#শালিক_পাখির_অভিমান
#পর্ব_২৬,২৭
#অধির_রায়
২৬
ভালোবাসায় মান অভিমান মিশ্রিত৷ প্রতি ভালোবাসায় অভিমান অন্তরের অন্তর আত্মা৷ অভিমানের মাঝে বুঝতে পারি অপরপক্ষের মানুষ কতোটা ভালোবাসে৷ আমি গহনার বক্স বিছানায় রান্না করতে চলে যায়৷ মনের মাঝে রাগ চেপে বসেছে৷ রাতে খাবার খেতেও নিচে আসেনি৷ রাগ করে আমারও খাওয়া হলো না৷ রাগে মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেছে৷ লা’থি দিয়ে কপাট খুলে রুমে প্রকাশ করলাম৷ ঘৃ’ণা’য় গা ঘি’ন ঘি’ন করছে৷ সবকিছু ভেঙে তছনছ করে দিতে ইচ্ছা করছে৷ চোখ আটকে যায় টি টেবিলের উপর রাখা নীল খামে৷ খাম খুলতেই ভিতর থেকে বেরিয়ে আসলো আমাদের একটা ফুটো। আমার ঘুমের সুযোগ নিয়ে মাথায় ভালোবাসার পরশ একে দেওয়ার৷ সাথে নীল চিরকুট।
“শ্যামলতা আলমারিতে তোমার জন্য জামদানী শাড়ি রাখা আছে৷ জলদি জামদানী শাড়ি পড়ে ছাঁদে চলে আসো৷ তোমার অপেক্ষায় প্রহর গুনছি। কখন আমার শ্যামলতাকে দেখতে পারো।”
মুহুর্তের মাঝেই আমার সকল রাগ চলে গেল৷ শাড়ি যখন আমার জন্যই ছিল তখন নাটক করার কি দরকার ছিল? উনার দেওয়া শাড়ি, মায়ের দেওয়া সোনার গহনা, চুলে বেলিফুলের মালা ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক, কপালে টিপ। আরশি থেকে নেত্র ফেরাতে পারছি না৷ নিজেই নিজের প্রেমে পড়ে যাচ্ছি৷ বারবার মনে হচ্ছে শালিক পাখির সাজ মাশাল্লাহ। আলতা পায়ে নুপুরে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। দোয়া দরুদপাঠ করতে করতে ছাঁদে আসলাম৷ সমস্ত ছাঁদ আঁধারে ঘেরা৷ ভয়ে ভয়ে বললাম,
“ইহান ইহান৷”
উনার কোন উত্তর পেলাম না৷ এবার সত্যি সত্যি ভয় হচ্ছে৷ নির্জন ছাঁদে ভুতের সমাহার। ভয়ে ভয়ে চলে আসতে নিলেই গিটারের টুংটাং শব্দে দাঁড়িয়ে পড়ি৷ আলোর মেলায় খেলা করে মরিচ বাতি৷ মধুর কন্ঠ বলল,
“আমাদের বিয়ের এক বছর পূর্ণ হলো শাকিল৷ হ্যাপি এনিভার্সারী শালিক।”
আমাদের বিয়ের এক বছর পূর্ণ হলো আমার স্মরণে ছিল না৷ কবে কখন কত তারিখে বিয়ে হয়েছে সবই অজানা৷ মিটারের টুংটাং শব্দ তুলে আমার কাছে আসেন। আলতো করে কপোলে ভালোবাসার পরশ একে বলল,
“তোমাকে একদম রাজকুমারী লাগছে৷ আমাকে লাগছে দেশদ্রোহী। রাজকুমারীর মনে দেশদ্রোহীর প্রেমের অনুভূতি জাগবে৷”
আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম৷ উনি গিটাং দোলনায় রেখে বলল,
“আমার লজ্জাবতী শালিক৷ কবে থেকে এতো লজ্জা পাচ্ছে৷ আজ তোমার মতো করে চলব৷ তোমার কোলে মাথা রেখে আকাশ দেখব।”
ইহান আমার কোলে মাথা রেখে বলল,
“তুমি নিশ্চয়ই ভাবছো এনিভার্সারী এতো সাদাসিধে কেন? কেক থাকবে চারিপাশে ক্যান্ডেল থাকবে৷ কেক কেটে উইশ করতে হবে৷ আমার কাছে সবকিছু তুচ্ছ৷ আমার কাছে সবকিছুর থেকে তুমি বড়৷ তুমি তোমার বান্ধবীদের সাথে কাল ইনজয় করবে৷ আজ রাতে আমার সাথে কথা বলবে৷ আমার কাছে বড় হলো তোমাকে সময় দেওয়া৷ সেজন্য বিকাল থেকে তোমাকে সময় দিচ্ছি৷”
অভিমানী স্বরে বললাম,
“আপনি খুব পঁচা। আপনার সাথে কোন কথা নেই৷ আপনি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছেন৷”
ইহান কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,
“তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এতো কিছু৷ আমি জানতাম মা আমাদের সম্পর্ক মেনে নিবে৷ আমাদের সবথেকে বড় গিফট আমরা পেয়ে গেছি৷”
“আজ আমার কাছে সত্যিই স্মরণীয় একটা দিন৷ এদিনকে কেন্দ্র করে কতো কিছু ঘটেছে৷ কখন ভুলা যাবে না৷”
“চল নির্জন নিরিবিলি রাস্তায় হেঁটে আসি৷ চারদিকে প্রচন্ড গরম৷ হেঁটে আসলে একটু ঠান্ডা লাগবে৷”
“আপনি পা’গ*ল হয়েছেন৷ রাতের শেষ প্রহরে রাস্তায় হাঁটতে বের হবে কেউ। আমি পারব না আপনার সাথে রাস্তায় যেতে৷”
“ভয় পাচ্ছো৷ নিরিবিলি রাস্তায় তুমি আর আমি পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটব। একবার চল অনেক ভালো লাগবে৷”
ল্যামপোস্টের আলোয় নির্জন জায়গায় হেঁটে যাচ্ছি এক জোড়া প্রাণ৷ একটি প্রাণ ছাড়া অন্য প্রাণ অচল৷ কারোর মুখে কোন কথা নেই৷ মনে মনে অনেক কথা হচ্ছে৷ হুট করেই রাস্তার মাঝে ইহান হাঁটু গেড়ে বসল৷ সোনার রিং আমার দিকে এগিয়ে দেন৷ মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে রেখে বলল,
“তুমি কি হবে আমার শেষ বয়সের সঙ্গী? শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি তোমাকে পাশে চাই৷ দেহে এক ফোঁটা রক্তবিন্দু থাকা অবস্থায় তোমাকে কখনও মাথা নিচু করতে দিব না৷”
উনার দিকে আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম৷ উনি আমার হাতে সোনার রিং পড়িয়ে রিং এর উপর আলতো করে চুমু দিলেন৷ ভালোবাসার মুহুর্তগুলো আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে উঠল৷ আমি সত্যিই খুব ভাগ্যবতী৷ ভাগ্য করে ইহানের মতো একটা জীবন সঙ্গী পেয়েছি৷
নীরা চায়ের কাপে চুমু দিয়ে বলল,
“আমাদের ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা চলে আসল৷ চিন্তায় আমার হাত পা কাঁপতেছে৷ আমি নিশ্চয়ই ফেল করব৷ আমি ঠিকমতো পড়তে পারি না৷”
অর্পি বরাবর পড়া চো*র৷ পড়ার কথা শুনলে তার মাথা গরম হয়ে যায়৷ অর্পি বিরক্তি সূচক দৃষ্টিতে নীরার দিকে তাকায়৷ মেঘের মতো গর্জন করে বলল,
“নীরার বাচ্চা নিরা। আর একবার কথা বললে লা*থি দিয়ে বাহিরের দেশে পাঠিয়ে দিব৷ পড়তে পড়তে কানা হয়ে গেছিস এখনও বলছিস তোর পড়তে বসিস না৷”
নীরা চোখের চমশা ঠিক করতে করতে বলল,
“দেখ অর্পি তুই আমার পড়া নিয়ে কোন কথা বলবি না৷ আমার মম পড়ার বিষয়ে খুবই সেনসেটিভ।”
ছোঁয়া সিঙ্গারায় ব্রাইট বসিয়ে বলল,
“আমার মা ধোঁয়া তু’ল’সী’পা’তা। আমাকে কতো কথা শুনান। উনার কথা এক কান দিয়ে শুনি অন্য কান দিয়ে বের করে দেই।”
অর্পি ছোঁয়ার পীঠে হালকা করে থা’প্প’ড় বসিয়ে বলল,
“এ হলো আমার বেষ্টু৷ পড়া নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই৷ আমরা কি নীরার মতো ছাত্রী৷ আমরা অবশ্যই পাস করব৷”
বলেই দু’জনে হেঁসে উঠল৷ আমি টেবিলের উপর চাওমিনের বাটি রেখে বললাম,
“অনেক হয়েছে লেখাপড়া। এখন মন উজাড় করে চউমিন খাহ। তোদের জন্য আমি নিজ হাতে বানিয়েছি৷”
খাওয়ার কথা বলতে দেরি হয়েছে ছোঁয়া, অর্পির থা*পা দিতে দেরি হয়নি৷ তারা দু’জন ভু’ক্ত’ভো’গী পা*গ*লে*র মতো খাওয়া শুরু করল৷ আমি বসে না থেকে আমিও ভাগ বসাতে শুরু করলাম৷ নীরা মুখ ছিঁ*ট*কে বলল,
“তোদের এসব কান্ড দেখে আমার বমি পাচ্ছে। হ্যান্ডওয়াস দিয়ে হাত না ধোঁয়েই খাওয়ার জন্য তর্জুর চলাচ্ছিস৷”
অর্পি নীরার দিকে বাটি বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“এসব খাওয়ার জন্য তোর বয়স হয়নি৷ তুই এখন মাম্মানস মেয়ে৷ তুই চাওমিন খেলে এখনই তোর হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে৷”
নীরা চোখের চশমা ঠিক করে বলল,
“মোটেও আমার হার্ট অ্যাটাক হবে না৷ আমি রেগুলার ইয়োগা করি৷”
আমি চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললাম,
“শৃঙ্খলা না দেখিয়ে কা*ড়া*কা*ড়ি করে খাহ। না খেতে চাইলে মিস করবি৷”
নীরা আর বসে থাকতে পারল না৷ সেও খাওয়ার জন্য কা*ড়া*কা*ড়ি চালাল। নীরা এসব কিছু থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত দূরে থাকতে পারে না৷ এসবের জন্য বাসায় গিয়ে তার মায়ের হাতে এ’লো’পা’তা’ড়ি ভাবে পি’ট’ন খাবে৷ কা’ড়া’কা’ড়ি মাঝে চাউমিন খেতে না পারলেও মাটি সম্পুর্ন চাউমিন খেয়েছে৷ এসব দেখে আমার রাগ সপ্তম আকাশে উঠে। কেউ আমার রাগের দামই দিল না৷ ছোঁয়া ভেংচি কেটে বলল,
“হুট করেই কোন কারণ ছাড়া আমাদের সারপ্রাইজ দেওয়ার কারণ কি? তুই চাওমিন নিয়ে আসছিস আমাকে বলিসনি কেন?”
অর্পি ব্রু নাচিয়ে বলল,
“বললে সারপ্রাইজ থাকতো না৷ এখন বল কোন উপলক্ষে নিয়ে আসছিস৷”
আমতা আমতা করে জবাব দিলাম,
“বন্ধুদের খাওয়াতে কোন উপলক্ষ লাগে নাকি৷ মন চাইল তাই তোদের জন্য নিজ হাতে বানিয়ে আনলাম৷”
ছোঁয়া গম্ভীর কন্ঠে উৎসাহ নিয়ে বলল,
“আমরা জানতাম তুই আমাদের থেকে কিছু লুকাবি না৷ কিন্তু আমাদের ধারনা ভুল করে দিলি৷”
আমি মিন মিন করে বললাম,
“আমাদের আমাদের বিয়ের এক বছর পূর্ণ হলো৷”
সবাই এক সাথে উচ্চ স্বরে বলে উঠল,
“কি!”
চলবে….
#শালিক_পাখির_অভিমান
#পর্ব_২৭
#অধির_রায়
সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না৷ পরীক্ষার রুটিন পড়তেই ধম ফেলার সময় পাইনি৷ সবসময় পড়ার ফাঁকি দিলেও পরীক্ষার আগে সবাই আদর্শ ছাত্র হয়ে উঠে৷ আমিও ভিন্ন কিছু নয়৷ আজ ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা শেষ হলো৷ পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিলাম৷ চিন্তা মুক্ত সবাই৷ হইচই করে দৌড়ে দিলাম ক্যাফিডিয়ামে৷ পরীক্ষার মাঝে ক্যাফিডিয়ামে বসা হয়নি৷ নীরা চশমা ঠিক করতে করতে বলল,
“ভালোই ভালোই আমাদের পরীক্ষা শেষ হলো৷ আজ গভীর একটা ঘুম দিব৷ পরীক্ষার চিন্তায় ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি৷”
অর্পি চেয়ার টেনে সবার মাঝে বসল৷ গোমড়া মুখ করে বসে আছে৷ চোখে মুখে আফসোসের ছাপ। আমি হালকা কেঁশে বললাম,
“অর্পি তুই শান্তশিষ্ট হলি কবে? তোর চোখে মুখে চিন্তার ছাপ৷”
অর্পি অসহায় কন্ঠে বলল,
“আমারও তো ইচ্ছা করে প্রেম করতে৷ আমি কতো বড় হয়ে গেলাম। আজ পর্যন্ত কোন প্রপোজ পেলাম না৷ ছেলেদের চোখে আমি পড়িনা৷”
অর্পির কথা শুনে কেমন রিয়েক্ট দিব ভেবে পাচ্ছি না৷ তিন জোড়া নেত্র অর্পির দিকে৷ হু করে উচ্চ স্বরে হেঁসে উঠলাম৷ অর্পি হুংকার দিয়ে বলল,
“আজ আমি সিঙ্গেল তোদের মতো ফ্রেন্ড পেয়ে৷ কু*ত্তা আমাকে একটা প্রেম করিয়ে দিতে পারতিস৷ যত নষ্টের মূল সব তোরাই৷”
“ছোঁয়া অর্পির পীঠে থা*প্প*ড় বসিয়ে বলল,
” আমার ড্রাইভার আঙ্কের সাথে প্রেম কর৷ জানিস ড্রাইভার আঙ্কেলকে দ্বিতীয় বিয়ে করাবেন৷ বেচারার প্রথম স্ত্রী অকালেই ইহকাল ত্যাগ করেছেন৷ তুই বললে আমি তোর বিষয়ে কথা বলব৷”
অর্পি অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ছোঁয়ার উপর৷ ছোঁয়া ত্যাজ দেখিয়ে বলল,
“দেখ অর্পি আমার দিকে চোখ তুলে তাকালে তোর চোখ তুলে লুডু খেলব৷ আমার প্রপোজ রাজি না হলে রিজেক্ট করে দে৷ তাও অগ্নি দৃষ্টি মেলে আমার দিকে তাকাবি না৷”
অর্পি গর্জন দিয়ে বলল,
“আমি বু’ই’ড়্যা ব্যা*টাকে বিয়ে করব৷ আজ তোর একদিন কি? আমার একদিন৷”
শুরু হয়ে গেল অর্পি ছোঁয়ার ঝগড়া৷ নিজেরাই ঝগড়া থামিয়ে বলল,
“শালিক আজ তোদের বাসায় আমাদের দাওয়াত৷”
আমি চোখ সরু করে বললাম,
“চেঁ’চি’য়ে দাওয়াত নিচ্ছিস৷ আমি কাউকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাব না৷ তোদের নজর ভালো নয়৷ আমার ইহানের উপর তোদের নজর পড়বে৷ আমার স্বামীর উপর তোদের মতো প্রেত্নীর নজর পড়তে দিব না৷”
নীরা ন্যাকামির স্বরে বলল,
“তোর বরের উপর ক্রাশ খাওয়ার মতো মেয়ে নিরা নয়৷ আমার ড্রেসিং, গ্লো দেখে তোর বর দুই জ্ঞান হারিয়ে হসপিটালে ভর্তি থাকবে৷”
নীরার কথায় ছোঁয়া অর্পি হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে৷ অর্পি হাসি থামিয়ে বলল,
“আমি আমার ভালোবাসার মানুষ খুঁজে পেয়েছি৷ কিউট হ্যান্ডসাম একেই আমার চাই।”
“অর্পির দৃষ্টি অনুসরণ করে ছোঁয়া বলল,
“অর্পি থাম৷ উনি মনে হয় আমাদের কলেজের লেকচারার। পরীক্ষার মাঝে প্রীতম স্যার বলল না নতুন স্যার আসবে৷ আমি নিশ্চিত উনি আমাদের নতুন স্যার৷”
অর্পি দুই গালে হাত রেখে বলল,
“তোরা কলেজে জানিয়ে দে নতুন স্যার অর্পির হবু হাসবেন্ড। লু’টি’য়ে দিতে পারিস ছাত্রী স্যারের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে৷”
তাদের দৃষ্টি অনুসরণ করেই আমি দাঁড়িয়ে পড়ি৷ লোকটি আমাকে দেখতে পেয়ে ক্যাফেডিয়ামের দিকে আসছেন৷ এই মানুষটা এখানে কি করছে? অর্পি আমার হাত টেনে বসাল। মায়াভরা কন্ঠে বলল,
“আমার ক্রাশ আমার মায়াজালে ফেঁসে গেছে৷ আমাকে প্রপোজ করতে আসছেন৷ এই নীরা তোর চশমাটা আমাকে দুই মিনিটের জন্য ধার দে৷ চমশা পড়লে আমাকে মেধাবী ছাত্রী মনে করবে৷”
“নীরা অর্পির কথার পাত্তা না দিয়ে বলল,
” তুই যেভাবে আছিস সেখানেই ভালো আছিস৷ ছোঁয়া খেয়াল করছিস অর্পির সাথে সাথে শালিক কিভাবে তাকিয়ে আছে? শালিককে দেখে মনে হচ্ছে অর্পি তার হাসবেন্ডের দিকে তাকিয়ে আছে৷”
নীরার কথা মাঝেই লোকটি আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান। সবার মাঝে আমার হাত ধরে বলল,
“বিদায় আদিঘর ওয়ালী। তোমাদের সাথে শালিক অন্য সময় কথা বলবে৷ তোমাদের বন্ধু পরীক্ষার মাঝে তার অ’ধ’ম হাসবেন্ডকে সময় দেয়নি৷ আজ আমাকে সময় দিবে৷”
অর্পি হা করে বলল,
“ভাই আমি দ্বিতীয় ছ্যাঁকা খাইলাম৷ আমি বিয়াত্তা মানুষের উপর ক্রাশ খাইছি। হে সৃষ্টিকর্তা আমাকে তুলে নাও৷ আপনি শালিকের মানে আমার জা…..ন।”
অর্পির কথায় উপস্থিত সবাই হেঁসে উঠল৷ ইহান অর্পিকে হালকা করে চোখ টিপল দেন৷ অর্পি দুই হাত তুলে পড়ে যাওয়ার চেষ্টা করে৷ ফল স্বরুপ প্লাস্টিকের চেয়ার ভেঙে যায়৷ পড়ে যাওয়ার আগেই ছোঁয়া ধরে ফেলে৷
আপন গতিতে গাড়ি চলছে৷ বাড়ির গাড়িতে করে আমরা আনন্দপুরে যাচ্ছি৷ ইহানের সাথে কোন কথা নেই৷ অবশ্য ইহান আমার সাথে কথা বলার অনেক চেষ্টা করেছেন৷ আমার হাতের উপর হাত রাখতেই হাত সরিয়ে নিলাম৷ মেঘের গর্জনের মতো গর্জন করে বললাম,
“আমার হাত ধরার চেষ্টা করবেন না৷ ড্রাইভ করার প্রতি মনোযোগ দেন।”
উনি হতাশ কন্ঠে বলল,
“তোমার চোখে মুখে অন্ধকার কেন? তোমার কি মন খারাপ? আমার সাথে কথা বলছো না কেন?”
চোখ পাকিয়ে বললাম,
“আপনি অর্পিকে চোখ টিপল দিলেন কেন? লজ্জা করে না আপনার এসব কাজ করতে৷ ইমন ভাইয়া জেল থেকে ভালো হয়ে ফিরে এসেছেন৷ আমার সাথে এমন কিছু করলে আমি আপনাকে খু’ন করে ফেলব৷”
উনি আমার কথার কোন উত্তর দিলেন না৷ ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা বজায় রেখে ড্রাইভিং এ মন দিলেন৷ আমার রাগ আরও বেড়ে গেল৷ বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনে যতটা খুশি হয়েছিলাম৷ তার থেকে বেশি মন খারাপ হলো৷ শিষ বাজিয়ে বলল,
“কিছু পু’ড়া’র গন্ধ পাচ্ছি৷ তুমি কি গন্ধ পাচ্ছো?”
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বুঝার চেষ্টা করলাম৷ কিন্তু কোন গন্ধ খুঁজে পেলাম না৷ আহত চোখে ইহানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম৷ বাঁকা হেঁসে বলল,
“হিংসায় জ্বলে যাচ্ছে কেউ৷ হিংসায় পু’ড়ে যাচ্ছে আমার পাশের মানুষটি৷”
“হ্যাঁ আমি হিং’সু*টে। আমার মন বড় নয়৷ আমার স্বামী অন্য কাউকে চোখ টিপল দিলে আমার খারাপ লাগে৷”
“আমাকে আলতো করে উনার বুকের দিকে নিয়ে যান৷ কিন্তু আমি উনার হাত ছাড়িয়ে বাহিরের দিকে তাকালাম আছি৷ অপরাধী কন্ঠে বলল,
” শালিক তুমি চাইলে কানও ধরতে পারি! আর কখনও কাউকে চোখ টিপল দিব না৷ এখন স্ট্যায়ারিং এ হাত না রাখলে দুই জনেই উপরে চলে যাব৷”
আমি হন্তদন্ত হয়ে বললাম,
“এই না..না। এমন কোন কাজ করবেন না৷ আমার মনে কোন আশংকা নেই৷ আপনি ড্রাইভিং এ মন দেন৷ আমার কাছে আপনি সবার আগে৷ আপনার সাথে অনেক পথ চলা বাকী৷”
ভার মুখে বলল,
“তোমার বাবা অসুস্থ প্রায় এক সপ্তাহ থেকে৷ আমাকে আরাফ ভাইয়া গতকাল রাতে ফোন করে বলছেন৷ আজ তোমার পরীক্ষা ছিল সেজন্য জানাতে পারিনি৷ আমাকে ক্ষমা করে দিও৷”
বাবার অসুস্থ কথার কানের আসতেই বুকের মাঝে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করলাম৷ আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসল৷ বাবা অসুস্থ এক সপ্তাহ থেকে৷ আমাকে জানানো হলো আজ৷ চোখের কোণে পানি টলমল করতে লাগল৷ না চাওয়া সত্ত্বেও টুপ করে চোখ থেকে দুই ফোঁটা নোনা জল গড়িয়ে পড়ল। আমি অবাক চোখে বললাম,
“আপনি আমাকে এখন জানাচ্ছেন৷ আমি শাকিলার সাথে সকালেও কথা বলছি৷ শাকিলা আমাকে একবার বলার প্রয়োজনবোধ টুকু মনে করল না৷”
“তোমার যা ইচ্ছা আমাকে বলতে পারো৷ আমি রাতে আরাফ ভাইয়াকে মানা করেছিলাম৷ আমি বলেছি আজ তোমার পরীক্ষা শেষ হলেই আমি তোমাকে বলব৷ আমি আগে জানতে পারলে তোমাকে আগে থেকেই জানাতাম৷”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম৷ ইহানের কথার ধরন দেখে বুঝতে পারলাম উনি সত্য কথা বলছেন৷ সারা রাস্তায় কোন কথা বললাম না৷ বাড়িতে পা রাখতেই আমি দুনিয়ার কথা ভুলে গেলাম৷ বাবা শুকিয়ে কাট হয়ে গেছেন৷ কথা বলতে পারেন না৷ চোখের তৃষ্ণা আমাকে খুঁজছিল। আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দিলাম৷ কান্না করতে করতে মাকে চিৎকার প্রশ্ন করলাম,
“বাবার অবস্থা এমন হলো কিভাবে? আমাকে একবারও জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না৷”
মা শাড়ির আঁচলে চোখের পানি মুছে বলল,
“শালিক মা আমার৷ তোর বাবা তোকে দেখার জন্য ছটফট করতো৷ তুই চলে যাওয়ার পর শুধু তোর কথা বলতো৷ তোর সাথে কথা বললেও তোকে দেখতে চাই এ কথা মুখ ফুটিয়ে বলতে পারেনি৷ নিজেকে অপরাধী ভেবে আসছে সব সময়৷”
“বাবা! বাবা! আমার সাথে কথা বল৷ আমাকে একবার জড়িয়ে ধরো৷”
বাবার মুখে কোন কথা নেই৷ শাকিলার কাছ থেকে জামতে পারলাম হসপিটাল থেকে ফিরিয়ে দিছেন আজ সকালে৷ বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই৷ বাবার হাত শুকিয়ে চলা মেরে গেছে৷ বাবাকে এমন অবস্থায় দেখতে হবে কোনদিন কল্পনাও করতে পারিনি৷ বাবার কথা বলতে পারেন না প্রায় তিন দিন থেকে৷ আমার দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলে যাচ্ছেন৷ খাওয়া বন্ধ করে দিছেন৷ আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে ইহানকে বললাম,
“কাল সকালেই আমরা ঢাকা ফিরব। আমাদের সাথে বাবা ঢাকায় ফিরবে৷ আমি বাবাকে ভালো ডক্টর দেখাব৷ বাবা আগের মতো সুস্থ হয়ে যাবেন৷”
উনি আমার কথার সম্মতি দিলেন৷ পাড়া প্রতিবেশীদের মুখে অনেক রকমের কথা৷ অনেকে বলতেছে পা*প বাপকেও ছাড়ে না৷ এতো পাপ করেছে তার শাস্তি পাবেই তো৷ আল্লাহ মানুষকে দুনিয়াতেই শাস্তি দেন৷ অথচ এসব প্রতিবেশী বাবাকে এক সময় আমার নামে মন্দ কথা বলত৷ অপয়ার বাবা বলে দূরে ঠেলে দিত৷ সব জায়গায় মাথা নিচু হয়ে যেত৷ তাদের কথা কানে আসছে৷ প্রতিবাদ করার শক্তি নেই৷ বাবাকে জড়িয়ে ধরে মাত্র চোখ লেগে আসছে তখনই ছটফট করতে থাকেন৷ হাত পা অস্বাভাবিকভাবে নাড়ান৷ আমি বাবাকে শক্ত করে কান্না করতে করতে জড়িয়ে ধরে বললাম,
“হ্যা আল্লাহ। হযরত আজরাইল (আঃ) কে আমার বাবার জান নিতে না করেন৷ আমার বাবার বাবার খুব কষ্ট হচ্ছে৷ আল্লাহ আমার বাবার জীবন ভিক্ষা দেন৷ আমার জীবন নিতে বলেন৷ আমার জীবনের বিনিময়ে আমার বাবাকে বাঁচিয়ে দেন৷”
এক সময় বাবা নিস্তেজ হয়ে গেলেন৷ বুঝতে দেরি হলো না আজরাইল (আঃ) উনার কাজ সমাপ্তি করেছেন৷ আমি বাবা বলে এতো উচ্চ শব্দে চিৎকার করি মাঝ রাতেই সারা বাড়ি মানুষের ভীড় জমে৷ আল্লাহ আমার বাবার জীবন ভিক্ষা দেননি৷ আমাকে এতিম করে আমার বাবাকে নিয়ে গেলেন৷ আর কোনদিন বাবার মুখ দেখার ভাগ্য হবে না৷
বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে যাচ্ছি আমরা দুই বোন৷ মা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন৷ আমাদের কেউ ছাড়াতে পারছেন না৷ বাবাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বুক ফেটে কান্না আসছে৷
চলবে….