তবুও তুমি
৭ম পর্ব
” আমার আপুরে বাঁচাও। আমার আপুরে ওই রুম থেকে বের করো ” ঝুমু আমাকে ধরে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল। আমি ঝুমুর মাথায় হাত দিয়ে শান্ত করতে করতে বললাম ” আচ্ছা আগে শান্ত হও পরে কি হইছে খুলে বলো “। জিমি কান চুলকাতে চুলকাতে ঝুমুকে বলল ” ঝুমাপু তুমি এত হাইপার হইও না তো। আস্তে আস্তে ভাবির অভ্যাস হয়ে যাবে। আজ প্রথম দিন তো তাই হাল একটু বেহাল এই আর কি “। জিমির উওর শুনে রাসেল ভাই যেন আর একটু কান খাড় করল। আমার হাত পা ঝিম ঝিম করতে লাগল জিমির কথা শুনে। ঝুমুকে বাদ দিয়ে জিমিরে জিজ্ঞেস করলাম ” কি রে জিমি কি হইছে ভাবির? ঝুমু এমন কথা বলতেছে কেন?”। ” আপু ঝুমুপু তো নতুন ভাবিও নতুন দুইজনেই সহ্য করতে পারে না। আমার প্র্যাক্টিস থাকলেও কেমন জানি লাগছে? ” এই বলেই জিমি কান খোঁচাতে লাগল। আমি কনফিউজড হয়ে গেলাম ঝুমু বলছে কি আর জিমিই বা বলছে কি। না পেরে রাসেল ভাইয়ের দিকে তাকাতেই বুঝলাম সেও আমার মতই কনফিউজড। এখন আমার অস্ত্র প্রয়োগ করার সময়। জিমির দিকে ঘুরে মুখে শীতল একটা হাসি দিয়ে বললাম ” এক্ষুনি যদি না বলিস রুমের ভিতরে কি হয়েছিল আমি খালামনির কাছে যেয়ে বলে দেবো যে তুই ভাইয়ার রুমে লুকিয়েছিলি”। এই কথায় যেন সেকেন্ডেই কাজ হয়ে গেল। ” ভাইয়া ভাবিকে এতক্ষন গান শোনাচ্ছিল ” এই বলেই জিমি ঝুমুর দিকে তাকালো। আমি আর রাসেল ভাই দুইজন দুকজনের দিলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম। ঝুমু আবার বলতে লাগল ” তোমার ভাই বিগত দুই ঘন্টা যাবত একা একাই গানের কলি খেকে যাচ্ছে। কি গানের গান খাটের নিচে দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরেছিলাম তাও কাজ হয় নি “। ভাইয়ার গান গাওয়ার বাতিক আছে অনেক আগে থেকেই। ও গান গাওয়া শুরু করলে বাসার সামনে রাস্তার কুকুর গুলো জড়ো হয়ে ডাকাডাকি শুরু করে। কিন্তু আমি ভাবতেও পারি নাই যে ও বাসর রাতেও বউরে গান শুনাবে।” ঝুমুপু তুমি চিন্তা করো না তো ভাবির অভ্যাস হয়ে যাবে যেমন আমাদের হয়ে গেছে ” এই বলে জিমি ঝুমুকে স্বান্তনা দিতে লাগল। ঝুমু ঝাজের সাথে উওর দিল ” হয় আপু বয়ড়া হয়ে যাবে না হয় পাগল হয়ে রাস্তায় নেমে যাবে”। ” আরে কি পাগলামি করতেছ ঝুমু শান্ত হও তো। ভাবি ভাইয়ারে টাইট দিয়ে দেবে।তুমি কিচ্ছু চিন্তা করো না আমরা তো আছিই ” এই বলে কোন রকমে ঝুমুকে ম্যানেজ করলাম।মনে মনে ভাবতে ছিলাম সকালেই না ভাবি গাট্টি বোচকা গুছিয়ে বাপের বাড়ি রওনা হয়।চোখের কোনা দিয়ে দেখলাম রাসেল ভাই আস্তে করে চলে যাচ্ছে। এত কিছু হল আল্লাহর বান্দা একটা শব্দ করল না মুখ দিয়ে। আর আল্লাহ না করুক আমি যদি কিছু করতাম মুখে খই ফুটত ওই মানুষটার। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতেছি কাহিনি আসলেই সত্যি। ” যার বিয়ে তার খবর নাই পাড়া পড়শীর ঘুম নাই “। ভাইয়ার বিয়ে আর আমি গত দুই দিন যাবত ঘুম ছাড়াই বলতে গেলে চলতেছি।আস্তে করে চোখের উপরে আইক্যাপ টেনে দিলাম।
ঠোঁটের উপরে কার যেন আলতো হাতের ছোঁয়া পেলাম। ঘুমের ভিতরেই অনুভব করতেছি। একটু পরেই টের পেলাম পিঠে যেন আলতো ছোঁয়া। কতক্ষন ঘুমিয়েছি বলতে পারি না কিন্তু এসব অনুভব করেই ঘুমের মধ্যে প্রচন্ড জিদ হচ্ছিল। তাড়াতাড়ি উঠে বসে চোখ খুলতে যাব এমন সময় টের পেলাম চোখ খুলতে পারছি না। চোখে উপরে যে আইক্যাপ দেওয়া তাও মনে নাই। আইক্যাপ সরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখি রুম পুরো ফাঁকা সব এলোমেলো আমিই ফ্লোরে পরে ঘুমাচ্ছি। ফোনটা মাথার নিচে থেকে বের করে দেখি সাড়ে দশটা বেজে গেছে। বাহ বেশ ভালই হয়েছে কেউ আমাকে ডাকে নি। একটু শান্তিতে ঘুমাতে তো পেরেছি। কিন্তু সবাই গেল কই। পেটে ক্ষুধায় চোঁ চোঁ করতেছে। উঠে দেখি মিলির টিশার্ট টাইট হয়ে পেটের অনেকটা অংশ দেখা যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি মনে পড়ল এই সুরতে আমি রাসেল ভাইয়ের সামনে শো ডাউন দিয়ে বেড়িয়েছি। ও খোদা আমি যে কেন এমন আলাভোলা হলাম কে জানে। তাড়াতাড়ি উঠে ওয়াশরুমে যেয়ে ড্রেস চেঞ্জ করলাম। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দেখি মিলি এসে হাজির। আমাকে দেখে দুলে দুলে হাসতেছে। ” কি রে অমন ভেটকি মাছের মত দাঁত বের করে আছিস কেন” অন্য দিকে ঘুরে প্রশ্ন করলাম। ” নিপাপু তাড়াতাড়ি চলো ভাবি রান্না করতেছে ” এই বলে মিলির কি হাসি। রুম থেকে বের হয়ে দেখি বড় মামা ছোট মামা আমার দুই খালু ভাইয়ারা রাসেল ভাই সহ মোটামুটি সবাই ওয়েট করতেছে ভাবির নাস্তার জন্য। বড় আপু টেনে আমাকে বসিয়ে দিয়ে বলল” নিপা তাড়াতাড়ি বসে পড় না হয় পরে ভাগে পাবি না ভাবির হাতের রান্না “। আমি বড় আপু মানহা আপু তিন জনে ডাইনিং রুমের এক সাইড দিয়ে বসে আছি। তিন খালাও আমাদের পাশে। মোটামুটি ডাইনিং রুমে মানুষ গিজগিজ করতেছে। একটা জিনিস খেয়াল করলাম মিলি আর জিমি আস্তে করে কেটে পড়েছে। দুই বান্দরানী তো আকামের প্লানের অভাব নেই তাই হয়ত চলে গেছে৷ রাসেল ভাই একটু পর পর মনে হয় আড়ে আড়ে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। আমি উনার দিকে তাকালেই অন্যদিকে তাকাচ্ছে উনি। নতুন ভাবি ট্রে হাতে নিয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকল। পিছনে বুয়া আর ঝুমু সবার হাতেই ট্রে। উঁকি দিয়ে দেখলাম ভাবি এতক্ষন বসে সেমাই রান্না করেছে আর তা খেতে সবাই লাইন দিয়ে বসে আছে। ভাবি আগেই বলল সবাই এক সাথে খাওয়া শুরু করবে। সবার হাতেই সেমাইয়ের বাটি আর চামচ। সবাইকে দেওয়া হলে ভাবি বলল ” এবার খেয়ে বলেন কেমন হইছে “। সেমাইয়ের আউট লুক দেখে তো মনে হচ্ছে সেই টাইপের ইয়াম্মি হবে। বিসমিল্লাহ বলে যেই মুখে দিলাম টের পেলাম চোখের সামনে যেন সব অন্ধকার হয়ে আসছে। আমার স্বাদ ইন্দ্রিয় বলতে ” ওরে নিপারে আমারে আর নির্যাতন করিস না “। পাশে তাকিয়ে দেখি বড় আপু আর মানহা আপু যেন তব্দা দিয়ে আছে। কোত করে সেমাইটুক পেটে চালান দিলাম। বড় মামা সেমাই চামচ দিয়ে না খেয়ে বাটির কোনায় মুখ দিয়ে খেয়েছিল। সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা তার। চোখ যেন কোঠর থেকে বেরিয়ে আসতেছে। না পারছে গিলতে না পারছে ফেলতে। মুখ ভর্তি সেমাই নিয়ে বসে আছে। মানুষ অল্প শোকে কাতর হয় অধিক শোকে পাথর হয় জয় ভাইয়া যেন তার বউয়ের কর্মকাণ্ড দেখে পাথর হয় গেছে। আমাদের সবার মুখের মানচিত্র দেখে ভাবি মনে হয় কিছু একটা আঁচ করতে পারল। ” কি হইছে? সেমাই ভাল হয় নাই? ” এই বলেই ভাইয়ার দিকে তাকালো। মানুষকে যদি বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে বলা হয় ” এখনি হাসবি না হলে গুলি করব “। তখন সেই অবস্থায় মানুষ যে হাসিটা দেয় সেই রকম একটা হাসি দিয়ে ভাইয়া বলল ” পরী অসাধারণ হইছে রান্না। তুমি তো জানো আমার পেট খারাপ। এখন দুধের জিনিস ডাক্তার খাইতে মানা করছে। তুমি অন্যদের খাওয়াও। আমি এই আসছি ওয়াশরুম থেকে ” এই বলেই ভাইয়া তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। হঠাৎই মনে হল সবার ভেতরে অন্য কিছু এসে ভর করেছে। বড় মামা ছোট মামার এক সাথে কোথায় যেন যাওয়ার কথা মনে পড়ল। রাসেল ভাই শিহাব ভাই সোজা ভাইয়ার পিছু পিছু গেল। তাসিন বড় ভাবির কোলে তারপরও তাসিন নাকি কান্না করতেছে। বড় আপু আর মানহা আপু ওদের বান্ধবীদের বাসায় যাবে। পুরো ডাইনিং ২ মিনিটে ফাঁকা হয়ে গেল। এখন বুঝলাম মিলি আর জিমি কেন আগেই সটকে পড়েছে। সবাই যাওয়ার পরে ডাইনিং রুমে শুধু আমি ভাবি আর ঝুমু। ভাবি হঠাৎই একচামচ সেমাই মুখে দিয়ে ফেলল। মুখে দিয়েই সোজা দৌড় বেসিনের দিকে। ঝুমু আমাকে বলল ” নিপা হইছেটা কি? ” ” বেয়াইন প্রশ্ন না করে খেয়ে দেখো ” পানি খেতে খেতে জবাব দিলাম।ভাবি তার বিদ্ধস্ত চেহারা নিয়ে সামনে এলো। ঝুমু ভাবির দিকে তাকাতেই ভাবি বলল ” সেমাইতে চিনির বদলে লবণ দিয়ে দিয়েছিলাম “।
সকালে নাস্তার ট্রাজিডির পরে খালা আর রিস্ক নিলেন না। দুপুরের রান্না আমার দুই খালা মিলেই সারল। সকালে যেহেতু সেমাই পড়েছে পেটে এক চামচ তাই দুপুরে টেবিলে খাবার দিতেই প্লেট ভর্তি করে ভাত মাংস আর দুই পিস মাছ নিলাম। কারো জন্য অপেক্ষা না করেই খাবার নিয়ে ভাবতেছি কই বসে খাবো। রুমে যেয়ে খেলে যে হারে কথা শোনাবে বড় দুই পন্ডিত তা বলার মত না। তাই খাবার আর আমার মামপটটা নিয়ে সোজা স্টোর রুমে চলে গেলাম। স্টোর রুমে ঢুকেই দরজা আর লাগালাম না হালকা করে ভেজিয়ে দিয়ে খেতে বসলাম। ভাত মেখে যেই এক লোকমা মুখে দেবো ঠিক তখনই দরজা আস্তে করে খুলে গেল। মাথা তুলেই দেখি রাসেল ভাই রুমে ঢুকে রুমের দরজা লক করে দিল। আমি তাড়াতাড়ি উঠতে যাব এমন সময় চোখ গরম করে তাকালো। তাতে যেন আমি আরো কুঁকড়ে গেলাম। এসে সোজা আমার সামনে বসে বলল ” আমার খুব ক্ষুদা লেগেছে। ভাত খাওয়ায়ে দে আমারে”। যা রাগ হচ্ছিল আমার বলার মত না। ” টেবিলে খাবার দেওয়া আছে ওখান থেকে এনে খাইলে কি হয় ” এই বলেই আমি মাছের কাঁটা বাছায় মন দিলাম। ” কি হয় না হয় পরের কথা খাওয়ায়ে দিতে বলেছি খাওয়ায়ে দিবি না হলে খবর আছে ” এটুকু বলেই আমার দিকে তাকালো সে। আগে ছিল সামনে বসা এর একটু পরে উঠে এসে ঠিক আমার পাশে বসল। আমি তার মুখে ভাত তুলে তুলে দিচ্ছি সে দিব্বি খাচ্ছে আর ফোনে গেইম খেলছে। আল্লাহর দুনিয়ায় শান্তি কারে বলে কেউ যেন এসে এই লোকটার কাছ থেকে শেখে। তবে একটা জিনিস কেন জানিনা এক অন্য রকম ভাল লাগা কাজ করছিল
মনে হচ্ছিল এই মূহুর্তে যেন আটকে যায়।আমি যেন উনার পাশে আরো কিছুক্ষন বসে থাকতে পারি। ভাত শেষ হওয়ার পরে বুঝলাম এত ভাত আমার একার পক্ষে খাওয়া কখনও পসিবল হত না।দুই জনে পেট ভরে খেয়েছি। আমি যখন হাত ধুয়ে উঠলাম তখন আমার দিকে তাকিয়ে রাসেল ভাই বলল ” মুখ ধুইয়ে দে তাড়াতাড়ি “। উফফ এই লোকটা এত জ্বালাইতে পারে আমারে। মুখ ধুয়ে দেওয়ার পর যখন চলে যাচ্ছিলাম তখন পিছন থেকে ওড়না টেনে ধরে। পেছনে ঘুরে দেখি উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে আমার পেছনে। আমার ওড়না দিয়ে মুখ মুছে বলল ” আমি ধন্যবাদ দিতে পারি না। অন্য কোন দিন আসিস তোকে ভাত খাওয়ায়ে দিয়ে হিসাব ফিট্টুস করে দেবো’। এই বলেই লক খুলে রুমে থেকে বেরিয়ে গেল। মানুষটা কেমন জানি একটা পিশাচ টাইপের। ধুর ছাই কোন যে পদের কে জানে। এমনি দেখলে মনে হয় ভাজা মাছ উলটে খেতে জানে না। আর এখন মনে হয় শয়তানির উপরে এফ সি পি এস করা।
খাওয়া দাওয়ার পরে সব মেয়েরা মোটামুটি আমাদের বেডরুমে যেয়ে বসেছে। নতুন ভাবিরে এক একটা জোক্স শুনাচ্ছে সবাই। হঠাৎ করে মিলি শুরু করল ভাইয়ার হলুদের দিনের কাহিনী। কি করে ভাইয়া বার বার ওয়াশরুম যাচ্ছিল। কেমনে খালা আমাদের রিমান্ডে নিচ্ছিল ব্লা ব্লা। ঠিক তখনই ঝুমু বলে উঠল ” দুলাভাই বিয়ের আগের দিন আপুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। সারারাত ছিল আপু আর দুলাভাই ছাদে”।এই কথা শুনে তো নতুন ভাবি লজ্জায় লালা হয়ে গেল। আর সবাই অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ল। বড় ভাবি খোঁচা দিয়ে বলল ” কি ব্যাপার পরী বিয়ের আগে তো ভালই পলাপলি খেলেছ “। কিন্তু বড় আপু আমার দিকে তাকিয়ে বলল ” কি রে নিপা তুই তো ভাইয়ার রুমে শুয়েছিলি সেদিন। টের পাস নি ভাইয়া যে গেছে “। ” আমি তো ঘুম ছিলাম সারাদিন ছোটাছুটিতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমালে কি কিছু টের পাওয়া যায়? ” এই বলে কোন রকমে কথা কাটালাম। ঠিক তখনই রাসেল ভাইয়ের আগমন। আমি উনাকে দেখে তাড়াতাড়ি বড় আপু আর মানহা আপুর আড়ালে লুকালাম। উনি রুমে ঢুকেই কাকে যেন খুঁজতে আরাম্ভ করলে। হঠাৎই আমার দিকে চোখ পড়তেই বলে উঠল………………..
চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর