#শুরুটা_অন্যরকম
#পর্ব_০১,০২
#অধির_রায়
০১
“আমাকে কি বাজারের মেয়ে মনে হয় আপনার? যে আপনার সাথে এক মাস রাত কাটাবো৷” নিয়তি বিদ্বেষের ভাব নিয়ে কাগজটি টেবিলে নিক্ষেপ করে বলে উঠে।
— সোফায় বসতে বসতে নির্বণ বলে উঠে, ” অ্যাজ ইউর ইউশ৷ তোমার ইচ্ছা৷ তুমি যদি আমার শর্তে রাজি হও তাহলে তোমার বাবা এই যাত্রায় বেঁচে যাবে।”
— করুণ স্বরে বলে উঠে, ” স্যার আপনি কি আমার দুর্বলতার সুযোগ নিতে চাইছেন? আমি আপনার কাছে নিজেকে সুপে দিব! ”
— মিস নিয়তি তুমি হয়তো ভুল ভাবছো৷ আমি এমন কোন কথা বলি নি৷ আমার শর্তটা ঠিকভাবে পড়ে দেখো?
— আমি কি পড়ে দেখবো? সেখানে লেখা আছে এক মাস আপনার সাথে থাকতে হবে। আপনি যা বলবেন তাই করতে হবে। এক মাসের জন্য আপনি আমার হাসবেন্ড হবেন৷
— রাইট আমি যা বলবো তাই করতে হবে। আর হ্যাঁ আমি কখনো হাসবেন্ডের দাবী নিয়ে তোমার সামনে আসবো না৷ জাস্ট অভিনয়।
— হতদন্ত হয়ে বলে উঠে, ” আপনি কি বলতে চান? ”
— আমি বিয়ের কোন বন্ধন মানি না৷ আমি বিয়ের কোন বন্ধনে নিজেকে জড়াতে চাই না।
— তাহলে কেন আমাকে এক মাস আপনার ওয়াইফের অভিনয় করতে বলছেন?
— সেটা তোমার না জানলেও হবে৷ তোমার হাতে দুইটা সুযোগ আছে। এক আমাকে বিয়ে করা। দুই আমার সাথে এক বিছানায় রাত কাটানো। যদি বিয়ে কর তাহলে তোমাকে স্পর্শও করে দেখবো না৷ সিদ্ধান্ত তোমার৷
নির্বণ কথাগুলো বলে চলে যেতে নিলেই নিয়তি পিছন থেকে নির্বণকে ডাক দেয়৷ নিয়তির ডাক শুনে নির্বণ দাঁড়িয়ে যায়৷
— নিয়তি হাত কাচুমাচু করে বলে উঠে, ” স্যার আমি আপনার চুক্তি নামায় সাইন করতে রাজি। কিন্তু আমারও কিছু শর্ত আছে?
— নির্বণ প্যান্টের পকেটে হাত গুছে, ” কি শর্ত মিস নিয়তি?” তোমার শর্তটাও শুনি।
— আমার শর্ত হলো আমাকে দিনে দু’ঘন্টা সময় দিতে হবে। আমি এই দুই ঘন্টা আপনার কোন কথা শুনবো না৷ দুই ঘন্টা আমি আমার বাবাকে সময় দিব৷ কারণ তিনি…
— নিয়তিকে থামিয়ে দিয়ে, “ব্যাস আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি৷ তোমার কাছ থেকে আমি দুই ঘন্টা কেঁড়ে নিব না৷ চুক্তিনামায় সাইন করে তোমার বাবার চিকিৎসার টাকা নিয়ে যাও৷ ”
নিয়তি চুক্তিনামায় সাইন করে দেয়৷ সাইন করার সাথে সাথে নির্বণ চুক্তিনামাটা এক টানে নিয়ে নেয়৷ এমন ব্যবহারে নিয়তি অনেকটা ভয় পেয়ে যায়৷ নিয়তি ধরে নেয় নির্বণ তার বাবার খরচ দিবে না৷
— নিয়তি নরম স্বরে বলে উঠে, ” স্যার টাকা দেন প্লিজ! টাকা দিলে আমার বাবার অপারেশন হবে৷”
— নির্বণ চেয়ারে বসতে বসতে, ” ক্যাশ চাই নাকি ব্যাংক চেক।”
— “এই মুহুর্তে আমার ক্যাশ লাগবে।” আতঙ্কিত হয়ে বলে উঠে।
— নির্বণ এক লক্ষ টাকা নিয়তির সামনে ছুঁড়ে মারে। নিয়তি অন্য কোন সময় হলে এই টাকা নিত না৷ নিয়তি নিরুপায় হয়ে টাকাগুলো তুলে নেয়।
— এখানে এক লক্ষ টাকা আছে৷ কাল এক লক্ষ পেয়ে যাবে। আশা করি “এক লক্ষ টাকা দিয়ে তোমার বাবার অপারেশন হয়ে যাবে।” কাল যখন আমার সাথে আমার বউ হিসেবে আমার বাড়িতে প্রবেশ করবে ঠিক তখন তোমাকে এক লক্ষ টাকা দিয়ে দিব৷
— নিয়তি চোখের জল মুছে বলে উঠে, ” ওকে স্যার। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার এই ঋণ আমি কোনদিন ভুলবো না৷ ”
নিয়তি টাকা নিয়ে হসপিটালে চলে আসে৷ টাকা প্রি মেন্ট করার পর তার বাবার কিডনির অপারেশন শুরু করে দেয়৷
নিয়তি বাবার কিডনিতে চুনাপাথর ধরা দেয়। যার ফলে নিয়তির বাবা ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিয়তি তার বাবার জন্য অনেক চেষ্টা করে। মেডিসিন খাওয়ানোর মাধ্যমে কমেনি। বরং পাথরগুলো বৃদ্ধি পেয়েছে। নিয়তির বাবার অবস্থা বর্তমানে এমন অবস্থায় পৌঁছে গেছে যে, “অপারেশন না করলে নিয়তির বাবা মারা যাবে ৷” সে জন্য নিয়তি এমন বাজে চুক্তি নামায় সাইন করতে বাদ্য হয়েছে।
নিয়তির পৃথিবী বলতে নিয়তির বাবা৷ নিয়তির জন্মের ২ বছর পর নিয়তির মা নিয়তিকে ছেড়ে চলে যান৷ মা চলে যাওয়ার পর বাবাই নিয়তির সমস্ত দায়িত্ব নেন৷ দ্বিতীয় বিয়ে করেননি নিয়তির অবহেলা হতে পারে বলে। আজ দিন এসেছে নিয়তির তার প্রতিদান দেওয়ার৷ নিয়তি নিজের সর্বত্র দিয়ে নিজের বাবাকে বাঁচাতে চায়৷
______
নির্বণ অফিসের কাজ শেষ করে বাড়িতে পৌঁছে যায়।ফ্রেশ হয়ে নির্বণ তার প্যারালাইছিস মায়ের সাথে দেখা করতে যায়৷ নির্বণের মা হার্ট অ্যাটাক থেকে প্যারালাইছিস হয়৷ নির্বণের মায়ের অঙ্গ প্রতঙ্গের এক সাইট কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে৷
নির্বণ তার মায়ের মাথার পাশে বসে মাথায় হাত রাখতেই নির্বণের মা চোখ মেলে তাকায়৷ নির্বণকে দেখে ছোট বাচ্চার মতো মুখে ফুটে মিষ্টি হাসি।
— নির্বণ তুমি অফিস থেকে কখন ফিরলে? দুপুরে তুমি খাওনি৷ তোমার মুখটা শুকনো শুকনো লাগছে কেন?
— মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ” প্লিজ মা উত্তেজিত হবে না৷ আমি দুপুরে খেয়েছি৷ আর আমার মুখ কই শুকনো লাগছে। আমি তো একদম ভালো আছি৷”
— নির্বণের মা মুখ গোমড়া করে বলে উঠে, ” আমি যখন থাকবো না তখন দেখবি কেউ তোকে এসব কথা বলবে না৷ আর তো মাত্র ২৮ দিন বেঁচে থাকবো৷ প্লিজ একটা বউ নিয়ে আয় না৷ আমি আমার চোখের দেখা দেখে যেতে পারব না৷”
— মা তুমি সব সময় ইমোশনাল কথা কেন বল? তোমার কিছু হবে না। আমি তোমার কোন ক্ষতি হতে দিব না৷ তোমাকে আমি বিদেশের বড় ডক্টরের কাছে নিয়ে যাব৷
— আরে বোকা ছেলে আমাকে নিয়ে ভাবা বন্ধ কর। আমার জন্য একটা লাল টুকটুকে বউমা এনে দাও। আমি সুস্থ হয়ে যাব৷
— বুকের মাঝে কষ্ট চেপে ধরে দীর্ঘ একটা শ্বাস ছেড়ে বলে উঠে, ” মা কাল তোমার জন্য একটা লাল টুকটুকে বউ নিয়ে আসবো৷ ”
— মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলে উঠে, ” সত্যি তুমি কাল বিয়ে করবে৷ কিন্তু একদিনে কিভাবে সম্ভব? ”
— ডোন্ট ওরি মা৷ আমার বান্ধবী বিয়েতে রাজি হয়েছে৷ তাকে বলেছি দেশের অবস্থা ভালো না আমরা বরং মন্দিরে বিয়ে করে নিব৷ সে আমার কথামতো রাজি হয়ে গেছে। কাল সকালে আমরা বিয়ে করব৷
— আমি তোমাদের আশীর্বাদ করি তোমরা সব সময় সুখী থাকো৷ সৃষ্টি কর্তা তোমাদের সব আশা পূর্ণ করুক।
— মা এখন প্লিজ ঘুমিয়ে পড়। আর কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করবে না৷ আমি আবার এসে যদি দেখতে পাই তুমি ঘুম আসোনি তাহলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে৷ এই আমি বলে রাখলাম।
— আচ্ছা বাবা৷ আর কোন চিন্তা করব না৷ তুমিও খেয়ে শুয়ে পড়৷ কাল তো তোমার অনেক কাজ৷
— হুম মা৷
নির্বণ তার মায়ের গায়ে কম্বল দিয়ে রুমের বাহিরে এসে কেঁদে ফেলে৷ মায়ের সামনে বুকের উপর পাথর রেখে নিজের কষ্ট গুলো লুকিয়ে রেখেছে।
— চোখের জল মুছে মনে মনে বলে উঠে, ” মা পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও৷ আমি তোমাকে অনেক মিথ্যা করা বলছি৷ ” আমি তোমার ভালোর জন্যই মিথ্যা কথা বলছি৷
_________
পরের দিন নির্বণ নিয়তিকে বউ সাজিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। নির্বণের কথামতো নিয়তি বাড়ির ভিতরে পা রাখতেই বাকি এক লক্ষ টাকা হাতে ধরিয়ে দেয়৷ নিয়তিকে নিজের রুমে নিয়ে যায়৷
— নির্বণ রুমের দরজা বন্ধ করে “মিস নিয়তি আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনবে। ”
— দরজা বন্ধ করাতে নিয়তি ভয় পেয়ে যায়৷ শুকনো গলায় ভয়ে ভয়ে বলে উঠে, ” আপনি কি বলতে চান? এভাবে দরজা বন্ধ করলেন কেন?”
— কোন ভয় নেই৷ আমি তোমার উপর হামলা করব না৷ শর্তগুলো হলো –
১.আমাকে স্যার ডাকা বন্ধ করতে হবে৷
২. আমার মা প্যারালাইছিস রোগী। তার উপর হার্টের রোগী৷ ডাক্তার বলে দিয়েছেন আর মাত্র ২৮ দিন বাঁচবেন । অলরেডি একদিন চলে গেছে। ২৭ দিন আমার মায়ের সামনে এমনভাবে অভিনয় করবে যেন মা মনে করে তুমি আমার সত্যিকারের বিবাহিত স্ত্রী।
৩.তুমি যখন বাহিরে যাবে তখন কোন সার্ভেন্টকে মার কাছে রেখে যাবে৷
— নিয়তি মাথা নিচু করে, ” ওকে স্যার৷ আপনি যেমনটা বলবেন ঠিক তেমনটাই হবে৷ আমি আমার সর্বত্র দিয়ে চেষ্টা করব৷ ”
— চল মার সাথে দেখা করে আসি৷
নির্বণ নিয়তির হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে তার মার রুমে। এই প্রথম নির্বণ নিয়তির হাত ধরে৷ নিয়তির কেমন জানি একটা একটা বিরক্ত লাগা অনুভব করছে। আবার কোথাও একটা ভালো লাগা কাজ করছে৷
— নিয়তি নির্বণের মাকে সালাম করে নির্বণের মায়ের পাশে দাঁড়ায়৷ নির্বণ চোখের ইশারায় তার মায়ের পাশে বসতে বলে। নির্বণের চোখের ইশারা বুঝতে পেয়ে নিয়তি তার মায়ের পাশে বসে।
— মা আমি তোমাকে সব সময় আশীর্বাদ করি তুমি সুখী হয়৷ তুমি আমার সোনা মা৷
— সোনা মা ডাকটা শুনে নিয়তি কেঁদে ফেলে৷ নিয়তি কান্না করে বলে উঠে, ” মা আপনি আমাকে কি বললেন?”
— নির্বণের মা কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে, ” কেন? আমি তোমাকে সুখী হওয়ার জন্য আশীর্বাদ করলাম৷ ”
— তারপর আমাকে কি মা বলে ডাকলেন?
— সোনা মা বলে ডেকেছি৷
— প্লিজ আমাকে আর একবার সোনা মা বলে ডাকেন!
— আমার সোনা মা৷
নিয়তি নির্বণের মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে বলে উঠে, ” জানেন মা৷ বাবা বলেছিল আমার মাও আমাকে সোনা মা বলে ডাকত৷ আজ তিনি বেঁচে নেই৷ আমাকে সোনা মা বলে ডাকত আমি জানতাম না ঠিক৷ বাবা সব সময় বলত মাকে আমাকে সোনা মা বলে ডাকত৷ ”
নির্বণের মা নিয়তির মাথায় এক হাত রেখে ভালোবাসার পরশ দিয়ে বলে উঠে, ” আজ থেকে আমিই তো তোমার মা৷ আমি তোমাকে সোনা মা বলেই ডাকব৷ ”
— নির্বণ বির বির করে বলে উঠে, ” এ তো দেখছি নাটকের মহারানী তুফান মে। ডিস্ট্রিক্টিং এত নাটক ভালো লাগে না৷ নির্বণ রুম থেকে নিজের রুমে চলে যায়৷
— নিয়তি চেখের জল মুছে বলে উঠে, ” মা আজ থেকে আপনার সব দায়িত্ব আমার৷ আপনাকে আমি সুস্থ করে তুলব। আপনি আবার আগের মতো হাঁটতে পারবেন৷ ”
— নির্বণের মা মুচকি হেঁসে, ” মা আমাকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখিও না৷ আমার আয়ু আর বেশি দিন নেই৷ ”
— “রাখে হরি মারে কে” আপনার কিছু হবে না৷ ডক্টররা অনেক সময় তো ভুল করে। ডক্টরদের সব কথা সব সময় সত্যি হয় না৷ সৃষ্টি কর্তা চাইলে সব হবে৷
নিয়তি ভালোবাসা পেয়ে নির্বণের মায়ের চোখে জল এসে পড়ে। নির্বণের জন্য এমন একটা বউ চেয়েছিল নির্বণের মা৷
— টলমল চোখে “তোমার নাম কি মা? ”
— আমার নাম নিয়তি৷
— নিয়তি আমার আলমারিতে একটা বক্স আছে। একটু কষ্ট করে এনে দাও৷
নিয়তি আলমারি খুলে নির্বণের মায়ের কথা মতো বক্সটা নিয়ে আসে৷ তার পর নির্বণের মা যা বলে নিয়তি উত্তর দেওয়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না৷
চলবে…..
#শুরুটা_অন্যরকম
#পর্ব_০২
#অধির_রায়
নিয়তি আলমারি খুলে নির্বণের মায়ের কথা মতো বক্সটা নিয়ে আসে৷ তার পর নির্বণের মা যা বলে নিয়তি উত্তর দেওয়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না৷
— নির্বণের মা কোমল কন্ঠে বলে উঠেন, ” নিয়তি এই বক্সে একটা পুরাতন ডিজাইনে গহনা আছে। সেটা আজ থেকে তোমার৷ ওই গহনাটা আমার শ্বাশুড়ি মা আমাকে দিয়েছিলেন। উনার মুখ থেকে শুনা ওই গহনা উনাকে উনার শ্বাশুড়ি মা দিয়েছেন৷ এই গহনা আমাদের বাড়ির বউদের ঐতিহ্য ও সম্মান বহন করে। আজ থেকে তুমি এই বাড়ির বউ। তাই গহনাটা আজ থেকে তোমার। ”
নিয়তি কি বলবে বুঝতে পারছে না? নিয়তি তো এই বাড়ির বউ নয়৷ কিভাবে এই বাড়ির ঐতিহ্য বহন করবে? ড্যাবড্যাব করে হাত কাচুমাচু করছে। নিয়তির এমন অবস্থা দেখে নির্বণের মা হেঁসে উঠেন।
— “আরে বোকা মেয়ে ভাবার কিছু নেই৷ তোমাকে আজ থেকে এই বাড়ির দায়িত্ব বহন করতে হবে৷”
— ইতস্ততভাবে বলে উঠে “আসলে মা… আমি এই গহনা নিয়ে কি করব? আপনি বরং এই গহনাটি আপনার কাছে রেখে দেন। আমি এই গহনার ভার বইতে পারব না৷”
— নিয়তির হাতে হাত রেখে, ” আমাকে কি তোমার নিজের মা মনে হয় না? ভেবে নাও আমি তোমার নিজের মা৷ তোমার মা তোমাকে কিছু দিলে তুমি কি ফিরিয়ে দিতে পারবে?”
— নিয়তি টলমল চোখে বলে উঠে, ” ওকে মা৷ আমি এই গহনা সাদরে গ্রহণ করলাম। এখন আপনি বলেন কি খাবেন? আজ থেকে আপনার সব দায়িত্ব আমার।”
মনে মনে বলে উঠে, ” স্যারের সাথে এই গহনা নিয়ে কথা বলতে হবে। আমি চাইনা কাউকে কষ্ট দিতে। ”
— তুমি যা পছন্দ কর আজ থেকে আমি তাই খাবো। তবে বাঙালি খাবার হতে হবে৷ আমি বাঙালি খাবার বেশি লাইক করি৷
— নিয়তি হাসিমুখে বলে উঠে, ” আপনি রেস্ট নেন৷ আমি আপনার জন্য সব ব্যবস্থা করব৷”
নিয়তি নির্বণের মায়ের গায়ে কম্বল টেনে দেয়। এয়ারকন্ডিশনের পাওয়ার একটু বাড়িয়ে দিয়ে নির্বণের রুমে আসে গহনা নিয়ে৷
— নির্বণ অফিসের কাজ করছিল। নিয়তির উপস্থিতি বুঝতে পেয়ে তার দিকে না তাকিয়েই বলে উঠে, ” মার সামনে ভালোভাবে অভিনয় করার জন্য ধন্যবাদ। ”
— নিয়তি অপ্রস্তুতভাবে বলে উঠে, ” কিসের অভিনয়? আমি কোন অভিনয় করিনি৷ যা করেছি সব সত্য ছিল। ”
নিয়তির এমন কথা শুনে নির্বণ নিয়তির সামনে এসে দাঁড়ায়৷ নির্বণের চোখ দেখে নিয়তি বুঝতে পারে সে ভুল বলে ফেলেছে।
— নির্বণ চোখ পাকিয়ে বলে উঠে, ” তো মিস নিয়তি৷ তুমি এখন নিজেকে মিসেস ভাবা শুরু করে দিয়েছো। তুমি ভালো করেই জানো তুমি এখানে অভিনয় করতে এসেছো। ভুলেও আমার দিকে পা বাড়ানোর চেষ্টা করবে না৷”
— নিয়তি ভয়ে ভয়ে বলে উঠে, ” আসলে স্যার… আমি কোনদিন মায়ের ভালোবাসা পাইনি সেজন্য ভুল করে বলে ফেলেছি৷ আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই আপনার প্রতি৷”
— এই কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে রাখতে পারলেই তোমার জন্য ভালো। আমি চাইনা তুমি আমার জীবনে আসো। ইভেন বিয়ের বন্ধনে আমি বাঁধা পড়তে চাই না৷”
নির্বণ নিয়তির হাতে একটা চুক্তিনামার একটা কপি দিয়ে চলে যেতে নিলেই নিয়তি নির্বণের সামনে এসে দাঁড়ায়।
— নির্বণ ব্রো কুঁচকে বলে উঠে, “আমার পথ আটকানোর মানে কি?”
— আমাকে চুক্তিনামা দিয়ে কিছু বুঝাতে হবে না৷ আমি কখনো নিজের লিমিট ক্রস করব না৷ সেজন্য আমি আপনার কাছে এসেছি৷
— কি বলতে চাও তুমি?
— নিয়তি গহনার বক্সটা নির্বণের হাতে দিয়ে বলে উঠে, ” এই গহনা আপনার মা আমাকে দিয়েছেন৷ গহনাটা এই বাড়ির বউদের সম্মান বহন করে৷ আমি নিতে চাইনি। তিনি জোর করে দিয়েছেন৷ উনার মনে কষ্ট না দেওয়ার জন্য নিয়েছি৷”
— তো.. এখন এই গহনা আমি পড়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াবো। নিজের কাছে রাখো। গহনার কোন অভাব নেই৷ এটা পছন্দ না হলে গহনা আমি কিনে এনে দিব৷
— আমি সে কথা বলতে চাইনি৷ আমি এই গহনা নিতে পারব না৷ গহনাটি আপনার কাছে রেখে দেন৷ আমি এই বাড়ির বউ নয়৷
— চৌধুরী বাড়ির কেউ কাউকে কিছু দান করলে সেটা ফিরিয়ে নেয় না৷ রেখে দাও তোমার কাছে। তুমি বুঝাতে চাইছো গহনার প্রতি তোমার কোন লোভ নেই৷ গহনার দিকে মন না দিয়ে আমার মায়ের দিকে মন দাও৷
কথাটি বলেই নির্বণ চলে যায়। নিয়তি এই গহনা নিয়ে কি করবে? কিছু না ভেবে গহনাটি নির্বণের আলমারিতে রেখে দেয়৷ গহনা রেখে রুম থেকে বের হতে নিলেই নির্বণের সাথে ধাক্কা খায় নিয়তি৷ ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলেই নির্বণ নিয়তিকে ধরে ফেলে।
নিয়তি কোমরে নির্বণের ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে কিছুটা কেঁপে উঠে। পড়ে যাওয়ার ভয়ে নির্বণের শার্ট চেপে ধরে। নির্বণ নিয়তিকে দাঁড় করিয়ে দেয়।
— নির্বণ চোখে মুখে রাগ করে নিয়ে বলে উঠে, ” ডিজগাস্টিং। চোখ হাতে নিয়ে ঘুর। দেখতে পাওনা।দিলে তো আমার ড্রেস টা নষ্ট করে দিলে।”
— বিনয় স্বরে বলে উঠে, ” এখানে আমার কোন দোষ নেই৷ আপনি অপজিট থেকে আসছেন আমি কিভাবে জানবো? আমি তো রুম থেকে বের হতে নিচ্ছি৷”
— হয়েছে আর ন্যাকা সাজতে হবে না৷ আমি অফিসে যাচ্ছি৷ মিটিং আছে। আর হ্যাঁ তোমাকে এক মাস অফিসে যেতে হবে না৷ এই এক মাসের বেতন আমি দিয়ে দিব৷ তোমার পরিবর্তে আমার নতুন পিএ কাজ করবে।
নিয়তির কোন জবাব না শুনে হন হন করে নির্বণ অফিসে চলে যায়। নিয়তি দাঁড়িয়ে থেকে সেই ধাক্কা লাগার কল্পনা করতে থাকে। কিভাবে নিয়তিকে প্রটেক্ট করল?
__________
নিয়তি নির্বণের মাকে খাইয়ে দিয়ে বলে উঠে, ” মা আজ থেকে আপনাকে আমার কথা মেনে চলতে হবে।”
— নিয়তির দিকে চোখের মনি ঘুরিয়ে, ” আমি আমার সোনা মার কথা কি ফেলতে পারি৷ বলেন সোনা মা আমাকে কি করতে হবে?”
— কিছু করতে হবে না৷ তবে আপনাকে চেষ্টা করতে হবে৷ মনে সাহস জুগাতে হবে৷ আমি আগে একটা ফিজিওথেরাপি হসপিটালে কাজ করতাম। সেখান থেকে আমার এই অভিজ্ঞতা৷ আপনি যদি এইভাবে শুয়ে থাকেন তাহলে আমাকে সুস্থ করা সম্ভব নয়৷
নিয়তির কথা শুনে নির্বণের মায়ের চোখে জল এসে পড়ে৷ প্যারালাইসিসের পর নির্বণের মা এক ভাবে বিছানায় শুয়ে আছে৷ সার্ভেন্টরা নির্বণের মায়ের দেখাশুনা করত৷ প্রকৃতি ডাক দিলে সার্ভেন্টরা এসে সাহায্য করে।
— চোখের জল মুছে দিয়ে, ” না মা কান্না করবেন না৷ চোখের জল আপনাকে দুর্বল করে তুলবে। এখন থেকে চোখে জল নয়৷ মনে সাহস জোগাতে হবে। ”
— মুচকি হেঁসে, ” কিন্তু মা ফিজিওথেরাপি দিয়ে আমার কোন কাজ নেই৷ আর তো মাত্র ২৭ টা দিন আছি এই দুনিয়ায়।”
— ক্ষেপে বলে উঠে, ” একদম এমন কথা বলবেন না৷ আপনাকে আমি বলেছি না “রাখে হরি মারে কে?” আপনার কিছু হবে না৷”
— আমার সোনা মা আমার কাছে থাকলে আমার কিছু হবে না৷ তুমি তো মা দুর্গা।
— হয়েছে আর আমাকে কিছু বলতে হবে না৷ এখন আপনার কাজ। আপনাকে এখন উঠে বসতে হবে৷
— অবাক চোখে তাকিয়ে, ” তুমি কি ঠিক আছো? আমি কি করে উঠে বসবো। তুমি ভালো করেই জানো আমি উঠে বসতে পারব না৷”
— চোখ পাকিয়ে বলে উঠে, ” আমি কোন কথা শুনতে চাইনা। আমার কথামতো কাজ করতে হবে। এটাই আমার লাস্ট কথা৷” আমি সময় নষ্ট করতে চাই না৷ আজ থেকেই আপনার টেইনিং শুরু।
— ওকে আমাকে সাহায্য করতে হবে তো।
নিয়তি ধীরে ধীরে নির্বণের মাকে তুলে বসায়৷ নির্বণের মা ব্যথায় কেঁদে ফেলে। উঠতে খুব কষ্ট হচ্ছে। উঠতে না পেরে নিয়তির হাত চেপে ধরে। নিয়তি হাতে প্রচুর ব্যথা পাচ্ছে। নিয়তির সেদিকে কোন খেয়াল নেই৷ নিয়তির উদ্দেশ্য হলো সুস্থ করা৷ বহু কষ্টের পর নিয়তি তার কাছে সফল হয়৷
— নিয়তি চোখের জল মুছে দিয়ে, ” মা আপনাকে আমি বলেছি চোখে জল আনবেন না৷ চোখের জল মানুষকে দুর্বল করে তুলে।”
— মা আমি আর পারছি না৷ প্লিজ আমাকে আজকের মতো ছেড়ে দাও। একদিনে এতটাই আমার জন্য অনেক কষ্টকর।
— ছেড়ে দিতে পারি৷ তবে আপনাকে এভাবে দুই ঘন্টা বসে থাকতে হবে। আমার দুই ঘন্টা বাহিরে কাজ আছে। কাজ শেষ করেই ফিরে আসবো।
— সোনা মা তুমি নতুন বউ। এমন সময় বাহিরে যাওয়া ঠিক হবে না৷
— মা ডোন্ট ওরি। আমার কিছু হবে না৷ মা আমি একজন বউ হওয়ার সমস্ত দায়িত্ব পালন করব৷ তেমনি আমাকেও বাহিরে দুই ঘন্টা সময় দিতে হবে। আমি যদি ঘরে বসে থাকি তাহলে তো কাজ আটকে থাকবে।
— মাথায় হাত রেখে, ” আমি তোমাকে আশীর্বাদ করছি তুমি ঘরে বাহিরে দু’টোতেই পারদর্শী হও। অল দ্যা বেস্ট।
নিয়তি নির্বণের মায়ের কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। একজন সার্ভেন্টকে নির্বণের মায়ের রুমে রেখে যায়।
__________
নির্বণ ডাইনিং রুমে আসতেই নিয়তি দৌড়ে নির্বণের কাছে যায়৷ নিয়তির এমন ব্যবহারে নির্বণ কিছুটা বোকা বনে যায়৷
— মুচকি হেঁসে আনন্দের সাথে বলে উঠে, ” স্যার আপনার জন্য একটা সুখবর আছে। ”
— চোখ ছোট করে, ” আমি বলেছিলাম বাড়িতে আমাকে স্যার বলে সম্মোধন করবে না৷ ”
— নিচু গলায় বলে উঠে “সরি! আসলে একটু সময় লাগবে সব কিছু মানিয়ে নিতে।”
— তুফান মে এখন বল, কি বলতে চাও? আমার জন্য কি সুখবর আছে?
— সেজন্য আপনাকে চোখ বন্ধ করতে হবে৷
— হোয়াট? আমি চোখ বন্ধ করব কেন?
— হাত কাচুমাচু করে, ” আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন? আপনি নিজের চোখে দেখতে পাবেন৷ ”
— ওকে। আমি চোখ বন্ধ করছি৷
নির্বণ চোখ বন্ধ করতেই নিয়তি নির্বণের চোখ চেপে ধরে। এতে নির্বণ খুব রেগে যায়৷
— হোয়াট দ্যা হ্যাল। তোমার সাহস কি করে হলো আমার চোখ ধরার?
— সরি! আমি আমার স্বার্থের জন্য কিছু করছি না৷ যা করছি আপনার জন্য৷ তাই নিজের রাগটা একটু কন্ট্রোল করেন।
নির্বণের চোখ ছেড়ে দিতেই নির্বণের চোখে জল এসে পড়ে। নির্বণ খুশি হয়ে নিয়তিকে জড়িয়ে ধরে।
চলবে…..