শালিক_পাখির_অভিমান #পর্ব_২৮,২৯

0
486

#শালিক_পাখির_অভিমান
#পর্ব_২৮,২৯
#অধির_রায়
২৮

বাবা হারানোর কষ্ট একমাত্র সেই ব্যক্তি জানেন যে বাবা হারিয়েছেন৷ আমার চারদিক অন্ধকার। একটু আলোর সন্ধান পাওয়ার জন্য ম’রি’য়া হয়ে উঠেছি৷ বুকের মাঝে বাবার জন্য তীব্র ব্যথা অনুভব করছি৷ আজ দুই মাস হয়ে গেলে তবুও বাবার স্মৃতি ভুলতে পারিনি৷ কবে কলেজের মাটিতে পা রেখেছি জানা নেই। কলেজে যাওয়া বন্ধ। ছোঁয়া, নীরা, অর্পি সেদিন বাড়িতে এসেছিল। অনেক বুঝিয়েও আমার মনটা হালকা করতে পারেনি৷ আঁখি বন্ধ করলেই বাবার হাসি মাখা মুখ খানা ভেসে উঠে৷ দু’হাত মেলে বুকে ডাকে৷ চোখের জল ফুরিয়ে এসেছে৷ বাকহারা মানুষের মতো বাবার সাথে একটি কথা বলার জন্য ছটফট করি৷ পথ চেয়ে বসে থাকি বাবা আসবে। আমার সাথে অভিমান করে চলে গেলেন৷ আমার সাথে কথা বলার প্রয়োজনবোধ মনে করল না৷ শরীফ চৌধুরী কাঁধে হাত রেখে বলল,

“তোমার বাবার জায়গা কখনও পূরণ করতে পারব না৷ আল্লাহ উনাকে জান্নাত দান করবেন। তোমার বাবার আত্মার মাগফিরাতের জন্য তোমাকে শক্ত হতে হবে৷ এতিমখানায় বাচ্চাদের পোষাক দিতে চেয়েছিলে তুমি৷ সব কিছু ঠিকঠাক আছে কি’না দেখে নাও৷”

শরীফ চৌধুরীর কথা কান অব্ধি স্পষ্টভাবে পৌঁছাল না৷ মমটা পড়ে আছে আনন্দপুরে৷ ইহান আমার হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দেন৷ আপন গতিতে গাড়ি চলছে এতিমখানার উদ্দেশ্যে৷ এতিমখানার উন্নয়নের জন্য কিছু টাকা, একশো কুরআন শরীফ, বাচ্চাদের জন্য পাঞ্জাবি পায়জামার কাপড়, সাথে পাঞ্জাবি বানানোর টাকা দিয়ে বাড়িতে ফিরলাম৷ ক্লান্ত দেহে বাড়িতে ফিরতেই ঘুমিয়ে পড়ি৷

শীত বসন্ত চোখের পলকে যেতে থাকল৷ বসন্তের সৌন্দর্য আমার মনকে ভরিয়ে দিতে পারেনি৷ পারেনি কবিদের কন্ঠে কবিতার সুর তুলতে। সকালের সোনালী রোদে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি৷ নিজের মনকে কিছুটা শান্ত করতে পেরেছি৷ পৃথিবীতে যার জন্ম আছে তার মৃত্যু অবধারিত। ছোঁয়া, নীরা, অর্পি গম্ভীর হয়ে বসে আছে ক্লাস রুমে। আমাকে দেখে ম্লান হাসার চেষ্টা করল। ক্লাস শেষে চিরপরিচিত ক্যাফেডিয়ামে গেলাম৷ ছোঁয়া উষ্ণ ধোঁয়া উঠানো চায়ের কাপে চুমু দিয়ে বলল,

“আজ ক্যাফেডিয়ামের প্রাণ ফিরে পাওয়া গেল৷ একদিন চিরপরিচিত ক্যাফেডিয়াম শুধু স্মৃতি হিসেবে মনে গেঁথে রয়ে যাবে৷ আড্ডা দেওয়া হবে না৷”

অর্পি আফসোস নিয় বলল,

“আমাদের পরীক্ষার পর ভার্সিটির কোচিং শুরু করব৷ চারজনের চার ভার্সিটিতে চান্স হলে আর দেখা হবে না৷ আমি তোদের খুব মিস করব৷ তোদের ছাড়া ক্লাস করব কিভাবে? ”

নীরার এসব দিকে তেমন টান নেই৷ নীরা উষ্ণ ধোঁয়া উঠানোর চা খেয়ে ব্যস্ত৷ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম,

“জীবন কখনও থেমে থাকে না৷ আমাদের জীবন অনেক বাঁধা আসে৷ সে বাঁধা পার হতে হলে আপনজনকে হারাতে হয়৷”

অর্পি চায়ের কাপে চুমু দিয়ে বলল,

“এসব আমার ভালো লাগে না৷ তোদের ছাড়া আমি এক পা চলতে পারব না৷ আমি তোদের খুব ভালোবেসে ফেলেছি৷ আমি কিছুতেই এ বন্ধন ভাঙতে পারব না৷”

নীরা চোখের চশমা ঠিক করতে করতে বলল,

“আমাদের দেখা না হলেও ফোনে কথা হবে৷ মম বলেন জীবনে সব সময় এগিয়ে যেতে৷ পিছনে কি আছে সেদিকে না তাকাতে।”

অর্পি নীরাকে কিছু বলার আগেই ছোঁয়া বলল,

“আজ তুই ভালো কথা বলছিস৷ আমাদের পিছনে ফিরে তাকানো উচিত নয়৷ সামনে মোভ করতে হবে৷ আমি তোর কথাকে সাপোর্ট করলাম৷”

অর্পি নিজেকে আটকিয়ে রাখতে পারল না৷ রাগী কন্ঠে বলল,

“তোদের দাদীমা টাইপের কথা শুনলে আমার মাথা গরম হয়ে হয়ে যায়৷ এসব কথা বলা থেকে বিরতি নে৷ আমি আর একবার এসব কথা শুননে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না৷”

আমি অর্পির দিকে চোখ তুলে তাকালাম৷ শ্যামবর্ণ মায়াবী চেয়াহায় চিন্তার ভাজ পড়েছে৷ কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা। মেয়েটা বন্ধুত্ব বলতে পা*গ*ল৷ বন্ধুর জন্য হাজারটা খু’ন করতেও পিছপা হবে না৷ আমি অর্পির হাতে হাত রেখে বললাম,

“সব সময় এমন করলে হয়না৷ নিজের মাথা খাটিয়ে একবার ভেবে দেখ৷ আমাদের জীবন তো কলেজ জীবনেই থেমে থাকবে না৷ আমরা সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছাতে হবে৷ রাগ করিস না। বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা কর৷”

অর্পি আর কারো কথা শুনল না৷ পাশে থাকা বেঞ্চে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে লা’থি দেয়৷ মেঘের মতো গর্জন করতে করতে বাড়িতে চলে গেল৷ পিছন থেকে অনেক ডাকাডাকি করলাম। কথাগুলো কান অব্ধি পৌঁছালেও কোন রেসপন্স করল না৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়িতে চলে আসলাম।

“শ্রুতি ভাবী মিষ্টি মধুর স্বরে বলল,

” চলো শালিক শপিং করতে যাব৷ আমার একা একা শপিংমলে যেতে ভালো লাগছে না।”

আমি চারিদিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলাম৷ মায়া ফুপি, আফসানা চৌধুরী সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত৷ ইমন ভাইয়া শার্টের হাতা হোল্ড করতে করতে নিচে আসলেন। আমি ইমন ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,

“ভাবী আপনি ইমন ভাইয়ার সাথে শপিংমলে যান৷ আমি মাত্রই কলেজ থেকে ফিরলাম৷ আমি খুব ক্লান্ত। আপনার সাথে যেতে পারব না৷”

ইমন ভাইয়া চোখে কালো চমশা পড়তে পড়তে বলল,

“শালিক তুমি শ্রুতির সাথে শপিংমলে যাও৷ আমার অনেক কাজ আছে৷ আমি শ্রুতির সাথে যেতে পারব না৷ আমার ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে৷”

ইমন ভাইয়া ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে উনার মাঝে কোন পরিবর্তন নেই৷ আজও অন্য মেয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে৷ আমার দৃষ্টি ক্ষুণ্ণ হয়ে আসল৷ আমার চাহনি বুঝতে পেরেন ইমন ভাইয়া ।হালকা হাসার চেষ্টা করে বলল,

“শালিক আজ আমি অন্য কোথাও যাচ্ছি না৷ অফিসের কাজে যাচ্ছি৷ বিশ্বাস না হলে বাবাকে ফোন করে জেনে নিও৷”

ইমন ভাইয়ার কথা তবুও বিশ্বাস করতে পারলাম না৷ এক আকাশ হতাশা নিয়ে শ্রুতি ভাবীর সাথে শপিংমলে গেলাম৷ শ্রুতি ভাবীর মাঝে তেমন কোন চাহিদা নেই৷ যা কিনছেন সব আমার জন্য৷ মিহি কন্ঠে শ্রুতি ভাবীকে প্রশ্ন করলাম,

“ভাবী এসবের মানে কি? আপনি আমার জন্য এতো কিছু কিনছেন কেন?”

শ্রুতি ভাবী ক্ষিপ্ত দৃষ্টি মেলে তাকান৷ গর্জন কন্ঠে বলল,

“আমি অতিরিক্ত কথা শুনতে পছন্দ করিনা৷ এসব কিছু তোমার জন্য কিনছি৷ আমি নিজের ইচ্ছায় সব কিনছি৷ বাঁধা দেওয়ার তুমি কেউ না?”

আমি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম৷ এখনো সেই অ*’হং’*কা*র বাজায় রেখেছেন। ভাবীর ভ’*য়া’*ন*’ক দৃষ্টির সাথে আমি বরাবর পরিচিত৷ কেউ মন থেকে কিছু দিতে চাইলে মানা করতে নেই৷ আমাকে কিনে দিচ্ছে এতো আমার খুশী হওয়ার কথা৷ কি ন্তু আমি খুশি হতে পারছি না৷ আমার জন্য দামী দামী শাড়ি। শাড়ির থাকে ম্যাচিং করে ইমিটেশনের গহনা৷ সবকিছু আমার খুব পছন্দ হয়েছে৷

নিভু নিভু আঁধারে বিছানার এক পাশে শুয়ে আছি৷ ইহান আমাকে পিছন থেকে হালকা করে জড়িয়ে ধরে বলল,

“শালিক তুমি কান্না করছো কেন? কি হয়েছে তোমার? আমি তোমার চোখের জল আর সহ্য করতে পারব না৷”

কান্না করার জন্য একটা শূন্য বুক খুঁজছিলাম৷ ইহানের স্পর্শ পেয়ে ইহানকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম৷ ইহান আমাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলেন৷ আমি উনার বুকে মাথা গুঁজে কান্না করে দিলাম৷ পরম আদরে কেশে বিলি দিতে থাকেন৷ মিহি কোমল কন্ঠে বলল,

“শাকিল তুমি প্রতিরাতে কান্না করো কেন? এর ফলে তোমার বাবা কষ্ট পাচ্ছেন৷ তোমার এক ফোঁটা জল উনার কবরের আজাব বাড়িয়ে দিচ্ছেন৷ প্লিজ আর কান্না করো না৷ এবার চোখের জল মুছে ফেলো৷”

“আমার তো একটাই কষ্ট, বাবার শেষ দিনগুলোতে পাশে থাকতে পারলাম না৷ বাবার সাথে কথা বলতে পারলাম না। আমার সাথে কথা বলার জন্য ছটফট করেছেন৷ আমি তোমার বাবাকে তৃপ্তি করে দেখতে পারলাম না৷”

বুকের মাঝে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বলল,

“আল্লাহ পাক চান তুমি হাশরের ময়দানে তোমার বাবার সাথে দেখা করো। তোমার বাবার সাথে প্রাণ খুলে কথা বল৷ সেজন্য আল্লাহ তায়ালা তোমাকে কথা বলার সুযোগ দেননি৷”

“আমি কিছু জানতে চাইনা৷ আমি মাতৃত্বের স্বাদ পেতে চাই৷ আমি মা হবো৷ আমার সন্তানকে ডাক্তার বানাবো৷”

আমার কথায় ইহান ঘাবড়ে যায়। তিনি কখনো এমন কিছু আশা করেননি৷ আমার কথা শুনে ইহান আকাশ থেকে পড়ল। বিচলিত কন্ঠে বলল,

“শালিক তুমি ঠিক আছো? এমন সময় তুমি মা হলে তোমার লেখাপড়ার ক্ষতি হবে৷”

“আমার লেখাপড়ার কোন ক্ষতি হবে না৷ আমি এখন কনসিভ হলে সমস্যা নেই। আমার পরীক্ষা বাকী মাত্র ৬ মাস৷ তখন আমি অনায়াসে পরীক্ষা দিতে পারব৷ এতো আমার লেখাপড়ার উপর চাপ পড়বে না৷ ভার্সিটির পরীক্ষার আগেই আমার ডেলিভারি হয়ে যাবে৷”

আমার অদ্ভুত যুক্তি শুনে ইাহানের কাশি উঠে। কাশতে কাশতে বলল,

“তোমার অদ্ভুত যুক্তির সাথে আমি একমত নয়৷ আমি তোমাকে এখনই মাতৃত্বের স্বাদ দিতে পারব না৷ আমাকে তুমি ক্ষমা করো৷”

আমি শার্টের কলার চেপে বললাম,

“আপনি বাবা হতে অক্ষম! আপনি আমার কাছে আসতে চাননা কেন? আমার চাহিদা আমার মিটে গেছে৷ আমি কালো বলে আমাকে দূরে ঠেলে দিতে ইচ্ছা করছে৷”

আমার অবাধ্য চু’লগুলো কানের কাছে গুছে দিয়ে বলল,

“ভালোবাসা চেহারা দেখে হয়না৷ আমি তোমার রুপে প্রেমে পড়িনি৷ তোমার ব্যক্তিত্বের আর বিচক্ষণ বুদ্ধির প্রেমে পড়েছি৷”

আমি অন্যদিকে ঘুরলাম৷ রাগ নিয়ে বললাম,

“আমি জানতাম আপনি আমার সন্তানকে ডাক্তার বানাতে চাননা৷ আমি মরিচীকার পিছনে এতোদিন ঘুরছি৷ আমার ভুল হয়েছে৷ আমাকে ক্ষমা করে দেন৷”

পিছন থেকে আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল,

“শালিক তুমি বুঝার চেষ্টা করো৷ তোমার দেহের যে কন্ডিশন সে অবস্থায় তুমি এমন চিন্তা বাদ দাও৷”

“উনাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। ইহানের শক্তির সাথে পেরে উঠতে পারলাম না৷ নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে নিলাম। আমাকে পটানোর অনেক চেষ্টা করলেন৷ আমি উনার কথায় কোন রেসপন্স করিনি৷ ব্যর্থ হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েন৷

চলবে…..

#শালিক_পাখির_অভিমান
#পর্ব_২৯
#অধির_রায়

ছোঁয়া অনবরত কান্না করে যাচ্ছে৷ তার কান্না করার উদ্দেশ্য বা ব্যর্থতা কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না৷ তিন জোড়া চোখ ছোঁয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ অর্পি বিরক্তি স্বরে বলল,

“ভ্যা ভ্যা থামা৷ আমার কান ব্যথা হয়ে গেছে৷ কখন থেকে বলছি কেন কান্না করছিস? কোন কিছুই বলছিস না কেন?”

নীরা চশমা ঠিক করতে করতে বলল,

“ছোঁয়া তোর কি টাকা হারিয়েছি? আমি একটু আগে ১০ টাকা কুড়িয়ে পেয়েছি৷ জানি না কার টাকা সেজন্য কলেজের মসজিদের দান বাক্সে দিয়ে এসেছি৷ কান্না করিস না৷ আমি তোকে বিশ টাকা দিচ্ছি৷”

নীরার আবুল মার্কা কথা শুনে ভীষণ হাসি পাচ্ছে৷ ছোঁয়া শেষে কি’না টাকার জন্য কান্না করছে৷ যার টাকার কোন অভাব নেই৷ সে দশ টাকার জন্য কান্না করছে৷ ছোঁয়া রাগ দেখিয়ে ভেজা গলায় বলল,

“আমি তোকে কখন বললাম আমার টাকা হারিয়েছি? আমার সামনে আবুল মার্কা কথা বলবি না৷”

অর্পি বিরক্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে৷ না পারছে সহ্য করতে না পারছে কিছু বলতে৷ নীরার পী’ঠে থা’প্প’ড় বসিয়ে বলল,

“তুই টাকা পাইছিস৷ এখন তুই চুপ থাক৷ ছোঁয়া তোর ন্যাকা কান্না বন্ধ কর। তোকে দেখে আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে৷ কান্না করতে হলে বাড়িতে গিয়ে কান্না কর৷ আমার কাছে তোদের ন্যাকামি ভালো লাগে না৷”

আমি চায়ের কাপে চুমু দিয়ে বললাম,

“ছোঁয়া কেন কান্না করছে আমরা কেউ কিছু জানি না৷ অর্পি তুই তোর রাগটা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা কর৷ ছোঁয়া তো কােন কারণ ছাড়া কান্না করছে না৷ নিশ্চয় কোন কারণ আছে৷”

অর্পি কর্কশ গলায় বলল,

“তোরা থাক আমি যাচ্ছি৷ এখানে বসে থেকে ন্যাকা কান্না সহ্য করতে পারব না৷ ছোঁয়া কোন কিছু না বললে জানব কিভাবে?”

অর্পির কথায় ছোঁয়ার কান্নার বেগ বেড়ে যায়৷ ভেজা গলায় বলল,

“আমার বিপদে আমার বন্ধুগুলো পাশে নেই৷ আমি কি এতোই খারাপ। তোরাও আমাকে ছেড়ে চলে যাবি৷”

অর্পি রাগ দেখিয়ে বলল,

“সব কথা বলতে পারিস কোকিলের মতো৷ কিন্তু কান্নার রহস্য বলতে পারবি না৷ তার থেকে বরং তুই কান্না কর৷ যখন তুই তোর সমস্যা বলবি আমাকে ফোন দিবি৷ আমি কলেজেই আছি৷”

ছোঁয়া আহত কন্ঠে বলল,

“মা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন৷ আমি এখন কিছুতেই বিয়ে করব না৷ আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বিয়ে করব৷”

নীরা আবারও আবুলের মতো মুখ খুলল৷ মিনমিন করে বলল,

“এখন কি তুই হামাগুড়ি দিয়ে চলিস? নিজের পায়ে হাঁটতে পারিস৷ তো বিয়ে করতে সমস্যা কি?”

নীরার কথায় ছোঁয়ার রাগ হলেও আমি আর অর্পি হেঁসে উঠলাম৷ অর্পি হাসতে হাসতে বলল,

“তোকে এই নিয়ে চিন্তা করতে হবে না৷ তোর বিয়ে ভাঙার দায়িত্ব আমাদের উপর ছেড়ে দে। আমরা তোর বিয়ে ভেঙে দিব৷”

ছোঁয়ার উৎসাহিত হয়ে বলল,

“সত্যি তোরা আমার বিয়ে ভেঙে দিবি৷ কাল আমাকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে৷ আমার বিয়েটা ভেঙে দিতে পারলে তোদের আমি কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়াবো৷”

আমি বললাম,

“আমরা আগামীকাল তোর বাড়িতে চলে যাচ্ছি। আর আমার মতো কালো মেয়েকে দেখলে তোর বিয়ে এমনি ভেঙে যাবে৷ এ নিয়ে কোন কান্না করবি না৷”

প্রেগ্ন্যাসির কীটে দুই দাগ দিয়ে চোখে পানি এসে পড়ল৷ তার মানে আমার স্বপ্ন পূরণ হতে চলছে৷ সেদিনের পর ইহানের সাথে এক সপ্তাহ কথা বলিনি। ইহান এক প্রকার বাধ্য হয়ে আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন৷ আমি জানি ইহান বাচ্চাদের খুব ভালোবাসেন৷ তিনি যখন জানতে পারবেন আমাদের রাজ্যে আরও একজন আসছে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাবেন৷ তাকে কিভাবে জানাব এই খুশির খবর? আমি নিজের খুশি ধরে রাখতে পারছি না৷ খুশির খবর জানানোর ভিন্ন একটা উপায় বের করলাম৷

রাতের খাওয়ার পর ইহান ল্যাপটবে কাজ করছিল৷ লজ্জায় ঘরে আসতে পারছি না৷ ছাঁদে চলে গেলাম৷ কাপা কাপা হাতে ইহানের নাম্বারে ফোন দিলাম৷ ইহান ফোন তুলে বলল,

“কি ব্যাপার? বাড়িতে আছি তবুও ফোন৷ মিস করছো তো রুমে আসোনি কেন?”

লজ্জা মাখা কন্ঠে বললাম,

“আমি রুমে যেতে পারব না৷ আমার মাথায় দুই মাস আগের ঘটনা ঘুরছে৷”

ইহান চিন্তিত স্বরে বলল,

“দুই মাস আগের ঘটনা মানে? আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না৷”

“আমি জানতাম আপনি একটা গা’ধা’রা’ম৷ টেবিলের উপর আপনার জন্য একটা খাম রাখা আছে৷ দয়া করে খামটা এখনই দেখে নেন৷”

ইহানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলাম৷ কি লজ্জায় বিষয়? ইহান খামটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলেন৷ প্রথমে খাম থেকে বের করলেন আমার আর ইহানের একটা ফুটো। তার পর বের হলো আমার প্রেগ্ন্যাসির কীট৷ যা দেখে ইহানের চোখ রসে গোল্লার মতো হয়ে গেলে৷ খুশিতে তিনি নাচতে শুরু করলেন৷ এক দৌড়ে ছাঁদে চলে আসলেন৷ আমাকে পাঁজা কোলায় তুলে ঘুরানোর শুরু করলেন৷ খুশির কারণে কথা বলতে পারছে না৷ ইহান আমাকে দোলানায় বসিয়ে দেন৷ আমার উদরে হাত রেখে বলল,

“সত্যি! আমাদের ছোট ঘরে নতুন অতিথি আসতে চলছে৷ আমি কতোটা খুশি হয়েছি বলে বুঝাতে পারব না৷”

“এতো খুশি হতে হবে না৷ আপনি আমার মতামতের দাম দেননি৷ আমাকে পটাতে পারবেন না৷ আমি আপনার উপর ভীষণ রেগে আছি৷”

“তুমি রেগে থাকলে আমার কিছু যায় আসে না৷ আমি বাবা হতে চলছি৷ তোমার যত অভিযোগ আছে পরে করো৷ আমি তোমার সব অভিযোগ মাথা পেতে নিব৷ আমি আগে আমার অস্তিত্বকে মন ভরে অনুভব করি৷”

“দূরে সরে যান৷ আমার সন্তানের উপর আপনার কোন অধিকার নেই। আপনি কি বলছিলেন এখন উপযুক্ত সময় নয়৷ উপযুক্ত সময় হলে বাবার স্বাদ নিবেন৷ তার আগে বাবার দাবী নিয়ে আসবেন না৷”

“এখনও আমার উপর রেগে আছো৷ আমি কিন্তু তোমার..”

“হয়েছে আর অজুহাত দেখাতে হবে না৷ আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে৷”

“আজ কোন ঘুম নেই৷ আজ আকাশে থালার মতো চাঁদ উঠেছে৷ আমরা এক সাথে বসে গল্প করব৷ আমরা আজকের রাতটা স্মৃতি করে রাখব৷”

“আমার কোন ইচ্ছা নেই৷ কাল ছোঁয়াদের বাসায় যেতে হবে৷ কাল মহৎ কাজ করতে যাব৷ তাই ঘুমিয়ে মাথা ঠান্না করতে হবে৷ মাথা গরম ঘাকলে সব উল্টেপাল্টে যাবে৷”

ইহান অবাক হয়ে বলল,

“ছোঁয়াদের বাড়িতে কেন যাবে? কাল তোমাকে কোথাও যেত হবে না৷ কাল আমি এই দিনটাকে স্মরনীয় করে রাখতে চাই৷ সারাদিন তোমার সাথে কাটাব৷ আমরা বিভিন্ন জায়াগায় ঘুরে বেড়াব৷ আমাদের ভালোবাসার সাক্ষী হবে অনেকে।”

“আমাদের ভালোবাসার সাক্ষী একমাত্র আল্লাহ তালায়া৷ আমি আমার সন্তানের জন্য আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করতে চাই৷ শরীর ভালো হয়ে সালাত আদায় করতে কষ্ট হয়৷ সেজন্য এখন আল্লাহকে খুশি করার জন্য সালাত আদায় করব। তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করব নিয়মিত। কুরআন শরীফ তেলওয়াত বাড়িয়ে দিব৷ খবরটা বাড়িতে জানাতে হবে৷ তারাও খুশি হবেন খবরটা জেনে৷”

ইহান আমার কোলে মাথা রেখে বলল,

“আমি তোমার সাথে একমত৷ আমিও তোমার সাথে রেগুলার তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করব। আমাদের সন্তান আর তোমার জন্য অতিরিক্ত প্রতিদিন দুই রাকাত সালাত আদায় করব৷”

“হুম আমরা এখন থেকে আল্লাহর এবাদত করব বেশি বেশি৷ ছাঁদে ঠান্ডা লাগছে৷ ঘরে চলেন৷ আর এমন সময় বাহিরে কম থাকাই ভালো৷
আপনি কিছু বলতে পারবেন না৷ আমরা বরং বেলকনিতে থেকে চাঁদের সৌন্দর্য উপভোগ করব৷”

ছোঁয়ার মা অর্পি, নীরাকে ছোঁয়ার বন্ধু হিসাবে মেনে নিলেও আমাকে মেনে নিতে পারল না৷ কারণ আমার গায়ের রং কালো৷ আমার দিকে এক প্রকার বিরক্তি চাহনিতে তাকিয়ে আছেন৷ অর্পিকেও তেমনভাবে মেনে নিতে পারলেন না৷ অর্পি চঞ্চল প্রকৃতির মানুষ হওয়ার অর্পির উপর ভীষন রেগে আছে৷ অর্পি আসার পরই কাঁচের গ্লাস ভেঙে ফেলেছে৷ কে সহ্য করতে চাইবে অর্পিকে৷ ছোঁয়াদের এতো বড় বাড়িতে মানুষ নেই৷ আমাদের বাড়ি কতো ছোট। তবুও অনেক মানুষ। ইমন ভাইয়া, শ্রুতি ভাবী, আফসানা চৌধুরী, শরীফ চৌধুরী, মায়া ফুপি, মালী কাকা, দাড়োয়ান কাকা৷ দু’জন ড্রাইভার আঙ্কেল। আরও একজন কাজের মেয়ে রেখেছেন। তাকে পড়ার কথা বললে সে জানিয়েছে লেখাপড়া করবে না৷ তাই তাকে জোর করে স্কুল ভর্তি করা হয়নি৷ আমাদের বাড়িতে মানুষে পরিপূর্ণ। সবাই এক ছাঁদের নিচে থাকি৷ ছোঁয়াদের বাড়িতে তেমন কেউ নেই৷ ড্রাইভারের জন্য আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করেছে। তারা নিজেরাই রান্না করে খান৷ বাড়িতে কোন কাজের লোক নেই৷ আমি আন্টিকে সাহায্য করার জন্য রান্না করে আসলাম৷ রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বললাম,

“আন্টি আমি আপনাকে রান্নার কাজে সাহায্য করি৷”

তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

“কোন সাহায্য করতে হবে না৷ তুমি ছোঁয়ার রুমে যাও৷ আমি রান্নার কাজ একাই করতে পারি৷ এজন্য আমি কাজের লোক রাখিনি৷”

উনার কথা না শুনে রান্না ঘরে ঢুকে পড়লাম৷ উনি বিরক্তি স্বরে বলল,

“তুমি খুব অবাধ্য মেয়ে তো৷ আমার কথা তোমার কানে গেল না৷”

“আমি একটু অবাধ্য টাইপের মেয়ে৷ আপনি একা এতো কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছেন৷ আমি আপনাকে সাহায্য করলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না৷ আপনি নিজেও জানেন আজ আপনাকে কেউ সাহায্য করলে আপনার কাজ করতে সুবিধা হবে৷”

আন্টি আর কথা বাড়ালেন না৷ আমার অবাধ্যতার জন্য উনি মনে মনে খুব খুশি হলেন৷ উনার ঠোঁটের কোণে হাসি বলে দিচ্ছে৷ রান্না শেষে বর পক্ষ ছোঁয়াকে দেখতে চলে আসেন৷ আন্টি তাদের কাছে চলে যান৷ আমি অর্পিকে ডেকে করলার রস, লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে শরবত বানিয়ে দিলাম৷ বরের মা বাবার জন্য শুধু করলার রসের শরবত বানিয়ে দিলাম৷ ছোঁয়াকে কি বলতে হবে বলে দিলাম? ছোঁয়ার করলার রস সামনে দিয়ে বলল,

“আপনারা অনেক কষ্ট করে এসেছেন। শরবত পান করে তৃষ্ণা মেটান৷”

মুখে দিয়েই শরবত ফেলে দিলেন৷ ছোঁয়া চোখ রাঙিয়ে হাসি মুখে বলল,

“কেন করলার রস ভালো হয়নি? প্রতিদিন তিন বেলা করলার রস খেতে হয়৷ স্বাস্থ্য ভালো থাকবে৷ আমার বিয়ে হওয়ার পর এমন কাজ করলে আমি জোর করে করলার রস খাওয়াব৷ আমি কিছুতেই আমার নিয়ম ভাঙতে পারব না৷”

ছেলের মা বলল,

“কেউ করলার রস খেতে পারি৷ তুমি কি পা*গ”ল হয়েছো?”

ছোঁয়া উৎসাহের সাথে বলল,

“আম্মু একবার ভেবে দেখেন৷ করলার রসের কত মহান৷ সকল পরিস্থিতিতে করলার রস খাওয়া যায়৷ ডাক্তাররা করলার রস খাওয়ার জন্য পরামর্শ দেন৷ আপনি যদি রেগুলার করলার রস খান তাহলে কখনও বুড়ী হবেন না৷”

অর্পি ছেলের গাল টেনে বলল,

“আমাদের দুলাভাই মাশাল্লাহ খুব কিউট। আমি দুলাভাইয়ের উপর ক্রাশ খেয়ে ফেলাম৷”
কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

“বিয়ে করার শখ মিটিয়ে দিব৷ আপনার মা বাবাকে এখান থেকে নিয়ে চলে যান৷ ছোঁয়ার ফ্যামিলি জোর করে বিয়ে দিতে চাচ্ছে। আর যদি আপনি বিয়ে করতে রাজি হোন আপনাকে কিডন্যাপ করব৷ মে*রে নদীতে ফেলে দিব৷”

অর্পির খোলা মাঠের হুমকিতে ভয় পেয়ে যান৷ ছেলেটি দাঁড়িয়ে বলল,

“মা বাবা৷ আমি বিয়ে করতে পারব না৷ আমি আরও দুই বছর পর বিয়ে করব৷ আমি এখনই বাড়িতে যাব৷”

আন্টি তাদের আটকানোর চেষ্টা করলেন৷ কিন্তু আন্টিকে উপেক্ষা করে চলে গেলেন৷ ছোঁয়াকে ইচ্ছামতো বকে যাচ্ছে৷ আমরা তিনজন দূরে দাঁড়িয়ে সব দেখছি৷ ছোঁয়া বলল,

“আমি এখন বিয়ে করব না৷ তাইতো করলার রস নিয়ে এসেছি৷ আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বিয়ে করব৷ আমি কোন ছেলের উপর নির্ভর করব না৷”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here