#শালিক_পাখির_অভিমান
#পর্ব_০৬,০৭
#অধির_রায়
০৬
সময় ও স্রোত কারোর জন্য অপেক্ষা করে না৷ থেমে থাকে না মানুষের জীবন স্থিতি জড়তার মতো। আবহমান নদীর মতো বয়ে চলে৷ চোখে ভীষণ ঘুম৷ চোখের পলক ফেললেই দুঃখগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠে৷ নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে চারিপাশ। প্রকৃতিও ঘুমিয়ে পড়েছে৷ শুধু আমি চোখের পাতা এক করতে পারছি না৷ আমি ওজু করে এসে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করতে বসলাম৷ সালাত আদায় করলে অস্থিরতা কমে৷ সালাতের মাধ্যমেই আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়া যায়৷ তাহাজ্জুদের সালাত শেষ হতেই কানে ভেসে আসে ফরজের আজান৷ ফজরের সালাত আদায় করে রুমের কপাট খুলে ডাইনিং রুমে আসলাম৷ আমি মায়া ফুপির সাথে নিচ তলায় থাকি৷ তারা সবাই উপরের তালায় থাকেন৷ নিচ তালায় আরও অনেক কাজের লোক থাকেন৷ ডাইনিং রুমের বড় একটা আলমারি রাখা আছে৷ গতকাল দেখেছি এখানে অনেক হাদিস শরিফের বই৷ পাশে কয়েকটা কুরআন শরীফ দেখেছি৷ আমি আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে আছি৷ কেউ আমাকে চো*র ভাববে না তো৷ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগতেছি৷ ঝাপ্সা আলোর মাঝে দেখতো পেলাম স্যার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছেন৷ আমি ওড়না ঠিক করে স্যারের সামনে গেলাম৷ স্যার আমার দিকে তীব্র দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছেন৷ এমন সময় আমাকে আশা করেননি৷ ঘুম ঘুম চোখে বলল,
“এতো সকালে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
গম্ভীর কন্ঠের আওয়াজ শুনে কথা বলার সাহস হারিয়ে ফেলেছি৷ আমাকে আবার চো*র ভাবেনি তো৷ হাত কাচুমাচু করছি৷ স্যারের কথার উত্তর না দেয় আমাকে বাড়ি থেকে চো*রের অপবাদ দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারে। চো*রের অপবাদ নিয়ে গ্রাম থেকে নিশি রাতে পালিয়ে এসেছি৷ ভয়ে ভয়ে বললাম,
“আমি এখানে ম্যাডামের জন্য অপেক্ষা করছিলাম৷ ম্যাডাম সালাত আদায় করতে উঠবেন কখন?”
স্যার আমার দিকে সন্দেহের দিকে তাকাল৷ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“তোমার ম্যাডাম বলেছে এখানে এতো সকালে দাঁড়িয়ে থাকতে৷ আমি ভেবে নিব তুমি অন্য কিছু… ”
স্যারের কথা শেষ না হতেই মুখের উপর বললাম,
“স্যার আমি আলমারি থেকে একটা কুরআন শরীফ নিতে চাই৷ গতকাল দেখেছি এখানে কয়েকটা কুরআন শরীফ আছে৷ ফজরের সালাত আদায়ের পর আমি নিয়মিত কুরআন শরীফ তেলওয়াত করি৷ কুরআন শরীফ নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম৷”
স্যার আমার দিকে তীব্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন৷ আমাকে সন্দেহ করল কিনা জানি না৷ ভয়ে একদম জড়োসড়ো হয়ে আছি৷ জামা খা*ম*চে ধরে আছি। ভদ্রতার সহিত বলে উঠল,
“আলমারি থেকে তোমার যে কুরআন পছন্দ সেটা নিয়ে পড়তে পারো। মায়া ঘুম থেকে উঠনি৷”
“না স্যার৷ চা খাবেন! আমি চা বানিয়ে দেয়৷”
“না আমি চা খাবো না৷ আমি বাগানে হাঁটতে যাচ্ছি৷ আমার ডায়াবেটিস আছে৷ সেজন্য রেগুলার সকাল বেলা হাঁটাহাঁটি করি।”
উনি চলে গেলেন৷ আমি কুরআন শরীফ নিয়ে দরজা খুলে ভোরের আলোতে পড়া শুরু করলাম৷ এতো বড় দরজার একটা কপাট খোলতেই সমস্ত রুম আলোকিত হয়ে গেছে৷ কুরআন শরীফ কিছু অংশ পড়ার পর দোয়া করলাম৷ ঘুরে দাঁড়াতেই ম্যাডাম আর ফুপি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন৷ স্যার দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে আছেন৷ ম্যাডাম বলল,
“বাড়িতে বাল্বের অভাব পড়েছে৷ এভাবে কেউ দরজার সামনে বসে কুরআন শরীফ পড়ে?”
উনার কথার তেমন কিছু বুঝতে পারলাম না৷ এটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি কপাট খুলে কুরআন শরীফ পড়াতে কিছুটা ক্ষিপ্ত আমার উপর৷ আমি বাড়িতে সকাল বেলা কপাট খুলে কুরআন শরীফ তেলওয়াত করতাম। আমি ভুল কি করেছি? মাথা নিচু করে বললাম,
“ম্যাডাম বাড়িতে দেখতাম মা, দাদী সবাই দরজার সামনে বসে কুরআন শরীফ তেলওয়াত করতেন৷ তাদের সাথে আমিও কুরআন শরীফ তেলওয়াত করতাম দরজার কাছে বসে৷ ভোরের আলোতে কুরআন শরীফের অক্ষর চকচক করে৷”
“এখন থেকে রুমে বসে কুরআন শরীফ তেলওয়াত করবে৷ এখানে বসে তেলওয়াত করার দরকার নেই৷ এটা তুমি গ্রাম পাওনি৷
আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম৷ কুরআন শরীফ যথাস্থানে রেখে রান্না ঘরে চলে গেলাম৷ মায়া ফুপি সবার জন্য চা বসিয়েছেন৷ কিছুটা অবাক হলাম৷ গতকাল বলল ‘খাওয়ার পর চা খান৷’ আজ কেন আগে চা বসালেন? মিহি কন্ঠে বললাম,
” ফুপি রান্না না বসিয়ে চা কেন বসালেন?”
ফুপি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“শালিক! কে কখন চা খাবে কফি খাবে বলা যায়না তো৷ শ্রুতি আর ইমন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আগে কফি খাবে৷ ইহান চা খাবে৷ বাকী সবাই রান্নার পর চা খাবে৷”
ফুপি কথা বলার মাঝে কফি বানিয়ে ফেলল। আমি উপর থেকে ময়দা নামালাম। আটা ময়দার মাঝে সব সময় গুলিয়ে ফেলতাম৷ করিম চাচার দোকানে গেলে আটা আর ময়দার দাম গুলিয়ে ফেলতাম৷ অনেক কষ্টে ময়দার দাম মনে রাখার উপায় পেয়েছিলাম৷ মেয়ে মানুষ মুখে ময়দা মা*খে। মেয়ে—ময়দা, ময়দার দাম বেশি৷ মনে পড়তে হেঁসে উঠলাম৷ ফুপি বলল,
“শ্রতি আর ইহানের রুমে কফি দিয়ে আয়৷”
আমি কফির ট্রে হাতে নিয়ে ধীর পায়ে তাদের রুমের সামনে গেলাম। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকলাম৷ শ্রুতির যে পরিমাণ রাগী কিছু করবে না তো৷ যে বান্দা আল্লাহকে ভয় পায় সে বান্দা অন্য কাউকে ভয় পায়না৷ আমি কেন ভয় পাব? মনে সাহস জুগিয়ে রুমে ঢুকলাম৷ শ্রুতি ভাবি ঘুম থেকে উঠে ফোন টিপতেছে৷ দেখে মনে হলো সারারাত ঘুমাইনি৷ সারারাত ফোন টিপছে৷ চুলগুলো উসকো খুশকো। চোখে ভারী ঘুমের আবাস ফুটে ওঠেছে৷ আমাকে দেখেই রেগে যান৷ সকাল বেলা আমাকে তার রুমে আশা করিনি৷ চিৎকার করে বলে উঠল,
“তুই আমার রুমে কেন? সকাল বেলা কালো মেয়ের মুখ দেখা মানে অমঙ্গল ডেকে আনা৷”
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,
“আপনার কফি। আমি আপনার কফি দিতে আসছি৷”
চিৎকারে ইহান ভাইয়া উড়ে গেল৷ উনিও নিচু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন৷ শ্রুতি গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“তুই ছাড়া বাকী সব কাজের লোক ম*রে গেছে৷ মায়া খালাকে আমি আজ দেখাচ্ছি৷ এতো ন্যাকামি কোথা থেকে আসে৷”
আমি মুখ ফুটিয়ে বললাম,
“আমি নিজ থেকে কফি নিয়ে এসেছি৷ মায়া খালার কোন দোষ নেই৷”
নিজের কথা বলতেই গালে ঠাস করে কষিয়ে একটা থা*প্প*ড় বসিয়ে দেন। চোখ পাকিয়ে বলল,
“তুই সকাল বেলা কোনদিন আমার সামনে আসবি না৷ তোর কালো মুখ সকাল বেলা আমাকে দেখাবি না৷ অপয়া মেয়ে৷”
গালে হাত দিয়ে চলে আসলাম৷ ভুলেই গেছিলাম ঘুম থেকে উঠে কেউ আমার মুখ দেখতে চাননা৷ শ্রুতি ভাবি লেখাপড়া করেও কুসংস্কার মেনে আসছে। আমাকে দেখলে কারোর দিন ভালো যায়না৷ সাদা চামড়ার লোক মনে করে কালো চামড়ার গায়ে আঘাত লাগে না৷ তাদের কোন অনুভূতি নেই৷ চোখের নোনা জল মুছে রান্না ঘরে চলে আসলাম৷ রান্না শেষ করেই বাগানে গেলাম৷ বাগানে বাহারি রকমের ফুলের গাছ৷ মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। প্রাণ খুলে ফুলের সুবাস নিলাম৷ আঙ্কেল ফুল গাছে পানি দিচ্ছে৷ আঙ্কেল ডাকতে কেমন জানি লাগে৷ ঢাকা এসে একটু আঙ্কেল ডাকার চেষ্টা করছিলাম৷ আঙ্কেল মুখে আটকে পড়ে৷ কাকা ডেকে বসলাম,
“মালী কাকা আমি গাছে পানি দিয়ে দেয়৷”
মালী কাকা মুচকি হেঁসে বলল,
“ঠিক আছে৷ সব গাছে ভালো করে পানি দিবে৷”
মালী কালা দোলনায় বসে সিগারেট খাচ্ছেন৷ আমি ফুল গাছে পানি দিলাম৷ গাছে পানি দেওয়ার পর চুপি চুপি রান্না ঘরে গেলাম৷ ফুপিকে বললাম,
“তারা কেউ খেতে আসিনি!”
“না খেতে আসেনি৷ ফুলের বাগান কেমন দেখলি৷”
“খুব সুন্দর ফুলের বাগান৷ বাহারি রকমের ফুলের গাছ। বাহারি রকমের ফুল৷ মনোমুগ্ধকর পরিবেশে একটা ভিন্ন জগৎ৷”
খাবারগুলো টেবিলে দিয়ে আয়৷ তারা এখনই খেতে আসবে৷ আমি খাবারের বাটি একে একে টেবিলে সাজিয়ে দিলাম৷ আমার খুব ভালো লাগছে৷ আজ ম্যাডাম স্যারকে আমার পড়ার বিষয়ে কথা বলবে৷ একে একে সবাই খেতে আসল৷ বাকি রইল ইহান ভাইয়া৷ তার খাবার ঘরে দিয়ে আসতে হয়৷ নবাবজাদা শুধু রাতে টেবিলে বসে খান৷ যে যার মতো খেয়ে যাচ্ছে৷ ম্যাডাম আমার পড়ার বিষয় নিয়ে স্যারের সাথে কোন কথা বলল না৷ আমার স্বপ্নটা ভে’ঙে চু’র’মা’র হয়ে গেল৷ এক সাগর আশা নিয়ে কান পেতে রয়ে ছিলাম৷ ম্যাডাম এখনই বলবে শালিক পড়ালেখা করতে চায়। কিন্তু মুখ থেকে শালিক নামে কোন শব্দ বের হলো না৷
এভাবে কেটে যাচ্ছে দিন৷ দেখতে দেখতে কেটে গেল এক সপ্তাহ। বড়লোক মানুষ গরিব মানুষের কথা মনে রাখে না৷ দুনিয়ায় সবকিছু মনে থাকলেও আমার কথা মনে থাকে না৷ শালিক নামে তাদের বাড়িতে কেউ আছে এটা ঠিক মনে আছে৷ কখন কি করছে? কখন কই লোকমা খাবার বেশি খাচ্ছি? সেসব বিষয়ে খেলা আছে৷ সেদিকে নজর দিতে ভুলে যাননি৷ আমিও আশা ছেড়ে দিলাম৷ গরিবের মেয়েকে তারা কোন স্বার্থে পড়াবে? তবুও কিঞ্চিৎ আশা নিয়ে বসে থাকি৷ আজ শুক্রবার। বিকেলে সবাই এক সাথে খেতে বসেছেন। আজ তারা আমাদের সাথে খেতে বসেছেন৷ অন্যান্য দিন তারা নিজেরা আগে খান৷ আমরা খাই কিনা না খাই সেদিকে কোন খেয়াল নেই৷ আজ সবাই ফ্লোরে মাদুর বিছিয়ে খাবার খাচ্ছি৷ আমি সহ বাড়ির সকল কাজের লোক এক সাথে বসে খাচ্ছেন৷ আমাকে দেখে শ্রুতি নাক ছিটকাচ্ছে। শ্রুতির কথা কেউ পাত্তা দেয়নি৷ স্যারের উক্তি, ‘একদিন সবার সাথে বসে খাবার খেলে ভালোবাসার বন্ধন মজবুত হয়৷’ আমার দিকে ম্যাডাম তাকিয়ে বলল,
“আমি আজ সবার সামনে শালিককে নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।”
ম্যাডামের কথা শুনে গলায় খাবার আটকে গেল। ফুপি আমার দিকে পানি এগিয়ে দিলেন৷ পানি পান করে নিজেকে শান্ত রাখলাম৷ আমার নামে কি বলতে চান? সকলের দৃষ্টি ম্যাডামের দিকে৷ খাবারের দিকে কারোর নজর নেই৷ ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে৷ ম্যাডাম আনন্দের সাথে বলল,
“আমি চাচ্ছি শালিককে স্কুলে ভর্তি করতে৷ শালিক লেখাপড়ার পাশাপাশি বাড়ির কাজ করবে৷ দরকার পড়লে আরও একটা কাজের লোক রেখে দিব৷”
শ্রুতি ক্ষোভ নিয়ে বলল,
“মা আপনার দেখছি গরিবের প্রতি দরদ বেশি৷ এই ছোটলোকদের পাত্তা দেওয়া বন্ধ করেন৷ একদিন দেখবেন আমাদের ঘাড়ে বসে নাচবে৷”
শ্রুতি ভাবির সাথে ইহান ভাইয়াও বলে উঠল,
“মা শ্রুতি একদম ঠিক বলেছে৷ কালো মেয়ে লেখাপড়ার করে কি করবে? তার থেকে বরং কোন বৃদ্ধ লোক দেখে কিছু টাকা যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিয়ে দাও৷”
স্যার রাগী গলায় বলল,
“তোমার মা বলেছে শালিক স্কুলে যাবে মানে স্কুলে যাবে৷ আর শ্রুতি মা গরিব ধনী একসাথে বসে খেলে কি মান সম্মান চলে যায়? বরং মান সম্মান আরও বৃদ্ধি পায়৷ তোমার জন্য তাদের চোখে সম্মান বেড়ে যাবে৷ তুমি নিজেকে তাদের জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেখো৷”
শ্রুতি ভাবি ক্ষোভ নিয়ে ভারী গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“বাবা আমি সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম নিয়েছে৷ তাদের সাথে আমাকে তুলনা করছেন৷ তাদের না আছে কোন স্ট্যাটাস, না আছে কোন সোসাইটি।”
শ্রুতি ভাবি খাবার রেখে হনহন করে চলে গেল। শ্রুতি ভাবির পিছন পিছন ইমন ভাইয়াও চলে গেল৷ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে স্যার বলল,
“ছেলেমেয়েদের আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলাম না৷ কাজ করলেই যে মানুষ চাকর হয়ে যায় তাদের মনোভাব৷ আমরাও তো কারোর না করোর আন্ডারে কাজ করি৷ আমরাও সেদিন থেকে চাকর হয়ে গেলাম?”
আমার লেখা পড়ার বিষয়ের বাড়ির সকলে সাপোর্ট করল৷ সবাই সাপোর্ট করলে এটার কোন মর্যাদা থাকত না৷ ভালো মন্দ মিলিয়েই দুনিয়া৷ মন আছে বলেই ভালোর এতো দাম৷ রাত আছে বলেই দিনের এতো কদর। চৌধুরী মঞ্জিলে সবাই খুব ভালো৷ সকলে খাবার খেতে মন দিল৷ কিন্তু আমার গলা দিয়ে খাবার নামল না৷ আমার সাথে রাগ করে ইমন ভাইয়া আর শ্রুতি ভাবি চলে গেল৷
চলবে…..
#শালিক_পাখির_অভিমান
#পর্ব_০৭
#অধির_রায়
আমি আর ইহান ভাইয়া রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছি৷ আজ আমি পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষ। আমার স্বপ্ন পূরণ হতে চলছে৷ লেখাপড়া করার সুযোগ পাবো আমি কল্পনাও করতে পারিনি৷ দাঁড়িয়ে থেকে রিক্সা পেলাম না৷ আমাকে গেইটের সামনে দাঁড় করিয়ে ইহান ভাইয়া একটা রিক্সা নিয়ে আসেন। ইহান ভাইয়া রিক্সা থামিয়ে বলে উঠল,
“চলে আসো৷”
আমি রিক্সায় উঠার সাহস পাচ্ছি না৷ অজানা অচেনা ছেলের সাথে এক রিক্সায় কিভাবে যাব? স্কুল কতোদূর তাও জানিনা৷ কাছে হলে হেঁটে যেতাম৷ আমি ইহান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি৷ ইহান ভাইয়া পুনরায় বলল,
“কি হলো? এভাবে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছো কেন? তুমি কি লেখাপড়া করতে চাওনা?”
আমি হাত কাচুমাচু করে বললাম,
“আমি আপনার পাশে বসলে অনেকে কথা শুনাবে৷ আমি পারব না আপনার পাশে বসতে৷ আপনি বরং অন্য আর একটা রিক্সা নিয়ে আসেন৷”
ইহান ভাইয়া মুচকি হেঁসে বলল,
“তুমি আমার পাশে বসলে আমার কোন সমস্যা নেই৷ কে কি বলবে সে নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। আমি একটা রিক্সাই পেয়েছি৷ বাড়তি গাড়ি থাকলে তোমাকে গাড়ি করেই নিয়ে যেতাম৷ গাড়ি শুধু অফিসে যাওয়া আসার কাছে ব্যবহার করে।”
এপাশ ওপাশ তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না৷ রাস্তা পুরো ফাঁকা। ফাঁকা বলতে রিক্সা নেই৷ ইহান ভাইয়ের পাশে বসা ছাড়া কোন উপায় নেই৷ আমি মাথার ওড়না ঠিক করলাম৷ ওড়না দিয়ে নিজেকে পরিপাটি করে নিলাম৷ বিসমিল্লাহ বলে রিক্সাই উঠলাম৷ মা সব সময় বলতেন, ‘কোথাও যাওয়ার আগে, কোন ভালো কাজ করার আগে বিসমিল্লাহ বলতে হয়। বিসমিল্লাহতে অনেক বরকত।’
ইহান ভাইয়ের কাছ থেকে দূরত্ব রেখে বসেছি। ইহান ভাইয়া এতো ভদ্র কবে থেকে হলো? আমাকে দেখলেই তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন৷ সেদিন উনার ফ্লোরে একটু পানি ফেলছিলাম৷ আমার ওড়না দিয়ে সে পানি পরিষ্কার করিয়েছে৷ আমি ঘর মুছতে নিলে জুতা নিয়ে সামনে ঘুরঘুর করতো৷ আমাকে এক কাজ বারবার করানোই তার স্বাভাব৷ শাস্তি হিসেবে আমাকে গান শুনাতে হতো৷ আমি গান না পারলেও তিনি এক লাইন বলে দিতেন সেটা শুনে আমাকে বলতে হতো৷ সেদিন হিন্দি গান বলতে পারিনি বলে আমাকে ত্রিশ বার কান ধরে ওঠবস করিয়েছে৷ উনিও যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বসে আছেন৷ রাস্তায় আমাদের মাঝে কোন কথা হলো না৷ রিক্সা স্কুল গেইটের সামনে নামিয়ে দিল৷ বাড়ি থেকে দূরে নয় স্কুল৷ হেঁটে আসতে দশ মিনিটের মতো লাগবে৷ আমাকে লেখাপড়ার করার সুযোগ দিয়েছে এটাই বেশি৷ প্রতিদিন রিক্সা ভাড়া নিতে পারব না৷ তাই আসার সময় রাস্তা খেয়াল করে করে আসলাম৷”
স্কুলে প্রবেশ করতেই কিছু মেয়ে ইহান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছে৷ ইহান ভাইয়া দেখতে এমনি অনেক সুন্দর। তার উপর কালো প্যান্ট, কালো শার্ট, কালো চশমা, কালো ঘড়ি৷ অনেক সুন্দর লাগছে৷ আমি ভাইয়ার পিছন পিছন অফিস রুমে গেলাম৷ ভাইয়া আমাকে ইশারা করে পাশের চেয়ারে বসে বলেন৷ আমার দিকে ফরম এগিয়ে দিল। কলম হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“শালিক ফরম পূরণ করো৷”
আমি ফরম পূরণ করতে লাগলাম৷ আমার পুরো নাম শালিক আহমেদ লিখলাম৷ বাবার নাম সাদমান আহমেদ, মাতার নাম রিয়া আহমেদ লিখলাম৷ ঠিকানা কি দিব? বুঝতে পারছি না। ইহান ভাইয়াকে বললাম “ঠিকানা কি দিব?”
ইহান ভাইয়া ফরম নিয়ে ঠিকানা বসিয়ে দিলেন৷ আমাকে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হলো৷ দশম শ্রেণিতে ভর্তি করল না৷ সাইন্স অনেক কঠিন বলে আমাকে মানবিকে ভর্তি করল৷ ভর্তির পর আমি এক রিক্সায়, ইহান ভাইয়া অন্য রিক্সায়৷ আমাকে নিয়ে শপিং মলে গেলেন৷ আমাকে গাইট, খাতা, কলম, পেন্সিল, জ্যামিতি বক্স, ব্যাগ, সাথে কয়েকটা নতুন থ্রি পিচ। দুই সেট স্কুল ড্রেস বানাতেও দিলেন৷
সবকিছু নিয়ে বাড়িতে চলে আসলাম৷ আমি ফুপিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম৷ ফুপি আমার কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল৷ মিষ্টি মধুর হাসি দিয়ে বলল,
“আমার শালিক অনেক বড় হবে৷ শালিক পাখির মতো তোর কথা শোনার জন্য সবাই অপেক্ষা করবে৷”
আমি কিছু বলতে যাব ঠিক তখনই শ্রুতি ভাবি আমাকে ডাক দিলেন৷ আমি দৌড়ে উনার রুমে গেলাম৷ আমার দিকে পা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“তাকিয়ে কি দেখছিস? আমার পা ব্যথা করছে। পা টিপে দে৷ শুধু লেখাপড়া করলে হবে কাজ করতে হবে না৷”
শ্রুতি ভাবির কথা কেউ মেনে নেননি৷ শ্রুতি ভাবি চায়না আমি লেখাপড়া করি৷ মুখের উপর না করলে ন্যাকা কান্না শুরু করে আমার নামে হাজারটা মিথ্যা কথা বলবে৷ সাথে থা*প্প*ড় ফ্রী। আমি বাধ্য মেয়ের মতো পায়ের কাছে বসে পা টিপে দিতে লাগলাম৷ উনার মুখে শয়তানির হাসি৷ দেখে মনে হচ্ছে বিশ্ব জয় করে ফিরেছেন৷ বিশ মিনিট হয়ে যাচ্ছে তবুও থামার কোন নামগন্ধ নেই৷ তিনি এক ধ্যানে মোবাইল টিপে যাচ্ছেন৷ আমি এবার জোরে চাপ দিতে লাগলাম৷ তিনি চিৎকার করে আমাকে লা*থি দিলেন৷ রাগী গলায় বলল,
“তুই আমাকে মেরে ফেলতে চাস! আমার পা ভেঙে ফেলবি নাকি৷”
আমি ফ্লোর থেকে উঠে বললাম,
“ভাবি আজ আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম৷ আমাকে গ্রামের মেয়ে ভেবে সব সময় লা’থি, থা*প্প*ড় দেওয়ার চেষ্টা করবেন না৷ এরপর আমার সাথে এমন ব্যবহার করলে আপনার হাত পা দু’টোই ভে*ঙে দিব৷”
আমার কথা শুনে আরও রেগে যান৷ আমার গায়ে থা*প্প*ড় মা*রা*র জন্য হাত তুলতেই আমি হাত ধরে ফেলি৷ চোখ পাকিয়ে বললাম,
“আর নয়৷ আমি কালো বলে আমাকে সহ্য করতে পারেন না৷ সাদা চামড়ার দাম বেশি আপনার কাছে৷ আপনি এতো শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও মূর্খের মতো ব্যবহার করেন৷ আমি এতো বছর মুখ ঘুরিয়ে সব দোষ মাথা পেতে নিয়েছি৷ শুনেননি ক্ষুধার্ত বিলাই সিংহের ন্যায় আচরণ করে৷ আমি কেন নিজের প্রতি অন্যায় মেনে নিব? আপনাদের বাড়িতে কাজের লোক হয়ে আসছি বলে সব মেনে নিতে হবে! আর কখনো আমি অন্যায় মেনে নিব না৷”
আমি কথাগুলো একাধারে বলে চলে আসলাম৷ শ্রুতি ভাবি কখনও আমাকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখেন না৷ আমাকে দিয়ে যত পারেন কাজ করিয়ে নেন৷ আমার কথাতে শ্রুতি ভাবি আরও রেগে যান৷ রাগ করে বলল,
“তোর এই বাড়িতে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ল৷ আমি তোকে এই বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব৷ তোকে দিয়ে সারাদিন পা টিপাতে না পারলে আমার নাম শ্রুতি নয়৷”
চোখে আগুন মনে ভয় কাজ করছে৷ আমাকে এই বাড়ি থেকে বের করে দিলে কই থাকব? এই বাড়ির সবাই ভালো৷ শুধু শ্রুতি ভাবি আর ইহান ভাইয়া আমাকে দিয়ে সারাদিন কাজ করান৷ মায়া ফুপি নিজেই সব রান্না করেন৷ আমাকে তেমন রান্না করতে হয়না৷ ইমন ভাইয়ার নজর খুব খারাপ। আমার দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন৷ আমি ইমন ভাইয়ার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকি৷
রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম৷ বাবা মায়ের সাথে কবে থেকে কথা হয়না৷ তাদেরকে কবে থেকে দেখিনা৷ আমার কথা মনে পড়ে কি তাদের? চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে গিলাম৷ প্রতিদিনের মতো সকালে উঠে সালাত আদায় করা, কুরআন তেলওয়াত করা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে৷ এখন তো মায়া ফুপিও আমার সাথে প্রতিদিন সালাত আদায় করেন৷ তিনিও প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করেন৷ সকালে সবার সাথে আমিও খেয়ে নিলাম৷ আমি খেতে চাইনি। আফসানা চৌধুরী মানে ম্যাডাম জোর করেছে তাই তাদের সাথে খেয়ে নিলাম৷ ব্যাগ গুছিয়ে স্কুলে চলে আসলাম৷ আমার শ্রেণিকক্ষ কোনটা জানি না৷ একজন মেয়ের কাছ থেকে ক্লাস রুমের কথা জানতে পারলাম৷ তিন তলায় আমাদের ক্লাস হয়৷ আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম৷ স্যার এখনও আসেনি৷ আমি যেতেই সবাই হা করে তাকিয়ে আছে৷ দ্বিতীয় বেঞ্চ ফাঁকা পেয়ে সেখানে বসি। সবাই হাসাহাসি করছে আমাকে দেখে৷ একটা মেয়ে বলে উঠল,
“দেখ দেখ নিগ্রো আমাদের সাথে ক্লাস করতে এসেছে৷”
তাদের হাসি দেখে চোখে জল এসে পড়ল৷ কেউ কালো চামড়ার মূল্য দেয় না৷ দুইজন মেয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল৷ হাসতে হাসতে বলল,
“নিগ্রো সবার পিছনে গিয়ে বস। তোর সাথে আমরা কেউ বসবো না৷ ভালোই ভালোই পিছনে চলে যা৷”
আমি রাগী চোখে তাদের দিকে তাকালম৷ পরক্ষণেই নিজের রাগ তাদের সামনে প্রকাশ করলাম না৷ তাদের কথায় আমি কেন রাগ করবো? যেখানে নিজের মা আমাকে মেয়ে বলে পরিচয় দেয়নি৷ বাবা মেয়ে বলে কোনদিন কাজে টেনে নেয়নি৷ নিজের পরিবার যেখানে আমাকে অস্বীকার করেছে তখন এদের কি দো*ষ? পরের ঘরের মেয়েদের চোখে ভালো হবো কিভাবে? মন খারাপ করে পিছনে বসলাম৷ আজ প্রথম দিন তাই তর্কে জড়ালাম না। একটা মেয়ে আমার পাশে বসল৷ দেখতে বেশ ফর্সা৷ আমি তার দিকে তাকালাম৷ কিন্তু তার মুখে অন্যদের মতো হাসি তামাশা নেই৷ সে বসতেই সামনের বসা একজন বলল,
“আশা তুই নিগ্রোর সাথে শেষে বসলি৷ তোর এসব কাজ আমাদের একদম পছন্দ নয়৷”
আশা নামের মেয়েটা মুচকি হেঁসে বলল,
“গায়ের রং দিয়ে বিচার করতে নেই৷ কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা পড়েছি।” সেখানে লেখা ছিল,
❝সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নেই৷❞
আশার কথা শুনে সবাই এক তরফা হেঁসে নিল৷ কেউ কিছু বলল না৷ এখনই স্যার চলে আসবে৷ আশা মুচকি হেঁসে বলল,
” তোমার নাম কি?”
আমি ব্যাগ থেকে কলম বের করতে করতে বললাম,
“আমার নাম শালিক৷ তুমি আমার সাথে কেন বসলে? কারোর মনে কষ্ট দিতে নেই৷”
আশা আমার হাতের উপর হাত রেখে বলল,
“আমি কাউকে কষ্ট দেয়নি৷ আমি সবাইকে সমান চোখে দেখি৷ এই সেকশনে সব মেয়েই আমার কাছে সমান৷ তুমি যে স্কুল ড্রেস পড়ে আসোনি তোমাকে ক্লাস করতে দিবে না৷”
“আমি গতকাল ভর্তি হয়েছি৷ আমি এক সপ্তাহ ড্রেস না পড়ে ক্লাস করতে পারব৷ আমাকে পারমিশন দিয়েছে৷ আমিও ড্রেস বানাতে দিছি৷ ইহান ভাইয়াকে দর্জি ওয়ালাকে বলে দিয়েছে দুইদিন পরই দিবে৷”
“সমস্যা নেই৷ তোমার বাসা কোথায়?”
আমি আশার কথায় চুপ হয়ে গেলাম৷ আমি তো কিছুই চিনি না৷ আমাকে চুপ থাকতে দেখে বলল,
“তুমি ঢাকায় নতুন!”
আমি মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলাম৷ আশা আর কিছু বলল না৷ স্যার এসে ক্লাস শুরু করে দিলেন৷ ক্লাস করে বুঝতে পারলাম আশা নামের মেয়েটা খুব ভালো। ছুটির পর আমার সাথে গেইট পর্যন্ত আসলো৷ সে অন্য রাস্তায় চলে গেল৷ আমাকে রিক্সা ভাড়ার টাকা দিয়েছেন৷ আমি আসার সময় হেঁটেই আসছি৷ কাছেই বাড়ি এতোটুকু রাস্তা বিশ টাকা রিক্সা ভাড়া৷ গ্রামে থাকতে কতো হাঁটছি। হেঁটেই বাড়িতে চলে আসলাম৷ কলিং বেল বাজাতে শ্রুতি ভাবি দরজা খুলে। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে দেন। নিজেও ইচ্ছা করে ফ্লোরে বসে পড়ে ন্যাকা কান্না করে। চিৎকার করে রাগী স্বরে বলল,
“এই মেয়ে চোখ হাতে নিয়ে ঘুরিস৷ দেখতে পারিস না৷ আমার কোমর ভেঙে দিলি৷”
শ্রুতি ভাবির চিৎকারে আফসানা চৌধুরী, মায়া ফুপি দৌড়ে আসেন। আমি নিজে থেকে উঠে দাঁড়ালাম৷ মায়া ফুপি শ্রুতি ভাবির হাত ধরে তুললেন৷ শ্রুতি ভাবি ন্যাকামি করে বলল,
“মা শালিক আমাকে একদম সহ্য করতে পারে না৷ আমি দরজা খুলে দিছি বলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিছে৷ আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে নিজে অভিনয় করছে৷”
ম্যাডাম গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“মায়া শ্রুতিকে তার রুমে দিয়ে আসো৷ শালিক ব্যাগ রেখে আমার রুমে আসো৷”
চলবে…..