগাড়িটা মাইপা চলে ঘড়ির কাটা
প্ল্যাটফর্মে বইসা ভাবি কখন বাজে বারোটা? কখন বাজে বারোটা?”

প্রান্ত ভাইয়া সামনে থেকে বিরক্তিকর সুরে বললেন,

—শালা তোর এই গান গাওয়া লাগলো? এটা কোন গান হলো? আমি দেখাচ্ছি কেমন গান গাইতে হয় দাড়া! “ট” দিয়ে না?

সবাই মাথা নাড়লে প্রান্ত ভাইয়া রাইসার দিকে চোখ টিপ মেরে গাইতে শুরু করলেন,

—“টিপ টিপ বারসা পানি
পানি মে আগ লাগা দি
আগ লাগি দিল মে জো
দিল কো তেরি ইয়াদ আয়ি”

প্রান্ত ভাইয়ার গান শুনে রাইসা বেচারি লজ্জায় কেশে উঠলো। বাকা হেসে গান বন্ধ করে দিলেন প্রান্ত ভাইয়া। সবাই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে এতক্ষণে। উনাদের এক বন্ধু লিমন ভাইয়া হাসতে হাসতে বললেন,

—ফানি, রোমান্টিক সবই হলো। একটা বিরহের গান না হলে হয়? এই রায়হান এবার তুই গা তো! তখন থেকে চুপচাপ বসে আছিস! সত্যিই ছ্যাকা-টেকা খাইছিস নাকি মামা? কি হইছে তোর?

—কিছুই হয়নি। কি গান গাবো সেটাই ভাবছিলাম বসে বসে। ছ্যাকা মার্কা গান শুনবি যখন তাহলে গেয়েই শুনাই একটা। কি বলো সবাই?

—হ্যাঁ হ্যাঁ, এটা আবার বলতে হয়? তবে বেশি কস্টের গান গাস না যেনো। একটা সুন্দর গান গা।

—আচ্ছা ঠিক আছে, আমার পছন্দের একটা গান গেয়ে শুনাই তোদের তাহলে।

কথাটা বলেই গিটারে সুর তুলতে শুরু করলেন রায়হান ভাই। সবার মনোযোগ এখন উনার দিকে! তবে উনার দৃষ্টি আকাশের দিকে। চাঁদের দিক চেয়ে গাইতে আরম্ভ করলেন,

“অবাক চাঁদের আলোয় দেখো
ভেসে যায় আমাদের পৃথিবী
আড়াল হতে দেখেছি তোমার নিষ্পাপ মুখখানি
ডুবেছি আমি তোমার চোখের অনন্ত মায়ায়
বুঝিনি কভু সেই মায়াতো আমার তরে নয়
ভুলগুলো জমিয়ে রেখে বুকের মণিকোঠায়
আপন মনের আড়াল থেকে ভালবাসবো তোমায়

তোমার চিরচেনা পথের ঐ সীমা ছাড়িয়ে
এই প্রেম বুকে ধরে আমি হয়তো যাবো হারিয়ে
চোখের গভীরে তবু মিছে ইচ্ছে জড়িয়ে
একবার শুধু একটিবার হাতটা দাও বাড়িয়ে
ডাকবেনা তুমি আমায় জানি কোনোদিন
তবু প্রার্থনা তোমার জন্য হবেনা মলিন”

শেষোক্ত পঙক্তিটুকু রায়হান ভাই হঠাৎ করেই আমার দিকে চেয়ে বললেন। এক মুহুর্তের জন্য উনার স্থির দৃষ্টি দেখে হঠাৎ কেপে উঠলাম আমি! আচ্ছা উনি কি তবে সত্যিই আমাকে পছন্দ করতেন? উনার চোখের ভাষা তো তাই বলছে! হঠাৎ করেই সত্যটা উপলব্ধি করে মনটা খুব বিষন্ন হয়ে উঠলো আমার। এত বছরে কোনোদিন আমি ওভাবে খেয়াল করিনি তার আচরণ, এজন্যই হয়তো চোখে পড়েনি তার অনুভূতি। তবে এখন উনার বা আমার কিছু করারও নেই, আমি চাই উনি নিজের জীবনে ভালো থাকুক! প্রিয়ার দিক তাকিয়ে দেখি সে মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছে রায়হান ভাইয়ের দিকে। ওর দৃষ্টিতে উনার জন্য একরাশ ভালোবাসা স্পষ্ট চোখে পড়ছে আমার! যে ভালোবাসাটা রায়হান ভাইয়ার জীবনে এখন সবচেয়ে প্রয়োজন!
এতদিন আমি প্রিয়াকে রায়হান ভাইয়ার জীবনে আনার ব্যাপারে সাহায্য করবো কি না অনিশ্চিত ছিলাম, তবে এখন হতে আমি নিজে থেকেই চাই প্রিয়া উনার জীবনে জায়গা করে নিক! ওর চঞ্চলতায়, ভালোবাসায় রাঙিয়ে তুলুক রায়হান ভাইয়ার সাদা-কালো জীবন!

নিজের ভাবনার মাঝেই কাধে পূর্ণর হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম আমি। উনার দিকে তাকাতেই দেখি তিনি শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন আমার দিকে। আমি সেদিকে এক পলক চেয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম। পূর্ণ গলা ঝেড়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন,

—বাহ রায়হান, সুন্দর গান গাও তো তুমি। তোমার গান শুনে সবাই ফিল করেছে। পরিবেশটা হঠাৎ করেই চুপচাপ হয়ে গেছো দেখো!

—হুম তাই তো দেখছি! এবার তাহলে তুমিই পরিবেশটা পুনরায় স্বাভাবিক করে দেও তো, পূর্ণ!

পূর্ণ হালকা হেসে হাত বাড়ালেন রায়হান ভাইয়ার দিকে। রায়হান উনার ইশারা বুঝে নিজের হাত থেকে গিটার এগিয়ে দিলেন। পূর্ণ চেয়ার টেনে আমার দিক ঘুরে গিটার নিয়ে বসে সুর তুলতে লাগলেন।

“কারণে-অকারণে, নিষেধে বা বারণে
তোমার নামেই যত জোছনা নিলাম
নিয়মে-অনিয়মে, দহনে বা ধারণে
আমায় নিখোঁজ ভাবো কেন?
বাঁ পাশেই ছিলাম

আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি, তোমার দ্বিধায় পুড়ে যাই
এমন দ্বিধার পৃথিবীতে
তোমায় চেয়েছি পুরোটাই
আমি তোমার স্বপ্নে বাঁচি, তোমার স্বপ্নে পুড়ে যাই
এমন সাধের পৃথিবীতে
তোমায় চেয়েছি পুরোটাই
পুরোটাই…”

উনি পুরোটা সময় আমার চোখের দিক সরাসরি তাকিয়ে অনবদ্য গলায় গানটি গেয়েছেন! আজ পূর্ণ নিজের ভালোবাসা আড়াল হতে প্রকাশ করেননি, গানের মাধ্যমে সরাসরি বুঝিয়ে দিয়েছেন আমায়! আমি উনার দিকে তাকাতেই স্নিগ্ধ হাসি উপহার দিলেন আমায়! এত এত মানুষের মধ্যে উনার এহেন আচরণ একিসাথে মুগ্ধতা ও লজ্জায় ফেললো আমায়। রক্তিম আভা নিজ দায়িত্বে ছড়িয়ে পড়লো দু’ গালে। চোখের পলক তুলতে পারলাম না উনার দিকে! এমন সময় পূর্ণর বন্ধুরা উনাকে ক্ষেপানোর সুরে একে-অপরকে উদ্দেশ্য বললো,

—দোস্ত, আমাদের আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবেনা। পূর্ণর যে অবস্থা তাতে বছর না ঘুরতেই ও বাপ হয়ে যাবে আমার মনে হচ্ছে।

—তোরা আবার শুরু করলি?

পূর্ণ চোখ পাকিয়ে তাকালেন উনাদের দিকে। আমি আর এখানে বসে থাকলাম নাহ৷ উঠে চলে গেলাম অন্যদিকে৷ রাইসা, প্রিয়াও উঠে আমার কাছে এলো। ছেলেরা অন্যদিকে কথা বলছেন সবাই। কথায় কথায় রাইসা জানালো একটু পর বের হবে সবাই, রাত তো অনেক হয়ে গিয়েছে। পূর্ণ-প্রান্ত ভাইয়া এতদিন পর বন্ধুদের সাথে দেখা হয়েছে তাই ওদের গাড়িতে গল্প করতে করতে বাসায় যাবেন৷ আমি, রাইসা ও প্রিয়া আমাদের গাড়িতে যাবো। এর মধ্যেই প্রান্ত ভাইয়া এসে বললো,

—আমাদের গাড়িতে সবার জায়গা হচ্ছেনা। রায়হান যেহেতু আগেই যাবে তোমাদের সাথে যাক? রাইসার বাসায় ওকে লিফট দিয়ে চলে যেয়ো।

রায়হান ভাই আপত্তি জানিয়ে বললেন,

—লাগবেনা, প্রান্ত। আমি ম্যানেজ করে নিবো।

—সমস্যা নেই, ভাইয়া। আমাদের গাড়িতে তো জায়গা আছেই। আমাদের কোন প্রব্লেম হবেনা।

প্রিয়ার কথায় রাইসাও সায় জানালো। ওদের জোরাজোরিতে অবশেষে রায়হান ভাইও রাজি হয়ে গেলেন! ঠিক হলো তিনি যাবেন আমাদের সাথে! আমি রাইসার কাছে পার্স, ফোন দিয়ে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে গেলাম। ওয়াশরুমে যেতে হলে ছাদের কর্ণার বেয়ে যে সিড়ি আছে সেদিক দিয়ে নিচে নেমে যেতে হয়। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতেই কানে এলো পূর্ণর সাথে উনার বন্ধুদের আলোচনা। আমি তেমন মনোযোগ না দিয়ে নিচে নামছিলাম হঠাৎ রিশাদ ভাইয়ার মুখে আমার নাম শুনে নিজ হতেই থেমে গেলো পা! কৌতুহলী হয়ে সিড়ির সাথে ঘেঁষে উকি দিলাম ছাদের কোণের নির্জন জায়গায় যেখানে উনারা কথা বলছিলেন। পূর্ণকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন সবাই৷ রিশাদ ভাইয়া আবার বললেন,

—চুপ করে আছিস কেন, পূর্ণ? তুরফাকে এখনও জানাসনি কেন তোর মনের কথা? আর কতদিন লুকিয়ে রাখবি ওর থেকে?

—যতদিন না ও নিজে থেকে আমাকে ভালোবাসবে, নিজে থেকে আমার কাছে আসতে চাইবে।

পূর্ণর সরল স্বীকারোক্তি। উনার বন্ধুদের চোখে বিস্ময়। লিমন ভাইয়া তো রেগেই বলে উঠলেন,

—শালা এত বছর অপেক্ষা করেছিস যার জন্য তাকে নিজের এত কাছে পেয়েও কিভাবে কন্ট্রোল করিস তুই? আমি জাস্ট বিশ্বাস কর‍তে পাচ্ছিনা তোদের মধ্যে এখনও প্রেম নিবেদন হয়নি! এমন চাপা কেন তুই? তোর কি মনে হয় তুরফা বুঝেনা তুই ওকে ভালোবাসিস?

লিমন ভাইয়ার কথায় মৃদু হাসলেন পূর্ণ। শান্ত গলায় বললেন,

—তুরফা শুধু সেটুকই জানে যেটুক আমি ওর সামনে প্রকাশ করি। ওকে যে আমি ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসি সেটা ও এখনো জানেনা। আমি চাই যেদিন ও নিজে থেকে আমাকে ভালোবাসবে, আমাকে কাছে টানবে সেদিন আমি ওকে শুনাবো আমার এত বছরের অপেক্ষার কথা! আমি জোর করে ওর মনে আমার জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করতে চাইনা, আমি চাই ও মন থেকে আমাকে অনুভব করুক। কোন কারণ ছাড়াই আমাকে ভালোবাসুক যেমনটা আমি ওকে বাসি। সেদিন আমার আসল অপেক্ষার অবসান হবে!

—এটা শুধু তোমার পক্ষেই সম্ভব, বড় ভাইয়া। আমি হলে এতদিন শেষ হয়ে যেতাম। তুরফা হারিয়ে যাওয়ার পর তোমার বদলে যাওয়া আমি নিজ চোখে দেখেছি। তোমাকে এতটা ভেঙে পড়তে আমি কোনদিন দেখিনি যতটা ওইদিন দেখেছি। এতটা বছর তুমি ওর অপেক্ষায় নিস্বার্থভাবে একতরফা ভালোবেসে গেছো অথচ এখন এত কাছে পেয়েও তোমায় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ভাগ্যের এ নিষ্ঠুর পরিনতি আমার ভালো লাগছেনা। তুরফা কবে তোমাকে ভালোবাসবে?

—ও আমাকে ভালোবাসে, প্রান্ত। শুধু বুঝতে পারেনি এখনও। এখনো ছোটই আছে কি না? তবে ব্যাপার নাহ। আমি তুরফার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করতেও প্রস্তুত। পূর্ণর ভালোবাসা এত দূর্বল না যে তুরফাকে কাছে পেয়েই ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওর উপর ঝাপিয়ে পড়বে। আমি ওকে ভালোবাসি, ওর ইচ্ছেকে সম্মান করি। আমি চাই ও নিজে থেকে আমার কাছে আসুক, আমার মতো প্রণয়ের আগুনে জ্ব/লুক। তবেই না আমার অপেক্ষা সার্থক!

মলিন হেসে বললেন পূর্ণ। যে হাসি সরাসরি বিধলো আমার অন্তরে! একেতো এতক্ষণ উনাদের কথা শুনে আমি বিস্ময়তার রেশ কাটিয়ে উঠতে পারিনি! ঢিপঢিপ করতে থাকা হৃদপিন্ড যেন বেরিয়ে আসবে বুকের মাঝখান থেকে! তার মধ্যে উনার মলিন মুখখানি আমার অন্তরে কড়াঘাত করছে বারবার! একটা মানুষ এভাবেও কাউকে ভালোবাসতে পারে? আমি বিশ্বাস কর‍তে পাচ্ছিনা এই গম্ভীর রাগী পূর্ণর মাঝে এমন একটা প্রেমিকপুরুষ লুকিয়ে আছে যার হৃদয়ের পুরোটা জুড়েই শুধু আমি ছিলাম এতগুলো বছর? যিনি আমার থেকে এতদূরে থেকেও আমার জন্য এভাবে অপেক্ষা করে গেছেন? কিছু বুঝে উঠার আগেই অক্ষিদ্বয় অশ্রুতে ভরে উঠলো আমার! প্রান্ত ভাইয়া কি বললেন সেটা শুনার জন্য আর থাকতে পারলাম না সেখানে! দৌড়ে চলে গেলাম ওয়াশরুমে।

দরজা লাগিয়ে বেশকিছুক্ষণ অনর্গল অশ্রুপাত করলাম আমি। চোখের পানি যেন আজ কিছুতেই বাধ মানছেনা আমার। পূর্ণর প্রতি টান বেড়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে! আমি তো ভেবেছিলাম উনি বিয়ের পর থেকে আমায় পছন্দ করেন কিন্তু এই লোকটা যে মনের গহীনে এতদিনের আবেগ পুষে রেখেছিলেন সে-খবর একবারো কিভাবে টের পেলাম না আমি? দু-হাতে মুখ ঢেকে কেদে ফেললাম আমি! নিজেকে সামলানো যেন দায় হয়ে যাচ্ছে এ মুহুর্তে!

পূর্ণ কি জানেন না এত অল্প সময়ের ব্যবধানে আমি কতটা গভীরভাবে উনার মায়ায় জড়িয়ে গেছি? উনাকে কিভাবে বুঝাবো আমি যে আমিও উনাকে ভালোবেসে ফেলেছি? হিসেব করে দেখলাম পূর্ণ ও আমার বয়সের ব্যবধান আট বছর। এখন আমার আঠারো, উনার ছাব্বিশ। আমার আন্টির বাসায় আসার প্রায় দশ বছর হয়েছে। অর্থাৎ উনি এত্তগুলো বছর আমাকে একতরফা ভালোবেসে গেছেন! এটা কি আদৌ সম্ভব? বিষয়টা মনে হতেই চিৎকার করে কান্না আসছে আমার! কিভাবে সহ্য করেছেন উনি কে জানে? তার এত বছরের বিশুদ্ধ ভালোবাসা কিভাবে শোধ করবো বুঝতে পেলোনা আমার ছোট্ট মন! কান্নার দমকে বারকয়েক কেপে উঠলাম আমি! জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে থামানোর ব্যর্থ চেস্টা করলাম।

________________

অবশেষে কান্না থামিয়ে নিজেকে সামলিয়ে বাইরে বের হলাম আমি। ঠিক কতক্ষণ অতিক্রান্ত হয়েছে আমি জানিনা। রেস্টুরেন্টের লোকেরা জিনিসপত্র উঠিয়ে রাখছেন, বন্ধ করবেন হয়তো একটু পরে। দ্রুত পায়ে ছাদে উঠেই আমার চক্ষুচড়ক গাছ! পুরো ছাদ খালি! কি আশ্চর্য? সবাই গেলো কোথায় আমাকে রেখে? রাইসা, প্রিয়াকেও দেখছিনা কেন? ছাদের রেলিঙ ধরে নিচে তাকাতেই দূরে আমাদের গাড়ি চলে যেতে দেখা গেলো। বিস্ফোরিত নয়নে সেদিকে চাইলাম আমি! আমাকে রেখেই ওরা চলে যাচ্ছে কেন? ওরা কি ভুলে গেছে আমি ছিলাম এখানে? চিল্লিয়ে লাভ হলোনা, আমার আওয়াজ ওদের কাছে পৌঁছালোনা। দৌড়ে নিচে নামতে নামতেই আরেকটি গাড়ি চলে যেতে দেখলাম আমি। যেটার লুকিং গ্লাস এ পূর্ণর হাতঘড়ি দেখতে পেলাম আমি, উনি গাড়িতে বসে ছিলেন মানে ওটা তার বন্ধুদের গাড়ি হবে নিশ্চয়? তাহলে কি পূর্ণও আমাকে রেখে চলে গেলেন? অদ্ভুত তো!

এদিকে রাত গভীর হচ্ছে। আমার হাতে ফোন, ব্যাগ কিছুই নেই। হঠাৎ করে কি হলো এখানে কিছুই বুঝতে পেলাম না আমি। দুরুদুরু বুকে ভাবতে লাগলাম এত রাতে একা বাসায় কিভাবে যাবো?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here