নক্ষত্র নারী-০১

0
787

নক্ষত্র নারী-০১
– রুদ্র আজাদ

১.
পায়েলকে যখন বিয়ে করি তখন সবে লেখালেখি শুরু করেছি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে, অন লাইনে গল্প প্রকাশ হতে লাগলো। তখনো কোনো নাম ডাক ছিলো না আমার। পেশাগত দিক থেকে একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতাম আর অবসরে লিখতাম। লেখাটা ছিলো স্রেফ শখ। ভালো লাগতো তাই লিখতাম। লেখালেখিকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে করতাম না।

বিয়ের পরই পায়েল প্রথম আমার লেখা পড়লো। কোনো একটা পত্রিকা থেকে পড়েছিলো।
সে রাতে পায়েল আমাকে জিজ্ঞেস করলো,”তুমি লিখছো কতোদিন থেকে?”
উদাসীন ভাবে বললাম,”দিন তারিখ ঠিক মনে নেই। বছরখানেক হবে। তবে লেখা প্রকাশ হতে শুরু করেছে মাস তিনেক হবে।”
“তোমার লেখা সম্বন্ধে তোমার নিজের ধারণা কী?”
হেসে বললাম,”অত্যন্ত বাজে লিখি।”
ও মুখ গম্ভীর করে বললো,”প্লিজ হেসো না। সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করছি।”
ও আমার লেখাকে এতো গুরুত্বের সাথে কেনো নিচ্ছে বুঝতে পারলাম না।
বললাম,”আমার আবার লেখা! বাদ দাও তো।”
পায়েল তখন আমার চোখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,”তোমার নিজের কোনো ধারণাই নেই তুমি যে কতো ভালো লেখো! তোমার প্রতিভা আছে। এবার থেকে লেখাকে আর হালকা ভাবে নিও না। মন দিয়ে লেখো।”

পায়েলের কথায় আমি যে সঙ্গে সঙ্গে গভীর মনে লিখতে শুরু করেছিলাম তা নয়, তবে একটা বদল আমার ভেতর এলো। মনে হলো, আমি কি তবে সত্যি ভালো লিখি? আমি কি প্রতিভাবান?
এরপর থেকে লেখায় মনোযোগ বাড়তে লাগলো। প্রতিটা গল্প লেখার পর পায়েলকে প্রথমে পড়ে শোনাতাম। সে অভিনিবেশে শুনতো। তারপর প্রচুর উৎসাহ দিতো।

বছরখানেক পত্র-পত্রিকায়, ম্যাগাজিন, অন লাইনে লেখার পর পায়েল একদিন বললো,”যে গল্পগুলো এতোদিন লিখেছো সেগুলো থেকে সেরা সাতটা গল্প বেছে নিয়ে একটা বই বের করো।”
কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বললাম,”আমার বই কে বের করবে? লেখক হিসেবে আমার তো তেমন পরিচয় নেই।”
পায়েল দৃঢ় কণ্ঠে বললো,”আমি বের করবো। টাকা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি একজন ভালো প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ করো।”
আমি অবাক হয়ে গেলাম ওর কথা শুনে।
বললাম,”কী দরকার এসব ঝামেলায় যাওয়ার? বই টই বের করার দরকার নেই। এই যেমন আছি তেমন ভালো।”
পায়েল অনড় থেকে বললো,”যা বললাম তাই করো। সামনের বইমেলাতেই তোমার বই বের হবে।”
ততোদিনে বুঝে গেছি এই মেয়ে শক্ত মনের মেয়ে। যা বলবে তা করবেই।

একটা বই বের করার টাকা অবশ্যই আমি দিতে পারি। কিন্তু পায়েল আমাকে এক টাকাও খরচ করতে দিলো না। ওর বাবার বাড়ির কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে যা পেয়েছিলো সেখান থেকে খরচ করলো। বই বের করার ব্যাপারে আমার চেয়ে ওর উৎসাহ ছিলো বেশি। আমার প্রকাশিত প্রত্যেকটি গল্প একাধিকবার পড়ে সাতটি গল্প নির্বাচন করলো। বইয়ে যাতে বানান ভুল না থাকে এজন্য রাত জেগে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রুফ দেখতো। ওর অমানুষিক খাটুনি দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম!

যদি বলতাম,”এতো নিখুঁত হওয়ার কী আছে? থাক না কিছু ভুল। তুমি যে পরিশ্রম করছো অসুস্থ হয়ে পড়বে। আমাকে কিছু দাও আমিও দেখি।”
ও তখন বলতো,”এ সবে সময় ব্যয় করার প্রয়োজন নেই। তুমি লেখো। ওখানেই সময় দাও।”

যথা সময়ে বইমেলাতে আমার বই বেরুলো। পায়েলের সে কি আনন্দ! নতুন বই হাতে নিয়ে বাচ্চাদের মতো খুশিতে আপ্লুত হয়ে গেলো। এবং সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, আমার প্রথম বইটা নগদ টাকা দিয়ে সেই কিনলো। তারপর বইটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,”লেখক সাহেব অটোগ্রাফ প্লিজ।”
আমি হাসতে হাসতে অটোগ্রাফ দিলাম।

বইটা যে খুব বিক্রি হয়েছিলো তা নয়। মোটামুটি বিক্রি হলো। তবে ঘটনা ঘটলো আরেক জায়গাতে। অন্য এক প্রকাশকের আমার লেখা ভালো লেগে গেলো। তিনি এক রাতে আমার বাসায় এলেন। এবং বললেন, আগামী বইমেলায় তিনি আমার কাছ থেকে একটা উপন্যাস চান।

এর আগে কখনো উপন্যাস লিখি নি। তাই লিখতে পারবো কিনা বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু পায়েল এমন প্রবল উদ্দীপনা অনুপ্রেরণা দিলো যে, এক সময় সাহস করে লিখতে শুরু করে দিলাম। দিনে ভার্সিটিতে পড়াতাম আর রাতে লিখতাম। তবে পায়েল বন্ধের দিন ছাড়া বেশি রাত জাগতে দিতো না।

ও বলতো,”ঘুমানোর প্রয়োজন আছে। শরীরের যত্ন নিতে হবে। শরীর ঠিক না থাকলে ভালো লেখা যাবে না।”
অগত্যা ওর কথা মেনে নিতাম। যখন লিখতাম পায়েল তখন টিভি, মোবাইল সব কিছুর সাউন্ড কমিয়ে দিতো। যাতে আমার লিখতে কোনো অসুবিধে না হয়। এমন কি ঘরের বাজার সদাই নিয়েও আমাকে ভাবতে দিতো না। নিজে বাজারে গিয়ে মাছ মাংস তরিতরকারি কিনতো।

পরের বইমেলায় বেরুলো আমার প্রথম উপন্যাস। এই বইটিও হাতে নিয়ে পায়েলের সে কি আনন্দ! যেনো বইটি আমার নয়, তার। এই বইটিও খুব একটা বিক্রি হলো না। তবে আগের বইটির চেয়ে বেশি বিক্রি হলো। এবং এই বইটিরও প্রথম ক্রেতা ছিলো পায়েল।

প্রকাশক পরের বইমেলার জন্য আবারো আমার কাছে উপন্যাস চাইলেন। এবং কিছু টাকা অগ্রীমও দিলেন। টাকার পরিমাণ সামান্য। বলার মতো নয়। টাকার দিকে আমার ঝোঁক ছিলো না। বই বেরুচ্ছে এটাই আমার কাছে বড়ো।

চতুর্থ বইমেলা থেকে পরিবর্তন শুরু হলো। হঠাৎ করে আমার বইয়ের প্রচুর বিক্রি হতে লাগলো। পাঠক পাঠিকারা লাইন দিয়ে আমার বই কিনলো। আমি অটোগ্রাফ সেলফি দিতে হিমশিম খেলাম।

মেলা শেষে প্রকাশক বললেন,”জাবের সাহেব, বাজারে আপনার বইয়ের প্রচুর চাহিদা। শুধু বইমেলায় লিখলে হবে না। বছরের অন্য সময়েও লিখতে হবে।”

সদ্য জনপ্রিয়তার স্বাদ পেয়েছি আমি তখন। লেখাটা নেশার মতো হয়ে গেছে। না লিখে থাকতে পারি না।

বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে আমার লেখার জন্য অনুরোধ আসে। বড়ো অংকের অগ্রীম টাকা দেয়। কিন্তু সমস্যা হলো আমি সময় করে উঠতে পারছি না। দিনে আমাকে ব্যস্ত থাকতে হয় শিক্ষকতা নিয়ে। বাকি সময়টুকুতে লিখি। তাও রাত জেগে পায়েল লিখতে দেয় না সব সময়। এ দিকে আমার বইয়ের চাহিদা অনেক।

তখন একদিন পায়েলকে বললাম,”কী করা যায় বলো তো?”
পায়েল এমন একটা সিদ্ধান্ত দিলো যা আমার পক্ষে নেয়া কখনো সম্ভব হতো না। অতো সাহস আমার ছিলো না।
পায়েল শান্ত গলায় বললো,”তোমার জন্ম হয়েছে লেখার জন্য। অন্য কিছুতে সময় ব্যয় করা ঠিক হবে না। তুমি ভার্সিটির চাকরিটা ছেড়ে দাও।”
আমি আঁতকে উঠে বললাম,”নিশ্চিত আয়ের চাকরি ছেড়ে অনিশ্চিত আয়ের জীবন বেছে নেবো? আজ আমার জনপ্রিয়তা আছে, কাল যদি না থাকে? তখন কী হবে?”
পায়েল নির্ভরতার কণ্ঠে বললো,”সে ভাবনা আমার। তুমি শুধু মন দিয়ে লেখো।”

পায়েলের কথায় ভরসা পেয়ে আমি চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। এবং নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেলে দিলাম লেখালেখিতে। বছরে ছয় সাতটা বই বের হয় আমার। এবং প্রচণ্ড বিক্রি। সত্যি বলতে শিক্ষকতা করে যে আয় করতাম এখন তার চেয়ে বহুগুণ বেশি আয় করতে লাগলাম। বই লিখে যে এতো আয় করা যায় অকল্পনীয় ছিলো। অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট কিনেছি। এক প্রকাশক উপহার দিলেন গাড়ি। সব কিছু অবিশ্বাস্য লাগছিলো।
এর মধ্যে আমি এক মেয়ে সন্তানের বাবা হয়েছি। সব কিছু চমৎকার ভাবে যাচ্ছিলো। তারপর আরম্ভ হলো আমার জীবনের অন্ধকার অধ্যায়। যে গল্প বলার জন্য আমি বসেছি।


আমার তখন প্রচুর ভক্ত। রাতদিন তাদের ফোন আসে, ই-মেইল আসে, মেসেজ আসে। নানা রকম উপহার পাই। এই সময় অল্প বয়সী দুর্দান্ত আকর্ষণীয় এক মেয়ে ভক্তের সাথে আমার পরিচয় বেশ গাঢ় হয়ে উঠলো। ওর নাম সিনথিয়া। কোনো ভাবে মেয়েটার ভাবনা থেকে নিজেকে সরাতে পারি না। ওর মোহে আমি তখন আচ্ছন্ন। ওর কথায়, হাসিতে, সঙ্গে, আমি অভিভূত। লুকিয়ে লুকিয়ে আমরা দেখা করি। ফোনে দীর্ঘ সময় কথা বলি। বিষয়টা পায়েলের মতো বুদ্ধিমতী মেয়ের চোখ এড়ানোর কথা নয়।

সে একদিন প্রশ্ন করলো,”কার সাথে ফোনে এতো কথা বলো?”
কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়ে বললাম,”শুধু কি একজনের সাথে কথা বলি? কতো জনের সাথে কথা বলতে হয়! কতো অনুষ্ঠানে আমাকে যেতে হয়! কতো জায়গা থেকে ফোন আসে! প্রকাশকরা ফোন করে, আয়োজকরা ফোন করে, পাঠকরা ফোন করে। তোমার তো এ সব না জানার কথা নয়।”
“আমি এ সব জানি। কিন্তু তুমি ইদানীং যে স্বরে কথা বলছো তা অন্য রকম।”
“কী রকম?”
“আমি বলতে চাইছি না। শুধু বলবো তোমার পাঁচ বছরের একটা মেয়ে রয়েছে। যা করার ভেবে চিন্তে কোরো।”

আমি পায়েলের কথায় বিরক্ত হলাম। এবং পরবর্তীতে পায়েল বিষয়টি নিয়ে যতো কথা বলতো ততো আমি বিরক্ত হতাম। এবং পায়েলকে আমার অত্যন্ত বিরক্তিকর মনে হতো।

এরপর থেকে এ নিয়ে প্রায় ঝগড়া হতে লাগলো। একদিন ঝগড়া চূড়ান্ত ভয়ংকর রূপ নিলো।
আমি চড়া গলায় বললাম,”এভাবে সন্দেহ করলে সংসার করা সম্ভব নয়।”
পায়েল বললো,”সন্দেহ মিথ্যে না সত্যি তুমি ভালো করেই জানো। তোমাদের ব্যাপারটা এখন অনেকেই জানে।”
“ওসব গুজব। জনপ্রিয়দের নিয়ে গুজব রটালে পত্রিকার কাটতি ভালো হয়। এ সব কি তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে?”
“গুজব না অন্য কিছু সেটা আমি যেমন জানি তুমিও জানো। নিজেকে আর কতো লুকাবে? আমার কথা না হয় বাদ দিলাম, তোমার মেয়েটার কথা কি তোমার একবারও মনে পড়ছে না?”
“ফালতু কথা বলা বন্ধ করো। এ সব শোনার সময় আমার নেই। গত ছয়টা মাস তুমি এসব বলে বলে আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছো। আর সহ্য হচ্ছে না। এবার আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও।”
“ঠিক আছে আমি আজই বিন্দুকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যাচ্ছি। আর আসবো না তোমার শান্তিতে বিঘ্ন ঘটাতে।”
“দয়া করে তাই যাও। আরো আগে গেলে খুশি হতাম।”

সে দিনই পায়েল বিন্দুকে নিয়ে চলে গেলো। ও যাওয়াতে মনে হলো বুকের ওপর থেকে যেনো পাথর নেমে গেলো। নিজেকে ভীষণ হালকা মনে হলো। পায়েল ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরই আমি বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে সিনথিয়াকে ফোন করলাম। এবং হাসি মুখে বললাম,”খুব শীঘ্রই আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি।”
সিনথিয়া বললো,”তোমার স্ত্রী সন্তান তাদের কী হবে?”
আমার মাথায় তখন তখন সিনথিয়া ছাড়া অন্য কিছু নেই।
বললাম,”দীর্ঘদিন থেকে ওর সাথে বনিবনা হচ্ছে না। কারণে অকারণে ঝগড়া করছে। বাসায় যে একটা মুহূর্ত শান্তিতে কাটাবো সে উপায় নেই। সারাক্ষণ খিটখিট করেই যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে পাগল হয়ে যাবো। বহু চেষ্টা করেছি মিটমাট করার, লাভ হয় নি। তোমার সাথে সম্পর্ক করার মূল কারণ ওটাই। ওর সাথে মিল হলে তো তোমার সাথে সম্পর্ক করতাম না।”

আমি জানি আমি মিথ্যে বলছি। কিন্তু আমি তখন সিনথিয়াতে এতোটাই মজে আছি যে, অনর্গল মিথ্যে বলাটা কোনো ব্যাপার ছিলো না। আমি তাই সিনথিয়ার কাছে অবিরাম পায়েলের বদনাম করে যেতাম।
সিনথিয়া বললো,”তাহলে এখন কী করতে চাও?”
“সমাধান একটাই। ওকে ডিভোর্স দেয়া। তারপর শুধু আমরা দু’জন।”


পায়েলকে তালাক দেয়ার কাগজপত্র তৈরির জন্য একজন উকিল নিয়োগ করেছি। যাবতীয় সব কিছু যখন গুছিয়ে এনেছি তখন এক রাতে প্রফুল্ল মন নিয়ে লিখতে বসলাম। সে দিন সারাদিন সিনথিয়ার সাথে কাটিয়েছি তাই মনটা প্রফুল্ল ছিলো। প্রফুল্ল মনে লেখা ভালো হয়। লিখতে বসে বিস্মিত হয়ে দেখলাম কিছু লিখতে পারছি না। অনেকক্ষণ বসে রইলাম কম্পিউটারের সামনে কিন্তু একটি বাক্যও লিখতে পারলাম না। বুঝলাম আজ আর লেখা হবে না। পরদিন ভোরে বসতে হবে। লেখালেখির জন্য ভোরের সময়টা চমৎকার। কিন্তু পরদিন ভোরেও এক লাইনও লিখতে পারলাম না। দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, রাত চলে গেলো কিন্তু কিছুই লিখতে পারলাম না। তারপর দিনও একই অবস্থা। মাঝে মাঝে সব লেখক কবির জীবনে এমন সময় আসে যখন তারা কিছুই লিখতে পারেন না। এটাকে বলে রাইটার্স ব্লক। ভাবলাম আমারো বোধহয় তেমন কিছু হলো।

এক প্রকাশক শুনে বললেন,”এটা কোনো সমস্যাই না। আপনি বিদেশ থেকে একটা ভ্রমণ দিয়ে আসেন। সব ঠিক হয়ে যাবে। পুরা খরচা আমার। আপনি ঘুরে আসেন। আমিসহ যাবো।”

তারপর কিছু কাছের বন্ধু আর প্রকাশকসহ ইউরোপ ঘুরে এলাম। বেশ আনন্দময় সফর হলো। কিন্তু আমার লেখার বন্ধ্যা দশা কাটলো না। সিনথিয়ার সাথে সময় কাটাই, এ দিকে ও দিকে ঘুরতে যাই। প্রাণবন্ত সময় কাটে। অর্থাৎ অন্য সকল কিছু ঠিক আছে। শুধু লিখতে পারি না। ঘন্টার পর ঘন্টা কম্পিউটারের সামনে বসে থাকি কিন্তু একটি শব্দও লিখতে পারি না।

একজন লেখক যখন লিখতে পারেন না তখন সেটা লেখকের জন্য মৃত্যুর মতো। আমি মনে মনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লাম। ধীরে ধীরে আমার ভেতর ভয় ঢুকতে লাগলো। এ ভয় আর্থিক ভয় নয়। ততোদিনে যতো বই লিখেছি তার যে রয়্যালটি পেতাম তাতে জীবন দিব্যি চলে যাবে। আমার ভয় লিখতে না পারার ভয়। লেখা যে কতোখানি আমার জীবন জুড়ে আছে লিখতে না পারার দিনগুলোতে তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। আমার সমসাময়িক লেখকরা কী দারুণ সব গল্প উপন্যাস লিখে যাচ্ছে! আর আমি কিছুই লিখতে পারছি না। তাহলে কি আমি ফুরিয়ে গেছি? প্রচণ্ড আতঙ্ক ঘিরে ধরলো আমাকে। লেখা ছাড়া আমার পক্ষে বাঁচা সম্ভব হবে না।


একদিন রাতে টেবিলে মাথা নিচু করে বসে আছি। হঠাৎ মনে হলো, পায়েলের সাথে যে দিনগুলোতে তীব্র ঝগড়া হতো সে দিনগুলোতেও আমি লিখতে পেরেছি, আর এখন ঝগড়া বিবাদ নেই তবু কেনো লিখতে পারছি না? অকস্মাৎ চোখ গেলো তাকে সাজানো আমার বইগুলোর দিকে। বই বের করার জন্য পায়েলের কী প্রচণ্ড আগ্রহ ছিলো! এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ওর একক চেষ্টাতেই আমি প্রতিষ্ঠিত লেখক হয়ে উঠি। নইলে তো সেই পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন, অন লাইনের অপরিচিত লেখক থেকে যেতাম। মধ্যবিত্ত পাড়া থেকে অভিজাত পাড়াতেও আসা হতো না। আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে ওর যে পরিশ্রম, ত্যাগ তা অভাবনীয়। জনপ্রিয়তার দম্ভে মত্ততায় এতোদিন সব ভুলে ছিলাম।

ভাবতে ভাবতে আমি কম্পিউটারে অজান্তে লিখলাম ‘পায়েল’। কেনো লিখলাম জানি না। এবং আমি নামটির দিকে স্থির তাকিয়ে রইলাম। তারপর মুখে উচ্চারণ করলাম ‘পায়েল’। অতঃপর আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে উঠলো কেনো আমি লিখতে পারছি না। এবং এটাও বুঝতে পারলাম লেখার জন্য কাকে আমার প্রয়োজন। শুধু লেখা নয়, জীবনের সব ক্ষেত্রে কাকে আমার প্রয়োজন।

রাত তখন এগারোটা। বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তায় পানি উঠে গেছে। আমি ততোক্ষণে স্থির করে ফেলেছি আমাকে কী করতে হবে। চেয়ার থেকে যখন দ্রুত উঠে দাঁড়িয়েছি তখন পরপর দুটো ফোন এলো।

প্রথম ফোন করেছেন উকিল। তিনি বললেন,”ডিভোর্সের কাগজপত্র সব তৈরি আমরা কি এগুবো?”
জোর গলায় বললাম,”উকিল সাহেব ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত বাতিল। পায়েলকে ছাড়া একদিনও বাঁচা অসম্ভব। ওকে আমার লাগবেই।” বলেই ফোন কেটে দিলাম।

তারপরই ফোন এলো সিনথিয়ার। কিন্তু ফোনটি রিসিভ করার প্রয়োজন বোধ করলাম না। এবং ঐ মুহূর্তে এটাও ঠিক করলাম, ওর ফোন এ জীবনে আর রিসিভ করবো না। যথেষ্ট ভুল করে ফেলেছি। আর না। আর না।

গাড়ি স্টার্ট করতে গিয়ে দেখলাম স্টার্ট হচ্ছে না। দরকারের সময় সব কেমন জানি বিগড়ে যায়। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও চালু করতে পারলাম না। ড্রাইভার থাকলে চেক করতে পারতো। কিন্তু গতকাল ও ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়ি গেছে।

বাইরে বেরিয়ে দেখলাম রাস্তাঘাট সব ফাঁকা। গাড়ি তো নেই-ই কোনো মানুষজনও নেই। সবাই এই বৃষ্টির রাতে ঘরে আরাম করে শুয়ে। কিন্তু আমার পক্ষে আর দেরি করা সম্ভব নয়। আর এক মুহূর্তও নয়। পায়েলকে আমার লাগবেই।

অতঃপর, প্রচণ্ড বৃষ্টিতে, রাস্তায় জমে থাকা পানি ভেঙে, সুনসান রাত উপেক্ষা করে আমি প্রাণপণে দৌড়াতে লাগলাম…দৌড়াতে লাগলাম…দৌড়াতে লাগলাম…।

( চলবে )
( দ্বিতীয় পর্বে গল্পটি শেষ হবে )

“নক্ষত্র নারী”
– রুদ্র আজাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here