শালিক_পাখির_অভিমান #পর্ব_০২,০৩

0
847

#শালিক_পাখির_অভিমান
#পর্ব_০২,০৩
#অধির_রায়
০২

“শালিক বিয়ের আগ পর্যন্ত এখানে থাকবে না৷ তার জন্য আমি আমার ছোট মেয়ের সর্বনাশ ঢেকে আনতে পারব না৷ শালিককে দেখা যাবে না এই বাড়িতে৷ আমি শালিককে তার তার ফুপির বাড়িতে পাঠিয়ে দিব৷”

আমি বাবার দিকে অশ্রু সিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি৷ বাবার মুখে কোন কষ্টের ছাপ নেই। দিব্যি বড় খালার সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলছেন৷ মনের মাঝে কোন অনুতপ্ত নেই৷ পাশে মা মুখে কাপড় গুছে নিরবে নিভৃতে চোখের জল মুছে যাচ্ছেন৷ গর্ভধারিণী মা কখনও তার সন্তানকে ফেলে দিতে পারে না৷ দাদী কপাটে বসে সব শুনতে পায়। দাদীর আমার হাত ধরে বাবার সামনে নিয়ে দাঁড়ান৷ কর্কশ কন্ঠে বলে উঠল,

“আমার দিভাই এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না৷ মানুষের রুপ দেখে তোরা বিচার করিস কেন? আমার দিভাই সব দিক থেকে গুণবতী।”

বাবা অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমাদের মাঝে৷ ক্ষিপ্ত দৃষ্টি আমার উপর পড়তেই আমি মাথা নিচু করে ফেললাম৷ রাগে নেত্রদ্বয় রক্তবর্ণের ন্যায় টকবক করছে৷ ভারী গম্ভীর গলায় বলল,

“তুমি কখনও অপয়া মেয়ের হয়ে কথা বলবে না৷ শালিকের হয়ে কথা বললে আমি ভুলে যাব তুমি আমার মা।”

দাদী কিছু বলার আগেই আমি বললাম,

“আমি কখনও আমার বোনের ক্ষতি চাইনা৷ আমি আমার ভাই ও শাকিলার জন্য সবকিছু করতে পারি৷ আমাকে নিয়ে তোমার কোন ভয় নেই৷ আমি আজ বিকেল বেলা ফুপির সাথে উনার বাড়িতে চলে যাব৷ শাকিলার বিয়ের কাজ সম্পুর্ন হলে বাড়িতে আসবো৷ এর আগে আমি বাড়িতে আসব না৷”

দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি৷ নিজেকে আর সবার সামনে উপস্থাপন করতে ইচ্ছা করছে না৷ এক দৌড়ে দাদীর ঘরে এসে কপাট লাগিয়ে দিলাম৷ চেয়ার টেনে পড়ার টেবিলে বসলাম৷ কৃষ্ণবতী উপন্যাসের কয়েক পাতায় চোখ বুলালাম৷ উপন্যাসের সাথে আমার জীবনের গল্প মিলে যাচ্ছে৷ আগে ভাবতাম সব গল্পের মাঝেই হয়৷ বাস্তবে তার ছিটেফোঁটাও নেই৷
উদরে একটা দানাও পড়ল না৷ মা এসে ডেকে গেছে৷ মায়ের কথার কোন উত্তর দেয়নি৷ আমি জানি আমার জন্য মা না খেয়ে রান্না ঘরের এক কোণে বসে চোখের অশ্রু ফেলছেন৷

সন্ধ্যার দিকে বড় ভাই নতুন বউ নিয়ে বাড়িতে এসেছে। নতুন বউকে দেখার তীব্র ইচ্ছা মনের মাঝে। শুক্রবারের আগে বাড়ি ফেরা হবে না৷ চারিপাশ তাকিয়েও কোন উপায় খুজে পেলাম না৷ অবশেষে চোখে পড়ল দাদীর বোরকা। দাদীর বোরকা পড়ে ভাবিকে দেখতে গেলে কেউ জানতে পারবে না৷ দাদীর বোরকা পড়ে কপাট খুলে বাহিরে আসলাম৷ ধীর পায়ে মানুষ ঠেলে ভাইয়ের রুমে ঢুকলাম৷ পাশে শাকিলা বসে আছে মন খারাপ করে৷ ভাবির সাথে ভাব করার কোন উৎসাহ তার মাঝে খুঁজে পেলাম না৷ আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা চকিত হয়৷ কারণ মহল্লার মাঝে আমার দাদীই একমাত্র বৃদ্ধ। বাকী বৃদ্ধদের আল্লাহর পছন্দ হয়েছে বলে তারা পরকালে চলে গেছেন৷ আমার দিকে শাকিলা এগিয়ে এসে বলল,

“দাদী আমার সাথো আসেন৷”

আমাকে নিয়ে ভাবির পাশে বসিয়ে দিল৷ শাকিলা চলে আসতে নিলেই শাকিলার হাত চেপে ধরলাম। আমার হাত পা কাঁপছে৷ কেউ আমায় চিনতে পারলে সমস্যা হবে৷ কথাটা যদি বড় খালা বা বাবার কানে রটে তাহলে আজ আমার শেষ দিন হবে৷ শাকিলা ভদ্রতার সাথে বলল,

“আপনার কিছু লাগবে?”

শাকিলাকে টান দিয়ে নিজের পাশে বসালাম৷ ফিসফিস করে বললাম,

“আমি শালিক৷ ভাবিকে দেখতে না পেয়ে বুকের মাঝে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করছিলাম৷ আমাকে এখান থেকে নিয়ে যা৷ আমি এখানে এসেছি কেউ জানতে পারলে বড় ধরনের অ*ঘ*ট*ন ঘটবে৷”

আমি বাহিরে আসতে নিলেই ভাবি আমার হাত ধরে ফেলেন৷ সাথে সাথে বুকের মাঝে চিনচিন ব্যথা শুরু হলো৷ ভাবি মিষ্টি মধুর ফিসফিস কন্ঠে বলল,

“শালিক সবাইকে ফাঁকি দিতে পারলেও আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না৷ আমি তোমাকে চিনে ফেলেছি৷”

হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে৷ শাকিলাও ভাবির দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢুক গিলছে৷ ভাবিকে আমার কথা কে বলেছে? ভাই আমার কথা ভাবিকে বলে দিয়েছে৷ নাকি পাড়ার কাকিমারা বলছে৷ মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকলাম৷ ভাবি আমার হাতের উপর হাত রাখলেন৷ বোরকার মাথা তুলে মুখ দেখতে নিলেই হাত ধরে ফেললাম৷ ভাবি সমস্যা বুঝতে পেরে সকলের উদ্দেশ্য বললেন,

“আপনারা একটু বাহিরে যাবেন৷ না মানে একটু পরই তো সন্ধ্যার আজান দিবে৷ আমি এসব পোশাক ছেড়ে সাধারণ পোশাক পড়ব৷ এসব পোশাক পড়ে নামাজ পড়তে পারব না৷”

ভাবির কথামতো সবাই বাহিরে চলে গেল। শাকিলা কপাট বন্ধ করে দিল৷ ভাবি আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলেন৷ ভাবির ভালোবাসায় যেন হারিয়ে গেলাম৷ চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ভাবি মুচকি হেঁসে বলল,

“আমাকে তোমার কথা তোমার ভাই বলেছে৷ তোমাকে যে যাই বলুক তুমি মন খারাপ করবে না৷ স্যামের গান কবিতায় বলা হয়েছে মানুষের উপর কিছু নেই৷ সেখানে বর্ণ নিয়ে কিছু বলেনি৷ তুমি নিজেকে প্রমাণ করবে তুমি কারো থেকে পিছিয়ে নেয়৷”

আমি ভাবিকে দুই নয়ন ভরে দেখে নিলাম৷ ভাবি দেখতে মাশাল্লাহ খুব সুন্দর। মুখের কোণে সব সময় হাসির রেখা৷ বড় খালার ডাক শুনা যাচ্ছে৷ চিৎকার করে বলছেন,

“সাদমান শালিক ঘর থেকে পালিয়ে গেছে৷ আমি বলেছিলাম না এই মেয়ের স্বভাব ভালো না।৷ কোন জানি ছেলের হাত ধরে পালিয়েছে৷”

বোরকা খুলে তাড়াতাড়ি করে উড়ানে আসলাম৷ একদম খালার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালাম৷ এখন আর নিজেকে আড়াল করতে চাইনা৷ আমি চোখ রাঙিয়ে বললাম,

“আমাকে খারাপ কথা বলার আপনি কে? আমাকে নিয়ে আর একটা বাজে কথা বললে আমি ভুলে যাব আপনি আমার মায়ের বোন৷ আমাদের বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব৷”

ছিটকে দূরে সরে গেলাম৷ বাবা অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছেন আমার দিকে৷ চোখের আগুনে আমাকে পুড়ে ছাই করে দিবেন৷ গালে হাত দিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালাম৷ বাবা ঘৃণা নিয়ে বললেন,

“আমার মাথা কতো নিচু করবি৷ কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানিস না৷ তুই এখনও এই বাড়িতে কোন? তোকে দেখে নিজেকে শেষ করতে ইচ্ছা করছে৷ আল্লাহ আমাদের কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছেন৷”

বাবার মুখের উপর কথা বলার সাহস নেই৷ দৌড়ে ঘরে চলে আসলাম৷ বিছানার উপর ব্যাগ গুছানো৷ আমাকে বাড়ি থেকে তাড়ানোই তাদের মূল ইচ্ছা৷ ফুপি আসতেই ফুপিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম৷ ফুপি মাথায় বিলি দিতে দিতে বলল,

“চল তুই আর এই বাড়িতে থাকবি না৷ তুই আজ থেকে আমার বাড়িতে থাকবি৷ আমি আজ থেকে ভুলে যাব আমার একটা ভাই ছিল৷ আমার কাছে আজ থেকে আমার ভাই মৃত৷”

এক বুক কষ্ট নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলাম। চোখ থেকে অশ্রু পড়া বন্ধ হচ্ছে না৷ শেষে চোখের অশ্রুও আমার সাথে বে*ই*মা*নি করল। বাড়ির জন্য বুক ফেটে কান্না আসছে৷

—- ফুপা বাজারে গেছেন৷ আমি আর ফুপি সকালের রান্না করছি৷ এমন সময় ভাই আসলো ফুপির বাড়িতে৷ উচ্চস্বরে ডাকতে শুরু করল,

“শালিক..শালিক”

ফুপি উাড়ানে এসে হাসি মুখে বলল,

“আরাফ তুই কখন আসলি৷ এতো সকালে তুই এখানে৷ সবাই ঠিক আছে তো৷”

আমিও ধীরে পায়ে উড়ানে উপস্থিত হলাম৷ আমার হাত ধরে বলল,

“বাড়িতে চল৷ তুই ফুপির বাড়িতে থাকবি কেন? আমাদের কি ঘর দোয়ার নেই৷”

“আরাফ তুই শাকিলের সাথে এমন করছিস কেন? ভাতিজি তার ফুপির বাসায় আসতে পারেনা৷”

“শালিক হাজার বার আসবে৷ ফুপির বাসায় আসবে না কেন? শাকিলার বিয়ে শেষ হোক তারপর আসবে৷”

বড় ভাই কোন কথা না বলে এক প্রকার টানতে টানতে আমাকে গেইটের বাহিরে নিয়ে আসলো৷ সামনের দিকে দৃষ্টি ফেলতেই আমরা দুইজনেই স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে পড়লাম৷ বাজার থেকে খাটিয়া করে ফুপাকে নিয়ে আসছে কয়েকজন৷ চিনতে অসুবিধা হল না৷ বাজারে যাওয়ার আগে আমি যে শার্টটা দিছি সেটাই ফুপার গায়ে জড়ানো। ফুপির সামনে ফুপার মৃত দেহ নামানো হলো৷ ফুপি চিৎকার করে সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন৷

চলবে….

#শালিক_পাখির_অভিমান
#পর্ব_০৩
#অধির_রায়

নিস্তব্ধ নিথর দেহ পড়ে আছে আমাদের সামনে৷ ফুপিকে ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে আসলাম। মহল্লার মহিলারা ফুপির জ্ঞান ফিরানোর চেষ্টা করছি৷ আমি নিজেকে যথেষ্ট শক্ত রাখার চেষ্টা করছি৷ কিন্তু ফুপার কথা মনে পড়তেই চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে৷ অনেকের কাছে শুনতে পাই, আমি নিজেও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম৷ বাবার থেকে বেশি ভালোবাসা পেয়েছিলাম মানুষটার কাছে৷ উনার প্রতি ভালোবাসা উনাকে বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে৷ ফুপির জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে বার বার৷ ডাক্তার ডেকে ফুপিকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে৷ আমার জ্ঞান ফিরার পর ফুপাকে দেখার স্বাদ হলো না৷ নিস্তব্ধ বাঁশ বাগানের কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে ফুপাকে৷
ভাইয়ের হাত ধরে কবরস্থানে আসলাম৷ ফুপার সমাহিত দেখে চিৎকার করে কেঁদে দিলাম৷ নিজেকে সবথেকে দুর্বল মনে হচ্ছে৷ দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছি না৷

মা, বাবা, ভাই, শাকিলা, একে একে সবাই চলে গেল৷ ফুপির মেয়ে ফারিয়াও চলে গেছে৷ আগামীকল থেকে উনার পরীক্ষা শুরু৷ রয়ে গেলাম আমি আর দাদী৷ বৃদ্ধ দাদীর ইহকালের প্রতি কোন মায়া নেই৷ মেয়ের অবস্থা দেখে নিজের অবস্থা নাজেহাল৷ তবুও মেয়েকে ছেড়ে যাবেন না৷ নাড়িছেঁড়া ধন কিছুতেই তিনি আলাদা করতে পারছেন না৷

আজ তিনদিন হলো ফুপা নেই৷ ফুপির মুখে নেই কোন হাসি৷ কাঁদতেও ভুলে গেছে৷ চোখের অশ্রু ফুরিয়ে গেছে। মনটা পাথরে পরিণত হয়েছে৷ হাজার চেষ্টা করেও এক লোকমা খাবার খাওয়াতে পারলাম না৷ জোর জবরদস্তি করে অল্প পরিমাণ আমের জুস খাওয়াতে সক্ষম হয়েছি৷ দাদী ভেজা গলায় বলল,

“দিভাই আমার মাকে আমার বাড়িতে নিয়ে চল৷ শাকিলার বিয়ে নিজের চেখে দেখলে একটু স্বাভাবিক হবে৷ আমার মা যে মারা যাচ্ছে৷ আমি আমার মায়ের কষ্ট দেখতে পারব না৷”

দাদীর কথামতো নিজের বাড়িতে চলে আসলাম৷ কাল শাকিলার বিয়ে৷ আমি বাড়িতে ফিরে আসছি বলে বড় খালা ছুটে আসলেন আমাদের বাড়িতে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে৷ আমি ঠোঁট কামড়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি৷ হুংকার দিয়ে বলল,

“তুই এ বাড়িতে আসলি কেন? আবার কাকে খেতে আসছিস৷ অপয়া মেয়ে যেখানে যাবে সেখানেই কাউকে না কাউকে খাবে! শেষে তোর ফুপাকেও ছাড়লি না! তোর ফুপিকে স্বামীর সোহাগ থেকে বঞ্চিত করলি৷”

খালার কথার আমার রক্ত চড়ে বসেছে৷ ভাই কোথা থেকে যেন দৌড়ে আসল খালার চিৎকার শুনে৷ আমি কিছু বলার আগে ভাই বলল,

“খালা আপনি আমার বোনের ব্যাপারে একটাও বাজে কথা বলবেন না। সে আপনার বাড়িতে আসেনি আজ না আসলেও একদিন না একদিন বাড়িতে ফিরতেই হতো৷”

ভাইয়ের কথাতে খালার আরও রাগ হলো৷ চোখ দু’টো রসে গোল্লার মতো গোল গোল৷ রক্তবর্ণ রাগী চোখে আমাদের স্কেন করছে৷ গম্ভীর গলায় বলল,

“আরাফ তুই অপয়া মেয়ের জন্য তোর খালাকে অপমান করছিস৷ এর ফল কি হতে পারে তোর কোন ধারণা আছে?”

“যাই হোক না কেন? একটা বাজে কথা বললে আপনার জিহ্বা কেটে দিব৷ ভুলে যাব আপনি আমার খালা হোন৷”

ভাইয়ের উচ্চ স্বরে খালা কিছুটা ভয় পান৷ খালা নিজের ভয় লুকিয়ে রাখার জন্য ভাইয়ের গালে কষিয়ে থা*প্প*ড় বসিয়ে দেন। ভাই থা*প্প’ড় তুললে আমি হাত ধরে ফেলি৷ খালা ফুসফুস করে বলে উঠল,

“তোদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই৷ আমার ছেলের বিয়ে তোর বোনের সাথে দিব না৷ আমি সাদাফের বিয়ে অন্য জায়গায় দিব৷ মোটা অঙ্কের যৌতুক নিব। কেন যে তোদের ফকির পরিবারে ছেলের বিয়ে ঠিক করলাম?

বাবা বাড়িতে নেই৷ বিয়ের কেনাকাটা করতে গেছেন৷ মা কোথায় থেকে দৌড়ে এসে হাত জোর করে বলল,

“বুবু এমন কাজ করবেন না৷ আমার মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। শাকিলার এতো বড় ক্ষতি করবেন না৷ আমরা গরিব মানুষ। আমাদের মান সম্মান আগে৷”

সাদাফ ভাই খালার সাথে এসেছেন৷ বাইকে বসে ফোন টিপে যাচ্ছে। মায়ের কথার কোন প্রতিবাদ করছেন না৷ ভাইয়া মায়ের হাত ধরে ফেলে। রাগী গলায় বলল,

“আমিও আমার বোনের বিয়ে সাদাফের সাথে দিব না৷ শাকিলার বিয়ে সাদাফের থেকে ভালো ছেলের কাছে দিব৷”

খালা মুচকি হেঁসে বলল,

“তোর বোনের বিয়ে কোনদিন দিতে পারবি না৷ তোদের টাকা আছে। তোর বোন যতই অপ্সরা হোক যৌতুক ছাড়া বিয়ে দিতে পারবি! আমি তোদের দয়া করে যৌতুক মাফ করে দিছিলাম৷ আমি সাদাফকে মোটা অঙ্কের যৌতুক নিয়ে বিয়ে দিব৷”

সাদাফ ভাইয়ার মুখে এখনও কোন কথা নেই৷ শাকিলা কপাট ধরে নিরবে নিভৃতে কান্না করছে৷ আমাকেই কিছু করতে হবে৷ হাতের চুড়ি খুলে সাদাফ ভাইয়ার মুখে ছুঁড়ে মারলাম৷ রাগী গলায় উপহাস করে বললাম,

“আপনার ছেলেকে চুড়ি পড়িয়ে ঘরে বেঁধে রাখেন৷ চুড়ি শাড়ি না পড়লে আপনার ছেলেকে সুন্দর দেখাবে না৷ সুন্দর না দেখালে বাজারে আপনার ছেলের দাম কমে যাবে৷যৌতুকের টাকা দেখার সৌভাগ্য নাও হতে পারে। আপনার ছেলে একটা হি*জ*রা। ভালোবাসার মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেনা৷

আমার কথা সাদাফ ভাইয়ার পুরুষত্বে লাগে৷ খালা কিছু বলার আগে সাদাফ ভাইয়া বলল,

“আমি শাকিলাকেই বিয়ে করব৷ শালিকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করব না৷”

বড় খালার ছেলের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন৷ গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

“যে বাড়িতে তোর মায়ের অপমান হলো সেই বাড়িতেই তুই বিয়ে করতে চাস৷ কেমন ছেলে তুই!”

“মা বাড়িতে চল৷ এখানে অশান্তি করার দরকার নেই৷”

সাদাফ ভাইয়া বড় খালাকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন৷ খালা চলে যেতেই শাকিলা দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল৷ ভেজা গলায় বলল,

“তোর মতো বোন যেন সবার ঘরে ঘরে হয়৷”

বাড়িতে হইচই পরিপূর্ণ। সবাই বরকে বরণ করতে চলে গেছে৷ ফুপিও গেছে সাদাফ ভাইকে বরণ করতে৷ ফুপিকে আজ জোর করতে হয়নি খাওয়ানোর জন্য৷ নিজের খাবার নিজ থেকে খেয়ে নিয়েছে৷ উপর থেকে দেখে স্বাভাবিক মনে হলেও ভিতরে ভিতরে ম*রে যাচ্ছেন৷ সাদাফ ভাইকে শাকিলার পাশে বসানো হলো৷ শাকিলাকে আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে৷ লাল টুকটুকে বেনারসিতে একদম লাল পরী লাগছে৷ আমার ছোট বোনটা বাড়ি থেকে চলে যাবে ভাবতেই বুকের ভিতর ধুমড়ে মুচড়ে উড়ল।

বিয়ের কাজ শেষ মুহুর্তে বড় খালা চিৎকার শুরু করে৷ চিৎকারের রহস্য উদঘাটনের জন্য সবাই দৌড়ে উড়ানে চলে আসি৷ কাজি হাসেব বিয়ে পড়ানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন৷ বড় খালা মাটিতে বসে ম*রা কান্না জুড়ে দিছে৷ ভাইয়া হাঁটু গেড়ে বসে খালাকে প্রশ্ন করল,

“আপনি এবাবে কান্না করছেন কেন? কি হয়েছে আপনার?”

খালার মুখে কোন জবাব নেই৷ ন্যাকা কান্না করেই যাচ্ছে৷ খালার কাঁধে হাত রাখতেই আমার হাত বিদ্যুৎ গতিতে সরিয়ে দেয়৷ চিৎকার করে বলল,

“তোর অপবিত্র হাতে আমাকে ধরবি না৷ তুই আমার চোখের সামনে থেকে দূর হু।”

ভাইয়া পুনরায় প্রশ্ন করেন৷ খালা জবাবে বলল,

“আমার সব শেষ হয়ে গেল৷ আমার তিল তিল করে গড়ে তোলা সব কিছুই নিমিষেই শেষ হয়ে গেল৷”

ভিড়ের মাঝখান থেকে একজন বলে উঠল,

“ছেলে বিয়ে করে মায়ের হাত ছাড়া হয়েছে নাকি৷ আপনার ছেলে তো আপনারই থাকবে৷”

ভেজা কন্ঠে বলল,

“আমার সব গহনা চু*রি হয়ে গেছে৷ আমার গহনা চু*রি করল কে? আমি খাবার শেষ করে হাত ধুতে আসলাম৷ এসে দেখি আমার একটাও গহনা নেই৷ আমি ব্যাগে রেখেছিলাম৷ এসব গহনা শাকিলাকে দিব।”

খালার কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে যায়। আমি এক কদম পিছিয়ে পড়লাম৷ আমি জানি খালা খুব কষ্ট করে গহনা গড়েছেন৷ হাতের কাকন, গলার চিকন চেইন, কানের জুমকো সব সোনার৷ কাউকে ধরতেও দেন না৷ ভাই বলে উঠল,

“বিয়ে বাড়িতে যারা এসেছে সবাইকে চেক করা হবে৷ কে এই কাজ করতে পারে?”

ওদিকে বিয়ের কাজ সম্পুর্ন হয়ে গেছে৷ বাবা আর আরাফ ভাই সবাইকে চেক করছেন৷ খালার পরিচিত এক মহিলা মেয়েদের চেক করছেন৷ একের পর এক সবাইকে চেক করলেন৷ কারো কাছে গহনার ছিঁড়ে ফোটাও পাওয়া গেল না৷ খালা ভেজা গলায় বলল,

“নিশ্চয় কেউ এসব সরিয়ে রেখেছে৷ আমি জানি আজই এসব কিছু পাওয়া যাবে৷ আমি সবার ঘরে সার্চ করবো৷ একে একে সবার ঘর সার্চ করল৷ অবশেষে সার্চ করতে আসল দাদীর ঘর। আমি দাদীর ঘরেই পড়াশোনা করি৷ ঘুম পেলে শাকিলার সাথে ঘুমাই৷ ভাইয়া সার্চ করতে চাইলে খালা বলে উঠল,

” আমি এই ঘর সার্চ করব। তোরা তো সব ঘর সার্চ করলি৷”

কেউ কোন বাঁধা দিল না৷ আমার মনে ভয় হানা দিল৷ খালার আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল দেয়৷ আমি নিশ্চিত খালা এখানে নিজের চাল চেলেছেন৷ খালা আমাকে নিয়ে সব সময় দাবার ঘুটির মতো খেলেন৷ বিছানার নিচে। আমার প্রতিটি বইয়ে খুজতে থাকল৷ ড্রায়ার খুলতেই খালার কাকক আর কানের দুল পাওয়া গেল৷ আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না৷ আমার ড্রয়ারে কিভাবে আসল? খালা আমার দিকে তেড়ে আসেন৷ আমার চুলের মুড়ি ধরে বলেন,

“সোনার চেইন কই? আমার সোনার চেইন কই রাখছিস৷”

কেউ কোন কথা বলছে না৷ চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে৷ শেষে কিনা খালা আমাকে চো*র বানিয়ে ছাড়ল৷ জোরে চুল টেনে ধরাতে অনেক ব্যথা পাচ্ছি৷ খালার সাথে থাকা মহিলাটি বলল,

“বু*জি ছোট মেয়ের মাথায় এমন ভাবনা আসতে পারে না৷ তার সাথে অন্য কেউ জড়িত ছিল৷ তার কাছে সোনার চেইন আছে৷ আপনি এই ঘর ভালো করে সার্চ করেন৷ খালার অন্য কিছু অন্য কিছু সার্চ না করে সোজা ফুপির ব্যাগে জাপিয়ে পড়লেন৷ ফুপির ব্যাগের থেকে উদ্ধার করল অবশিষ্ট সোনার চেইন৷ খালা হুংকার দিয়ে বলল,

” এজন্যই বলি ফুপু ভাতিজির এতো মিল কেন? এই মহিলাই শালিককে দিয়ে এসব কাজ করিয়েছে৷”

ফুপি কিছুই বুঝতে পারছে না৷ কে রেখেছে তার ব্যাগে চেইন? খালা তেড়ে এসে ফুপিকে কয়েকটা চর বসায়৷ এবার মারতে নিলেই আমি খালার হাত ধরে ফেলি৷ আমি ক্ষোভ নিয়ে বলে উঠলাম,

“ছি খালা। তুমি খালা হয়ে আমাদের সাথে নোংরা খেলা খেলতে পারলে৷ তুমি নিজেই তো আমাদের এখানে তোমার গহনা রেখে গেছ৷”

রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

“চো*রে*র মায়ের বড় গলা৷ আমার কোন দরকার আছে এসব করার৷ আজ তোদের দু’জনের বিচার করতে হবে৷ তার আগেই আমি সাদাফ আর শাকিলাকে বাড়িতে রেখে আসি৷”

আমি দাদীর রুম থেকে বের হলাম না৷ বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে আমাদের চো*র প্রমাণ করল৷ ফুপি কান্না করে যাচ্ছেন৷ ফুপি কান্না করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে যান৷ ফুপির পিছন পিছন আমিও বের হয়৷ আমি বের হতে হতে ফুপি আড়াল হয়ে যান৷

রাত দু’টো বাজে৷ কারো চোখে কোন ঘুম নেই৷ দুই হাতে যত জোর আছে সমস্ত জোর দিয়ে বাবা আমাকে কয়েকটা থা*প্পড় দেন। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছি না৷ মাটিতেই বসে পড়লাম৷ খালা গম্ভীর কন্ঠে বলল,

“সাদমান কাল সকালে চো*র দুইটার মুখ কালো করে সারা মহল্লা ঘুরিয়ে তাদের এ মহল্লা থেকে বের করে দিব৷”

বাবা আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। সবার মুখে এক কথা৷ চো*র বিদায় না করলে অন্যদিন অন্যের বাসায় চু*রি করবে৷ বাবার বুকে পাথর রেখে বলল,

“আপনাদের যা ইচ্ছা তাই করেন৷ শালিক নামে আমার কোন মেয়ে নেই৷”

বাবার মুখ লুকিয়ে চলে যান৷ একে একে সবাই চলে যায়৷ ভাইও শেষে মুখ ফিরিয়ে প্রস্তান করে৷ খালা চাওয়ার আগে শয়তানি হাসি দিয়ে যান৷ ফুপি আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকেন৷ আমি, দাদী, ফুপি নিস্তব্ধ উড়ানে বসে কান্না করে যাচ্ছি৷ কান্না করতে করতে উড়ানেই ঘুমিয়ে পড়ি৷ ভোরের আলো ফুটতেই ঘুম ভেঙে যায়৷ আমার গায়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে ফুপি আর দাদী৷ ফুপির হাতে বি*ষের ওষুধ। নিষ্পাপ দু’টো দেহ পড়ে আছে৷ আমি ফুপি বলে চিৎকার করে উঠলাম৷ আমার চিৎকারে সবাই এসে জমা হলো৷ আমার কানে শুধু ফুপির একটা কথায় বাজছে, ❝চো*রে*র অপবাদ নিয়ে বাঁচতে পারব না৷ স্বামী হারানোর ব্যথা লাগাম হলেও চো*রের কথা রটে যাবে সারা জীবন।❞

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here